বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

অবিশ্বাস


ঘরের বিছানাটা অগোছালো। বেডসাইড টেবিলে এখনও চায়ের কাপটা পড়ে আছে। কাপের মধ্যে থাকা লিকার চা ততক্ষণে জুড়িয়ে গেছে। ঘরে খুব জোরে পাখাটা ঘুরছে। গতকাল অনেক রাতে জ্বর এসেছিল, শরীরটা আজ খুব একটা ভালো নেই কৌশিকের। কৌশিক সেন, সি আই ডি র নামকরা গোয়েন্দা অফিসার ।এছাড়াও ওর আরেকটা পরিচয়ও আছে। কৌশিক কবিতা পড়তে ও লিখতে ভালোবাসে। কৌশিকের জীবনে ক্রাইসিস প্রচুর।তাই হয়তো কবিতাগুলো বিষাদমেখে ওর কলম থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বেরিয়ে আসে।


আজ অফিসে যাবে না, প্রথমে ঠিক করলেও অফিস থেকে ও সি র ফোনটা আসতেই, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওকে অফিসের জন্য বেরোতে হল। অফিসে পৌঁছেই, সোজা ও সি র ঘরে। শুরু হলো কথাবার্তা। ও সি বললেন, "ব্যারাকপুর চিড়িয়ামোড়ের কাছেই একটি ফ্ল্যাটে থাকেন এক জোড়া নিঃসন্তান বৃদ্ধ দম্পতি। বিকাশ রায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেলথ ডিপার্টমেন্টে ছিলেন। এখন সাহিত্যকে বুকে নিয়ে অবসর যাপন করছেন। ওনার স্ত্রী দেবী রায়, গৃহবধূ। ওদের জীবনে সব আছে। সবপেয়েছির দেশে ওরা দারুন খুশিতে জীবনের গোধূলিলগ্ন কাটিয়ে যাচ্ছিলেন।"


- " বাহ্, আজকাল এমন ভালোবাসে বেঁধে বেঁধে থাকা তো আর দেখাই যায় না।" চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে কথাগুলো বললো কৌশিক। 


- " গোল টা বাঁধলো তো সেইখানেই।"


- "গোল বেঁধেছে! কি হয়েছে?"


- "আজ সকালে বিকাশ বাবু নিজের ফ্ল্যাটে স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে বিষ খেয়ে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছেন। উনি এখন নার্সিংহোমে ভর্তি আছেন। উপর থেকে অর্ডার এসেছে, ওনার বিরুদ্ধে ভারতীয় দন্ডবিধির ৩০৯ ধারায় কেস শুরু করতে হবে। উনি পুলিশের সাথে সহায়তা করছেন না। সুইসাইডের কারণ টাও জানা যাচ্ছে না। ম্যাটার টা একটু দেখে দাও।"


- " ৩০৯ ধারা তো এখন অবলুপ্তির পথে। আমি এই ধারার বিরুদ্ধে। একজন মানুষ যখন আত্মহত্যা করতে যান তখন তার পিছনে, না বলতে পারা অনেক বিষাদযাপন লুকিয়ে থাকে। তাই তাকে আত্মহত্যার চেষ্টার অপরাধে গ্রেফতার করা একদমই উচিত নয়। দেখি কি করতে পারি?"


ব্যারাকপুর পৌরসভা থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম হাসপাতালে। হাসপাতালের মেল ওয়ার্ডের চার নাম্বার বেড। কাছে গিয়ে দেখি একজন ভদ্রলোক বেডের উপর চিত হয়ে শুয়ে আছেন। স্যালাইন চলেছে, তখনও। গায়ের রং শ্যামলা, সুঠাম দেহ। দেখেই মনে হচ্ছে, একসময় শরীরচর্চা করতেন। পরম শান্তি বিরাজ করছে ওনার মুখের কান্তিতে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ওনার ওই বন্ধ দু'চোখের পিছনে হাজার শতাব্দীর বিষাদ জমে আছে। বয়স আনুমানিক সত্তর, মুখে অনেকদিনের জমে থাকা পাকা দাড়ি। 


- নমস্কার। কেমন আছেন? 


- ভালো আছি। আপনি? 


- আপনি, আমাকে আপনার কাছের মানুষ ভাবতে পারেন। 


- কাছের মানুষ! আজকাল কাছের মানুষগুলো কেনো জানি সবাই দূরে সরে সরে যাচ্ছে। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, কাছের ভালোবাসা দূরে চলে গেলে তাকে আর কাছের বলা যায়? 


- কি যে বলেন? ভালোবাসা কখনো কাছে থাকবে, আবার কখনো দূরে সরে যাবে। তবুও মনের তাগিদ থেকে, সুখস্মৃতির চাহিদায় সেই ভালোবাসা তার সব উৎফুল্লতা নিয়েই আমাদের কাছে রয়ে যাবে। 


আমার কথাটা শুনে, উনি উঠে বসার চেষ্টা করতেই, একজন নার্স ছুটে এসে ওনাকে মৃদু বকা দিয়ে শুয়ে থাকতে বললেন। 


- কি নাম আপনার? আপনার সাথে আমি কেনো এতো কথা বলেছি? 


- আমার নাম কৌশিক। আমি পেশায় একজন সাংবাদিক। আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। আপনার পাশে বসতে এসেছি। আপনার মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা না বলা কথাদের সাথে আলাপ করতে এসেছি। 


বয়স্ক সমাহিত মানুষটার ততক্ষণে দুই চোখের বাঁধ ভেঙে গ্রীষ্মের ভরা দিনে, হঠাৎ শ্রাবণ নেমে এসেছে। 


- জানেন কৌশিক বাবু আমি সরকারী কাজ করতাম। এখন অবশ্য অবসর নিয়েছি। আমার স্ত্রী দেবী, যাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। ভালোই কেটে যাচ্ছিল আমাদের জীবন। আমাদের কোনো সন্তান নেই। আমার অক্ষমতার জন্যেই.... যাইহোক, তাও আমরা বেশ ছিলাম। অবসরের পর পরেই আমার স্ত্রীর একটি কঠিন রোগ ধরা পড়লো। প্রথমটা কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেলেও, পড়ে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। ডাক্তার বললেন, আপনার স্ত্রীর খুব কঠিন রোগ হয়েছে। প্রতি মাসে অনেক টাকার ওষুধ কিনতে হবে। অনেক কষ্ট করে বেশ কয়েক মাসের ওষুধ জোগাড় করলাম। তারপরে আর পেরে উঠছিলাম না। আমাদের কাছের কিছু মানুষ ছিলেন, বিপদের দিনে তারা এগিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম ওরা ওদের স্বার্থের তাগিদে আমাদের কাছে এসেছে। তাই ধীরে ধীরে ওদের থেকে দূরে সরে এলাম। আসলে কি জানেন, নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হয়। কিন্তু তারপরে অনুভব করলাম, যার জন্য এত লড়াই সে ই আমায় ভুল বুঝছে। আর হঠাৎ করে বিষাদ নেমে এলো। আর নিতে পারলাম না।'


আমি আর বেশি কথা না বলে উঠে পড়লাম। 


- 'আজ আসি। পড়ে আবার আসবো।' কোনো রকমে কথাগুলো বলেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম। মনটা কেনো জানি চিৎকার করে কাঁদতে চাইছিল। 


কিছুক্ষনের মধ্যেই, পৌঁছে গেলাম বিকাশ বাবুর ফ্ল্যাটে। বেশ ছিমছাম ফ্ল্যাট। টু বেডরুম ফ্ল্যাট। সুন্দর করে সাজানো গোছানো। বইয়ের তাকগুলোও বইয়ে ঠাসা। তবে মাত্রাতিরিক্ত বিলাসিতা চোখে পড়লো না। 


বছর ষাটের ফর্সা, মাঝারি গড়নের দেবী রায়, ঘরে প্রবেশ করেই বললেন, 'Mr Sen নমস্কার। আমি আপনার কথা মাঝে মধ্যেই পেপারের পড়ি। লোকাল থানা থেকে ফোন এসেছিল। ওরা জানালো আপনি আসবেন। ' 


- কি হয়েছে যদি একটু বলেন? 


- আমার স্বামী, বিকাশ রায় কিছুদিন আগে অবসর নিয়েছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে আমার এক কঠিন রোগীর চিকিৎসা চলছিল। সেই চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে যখন আমাদের খুব খারাপ অবস্থা, ঠিক তখনই বিকাশ বাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পরেই ব্লাড টেস্ট, ডক্টর, হাসপাতাল। 


- কি হয়েছিল ওনার? 


- রিপোর্টে ওনার এইডস ধরা পড়েছে। 


- কি বলছেন? 


- আমিও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবতে ঘেন্না লাগছে, এই মানুষটাকেই আমি সব দিয়ে ছিলাম। একদিন নিজের পরিবার ছেড়ে, নিজের আইডেন্টিটি ছেড়ে, এক কাপড়ে বাড়ি থাকে বেরিয়ে এসে ওর সাথে জীবনটা কাটিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখেছিলাম। 


আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, 'আপনাদের ঘর দুটো একটু দেখতে পারি?' 


উনি রাজি হয়ে গেলেন। দুটি ঘরে দুটো আলাদা আলাদা বেড। দুটো আলমারি। আলমারিতে বইপত্র, দরকারী কাগজ আর পুরোনো জিনিসপত্র ঠাসা। আসতে আসতে এটা ওটা দেখতে শুরু করলাম। একটা একটা করে কাগজ বের করে পড়তে শুরু করলাম। 


-আপনার স্বামীর লেখালেখির অভ্যাস আছে নাকি?


- হ্যাঁ, ওই কবিতা-টবিতা লেখেন। ওই সব করেই তো মেয়েদের কাছে টেনে আনতো। 


- দেবী রায়ের কথায় যতটা না অবাক হচ্ছি, তার থেকেও অনেক বেশি অবাক হচ্ছি বিকাশ বাবুর কবিতায় ভাবের গভীরতা দেখে। কোথাও যেনো, সুগভীর হতাশা, বিষাদ ওনাকে ছুঁয়ে ছিল। 


কাগজগুলো ঘাটতে ঘাটতে একটা লাল রঙের ফাইল কৌশিকের হাতে এলো। 


- Mrs Roy, এটা কিসের ফাইল? 


- বলতে পারবোনা। আপনি একটু দেখে নিন। 


ফাইলের মধ্যে গুচ্ছের কাগজ। তাই এই ফাইলটা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কৌশিক। 


কাল অনেকে রাতে বাড়িতে ফিরেছে কৌশিক। আজ ও সি কে বলে একদিনের অফ নিয়ে সেই লাল রঙের ফাইল নিয়ে বসেছে সে। কাগজগুলো দেখতে দেখতে নিজের মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছিল কৌশিক। কিছু মনখারাপি হঠাৎ করে এসে মনের উপর কালি মাখিয়ে দিয়ে গেলো। ফাইলের কাগজগুলো ঘাটতে ঘাটতে একটা চিরকুটে বিকাশ বাবুর আর্তনাদ চোখে এলো - 

'রাত জানুক আমার চোখে কত জল, 

ঘুম চিনে নিক তোমায়, 

বৃষ্টি আসুক, কি এসে যায়? 

আমি বিষাদ কিনেছি হাওয়ায়।' 


আজ খুব সকালে ও সি কে ফোন করে, ব্যারাকপুর থানায় আসতে বলে কৌশিক। ওর কথামতো সবাই এসে গেছেন। সাথে দেবী রায়ও এসেছেন। 


ও সি বললেন, 'সবাইকে তো ডেকে আনলে, এবার বলো, কি বলবে? '


-' স্যার, বিজ্ঞান আজ অনেক দূরে পৌঁছে গেছে। রোজ রোজ নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। আজ এক একটা চাপধরা অন্ধকার বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় আলোকিত হচ্ছে। কিন্তু, মানুষের ভালোবাসার গভীরতা কতোটা সেটা আজও বিজ্ঞান মেপে উঠতে পারেনি। একজন মানুষের সাথে পাশাপাশি দশ বছর বা কুড়ি বছর কাটিয়েও আজ আমরা আমাদের পাশের মানুষটির মনের খবর জানতে পেড়েছি কি? বিকাশবাবু ধীর স্থির মানুষ। জীবন দিয়ে ভালোবাসা ও সম্পর্ককে বেঁধে রাখেন। বিগত কয়েক বছর ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে চলেছেন শুধুমাত্র নিজের কাছের মানুষটাকে আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখবেন বলে।'


- ' Mr Sen, প্লিজ থামুন। আপনার এই সব বানানো কথা বলা বন্ধ করুন। উনি একজন চরিত্রহীন মানুষ। উনি আমাকে ঠকিয়েছেন। আমি ওনাকে বিশ্বাস করি না। ' দেবী রায়, কথা গুলোই বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। 


কৌশিক সেন সেই লাল ফাইল থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে সবার সামনে কাগজগুলো মেলে ধরলেন। মুহূর্তের মধ্যেই গ্রীষ্মের ঘেমে ওঠা দিনেও বরফশীতল নিরবতা নেমে এলো থানার এই ঘরে। 


-' বিকাশ বাবু বিগত কয়েক বছর ধরেই নিয়মিত নিজের শরীরের রক্ত বিক্রি করে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই ব্লাড দিতে দিতেই, আজ তিনি এইডস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। Mrs Roy, অনেক ভাগ্য করলে, আজকাল ভালোবাসার মানুষ পাওয়া যায়। আপনি সেই মানুষটিকেই অবিশ্বাস করে, ওনাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন।' কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, কৌশিক সেন।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু