বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

জীবনযুদ্ধ

মানুষটা যখন গেল ছেলেটা তখন সাত আর মেয়েটা কোলের। শম্ভু এসে খবর দিল। বলল - অনেক চেষ্টা করলাম গো। টিন পিটলাম। মশাল দেখালাম তবু শেষ রক্ষে করতে পারলাম না গো সাগর বৌ। সাগর'টারে আমার সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে গেল ঐ দক্ষিণরায়। বড় লড়াই করেছিল সাগর বাঁচতে চেয়ে। বুকের মাঝে মেয়েটারে চেপে ধরেছিলাম। কাঁদতে পারিনি। কষ্টগুলো গলায় দলা পাকিয়ে পাথর হয়ে গেছিল।

কদিন ছেলে মেয়েটাকে নিয়ে অমনি পড়ে রইলাম। কোন কাজে মন লাগত না। কোনরকমে ভাত ফুটিয়ে বাচ্চাদুটোর মুখে তুলে দিতাম। নিজে খেতে পারতাম না। তার কথা বড় মনে পড়ত। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম দুজন। ঘর বেঁধেছিলাম। কত স্বপ্ন ছিল তার চোখে। জঙ্গল থেকে মধু আনার সাথে সাথে মাছ ধরার কথাও ভাবত। বলত একটা ডিঙি কিনবে। ঘরের ছাদ পাকা করবে। ছেলে মেয়ে দুটোকে লেখাপড়া শেখাবে। আমার একজোড়া মাকড়ি বানিয়ে দিতে চেয়েছিল। বড় সোহাগ করত সে আমায়। চোখে হারাতো।

একদিন ঘরে চাল ফুরালো। খিদের জ্বালায় বাচ্চাদুটো কেঁদে উঠতে হুঁশ ফিরল আমার। বুঝলাম কিছু একটা করতে হবে নইলে না খেয়ে মরতে হবে। বনবিবির থানে পুজো দিয়ে আমিও চললাম জঙ্গলের দিকে। কোমরে দা'খান গুঁজে নিলাম। আমি না ফেরা পর্যন্ত ছেলেটাকে ঘরে দোর আটকে পড়ে থাকতে বলে গেলাম। মেয়েটাকে কাপড়ের ঝোলায় ঝুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে যেতাম।


- ভয় করত না ?
- ভয় করলে চলবে কেন গো বাবু। তাহলে যে মরার আগেই মরে যেতে হয়।
- জঙ্গলে তার দেখা পাওনি কখনো ?
- এসেছিল তো। জ্বলজ্বল চোখদুটো একবার দেখতে পেলাম ঝোপের মাঝে। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালাম। এক হাতে মশাল আর অন্য হাতে দা নিয়ে। আমার চোখেও সেদিন আগুন ছিল তাই হয়তো সে ফিরে গেছিল। এক মায়ের লড়াই দেখেছিল হয়ত আড়াল থেকে। সেও বোধহয় মা ছিল।

ষাট বছর বয়সে এসে পারুল দাস তার জীবন কাহিনী বলে চলেছে শহর থেকে আসা এক সাংবাদিককে। জীবনযুদ্ধে জিতে যাওয়া এক মায়ের কথা শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছিল সেই সাংবাদিক।
- তোমার ছেলে এখন কী করে?
মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে পারুলের। - সে মাছ ধরতে যায়। বাপের কথা রেখেছে। ডিঙি কিনেছে। বুক চিতিয়ে দাঁড়ালে একদম বাপের বেটা। বড্ড সাহস। মাস গেলো বিয়েও করেছে। বৌটিও তেমন ডাকাবুকো। বলে - মা তোমার সাথে মধু আনতে আমিও যাব। বাধা দিইনি। মেয়েরা কী এখন আর ঘরে বসে থাকে। মা মেয়েতে মিলে যাই। একজন পাহাড়ায় থাকি তো একজন মধু পেড়ে আনি। এইভাবেই চলছে।

-আর তোমার মেয়ে ? সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল পারুল।
তারপর বলল - তারে আর বাঁচাতে পারলাম না। একদিন জঙ্গল থেকে ফিরে দেখি বাচ্চাটার ধুম জ্বর। ছেলেটা কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। এখানে তো তেমন ভালো ডাক্তার নেই কো। ঐ কবরেজই ভরসা। দেখে বলল ম্যালেরিয়া। ওষুধ দিল বটে। তবে বাচ্চা মেয়েটি সইতে পারল না। চলেই গেল বাপের কাছে। ঐ যে দেখছেন নদীর চরা। ঐখানেই দু হাত মাটির নিচে শুইয়ে দিয়েছিলাম। পাঁচটি বছর না হলে যে আগুন দিতে নেই কো। এখন ঐ ছেলের বৌটিই আমার মেয়ে।


সাংবাদিকটি দেখল  মেয়ের কথা বলতে গিয়ে পারুল উদাস হলো বটে তবে চোখদুটো তার শুকনো খটখটে। জীবনযুদ্ধে লড়তে লড়তে কোথাও যেন পরিস্থিতির সাথে মনটাকে মানিয়ে নিতে গিয়ে অনেকটাই কঠিন বনে যায় এই সুন্দরবনের মানুষগুলো। ঠিক যতটা কঠিন এদের জীবনযাত্রা।

সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে এবার পারুল বলে উঠল  -তুমি তো কাগজের লোক। লিখবে আমাদের কথা তোমাদের কাগজে ? তা বেশ। এখানে ঘরে ঘরে জীবনযুদ্ধের কথা লিখ তোমাদের কাগজে। যে জীবনযুদ্ধে জিতে কেউ কেউ ঘরে তো ফেরে আবার কেউ কেউ ইতিহাস হয়ে যায়। তাদের নাম লেখা থাকে ঐ জঙ্গলে। নদীর জলে।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু