বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

হঠাৎই আজ

         হঠাৎই আজ একটা আওয়াজ মনটাকে সুদূর অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল মিসেস সেনের। মনে পড়তে থাকল একটা একটা করে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা...। আজকের মিসেস সেন, সেদিনের ঋতপা দত্ত যেদিন প্রথম পা রেখেছিল কলেজে, সেদিন ছিল সদ্য প্রস্ফুটিত কলির মতই সাদাসিধে। কাঞ্চন তপ্ত বর্ণের সাথে ঐ সাদাসিধে ভাবটাই আকৃষ্ট করত সবাইকে। পড়াশোনার ফাঁকে অবসর সময় কাটাতে বিভিন্ন ধরনের কবিতার বই পড়তে পছন্দ করত সে। তাছাড়া বাংলা ভাষার প্রতি টান ওকে প্রবাসী হলেও বাংলা কবিতা আবৃত্তি শুনতে উৎসাহিত করত বরাবরই।


        ঋদ্ধিমান ঠাকরে একজন অবাঙালী হলেও বাংলা ভাষাটা দারুণ রপ্ত করেছিল ছোট থেকেই বাংলায় থাকার সুবাদে। উঠতি বাচিক শিল্পী হিসেবে পরিচিতিটাও ছিলো বেশ ভালোই। কলেজের প্রায় সব অনুষ্ঠানই প্রাণ পেতো ওর কবিতা আবৃত্তি অথবা সঞ্চালনা দিয়ে।


          সেদিন ছিল কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠান। এক বছরের সিনিয়র ঋদ্ধিমান ঠাকরে সেবার নবীনবরণ অনুষ্ঠানে ছিল সঞ্চালক হিসেবে। প্রথম দিন, বুকে ধুকপুকানি নিয়ে অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলো। সেদিন অনেকটা নার্ভাস থাকাতে , সঞ্চালকের চেহারাটা বিশেষ মনে না থাকলেও তার গলারস্বর আর সঞ্চালনা ভীষণ রকম ভাবে মনে গেঁথে গেছিল ঋতপার। তার কন্ঠ স্বরের প্রেমে পড়ার কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকটা ঠিক "কানের ভিতরে দিয়া মরমে পশিলো গো" এর মতন।

     

     তারপর অনেকদিন আর তেমন দেখাশোনা হয়নি তাদের মধ্যে। আর কখনো সখনো সামনা সামনি হলেও পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত ঋতপা খেয়াল করেনি হয়তোবা।


           চাকরি সূত্রে দীর্ঘদিন প্রবাসে কাটিয়ে কিছুদিন হলো ঋতপার বাবা বদলি হয়ে এসেছেন সপরিবারে কোলকাতায়। তাই কলেজের সাথে সাথে ঐ সোসাইটিটা ও নতুনই ছিল ঋতপাদের কাছে। তবে তাদের পুরো পরিবারটাই বেশ মিশুকে স্বভাবের হওয়ার কারনে সবার সঙ্গে পরিচয় গড়তে বা মিলমিশ বাড়াতে খুব একটা সময় লাগেনি ওদের।

 

          এমনি একদিন সকালে সোসাইটির মেয়ে বৌ'রা এসে সদলবলে হাজির হয়  সোসাইটির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সক্রিয় যোগদানের জন্য ঋতপার নাম নথিভুক্ত করতে। সেবার একটা সমবেত সঙ্গীত আর অতিথিদের চন্দন পরিয়ে অভ্যর্থনা করার দ্বায়িত্ব পড়েছিল নবাগতা ঋতপা ও তার ওখানকার সাথীদের উপরে। সেখানে ঋদ্ধিমান এসেছিল আমন্ত্রিত বাচিকশিল্পী হিসেবে। আনুষ্ঠানিক ভাবে বলতে গেলে প্রথম পরিচয়টা ওখানেই। সেদিন ঋতপা একতরফা প্রেমে পড়েছিল কিনা জানেনা, তবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে গেছিল তার একের পর এক করে যাওয়া আবৃত্তি গুলো।


              কন্ঠস্বরে একরাশ মুগ্ধতা যে ছড়িয়ে দিয়ে গেছিল ঋদ্ধিমান সেদিন ঋতপার মনের সাথে জীবনেও তাতে কোন সন্দেহ ছিলো না। মনে মনে ঋতপা সারারাত ধরে আওড়েছিল কবিতার লাইন কটা। এক অদ্ভুত আবেশে ঋতপার কেটেছিল সেই রাত। পরদিন কলেজ পৌঁছে একবার চোখের দেখা দেখবার যা উদগ্র বাসনা ছিল ঋতপার মনে তা যে একতরফা নয়, সেটা  বুঝতে পেরেছিল কলেজে পৌছানোর পরপরই। সে'দিন থেকেই বলতে গেলে ঋতপা একনিষ্ঠ ভাবে শিখতে শুরু করে আবৃত্তি আর উপস্থাপনা ঋদ্ধিমানের সাথে একমঞ্চে উপস্থিত হবার অভিলাষে।


          কলেজ ক্যাম্পাসেও ঋদ্ধিমান এর কন্ঠস্বরের ভক্ত কম ছিলনা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে। তার গলারস্বর, বাচনভঙ্গিতে কত মেয়ে যে প্রেম নিবেদন করেছে তা বলাই বাহুল্য। তাদেখে মনে মনে কেবল রাগইনা ভয়ও হতো খুব ঋতপার। কখনো কখনো ঋদ্ধিমানকে না পাওয়ার চিন্তায় রাতে ঘুম আসতো না তার। এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করত লাগলো সে ঋদ্ধিমানের জন্যে। আপন মনে তার প্রেমে হারিয়ে যেতে যেতে ঋতপা বন্ধ ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কত যে কথা, কত যে কবিতা পাঠ করত তখন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।


        এভাবে চলতে চলতেই একদিন এক অনুষ্ঠানে সুযোগ এসে গেল দু'জনের একই মঞ্চে পাঠ করার। সেই প্রথম স্বপ্ন সার্থক হতে দেখতে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা ঋতপা। অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে প্রথম বার মুখোমুখি আলাপ হলো তার মনের মানুষের সাথে।


          এর পর কলেজ শেষ করে দুজনেই তখন ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। একই ক্যাম্পাসে হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন রিহার্সালে দেখা হতো প্রায়ই। কথাও হতো টুকটাক। এমনি চলতে চলতে একটা সময়ে দুজনেই মুগ্ধ দুজনের আবৃত্তিতে। মুগ্ধতা মগ্ন করেছে দু'জনকে দুজনের প্রেমে। একটু সময় পেলেই দুজনে ক্যান্টিনে বসে কিম্বা নিরিবিলিতে বসতো। কখনো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতো। পাশাপাশি বসে স্বপ্ন সাজাতো তাদের ভবিষ্যতের পথ।


            ইউনিভার্সিটিতে দুর্দান্ত রেজাল্ট করেও ঋদ্ধিমান চাকরি করতে না গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবৃত্তি নাটক থিয়েটার নিয়ে। এদিকে ঋতপার বাবা মা ব্যস্ত হয়ে পড়েন তার বিয়ের জন্য। শেষে ভালো পরিবার ও চাকরী দেখে বয়সের বেশ কিছুটা পার্থক্যের ছেলের সাথে প্রায় বিয়ে ঠিক করে দেন ঋতপার।


           অন্যদিকে ঋদ্ধিমানের ধ্যান জ্ঞান তখনও মঞ্চ। ভালোবাসা থাকলেও বিযের ব্যাপারে একেবারেই অপ্রস্তুত অপারগ তার সাথে পরিবারের বিরূপতা। তাই বেকার ঋদ্ধিমানের জন্য সময় দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও পরিবারে মা বাবার যুক্তির সামনে তা একেবারে ধোপে টেকাতে পারেনি ঋতপা। কিছুটা বাবার বয়সের কথা ভেবে আর অনেকটা ঋদ্ধিমানের উপর অভিমান করেও শেষ পর্যন্ত মত দিয়ে দেয় সেই বিয়েতে।


         ‌‌ এভাবেই জীবনের গতিতে ঋদ্ধিমানের উদাস নীতির ফলে আর অভিভাবকদের হস্তক্ষেপে আলাদা হয়ে যায় দুজনের পথ দুদিকে। ঋদ্ধিমানের না হলেও ঋতপার ছন্দ পতন ঘটে জীবনের কবিতায়।


             বিয়ের পর আর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেনি ঋতপা। এক বুক অভিমান নিয়ে মন দিয়েছিল সংসারের দিকে। এক মেয়ে নিয়ে স্বামী স্ত্রীর সংসারে কবিতাকে আর ঢুকতে দেয়নি সে, পাছে তার অতীত তাকে তাড়া করে আবার! মেয়েকে ব্যস্ত রেখেছে অন্য ভাবে। তবু নিয়তির কি পরিহাস! আজ তার মেয়েও সেই মানুষটির কন্ঠ স্বরের অনুরক্ত।


          পাশের বাড়ি থেকে সমবয়সী বন্ধুর ডাক আসতেই , এফ এম ওর গুড মরনিং ইন্ডিয়া শুনতে শুনতে মায়ের কানে ইয়ার ফোনটা আচমকা গুঁজে দিয়ে চলে যায় ব্যালকনিতে বন্ধুর সাথে কথা বলতে। এতো বছর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছবি দেখলেও কখনো শোনা হয়ে ওঠেনি তার আওয়াজ। এড়িয়ে গেছে ইচ্ছে করেই। আজকে মেয়ের কলেজ ক্যাম্পাসে ঋদ্ধিমান ঠাকরে আসছে আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পী হিসেবে। কথা শেষ করে মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করে ," মা আজকের এই স্পেশাল দিনে কি পরে যাই ? বলনা! যাতে সবাই নোটিশ করবে আমায় আর বিশেষ করে ঐ আর জেও ?

           উত্তেজনায় টগবগ করতে থাকা মেয়ের, মাকে অন্যমনস্ক দেখে আলতো ধাক্কা দিতেই স্বম্বিত ফেরে মায়ের। শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ, আজকের মিসেস সেন, সেদিনের ঋতপা দত্ত। এখনো গলা সেই দরাজ, সেই একই মাদকতা তার বাচনভঙ্গিতে। হঠাৎ করে শুনে এতো বছর পরেও চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাদের মঞ্চস্থ যুগলবন্দীর কিছু লাইন। বিড়বিড় করে আওড়াতে চেয়েও গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসা কিছু একটা জিনিস যেনো চেপে ধরে আছে তার কন্ঠস্বর।

               স্পিকারে আরজে ঋদ্ধিমানের গলার স্বর শুনতে শুনতে নিজের স্বর যেনো হাতরে চলেছে সে তখনো। গলা দিয়ে আর একটা শব্দও বেরোচ্ছে না তার ...

DCR

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু