বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

তোমার সাথে একলা হতে চাই

- কিরে প্রদ্যুম্ন আজকাল ছুটির পর অফিস থেকে রোজই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাচ্ছিস। ক্যান্টিনের আড্ডাতেও যাচ্ছিস না। এখন তো আর বৌদি নেই বাড়িতে যে অপেক্ষা করে বসে থাকবে তোর জন্য। কথাটা বলেই জিভ কেটে থেমে যায় অলোক। পাশেই দাঁড়িয়েছিল সুবোধ। চোখ পাকিয়ে তাকালো অলোকের দিকে। অলোক অপরাধীর স্বরে বলে উঠল - সরি রে। আমি দুম করে কিছু না চিন্তা করেই বলে ফেললাম কথাটা।
প্রদ্যুম্ন ব্যাগ গোছাতে গোছাতে খুব শান্ত ভাবেই বলল - তুই তো ঠিকই বলেছিস। এতে মনে করার তো কিছু নেই। সত্যিই তো কেউ নেই বাড়িতে আমার অপেক্ষায় বসে থাকার জন্য। যে ছিল সে বেঁচে থাকতে তার অপেক্ষার অবসান ঘটানোর চেষ্টা কোনদিন করিওনি। তাই হয়ত সে নিজেই নিজের অপেক্ষার ইতি টেনে নিয়েছে। অলোক এগিয়ে আসে প্রদ্যুম্নের কাছে।ওর কাঁধে হাত রেখে বলে -ঐজন্য তো বলছি। একটু আমাদের সাথে সময় কাটা। একাকীত্ব একটু হলেও কমবে। প্রদ্যুম্ন মৃদু হাসে। বলে - জানিস অলোক তখন বাড়িতে মা, বাবা, ভাই সকলে ছিল। তবুও মিনু আমার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকত। আমার সাথে সময় কাটাবে বলে। আমি রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লে, ছুটির দিনে ক্লাবে গিয়ে সময় কাটালে অভিযোগ করত। ঠোঁট ফোলাত। আমি বলতাম - বাড়িতে এত লোক থাকতে তোমার কথা বলার লোকের অভাব। ওদের সাথে সময় কাটে না তোমার ? তখনও বুঝিনি প্রিয় মানুষটিকে কাছে না পেলে হাজার ভিড়েও মানুষ একা হয়ে যায়। মা হতে পারেনি বলে কষ্ট পেত। বড্ড উদার মনের পরিচয় দিতে চেয়েছিলাম তখন। বলেছিলাম - সবাই কী আর মা হতে পারে মিনু ? আমার তোমাকে নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। ওর মন মানত না।বলত কোন অনাথ শিশুকে নিয়ে এসে মানুষ করতে। আমি রাজি হতে পারলাম না। পারলাম না বলতে কখনো - মিনু তোমার মতো সর্ষে ইলিশ কেউ রাঁধতে পারেনা। বলতে পারিনি - চলো মিনু আজ ছাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে গল্পের মেলায় সন্ধ্যে নামিয়ে আনি। কখনও বলতে পারিনি - কষ্ট পেলে আমার বুকে মুখ গুঁজে তুমি বালিশের বদলে আমার জামাটিই না হয় ভেজাও। হালকা হবে।
একটা বাচ্চা পেলে অন্ততঃ মিনুর একাকীত্বের সময়টা লাঘব হত। সে সাধ পূরণ চেষ্টাটুকু করলাম না।
তাহলে আমি উদার হতে আর পারলাম কৈ ?
এখন আমি ইচ্ছে করেই একা হতে চাই অলোক। দেখতে চাই একাকীত্বের যন্ত্রণা মানুষকে ভেতর থেকে কতটা ঘুণ পোকার মতো কুরে কুরে খায়। আমি অনুভব করতে চাই অলোক। সুবোধ পাশ থেকে বলে - ওকে যেতে দে অলোক। একটু প্রায়ঃশ্চিত্ত বোধয় ওর করা প্রয়োজন।

বাড়িতে ঢোকার মুহূর্তেই পাশের কোন বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ ভেসে এলো। প্রদ্যুম্ন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই সময়ে ওর বাড়ি থেকেও তো শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসত। মিনু সন্ধ্যে দিত যখন অফিস থেকে ফিরে সদর গেট খুলে বাড়িতে ঢুকে আসত প্রদ্যুম্ন। ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়েই স্বামীর জন্য চা জলখাবারের প্রস্তুতি নিতে রান্নাঘরে ঢুকে যেত মিনু। আর প্রদ্যুম্নও ব্যস্ত হয় পড়ত খাওয়া সেরে ক্লাবে যাওয়ার জন্য।

 

ঘরে ঢুকে জামাকাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে ঠাকুরঘরে গিয়ে দাঁড়ায় প্রদ্যুম্ন। বিগ্রহটাও যেন মিনু বিহনে একা হয়ে পড়েছে। প্রদীপটা জ্বালিয়ে দেয় প্রদ্যুম্ন। তারপর শাঁখে তিনটে ফুঁ। নিজেকেই কেমন অবাক লাগে ওর। ভাবে আশেপাশে মিনু থাকলে ওকে দেখে নিশ্চয় হাসছে। কারণ এবার প্রদ্যুম্ন রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জল বসাবে। রাতের জন্য কিছু খাবারও তৈরি করবে।ওর অসহায়তা চুঁয়ে চুঁয়ে গড়িয়ে পড়বে ঘামের বিন্দুতে। না কোন কাজের লোক রাখেনি সে। বিদেশ থেকে ভাই বলেছিল বটে - তুই একা সব পারবি না দাদা। একটা কাজের লোক রাখ। পারলে চব্বিশ ঘন্টার। রাখেনি প্রদ্যুম্ন। পারার সাথে সাথে নিজের না পেরে ওঠার অক্ষমতাকেও উপলব্ধি করতে চায় ও।

একাই তো ছিল মিনু। একা হাতেই সংসার নামক গাড়িটিকে গড়গড়িয়ে নিয়ে চলত। শ্বশুর শাশুড়ির সেবা। দেওরের আবদার। কতটুকু করতে হয়েছে প্রদ্যুম্নকে বাবা মা'র জন্য। ভাই তো দাদার থেকে বৌদির ওপর নির্ভরশীল ছিল। অথচ প্রদ্যুম্ন ভাবত তাকে ছাড়া সংসার অচল। কারণ সে রোজগার করে। আর সেইজন্য নিজের মনোরঞ্জনের জন্য কখনো অফিসের বন্ধুদের সাথে হুল্লোড় নয়ত পাড়ায় ক্লাবে ক্যারাম খেলার তোড়জোড়। মিনু যে কত রাত জেগে আকাশের তারাদের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে খেয়াল রাখেনি প্রদ্যুম্ন। তাই হয়ত সাততাড়াতাড়ি সেই তারাদের দেশে পাড়ি দিয়েছে সে।

 

 

সবকিছু একা হাতেই সামলাতো মিনু। হাতে হাতে সব জিনিস পেয়ে গেলেই তৃপ্ত প্রদ্যুম্ন। ঠিক যেন ঈশ্বর যাকে সন্তুষ্ট করতে সদা প্রচেষ্ট মিনু। ঈশ্বর তৃপ্ত হলেই মনস্কামনা পূর্ণ হবে। কী কী যেন ইচ্ছে ছিল মিনুর ? নিজেকেই প্রশ্ন করে প্রদ্যুম্ন। কী কী যেন আবদার নিয়ে ছুটে আসত কাছে। কৈ কিছু মনে পড়ছে না তো। শুধু ঐ বাচ্চা ছাড়া আর কিছুই দাবি ছিল না তার। অনাথ আশ্রমের একটি শিশুকে ঘর দিতে চেয়েছিল। বাবা মা'র আশ্রয় দিতে চেয়েছিল। কেন সেদিন রাজি হতে পারেনি প্রদ্যুম্ন নিজেকে প্রশ্ন করলেও উত্তর খুঁজে পায় না। ছাদে টবে কয়েকটা ফুলের গাছ লাগেয়েছিল মিনু। সেগুলোর পরিচর্যা করত নিয়মিত। রাতে হাঁপের টান উঠলে প্রদ্যুম্ন বিরক্ত হয়ে বলত - কেন যে ছাইপাঁশ গাছপালা নিয়ে পড়ে থাক। রাত বিরেতে যত ঝামেলা।মিনু চলে যাওয়ার দুদিন পর ছাদে গিয়ে গাছগুলো দেখেছিল প্রদ্যুম্ন। দুদিনেই নিস্তেজ হয়ে নুয়ে পড়েছিল। প্রিয়জনের হাতের ছোঁয়া না পাওয়ার বেদনায় হয়ত। প্রদ্যুম্ন জল দিয়েছিল গাছগুলোকে। আচ্ছা গাছগুলো কী বলতে পারবে ওরা আর কীভাবে যত্ন পেত মিনুর কাছে ? প্রশ্ন রেখেছিল প্রদ্যুম্ন নিজের কাছে। নিজের একাকীত্বের অনেকটা সময় মিনু এদের উজার করে দিত। আর কী যেন করত ? কবিতা লিখত। পাতার পর পাতা ভরে উঠত কবিতায়। শোনাতে চাইত সেসব কবিতা প্রদ্যুম্নকে। কিন্তু ওর কাছে তো সেসব নিছক আঁতলামি ছাড়া আর কিছুই মনে হত না। তাচ্ছিল্যের সুরে বলত - ধুর আজকাল কবিতা কে পড়ে। জীবনে কখনো গল্পের বইয়ের পাতাই উল্টে দেখলাম না। না জানি কতো বীরত্বের কথা বুক ফুলিয়ে বলত প্রদ্যুম্ন। কোথায় যেন রেখেছে মিনু ওর কবিতার খাতাটা। ঘরে ঢুকে খুঁজতে থাকে প্রদ্যুম্ন। এদিক ওদিক, দেরাজের ভেতর, টেবিলের ওপর। শেষমেশ আলমারিটার এক কোণে মুখ লুকিয়ে থাকার মত পড়ে থাকা খাতাটা বের করে আনে । পাতার পর পাতা মিনুর অন্তরাত্মার স্বীকারোক্তি। প্রিয় মানুষটিকে কাছে পাওয়ার আকুল আবেদন। নিজের অক্ষমতাকে নিয়ে তীব্র আত্মদংশন।মিনুর কাছে থাকার ভীষণ প্রয়োজন ছিল। পাশে থেকে হাতে হাত রাখার প্রয়োজন ছিল। কিছুই তো করেনি প্রদ্যুম্ন। অথচ যাওয়ার সময় প্রদ্যুম্নর হাত ধরেছিল মিনু। বলেছিল - আমি চলে গেলে তুমি যে একা হয়ে যাবে গো। প্রদ্যুম্নর জীবনে মিনুর ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এক লহমায় বুঝিয়ে দিয়ে গেছিল সে। প্রদ্যুম্ন খুব চেষ্টা করেছিল বলতে - আমি একলা হতে চাই মিনু। তোমার সাথে একলা হতে চাই। দেবে সে সুযোগ আমায় ? মিনু দেয়নি। দিতে পারেনি। ওপরের ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারোর থাকে না।

মিনুর কবিতাগুলোকে বইয়ের আকার দিয়েছে প্রদ্যুম্ন। বেশ সারা ফেলে দিয়েছে পাতায় পাতায় লিখে যাওয়া শব্দগুলো। যেন পরতে পরতে এঁকে দেওয়া একটা মানুষের কোমল অনুভূতিগুলো স্পর্শ করে যাচ্ছে হাজারো অন্তর। প্রদ্যুম্ন লজ্জিত। সুবোধের কথামতো প্রায়ঃশ্চিত্ত করেছে সে। বই থেকে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ তুলে দিয়েছে একটি অনাথ আশ্রমে। আশ্রমের শিশুগুলো যখন হাসে মিনুর চুড়ির আওয়াজ শুনতে পায় প্রদ্যুম্ন। ভি আর এস নিয়ে নিয়েছে ও। আজকাল বাড়িতেই থাকে। চার দেওয়ালের মাঝে মিনুর গায়ের গন্ধ শরীরে মাখে। এখন প্রদ্যুম্নও ভীষণ রকম আঁতেল হয়ে উঠেছে। সে কবিতা পড়ে। মিনুর কবিতা। পাশে অনুভব করে তাকে প্রতিমুহূর্তে। পড়ন্ত বিকেলের মায়াবী আলো গায়ে মেখে ছাদে দাঁড়ায়। কে বলে প্রদ্যুম্ন একা। ও তো মিনুর সাথেই একলা হতে চেয়েছিল। আজ তাই সে সফল। ভীষণ সফল।

**********************************

ছবি সৌজন্যে :- গুগল

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু