বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মোটা মাইনের গভর্নেস

যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ ক’রে কিরীটি কোনো কোম্পানীতে যোগ দেয়নি, কারণ বাজারে চাকরী নেই। কিরীটি ব্যবসা শুরু ক’রেছে, ‘সেবা’- নামে একটা কোম্পানী খুলেছে; ওর মূল দক্ষতা কম্পিউটারে; ছোটোখাটো ব্যবসাদারের পে-রোল, ইনভেন্টরী ম্যানেজমেন্ট, ইনভয়েসিং, দেনা-পাওনা ম্যানেজমেন্ট, সর্ব্বোপরি সাইবার সিকিউরিটি আর ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনে। ‘সেবা’র মালিক কিরীটি, আবার একমাত্র কর্ম্মচারীও কিরীটি; তবে স্থানীয় পুলিশ ইনস্পেক্টর অনুভা কিরীটির বন্ধু হিসেবে প্রায়ই কিরীটির অফিসে থাকে; যেদিন মিস্ প্রণতি দেব কিরীটির সঙ্গে প্রথম দেখা ক’রতে এলো সেদিনও অনুভা ছিল ওর চেম্বারে। সুন্দরী তরুণী মিস্ প্রণতি দেবের কাছ থেকে কাজ আদায় করার জন্যে অনুভা ব’ললো, ‘আপনি যা চাইবেন তাই ক’রে দেবে কিরীটি। আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট – যা চাইবেন, তাই পাবেন। কাজ ক’রতে যা খরচ হবে, সেইটুকুই আমরা আপনাকে বিল ক’রবো’। 
মিস্ প্রণতি দেব জানালো যে, ও একটা মোটা মাইনের চাকরি পেয়েছে, কিন্তু গভর্নেস হিসাবে এই চাকরি করার মধ্যে কোনোরকমের ঝুঁকি আছে কিনা বুঝতে পারছে না। কারণ এই চাকরির সঙ্গে ওকে মেনে নিতে হবে কিছু অসাধারণ শর্ত। প্রণতির কাছে এই চাকরীটির প্রধান আকর্ষণ এখানকার মাইনে – সপ্তাহে দু-হাজার টাকা, তার উপর থাকা-খাওয়ার কোনো খরচ নেই। এর আগে প্রণতির মাসিক বেতন ছিল পাঁচ হাজার টাকা। নিয়োগকর্তা তিমির তরফদার প্রথমেই দেড় হাজার টাকা সাপ্তাহিক বেতনের চাকরীর প্রস্তাব দিয়েছিল। এর পরে প্রণতি তার আজানুলম্বিত কেশরাশি বিসর্জ্জন দিতে অনিচ্ছুক হওয়ায়, তিমির ব’লেছিল এখানে কাজ ক’রতে হ’লে চুল ঘাড়ের নীচে নামানো চলবে না; এর জন্যে সপ্তাহে দু-হাজার টাকা দিতে তিমির রাজী। চুল ছোট করা ছাড়া আরও কিছু সর্ত্ত আছে পোষাক-আশাক, চলাফেরা ও কথাবার্ত্তার ব্যাপারে যেগুলোতে প্রণতির  একটু অস্বস্তি লাগছে। প্রণতির সন্দেহ- আপাতদৃষ্টিতে তিমির তরফদার যতটা হাসি-খুশি ভালো মানুষ মনে হয়, ও ততটা আস্থাভাজন নয়।
তিমির তরফদারের মাইনে বাড়ানোর প্রস্তাব পেয়ে প্রণতি কিরীটিকে জানালো যে ও চাকরিতে যোগ দেবে; তখন কিরীটি পরামর্শ দিলো,- যদি কোনো প্রয়োজন হয়, প্রণতি টেলিফোন ক’রে জানালেই কিরীটি পৌঁছে যাবে তিমির তরফদারের জমিদার বাড়ীতে।
***
পনেরো দিন পরে, কিরীটি প্রণতির টেলিফোন পেয়েছিল, প্রণতি তাকে অনুরোধ ক’রেছিল জমিদার বাড়ীতে এসে প্রণতির সঙ্গে দেখা করার জন্যে। মিস্ দেব কিরীটিকে কয়েকটি অস্বস্তিকর ঘটনার কথা জানিয়েছিল:- (১) মিস্টার তরফদার মিস্ দেবকে কাজের সময় ওর নিজের জামাকাপড় প’রতে বারণ ক’রেছিল; ওকে দেওয়া হ’য়েছিল কয়েকটি পুরোনো কিন্তু নতুনের মতো সালওয়ার কামিজের সেট। এই বিশেষ পোশাক প’রে, একটি খোলা জানলার দিকে পিঠ ক’রে, সামনের রুমে বসে ওকে ছাত্রকে পড়াতে হ’তো। মিস্ দেবের সন্দেহ হ’য়েছিল যে জানালার বাইরে থেকে কেউ ওকে দেখছে; কিন্তু জানালার দিকে দেখা ওর বারণ ছিল। রুমালে লুকোনো একটি ছোট আয়না দিয়ে মিস্ দেব দেখতে পেয়েছিল যে ওর সন্দেহ ঠিক; একজন লোক পিছনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল।
(২) আর এক দিন, মিস্টার তরফদার অনেক মজার গল্প বলেছিল মিস্ দেব আর মিসেস তরফদারের  সামনে যা শুনে মিস্ দেব হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়েছিল। আশ্চর্য্যের কথা এই যে মিসেস তরফদার এতে একটুও হাসেননি।
(৩) এই বাড়ী সম্পর্কে আরও কিছু অস্বস্তিকর বিষয় ছিল। যে ছ-বছর বয়সের শিশুটির দেখাশোনা করার ভার মিস্ দেবকে দেওয়া হ’য়েছিল, সে ছোট জীবজন্তুদের উপর আশ্চর্য্যজনকভাবে নিষ্ঠুর ছিল।
(৪) এ বাড়ীর কাজের লোক মিস্টার এবং মিসেস পাকড়াশীর মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না।
(৫) যে বিরাট ড্যাশুন্ড (dachshund) কুকুরটি এই সম্পত্তির পাহারায় থাকতো, তাকে সবসময় ক্ষুধার্ত রাখা হ’তো। রাতের বেলা কুকুরটিকে মাঠে ছেড়ে দেওয়া হ’তো, এবং অন্ধকার হ’য়ে যাবার পরে  মিস্ দেবের বাড়ীর বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল।
(৬) এছাড়াও, মিস্টার পাকড়াশী প্রায়ই মাতাল হ’য়ে থাকতো, অথচ একমাত্র তার উপরেই ছিল কুকুরটিকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব।
(৭) মিস্ দেব একদিন এক অদ্ভুত আবিষ্কার ক’রলো,- ওর নিজের লক করা ড্রয়ারে রয়েছে ওর নিজেরই চুলের গোছা। মিস্ দেব ওর নিজের সুটকেশ চেক করে দেখলো, ওর নিজের কাটা চুলের গোছা সেখানেও রয়েছে। তাহ’লে ড্রয়ারে রাখা চুলের গোছাটি কি অন্য কোন মহিলার? কিন্তু মিস্ দেবের নিজের চুলের মতো ঠিক একই অস্বাভাবিক রঙের এই চুলের গোছাটিরও।
(৮) যাইহোক, মিস্ দেবের কাছে সবচেয়ে রহস্যজনক মনে হ’তো বাড়ীটির সেই অংশটি, যেখানে মনে হ’তো কেউ থাকতোনা বা কোনো কজে লাগতো না। জানালাগুলো ছিল হয় নোংরার জঙ্গল, নয়তো বন্ধ, এবং একবার মিস্ দেব দেখলো মিস্টার তরফদার বাড়ীর এই অব্যবহৃত অংশের দরজা থেকে বেরিয়ে আসছে বেশ বিচলিত অবস্থায়। পরে, মিস্টার তরফদার ব’লেছিল যে ঘরগুলিকে ফটোগ্রাফিক ডার্করুম হিসাবে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু মিস্ দেবের সে কথা বিশ্বাস হয়নি।
(৯) খুব মাতাল হ’য়ে থাকলে, মিস্টার পাকড়াশী বাড়ীটির রহস্যজনক অব্যবহৃত অংশের দরজার চাবি ঐ দরজাতেই ছেড়ে যেতো। একবার মিস্ দেব চুপিসাড়ে ভেতরে ঢুকলো। বাড়ীর ভিতরটা বেশ ভীতিকর; মনে হ’লো, লক করা একটা দরজার অন্য পাশে একটা ছায়া চলছে। আতঙ্কিত হ’য়ে মিস্ দেব দৌড়ে পালাতে গেলো; কিন্তু পালানো হ’লো না; মিস্ দেব ধরা পড়লো সেখানে অপেক্ষমান মিঃ তরফদারের বাহু-বন্ধনে। মিস্টার তরফদার ওকে তিরস্কার করেনি; বরং, ওকে ভরসা দেওয়ার ভান ক’রেছিল। যাইহোক, মিস্টার তরফদারের অতিরিক্ত ভালোমানুষি সন্দেহ জাগিয়েছিল মিস্ দেবের মনে; তাই মিস্ দেব দাবী ক’রেছিল যে ও কিছুই দেখেননি। এক মুহুর্তের মধ্যে, মিঃ তরফদারের ভরসা দেওয়া হাসিমুখ বদলে গিয়েছিল যেন রক্তচক্ষু ক্রুদ্ধ মূর্ত্তিতে।
 
***
 
কিরীটি আর অনুভা এসে খোঁজ ক’রে দেখলো কাউকে বাড়ীর নিষিদ্ধ ঘরে বন্দী রাখা হ’য়েছে কিনা। মিস্ দেবকে নিয়োগ করার উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গেলো: তরফদারের মেয়ে কেয়ার বয়ফ্রেন্ড রাস্তা থেকে সামনের ঘরের জানলা দিয়ে দেখতে চাইতো কেয়াকে। কেয়ার সঙ্গে মিস্ দেবের চেহারার অনেকটা মিল ছিল ব’লেই মিঃ তরফদার মিস্ দেবকে অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের প্রলোভন দেখিয়ে এই কাজে নিযুক্ত ক’রেছিল যাতে কেয়ার বয়ফ্রেন্ডকে বোঝানো যায় যে, তরফদারের মেয়ে কেয়া তাকে দেখতে আর আগ্রহী নয়।
কিরীটি, অনুভা এবং মিস্ দেব মিস্ তরফদারের গোপন ঘরে প্রবেশ ক’রে দেখে ঘরটি খালি। কিছু পরে মিঃ তরফদার এসে মনে করে যে এই তিনজন তার মেয়েকে পালিয়ে যেতে সাহায্য ক’রেছে;  তাই এই তিনজনের উপর লেলিয়ে দেবার জন্যে নিয়ে আসে ড্যাশুন্ড কুকুরকে। মিঃ তরফদারের দুর্ভাগ্য যে, কুকুরটি দুর্ঘটনাক্রমে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষুধার্ত ছিল, তাই মিঃ তরফদারের নির্দ্দেশ না মেনে, মনিব মিঃ তরফদারকেই ও আক্রমণ ক’রেছিল। অনুভা তার রিভলবার দিয়ে কুকুরটিকে গুলি করে। গুলির আওয়াজ শুনে মিসেস পাকড়াশী ছুটে এল সেই ঘরে; কুকুর ও মিঃ তরফদারের অবস্থা দেখে প্রথমে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো হতভম্ব হ’য়ে; তারপরেই ‘তাড়াতাড়ি এসো এদিকে’ ব’লে দৌড় দিল মিঃ পাকড়াশীকে ডাকতে।  মিঃ পাকড়াশী কুড়ি মিনিটের মধ্যেই হাজির ক’রলো দুটো অ্যাম্বুল্যান্স ভ্যান – একটা ড্যাশুন্ড কুকুরের জন্যে, অপরটা কুকুরের মনিবের জন্যে। এর পরে, মিস্ দেব মিস্টার ও মিসেস পাকড়াশীর সঙ্গে কিরীটি ও অনুভার পরিচয় ক’রিয়ে দিল। মিস্ দেব মনোবিজ্ঞানে পি-এইচ-ডি, খুব সহজেই অন্তরঙ্গ হ’য়ে উঠতে পারে; মিস্টার ও মিসেস পাকড়াশী খুব সহজেই অনেক কথা মন খুলে প্রকাশ ক’রলো, যে কথাগুলো এই দুর্ঘটনার আগে ওরা কাউকে বলেনি – এমনকি একে অপরকেও নয়।
মিস্টার পাকড়াশী এদিন সামান্যই মাতাল ছিল, ব’ললো কেন ও এখন রোজ মাতাল হ’য়ে থাকে। মিসেস তরফদারকে ও নিজের ছোটবোনের মতোই ভালবাসতো, ওকে টুলু ব’লে ডাকতো; টুলুর বিয়ের আগে, ছোটবেলায় টুলু আর ও একই পাড়ায় থাকতো, তখন থেকেই টুলু ওকে ‘মন্টুদা’ ব’লে ডাকতো। টুলুর যখন বিয়ে হ’য়েছিল, তখন মিঃ তরফদারের বাবা বেঁচে ছিলেন, তিনি টুলুবৌমাকে খুবই স্নেহ ক’রতেন; হয়তো ছেলের চেয়ে বেশী ভালবাসতেন বৌমাকে; তাই মরার কয়েক বছর আগেই তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি টুলুবৌমার নামে ক’রে দিয়েছিলেন। টুলু মিঃ তরফদারকে ভয় পেতো। টুলু বাড়ীর কাজের লোকের সঙ্গে এতো কথা বলে, সেটা ওনার পছন্দ ছিল না। তারপর, হঠাৎ কদিনের জ্বরে টুলুর মৃত্যু হ’লো। তবে মৃত্যুর আগেই টুলু যাবতীয় সম্পত্তি ওর মেয়ে কেয়ার নামে উইল ক’রে গেছে। টুলুর মৃত্যুর মাত্র ছ-মাস পরেই মিঃ তরফদার আবার বিয়ে করেন। এখনকার মিসেস তরফদার মিঃ তরফদারের দ্বিতীয় স্ত্রী। এই সময়েই মিসেস তরফদার একটা মারাত্মক কুকুর নিয়ে এলেন; এতে বেড়েছিল কেয়ার আতঙ্ক। ওর প্রয়াত মায়ের উইল অনুযায়ী কেয়ার প্রতি মাসে আর্থিক ভাতা পাওয়ার কথা। মিঃ ও মিসেস তরফদার ওদের প্রথম পক্ষের মেয়েকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত ক’রতে চেয়েছিল; এই জন্যে ওরা কেয়াকে একটা কাগজে স্বাক্ষর ক’রতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল; যার ফলে কেয়া মস্তিষ্কের জ্বরে অসুস্থ হ’য়ে পড়েছিল; এবং তার চুল কাটতে হ’য়েছিল। তবে ওর চুল একটা লকারে রাখা আছে। মিঃ ও মিসেস তরফদার কেয়াকে তার বয়ফ্রেণ্ডের থেকে দূরে রাখার জন্যে এই বাড়ীটির রহস্যে ঘেরা অব্যবহৃত অংশে আটকে রেখেছিল। পরে কেয়ার ছদ্মবেশ নিয়ে ওদের ছেলে লাল্টুকে পড়ানোর জন্যে জন্য মিস্ দেবকে নিয়োগ করা হ’য়েছিল।
টুলুর শোক ভুলে থাকার জন্যে টুলুর মন্টুদা মদ খাওয়া শুরু ক’রেছিল; খাওয়ার মাত্রা আরও বেড়ে যায় মিঃ তরফদার দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পরে। এর পরে মিঃ তরফদারের তাগিদে বিয়ে করে মিঃ পাকড়াশী; কিন্তু বিয়ের পরে ও আরও একা হ’য়ে যায়। ওর স্ত্রী মিসেস্ পাকড়াশী অর্থাৎ নীতা কোনদিনই টুলুর মতো আপন ক’রে শ্রদ্ধা করেনি ওকে; বরং মনে ক’রেছে ওর স্বামী মন্টু ওর এম.এস.সি পাশ স্ত্রীর তুলনায় নিতান্তই অশিক্ষিত; একমাত্র একটা কারণেই ও মন্টুকে ভালবাসতো, সে কারণ- বিরাট ড্যাশুন্ড কুকুরটিকে মন্টু সামলাতে পারতো। কিন্তু মন্টু বিয়ের পরে আরও বেশী মাতাল হ’য়ে থাকতো- প্রথমতঃ টুলুর স্মৃতি ভুলতে, দ্বিতীয়তঃ ও যে বিবাহিত সেকথা ভুলে থাকতে।
এর পরে, মিসেস পাকড়াশী কথা শুরু ক’রলো, ‘মন্টুকে এতদিন আমি মাতাল ছাড়া আর কিছু ভাবিনি। আজ প্রথম জানলুম যে আগের মিসেস তরফদারের নাম ছিল টুলু, যে মন্টুকে দাদার মতো শ্রদ্ধা ক’রতো। আমি সন্দেহ ক’রতাম, আগের মিসেস তরফদারের সঙ্গে মন্টুর অন্য সম্পর্ক ছিল আর সেই কারণেই ওঁকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হ’য়েছিল। পাছে ও আবার নতুন মিসেস তরফদারের সঙ্গে আবার ওরকম কিছু করে, সেই ভয়ে মিঃ তরফদার আমাকে এ বাড়ীতে নিয়ে এসেছেন মন্টুর বৌ ক’রে। যেহেতু আমি উচ্চ-শিক্ষিতা, ব্যবসার কাজে হিসেব রাখতে পারবো, কেয়াকে পড়াতে পারবো, পরে নতুন মিসেস তরফদারের যখন ছেলে হ’লো, ভেবেছিলাম তখন তাকে মানুষ ক’রে তোলার দায়িত্বও আমারই থাকবে। …. আমার নাম ‘নীতা’ – অনেকটা ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমার নীতার মতোই মা, বাবা, ভাইবোনেদের জন্যে আত্মদান ক’রে এসেছি আমি। বাবা গাড়ীর ধাক্কায়, পা ভেঙ্গে পঙ্গু হওয়ার পরে সংসার চালানোর ভার নিতে হয়েছে আমাকে। দাদা সঙ্গীত নিয়ে সাধনা ক’রেছে অনেক, কিন্তু রোজগার ক’রতে পারেনি। আমি আমার পরের দুই ভাই আর দুই বোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় ক’রেছি; দুই বোনের বিয়ে দিয়েছি; ছোট দুই ভাই কাজ শুরু করার পরে আমার গলায় যন্ত্রণার জন্যে ডাক্তার দেখাই; অপারেশনের পরে বায়োপ্সিতে জানা গেছিল, কিছু ক্যান্সারের টিস্যু রয়ে গেছে, ক্যান্সার লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞেরা বলেছিলেন যে ক্যান্সার খুব বেশি ছড়িয়ে পড়েনি; এখনও দিল্লীর অল ইন্ডিয়া মেডিকেল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটে রেডিও-অ্যাক্টিভ আয়োডিন (RAI) থেরাপির চিকিত্সা দিয়ে নিরাময় করা সম্ভব। দিল্লীর অল ইন্ডিয়া মেডিকেল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট থেকে নির্দ্ধারিত হ’লো রেডিও-অ্যাক্টিভ আয়োডিন (RAI) থেরাপির চিকিত্সার দিন। এক সপ্তাহের থেরাপিতে সেরে উঠলাম। এই সময়েই আমার মনে হ’লো, আমিও বাকী ভাইবোনেদের মতো বাঁচতে চাই, বিয়ে ক’রে সংসার ক’রতে চাই। কিন্তু এই বয়সে কে আমাকে বিয়ে ক’রবে; আমার বয়সী পুরুষদের অনেক আগেই বিয়ে হ’য়ে গিয়েছে। এই সময়ে আমার কনিষ্ঠতম ভাই শ্যামল ওর বান্ধবী কেয়ার কছে জানতে পারে এ বাড়ীতে এক বয়স্ক পাত্র মন্টু পাকড়াশীর জন্যে একটু বয়স্কা পাত্রীর খোঁজ চলছে। এর পরে আার বিয়ে হ’তে দেরী হয়নি। এইমাত্র আমি শ্যামলকে জানিয়েছি মিঃ তরফদারের হাসপাতালে যাওয়ার কথা; ও কেয়াকে জানানোর চেষ্টা ক’রবে।‘
এর মধ্যে কখন মিসেস তরফদার এসে ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়েছে, কেউই বুঝতে পারেনি, ও এ-পর্য্যন্ত কতটা কথা শুনেছে বোঝা যায়নি, এবার সুযোগ পেয়ে ব’ললো, ‘আমি মিসেস সোমা তরফদার। বলুন কে কে আমার সঙ্গে আসবে? আমি এবারে দুই হাসপাতালে যেতে চাই। এক হাসপাতালে আমার স্বামী তিমির, যার জন্যে আমার এ-বাড়ীতে আসা, গত সাত বছর ধ’রে এখানে ঘর করা। আর এক হাসপাতালে আমার প্রিয় কুকুর ড্যাশুন্ড, গত দশ বছর ধরে যে আমার খেলার সঙ্গী, যাকে আমি বিয়ের পরেই নিয়ে এসেছি এখানে।‘
অগত্যা কিরীটি, অনুভা আর প্রণতি মিসেস সোমা তরফদারের সঙ্গে হাজির হ’লো হাসপাতালে। তিমির তরফদারের বেডের কাছাকছি এসে কিরীটির মনে হ’লো যেন আর একটা প্রণতি রোগী তিমির তরফদারের সঙ্গে কথা ব’লছে – ঠিক প্রণতির মতো ঘাড় পর্য্যন্ত চুল, ঠিক এই মাপের এই ধরণের শালোয়ার কামিজ প্রণতিও প’রে রয়েছে। বেডের আরও একটু কাছে যাওয়ার পরে, মিঃ ও মিসেস তরফদারের কথাবার্ত্তা শুনে বোঝা গেলো যে মেয়েটি কেয়া - মিঃ তরফদারের প্রথম পক্ষের মেয়ে – এর পালিয়ে যাওয়া নিয়েই মিঃ তরফদার ভীষণ উত্তেজিত হ’য়ে কিরীটি, অনুভা আর প্রণতির উপর ড্যাশুন্ডকে লেলিয়ে দিয়েছিল। কেয়ার সঙ্গে একটি যুবকের দিকে চোখ পড়লো প্রণতির – কোথায় যেন দেখেছে এই মুখ? মনে পড়লো, বাড়ীর সামনের ঘরে জানলার দিকে পেছন ক’রে বসে থাকার সময় প্রণতি ওর ড্রেসিং মিরর দিয়ে দেখেছে এই মুখ; অর্থাৎ এই সেই যুবক যাকে মিঃ তরফদার বোঝাতে চেয়েছিল কেয়া আদৌ আগ্রহী নয় ওর জন্যে। যাই হোক কেয়া যে নিরুদ্দেশ হ’য়ে বাড়ী থেকে পালিয়ে যায়নি, সেটাই অনেক আশ্বাসের কথা। হয়তো এই যুবকটিই মিসেস নীতা পাকড়াশীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্যামল; ভাই আর বোনের মুখের মধ্যে কিছুটা সাদৃশ্য আছে।
মিঃ তরফদারের বেডের কাছে গিয়ে কিরীটি, অনুভা আর প্রণতি ওর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হ’লো। ওকে হাইড্রোফোবিয়া, টিটেনাস ইত্যাদি প্রতিরোধের জন্যে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে; হাঁটুর উপরে অনেকটা জায়গায় ড্রেসিং করা হ’য়েছে; হাড় না ভাঙলেও অনেকটা মাংস ও পেশী ছিঁড়ে গেছে; কতদিন বাদে মিঃ তরফদার চলাফেরা ক’রতে পারবে তা বলা কঠিন।
কিরীটির মনে হ’লো, মিসেস তরফদার মিঃ তরফদারের সঙ্গে কথা ব’লতে তেমন আগ্রহী নয়। মিঃ তরফদার হাসির কথা বললেও ওর মুখে হাসি দেখা যায় না; মিঃ তরফদার ওর কষ্ট বা যন্ত্রণার কথা বললেও ওর মুখে কোনো অভিব্যক্তি দেখা যায় না। পাঁচ-সাত মিনিট মিঃ তরফদারের বিছানার কাছে থাকার পরে মিসেস তরফদার ব্যস্ত হ’য়ে পড়লো ওর প্রিয় কুকুর ড্যাশুণ্ডের হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে। কিরীটি মিঃ তরফদারের বিছানার কাছেই র’য়ে গেলো; অনুভা আর প্রণতি মিসেস তরফদারের সঙ্গী হ’লো।
মিসেস তরফদার চলে যাবার পরে, কেয়া আরও অনেক বেশী অন্তরঙ্গ হ’লো ওর বাবা মিঃ তিমির তরফদারের সঙ্গে, বললো, ‘কোনো দুশ্চিন্তা কোরো না বাবা। তোমাকে আমি পুরো সুস্থ ক’রে তুলবো, আবার তুমি দৌড়োদৌড়ি ক’রে ফুটবল খেলবে, টেবিল-টেনিস খেলবে। কী দরকার ঐ খুনে কুকুরটাকে এ বাড়ীতে রাখার? যদি ও গুলি খেয়েও বেঁচে যায়, নতুন মাকে ব’লো ওর বাপের বাড়ীতে এই খুনেটাকে রেখে আসতে।‘
 
অনুভা আর প্রণতি মিসেস তরফদারের সঙ্গে গেলো কুকুর ড্যাশুণ্ডের হাসপাতালে। হাসপাতালে ঢোকার মুখেই প্রণতির চোখে পড়লো ছ-বছর বয়সী সেই ছেলেটি, যাকে পড়ানোর জন্যে বা যার গভর্নেস হওয়ার জন্যেই প্রণতির চাকরী হ’য়েছে মিঃ তিমির তরফদারের বাড়ীতে। ছেলেটির নাম লাল্টু। এক ভদ্রলোক লাল্টুকে নিয়ে লোফালুফি খেলছে। মিসেস তরফদার একটু অশালীনভাবেই গলা জড়িয়ে অন্তরঙ্গতা দেখালো ভদ্রলোকটিকে, তারপর জিগ্যেস ক’রলো, ‘কতক্ষণ এসেছো, বাবলু? ড্যাশুণ্ডের কি অবস্থা?’
বাবলু ব’ললো, ‘প্রায় এক ঘন্টা হ’লো এসেছি। তোমরা লাল্টুকে ফেলে বেরিয়ে পড়েছ দেখে আমি ওকে সঙ্গে নিলাম। ড্যাশুণ্ডের কি হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এখনও অপারেশন চলছে গুলিটা বের করার জন্যে।‘
প্রণতির মনে হ’লো, মিসেস তরফদার বাবলুর সঙ্গে যতটা অন্তরঙ্গভাবে কথা ব’লছে, মিঃ তিমির তরফদারের সঙ্গে অতটা মন খুলে কথা বলে না। কে জানে হয়তো বাবলু মিসেস তরফদারের বাল্যবন্ধু। বাবলু লাল্টুকেও বেশ আদর করে, তবে মাঝে মাঝে আদরের মধ্যে একটু নিষ্ঠুরতার আভাস দেখা যায়। অনুভার মনে হ’লো বাবলু আর লাল্টুর মধ্যে অনেকটা মিল আছে – চেহারার গড়নে, মুখমণ্ডলে, এমনকি উচ্চারণের কায়দায়। এখান থেকে মিসেস তরফদার বাবলুর সঙ্গে বাড়ী ফিরে গেলো। অনুভা আর প্রণতি গেলো মিঃ তরফদারের হাসপাতালে; সেখান থেকে কিরীটিকে নিয়ে গেলো কিরীটির অফিসে; বসলো আলোচনায়।
আলোচনায় ব’সে কিরীটি ব’ললো, ‘কদিন আগে প্রণতি জানিয়েছিল মিঃ তরফদারের বাড়ীতে কি কি অসঙ্গতি ওর চোখে পড়েছে; আমরা দেখবো ঐ অসঙ্গতিগুলোর ব্যাখ্যা ক’রতে পারি কিনা এবং কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হ’তে পারি কিনা।‘
অসঙ্গতিগুলির ব্যাখ্যা:-
(১) মিস্টার তরফদার প্রণতিকে কেয়ার মতন চুল রাখতে ও কেয়ার সালওয়ার কামিজ প’রতে বাধ্য ক’রেছিল; যাতে জানালার বাইরে থেকে ওর পিঠ দেখলে কেয়ার বয়ফ্রেন্ড শ্যামল ওকে কেয়া ব’লে মনে করে। প্রণতি আর কেয়ার চেহারার গড়ন একই ধরণের। প্রণতি ওর ভ্যানিটি ব্যাগের আয়না দিয়ে যে মুখটি দেখেছে সেটি শ্যামলের।
(২) মিসেস তরফদার মিস্টার তরফদারের কথা শুনতে চায় না; তাই মিসেস তরফদার মজার গল্প বললেও মিসেস তরফদারের হাসি পায় না।
(৩) ছ-বছর বয়সের শিশু লাল্টুর সঙ্গে মিসেস তরফদারের পরিচিত বাবলুর অনেকটা মিল আছে; এরা দুজনেই নিষ্ঠুর।
(৪) টুলু মিস্টার পাকড়াশীর বোনের মতো; বোন মারা যাওয়ার শোক ভুলতে পারেনি মিস্টার পাকড়াশী, তাই মাতাল হ’য়ে থাকে। বিয়ের পর মিসেস পাকড়াশীকে ও আপন ক’রে নিতে পারেনি।
(৫) বিরাট ড্যাশুন্ড কুকুরটিকে কেন ক্ষুধার্ত রাখা হ’তো, জানা নেই; ক্ষুধার্ত রাখার জন্যেই ও মিস্টার তরফদারকে আক্রমণ ক’রেছিল।
(৬) মিস্টার পাকড়াশীর প্রায়ই মাতাল হ’য়ে থাকার কারণ টুলুর মৃত্যুর পরে টুলুর জন্যে শোক।  টুলুর মৃত্যুর আগে ও মাতাল ছিল না।
(৭) প্রণতি ওর নিজের লক করা ড্রয়ারে যে চুলের গোছা পেয়েছিল সেটি কেয়ার, অসুখের পরে চুল ছোট করার দরকার পড়েছিল। কেয়ার চুল ছোট বলে, প্রণতিকে চুল ছোট ক’রতে হ’য়েছিল, যাতে ওকে পিছন থেকে কেয়ার মতো দেখায়। প্রণতির নিজের কাটা চুলের গোছা ওর সুটকেশে রয়েছে।
(৮) কেয়াকে লুকিয়ে রাখা হ’তো বাড়ীটির সেই রহস্যজনক অংশটিতে, যেখানে মনে হ’তো কেউ থাকতো না।
(৯) বাড়ীটির রহস্যজনক অব্যবহৃত অংশে কেয়া থাকতো ব’লে, মিঃ তরফদার ওকে মাঝে মাঝে দেখতে যেতো; তাই প্রণতি যখন না জানিয়ে ওখানে গিয়েছিল, মিঃ তরফদারের সঙ্গে ওর দেখা হ’য়ে গিয়েছিল। মনে হয় মিঃ তরফদার প্রণতিকে প্রথমে ওর মেয়ে কেয়া বলে ভুল ক’রে খুশী হ’য়েছিল; পরে যখন বুঝতে পারে ও মিস্ দেব তখনই মিঃ তরফদার রক্তচক্ষু হ’য়েছিল।
 
এই আলোচনার পরে কিরীটি দেখলো, এখন কোনো অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কেয়াকে বাড়ীটির রহস্যজনক অংশে আর রাখা হবে না, কারণ কেয়া আর অসুস্থ নয়; ওর বয়ফ্রেণ্ড শ্যামল ওর খেয়াল রাখবে। কেয়া ও লাল্টুর আসল বাবা কে সেবিষয়ে অনুভা নিশ্চিত হ’তে চাইলো। মিঃ তিমির তরফদার, মিঃ মন্টু পাকড়াশী আর বাবলুর জিন পরীক্ষা করা হ’লো কেয়া ও লাল্টুর জিনের পরিপ্রেক্ষিতে; বিশ্লেষণের ফল অনুযায়ী, মিঃ তিমির তরফদার সুনিশ্চিতভাবে কেয়ার পিতা; কিন্তু লাল্টুর পিতা এদের তিনজনের কেউ নয়।
 
মিঃ তরফদার ১৫দিন পরে হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফিরলো; তখন ও লাঠি ছাড়াই হাঁটতে পারে; তবে ড্রেসিং ক’রতে হবে আরও কিছুদিন।  কুকুর ড্যাশুণ্ড হাসপাতাল থেকে ফিরলো তিন সপ্তাহ পরে; গুলি বের করার পরে ওর সামনের বাঁ পায়ে ভর দিতে পারছে না; খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে পারছে। মিঃ তরফদারের ইচ্ছে – ড্যাশুণ্ড কুকুরটির আর এবাড়ীতে থাকার দরকার নেই, যত শীঘ্র সম্ভব ওকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে মিসেস সোমা তরফদারের বাপের বাড়ীতে; বাবলুর অনুভার সঙ্গে নিয়মিত দেখা করার কতটা দরকার আছে- সে ব্যাপারে  মিসেস সোমা তরফদারের সঙ্গে আলোচনা ক’রবে মিঃ তিমির তরফদার। কেয়াকে বাড়ীর মালিকানা ত্যাগ করার জন্যে জোর করা বা অনুরোধ করার দরকার নেই; কারণ কেয়া কখনও ওর বাবাকে বঞ্চিত ক’রবে না। লাল্টুকে পড়ানোর জন্যে প্রণতির দরকার হবে না; কেয়াই ওকে পড়াতে পারবে।
***
অনুভার মনে হ’য়েছিল যে কিরীটি মিস্ দেবের জন্যে আগ্রহী হ’য়ে উঠবে। কিন্তু, পরে অনুভা হতাশ হ’য়েছিল কারণ, রহস্য সমাধান হওয়ার পরে কিরীটি মিস্ দেবের প্রতি সে-ধরণের আগ্রহ দেখায়নি, নির্লিপ্ত অনুসন্ধানেই কিরীটির বিশেষ দক্ষতা। তবে এই অনুসন্ধানের পরে মিস্ দেবের চাকরী আর রইলো না; কারণ গভর্নেস হিসাবে কারুর কাজ করার দরকার রইলো না। এই অনুসন্ধানের খরচের জন্যে কিরীটি মিস্ দেবকে কোনো বিল পাঠায়নি, বরং যোগাযোগ ক’রেছে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সঙ্গে, যাতে মিস্ দেবকে মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপকের পদের জন্যে সুযোগ দেওয়া হয়। মিস্ দেব কিরীটির গোয়েন্দাগিরিতে দরকারমতো সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
***
হয়তো গোয়েন্দা কিরীটির দরকার ছিল না মিঃ তরফদারের পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ বজায় রাগার; এখানেই এ গোয়েন্দা কাহিনীর ‘সমাপ্তি’ ঘোষণা করা যেতো। কিন্তু কেবল আইনভাঙার দোষের বিশ্লেষণ ক’রে অপরাধীকে দণ্ড দেওয়াতেই নিজের কাজ শেষ ব’লে মনে করেনা কিরীটি; কিরীটি মনে করে ওর কাজ গোয়েন্দাগিরি শেখানো - যে গোয়েন্দাগিরির কাজ কেবল মানুষের খুঁৎ ধরা নয়, দেখা কিসে মানুষের উৎসাহ আসে নতুন কিছু গড়ে তোলার জন্যে, নিজের আত্মীয়-স্বজনদের মুখে হাসি আনার জন্যে, যাতে পরিবারের সকলেই নিজের নিজের খুশিমতো কিছু-না-কিছু ক’রতে পারে, কিছু টাকাও নিয়মিত ঘরে আসে। এর জন্যে কিরীটি প্রথমে আলোচনা ক’রলো সকলের সঙ্গে - মিঃ ও মিসেস্ তরফদার, মিঃ ও মিসেস্ পাকড়াশী, কেয়া, লাল্টু, এমনকি প্রণতি, বাবলু ও শ্যামলও ছিল সে মিটিংএ। তারপর এই নয় জনের প্রত্যেকের সঙ্গে নিয়মিত আলাদা ক’রে মিটিং ক’রলো কিরীটি, কি-করে বাকী আট জনের মুখে হাসি আর কাজে উৎসাহ আনতে পারে।
মিঃ তিমির তরফদারের কাছে কিরীটি জানতে চাইলো, কেন ওর বাবা সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিজের ছেলের হাতে না দিয়ে পুত্রবধূকে দিলেন আর কেনই বা টুলু তরফদার নিজের স্বামীকে না দিয়ে তার কন্যার জন্যে উইল করলো। তিমির বললো, ‘বাবা মনে করতেন, আমি যে ভাবে টাকা খরচ ক’রি তাতে এ সম্পত্তি অল্পদিনের মধ্যেই নিঃশেষ হ’য়ে যাবে। (১) আমার মতে যে ব্যবসায়ে টাকা লাগালে অনেক লাভ হবে, বাবার মতে সে ব্যবসা আমাকে দেউলিয়া ক’রে দেবে। বাবার মতে আমাদের যে প্রিন্টিং প্রেস আর ফটো স্টুডিও আছে সেগুলো ঠিকমতো চালিয়ে যেতে হবে অন্যদিকে মন না দিয়ে। (২) আমি বন্ধুদের জন্যে অনেক খরচ ক’রতাম, ভালো রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আর মদ আনাতুম, যাতে বন্ধুরা আমার হ’য়ে কাজ করে। বাবার মতে যে বন্ধুরা মদ আর ভোজনের জন্যে কাছে আসে, তারা দুর্দিনের সময় পাশে থাকবে না। বাবার কথা যে সত্যি সেকথা বুঝেছি পরে। বাবার ব্যবসার টাকা নিজের জন্য খরচ ক’রতে পরিনি ব’লে বন্ধুরা আমার কাছে আসে না;  কিন্তু  প্রিন্টিং প্রেস আর ফটো স্টুডিও ঠিকই চলছে। ও-দুটোর ম্যানেজারেরা ভালই ব্যবসা চালাচ্ছে।‘
কিরীটি ব’ললো, ‘তাহ’লে আপনি বুঝেছেন যে বাবা কেন আপনার হাতে সম্পত্তি দিতে চান নি। আপনাকে এখন ঐ দুজন ম্যানেজারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে, ওদের কাজ বুঝতে হবে,  যাতে ওদের কেউ ছুটিতে গেলে কাজ চালাতে অসুবিধে না হয়।‘
তিমির ব’ললো, ‘আমি এখন রোজই দুই ম্যানেজারের সঙ্গে কথা ব’লি। ওদের কোনো সমস্যা থাকলে সমাধানের চেষ্টা ক’রি। কিন্তু ওদের লাভ-ক্ষতিতে আমার নিজের কিছু এসে যায় না।‘
কিরীটি ব’ললো, ‘এসে যায়; কারণ সংসারে প্রতিমাসে যা খরচ হয়, তা আসে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে, আর লাভ-ক্ষতির জন্যে ব্যাঙ্কে জমানো টাকা বাড়ে বা কমে। আচ্ছা, আপনি কেয়াকে জোর ক’রে মালিকানা আপনার হাতে তুলে দেবার জন্যে সাইন ক’রতে কেন ব’লেছিলেন?’
তিমির বললো, ‘সোমা বলেছিল, আমার প্রাপ্য অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত ক’রেছে আমার বাবা এবং আমার স্ত্রী টুলু; কেয়া এই দায়িত্বের যোগ্য না হ’য়েও এর মালিক হ’য়ে উঠছে; ওর ছোটবেলাতেই ওকে দিয়ে সই করিয়ে নাও। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে, কেয়া আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে ও ভালবাসে। সময়মতো ও আমার পরামর্শ নেবে; আমাকে কখনও বঞ্চিত ক’রবে না বা ঠকাবে না। আমি ভাবছি, কেয়ার সঙ্গে পরামর্শ ক’রে বাড়ীর পুরোনো অন্ধকার অংশটি মেরামত ক’রে, রং ক’রে নতুন ক’রে তুলবো।‘
 
কিরীটি কেয়ার সাথেও আলাপ ক’রেছে। কেয়াও ওর বাবার জন্যে চিন্তিত; ও বাবার জন্যে বাড়ীতে একটা টেবিল টেনিসের বোর্ড লাগাতে চায়। বাবা নিজের বন্ধুদের ডাকতে পারে খেলার জন্যে। কেয়া আর বয়ফ্রেণ্ড শ্যামলও খেলবে বাবার সঙ্গে। নতুন-মা আর মিস্টার ও মিসেস পাকড়াশীকেও বলবে খেলার জন্যে। লাল্টুও একবার কেয়ার সঙ্গে এসেছিল কিরীটির সঙ্গে দেখা করার জন্যে; লাল্টুও চায় দিদির সঙ্গে আরও বেশী সময় খেলা ক’রতে; খেলার সঙ্গে একটু লেখাপড়া ক’রতে আপত্তি নেই।
 
মিস্টার ও মিসেস পাকড়াশী অর্থাৎ মন্টু ও নীতার সঙ্গে প্রাণ খুলে আলোচনা ক’রলো কিরীটি। ওরা একে অপরের মন বুঝতে চাইলো। নীতা যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে পারে, সেজন্যে ব্যবস্থা ক’রতে গিয়ে বারবার নীতার সঙ্গে আর ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করলো মন্টু, ও মদ খাওয়ার কথা ভুলে গেলো। ছাত্র-ছাত্রীদের তালিকায় সবচেয়ে প্রথমে রইলো কেয়া আর লাল্টুর নাম। সুতরাং, প্রণতিকে গভর্নেস হিসেবে রাখার দরকার নেই মোটা মাইনে দিয়ে। মন্টু আর নীতা আরও বেশী ক’রে চিনলো একে অপরকে, জানলো ওরা দুজনেই গান গাইতে ভালবাসে, আর মন্টু তবলায় ভালোই সঙ্গৎ ক’রতে পারে। নীতা ওর বাপের বাড়ী থেকে ওর হারমোনিয়ামটা নিয়ে এলো; মন্টুও এক জোড়া তবলা কিনলো। এর পর থেকে সুযোগ পেলেই ওরা গানের চর্চ্চা ক’রতো।
 
মিসেস সোমা তরফদারের সঙ্গে আলোচনা করার চেষ্টা ক’রলো কিরীটি; সোমা ব’ললো তিমিরকে বিয়ে ক’রে ও আরও বেশী ক্ষমতা ও সম্পদের আশা ক’রেছিল; সে আশা ওর পূর্ণ হয়নি। সে আশা কি ক’রে পূর্ণ হবে ও জানেনা। কিরীটি ওকে ব’ললো কেয়া, লাল্টু ও তিমিরের সঙ্গে আরও বেশী সময় কাটাতে; এতে ওদের জন্যে নিঃস্বার্থ ভালবাসা হয়তো জেগে উঠবে; সঙ্গে সঙ্গে হয়তো ওদের ভালবাসাও জেগে উঠবে সোমার জন্যে।
 
*** ***
 
এক বছর পরে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র পেয়ে কিরীটি, অনুভা আর প্রণতি হাজির হ’লো তিমির-সোমার বাড়ীতে – কেয়ার বিয়ে শ্যামলের সঙ্গে। প্রণতি দেখলো বাড়ীটির সেই রহস্যজনক অংশটি আর নেই। নেই ওবাড়ীর জানালাগুলোতে কোনো নোংরার জঙ্গল। ঐ অংশটিতে এখন কেয়ার থাকার জায়গা; বিয়ের পরে শ্যামলও এখানে এসে উঠবে। শ্যামল ভালই রোজগার করে; কিন্তু আলাদা বাড়ীর জন্যে খরচ করার বদলে, ও এ বাড়ীর মেরামতের জন্যে টাকা খরচ ক’রেছে; এ বাড়ীতে ঘর-জামাই হ’য়ে থাকতে ওর আপত্তি নেই। এছাড়া, এবাড়ীতেই আছে শ্যামলের নিজের দিদি নীতা আর মন্টু জামাইবাবু। কেয়ার কাছে মিঃ পাকড়াশী আর কাজের লোক নয়, একদিকে মায়ের মন্টুদা, অর্থাৎ ওর মন্টুমামা, অন্যদিকে স্বামী শ্যামলের দিদির স্বামী অর্থাৎ ওর মন্টু জামাইবাবু। কাজেই মিঃ ও মিসেস পাকড়াশীর বাসস্থান কেয়া-শ্যামলের আস্তানার চেয়ে কোনমতেই খাটো নয়।
কিরীটি সবচেয়ে অবাক হ’লো মিসেস সোমা তরফদারকে দেখে, এই এক বছরে অনেক গোয়েন্দাগিরি শিখেছে সোমা; এখন ও তিমিরের সব কথা শুনতে ভালবাসে, ভালবাসে ওর কথা শুনে হাসতে বা কাঁদতে, উত্তর দিতে, নতুন গল্প শুরু ক’রতে। শুরু ক’রেছে রোজ লাঞ্চের পরে তিমিরের সঙ্গে টেবিল টেনিস খেলা। শুধু তিমির কেন, বাড়ীর সকলেরই সুখ-দুঃখ মনের কথা বুঝতে শিখেছে সোমা। কেয়ার উপর জোর ক’রে ওকে সম্পত্তির অধিকার ছেড়ে দিতে বলার দরকার নেই; কেয়াকে ভালবেসেছে সোমা; সোমাকে ভালবেসেছে কেয়া; মা-মেয়ের ভালবাসার জোরে অনেক ক্ষমতাশালী হ’য়ে উঠেছে সোমা। তিমিরকেও সোমা এই একই কথা বুঝিয়েছে; প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্যে খেদ ক’রে লাভ নেই; ভালবাসার অধিকারে জিতে নিতে হবে নতুন মালিক কেয়াকে, নিজেরই স্নেহের মেয়েকে।  সোমার আরও এক গোয়েন্দাগিরির উদাহরণ ওর কুকুর ড্যাশুণ্ডের পরিবর্ত্তন; ড্যাশুণ্ডকে আর ক্ষুধার্ত্ত রাখা হয় না; সোমা ড্যাশুণ্ডের ঘ্রাণশক্তির ব্যবহার ক’রতে শিখেছে; বাজার থেকে কেনা ফলমূলের প্রথম পরীক্ষা করে ড্যাশুণ্ড; যদি ড্যাশুণ্ডের পরীক্ষায় পাশ করে, তবেই সে খাবার স্বাস্থ্যকর ব’লে মানা হয়।
গোয়েন্দা কিরীটির এই ভেবে ভালো লাগলো যে অপরাধের অনুসন্ধান এ পরিবারের সকলের সুখী হওয়ার সম্মান নিয়ে এসেছে। এক সুযোগে কেয়া আর প্রণতিকে একসঙ্গে পেয়ে ওদের পিছন ফিরে দাঁড়াতে ব’ললো কিরীটি – দুজনের পিঠেই আজানুলম্বিত নীল চুলের বাহার; কে কোনজন তা বোঝা দুঃসাধ্য। ওদের মধ্যে একজন অতর্কিতে কিরীটির হাত ধরে ব’ললো, ‘বাবা-মা একমাসের জন্যে কাশ্মীর বেড়াতে যাচ্ছে। প্লীজ কিছুদিন আমাদের বাড়ীতে কাটাও; আমরা গোয়েন্দাগিরি ক’রবো পরস্পরের উপর।‘
********

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু