বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

লাল ফ্রক

লাল ফ্রক


বাপি বেরিয়ে যাওয়ার পর তৃষা দরজাটা বন্ধ করে দিল।তার বড়ো আনন্দ আজ,আজ যে তার জন্মদিন। বাপিকে পই পই করে  বলে দিয়েছে আজ যেন তাড়াতাড়ি ফেরে।সাথে আনতে হবে মিকি মাউস কেক,একটা লাল ফ্রক আর একটা পিঙ্ক টেডি।সন্ধেবেলা লাল ফ্রকটা পরে বাপি,সে আর পাশের বাড়ির ঝুমা পিসিমনি মিলে কেক কাটবে। সাঁকরাইল স্টেশনের পাশেই ছোট্ট বাসা ওদের।


জাফর আজ তাড়াতাড়ি কাজে বেরিয়েছে।মালিককে অনুরোধ করতে হবে যেন তাড়াতাড়ি ছুটি দেয়। মেয়েটার কাছে যে ওকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।যা যা আবদার করেছে সেগুলোও কিনতে হবে তো।পাঁচ বছর আগে বিবি আয়েশা মারা যাওয়ার পর আজকের দিনেই তো খুঁজে পেয়েছিলো বছর দুয়েকের ফুটফুটে মেয়েটাকে।রাস্তায় কাঁদছিল,জিজ্ঞাসা করলে আধো আধো স্বরে তিষা নামটা ছাড়া কিছুই বলতে পারেনি।গলায় ঝোলানো দুর্গার লকেট দেখে বুঝেছিল হিন্দু পরিবারের মেয়ে।অনেক খোঁজার চেষ্টা করেছিল ওর বাবা মাকে,পায়নি।তারপর মায়া পড়ে গিয়েছিল,নিজের মেয়ে ভেবেই বড়ো করেছে ওকে।কখনো মনে হয়নি বাপ মেয়ের এই সংসারে আর কারো প্রয়োজন আছে।তাই আজকের দিনটা জাফরের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।ঝুমা দি যখন মেয়েটাকে আজ নতুন সাদা ফ্রকটা পরিয়ে সাদা রিবন দিয়ে চুল বেঁধে দিয়েছিল একেবারে পরীর মত লাগছিল।ঝুমা দি বড়ো ভালোবাসে মেয়েটাকে।হিন্দুদের আচার নিয়ম সবই তো তৃষাকে ঝুমা দিই শিখিয়েছে।জাফর না হলে পারতো কি করে মেয়েকে ওর নিজের ধর্ম শেখাতে। সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে তাড়াতাড়ি বাসের কাছে পৌঁছনোর জন্য সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে থাকে জাফর।


তৃষা দরজা বন্ধ করে হারমোনিয়ামে রেওয়াজে বসলো।নতুন শেখা গানটা প্র্যাকটিস করতে শুরু করলো সে -------


"মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান

মুসলিম তার নয়নমনি হিন্দু তাহার প্রাণ"

অনেকক্ষন থেকে বাইরে শোরগোল শোনা যাচ্ছিল।কিন্তু তৃষা মন দিয়ে রেওয়াজ করতে থাকে।গুরুজী বলেছেন রেওয়াজের সময় অন্য কোনো দিকে মন দিতে নেই।


জাফর টিকিট দিতে দিতে হঠাৎ দেখে একদল লোক  কোনা হাইওয়ের উপর জোর করে তাদের বাস টা দাঁড় করালো।আরো কয়েকটি বাস দাঁড় করিয়েছে এরা।কি হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছেনা জাফর। সব্বাইকে জোর করে বাস থেকে নামিয়ে বাসে আগুন ধরিয়ে দিল লোকগুলো।চারিদিকে প্রচণ্ড উত্তেজনা,পুলিশকেও ঢিল ছোড়া হচ্ছে।ভয়ে পালাতে চাইলো জাফর,কিন্তু সেই সময় একটা ঢিল সজোরে লাগলো ডান ভুরুর উপর।দুচোখ অন্ধকার হয়ে গেলো।চোখটা চেপে ধরে ওখানেই বসে পড়লো সে।


শোরগোল টা বড়ো বেশি হচ্ছে,তৃষা রেওয়াজ ছেড়ে উঠে ভয়ে ভয়ে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো স্টেশনে অনেকগুলো কাকু ছোটাছুটি করছে খুব রেগে আছে মনে হচ্ছে।পা টিপে টিপে বেরিয়ে এসে একটা ঝোপের আড়াল থেকে দেখতে লাগলো সে।কাকুরা টিকিট ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে,যে যা পারছে ছুঁড়ছে,ভাংচুর করছে।হঠাৎ তৃষার চোখ যায় একজন মানুষের দিকে.....আরে বাপি না? বাপি তো এরকম ব্লু জামাটা পরেই গেছে আজ। একি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে লেগে যাবে তো।তৃষা ঝোপ থেকে বেরিয়ে প্রাণপণে " বাপি, বাপি" করে ডাকতে ডাকতে ছুটলো লোকটির দিকে।প্রায় পৌঁছে গেছে এমন সময় একটা ভাঙা কাঁচের বোতল এসে লাগলো পেটে,সাদা ফ্রকটা লাল হয়ে ভিজে উঠলো।ছোট্ট পা দুটো আর পারলো না,হুমড়ি খেয়ে ওখানেই পড়ে গেলো তৃষা।


সন্ধ্যেবেলা জাফরের জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালে,কে ওখান থেকে এখানে দিয়ে গেলো কে জানে।উঠে বসতেই মনে পড়লো বাড়ি পৌঁছতে হবে,তৃষা নাহলে রাগ করবে।টাকা পয়সা পকেটে যেটুকু ছিল কিছুই নেই,গিফট আর কিনতে পারবে না।কিন্তু বাড়ি ত যেতেই হবে।হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরল জাফর।


বাড়ি পৌঁছে দেখে বাড়িতে অনেক লোকের ভিড়,ঘরের ভিতর থেকে ঝুমাদির কান্নার আওয়াজ আসছে।বুকটা ধ্বক করে উঠলো!"কি হলো ঝুমাদি?"বলতে বলতে ভিড় ঠেলে ঘরে ঢুকেই নির্বাক হয়ে গেলো জাফর,মাটিতে চাদরের উপর শোয়ানো ছোট্ট তৃষার মৃতদেহ,পরনে রক্তে লাল হয়ে যাওয়া ফ্রকটা।


অনেকক্ষন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জাফর বলল," আমি তো লাল ফ্রক আনতে পারিনি,এই লাল জামাটা তোকে কারা পরালো রে মা?"


(গল্পের চরিত্রগুলি সবই কাল্পনিক)

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু