বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

#হর_পাপং_হর_ক্লেশং

#গল্প

#হর_পাপং_হর_ক্লেশং


#সুজাতা_দে


কেউ চলেছে আবাহনে, কেউ ভেসেছে বিসর্জনে।

তবুও দুর্গারা বাঁচাতে জানে। দুর্গাদের দমিয়ে রাখা যায়না।

শরতের শারদপ্রাতে আলোকমঞ্জরী সাজিয়ে 

মর্ত্যে নেমে আসেন মৃত্তিকারূপী মা দশভূজা।

সমাজের দৈত্যদলনী ও কল্যাণকামী দুর্গারা অশুভ শক্তির বিনাশ করেন ভিন্নরূপে ভিন্ন আঙ্গিকে। 


 নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে গেলে-

অসুস্থ শয্যাশায়ী  বাবার চিকিৎসার দায় এসে পড়ে;

মা মরা পাঁচ ভাইবোনের বড় দিদি সুলেখার কাঁধে।

সুলেখা সেজেগুজে রাতের পরিক্রমায় বের হয়।

পাড়ার লোকে তাই বলে। রাতচরা মেয়ে,নষ্টা মেয়ে।

শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ সাহায্যের হাত বাড়াতে তবু এগিয়ে আসেনা।

একটা টাকাও কারো কাছে হাত পেতে চাইতে ঘৃণা বোধ হয় সুলেখার। আত্মসম্মানে বাধে।


দুপুরে  বস্তির গরীব ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সায় পড়িয়ে দেয় দাশগুপ্ত  বাড়ির উচ্চশিক্ষিতা সুলেখা।

ইঁট বের করা শরিকি দোলতা বাড়িটার প্রায় সব ঘরগুলোই তালাবন্ধ। চাকরি বাকরি সূত্রে শরিকরা চলে গেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শহরে বা শহরের বাইরে। 

এবাড়িতে পড়ে আছে শুধু সুলেখারা ।

 ভগ্নপ্রায় বাড়িটার একতলার দুকামরার একটা ঘরে মাটিতেই আসনপিঁড়ি করে বসে যায় বিভিন্ন বয়সের ছাত্রছাত্রীরা। যে যাই বলুক প্রিয় বড়দি যে ওদের কাছে ভগবান। 


শিক্ষাকে বেচতে পারেনা যে মেয়ে;

কিভাবে সেই মেয়েই শরীর বেচে দেয় অনায়াসে!

ভাইদের পিঠোপিঠি ওর একটা ছোট বোন আছে না?

কি করে বিয়ে হবে তার!

রাক্ষুসির তো নিজের বিয়ের বয়েস পেরিয়ে গেছে।

কানাঘুষোয় উড়ে আসে কতোরকমের  উক্তি,কটুক্তি। 

পরিবারের অন্নপূর্ণা,নিজের  মাস্টার ডিগ্রির সার্টিফিকেটটা কতোবার হাতে ধরে ছিঁড়ে ফেলতে গিয়েও শেষমেশ পারেনা। 

ইতিহাসের ছাত্রীর ইতিহাসের খোঁজ কেউ রাখেনা।

ভালো বেতনের একটা সুস্থ চাকরির জন্য  মামা, কাকা, দাদা, ধরাধরির মতো কেউ নাইবা থাকুক তবু

মা সরস্বতীর  অপমান যে তার নিজের-ই অপমান!

ভদ্র সভ্য চাকরি না জুটলে ক্ষুন্নিবৃত্তি মানতে বাধ্য করে জীবনযাপন। তবে কারো চোখে যা ক্ষুন্নিবৃত্তি অন্যের কাছে তা মহৌষধ। 


 

অসহায় সুলেখার সেদিন একটা চাকরির বড় প্রয়োজন ছিল। জেনারেল কাস্টের বা শিক্ষগত যোগ্যতার কোনো দাম পাওয়া যায় না সহজে। ওবিসি বা নিম্নবর্গের কোনো কাস্ট সার্টিফিকেটও নেই। নিদেনপক্ষে কাউন্সিলরের পরিচয়পত্র লাগবে ইন্টারভিউ শেষে। নাহলে বাতিলের খাতায়। সরকারী চাকরি এখন সোনার পাথরবাটি।

বক্তৃতা ভরা মজলিশের আসরে লোকাল কাউন্সিলর এর কাছে পরিচয়পত্র চাইতে গেলেও যে মোটা টাকার খেলা আছে; তা জানতো না সুলেখা। 

-ভেট; ভেট বলে একে, জানিস না! ওই নেতার পারিষদ ভোলাদা বলেছিল।

ওর শুকনো মুখে মাথা নাড়া দেখে আরও বলেছিল-

বেশ তো টাকা না দিতে পারিস আমাদের দাদাকে তোর পুরুষ্ট বুকে একটু মাথা রাখতে দিস নাহয়।

অফিস ঘরটায় হাস্যরোল উঠেছিল। 

ওই  বিশিষ্ট নেতাদাদার লোভী চোখদুটো চকচক করছিল কামনার আগুনে।

একটানে নিজের বুকের কাপড়টা সরিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলেছিল সুলেখা -

মেয়েদের এই স্তন কি শুধুই ভোগের বস্তু? শিশুর কাছে মায়ের সঞ্জীবনী প্রাণদায়ী সুধার কথা জানা আছে তোমাদের? যতো মূর্খ কাপুরুষের দল।

দুর্গার ভয়ংকর রূপের কাছে সেদিন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল সারা ঘর। তবুও সুলেখার জন্য সামান্য পরিচয়পত্রটুকু মেলেনি সেদিন।


 আলঝাইমার্স রোগে অসুস্থ,শয্যাশায়ী, বয়স্ক ও বিপত্নীক প্রৌঢ় মানুষের সেবার জন্য একজন পার্মানেন্ট রাতের আয়া বা নার্সের প্রয়োজন। মাসিক বেতনে মোটা কাঞ্চনমূল্য মিলবে।


খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনটা আকৃষ্ট করেছিল সুলেখাকে। তিনদিন ডিউটি করার পরে বুঝেছিল দুশ্চরিত্র মানুষটার কাছে কাজ করা যাবেনা। প্রথম দুদিন রাতে খাবার পর ওষুধ খেতে না চাইলে কি করবে বুঝতে পারছিল না সুলেখা। ওনার আবদার গান শোনাতে হবে,মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে। শেষে ওষুধ খেতে রাজি হলেন। ঘুমিয়ে ও পড়লেন চুপচাপ।

 সেদিন শুয়ে থাকা রোগীর মাথাটা যত্নে কোলে তুলে ঝুঁকে রাতের চিকেন স্যুপ খাওয়াচ্ছিল সুলেখা। বুকের কাপড় সরে গিয়েছে অসাবধানে। অসহায় প্রৌঢ় হঠাৎই মাথাটা উঁচু করে ওর বুকে জিব ঠেকিয়ে দিল আচমকা। ছিটকে সরে আসতে গিয়ে কিছুটা স্যুপ পড়ে গেল ওনার রাত পোষাকে। রেগে গিয়ে আঁ আঁ করে এক জান্তব চিৎকার জুড়ে দিলেন উনি। ভয়ে দৌড়ে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল সুলেখা। ওর ধাক্কায় টেবিলে রাখা দামী কাঁচের ফ্লাওয়ার ভাসটা পড়ে গেল। সেই শব্দে উপরতলা থেকে নেমে আসে ওনার পুত্রবধূ। 

 সুলেখা ভয় পেওনা। ভয়ের কিছু নেই। ওনার এটাই অসুখ,সমস্যা। ছোটবেলায় ওনার মা মারা যান, মাঝ বয়েসে স্ত্রীকে হারিয়েছেন । তারপর থেকেই মহিলা দেখলেই উনি এমন করতে থাকেন,বিশেষত রাতে শুতে যাবার আগে। মাঝে মাঝে ভালোই থাকেন,ফের শুরু হয় এইসব অত্যাচার। তাই আমাদের রাতের আয়া আর নার্সদের বদলাতে হয় বারে বারে। তুমি উচ্চশিক্ষিতা মেয়ে।খুব প্রয়োজনে পড়েই নিশ্চয় এই প্রফেশনে এসেছ। তাই সবটা খুলে জানালাম। একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নিও।

চারদিন ওই বাড়িমুখো হয়না সুলেখা।

মোটা টাকার আমদানি বন্ধ। কিন্তু আত্মসম্মান বিকিয়ে...

তিন ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ, এক্সিডেন্টে পঙ্গু শয্যাশায়ী পিতার স্পাইনের অপারেশনের পরেও ব্যয়বহুল চিকিৎসার ব্যয়ভার,বোনের সুশিক্ষা,বিয়ে...  

দাঁতে দাঁত চেপে ঘুরে  দাঁড়ায় সুলেখা।


আলঝাইমার্স এর রোগীদের মনস্তত্ত্ব পড়ে নেয় গুগল সার্চ করে। মা দুর্গা ফের রণসাজে নেমে পড়ে।

এখন বুড়ো শিশুকে দুগ্ধহীন স্তনদান করে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সুলেখা। 

বাধ্য শিশুর মতো সেই সুযোগে রাতের ওষুধগুলো পরপর খেয়ে নেয় অসহায় অসুস্থ আলঝাইমার্সে ভুগতে থাকা প্রৌঢ়। 

 এতে তাঁর তীব্র মাতৃকাঙ্খা নাকি কামনার আগুন- নিভে যায় কিনা জানেনা সুলেখা।

 কিন্ত তার অবিবাহিত ছুঁই ছুঁই তিরিশের শরীরে প্রথম প্রথম আগুন ধরে যেত। ওষুধের কারণে প্রৌঢ় ঘুমিয়ে পড়লেই সে মাঝরাতে ওই রুমের এটাচড বাথে শাওয়ারের  তলায় দাঁড়িয়ে শান্ত, শুদ্ধ করে নিতো নিজেকে।


এই জীবনে অভ্যস্ত সুলেখা এখন পুরোপুরি গ্লানিহীন। মাতৃরূপেন সংস্থিতা বোধে এক অসহায় প্রৌঢ়রূপী শিশুর

জীবনদায়ী ওষুধ সে। 


গত বছর বড়ো ভাইটা কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে সুযোগে পেয়েছে। ছোট ভাইটা এবছর মাধ্যমিক পাশ করল। বোনটা ক্লাস নাইন।বোনটার বিয়ে দিতে পারলেই

এই রাতের আয়ার কাজটা ছেড়ে দেবে,ভাবে সুলেখা। ততোদিনে তার বাবাও নিশ্চয় সুস্থ হয়ে উঠবেন।

ভাইয়েরাও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। লোকের কথার পরোয়া না করার শক্তিটুকু যেন সেদিন পর্য্যন্ত বজায় থাকে।

জগৎজননী মা দুর্গা তাকে নিশ্চয়ই  কৃপা করে এইটুকু শক্তি দেবেন। স্নান সেরে দুহাত কপালে ঠেকায় সুলেখা।


ঠিক তখনই কাছের পূজামন্ডপ থেকে মাইকে ভেসে আসছে দুর্গাপূজার সপ্তমীর অঞ্জলিমন্ত্র...


হর পাপং হর ক্লেশং হর শোকং হরাসুখম।

হর রোগং হর ক্ষোভং হর মারীং হরপ্রিয়ে..।


****************


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু