#চিঠি
#চিঠি।।
মুদ্রালী চক্রবর্তী।।
--আজ অনেকদিন হলো তোমার কোন চিঠি পাই না। কেমন আছো তুমি?
---এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ফোন করলে?
-- নাতো। ফোন করতে ইচ্ছে হলো তাই ফোনটা করলাম।
---- আমি কি করবো কি করবো না তা আজও আনপ্রেডিক্টেবল থাকে। আমি সচরাচর কাউকে নিজের সবকিছু বলে বেড়াই না। যাইহোক ভালো থেকো। আর হ্যাঁ চিঠি লেখাটা ভুলো না।
অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল রিমলি। আকাশের সাথে সম্পর্কটা শেষ করে দিয়েছিল একটা জেদের বশে ,যে জেদের কোন প্রয়োজন আদৌ ছিল কি না তা আজ আর মনে নেই। এখনও রিমলি সেই স্কাই-হাইটস নামের একটি হাউজিং সোসাইটিতেই থাকে,একা ।বাইশ তলা বিল্ডিং কুড়ি তলায় ওর ঘর তিনটে রুম অ্যাটাচড বাথরুম। অনেকটা বড় একটা বারান্দা যার থেকে নীচে তাকালে ওর মাথা ঘোরে তাই পারতপক্ষে ও বারান্দায় যায় না।
রিমলির বাড়ি ছিল যৌথ পরিবার। যেখানে বিরাট রান্নাঘরে একসাথে বসে কাকি-মা -জ্যেঠিরা কুটনো কুটতো, পরনিন্দা করত, ঝগড়াও করত আবার দিনশেষে সবাই সবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তো---বিপদ আসলে। এই বাড়ির মেয়েদের চাকরি করার কোন অধিকার ছিল না, ছেলেরা রোজগার করবে হেঁসেল থাকবে মহিলাদের । এই মানসিকতার বিপক্ষে গিয়ে প্রথম চাকরি করার সাহস এবং একলা থাকার সাহস দেখিয়েছিল ওই। ফলে বাড়ির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হতে ওর সময় লাগে নি। যেদিন জ্যেঠু ডেকে বলেছিলেন
--- হয় চাকরি করবে নয় এ বাড়ির নিয়ম মেনে সংসারী হবে।
সেইদিন প্রথম অপশনটাই ও বেছে নেয়, মায়ের চোখের জল বাবার মুখ সব ভুলে এক অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়।
নতুন শহর একটা পিজি। অনেক মেয়ে যারা চাকরি করে সারাদিন খাটে রাতে নিজেদের জীবন বাঁচে। সেইখানে দু-জনের সাথে শেয়ার করা একটা ঘরে , কমন বাথরুমে নিজের জীবনের একটা অধ্যায় ও নিজেই তৈরি করতে থাকে। সাধারণ একটা চাকরি, ব্যাগের ভেতর অনেকগুলো ডিগ্রির কাগজ আর অনেকটা ওড়ার স্বপ্ন এই ছিল ওর নিজের জগত। সারাদিন বসের ঝাড়। বাসে ঘেমো গন্ধের পুরুষ মানুষ আর অনেকটা মনখারাপের একাকিত্ব সঙ্গে করে হাতের ব্যাগে টুকিটাকি জিনিস নিয়ে যখন ও ফিরতো মনে হতো মার হাতের একটু খাবার, নিদেনপক্ষে এক কাপ চা পেলে মন্দ হত না!
একটু একটু করে ওর ওপরে ওঠা শুরু হয়। কাউকে তেল দিয়ে না! শুধু নিজের কাজ দিয়ে ও নিজেকে প্রমাণ করতে থাকে।পাঁচ বছর সময়ে অনেকটাই এগিয়ে যায়। মাঝে একটা অফিস পরিবর্তন হয় সঙ্গে থাকার জায়গা। না বাড়িতে ফেরা ওর হয় নি, জ্যেঠুর মৃত্যুর খবর পেয়েছিল। যায় নি, নিজেরমতো অশৌচ পালন করেছে। গোত্রটা একই ছিল বলে!
রিমলি এখন ম্যাডাম, অনেকের কাছে। মাইনের টাকার একটা অংশ বাড়িতে পাঠায় বাবার একাউন্টে। কোনোদিনও সেই টাকা কিন্তু ফেরত আসেনি। মনে মনে ওর হাসি পায়! এতো দ্বিচারিতা দেখে।
--এই যাবি নাকি রঙ খেলতে?
ওর সাথে যে কজনের সেই প্রথমদিন থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে তমসা দি একজন। একটু পৃথুলা মাতৃসমা মহিলা। অফিস বদলালেও এই টানটুকু রয়ে গেছে। ভীষণ রকম প্রাণবন্ত মানুষ তাই তার আঁচলটা অনেক আঁধাররাতে রিমলির কাছে একটা মা মা গন্ধ নিয়ে আসতো। তার আহ্বান ও ঠেলতে পারেনি। গেছিল একটা রিসোর্টে। ডিজে ছিল। শুকনো আবীর সব অরগ্যানিক। অবাধ খাওয়া-দাওয়া। আর সুরাপ্রেমিদের জন্য সুসজ্জিত বার কাউন্টার। জনপ্রতি আঠেরশো টাকার টিকিট। একটু গা কষকষ করছিল--- একবেলার জন্য এতোগুলো টাকা! তার থেকে মাংস এনে রান্নাও করা যেত ঘরে! অনেক সস্তা হোত। তমসাদির এক ধমকে সব চিন্তা শেষ। যেতেই হলো।
একটু শহরের বাইরে অনেকটা জায়গায় রিসোর্টটা। চার দিকে সবুজে-সবুজ।বিরাট লন।মাঝে মাঝে ছাতা। তার তলায় টেবিল -চেয়ার। ঘর আছে। ইচ্ছে করলেই একটু বিশ্রাম নেওয়া যায় সেখানে। আসার পরেই কচি ডাবের জল দিয়ে সবাইকে স্বাগত জানানোর চেষ্টা বেশ ভালো লাগে রিমলির। বেলা বাড়ে। সবাই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে রঙের নেশায় মেতে ওঠে। মুখ চলে, গলা ভেজে।তারমধ্যেও রিমলি চুপচাপ তমসা দি বেশ জমাটি, ফলে বেশ জমিয়ে বসেছে। একটা বিয়ার ও শেষ করেছে। রিমলি নিজের মধ্যবিত্ত মানসিকতার সঙ্গে তখনো যুদ্ধ করেই চলেছে। এই প্রথম এসেছে নিজের গ্যাঁটের কড়ি খসিয়ে এমন জায়গায়। আর প্রতি মুহূর্তে ভাবছে
--এলাম কেন।
পেছনের দিকে একটা পুকুর আছে। সেখানে দল বেঁধে কজন মাছ শিকারও করে ফেলছে। বিকেলে নাকি ওগুলো দিয়েই বারবিকিউ হবে। পায়ে পায়ে রিমলি পুকুর পাড়ে যায়। ঘাট বাধানো। বসে চুপচাপ।
---আপনি কি আনকমফোর্টেবল ফিল করছেন?
হঠাৎই অচেনা গলা শুনে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে । বয়স খুবজোর পয়ত্রিশ!
--না না।
সপ্রভিত হবার একটা চেষ্টা করে। খুব বেশি সফল তো হয়ই না। বরঞ্চ মনে হয়
----এ আপদটা কে? মাতাল না তো?ফ্লার্ট করবে নিশ্চিত।
---আমি আকাশ।এখানে অফিস কলিগদের সাথে এসেছি। ওরা ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে আমি ব্যাচেলর তাই এদিক ওদিক ঘুরছি।
মাথার একঠাস চুল থেকে গুলাল ঝাড়তে ঝাড়তে বলে। নীল-লাল-সবুজ গুড়ো উড়ছে তখন হাওয়ায়।
---বসি আপনার পাশে। যদি অনুমতি দেন!
--জায়গাটা তো আমার না। আপনি বসতেই পারেন।
রিমলির গলাটা একটু রুঢ় হয়। সেসবের তোয়াক্কা না করেই বসে পড়ে আকাশ। মোবাইল বের করে বেশ কটা সেল্ফি তোলে। রিমলি উঠে যাবে কি যাবে না ভাবে!
--আপত্তি না থাকলে আপনার ফোনটা দিন না। কটা ছবি তুলে দি?
--আমি ছবি তুলতে পছন্দ করি না।
কাঠ কাঠ জবাবে আকাশ দ্বন্দ্বে পড়ে।
--না আমার তো এটাই নেশা। তাই বলছিলাম ।লোকে বলে আমি ছবি ভালোই তুলি।
--এতো বাজে বকেন কেন?
--মানে?
--মানে গায়ে পড়ে এতোকথা বলছেন কেন? আমি ছবি তুলবো না। আপনি বসুন । আমি যার সাথে এসেছি তাকে নিয়ে খেয়েই চলে যাবো।
গটগট করে হেঁটে রিমলি চলে যায়। ওদিকে তমসার তখন তুরিয় অবস্থা। সে সিদ্ধিও খেয়েছে, সঙ্গে আর যা যা ছিল সব। এখন সে খালি হাত ধুচ্ছে। হাতে নাকি প্রচন্ড নোংরা। আর ভেউ ভেউ করে কাঁদছেবড্ড মনখারাপ লাগছে।
--ও তমসা দি বাড়ি যাবে কি করে? আমি তো গাড়ি চালাতে জানি না। এইজন্যই আমি আসতে চাই নি।
--শুনছে কে আপনার কথা? উনি কি শোনার মত অবস্থায় আছেন বলে আপনার মনে হয়?
সেই ছেলেটা !বড্ড পাকা! এই সময় এসেছে মজা দেখতে। রিমলি মনে মনে বলে।যাইহোক শেষপর্যন্ত সেই মসিহা হয়ে এই দুই মহিলাকে রিমলির বাড়িতে পৌছায়।
তারপর তার নিত্য আনাগোনা। প্রথমে মনে, পরে দেহেও। অথচ বিয়ে সংসার এগুলো কোনোদিনও তার কাছে প্রাধান্য পায় না। এ সম্পর্কের মানে কি? রিমলিও বোঝে না। তবুও অমোঘ টান। এদিকে রিমলির বৃহস্পতি তুঙ্গে-- শত্তুররা বলে। একের পর এক ইনক্রিমেন্ট। প্রোমশন। আর অপরদিকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মোহ।
আকাশের কোন ঊচ্চাকাঙ্খা নেই। পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট পেলেও যা দশেও তাই। শুধু ক্যামেরা হাতে নিলেই, লেন্সে চোখ রাখলেই ও অন্য মানুষ। মাইনের আদ্ধেক টাকা এই লেন্স,কিট, সারানো আর সংরক্ষণের পেছনে যায় বলতে গেলেই মুখ ভার। থাকার মধ্যে আছে এক মা। তিনিও তিতিবিরক্ত ছেলের আচরনে। রিমলি বৌ হয়ে আসুক তিনি চান। অথচ তার কথাও ও এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে এক কান দিয়ে বের করে দেয়।
--আমি একটা ফ্ল্যাট বুক করেছি।
---খুব ভালো খবর।
---মানে? এটা আমাদের দু-জনের তিনটে রূম। একটা আমাদের একটা মায়ের। আর একটা শেষ চেষ্টাও করবো নিজের বাবা-মাকে বুঝিয়ে এখানেই নিয়ে আসার, সামনের মাসেই পজেশন পাবো, তুমিও যাবে আমার সাথে চাবি নিতে আর ফ্ল্যাট ডেকোরেশন তোমার টাকায় করবো।
--সব তো নিজেই বলে দিলে! আমি একটা ফোটো শ্যুটের জন্য পাহাড়ে যাচ্ছি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি আজই। এই কথাই তো বলতে এলাম, তুমি বকবক করেই চলেছ বলে বলতে পারলাম না।, আর খুশি খুশি মুখটা দেখে বলতেও ইচ্ছে হলো না।, যাইহোক মা আমার , আর সে আমার বাবার তৈরি বাড়িতেই থাকবে, তুমি তোমার রাজপ্রাসাদে থেকো আমি চলি।
একটা শব্দ বলার সুযোগ না দিয়েই সেইদিন আকাশ চলে গেছিল। মাঝে ঢেউ উঠেছে, ঝড় এসেছে। রিমলির নতুন বাড়ি হয়েছে,নতুন চাকরিও , ই এম আইয়ের চাপ বাড়লে চাকরি পাল্টাতেই হয়! আকাশের কোন খবর ছিল না। এমনকি ওর মাও জানতেন ছেলে পাহাড়েই আছে ব্যস! ওখানেই কাজ করে, গাড়িও চালায় ওর কাছে কোন কাজ ছোট না! ছবিগুলো পাঠায় নানা পত্র-পত্রিকায় ,প্রাইজ আসে। অথচ রিমলি নেই আর কোথাও।
হঠাৎই একদিন অফিস ফেরত রিমলির চিঠিগুলো হাতে তুলে দেয় দারোয়ান। সব কেজো চিঠির ফাঁকে একটা সাদাখাম। পরে পড়বে বলে সবগুলো সেন্টার টেবিলে জমা করে রাখে। পরদিন ও ছুটির এপ্লিকেশন মেল করে। ছুটি গ্রান্ট হলো কি হলো না দেখার সময় তখন আর ওর হাতে নেই।
স্তব্ধ হয়ে ঘরেই বসেছিল অনেকক্ষণ। তারপর চিঠিতে লেখা নম্বরে ফোন করে।
----আমার উদ্দাম জীবনযাপনের খেসারত দিচ্ছি আমি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে আকাশ।
----তুমি ফিরে এসো। সব দায়িত্ব আমার। চিকিৎসা করাবো।তুমি সেরে উঠবে।
----না। যাবো না। এখন তোমাকে দেখলেই টোপর পরতে ইচ্ছে করবে। সে ভুল করবো না, তুমি চিঠি দেবে, আমিও। ওতেই দুজন-দুজনের স্পর্শ পাবো, রোগটা ছোঁয়াচে । ছবি তুলতে গিয়ে রজনীর ঘরে অনেক সময় কাটিয়েছিলাম। এখন আর কারুর কাছে যেতে চাই না মার খবর নি, টাকা পাঠাই। আর হ্যাঁ ছবির প্রাইজ মানিও ভালোই পাই। জমিয়েছি কিছু, নমিনি তুমি, যদি কোনোদিন আর চিঠি না পাও তবে ধরে নিও আমি নেই হয়ে গেছি, এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া খুব অসুবিধার। তাই চিঠিই ভালো। একটু পুরোনো কিছু শেষপর্যন্ত ছুঁয়ে থাক এই এইডস রোগিটার সাথে।
এটুকুই শেষ কথা ছিল, তারপর শুধু চিঠি আর চিঠি এখন আর তাও আসে না।।