বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

গদ্দানের ময়দান

গদ্দানের ময়দান

ঝিলিক মুখার্জী গোস্বামী


   সন্ধ্যা বেলায় গ্রামের দিকে বড্ড লোডশেডিং হয়। গরমে ঘেমে নেয়ে পড়াশোনার পাততাড়ি গুটিয়ে সবাই বাড়ির ছাদে চলে যাই। প্রতিদিনের মতো সেদিন সন্ধ্যায় লোডশেডিং হওয়ার ফলে অন্ধকার যেন ঝপ করে নেমে এলো। মাদুর, হ্যারিকেন নিয়ে সোজা ছাদে। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠা। স্বাভাবিক ভাবেই লোক সংখ্যা একটু বেশী। সেদিনের সন্ধ্যেটা আমরা অন্যভাবে কাটিয়েছিলাম।


  কর্মসূত্রে আমার এক কাকা বিদেশে থাকেন। কাকা, ছুটিতে বাড়ি এলে আমাদের খুবই আনন্দ হয়। কাকা এলেই গল্পের আসর বসে আমাদের। সেদিন যখন ঝুপ করে আঁধার নেমে এলো, কাকার কাছে সবাই আবদার করে বসলাম গল্প শোনার। আমাদের আবার ভুতের গল্প ছাড়া আসর ঠিক জমে না। ছাদের মাঝখানে মাদুর বিছিয়ে আমাদের আসরের আয়োজন করা চলছে, কাকিমা এক ধামা মুড়ি মেখে নিয়ে হাজির। তেলেভাজার তেলচিটে গন্ধ ভেসে আসছে মুড়ির ধামা থেকে। আমরা সমবেত ভাবে শুরু করলাম,

- "এবার গল্প বলো।"

আমাদের সমবেত স্বর শুনে, তেলেভাজার তেলো হাত দিয়ে নিজের কালো কুচকুচে গোঁফে তা দিয়ে কাকা  শুরু করল,

-"তোদের আজ একটা সত্যি ঘটনা বলব। শোন।"

আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে একটু এঁচড়ে পাকা বাবাই বলে উঠল,

-"তোমার সবই গুল।"

বাবাইয়ের কথা শুনে, কাকা তাকে এক ধমক দিয়ে গল্পটা শুরু করল।


"আজ থেকে প্রায় একশত বছর আগের কথা বলছি। আমি তখন তোদের মতো ছোট্ট। নীলকান্তমণি বলে একজন খুড়ো ছিলেন। খুড়ো আর খুড়িমা মিলে দু'জনের সংসার। আমরা কিছুজন রোজ সন্ধ্যায় খুড়োর ছিটেবেড়ার ঘরে চলে যেতাম গল্প শুনতে। খুড়োর মুখেই শোনা এই ঘটনা। সেটাই বলব।"

এতটুকু বলে, কাকা একটু থেমে মুখে জাবর কাটতে লাগল। আমাদের উসখুস করা দেখে মুচকি হেসে আবার বলা শুরু করল,


-" তাতারপুর বলে একটা গ্রাম ছিল।"


আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে বললাম, এখনো আছে। আমাদের অঙ্কের মাস্টার মশাই এর বাড়ি ওখানে।

আমাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে হ্যাঁ সূচক ঘাড় নেড়ে কাকা আবার শুরু করল,


-" তৎকালীন তাতারপুর গ্রাম। কয়েকটি বাড়ি নিয়ে একটি ছোট্ট গ্রাাম।সেই গ্রামেই একবার মড়ক লাগল। কলেরা, গুটি বসন্তের প্রকোপে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার উপক্রম। কলেরা হওয়ার কারণটা না হয় ওই নদীর পাড়ে প্রাতঃকৃত সারা এবং পরে ওই জল সব কাজের জন্য ব্যবহার করা। সে কারণে কলেরা হতেই পারে। কিন্তু গুটি বসন্তের কারণ? গ্রামের অন্ধ কুসংস্কারে জর্জরিত মানুষের বিশ্বাস ছিল, এ সবাই মা শীতলার কোপ। তিনি কুপিতা হয়ে এইসব করছেন। মা কে তুষ্ট করলে, তিনি তাঁর সন্তানদের নিশ্চয়ই রক্ষা করবেন। এই ভেবে পুরোদস্তুর ভাবে চলতে লাগল মায়ের পুজোর আয়োজন। বেশ জাঁকজমক ভাবে পুজো সুসম্পন্ন হয়ে গেল। কিন্তু..."


  একটা লম্বা 'কিন্তু' বলে একটু থেমেই পিতলের ঘটি থেকে ঢকঢক আওয়াজ তুলে গলার মধ্যে জল ঢাললো, কাকা। আমরা চোখ বড়ো করে তাকিয়ে আছি কাকার দিকে। উত্তেজনার পারদ চড়ছে। একটু বিরক্ত হয়েই বাবাই বলে উঠল,


-"গল্পের মাঝে এত বিরতি হলে ভাল লাগে না।"


   কাকা বোধহয় আমাদের সবার উত্তেজনা টের পেয়েছিল। ঘটিটা মাদুরের পাশে রেখে আবার শুরু করল,


-" কিন্তু পুজোর পরও গ্রামের মড়ক প্রতিদিন বেড়েই চলল। বাড়ির পর বাড়ি সদস্যদের সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় লুপ্তপ্রায় হতে থাকল। একটা সময় মৃত মানুষের দাহ করার জন্য কাওকে পাওয়া গেল না। তখন বাড়ির জীবিত লোক গুলোই মৃতদেহ গুলোকে সামনের বিশাল ফাঁকা মাঠে ফেলে দিতে লাগল। আকাশে বাতাসে  মৃত মানুষের দেহের পচা গন্ধে ভরে গেছে। মৃতদেহের উপর একচেটিয়া অধিকার জমাতে চিল-শুকুনের ভিড়। হিংস্র পশুরাও পিছিয়ে ছিল না। গোটা গ্রাম ভরে গেল শিয়াল -কুকুরে। একসময় এরকম পরিস্থিতি দেখা দিল, ফাঁকা বাড়ি থেকে শিয়াল-কুকুরে মৃতদেহ গুলো টেনে নিয়ে যেতে লাগল সামনের ফাঁকা ময়দানে। একসময়ের ফাঁকা ময়দান ভরে গেল মৃতদেহের শরীরের অংশে। তখন থেকেই তার নামকরণ হল, 'গদ্দানের ময়দান' নামে।"


কাকার গল্প বলার মাঝেই আমি করুণ স্বরে বলে উঠলাম, মড়কে পুরো গ্রাম মনুষ্যশূণ্য হয়ে গেল?

আমি, বাবাই, বাবু, মুন্না,সোন্টাই সবাই একদম মিয়ানো মুড়ির মতো চুপসে গেলাম। সবাই চুকচুক করে দুঃখ প্রকাশ করলাম।


এরপর কাকা আবার বলতে শুরু করল,

-" তোরা নিশ্চয়ই জানিস? প্রতি একশো বছর অন্তর এরকম এক একটা মহামারী লেগেই থাকে। এই মড়কের ফলে গদ্দানের ময়দান লোকের মুখে ছড়িয়ে পড়ল। শোনা যায়, শিয়াল-কুকুর মৃত মানুষের মাথাগুলো জমির আলের ধারে বেনে গাছের নীচে জমাতে শুরু করে। ওই পথ দিয়ে যাতায়াত প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। রাতের দিকে গদ্দানের ময়দান থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। হাওয়াতে শোনা যায় বাঁশির আওয়াজ। মাথার খুলি গুলো আপনা থেকেই হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। সন্ধ্যার পর থেকে ময়দান থেকে দপদপানি আলোর ঝলক দেখা যায়। একসময় মড়ক বন্ধ হলেও ও পথ দিয়ে যাতায়াত কার্যত বন্ধ হ'ল। এইরকম পরিস্থিতিতে..."


আমাদের গায়ের লোম আস্তে আস্তে খাড়া হতে শুরু করেছে। ছাদের যে জায়গায় আমরা বসেছিলাম, বাঁশের একটা ডগা কখন যে আমাদের দিকে নেমে এসেছে খেয়াল করিনি। হ্যারিকেনের বাতি দপদপানি শুরু করেছে। কানের পাশ দিয়ে সিঁ সিঁ করে হাওয়াটা চলে গেলো, অনুভব করলাম।


কাকার কথায় আমাদের সম্বিত ফিরল।

-" তৎকালীন যুগে সবেধন নীলমণি একজন ব্রাহ্মন ছিল সারা গাঁয়ে। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ... সম্পন্ন হত তাঁর হাত দিয়ে। লিকলিকে চেহারায় ওই ব্রাহ্মন অনায়াসে খান আশি লুচি, কেজি পাঁচেক কাতিলার দই খেতে পারত। একদিন গভীর রাতে, সরবেড়িয়া গ্রাম থেকে বিয়ে দিয়ে ফিরছে। হাতের লন্ঠনের আলোয় পথ বিশেষ দেখা যায় না। অমাবস্যার রাত। মাঝ রাস্তায় এসে কতগুলো মূর্তির সম্মুখীন হল, পুরুতঠাকুর। পুরুতঠাকুরের বয়ানানুযায়ী সেই রাতে নাকি তিনি ভুতের বিয়ে দিয়েছিলেন। গদ্দানের ময়দানে অশ্বত্থ গাছের উপর মাচা বেঁধে ভুতের বিয়ের আয়োজন হয়েছিল। সরবেড়িয়া থেকে তাতারপুর আসার পথে, যে রাস্তা পান্ডব বর্জিত ছিল তিনি সেই রাস্তা ধরেই আসছিলেন বলে তাঁর এই বিপত্তি। ভুতেরা তাকে জোর পূর্বক ময়দানে তুলে নিয়ে যায়। এরকম ও শোনা যায়, বিয়ের কার্য সাধনের জন্য প্রচুরপরিমাণ উপঢৌকন তাঁর প্রাপ্ত হয়। খুশি মনে বাড়ি ফিরে এসে যখন পোঁটলা খুললেন, নজরে এলো একরাশ খলমকুচি।"


কাকার শেষের কথায় আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। গল্প শেষ ভেবে আমরা সবাই উঠতেই যাচ্ছিলাম! কাকার গম্ভীর গলা শুনে আমরা হকচকিয়ে গেলাম। কাকার হঠাৎ পরিবর্তনে আমাদের মেরুদন্ড বেয়ে গরম স্রোত বইয়ে দিল। ছাদের পাশে বাঁশ গাছের আকস্মিক তান্ডবে চমকে উঠলাম। হঠাৎই কাকা...


আমাদের মনে হল আমরা এখন গদ্দানের ময়দানে বসে আছি। চারিদিকে মৃত মানুষের শরীরের অংশ ছড়িয়ে আছে। পচা গন্ধ যুক্ত বাতাস। পায়ের নীচে খুলি গুলো দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমরা পাঁচজন একে অপরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছি। অট্টহাস্যে ছেয়ে গেছে গদ্দানের ময়দান।


****

সেদিনের সেই ঘটনা অতিলৌকিক কিনা! কোনো ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। আমাদের চোখে যখন জলের ঝাপটা পড়ল তখন আমাদের সবার চেতনা ফিরল। কাকার অট্টহাসির ফলে বাড়ির সবাই সেদিন ছাদে জড়ো হয়ে আমাদের চেতনায় ফিরিয়েছিল। চেতনায় ফিরলেও আমারা সবাই ঘোরের মধ্যে ছিলাম। অদ্ভুত সব আচরণ করতাম। যা দেখে বাড়ির লোকজনের কপালে চারটে রেখার দাগ স্পষ্ট অঙ্কিত হয়েছিল। মসজিদ থেকে ওঝা ডেকে এনে আমাদের সবাইকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। ওঝা এসে আমাদের উপর ঝাড়ফুক তুকতাক করে আমাদের শরীরের মধ্যে থাকা ভুতকে তাড়াতে সাহায্য করে। গল্পের মাঝেই তেনারা কখন যে আমাদের শরীরে দখল নিয়ে বসে আমরা কিচ্ছুটি টের পাইনি। 


এরপর থেকে কাকার উপর আদেশ বর্তায়, ভুতের গল্প না শোনানোর। কাকা সমেত আমাদের পাঁচ জনকে চোখে চোখে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কাকার গল্পের আসর বন্ধ প্রায়।


আমি আর বাবাই কিন্তু থেমে নেই। তাতারপুরে অঙ্কের স্যারের কাছে পড়তে গিয়ে কথাটা পাড়ি, স্যারকে। স্যার এর মাথা ভর্তি চুল জানান দেয়, তিনি অনেক অভিজ্ঞতার শিকার। স্যারকে অনুরোধ -উপরোধ করতেই স্যার যা বললেন! আমার আর বাবাঈ এর লোম আরও একবার খাড়া হবার উপক্রম হল। স্যার এর বয়ান পুরো তুলে ধরলাম,


-"তৎকালীন 'গদ্দানের ময়দান' কারণে অকারণে মাঝেমধ্যেই জেগে ওঠে। অতৃপ্ত আত্মার করুণ স্বরে ছেয়ে যায় ময়দানের আকাশ-বাতাস। বিশেষ বিশেষ দিনে ওই রাস্তা আগের মতোই পান্ডব বর্জিত থাকে। এমনকি দিনের বেলায় ও পথ মাড়ানো যায় না। খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার না থাকলে ও পথ কেউ ভুলেও মাড়ায় না। আমাদের সময়ে জেলে পাড়ার এক ছোকরা পাকামি করে ওই পথ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। ভর দুপুরেও সে বেমালুম হারিয়ে গেল। সেদিনের পর থেকে তাকে আর দেখতে পাওয়া যায়নি। হঠাৎ হঠাৎ আলের ধারে বেনে গাছের গোড়ায় খুলির স্তূপ চোখে পড়ে। তাও লোক কথা অনুযায়ী। তাতারপুর থেকে সরবেড়িয়া গ্রামের রাস্তার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। ঝুপ করেই সেখানে অন্ধকার নেমে আসে। গদ্দানের ময়দানের পথ না মাড়ানোই ভাল। "


এত অবধি বলে স্যার থামলেন। প্রশ্নালু চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,


-" তোদের হঠাৎ গদ্দানের ময়দান নিয়ে এত ইন্টারেস্ট কেন?"


স্যার এর প্রশ্ন চিহ্নের সম্মুখে আমি আর বাবাই আমতা আমতা করে সমস্ত ঘটনা স্যার কে বললাম। কিভাবে অজান্তেই আমরা তেনাদের শিকার হয়ছিলাম। সেই সব শুনে স্যার শুধুমাত্র এইটুকু বললেন,


-" গদ্দানের ময়দান এর পথ যেমন ভয়াবহ। ঠিক সেরকম ই ওই ঘটনাও ভয়ঙ্কর। এই গল্প বা ঘটনা যারা যারা শুনেছে তাদের সবাইকে ভুতে ভর করেছে। এই ঘটনা আলোচনা করা মানে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনা।"


সেদিন স্যার এর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর সারা রাস্তা আমি আর বাবাই একটাও কথা বলিনি। দু'জনে চুপচাপ সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে এসেছি। রাস্তায় অনেক গুলো শ্মশান পড়ে। সেগুলো অতিক্রম করতে গিয়েও পড়ন্ত বিকেলে আমরা ঘেমে নেয়ে গিয়েছিলাম। অজান্তেই একটা ভৌতিক ভয় গ্রাস করেছিল আমাদের। স্যার বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকে আমি আর বাবাই ধুম জ্বরে পড়ি। প্রায় সাত দিন অচৈতন্য ছিলাম। এর কারণ ও ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে দুর্বোধ্য। স্যারের বাড়ি থেকেও খবর আসে স্যার এর অসুস্থতার। অঙ্কের টিউশন ছুটি হওয়ার আনন্দ যতটা না আমাদের গ্রাস করল! তার চেয়ে বেশি গ্রাস করল না দেখা, 'গদ্দানের ময়দানের' ভয়।

***

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু