বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

তিষ্ঠ ক্ষণকাল!

ডিসেম্বরের ছুটির এক দুপুর; মধ্যাহ্ন ভোজনে দেহমন ভরপুর; এসেছে ঘুমের, শীতের আমেজ।

গা-হাত-পা কম্বলে মুড়ি, ভাবলাম এবার শুয়ে পড়ি; আকাশে মেঘ, নেই রোদ্দুরের কোনো তেজ।

হোয়াটস্ অ্যাপে রিমাইণ্ডার – বাইরে যাওয়ার খুব দরকার; বসের বাড়ীতে এক বিষণ্ণ শোকসভায়।

ভুলতে হ’লো ঘুমের আরাম, অফিসের ড্রেস গায়ে চড়ালাম; নিলাম ফুলের তোড়া, জানাতে বিদায়।

 

পৌঁছালাম অচিরে শোকসভায়; আরাধনা সাদা ফুলের শোভায়, লজ্জিত আমি উদ্ধত পশ্চিমী সজ্জায়।

বস আজ এক ভারতীয় নারী, প’রেছে সাদা লালপাড় শাড়ী, ওঁর বাবার ছবির সমুখে নতমুখ শ্রদ্ধায়। 

হতবাক আমি বসকে দেখে, এ-বেশে কোনোদিন দেখিনি ওঁকে, শুনিনি কখনও ওঁর মুখে বাবার কথা;

কোনো কিছু বলার সময় নেই, চুপি চুপি চেয়ারে নিই ঠাঁই; সমবেত সকলেরই নীরব শান্ত মুখ সেথা।

 

 

……..বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নীচু হ’য়ে প্রণাম ক’রলো সৃজা; তারপরে ডায়াসে দাঁড়িয়ে শুরু ক’রলো ওর বক্তৃতা,- বক্তৃতা নয়, বাবার ছবির সঙ্গে ওর কথা:-

“বাবা, আজ তোমাকে বিদায় জানাতে এসে শুরু ক’রছি তোমারই বারবার বলা গল্প দিয়ে। এই গল্পটি আমার প্রথম শোনা গল্প। কতবার যে তোমার কাছে শুনেছি এ গল্প, তার হিসেব করা আমার অসাধ্য। প্রতিদিন রাত্রে তোমার কাছে এ গল্পটা না শুনলে আমার ঘুম আসতো না। প্রথম প্রথম অনেক কথার মানে বুঝতাম না; তাই তুমিও খুব অল্প কথায় গল্প ব’লতে; গল্পের বেশীর ভাগ বুঝতাম তোমাকে দেখে, তোমার হাত-পা নাড়ানো দেখে, তোমার নানান্ রকম গলার স্বর শুনে। হাতী বা বাঘ কি ভাষায় কথা বলে জানিনা, কিন্তু তোমার গলায় শুনে অনায়াসে বুঝতে পারতাম কে কথা ব’লছে – সে হাতীই হোক্ বা বাঘ বা অন্য কোনো জন্তু। হাতীর শুঁড় দোলানোটা পরে মিলিয়ে দেখেছিলাম দেওয়াল ঘড়ির সঙ্গে। বাঁই বাঁই ক’রে ঘুরিয়ে যে জোরে ছুঁড়ে দেওয়া যায় সেটা বুঝে গিয়েছিলাম আমার কথা ব’লতে শেখার পরেই; এর অনেক অনেক পরে শিখেছি centrifugal force কাকে বলে।

আর বেশী ভূমিকা না ক’রে গল্পটা ব’লে নিই; দেখো আমার ঠিকমতো মনে আছে কিনা; তুমিও প্রতিদিনই একটু নতুন ক’রে ব’লতে, একটু নতুন নতুন শব্দ জুড়ে দিতে। আমারটাও একটু আলাদা হ’তেই পারে।…

……..’দুপুরের খাওয়াটা বেশ ভালো হয়েছে ; বনের একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো হাতী। তার লম্বা শুঁড়টা দুলতে রইলো পেণ্ডুলামের মতো এপাশ থেকে ওপাশ – ডিং ডং, ডিং ডং।

ওদিকে বাঘও বেড়াতে বেরিয়েছে; বেড়াতে বেড়াতে এসে পড়লো বনের পাশে হাতীর কাছে। হাতীর দোদুল দোলা ঝোলানো শুঁড়টা দেখে ভারী মজা লাগলো বাঘের, ভাবলো শুঁড় ধরে একটু ঝুলে নিই, দুলে নিই। লাফ দিয়ে হাতীর শুঁড়ের ডগাটা কামড়ে ধরলো বাঘ, ঝুলতে লাগলো দোদুল-দুল।

হাতীর ঘুম গেলো ভেঙ্গে, হাতী ক্ষেপে উঠলো রেগে; শুঁড় দিয়ে ধ’রে বাঘকে তুলে ধ’রলো মাথার উপরে; বাঁই-বাঁই করে ঘোরালো তিনবার, ছুঁড়ে দিল বাঘটাকে, শূণ্যে অনেক জোরে, অনেক দূরে।

বাঘটা উড়ে গিয়ে পড়লো দূরে, একটা পুকুরে। একটা মস্ত কুমীর ছিলো সেই পুকুরে, ওৎ পেতে, হাঁ করে; ঠিক সেই হাঁয়ের মধ্যে গিয়ে পড়লো বাঘটা।

কুমীর সঙ্গে-সঙ্গে বন্ধ ক’রলো তার মুখটা, তার ধারালো দাঁতের চাপে দুখান হ’লো বাঘটা। বাঘের কোমর থেকে দুটো পা-সমেত পেছনের আধখানা রইলো কুমীরের মুখের মধ্যে; মাথা-সমেত বাঘের সামনের আধখানা পুকুরের জলে সাঁতার কাটতে রইলো সামনের দুটো পাদিয়ে, পেছনের আধখানার কথা খেয়ালই নেই বাঘের। বাঘের রক্তে পুকুরের জল উঠলো লাল হ’য়ে।

ওদিকে হাতী চলতে শুরু ক’রেছে বাঘকে ছুঁড়ে দেওয়ার পরেই। চলতে চলতে হাতী এসে পড়লো সেই পুকুরের কাছে; দেখলো আধখানা বাঘ জলে সাঁতার কাটছে। বাঘের জন্যে খুব কষ্ট হ’লো হাতীর মনে। ওকে বাঁচাতে চাইলো হাতী। কুমীরকে হুকুম দিলো মুখ হাঁ করার জন্যে।

কুমীর যেই হাঁ কোরলো, ওর মুখ থেকে বাঘের পেছনের আধখানা তুলে নিজের পিঠে চাপালো হাতী; তারপর জলে ভাসা বাঘের সামনেটাকেও পিঠে তুলে নিলো।

হাতীর পিঠে এখন পুরো বাঘটাই, কিন্তু দু-আধখানা করে ভাগ করা। হাতীর মোটা মাথায় এখন বড়ো চিন্তা – কী করে জোড়া যাবে দুটো আধখানাকে?

হাতী খুঁজতে বেরোলো কে জুড়তে পারবে বাঘের দুটো আধখানাকে। খুঁজতে খুঁজতে হাতী গেলো বাবুই পাখীর কাছে,- “বাবুই ভায়া, এই দুটো টুকরোকে জুড়ে দাওনা ভাই!”

“ও আমার কম্মো নয়” – ব’ললো বাবুই, - “আমি খড়ের সুতো দিয়ে বাসা বুনি, কিন্তু বাঘ সেলাই ক’রতে পারবো না। বাঘের দুটুকরো জুড়তে চাই সেলাই মেশিন।“

হাতী আর বাবুই মাথা চুলকে ভেবে মরে – কী ক’রবে তারা? কী ক’রে জুড়বে দুটো আধা বাঘ?

“যাওয়া যাক পুটুমের বাড়ী।“, - ঠিক ক’রলো তারা।

বাবুই ব’সলো হাতীর মাথায়। মাঝে মাঝে বাবুই হাতীর মাথা থেকে উঠে উড়ে উড়ে দেখায় পুটুমের বাড়ীর পথ, আর হাতী যখন ঠিক সোজা পথে চলে তখন আবার মাথায় এসে বসে। বাঘের দুটো আধখানা পিঠে নিয়ে হাতী চললো পুটুমের বাড়ীর দিকে।

শুঁড় দিয়ে ধাক্কা মারলো হাতী পুটুমের বাড়ীর দরজায়। পুটুম দরজা খুলে অবাক। দরজা ভাঙতে হ’লো হাতীকে ঘরে ঢোকানোর জন্যে।

হাতী পুটুমকে খুলে ব’ললো সব কথা, ব’ললো “বাঘকে বাঁচাও, জুড়ে দাও বাঘের দুটো আধখানা।“

পুটুমেরও মন গললো, সে একটা সাদা চাদর পেতে দিলো লম্বা টেবিলে, হাতী তার উপর শোয়ালো বাঘের দুটো আধখানাকে।

পুটুমের মা এলো তার সেলাইকল নিয়ে; বাঘের দু টুকরোকে চেপে ধরে সেলাই ক’রে জুড়ে দিলো।

“সেলাই করা বাঘ – এখন কি ঠিকঠাক?”- জিগ্যেস ক’রলো হাতী।

চতুর পুটুম নিয়ে এলো একটা দুধের বোতল, পুরে দিলো বাঘের মুখে, দেখবে দুধ পড়ে কিনা সেলাইয়ের জোড় থেকে।

সেলাই একদম ঠিকঠাক। বাঘ মন ভ’রে দুধ খেলো বোতলে মুখ দিয়ে। মুখ থেকে গলা দিয়ে দুধ নামলো বাঘের পেটে, একফোঁটাও পড়লো না সেলাইয়ের ফাঁক দিয়ে। বোতলের দুধ শেষ ক’রে ঘুমিয়ে পড়লো বাঘ।

এই সুযোগে পুটুমও দুধ খেলো, তার চোখজুড়ে এলো ঘুম।

তার পরেই ঘুমিয়ে পড়লো পুটুমের মা আর বাবা। গল্পের হোলো শেষ।‘

 

শেষবার এই গল্পটির কিছুটা ব’লেছিলে আমার বিয়ের রিশেপসনের সন্ধ্যায়। আবার আমি পুটুম হ’য়েছিলাম, না কেঁদে থাকতে পারিনি।

 

 

এরপর একটু থেমে আবার সুরু ক’রলো সৃজা, বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে।

“ছোটবেলায় একবার অঙ্কে ফেল ক’রেছিলাম। আমি তোমাকে অফিসে ফোন ক’রে ব’লেছিলাম যে আমি আর অঙ্ক নিয়ে পড়বো না; অন্য কিছু পড়বো।

তুমি উত্তরে ব’লেছিলে, ‘তোমার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে অঙ্কে ফেল ক’রতে পারেনা। আমি বাড়ীতে ফিরে দেখবো তুমি কোন্ কোন্ বই পড়ো আর কিভাবে পড়ো।’

বাড়ীতে আমার বইগুলো দেখে তুমি ব’লেছিলে, ‘এ বইগুলো পড়লেই হবে। তবে প্রত্যেক বইয়ের গোড়া থেকে শুরু ক’রতে হবে। তোমাদের ক্লাসে বীজগণিতের কুড়িটা চ্যাপ্টার পড়ানো হ’য়ে গেছে; এখন একুশ নম্বর চ্যাপ্টার পড়াচ্ছে, আর তোমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। প্রথমে দেখো, এই চ্যাপ্টারের সমাধান করা অঙ্কগুলো বুঝতে পারো কিনা, বুঝতে পারলে একই পদ্ধতিতে ঐ চ্যাপ্টারের প্রশ্নগুলোর সমাধান করো।‘

আমি ব’লেছিলাম, ‘এই চ্যাপ্টারের সমাধান করা অঙ্কগুলো বুঝতে পারছিনা।‘

তুমি বলেছিলে, ‘প্রথম চ্যাপ্টার থেকে শুরু করো; ঐ চ্যাপ্টারের শেষ চারটি প্রশ্নের সমাধান করো; না পারলে সমাধান করা অঙ্কগুলো দেখে বোঝার চেষ্টা করো।‘

আমি পেরেছিলাম, প্রথম চ্যাপ্টার থেকে শুরু ক’রে, ধ’রে ফেলেছিলাম ক্লাসের আর সবাইকে।  স্কুলের টিচাররাও বেশ অবাক হচ্ছিলেন। ক্লাসে যে অঙ্কই দেওয়া হোক, সবার আগে ক’রে ফেলছিলাম আমি।    রেজাল্ট যেদিন বেরোল, সেদিন স্কুলের সবাই হতবাক! একশোয় একশো!

তুমি রেজাল্ট দেখে ব’লেছিলে, ‘আমি জানতাম তোমার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ের কাছে অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইকনমিক্স কখনই দুর্বোধ্য হ’তে পারে না। প্রথম দিকে একটু সময় দিতে হবে ভিতটা শক্ত করার জন্যে; তারপরে প্রাসাদ তুলতে সময় লাগবেনা।“

 

 

একটু থেমে সুরু ক’রলো সৃজা, বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে।

“বাবা, তুমি আমাদের জীবনে এক বিরাট পরিবর্ত্তন এনেছিলে ভারতবর্ষ ছেড়ে কানাডাতে এসে। আজ আমি যে এতটা উঠতে পেরেছি, তার মূল কারণ কানাডাতে পড়াশোনা ক’রতে পাওয়ার সুযোগ।

কানাডাতে বাছাই-করা ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে ভর্ত্তি হওয়ার জন্যেও তোমার উৎসাহ হয়তো আমার চাইতে বেশী ছিল। ইনফর্মেশন টেকনোলজিতে ডিগ্রী করার প্রথম প্রেরণা এসেছিল তোমার কাছ থেকে; ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই যখন হাজার ডলারের স্কলারশিপ নিয়ে পড়া শুরু ক’রলুম, ভেবেছিলুম- পৃথিবী জয় ক’রে ফেলেছি। ইউনিভার্সিটিতে পেলাম সহপাঠী ক্যামেরুনকে, যে এখন আমার জীবনসঙ্গী। ক্যামেরুন বারবার ধন্যবাদ জানিয়েছে তোমাকে; তুমি যদি আমাকে কানাডাতে না নিয়ে আসতে আর ঐ ইউনিভার্সিটিতে ভর্ত্তি না ক’রতে, ক্যামেরুন ও আমি কখনও পরশপাথর খুঁজে পেতাম না পরস্পরের মধ্যে।“

“কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পরে, তোমার জীবনদর্শন দুর্বোধ্য হ’য়ে উঠলো। তুমি নেমে পড়লে সীমান্তহীন বিবাহবিহীন জগৎ প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। তোমারই লেখা গল্প না ব’লে পারছিনা।…

 

“ওয়েলিংটনের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক অভিনব ইতিহাস লেখা হ’লো। দিনের প্রথম বিমান ওড়ার কথা সকাল ৬টায় ফিলাডেলফিয়া যাবার জন্যে। ভোর আড়াইটের সময় খুললো ৪টে ইকনমি ক্লাসের আর ২টি বিজনেস-ফার্স্ট ক্লাসের চেক-ইন কাউন্টার। ‘অনুগ্রহ ক’রে আপনার টিকিট আর পাসপোর্ট দেখান’। একসঙ্গে ব’ললো ৬-টি চেক-ইন কাউন্টারের ৬-জন বিমানসংস্থার কর্মী সামনের ৬-জন যাত্রীকে।

প্রত্যেক চেক-ইন কাউন্টারে অপেক্ষমান যাত্রী জমা দিলো তার পাসপোর্ট আর কাগজপত্র।  বিমানসংস্থার কর্মী ই-টিকিট দেখার পর ব’ললো- ‘তাহলে আপনি যাচ্ছেন ফিলাডেলফিয়া’। পাসপোর্টের ফটোর সঙ্গে মিলিয়ে নিলো যাত্রীর মুখ। সব ঠিকঠাক। তারপরে নজর দিল পাসপোর্টে ইউএসএ যাবার ভিসার দিকে। ভিসার কোনো হদিশ নেই।

‘এই পাসপোর্টে ইউএসএ যাবার ভিসা নেই। পুরোনো পাসপোর্টে থাকলে দেখান’।  বিমানসংস্থার কর্মী জিগ্যেস ক’রলো।

‘ইউএসএ যাবার ভিসার দরকার নেই আমার, আমি পৃথিবীর নাগরিক’- যাত্রীর উত্তর এলো।

‘না মশায়,’ বিমানসংস্থার কর্মীর উত্তর, ‘পাসপোর্ট অনুযায়ী আপনি নিউজিল্যান্ডের নাগরিক। ভিসা ছাড়া আপনাকে প্লেনে উঠতে দেওয়া হবে না। কোনো মাল আছে কি আপনার সঙ্গে?’

‘না, আমার সঙ্গে যাবে কেবল এই কেবিন ব্যাগটা’। উত্তর দিলো যাত্রী।

‘আপনি প্লিজ একটু পাশে দাঁড়ান আর আপনার পরের যাত্রীকে এগিয়ে আসতে দিন’ এ কথা ব’লেই বিমানসংস্থার কর্মী মুখ ফেরাল অন্য চেক-ইন কাউন্টারগুলোর দিকে। ঠিক একই কথার যেন প্রতিধ্বনি শুনলো বাকি পাঁচটা কাউন্টার থেকে।

যে-ক’জন যাত্রী হাজির হ’য়েছে চেক-ইন করার জন্যে, তাদের কারও কাছেই একটা কেবিন ব্যাগ ছাড়া আর কোনো সুটকেশ নেই। কারও পাসপোর্টেই নেই আমেরিকা যাওয়ার ভিসা। কেউই সরে দাঁড়াল না পরের যাত্রীর জন্যে পথ ক’রে দিতে। বিমানসংস্থার কর্মীরা যাত্রীদের লাইনের দিকে তাকালো– কারও সঙ্গেই নেই কোনো ভারী ব্যাগ, সবাই যেন লাইন দিয়েছে বাসে ওঠার জন্যে, বিমানে চড়ার জন্যে নয়।

প্রত্যেক কাউন্টারেই যাত্রী তার টিকিট আর পাসপোর্ট দেখিয়েছে, কিন্তু কারও সঙ্গে ভিসা নেই গন্তব্যস্থলে যাওয়ার জন্যে। বিমানসংস্থার কর্মীরা এরকম ঘটনার জন্যে প্রস্তুত ছিল না, তাই বসকে ফোন ক’রলো নির্দেশ চেয়ে। নিরাপত্তা বাহিনীর ডাক পড়লো– যে যাত্রীরা চেক-ইন কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাশ না নিয়ে নড়তে চায়নি, তাদের গ্রেপ্তার করা হ’লো। ছয়জন যাত্রী গ্রেপ্তার হ’লো। এগিয়ে এলো আরো ছয়জন। তাদের কারও কাছেও ভিসা নেই। তারাও কেউ কাউন্টার থেকে সরে দাঁড়ালো না পেছনের যাত্রীর জন্যে। তারাও গ্রেফতার হ’লো।

এরপরে এগিয়ে এলো আরও ছয়জন যাত্রী। তাদেরও একই অবস্থা পাসপোর্ট-ভিসার। তারাও গ্রেফতার হ’লো। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হ’য়েই চললো।  অবশেষে যে ২১৫ জন যাত্রী এসেছিল বিমানে চড়ার জন্যে তাদের সকলেই গ্রেফতার  হ’লো। বোর্ডিং পাশ দেওয়া হ’লো না কোনো যাত্রীকে। কোনো ভারী মালপত্র উঠলো না লাগেজ বেল্টে, বিমানের খোল বা হোল্ডে যাবার জন্যে। ফ্লাইট বাতিল হ’লো।

ওয়েলিংটন বিমানবন্দর থেকে এর পরের উড়ানেরও একই দশা হ’লো। কারণ, এই উড়ানেরও সব যাত্রী বিদেশে যাবার ভিসা ছাড়াই হাজির হ’য়েছে বিদেশ যাওয়ার জন্যে। তার পরের উড়ানের অবস্থাও কিছু আলাদা হ’লো না।  সারাদিন কোনো বিদেশগামী বিমান ছাড়লো না ওয়েলিংটন বিমানবন্দর থেকে। কিছু পরে খবর পাওয়া গেলো নিউজিলান্ডের অন্য বিমানবন্দর থেকে যে, সারাদিনে নিউজিল্যান্ডের কোনো বিমানবন্দর থেকে কোনো আন্তর্জাতিক উড়ান ছাড়েনি।

কয়েকঘন্টা পরে একই ঘটনা ঘটলো সিডনী, মেলবোর্ন, সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক, কুয়ালালামপুর এবং অন্যান্য বিমানবন্দরে। কেউ জাল বিছিয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে, পৃথিবীর প্রতি বিমানবন্দরের প্রতিটি আন্তর্জাতিক উড়ানের প্রতিটি সিটের টিকিট কাটার জন্যে যাত্রীর ব্যবস্থা ক’রেছে। 

পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে, প্রত্যেক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চললো ভিসার আইন অমান্য করার একটানা অহিংস আন্দোলন। এক দেশ থেকে আর এক দেশে যাওয়ার সমস্ত আন্তর্জাতিক উড়ান হ’লো স্থগিত। অতর্কিত পূর্ণচ্ছেদ পড়লো শুধু বিমান উড়ানেই নয়- কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বীমার বেচাকেনা বন্ধ ক’রলো যাবতীয় ইনসুর‍্যান্স কোম্পানি। বিমানবন্দরের কর্মচারীদের কোনো কাজ রইল না করার মতো। শূন্য হ’লো বিমানবন্দরের তহবিল। কোনো আয় না থাকলে কর্মচারীদের মাইনে কীভাবে দেওয়া হবে তা নিয়ে চিন্তিত হ’লো বিমানবন্দরের কর্তৃপক্ষ। দিনের পর দিন ভিসাহীন যাত্রীদের কারাগারে ভরার পর কারাগারেও স্থান সংকুলানের সমস্যা দেখা দিলো। স্থগিত রইলো যাবতীয় আমদানি-রপ্তানী। বিমান-পরিবহন শিল্পের অনুরোধে জরুরী মিটিং ডাকলো ইউএনও। কিন্তু ইউএনও-এর সভ্যদের এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে মিটিং করার উপায় নেই। সমস্ত উড়ানই বাতিল হ’য়ে গেছে। মিটিং হ’লো স্কাইপে।

কী করবে এখন ইউএনও?  ইউএনও-এর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা দেখলেন, ‘বীরু’ নামে একজন সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়, কোটি-কোটি লোক ট্যুইটার-ফেসবুকে তার কথা শোনার জন্যে উদগ্রীব। ইউএনও আদেশ দিল ‘বীরু’কে গ্রেফতার ক’রে জিজ্ঞাসাবাদ করার, যাতে পৃথিবীর মানুষের আইন-ভাঙ্গার আন্দোলন থামানো যায়, পরিস্থিতিকে আনা যায় আয়ত্ত্বের মধ্যে। কিন্তু কী করে গ্রেফতার করা যাবে ‘বীরু’কে? অগুন্তি মানুষের দাবি তারা প্রত্যেকে এক একজন  ‘বীরু’, কিন্তু কে আসল ‘বীরু’? পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যেন হঠাৎ ‘বীরু’ হ’য়ে গিয়েছে।

ইউএনও-এর  সমৃদ্ধশালী দেশের প্রতিনিধিদের আদেশ অনুযায়ী গ্রেফতার করা হ’লো প্রতি ভিসা-ছাড়া যাত্রীকে।  এদের জিজ্ঞাসাবাদের পর দুটি নাম এলো সকলের মুখে – একটি ‘বীরু’র আর অন্যটি বাবা তোমার।  কোন্ বীরুকে গ্রেফতার ক’রবে পুলিশ? পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য মানুষ হাত বাড়ালো  বীরুর পরিচয় দিয়ে, কিন্তু আসল বীরুর হদিশ পেলো না নিরাপত্তা বাহিনী।  জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে গ্রেফতার হ’লে তুমি।

তদন্ত চললো তোমাকে নিয়ে, তোমার মগজ নিয়ে। প্রমাণ হ’লো তুমি নির্দোষ, কোনোদিন হিংসার আশ্রয় নাওনি।

কর্ম্মজীবন থেকে  অবসর নিয়ে লিখলে অনেক বই সীমান্তহীন বিবাহবিহীন জগতের জীবনদর্শন নিয়ে, বিবাহিত জীবনে বিতৃষ্ণা নিয়ে। কোভিডের মহামারী শুরু হওয়ার আগেই তুমি হ’লে নিরুদ্দেশ….

গতকাল তোমার মৃত্যু-সংবাদ পেলাম কলকাতা থেকে।….”

 

অনুষ্ঠানের শেষে বস সৃজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম, মনে রইলো এক হাতী আর বাঘ নিয়ে ওঁর বাবার ঘুমপাড়ানী গল্প। এই প্রথম জানলুম যে আমার জাঁদরেল বস সৃজা ছিল অঙ্কে কাঁচা, ওঁর বাবা ওঁকে শিখিয়েছিল ধৈর্য্য ধ’রে পড়তে। ভাবলাম বসকে কোনোদিন একা পেলে জিগ্যেস ক’রবো ওঁর বাবা কেন নিরুদ্দেশ হ’য়েছিলেন, আর কিভাবে উনি বাবার মৃত্যুসংবাদ পেলেন।

***সমাপ্ত***

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু