বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বিংশ শতাব্দীর শেষ রাত

কিরীটির মতো ইনফরমেশন টেকনোলজির কর্মীদের কাছে ২০০০ সালের ১লা জানুয়ারী নিয়ে এসেছিল একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ – Y2K সমস্যা – এর আগে পর্য্যন্ত যে সব প্রোগ্রাম লেখা হ’য়েছে শিল্প ও বাণিজ্যের কাজ চালানোর জন্যে, তার সবই কি অকেজো হ’য়ে যাবে নতুন শতাব্দী, নতুন সহস্রাব্দ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে? যেহেতু এই সমস্যা পৃথিবীর সব দেশকেই থামিয়ে দিতে পারে, তাই সারা পৃথিবীর ইনফরমেশন টেকনোলজির পেশাদারেরা দেশবিদেশের সমস্ত তফাৎ ভুলে এক সাথে কাজ ক’রেছে Y2K সমস্যার সমাধানের জন্যে।

প্রশ্ন উঠেছিল - নতুন সহস্রাব্দের জন্মদিন কবে পালন করা উচিত?

     - ২০০০ থেকে ২০০১ সালের উত্তরণে (অর্থাৎ ৩১শে ডিসেম্বর, ২০০০ এর পরের দিন)  

       অথবা

     - ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সালের উত্তরণে (অর্থাৎ ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৯৯ এর পরের দিন)?

কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছিলেন যে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের কোনও বছর শূন্য না থাকায়, সহস্রাব্দটি ১AD বা ১CE থেকে গণনা করা উচিত। সুতরাং পুরো এক হাজার বছরের প্রথম সময়কাল ১AD বা ১CE থেকে শুরু ক’রে ১০০০AD বা ১০০০CEএর  শেষ পর্য্যন্ত ধরা হয়েছিল। সুতরাং, দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরু ১০০১ এর শুরুতে হ’য়েছিল, তাই দ্বিতীয় সহস্রাব্দ শেষ হওয়া উচিত ২০০০AD বা ২০০০CE-এর শেষদিনে অর্থাৎ ৩১শে ডিসেম্বর, ২০০০ তারিখে। কিন্তু ইনফরমেশন টেকনোলজির পেশাদারদের এবং জনগণের যুক্তি বিবেচনা করে ঠিক হ’লো - নতুন সহস্রাব্দের শুরু হওয়া উচিত যখন বছরটি ২০০০ সাল হবে, অর্থাৎ ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৯৯ তারিখের পরের দিন থেকে।

প্রথম সহস্রাব্দের শেষ কয়েক বছরে, Y2K bug বা দু-হাজার সালের ধাঁধা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হ’য়েছিল দেশবিদেশের সংবাদপত্রে. টিভিতে, মন্ত্রিসভায়, প্রতিটি কম্পিউটারাইজড প্রতিষ্ঠানে। যেহেতু পানীয় জল, ইলেক্ট্রিসিটি ইত্যাদি ইউটিলিটির বেশিরভাগ প্রক্রিয়া কম্পিউটারাইজড ছিল এবং বেশিরভাগ কম্পিউটার প্রোগ্রামগুলি ২-ডিজিটের বছর তারিখের জন্যে ব্যবহার করেছিল, তাই প্রোগ্রামের যুক্তি অনুযায়ী ২০০০ সালের প্রথম দিনের ঘটনা, ৯৯ বছর আগে অর্থাৎ ১৯০০ সালে ঘটেছিল বলে ধরা হবে। কাজেই ব্যবহৃত প্রোগ্রামগুলির যুক্তি জল, ইলেক্ট্রিসিটি ইত্যাদি পরিষেবাগুলি বন্ধ ক’রে দেওয়ার জন্যে নির্দেশ দিতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রধান শহরগুলির মতো, কিরীটির থাকার শহর সিডনীতেও পরিষেবা বন্ধ হওয়ার দুর্যোগের মধ্যেও বেঁচে থাকার জন্যে পরিকল্পনা করা হ‘য়েছিল। কিরীটি এবং কিরীটির স্ত্রী সুভদ্রা ওদের বাড়িতে ১০ লিটারের দশটি বোতলে জল রেখেছিল. রান্নার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হওয়ার ভয়ে প্রচুর কাঠ, কয়লা এবং অন্য জ্বালানী রেখেছিল; শুকনো খাবার, চাল-ডাল, বিস্কুট, সিরিয়াল ইত্যাদি যতটা সম্ভব কিনে রেখেছিল।

কিরীটির কাজ ব্যাঙ্কের ইনফর্মেশন টেকনোলজিতে। সেখানে কিরীটি ছিল Y2K প্রকল্পের পুরোধা বা প্রোজেক্ট-লিডার - ২০০০ সাল শুরু হওয়ার সময় কোনও সিস্টেম যাতে কাজ বন্ধ না করে আর ব্যবসায়ের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে তার দায়িত্ব ছিল কিরীটির। এই বিশাল প্রকল্প ১৯৯৫ সালে শুরু হ’য়েছিল। প্রথমে, যে সমস্ত প্রোগ্রাম ও ডাটাবেস তারিখের জন্যে ২-ডিজিটের বছর ব্যবহার করে, তা বাছাই ক’রে, ৪-ডিজিটের বছর ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হ’য়েছিল। প্রথমদিকে ১৯৯৫ সালে, প্রকল্পের রূপায়নের মূল্যায়ন ক’রতে সমস্ত অ্যাপ্লিকেশন গ্রুপের মিটিং হ’তো প্রতি তিন মাসে; সময় এগোনোর সাথে সাথে ১৯৯৭তে এই মিটিং হ’তো প্রতি মাসে, তারপরে ১৯৯৮তে প্রতি সপ্তাহে, ১৯৯৯তে প্রতি দিন। ১৯৯৯এর শেষ সপ্তাহে, একটি কন্ট্রোল রুম চালু করা হ’য়েছিল, সকল সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্যে।  

৩১শে ডিসেম্বর ১৯৯৯ তারিখে রোজকার মতো ছুটির পরে বাড়ী যেতে পারলো না কিরীটি; পৃথিবীর কোন দেশে কী ঘটছে তা পর্য্যবেক্ষণ ক’রতে রইলো, যাতে প্রয়োজনে শেষ মুহুর্তেও কোনও পরিবর্ত্তনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কয়েক মিনিটের জন্যে, কিরীটি সিডনী শহরের রাত ৯টার আতসবাজি দেখতে কিরীটিদের অফিস বিল্ডিংএর বারান্দায় গিয়েছিল; তারপরে নিউজিল্যান্ড থেকে খবর নেওয়ার জন্যে কন্ট্রোল রুমে ফিরে এসেছিল। কিরীটির রাত বারোটার আতসবাজি দেখার এবং সিডনীর নতুন সহস্রাব্দের স্বাগত জানানোর জন্যে কিরীটির কোনও সময় ছিল না। কিরীটি কন্ট্রোল রুমে গিয়ে, সিস্টেম সফ্টওয়্যারে আইবিএম ঘড়ির সাথে সমস্ত কম্পিউটারাইজড অ্যাপ্লিকেশনগুলোর ঘড়ি মেলানো বা সিঙ্ক্রোনাইজ করার জন্যে নতুন সহস্রাব্দ প্রবর্তনের কন্ট্রোল ফাইলগুলো দেখে নিয়েছিল। এরপরে কিরীটি সমস্ত অ্যাপ্লিকেশনগুলির নাইট ব্যাচ প্রসেসিং পর্যবেক্ষণ ক’রেছিল; অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামগুলির মধ্যে একটিতে সামান্য ত্রুটি ছিল; তবে সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করা হ’য়েছিল এবং সমস্ত ব্যাচের প্রক্রিয়াটি সময়মতো সম্পন্ন হয়েছিল। এর পরে কন্ট্রোল রুম থেকেই অনলাইন লগ-এ নজর দিয়েছিল কিরীটি, ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট-হোল্ডাররা প্রত্যাশিতভাবে অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে অংশগ্রহণ ক’রতে পারছে কিনা তা দেখার জন্যে। দেখা গেলো যে সব এটিএম-ই কোনও আপাত কারণ ছাড়াই সমস্ত লেনদেন প্রত্যাখ্যান ক’রছে।

কিরীটি টেস্ট মেশিনে ঐ লেনদেনের অনুকরণ ক’রেছিল এবং দেখেছিল যে লেনদেন সেখানে ঠিকঠাক হ’চ্ছে। কিরীটি অফিসের গেটের কাছে একটি এটিএম-এ ঐরকম লেনদেনের জন্যে একজন কর্মীকে পাঠিয়েছিল; সে এসে জানালো যে ঐ লেনদেন ওখানে কাজ করেনি; কিরীটি আরও তদন্ত ক’রে দেখলো যে, এটিএমগুলি ব্যবহার ক’রছে পুরোনো ভুল ডাটাবেস যেখানে ২-ডিজিটের বছর তারিখের জন্যে ব্যবহার করা হ’য়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত এটিএম অফলাইন করা হ’লো, সম্পর্কিত ডাটাবেস রূপান্তরিত করার পর এটিএমগুলি আবার অনলাইনে আনা হ’লো। কিরীটি নিজেই রাস্তায় এটিএম-এ গিয়ে একটি লেনদেন পরীক্ষা ক’রেছিল; এটি ঠিক মতো হ’য়েছিল। কিরীটি ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান আর ম্যানেজিং ডাইরেক্টরকে জানিয়েছিল যে সমস্ত অ্যাপ্লিকেশন নতুন সহস্রাব্দে আশানুরূপভাবে কাজ ক’রছে।

*** ***

পরদিন সকাল সাতটায় কিরীটি বাড়ী ফিরে এলো; এখন দুদিন ছুটি। বছরের প্রথম দিন ব’লে ১লা জানুয়ারীতে এমনিতেই ছুটি, তার উপর এদিন শনিবার; রবিবার ২রা জানুয়ারীও ছুটি; ৩১শে ডিসেম্বরে সারারাত কাজ করার জন্যে আরও একদিন ছুটি পেতো; কিন্তু তা আর হবে না; সোমবার ৩রা জানুয়ারীতে কিরীটির ওয়ারশতে যাবার ফ্লাইট।

বাড়ীতে ঢুকতেই কিরীটি শুনলো, “শুভ শতাব্দী, কিরীটি।“

কন্ঠস্বর সুভদ্রার, কিন্তু চেহারাটা কার? কিরীটির মনে হ’লো এ অন্য কেউ, নতুন কোনো মেয়ে, পরণে আটপৌরে ছাপা শাড়ী, লাল ব্লাউজ; জ্বল-জ্বল ক’রছে সিঁদুর সিঁথিতে।

সিডনীতে আসার পর থেকে, বাড়ীতে শাড়ীপরা সুভদ্রাকে কিরীটি দেখেনি কখনও। কদাচিৎ ভারতীয়দের কোনো পুজো বা বিয়ের অনুষ্ঠানে ও শাড়ী প’রেছে, নয়তো এখানে স্কার্ট বা জিনস্-এর উপর টপ প’রে বাইরে যায়; বাড়ীতে সর্টসের উপরে টপ পরে; সকালের দিকে নাইটির উপরে ড্রেসিং গাউন। 

সিঁদুর কদাচিৎ দেখা গেছে সুভদ্রার সিঁথিতে। বিয়ের পরেই সুভদ্রা কিরীটির সঙ্গে জামসেদপুরে আসেনি; ক’লকাতায় র’য়ে গেছে ইউনিভার্সিটিতে এম.এ. পড়ার জন্যে; সেখানে সিঁথিতে সিঁদুর থাকলে বয়েস অনেকটা বেশী দেখায়; ছেলেরা এড়িয়ে যায়। তবু কয়েকজন পুরুষ দেহে-মনে অন্তরঙ্গ হ’য়েছে ওর সঙ্গে ও বিবাহিতা জেনেও। এই পুরুষদের মধ্যে রবি একেবারে নিশ্চিত ছিল যে ও সুভদ্রাকে অন্তঃসত্ত্বা ক’রেছে; তারপরে সুভদ্রার পিরিয়ড শুরু হওয়াতে বোঝা গিয়েছিল রবির, হয়তো সুভদ্রারও স্বপ্ন পুরো হয়নি।

শুভ শতাব্দীতে শাড়ী, সিঁদুর আর সুভদ্রা সম্মোহিত ক’রলো কিরীটিকে। ও ভাবলো, নতুন শতাব্দীতে ওরা পরস্পরকে ভালবাসবে, অন্তরঙ্গ হ’য়ে গড়ে তুলবে ওদের জীবন; কিরীটির আফশোষ হচ্ছিল – মাত্র দু-দিন বাদে তেসরা জানুয়ারীতে এই নতুন সুভদ্রাকে ছেড়ে ওকে অনেক দূরে ওয়ারশতে চলে যেতে হবে। এটা এগারো মাসের প্রোজেক্ট; তবে ওখানে একটানা নব্বই দিনের বেশী কাজ করার ভিসা পাওয়া যায় না, তাই এই এগারো মাসের প্রোজেক্টে কয়েকবার ও সিডনী ফিরে আসবে হপ্তাখানেকের জন্যে।

সুভদ্রা ব’ললো, ‘তাড়াতাড়ি অফিসের জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হ’য়ে এসো; আজ স্পেশ্যাল ব্রেকফাস্ট আছে।‘

কী স্পেশ্যাল ব্রেকফাস্ট সেটা জিগ্যেস করার জন্যে কিরীটি সময় খরচ করলো না, একটু সারপ্রাইস থাকা ভালো। ব্রেকফাস্ট খেয়ে ওকে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে।

অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়িই রেডী হ’য়ে ফিরলো কিরীটি। বহুদিন পরে, ওরা দুজনে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট ক’রতে চলেছে, নয়তো ওরা যে যার সময়মতো, যে যার সুবিধেমতো খেয়ে নেয়। কিরীটি ভাবলো, সুভদ্রার শাড়ী-সিঁদুরের সঙ্গে মানানসই হবে পাজামা-পাঞ্জাবী; আরও ভাবলো, ব্রেকফাস্টের সঙ্গে সঙ্গে ওরা পরস্পরকেও হয়তো একটু চেখে দেখতে পারবে।

ব্রেকফাস্টের সময় কিরীটি অবাক হ’য়ে দেখলো, রোজকারমতো টোস্ট আর ওমলেট নেই; শাড়ী-সিঁদুরপরা সুভদ্রা সদর্পে ঘোষণা ক’রলো, ‘আজ পৌষপার্ব্বণ’ আর কিরীটির দিকে এগিয়ে দিল পিঠে-ভরা একটা প্লেট আর পায়েস-পুলির বাটি। আঁতকে উঠে পিছিয়ে আসছিল কিরীটি; সুভদ্রা ব’ললো, ‘ভয় পেয়োনা; তুমি ডায়াবেটিক ব’লে একটুও গুড় দিইনি; সব সুগার-ফ্রি দিয়ে ক’রেছি।‘

অনেক বছর বাদে দুজনে একসঙ্গে পিঠে-পায়েস খেয়ে পরিতৃপ্ত উচ্ছ্বসিত হ’য়ে উঠলো কিরীটি, ঝাঁপিয়ে পড়ে ও জড়িয়ে ধ’রলো শাড়ী-সিঁদুরপরা সুভদ্রাকে, ব’ললো, ‘নতুন বছরে তুমি কতটা মিষ্টি হ’য়ে উঠেছো, চেখে দেখতে চাই।‘

সিডনীতে আসার পর থেকে গত পনেরো বছর ধ’রে, সুভদ্রা কিরীটিকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি, কিরীটির গায়ের গন্ধ নাকি ও সহ্য ক’রতে পারেনা; সহ্য ক’রতে পারেনা কিরীটির বুকের ঘন চুল, লোমে ভরা ওর হাত-পা। সুভদ্রা কিরীটিকে চুমু খেতে দেয় না; অথচ অস্ট্রেলিয়ার প্রথা অনুযায়ী পুরুষ সহকর্ম্মীদের অফিসে নিয়মিত চুমু খায়; শপিং সেন্টারে কোনো চেনা পুরুষের সঙ্গে দেখা হ’লে সুভদ্রা এমন ঝাঁপিয়ে পড়ে চুমু খায় যে কিরীটির অস্বস্তি লাগে। তবে আজকের শাড়ী-সিঁদুরপরা সুভদ্রা অনায়াসে নিজেকে ছেড়ে দিল কিরীটির হাতে। ত্বরিৎকর্ম্মার মতো সুভদ্রার কোমর ধ’রে কিরীটি ওকে উঠিয়ে নিলো নিজের কাঁধে; নিয়ে চললো ওর বিছানায়।

কিরীটি ব’ললো, ‘কাল সারা রাত জেগেছি, এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বো; তার আগে দেখবো তুমি কতটা সুগার-ফ্রি মিষ্টি; সুভদ্রা আপত্তি ক’রলো না; নতুন বছরের প্রথম সকালে কিরীটি সুভদ্রার শাড়ী-ব্লাউজ ছাড়িয়ে নিয়ে ওকে তৃপ্তি ক’রে চেখে দেখলো; পনেরো বছরের জমানো ভালবাসা উজাড় ক’রে দিল। সুভদ্রার দুচোখে জল নামলো আনন্দে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে হঠাৎ ব’লে উঠলো সুভদ্রা, ‘এতক্ষণ একটা কথা বলা হয়নি তোমাকে; তুমি বাড়ী ফেরার একটু আগে লণ্ডন থেকে সৃজা ফোন ক’রেছিল, ‘নিউ ইয়ারস্ ইভে, বিগ বেনের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরুন সৃজাকে জিগ্যেস ক’রেছে, ‘সৃজা, তুমি কি আমাকে বিয়ে ক’রবে?’ উত্তরে সৃজা ব’লেছে, ‘হ্যাঁ’।“

কিরীটি ব’ললো, “যাক্, এতদিনে ওরা সংসারী হবে; সাত বছর ধ’রে ওরা একসঙ্গে রয়েছে। ওয়ারশ থেকে লণ্ডন খুব দূরে নয়; যে কোনো উইক-এণ্ডেই যাওয়া আসা করা যাবে। সুভদ্রা, তোমাকেও আমার একটা সুখবর দেবার আছে। আজ ইউনিভার্সিটির ডীন ফোন ক’রেছিল – আমার থিসিস বাইরের পরীক্ষকেরা অনুমোদন ক’রেছে। আমাকে ফেব্রুয়ারীতে একবার আসতে হবে, থিসিসের তিন কপি ছাপিয়ে বাঁধিয়ে জমা ক’রতে হবে, আর মে-মাসে কনভোকেশনে আসতে হবে।“

সুভদ্রা ব’ললো, “কনগ্র্যাচুলেশনস! কিরীটি নিশ্চয়ই যাবো কনভোকেশনে। কিন্তু মনে হচ্ছে, একটু আগে বুড়ো বয়সে তুমি আরও একটা খবর তৈরী ক’রে বসেছো,- মনে হচ্ছে সৃজার ভাই বা বোন কিছু হবে। এখন সৃজা-কামেরুন কবে ওদের বিয়ের দিন ঠিক ক’রবে জানিনা।“

কিরীটি ব’ললো, “মনে হয়, ওদের  বিয়ের দিন হবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি. ওদের প্রথম দেখা হওয়ার দিন; তাহ’লে সৃজার ভাই বা বোন জন্মে যাবে তার আগে, দেখতে পাবে সৃজার বিয়ে।“

সুভদ্রা ব’ললো, “এবার আমি যাই; তোমাকে একটু ঘুমোতে দিই।“

কিরীটির চোখের পাতা জুড়ে আসছিল; সুভদ্রা কিরীটির চিবুকে চুমু খেয়ে বিদায় নিলো; নতুন বছরের এত সুখবর নিয়ে খুব সহজেই চোখ বুজে এলো।

***

ঘুম ভাঙলো দুপুর তিনটেয়। বিছানায় এপাশ ওপাশ ক’রছে কিরীটি; সুভদ্রা হাজির হ’লো এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট নিয়ে। দুপুরে লাঞ্চের পরেই কিরীটি চা খায় – টীব্যাগের চা; ও নিজেই ক’রে নেয়। নতুন বছরে শাড়ী-সিঁদুরপরা সুভদ্রা অনেকটা অন্তরঙ্গ হ’য়ে কিরীটির দেখাশোনা ক’রছে।

সুভদ্রা ব’ললো, “মনে আছে তো এবার অলিম্পিক হবে সিডনীতে। পয়লা অক্টোবরে ক্লোজিং সিরেমনির টিকিটের জন্যে ডলার জমা ক’রেছি; আশা করি টিকিট পেয়ে যাবো; ঐ সময়ে প্লীজ থেকো সিডনীতে।“

“নিশ্চয়ই থাকবো”, কিরীটি জবাব দিল, “নতুন বছরের সুখবরের শেষ নেই।“

সুভদ্রা ব’ললো, “এবারে তোমাকে একটা অন্য কথা জানাচ্ছি। একথা না জানালেও চলতো; তুমি হয়তো বুঝতে পারতে না।“

-“তবু বলো কী সে কথা?”

-“তুমি তো এই সোমবার ৩-তারিখে ওয়ারশ যাবে; আর আমি শুক্রবার ৭-তারিখে ক’লকাতায় যাবো; তুমি ফিরে আসার আগেই ফিরে আসবো। তুমি বুঝতেও পারবে না।”

-“ওয়ারশ থেকে এখানে ফোন ক’রলেই আমি বুঝতে পারতাম। তুমি এখন ক’লকাতায় যাবার ছুটি পাবে? টিকিটের জন্যেও বেশ কিছু খরচ ক’রতে হবে।“

-“ক’লকাতা থেকে রবি ইমেলে ফ্লাইটের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি হয়তো জানো, রবির বিয়ে হ’য়েছিল আমাদেরই পাড়ার মেয়ে উমার সঙ্গে। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে উমা হঠাৎ ডেঙ্গুজ্বরে মারা গেছে। রবি আর রবির মা দুজনেই আমাকে ব’লেছে ওদের বাড়ীতে গিয়ে থাকতে, রবির বৌ সেজে উমার ফাঁকা জায়গাটা ভরে দিতে।“

-“উমার ফাঁকা জায়গাটা ভরে দিয়ে ওখানেই থেকে যাও সারা জীবন; সিডনীতে ফিরে আসার দরকার নেই। যদি আমার সঙ্গে থাকতে চাও রবিকে বলো ফ্লাইটের টিকিট ক্যানসেল ক’রে পয়সা ফেরৎ নিতে। তুমি কি এইজন্যে সকাল থেকে শাড়ী-সিঁদুর পরা অভ্যেস ক’রছিলে? তুমি বলছিলে, সৃজার ভাই বা বোন কিছু হবে; আমি নিশ্চিত থাকতে চাই যে, তোমার সন্তানের পিতা একমাত্র আমিই হবো।”

একটু থেমে আবার ব’ললো কিরীটি, “এবারে আমার একার জন্যেই সুটকেশ গুছিয়ে নিচ্ছি, হোটেল সোবিয়েস্কিতে গিয়ে উঠবো। হপ্তাদুয়েকের মধ্যেই আমার জন্যে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া ক’রবে আমাদের কোম্পানী। তখন তোমার কোনো অসুবিধে হবে না ওখানে থাকতে। মাঝে মাঝে সৃজার বাড়ীতেও থাকতে পারবে। ক’লকাতায় থাকতে হ’লেও তোমাকে কাজে ইস্তফা দিতে হ’তো। না হয় ওয়ারশ-তে থাকার জন্যে ইস্তফা দেবে।“

সুভদ্রা ম্লানমুখে ব’ললো, “এই শাড়ীটা রবির মা আমাকে দিয়েছিল।“

কিরীটি ব’ললো, “তুমি যে শাড়ী প’রেছো, এতেই তোমাকে অনেকটা আপন লাগছে। আরও অনেক শাড়ী কিনে দেবো তোমাকে; যতক্ষণ খুশী প’রে থেকো। নতুন শতাব্দীতে, নতুন সহস্রাব্দে আমরা আরও বেশী বাঙালী হ’য়ে থাকবো, যেখানেই থাকিনা কেন।“

*** সমাপ্ত ***

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু