বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বন্ধু

                            বন্ধু

                                - গোপাল চন্দ্র মন্ডল



               

        সুভাষ--- সুভাষ---- কোথায় গেলি বাবা এদিকে তোর চিন্তায় তোর মা পাগল হতে বসেছে,কোথায় লুকিয়ে আছিস বাবা এক্ষুনি বেরিয়ে আয়,ছেলেধরার এত তান্ডব বেড়েছে যে ভয়ে বুক কেঁপে উঠছে বাবা- বলতে বলতে অবিনাশবাবু হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছেন নিজেদের একমাত্র সন্তান চোখের মনি সুভাষকে


             গ্রীষ্মের প্রখর রোদ্দুর, তাপমাত্রা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।স্কুলের ছুটির পর সুভাষকে বাড়ি ফিরতে না দেখে অবিনাশবাবু ও তার স্ত্রী নীলা দেবী গভীরভাবে চিন্তিত। ছেলের মুখ না দেখা পর্যন্ত জল স্পর্শ করবেন না এই নীলা দেবীর প্রতিজ্ঞা। ঘণ্টাখানেক পর অবিনাশবাবু নত মস্তকে হাজির হলেন নীলা দেবীর কাছে।অস্পষ্ট গলায় উচ্চারিত হলো -- আমাদের সুভাষকে আমি সঙ্গে আনতে পারলাম না অনেক খুঁজলাম স্কুল, রাস্তাঘাট, বন্ধু-বান্ধবদের বাড়ি, পার্ক, নেই কোথাও নেই।এ--কি বলছো তুমি নেই মানে? কোথায় গেল? আমার সুভাষ হারাতে পারে না, এটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না,আমি খুঁজে আনব আমার সুভাষকে।এই কথা বলতে বলতে চোখের জলে পরিপূর্ণ নীলা দেবী পাগলের মত বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।


          চতুর্থ শ্রেণীর এক মেধাবী ছাত্র সুভাষ চ্যাটার্জী। শুধু মেধাবী নয় সে বড্ড পরোপকারী। নিজের কথা না ভেবে শুধু অন্যের কথা ভাবে। পরের দুঃখ কষ্ট দেখে চুপ থাকতে পারে না এই ছোট্ট বালকটি।এদিকে নির্ভীক হৃদয়ে সুভাষ গল্প করতে ব্যস্ত এক অজানা-অচেনা আধবয়সী ভিখারীর সঙ্গে।প্রত্যেকদিন ছুটির পর রেল স্টেশনের ধারে বসে থাকা এক ভিখারীর সাথে মিনিট দশেক গল্প চলে তার। আর ভিখারি ও যেন এক অনন্য ব্যাক্তি, সুভাষের সঙ্গে মিশে গেছে বেশ। মনের মিল না থাকলে তো আর বন্ধুত্ব হয়না। ভিখারীর  নাম বিবেকানন্দ দাস।মাস দুয়েক আগে এই তেজস্বী ভিখারির সাথে সুভাষের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারপর থেকেই সুভাষের চরিত্রে সব সদ্গুণ ফুটে উঠেছে।


             সুভাষ ও ভিখারির বন্ধুত্বের খবর সুভাষের পিতা-মাতা জানতো না।যাইহোক সুভাষ এর সাথে ভিখারির গল্প এতোই জমে উঠেছে যে সুভাষ বাড়ির কথা ভুলেই গেছে। আজ সুভাষ এমন কিছু শুনছে যে তার চক্ষু স্থির হয়ে গেছে। জ্ঞানী ভিখারি ও সুভাষকে যেন এক অসাধ্য মন্ত্রে দীক্ষিত করছেন। আগেও সুভাষ তাঁর কাছে শুনেছেন অনেক গল্প।কখনো কখনো সেই ভিখারি সুভাষকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে আজকের দিনে  তোমার মত বালক চায়। ভিখারীর গল্পে সুভাষ শুনেছে ছোট্ট বেলার নানা মজার কথা। সে জেনেছে প্রকৃতির প্রত্যেকটা রং নিয়ে খেলা করেছে সেই ভিখারি।ভিখারীর বর্ণনায় সুভাষ তার ছোটবেলা যেন গ্রামের খোলা মাঠে শুদ্ধ হওয়ায় সবুজ শস্যের সঙ্গী হয়ে ও খেলাধুলার মাধ্যমে কাটাতে লাগলো। এমন বর্ণনা যে তাকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়।ভিখারি বলেন ছেলেবেলার সেই সোনালী দিনগুলো আজ আবার ফিরে পেলাম তোমাকে দেখে।সেদিনের সব পুরনো বন্ধু আজ আর নেই পাশে তবে সুভাষ এর মধ্যে সকল বন্ধুকে তিনি ফিরে পেয়েছেন।


             অবিশ্বাস্যকর ঘটনা - গল্পের ফাঁকে কখন যেন দুপুর পেরিয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে, সন্ধ্যে পেরিয়ে গভীর রাত্রি এসে গেল। হঠাৎ দুজনে যেন এক অন্য জগত থেকে বেরিয়ে এলো ইহ জগতে। ভিখারি বললেন দেখো সুভাষ অনেক বেলা হয়ে গেছে তুমি বাড়ি ফিরে যাও। এতক্ষণে তোমার বাবা-মা হয়তো পাগল হয়ে গেছেন। সুভাষ বলল হ্যাঁ তাইতো আমিতো ভুলেই গেছি যে আমার একটা বাড়ি আছে। রেলস্টেশন থেকে মিনিট সাতেক হাঁটা পথ পেরিয়ে সুভাষের বাড়ি। এখন রেলস্টেশন যেন ঘুমে আচ্ছন্ন। লোকজন কেউ নেই। শুধুই নিস্তব্ধ। সুভাষ বলল আমি একটু বাথরুম থেকে ঘুরে আসি। ঠিক আছে ঘুরে এসো মিত্র, দেখো আবার এত রাত্রে কেউ নেই বলে যেখানে সেখানে ত্যাগ করোনা এই বলে ভিখারী থলে থেকে বিভিন্ন কাগজপত্র বের করে মনে মনে কি যেন ভাবতে লাগলেন। ধীরে ধীরে বললেন আজ থেকে তুমি হবে সকলের সুভাষ, জাতির সুভাষ, দেশের সুভাষ। আমি আবার আসব ফিরে যুগে যুগে সুভাষ গড়তে।


        আজকে যেন বাথরুমটা সরে সরে যাচ্ছে, ওদিকে বাবা-মা যে কি বলবে কি জানি। কিন্তু আগের কাজ আগে তো সারতে  হবে । বর্জ্য পদার্থ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে নেই। একটু এগিয়ে যেতে সুভাষ চিন্তায় পড়ে যায়। একই অদ্ভুত কান্ড দেখো দেখি, আমি এবার কোন দিকে যায়, সবকিছু তো অন্ধকার। বাবাকে বলেছিলাম একটা মোবাইল কিনে দিতে কিন্তু সেটাও দিল না। মোবাইলটা থাকলে তো অন্ধকার কে পরাজিত করতে পারতাম।নানা আমার মিত্র বলেছে মোবাইল নাকি খুব ভালো কিছু নয়। উনি বলেন ছোট বাচ্চাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে অনেক ক্ষতি হয়। তাই বাবা ঠিকই করেছেন।একটু এগিয়ে গিয়ে সুভাষ চিৎকার করে বললো এখানে কেউ আছেন আমাকে একটু সাহায্য করুন না। আরেকটু এগিয়ে যেতেই সুভাষ কোন রহস্যের গন্ধ পেল। মিত্র ওকে বলেছে ভুতে কখনো বিশ্বাস করো না। তাই আর কোন ভয় নেই তার। মনে প্রচন্ড সাহস। রহস্য উদঘাটন না করে কিছুতেই থামবে না সে। হালকা পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ কান্নার আওয়াজ পেল সে। কান্নার সেই আওয়াজ ছিল কোন বাচ্চা ছেলের। ধীরে ধীরে আরো কাছে এগোতে থাকে সুভাষ। দেখেই তার চক্ষু স্থির।ওকে পেতে দেখে মুখে মুখোশ পরা কয়েকজন দুষ্কৃতী কয়েকটা বাচ্চা ছেলেকে চুরি করে নিয়ে এসেছে। দুষ্কৃতীদের কাছে হালকা লাইট তাই সম্পূর্ণ বুঝতে পারছেনা সে। তবে সে নিশ্চিত যে দুষ্কৃতীদের হাতে বন্দুক ও ধারালো অস্ত্র আছে।এসব দেখে ছোট্ট সুভাষ  ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। একটু পিছিয়ে এসে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব সাবধানে। পিছনে ঘুরে সে দৌড় দিল মিত্রের কাছে। এদিকে তার মিত্রও উধাও। সে কোন রকম চিন্তা না করে ছুটে গেল রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টারে। সেখানে কেউ নেই দেখে আবার ছুটে যায় এনকোয়ারিতে। গিয়ে দেখে অফিসার নিদ্রামগ্ন। ধীরে ধীরে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে সে। সমস্ত ঘটনা একে একে গুছিয়ে বলে। কালবিলম্ব দেরি না করে অফিসার অনেকগুলো পুলিশকে হাজির করলেন। আর কোন চিন্তা নেই সুভাষের। এরপর দুষ্কৃতী ধরার পালা। সাহসে পরিপূর্ণ সুভাষ সবার আগে সকলকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। বাথরুমের ভিতরে হঠাৎ আক্রমণ করে পুলিশ সব দুষ্কৃতীদের ধরে ফেলল। ছোট্ট বালকের দুঃসাহস দেখে সকলেই বিস্মিত হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পরলো। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নিমিষের মধ্যে হাজির হলো সেই স্থানে।


            গভীর রাতের ঘটনা হলেও স্টেশন এর নিকটবর্তী মানুষজন সব হাজির হল সেখানে। অবিনাশবাবু ও নীলা দেবী হৃদয়ের মানিকের চিন্তায় পাথর হয়ে বসে আছেন। বাড়ির মেন গেট সম্পূর্ণ খোলা অবস্থায় রয়েছে। এইসব হইচইয়ের কোন কিছুই তাদের কানে পৌঁছালো না। কিছুক্ষণ পর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে অবিনাশবাবুর ঘোর কাটল। তিনি খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেলেন অনেক মানুষ তার বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে।তিনি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখেন তাদের আদরের সুভাষকে গলায় মালা পরিয়ে মাথায় করে নিয়ে আসছেন এক পুলিশ অফিসার। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলেন-ওই দেখো আমাদের সুভাষ ফিরে এসেছে। এই কথা শুনে নীলা দেবী ছুটে গেলেন তাঁর সুভাষকে দেখতে। সুভাষকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরলেন নীলা দেবী। তারপর সুভাষের মুখের সমস্ত ঘটনা শুনলেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই অসীম সাহসী ছেলের সঙ্গে তার পিতামাতার গর্বের ছবি তুললেন। ছেলের কীর্তিতে গর্বে বুক ভরে গেল অবিনাশবাবু নীলা দেবীর।


            পরদিন সমস্ত সংবাদমাধ্যমে ছোট্ট সুভাষের অসমসাহসী কীর্তির সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো। চারিদিকে শুধু সুভাষের প্রশংসা। এরই ফাঁকে সুভাষের মন চলে যায় সেই রেলস্টেশন ও ভিখারীর দিকে। একটু এগিয়ে যেতেই সুভাষের কানে এলো তার মিত্রের কথা--সুভাষ তোমার জন্য নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্য, দেশের জন্য। তুমি কখনোই থেমে থাকবেনা। যত বাধাই আসুক কোন বাধা তোমাকে থামাতে পারবে না। তুমি এগিয়ে যাও শুধু এগিয়ে যাও।



                            সমাপ্ত


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু