বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

স্বর্গ থেকে স্বর্গ গড়ার ডাক

২০২১এর ১৩ই নভেম্বর দুপুর বারোটায় সিডনীতে বসে পেলাম এই দুঃসংবাদ – দাদাভাই আর নেই। কলকাতা থেকে ওঁর ছেলে হোয়াটস্ অ্যাপ ক’রে জানিয়েছে আজ ওখানের সকাল ছ-টায় দাদাভাইয়ের শেষ নিঃশ্বাস মিলিয়ে গেছে কলকাতার আকাশে। এ মেসেজের উত্তর দেবার ভাষা আমার জানা নেই। পারলে একবার দাদাভাইকেই জিগ্যেস ক’রে আসতাম – এর পরে কী বলা যায়; জীবনে অনেকবার গল্প-কবিতা লিখে দাদাভাইকে পাঠিয়েছি আমার কথাগুলো বলা হ’য়েছে কিনা বুঝে নিতে, ব’লে দিতে কী ক’রে ব’ললে পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে; আমার প্রথম উপন্যাসের প্রচ্ছদপটে দাদাভাইয়ের আঁকা ছবি দিয়ে শুরু ক’রেছি। আজকের এই লেখার সময় সে সুযোগ আর নেই, চাইলেও দাদাভাইকে জিগ্যেস করা যাবেনা। জানলার বাইরে চোখ পড়লো, সবুজ পাতাভরা গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশের নীল চোখে পড়ছে, শোনা যাচ্ছে পাখীদের কোলাহল; ওরা কেউ কি বুঝেছে দাদাভাই আর নেই ঐ নীল সবুজ ছবি আঁকার জন্যে, পাখীদের কাকলী কবিতায় ধ’রে রাখার জন্যে।

দাদাভাই আমার ভায়রাভাই, আমার স্ত্রীর জামাইবাবু, আমার স্ত্রী ওঁকে দাদাভাই ব’লে সম্বোধন করে; তাই উনি আমারও দাদাভাই হ’য়ে উঠলেন; একথা বলা হয়তো বাহুল্য যে ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ হ’য়েছিল আমার বিয়ের পরে। বিয়ের দিনে নিয়মমতো পরিচয় হ’য়েছিল, ভালো ক’রে আলাপ হ’লো দাদাভাইয়ের কুলটির বিরাট বাংলোতে গিয়ে। তখনও জানি উনি আমার মতো ইঞ্জিনীয়ার, তফাৎ কেবল বিশেষজ্ঞতায়; আমি মেকানিকাল ইঞ্জিনীয়ার আর উনি ফাউণ্ড্রি ইঞ্জিনীয়ার – ছাঁচ তৈরী ক’রে লোহা ঢালাই-এর শিল্পী। তবে ইঞ্জিনীয়ার হিসেবে আমাদের দুজনেরই কাজ - নিজে জিনিস তৈরী করা নয়, শ্রমিকদের নিয়ে কাজ ক’রিয়ে নেওয়া, যন্ত্রপাতি, পরিবহন ও সরবরাহের ব্যবস্থা করা যাতে শ্রমিকেরা কাজ ক’রতে পারে সহজে ও কম সময়ে; সবচেয়ে বড় কথা শ্রমিক আর ইঞ্জিনীয়ারদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সৌহার্দ্দ্য যেন বজায় থাকে। এই পর্য্যন্ত দাদাভাই আমার এক ইঞ্জিনীয়ার আত্মীয়; কিন্তু দুটো আলাদা কোম্পানীর বিভিন্ন ধরণের ইঞ্জিনীয়ারদের মধ্যে ঠিক কনেকশন বা রেজোন্যান্স হয় না, হয় না প্রাণের যোগ বা অনুরণন। অনুরণন শুরু হ’লো আড্ডা বা আলোচনা থেকে; হয়তো ঘরোয়া আড্ডা শুরু হ’য়েছিল দুটি স্বামী-স্ত্রীর জুটি থেকে – আমার স্ত্রী ও তার দিদি এরা দুই বোন, আর এই দুই বোনের স্বামীরা – আমি ও দাদাভাই – এই চার জনের আড্ডায় মূলতঃ আলোচনা হ’তো সিনেমা, রবীন্দ্রসঙ্গীত আর অনুরোধের আসরের গান নিয়ে; তারই ফাঁকে ফাঁকে জানা গেলো, দাদাভাই নিয়মিত কবিতা লেখেন আর ছবি আঁকেন, মাঝে মাঝে গল্প লেখেন, কোনো নতুন শহরে গেলে লেখেন সেই শহরে দিন কাটানোর কাহিনী। শুনলাম ওদের পারিবারিক সাহিত্য-সংকলন ‘সেঁজুতি’র কথা। মনে পড়লো, ছোটবেলায় আমরা পাঁচ ভাইবোনে মিলে হাতে লেখা ম্যাগাজিন বার ক’রতাম; এতে প্রত্যেকেই নিজের লেখা গল্প বা কবিতা নিজের হাতে লিখতো, নিজে হাতে আঁকতো ছবি। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল পাঁচজনে মিলে লেখা বড় গল্প বা উপন্যাস। এতে একজন শুরু ক’রতো প্রথম পরিচ্ছেদ দিয়ে, এর পরে আর একজন লিখতো দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, তার পরে আর একজন তৃতীয় পরিচ্ছেদ। পাঁচ পরিচ্ছেদেই যে উপন্যাস শেষ হ’য়ে যাবে এমন কোনো নিয়ম ছিল না, উপন্যাস শেষ হ’তে যত পরিচ্ছেদের দরকার ততগুলোই লিখতে হ’তো বিভিন্ন পর্য্যায়ে। দাদাভাইয়ের অনুরোধে ‘সেঁজুতি’তেও আমরা লিখেছি। তবে ‘সেঁজুতি’র প্রায় প্রতিটি পাতাই লিখতেন দাদাভাইয়ের দাদা ওঁর চোখ ভুলোনো হস্তাক্ষর দিয়ে।

মাঝে মাঝে মেলামেশা করা সত্ত্বেও দাদাভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত দেখাশোনা করা সম্ভব হ’তো না মূলতঃ আমাদের কর্ম্মস্থলের দূরত্বের জন্যে। রিটায়ার করার আগে দাদাভাইয়ের কর্ম্মস্থল ছিল কুলটি – ক’লকাতার কাছেই। দাদাভাইয়ের সঙ্গে প্রথম আলাপের সময়, অর্থাৎ আমার বিয়ের সময় আমার কর্ম্মস্থল ছিল জামসেদপুর; সেখান থেকে সরাসরি কুলটি যাওয়ার সুবিধে নেই; এছাড়া বিয়ের পরে আমার স্ত্রী তিন বছর ক’লকাতায় লেখাপড়ায় ব্যস্ত ছিল; আমার ক’লকাতায় আসার দরকার পড়তো না; যেহেতু আমার স্ত্রী দাদাভাইয়ের নিকটতর আত্মীয়, স্ত্রীকে সঙ্গে না নিয়ে কুলটি যাওয়া হ’তো না দাদাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্যে। আমার স্ত্রী জামসেদপুরে আমার সঙ্গে থাকতে আসার এক বছর পরেই আমার কর্ম্মস্থল হ’লো অনেক দূরে রসায়নীতে, সেখানে সাড়ে চার বছর কাজ করার পরে আমার কর্ম্মস্থল হ’লো দিল্লীতে। রসায়নী বা দিল্লী থেকে আমার কুলটি যাবার সুযোগ বা ছুটি হয়নি। দাদাভাই দিদিকে আর বাচ্ছাদের নিয়ে রসায়নী আর দিল্লীতে বেড়াতে এসেছিলেন, কিন্তু আমার সঙ্গে বেশী সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি। এছাড়া তখন ভারতবর্ষে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংএর কাজ সবে সুরু হ’য়েছে; আমার বিয়ের কয়েক মাস পরেই আমি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখার সুযোগ পেয়েছি, পেয়েছি জামসেদপুরের ইণ্ডিয়ান টিউবের ব্যবসা কম্পিউটারাইজ করার দায়িত্ব। ইঞ্জিনীয়ারিংএর বদলে আমার পেশা হ’য়েছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। কাজের চাপে সাহিত্যচর্চার সময় পাইনি একেবারে। মাঝে মাঝে দাদাভাইয়ের লেখা পড়েছি; ভালো লেগেছে; কিন্তু নিজে লেখার সময় পাইনি, তেমন তাগিদও আসেনি লেখার জন্যে।

এরপর আমি সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা হলাম। বছরে একবার ক’রে আসতুম ক’লকাতায় বাঙ্গুরে মাস-দেড়েকের জন্যে। দাদাভাই কুলটি থেকে অবসর নিয়ে ফ্ল্যাট কিনলেন লেকটাউনে। বাঙ্গুর থেকে লেকটাউনে যেতে বেশী সময় লাগেনা, কাজেই যাওয়া আসা লেগেই থাকতো; অন্য কাজকর্মের সঙ্গে আলোচনা হ’তো সাহিত্যের, দেখতাম দাদাভাইয়ের আঁকা ছবি, পড়তাম ওঁর লেখা। আমার কম্পিউটার নিয়েই কাজ, তাই কম্পিউটারে পারদর্শিতা দিয়ে দাদাভাইকে একটু সাহায্য ক’রতাম; দাদাভাইও হাতে লেখার বদলে অভ্র কীবোর্ডের সাহায্যে ওয়ার্ড ডক্যুমেন্টে লেখা শুরু ক’রলেন, মাইক্রোসফ্ট পেন্ট দিয়ে পেন্টিং, ফাউণ্ড্রির সেমিনারের জন্যে পাওয়ারপয়েন্ট।

দাদাভাইয়ের সঙ্গে আরও অন্তরঙ্গ আলোচনার সুযোগ হ’লো যখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইমেল দেওয়া সহজ হ’লো, ফোন করার খরচও অনেক কমে গেল; সম্প্রতি যোগাযোগ আরও সহজ হ’য়ে গেছে হোয়াটস্ অ্যাপের মাধ্যমে। তবে সবচেয়ে বেশী মুখোমুখি বসে আলোচনা হ’য়েছে দাদাভাইয়ের দু-দফা সিডনী ভ্রমণের সময়ে। উনি পড়েছেন আমার লেখা বইগুলো, সীমান্তহীন জগতে বিবাহবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে আমার কেন এত আগ্রহ সেটা জেনে নিয়েছেন, অনুভব ক’রেছেন আমার জীবনদর্শন। আমার প্রথম ইংরেজী উপন্যাসটির প্রচ্ছদের ছবিটি দাদাভাইয়ের আঁকা।

২০২০ সালের জানুয়ারীতে অনেক হৈচৈ হ’য়েছে দাদাভাইয়ের সঙ্গে। ২৯শে জানুয়ারীতে সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি দিয়েছি, খিচুড়ী খেয়েছি দাদাভাইয়ের পরিচালিত ‘ঐকতান’এর পূজামণ্ডপে। দাদাভাই ওখানে আমার লেখা উপন্যাসের জন্যে একটি পোস্টার দিয়েছিলেন। তার পরের দিনেই আমাদের সিডনীতে ফিরে আসার কথা; সকালে খবর পেলাম দাদাভাই বিছানা থেকে পড়ে গেছেন; চোট লেগেছে কোমরে আর পাঁজরায়; আমরা ফেরার তারিখ পেছিয়ে দিতে চাইলুম; কিন্তু ফ্লাইটের তারিখ পেছোনো গেল না। এর পরে কোভিডের জন্যে নানা নিষেধাজ্ঞা শুরু হ’লো; এখনও পর্য্যন্ত কলকাতা যাওয়ার উপায় নেই। এরপরে দাদাভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হ’য়েছে; দাদাভাইয়ের আবৃত্তি শুনেছি; কিন্তু দাদাভাই আর সুস্থ হ’য়ে উঠলেন না। কোমর, পাঁজরা আর হাঁটুর ব্যথার চেয়ে ওঁকে বেশী কাবু ক’রলো কিডনীর অসুখ।

***

দাদাভাইয়ের সঙ্গে মুখোমুখি ব’সে আলোচনা আর হবে না, শোনা যাবে না নতুন কোনো কবিতার আবৃত্তি। তবু ওঁর সৃষ্টির মধ্যেই বেঁচে থাকবে দাদাভাই। আমার কাছে কোনোদিনও হারিয়ে যাবেনা দাদাভাইয়ের ডাক, বাজতে থাকবে আমার অন্তরে ওঁর সত্য ও সুন্দরের সন্ধানের আকুতি, মর্ত্ত্যভূমিতে স্বর্গ প্রতিষ্ঠা করার মন্ত্র। যাতে কেবল আমার মধ্যেই এ ডাক হারিয়ে না যায়, এ ডাক শোনাতে চাই আরও অনেক মানুষকে।

দাদাভাইয়ের হাতে লেখা যে বইগুলিতে কবিতা ও ছবির যুগলবন্দী আছে, সে বইগুলির প্রতি পৃষ্ঠার ফটো তুলে, ফটোগুলো দিয়ে প্রকাশ করবো ই-বুক, পেপারব্যাক বা হার্ডকভার; আর যে অজস্র ছবি বাড়ীর দেওয়ালে আঁকা আছে, যে অজস্র লেখা আলমারীতে রাখা আছে, সব একসঙ্গে একটা ওয়ার্ড ডকুমেন্টে পেস্ট ক’রবো, তারপর ওয়ার্ড ডকুমেন্ট থেকে পিডিএফ ফাইল তৈরী ক’রবো, ফেসবুকের কয়েকটা গ্রুপে প্রকাশ করবো। দাদাভাইএর ডাক হারিয়ে যাবেনা; দাদাভাই বেঁচে থাকবে আরও অনেকের মনে ওঁর ছবি, কবিতা ও অন্য লেখার মাধ্যমে।

***

আজ যখন দাদাভাইয়ের কথা ভাবছি, তখন আমার নিজের স্বর্গত দাদার কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। দাদার মৃত্যুর মাত্র দুমাস আগে ওঁর লেখা স্মৃতিকথা প্রকাশ ক’রে ওঁকে একটু খুশী ক’রতে পেরেছিলুম ব’লে ধন্য মনে ক’রেছি নিজেকে। শুধু আমি নয়, আমরা ভাইবোনেরা সবাই দাদার মতো হ’তে চেয়েছিলাম। কয়েকটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত্তের কথা লিখবো এখানে।
বার বার ব’লেছি একথা, “ছোটবেলা থেকেই আমি তোমার মতো হ’তে চেয়েছিলাম, দাদা। তুমি যেভাবে তোমার জীবন অন্যদের সাথে ভাগ ক’রে দিয়েছো তাতে কেবল তোমার জীবনই সমৃদ্ধ হয়নি; সমৃদ্ধ হ’য়েছে তোমার আত্মীয় এবং বন্ধুদের জীবনও। ‘জীবনে জীবন যোগ করা  না হ’লে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় জীবনের পসরা’।“
“ছোটবেলা থেকেই তোমার ছোট ভাই হিসেবে আমি সবসময় তোমার মতো হ’তে চেয়েছি। প্রায়ই অনেকে আমাকে তুমি ব’লে ভুল ক’রেছে । আমি যখন চক্রবেড়িয়া স্কুলে পড়তাম, তখন প্রায়ই মাস্টারমশয়েরা আমাকে তোমার নাম ধরে ডাকতো, যদিও আমি তোমার মতো সুদর্শন ছিলাম না, আমাদের মুখ ছিল একই রকমের আর দুজনেই ছিলাম মেধাবী ছাত্র। শুধু আমি একা নয়, আমার তিন দিদিও পড়াশোনায় তোমাকে অনুকরণ করার চেষ্টা ক’রতো, তারা প্রায়ই তোমার লেখা অনুচ্ছেদ মুখস্থ ক’রতো এবং কোনো রচনা বা ব্যাখ্যা লেখার সময় তোমার মতো ক’রেই লিখতো।“
“আমাদের বাবা-মা এবং পাঁচ ভাইবোন – আমরা সাতজনে কত বছর ধরে একসাথে এক বাড়ীতে থেকেছি; সব কথা মনে ক’রে ক’রে লিখতে কয়েক মাস লেগে যাবে। এখানে শুধু কয়েকটি ঘটনার কথা বলছি।“
“একবার, আমি ভবানীপুরের বাড়ির লম্বা জানলার কাছে একটি রুমাল নিয়ে খেলছিলাম, রুমালটি আমার হাত থেকে ফসকে ফুটপাতে পড়েছিল; আমি সঙ্গে সঙ্গে খালি পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম রুমালটি তুলতে; আমি রুমালটি তুলতে পেরেছিলাম, কিন্তু ট্যাংরা মাছের একটি কাঁটা আমার পায়ের নীচে বিঁধেছিল। আমি বাড়ি ফিরলাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তক্ষুনি তুমি, দাদা, হঠাৎ হাজির হ’য়েছিলে, আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে ডক্টর কর-এর চেম্বারে ছুটে গিয়েছিলে অস্ত্রোপচারের জন্য; ডক্টর কর মাছের কাঁটাটি পা থেকে বের ক’রে আবার আমাকে সচল ক’রে তুলেছিলেন।“
“আমি যখন চক্রবেড়িয়া স্কুলের ক্লাস নাইনে উঠি, তখন হায়ার সেকেণ্ডারী পাঠক্রম সবে শুরু হ’য়েছে। তুমি সিন্দ্রিতে ছিলে; তুমি জানতে না যে চক্রবেড়িয়া স্কুল বিজ্ঞান পড়ানো শুরু করেনি, তাই সেখানে হিউম্যানিটিস্ শাখায় পড়া ছাড়া আমার আর কোনো বিকল্প ছিল না। মে মাসে কয়েকদিনের ছুটিতে কলকাতায় এসে তুমি একথা জানতে পেরেছিলে। সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমাকে মিত্র ইনস্টিটিউশন - ভবানীপুরে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করার জন্য ব্যবস্থা ক’রেছিলে। কিন্তু তোমার সাহায্য না পেলে, আমি বিজ্ঞান শাখায় পড়ার সুযোগ পেতাম না এবং তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারতাম না।“
“আমার মনে আছে বড়দির গীটার বাজানোর অনুষ্ঠানের আগের দিন, ওই উপলক্ষে ছবি তোলার জন্য তুমি একটি ক্যামেরা কিনে এনেছিলে। এতে কিভাবে ফিল্ম লোড ক’রতে হয় তা দেখার জন্যে আমি খুব কৌতূহলী ছিলাম, আর ফিল্ম লোড ক’রতে গিয়ে, আমি একটা ক্লিপ ভেঙে ফেলেছিলাম, তখন ফিল্ম আর লোড করা যাচ্ছিল না। কিন্তু তুমি এর জন্য আমাকে বকাবুকি করোনি, বরং ক্লিপটি ঠিক ক’রতে আমাকে সাহায্য করার জন্য তোমার সমস্ত ইঞ্জিনীয়ারিংএর কায়দা ব্যবহার ক’রেছিলে। আমরা ক্যামেরায় ফিল্মের রোল মাউন্ট ক’রতে পেরেছিলাম, কিন্তু শুধু একটি ছবি তোলা সম্ভব হ’য়েছিল; প্রথম ক্লিকের পর ফিল্মের রোল আর ঘোরেনি দ্বিতীয় ছবি তোলার জন্যে।“
“তুমি আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি করাতেও বড় ভূমিকা নিয়েছিলে; আমি যখন ভর্তি হ’য়েছিলাম, তখন তুমি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমার সঙ্গে ছিলে।“
“এমনকি আমি অস্ট্রেলিয়াতে চলে আসার পরেও যখন দিল্লিতে তোমার সাথে দেখা ক’রতে গিয়েছিলাম, তুমি আমাকে রাস্তা পার হ’তে সাহায্য ক’রেছিলে, যাতে আমি রাস্তার যানবাহনের ধাক্কায় আঘাত না পাই; যদিও তোমার বয়েস তখন পঁয়ষট্টি বছর, তুমি তোমার স্নেহের ভাইকে আগলে রেখেছিলে নিজের শরীরের তোয়াক্কা না ক’রে।“
“তুমি চলে যাবার মাত্র এক বছর আগে তুমি আমাকে তোমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিনগুলির কথা বলেছিলে। একদিন সন্ধ্যায় তুমি কাজ থেকে ফিরতে খুব দেরী ক’রেছিলে; আমরা সবাই ভাবছিলাম তোমার এত কেন দেরী হচ্ছে। তুমি যখন ফিরে এলে, তুমি একটি বড় স্টীলের আলমারী নিয়ে এসেছিলে, যার মধ্যে আমরা আমাদের সমস্ত জামা-কাপড় রাখতে পারবো। আলমারীতে একটি লকার ছিল, যেখানে আমাদের বাবা-মা গয়না এবং টাকা রাখতে পেরেছিল। আমরা সবাই তোমার আনা আলমারী দেখে খুব খুশি হ’য়েছিলাম, আর আমরা একে অপরের সাথে তর্ক ক’রে ঠিক ক’রেছিলাম- কে আলমারীর কোন অংশ দখল ক’রবে। আমরা, ভাইবোনেরা তখন কেউই বুঝতে পারিনি যে এই দিনটিতে তুমি এতটাই হতাশ ছিলে যে তুমি আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলে; তুমি তোমার নিজের জীবন শেষ ক’রে দেবার জন্য অনেক উপায় খুঁজেছিলে। অবশেষে তুমি ভেবেছিলে যে তোমার জীবন শেষ ক’রে দিলে, তোমার ভাইবোনেদের জীবনও নিঃস্ব হ’য়ে যাবে – আমাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তখন তুমি নিজেকে আদেশ দিয়েছিলে বাঁচার জন্যে, নিজেকে ব’লেছিলে তোমার ভাইবোনেদের জন্য কাজ ক’রে যেতে হবে। আমাদের ভাইবোনেদের কেউই তোমার সেদিনের দুর্দশার কথা, সংগ্রামের  কথা জানতুম না; তুমি সেদিন যে আলমারীটা নিয়ে এসেছিলে তাতেই আমরা সবাই খুশি ছিলাম।“
“২০১৭এর নভেম্বরে, তুমি স্বর্গতা বৌদি এবং তোমার দুজনের জীবনকে স্মরণ করার জন্য ‘Remembrances – Tales of Our Life’ ‘রিমেমব্রেন্সেস – টেলস্ অফ আওয়ার লাইফ’ বইটি প্রকাশ ক’রেছিলে – তুমি ও বৌদি কিভাবে কলকাতা, দিল্লি ইত্যাদি জায়গায় বড় হ’য়েছিলে জীবন কাটিয়েছিলে, এই বইটিতে আছে তারই সংক্ষিপ্তসার। আমি এই সাধনায় তোমার সাথে যুক্ত হ’তে পেরে গর্ব্ব বোধ ক’রেছি। ২০১৭এর ২৯শে ডিসেম্বরে তুমি অকস্মাৎ ইহলোক ছেড়ে গেলে; তোমার শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো সিডনীতে চলন্ত গাড়ীর সীটে ব’সে থাকা অবস্থায়, বিনা কোনো দুর্ঘটনায়। তুমি তোমার শেষ দিনেও এই বইটিতে আরও কিছু লেখা যোগ ক’রতে চেয়েছিলে। এই বইটির সংশোধিত সংস্করণে এই লেখাগুলিও জুড়ে দিয়েছি। যদি স্বর্গ ব’লে কিছু থাকে, তুমি সেখানে গিয়ে তোমার ইঞ্জিনীয়ারিং চালিয়ে যাও। তোমার জীবনদর্শন অনুসরণ ক’রে আমরাও চালিয়ে যাবো ইঞ্জিনীয়ারিং - এই পৃথিবীকে স্বর্গ ক’রে তোলার জন্যে।
***
আমার দাদা ও দাদাভাই এমন দুটি চরিত্র যাদের জীবনদর্শন দুর্নিবার আকর্ষণে আমাকে ডাকবে এই পৃথিবীকে স্বর্গ ক’রে তোলার জন্যে। তাঁরা এই পৃথিবীতে না থাকলেও, তাদের ডাক হারিয়ে যাবেনা আমাদের জীবন থেকে।

*** সমাপ্ত ***

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু