বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

ইওকাই

[ এই গল্পের মাধ্যমে কোনোরকম কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাসকে প্ররোচনা দেওয়া হয়নি।আশা রাখি গল্প পরার আনন্দেই পাঠকেরা এই গল্পটিকে গ্রহণ করবেন।ধন্যবাদ। ]

( দ্রুত টাইপিং এর ফলে হওয়া বানান ত্রুটিগুলো মার্জনীয় )

|| ইওকাই ||

©® -নেহা কর্মকার

( প্রথম পর্ব) 

ডাইনিং হল-এ রাখা গ্র‍্যান্ড ফাদার ক্লক-টা থেকে ঢং ঢং করে জোড়ালো আওয়াজ ভেসে আসতেই ঘুমের রেশ-টা হঠাৎ করেই ভেঙে গেল।প্রথমটায় কিছুটা সময় লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে তারপর বুকের ওপর খোলা বই'টাকে অবহেলিত হয়ে পরে থাকতে দেখেই মনে পরলো সমস্তটা।কখন যে বই পড়তে পড়তে চোখ লেগে গেছে তা খেয়ালই করিনি।চশমা-টা ঠিকঠাক করে ঘরের একপাশে দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটা-র দিকে চোখ রাখলাম।রাত ৮:০০।আশ্চর্য! এরম অসময়ে তো কোনোদিন এত গভীর ঘুম হয়নি।তবে আজ!
তারপরেই হঠাৎ মনে পরলো,আরে আজ তো বাড়িতে পরেশ'ই নেই।সে থাকলে কি বাড়িটা আর এতো শান্ত থাকত? এই বাড়ির আনাচ-কানাচে সর্বক্ষণ তার কথার ফুলঝুরি ছুটে বেড়ায়।
" আজ কিন্তু ওষুধ খাও'নি ; ওই ওষুধ শেষ হয়ে গেছে, সেই ওষুধ শেষ হয়ে গেছে ;  আজ সত্য কাকু এলো না,খালি ফাঁকিবাজি ; আজ সবজি দিয়ে ডাল রান্না করেছি,তোমার ফেভার হিট!", সারাক্ষণ বকবক! কতবার বলেছি ওটা ফেভার হিট নয়,ফেভারিট, কিন্তু কে শোনে কার কথা!

অন্য দিনগুলোতে পরেশ থাকে বলেই মালুম হয় না।আজ দোতলা নিঝুম বাড়িটা যেন একেবারে গিলে খেতে আসছে।তাছাড়া বাড়ি'টাও এই পাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে।আমার বাড়ির পিছন থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে ধূ ধূ ফাঁকা জমি'র প্রান্তর।শীতকালে এদিকটায় হাওয়ার গতিবেগ এতটাই বেড়ে যায় যে শরীরের সমস্ত হাড়,পাঁজর রীতিমতো কাঁপতে থাকে।
তবে এখন সময়'টা বৈশাখের মাঝামাঝি। সকাল থেকেই একটা গুমোট গুমোট ভাব!আবওহাওয়া দপ্তরের অধিকর্তা নিউজে এসে কিসব অদ্ভুত নামের ঝড়ের আগমনবার্তা শুনিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন রোজ।কিন্তু কোথায় কি! এই তো আজই সকালে আকাশের অবস্থা দেখে ভাবলাম বিকেলে'ই হয়তো ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে।কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দুপুরের দিকে সূর্য দেবতা প্রকট হয়ে জানিয়ে দিলেন যে শহরবাসীকে আরও কয়েকদিন এই পচা গরম সহ্য করতে হবে।তবে এখন জানলা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে চোখ পরতেই দেখলাম রাতের কালো আকাশের বুক চিড়ে সরু আলোকরেখা এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল।সাথে মৃদু গুমগুম আওয়াজ। আজ পাশের পাড়ায় পরেশ -এর বন্ধু রতনের বিয়ের নেমতন্ন আছে, সেখানেই গেছে পরেশ।ওই রতন'ই আছে যার সাথে একটু-আধটু মেশে নাহলে তো সারাক্ষণ'ই আমার সেবাযত্ন করে যাচ্ছে।

পাশের টেবিলে পরেশ ঢাকা রেখে গেছে রাতের খাবার।পইপই করে বলে দিয়ে গেছে সময় মতো খেয়ে নেওয়ার জন্য।ওষুধ'টাও পাশে রেখে গেছে মনে করে। উফ এই ছেলেটা'র সব মনে থাকে। ওর নজরের এদিক থেকে ওদিক কিচ্ছু হয় না।মাঝেমধ্যে ভাবতেও অবাক লাগে, এই পরেশ যদি না থাকত তাহলে আমার কি হত?পরেশ এসে আমার শূন্য জীবন একেবারে সম্পূর্ণ করে দিয়েছে।আমি নিজে বিয়ে-থা করিনি।একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথেই আমি পরেশকে খুঁজে পাই রাস্তার ধারে।রাস্তায় পরে গায়ে প্রবল জ্বর নিয়ে গোঙাচ্ছিল সে।দেখে ভীষণ মায়া হল।তখন ওর বয়স ওই ১৬ কি ১৭!আর আমার প্রায় ৩০ ছুঁইছুঁই! কি করে এতগুলো বছর যে পার হয়ে গেল, সেই ছোটো পরেশ এখন আমায় সামলাচ্ছে!ভাবলেও অবাক লাগে।মনেই হয় না যে ও আমার নিজের কেউ নয়!

ও কোথা থেকে এসছে?ওর অতীত কি?সেদিন রাতে ও ওখানে একা রাস্তায় কি করছিল?এইসব কিছুই ওকে আমি জিজ্ঞেস করিনি।যদি কোনোদিন ওর ইচ্ছে হয় তাহলে ও নিজেই বলবে।

হঠাৎ মেঘের মধ্যে যেন একটা আলোড়নের সৃষ্টি হলো। শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া ক্রমাগত জানলার গ্রিল পেরিয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগলো আমার অকেজো শরীরটাকে।

নিজের শরীর'টাকে এখন দেখলে একে 'অকেজো শরীর' ছাড়া যে আর কি নামে আখ্যায়িত করা যায় তা আমার জানা নেই।

এর জন্য দায়ী অবশ্যই আমি।ছোটোবেলায় যে অভিশাপের শিকার আমি হয়েছি তার থেকে বাঁচার কোনো রাস্তা নেই।সেই ভয় আমায় শয়নে স্বপনে তাড়া করে বেড়ায়।

আগে বাড়িতে একা থাকতে ভীষণ ভয় করতো। মনে হতো 'সে' আছে।আমি তাকে অনুভব করতে পারতাম।রাতে ঘুম ভেঙে গেলেও চোখ খুলতাম না ভয়ে , না জানি কোনো ভয়ানক মুখ যদি দেখে ফেলি!

মা মারা যাওয়ার পর এই ভয়'টা আরও জাঁকিয়ে বসেছিল।কত সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছি কিন্তু কেউ'ই এর সমাধান দিতে পারেনি।অবশ্য মনের রোগ হলে তো সমাধান দিতে পারতো!এটা যে কোনো মনের রোগ ছিল না,তা আমার থেকে ভালো কে'ই বা জানবে!

হ্যাঁ অনেকবারই আমি এই ভয়কে নিজের মানসিক কোনো রোগ বলে দাগিয়ে দিতে চেয়েছি।কিন্তু নিজেকে কত মিথ্যে বলে বোঝানো যায়!সে যে আছে  এটা সত্যি,আমি নিজে তাকে অনুভব করি।বারবার তো একই ভুল হতে পারেনা।ছোটোবেলায় ঘটে যাওয়া অন্যায়কে বারবার মন করিয়ে দিতে ফিরে আসে সে! নাকি এখনো সে অপেক্ষায় আছে আমার!ঠিক সময় এলেই হয়তো নিয়ে যাবে আমাকে তার সাথে তার অন্ধকার জগৎ-এ!যেমন করে নিয়ে গিয়েছিল ওদের! যেমন করে নিয়ে গিয়েছে আমার মা'কেও!

আমার মনে আছে, একবার রাতে ভীষণ শরীর খারাপ লাগতে শুরু করেছিল।বুকের বাঁদিকটায় অসহনীয় যন্ত্রণা! উফ সে যে কি কষ্ট! বুকের ভেতরটায় মনে হচ্ছিল কেউ ভারী ভারী বস্তা চাপিয়ে দিয়েছে।দম নেওয়া দায়।অথচ আমার কিন্তু কোনোদিনই কোনোরকম অসুখ ছিল না।আমার ওই অবস্থা দেখে সত্য পাড়ার লোক জড়ো করে সেই মুহূর্তেই নিয়ে যায় হসপিটালে।সত্য ছিল বলে সেবার ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছিল।ডাক্তার তার সন্দিগ্ধ দৃষ্টি বুলিয়ে বলেছিলেন," আপনি কি কোনো কারণে খুব ভয় পেয়েছিলেন? "
আমি কোনো সন্তুষ্টজনক উত্তর দিতে পারিনি।ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল," আপনার হার্ট খুব উইক!সাবধানে থাকতে হবে!"

এর বেশ কিছুদিন পর তখন আমি অনেকটাই সুস্থ,অফিস যাওয়া'ও শুরু করেছি,আসার পথেই একদিন হঠাৎ করে পরেশ'কে খুঁজে পেলাম।এরপরেই আস্তে আস্তে আমার ভয় কমতে থাকে।আসলে ওষুধ, ট্রিটমেন্ট এইসব ছাড়াও আমার একটা মানুষের প্রয়োজন ছিল।যে সবসময় আমার আশেপাশে থাকবে।পরেশের কারণেই আমি নিজের ভয়কে জয় করতে পেরেছি।তাই আজ এই বড় বাড়িতে একা থাকলেও কোনো ভয় কাজ করছে না আমার।

তবে ওই অ্যাটাক'টা হওয়ার পরেই আমার হাত পা ধীরে ধীরে কাজ করে দেওয়া বন্ধ করে দেয়।কোনো সাড় পেতাম না।এই করেই একদিন আমার পা'টা পুরোই অবশ হয়ে গেল।সেই থেকে ৫ বছর এই বিছানাতেই শুয়ে আছি।তবে ওষুধপত্র আর পরেশের মালিশের জন্য'ই মনে হয় আজকাল একটু হলেও সাড় পেতে শুরু করেছি।

রাত ১০-টার আগে আমার সেরম কিছুই করার নেই।১০-টায় ডিনার সেরে ওষুধ খেয়ে ঘুমানো ব্যাস! দু'ঘন্টা সময় এখনো হাতে।পরেশ আসবে একেবারে কাল সকালে।আমি'ই বারণ করলাম আজ ফিরতে।একটু আনন্দ করুক ছেলেটা।সবসময়ই তো আমার দেখাশোনা করে যাচ্ছে।

হঠাৎ জানলার অন্ধকার ভেদ করে শীতল বাতাসের আনাগোনা শুরু হল।সেই শীতল হাওয়া'র স্পর্শ পেতেই পুনরায় আরামে চোখ বুজলাম। কেন জানি না, আজ বড্ড ঘুম পাচ্ছে!
চোখ বন্ধ করে পুরনো দিনের কথাগুলো ভাবতে থাকলাম।আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে ছায়াছবির মতো ভেসে উঠতে লাগলো একের পর এক চিত্র।আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এক অন্ধকারময় অধ্যায়।

------------------------------------------

এতক্ষণ দরজার বাইরে অন্ধকারের আড়ালে থেকে একজোড়া চোখ ওৎ পেতে ঘরের ভেতরে থাকা মানুষটা'র সমস্ত কার্যক্রম লক্ষ্য করছিল। যে মূহুর্তে ভেতরে থাকা মানুষ'টা ঘুমিয়ে পরেছে বুঝতে পারলো, নিশ্চিন্তে সে দরজা'টা ভেজিয়ে পা টিপে টিপে নীচে নেমে এলো।
ডাইনিং-এ আসতেই সত্য তাকে চেপে ধরলো।
-" পরেশ এই পরেশ, কি ব্যাপার বলতো?তোর তো আজ রতনের বিয়েতে যাওয়ার কথা।তুই এখন এখানে কি করছিস?আর এতো লুকোচুরি কিসের?আমাকে এখানে অপেক্ষা করতেই বা বললি কেন?  "
-"আহ সত্য কাকু তুমি বড্ড প্রশ্ন করো!একটু শান্ত হয়ে বসো আগে।আর আসতে কথা বলো! "
-" তুই আগে বলতো তোর মতলব'টা কি? "
-" একটু বসো আমি আসছি! "
এই বলে পরেশ চলে যায় পাশের একটা ঘরে।কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঘর থেকে বেরিয়ে'ও আসে।তবে এবারে সত্য খেয়াল করে পরেশের হাতে একটা খাতা মতো কিছু।আর একটু কাছে আসতেই সত্য বুঝতে পারে যে ওটা ভীষণ'ই পুরোনো একটা ডায়েরি।
-" কি রে এটা কি? "
-" তোমার কর্তা বাবার ডায়েরি! "
সত্য এই কথা'টা শুনে বেশ অবাক হয়!
- " কর্তা বাবার ডায়েরি তুই কোথা দিয়ে পেলি? "
-" ওই নীচের ঘরটা থেকে "
-" নীচের ঘর!! তুই নীচের ঘরের চাবি কোথা দিয়ে পেলি।ওটা তো কত বছর ধরে তালাবন্ধ হয়ে রয়েছে! "
-" চাবি আবার কোথায় পাব?চাবি নতুন করে বানিয়েছি! "
-" এই পরেশ ঠিক করে বলতো তোর মতলব'টা কি? আমার কিন্তু কিছু ভালো ঠেকছে না!আমি এতদিন কাজ করছি কিন্তু একটা দিন'ও কর্তা বাবা আমাকে ওই ঘরে যেতে দেন'নি।উনি বলেছিলেন যে ওই ঘরের চাবি অনেক আগেই কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল! "
-" আহ অতো উত্তেজিত হয়ো না!সব বলছি।হ্যাঁ এটা ঠিক যে ওই ঘরের চাবি হারিয়ে গিয়েছিল কিন্তু সেটা ভুলবশত নয় ইচ্ছাকৃত! "
-" মানে? "
-" তোমার কর্তা বাবা মানে সমরেশ সেন -এর অতীতে এমন কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল যার সাথে আমার পরিচিত একজনের অতীত'ও ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত! বেশ কিছুদিন আগে উনি বেঁফাস কিছু কথা বলে ফেলেন আমায় আর তারপর থেকেই আমার সন্দেহ মনে দানা বাঁধে! "
-" সন্দেহ! কিসের সন্দেহ?কর্তা বাবা তোকে কি বলেছিল? আর কার অতীত জড়িয়ে থাকার কথা বলছিস?আমি তো কিছুই বুঝছি না! "

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরেশ ডায়েরি'টা এগিয়ে দেয় সত্য'র দিকে, " এটা আগে পড়ো তাহলে সব বুঝতে পারবে! "
-" আরে ও কত পুরোনো ডায়েরি। লেখা তো অর্ধেক বুঝতেই পারছি না।তার ওপর দেখতেও কি অসুবিধা হয়...."
-" উফ ছাড়ো আমি'ই পড়ছি! "
-" আরে শোন না পরেশ অন্য লোকের ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে ঘাটাঘাটি করা'টা উচিৎ হবে?..."
-" করতাম না ঘাটাঘাটি, যদি না এর সাথে আমার সেই চেনা মানুষটির অতীত জড়িয়ে থাকত।যাক গিয়ে,তুমি আগে শোনো পুরো ঘটনা'টা! "

এই বলেই পরেশ খুব সাবধানে ডায়েরি'টা খুলে প্রথমের বেশ কয়েকটা পাতা ছেড়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে পড়তে আরম্ভ করে।

ডায়েরির পাতায়.....

প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই এমন কিছু কিছু ঘটনা থাকে যা সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া যায় না।আমার জীবনে একটা সময় ঘটে যাওয়া এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা আছে যা কাউকে বললে কেউ বিশ্বাস'ই করবে না।আর সত্যি বলতে কি আমি চাই'ও না কেউ এই ব্যাপারে কিছু জানুক। এটা আমার জীবনে এক অত্যন্ত গোপনীয় একটা অধ্যায়।কারোর সাথে শেয়ার তো করতে পারব না,তাই এটা ডায়েরি'তে লিপিবদ্ধ করাই সমীচীন বলে মনে করলাম।

------------------------------------------

তখন আমার কতই বা বয়স ১৬ কি ১৭। 'বড়লোক বাবার জেদি ও বিগড়ানো ছেলে' নামেই আমার পরিচিতি ছিল।তাতে অবশ্য আমার কিছুই যায় আসতো না।বাবা-র অঢেল টাকায় অর্ধেক দিন পার্টি করে, কিংবা বন্ধুদের পিছনে খরচ করে উড়িয়ে দিতাম।বন্ধুমহলে নিজের আধিপত্য বজায় রাখা-টা আমার নেশা ছিল।
কিন্তু আমার বেহিসেবী লাইফস্টাইলে একটা বড়সড় ফুলস্টপ বসলো যেদিন জানতে পারলাম যে আমার বাবা ড.নিরজ্ঞন সেন ইললিগাল অরগ্যান পাচারের সাথে যুক্ত।আর এই কারণেই আমাদের টাকার এতো রমরমা।এই খবর ছড়িয়ে যেতেই পাবলিক ও মিডিয়া'র মধ্যে শোরগোল পরে গেল।আমার বাবা ও তার কিছু সহকারী এবং নার্সিংহোমের নামে কেস করে দেওয়া হল।এর পরেই আমার বাবা নার্সিংহোম থেকে পালানোর চেষ্টা করেন এবং অতিরিক্ত স্পীডে ড্রাইভ করার সময় একটা ভয়ানক অ্যাকসিডেন্টের সম্মুখীন হন।সেখানেই স্পটডেড।

এরপরেই আমার আর আমার মায়ের জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়।আমার মা সম্পূর্ণ ভেঙে পরেছিল এই ঘটনা জানার পর।আমরা এই ব্যাপারে কিছুই জানতাম না।কিন্তু সমস্ত ঘটনার রোষ এসে পরে আমাদের ওপর। আমার দাদু'র বন্ধু মি. যুধাজিৎ বোস সেই সময়ের একজন দুর্দান্ত ব্যারিস্টার ছিলেন।তার এবং আমার দাদু'র চেষ্টায় কোনোভাবে সেই সময় তারা আমার মা আর আমাকে জনগণের রোষের মুখ থেকে বাঁচিয়ে নেন।এরপরে আমরা চলে আসি সিকিমের একটা ছোটো পাহাড়ি গ্রাম নামচিং'এ।আমার দাদু'ই আমাদেরকে এখানে পাঠিয়ে দেন।দাদুর ট্রাভেলস এর ব্যবসা ছিল।সিকিমে তার একটা বাংলো আছে।বিভিন্ন টুরিস্ট'রা ওখানে থাকতে আসে।কিছুদিন আগেই খবর এসছিল যে বর্তমানে যিনি ওখানকার ম্যানেজার পদে ছিলেন তার হঠাৎ'ই একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়।ফলে সে এখন গুরুতর অসুস্থ। ডাক্তার তাকে কমপ্লিট বেড রেস্টে থাকতে বলেছে।এমতাবস্থায় দাদু সুযোগ বুঝে আমার মা'কে পাঠিয়ে দিলেন ওখানে।যাতে ওখানে গিয়ে মা ম্যানেজারের কাজটা'ও সামলাতে পারে আর এইদিকে কলকাতার থেকে'ও মা কয়েক বছরের জন্য দূরে থাকতে পারে।মা প্রথমে চলে গেলে'ও আমি যেতে চায়নি।আমি কোনোমতেই মানতে পারছিলাম না যে আমার বাবা আর নেই!কিন্তু একটা সময় দাদুর জোড়াজুড়িতেই আমাকে কলকাতা ছেড়ে এখানে চলে আসতে হয়।কারণ ততদিনে ইললিগাল অরগ্যান পাচারের পুরো র‍্যাকেট ধরা পরেছে। এই নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড সেখানে।বেশ কিছুটা সময় লাগবে এইসব ধামাচাপা পরতে।তাছাড়া মিডিয়া আর নানান লোকের নানান প্রশ্ন,কু মন্তব্যে জর্জরিত হয়ে দাদু আমাকে এইসবের থেকে দূরে রাখতে এই পাহাড়ি এলাকায় জোড় করে পাঠিয়ে দিলেন।

যখন সেই নামচিং'এ গিয়ে আমি পৌঁছাই তখন প্রায় লালচে আকাশে হালকা আঁধারের আনাগোনা শুরু হয়েছে।সেখানে পৌঁছে তো আমার মাথায় হাত।নামের সাথে সাথে জায়গাটা'ও বড়ই অদ্ভুত।পুরো একটা অজপাহাড়ি গ্রাম।রাস্তায় একটা কি দুটো লোক ঘোরাঘুরি করছে।কলকাতার মতো জমজমাটি জায়গা ছেড়ে এসে এই জায়গাটা'কে দেখলে আমাদের মতো মানুষের রীতিমতোই কপালে হাত দিতে হয়।

কিন্তু আমার মা ছিলেন ব্যাতিক্রম। তার এই পাহাড়ি গ্রাম বেশ মনে ধরেছিল। ওই কয়েক সপ্তাহে বেশ কাজ'ও বুঝে নিয়েছিল।কিন্তু একটা জিনিস আমার খুব চোখে লেগেছিল। এখানে আমার আসার সময় থেকেই মা যেন আমায় একটু এড়িয়ে চলা শুরু করেছিল।প্রয়োজনের বেশি একটা বাড়তি কথা'ও বলতো না।সারাক্ষণ কি যেন একটা ভেবে চলতো আর বিড়বিড় করে নিজের সাথে'ই নিজে কথা বলতো।তখন বুঝিনি, ভেবেছিলাম বাবা'র এইভাবে চলে যাওয়ার শোক হয়তো এখনো সামলে উঠতে পারেনি মা।তাই আমি'ও বেশি ঘাঁটাতাম না।

অগত্যা আমার আর কিছু করার'ও ছিল না।ততদিনে বাবার অসৎ উপায়ে কামানো টাকা'ও ফুরিয়েছে আর আমার বড়লোকি দেখনদারি'ও।হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছি।তাই নিজেকে এই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করলাম।

এখানে আসার কিছুদিন পরে এখানকার লোকাল স্কুলে মা আমায় ভর্তি করে দিলেন দাদুর পরামর্শেই।আমার দাদুকে এখানে অনেক লোকই চিনতো এবং ভীষণ সম্মান'ও করতো। মা'ও ততদিনে ম্যানেজারের থেকে ধীরে ধীরে কাজ শিখে নিচ্ছিলেন।মা খুব সহজেই এই জায়গা,এখানকার মানুষজনের সাথে মিশে যেতে পারলেও আমি পারছিলাম না।ওরম লাইফস্টাইল ছেড়ে হঠাৎ এরম গাঁইয়া পরিবেশে নিজেকে মানানো ভীষণ কঠিন।কারোর সাথেই সেরম কথা বলতাম না।তাই একা থাকতে থাকতে ডায়েরি লেখাটা আমার অভ্যেস হয়ে যায়।মনের সমস্ত কথা আমি ডায়েরি'তে শব্দবন্দি করে রাখতে শুরু করলাম।তবে খুব বেশিদিন আমায় একা একা থাকতে হয়নি।বেশ কিছু মাস পর আমার দু'জন বন্ধু হয়।বিজয় আর সুখপ্রকাশ।ওদের পুরো নাম ছিল বিজয় তামাং আর সুখপ্রকাশ ছেত্রী।আমি ওদের বিজু আর সুখু বলে'ই ডাকতাম।ওরা'ও তাই, আমায় সমু বলে ডাকতো ওরা।যদিও ওদের থেকে আমি দু-বছরের বড় ছিলাম।কিন্তু আমি'ই বারণ করেছিলাম ওদের, আমাকে দাদা বলে ডাকার কোনো দরকার নেই।

মা অবসর সময়ে এখানের বেশ কয়েকটি বাচ্চাকে পড়াতো।সুখু আমার মা-এর কাছেই পড়তো।সেখান থেকেই ধীরে ধীরে প্রথমে সুখু ও পরে সুখু'র বন্ধু বিজু'ও আমার বন্ধু হয়ে ওঠে।বয়সে ওরা আমার থেকে দু-বছরের ছোটো ছিল ঠিকই কিন্তু আস্তে আস্তে ওরা'ই আমার ভীষণ আপন হয়ে উঠলো। তাছাড়া কলকাতার বন্ধুদের সাথে তো সব সম্পর্কই চুকেছিল।তাই বিজু আর সুখু-কে পেয়ে ধড়ে যেন আমার প্রাণ ফিরেছিল।

আমাদের রোজ একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল।স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই ব্যাট,বল নিয়ে আমরা হাজির হতাম মাঠে।প্রায় দু-তিন ঘন্টা মনের সুখে খেলে নিয়ে একসাথে বাড়ি ফিরতাম আমরা।কতদিন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা অব্দি এই মাঠে মাঠে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছি।সন্ধ্যা'র অন্ধকার নামলে ধুলোবালি মেখে বাড়ি ফিরলে কত বকা'ও খেয়েছি।তবুও আমাদের রুটিনের এদিক থেকে ওদিক হতনা একদিনও।

একদিন আমি খেলতে যাওয়ার জন্য বিজু আর সুখু'র আসার অপেক্ষা করছিলাম অনেকক্ষণ।আমি সেইদিন কোনো একটা কারণে স্কুলে যায়নি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সুখু-কে আসতে দেখলাম।কী ব্যাপার, সুখু একা কেন? বিজু কই?
সুখুকে জিজ্ঞেস করাতে সে ঠোঁট উল্টে হাতের ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে সে জানে না।কারণ সুখু'ও সেদিন স্কুলে যায়নি।
অগত্যা উপায় না দেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম।তখন আমাদের অতো ফোনের চল ছিল না যে যখন ইচ্ছে হল ফোন করে জেনে নিলাম।তাই অপেক্ষা ছাড়া কোনো গতি ছিল না।কিন্তু প্রায় আধ ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েও যখন দেখলাম বিজু আসছে না তখন আমার ভারী চিন্তা হল।তাই আমি আর সুখু মিলে গেলাম বিজু'র বাড়িতে।গিয়ে দেখি বিজু মুখ কালো করে বসে আছে।

-"কিরে খেলতে যাবি না আজ?", জিজ্ঞেস করলাম আমি।বিজু আমার কথায় শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমি বুঝলাম যে বিজু'র মন কোনো কারণে ভালো নেই।নাহলে খেলতে না যাওয়ার ছেলে বিজু একেবারেই নয়।
আমি তাকে আশ্বস্ত স্বরে বললাম,
- " কিরে কিছু হয়েছে?কাকিমা কি বকেছে?"। বিজু কিছু না বলে ডানদিক বাঁদিক মাথা ঘুরিয়ে বোঝালো যে না সেরম কিছুই হয়নি।
-"তাহলে?"
এবারে বিজু বললো,
- " আসলে জিগেশি...."
-"জিগেশি!সেটা আবার কি?", আমি এমন অদ্ভুত একটা নাম শুনে প্রথমে বেশ অবাক হলাম।
-" আরে জিগেশি বিস্তা রে!!ওকে চিনিস না??",প্রছন্ন একটা বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে সুখু।
সুখু'র কথা শুনে আমি স্মৃতির পাতা ওল্টাতে লাগলাম।কিছুক্ষণ পর মনে পরলো,
- "ওহ জিগেশি!" সে তো এই গ্রাম প্রধানের ছোটো ছেলে মানে ইউনিয়ন মেম্বার জিগমে'র ভাই।এটা মনে পরবার পরেও আমার বিশেষ কোনো হেলদোল হল না।

-" হ্যাঁ তো কি হয়েছে?তোর খেলতে না যাওয়ার সাথে এর কি সম্পর্ক?!  "। আমার এরম কথা শুনে বিজু যেন আকাশ থেকে পরলো,ওর মুখের অবস্থা দেখে তাই মনে হল।
-" তুই জিগেশি'কে চিনিস না বলেই এমন কথা বলতে পারছিস! ও যা ছেলে না! ",ভয় ভয় বলে ওঠে বিজু।
-" এই তুই পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতো! ", আমি আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম।
-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিজু বললো, " ও বেশ কিছুদিন ধরেই আমার পিছনে পরে আছে।আসলে সেই প্রথম দিন থেকেই আমার সাথে ওর ঝামেলা।  ও আমায় মোটে সহ্য করতে পারে না! "
-" কিন্তু কেন?ওর সাথে তোর কিসের শত্রুতা? ", বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
-" শুনেছিলাম বাবা'র সাথে জিগেশি'র বাবা'র নাকি ব্যবসায় কি ঝামেলা হয়েছিল।ওর বাবা আর আমার বাবা একটা সময় খুবই ভালো বন্ধু ছিল।দু'জনে মিলে একটা কাঠের ব্যবসা'ও দাঁড় করিয়েছিল।কিন্তু কিছু বছর পর দু'জনের মতের অমিল হতে শুরু করে। আর এই অমিল হতে হতে একটা সময় তা চূড়ান্ত ঝামেলা'র রূপ নেয় এবং অবশেষে যা হওয়ার তাই হয়।জিগেশি'র বাবা ব্যবসা ছেড়ে নিজের ভাগ বুঝে নিয়ে সরে যায়! ", একটানা কথাগুলো বলে থামে বিজু।সমস্তটা শুনে আমি বললাম,
-" হুম সব বুঝলাম।কিন্তু সে তো অনেক বছর আগের কথা।এখন কিসের প্রবলেম? "
এবারে সুখু বললো,
- " বাবা'র পুরো ফটোকপি হয়েছে জিগেশি।বিজুকে মোটে সহ্য করতে পারে না।আসলে বিজু পড়াশোনায় এত ভালো। সবাই ওকে নিয়ে এতো মাতামাতি করে এটা ওর সহ্য হয় না।নিজে তো দু'বার ফেল করলো। তারপর থেকেই তো বিজু'র ওপর ওর রাগ! শুধু বিজু না।কয়েক বছর আগে ও রাজেশে'র সাথেও এমন করেছিল! "
-" রাজেশ! ওর সাথে কি হয়েছিল? "
সুখু আর বিজু একসাথে বলে উঠলো, " র‍্যাগিং!!"
বিজু বলতে থাকলো, " জিগেশি আর ওর একটা দল আছে।বেছে বেছে ওরা তাদেরকেই র‍্যাগিং করে যারা বিশেষত দুর্বল মনষ্কের।
রাজু মানে রাজেশ'ও সেরকমই একজন ছিল।রাজু'র ওপর মানসিক অত্যাচার তো চলছিলই।ধীরে ধীরে তা শারীরিক অত্যাচারে রূপান্তরিত হয়।জিগেশি'র বাবা এই এলাকার প্রধান।তাই কে তার সাথে ঝামেলা করতে চায়। আর এইভাবেই একদিন একটা চরম ঘটনা ঘটে যায়! "
-" কি ঘটেছিল ? ",আমি আর নিজের বিস্ময় চেপে রাখতে পারছিলাম না।এমন আকছার ঘটনা তো কলকাতার স্কুল কলেজে শোনাই যায়।কিন্তু এই গ্রাম্য পাহাড়ি এলাকাতেও যে এরম ঘটনা শুনতে হবে তা আমি ভাবিনি।কারণ আমি হামেশাই শুনেছি যে পাহাড়ি লোকেরা মিলে-মিশে থাকতেই পছন্দ করে। সে যাই হোক,মানুষের চিন্তাভাবনার বাইরে অনেক কিছুই ঘটতে পারে।এবারে আমার প্রশ্ন শুনে সুখু বললো,
-" শুনেছিলাম বেশ কিছুদিন ধরে জিগেশি ও তার দলবল মিলে রাজুকে চাপ দিচ্ছিল টাকা আনার জন্য! "
-" টাকা??!! ওর ফ্যামিলির তো ভালো অবস্থা! তো টাকার কি দরকার ছিল ওর? "
-" আরে তুই তো কলকাতার ছেলে তুই বুঝিস না? আর তাছাড়া ও অনেকবার বিজু'কেও সবার সামনে অপমান করার চেষ্টা করেছে।কিন্তু এবারে আর আগের মতো ভুল কেউ করেনি।সবাই রাজু’র শেষ পরিণতি'র কথা মনে করে আর সাহস পায়নি জিগেশি'র অপকর্ম জানার পরেও চুপ করে থাকতে। সবাই বিজু'র পাশেই দাঁড়ায়।ফলত জিগেশি'র আধিপত্য একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে! "
সুখু'র কথা শেষ হতেই আমি বললাম,
-" আচ্ছা একটা কথা বল, জিগেশি'র বাবা কি জানে ওর এই কান্ডকারখানা? "
বিজু আর সুখু দু'জনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর বিজু বলে,
-" আরে ওর বাবা বেশিরভাগ সময়েই কাজে ব্যস্ত থাকে।বাড়ি থাকেন না।আর উনি ওনার ছেলেদেরকে নিজের প্রাণের চেয়ে'ও বেশি ভালোবাসেন ও বিশ্বাস করেন।আর ওনার আস্কারাতেই ওনার ছোটো ছেলে দিন দিন গুন্ডা হচ্ছে! তাছাড়া এখানের সকলের'ই বিশ্বাস যে জিগেশি'র এইসব কান্ডকারখানা'তে ওর বাবা'র প্রছন্ন মদত আছে।
ওই যে রাজু'র কথা বলছিলাম না,একবার তো ওকে জিগেশি আর তার দলবল মিলে এমন মেরেছিল যে ওর বাঁ কাঁধের হাড়ে নাকি ফ্র‍্যাকচার হয়ে গিয়েছিল।রাজু'র বাবা জিগেশি'র বাবা'কে নালিশ করতে গিয়েছিল। কিন্তু উনি রাজু'র বাবা'র কথা তো শুনলেনই না বরং তাকে সবার সামনে অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। এই ঘটনা জিগেশি'র কানে আসা মাত্রই সে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠে।একদিন স্কুল ফেরার পথে রাজুকে পাকড়াও করে জিগেশি।তারপরে যে ঠিক কি ঘটেছিল তা জানা যায়নি!তবে এর বেশ কিছুদিন পরে....! ", এরপর হঠাৎ'ই বিজু'র গলার স্বর কাঁপতে শুরু করে। চোখে ফুটে ওঠে অপার আতঙ্ক।সুখু'র অবস্থা'ও তাই।আমি আর থাকতে না পেরে বললাম,
-" আরে থামলি কেন?তারপর বল কি হলো? "
এবারে বিজু চাপা স্বরে একটা ঢোক গিলে বলে,
-" এর বেশ কিছুদিন পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর রাজু'র লাশ মেলে। লাশ'টা লা..শ'টা মাঝখান দিয়ে আড়াআড়ি চেড়া ছিল।যেন কেউ ওর দুটো পা ধরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কাগজ ছেঁড়ার মতো ছিঁড়ে দিয়েছে শরীর'টাকে মাঝখান থেকে।চারিপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল নাড়িভুড়ি আর দলা দলা মাংস।সেগুলোতে বীভৎস পোকামাকড় বাসা বেঁধেছিল।লাশ'টা পচে এক বিকট দুর্গন্ধ বেরোচ্ছিল।একটা চোখ অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে ঝুলছিল।উফ সে কি বীভৎস!!! ",
বিজু'র কথা শুনে আমি আর স্থির হয়ে থাকতে পারলাম না। সারা শরীর গুলিয়ে উঠলো।
- " থাম থাম ভাই।আমার তো শুনেই গা হাত পা কাঁপছে! "।
-" তাহলে ভাব আমাদের কি অবস্থা হয়েছিল ওই লাশ দেখার পর! টানা এক সপ্তাহ ঠিক মতো ঘুমাতে পারিনি! ", ভীত স্বরে বলে ওঠে বিজু।
" তুই তখন সবে সবে এখানে এসছিস,স্কুলে'ও ভর্তি হসনি তখন'ও।এইসব ওই সময়ের'ই ঘটনা! "

আমার মনে পরলো,আমি এখানে আসার পর প্রায় এক মাস কিংবা তার বেশিও হতে পারে,নিজেকে ঘর বন্দি করে'ই রেখেছিলাম।তখন একবার কানে এসছিল যে কোনো এক বাচ্চা ছেলের নাকি বডি পাওয়া গেছে জঙ্গলের দিকে।কিন্তু আমি খুব একটা মাথা ঘামায়'নি।তখন আমি সদ্য সদ্য বাবা'কে হারিয়ে পুরোপুরি ভেঙে পরেছিলাম।এখন এতো সব ঘটনা শুনে আমার গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো!

আমি ভীত ভীত কন্ঠে বললাম,
- " কিন্তু ওর এই অবস্থা হল কি করে? আর সেদিন জিগেশি ঠিক কি করেছিল ওর সাথে? "
-" সে আর জানা যায়নি।রাজু’র পরিবার গরীব ছিল।রাজু'র এমন বীভৎস অবস্থা দেখার পরেও এলাকা'র লোক এই বিষয়ে কোনো মাথা ঘামায়নি।পুলিশ'ও এটা কোনো জংলী জানোয়ারের কাজ বলে এড়িয়ে গেছে।রাজু’র বাবা অনেক চেষ্টা করেছিল ওর এই ভয়ানক ঘটনা'র পিছনে আসলে কে দায়ী তাকে খুঁজে বার করার জন্য।কিন্তু কেউ'ই তাকে কোনোভাবে সাহায্য করেনি।এই ঘটনার বেশ কিছু মাস পর রাজু'র পরিবার'ও এখান থেকে অন্যত্র চলে যায়! "।
বিজু'র সমস্ত কথা শোনার পর আমি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।এরম বীভৎস ঘটনার কথা আমি আগে কখনো শুনিনি।
-" যাই হোক, এইসব কথা নিয়ে আর কোনো আলোচনা করার দরকার নেই।আজ তো প্রায় অন্ধকার হতে চললো।তোরা বাড়ি ফিরে যা।কাল যা হবে দেখা যাবে! ", একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিজু পিছনে ঘুরতেই যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই হঠাৎ সুখু বলে উঠলো , " কিন্তু আমি একটা কথা এখনও বুঝি না যে সেদিন রাজু ওই ওনি'এর জঙ্গলে গেল কি......!! ",
-" সুখু!! এটা তুই কি করলি? ", সুখু পুরো কথা'টা শেষ করতে পারলো না তার আগেই বিজু এমন আচমকা আর্তনাদ করে উঠলো যে ক্ষণিকের জন্য আমি'ই চমকে উঠেছিলাম।বিজু চিৎকার করে ওঠার সাথে সাথে সুখু'ও নিজের মুখ চেপে ধরলো যেন কি না কি বলে ফেলেছে।ওদের আবভাব দেখে এবারে আমিই ধন্দে পরে গেলাম।
-" ওনি! সেটা কি?!",এবারে দেখলাম ওরা এক ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকালো।
-" চুপ কর চুপ কর!ওই নাম নিবি না একদম! ",বিজু হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলো।
-" আহ ছাড়! কি হবে এই নাম নিলে?নে আবার বলছি ওনি ওনি ! ", এইবার কিন্তু হাসতে গিয়ে'ও হাসতে পারলাম না।কারণ বিজু এমন ক্রোধান্বিত হয়ে আমার দিকে তাকালো যে আমার বুক কেঁপে উঠলো।বুঝলাম নিশ্চয়ই কোনো ব্যাপার আছে।না জেনে ইয়ার্কি করা'টা বোধহয় উচিৎ হয়নি।

অনেকক্ষণ নিশ্চুপ দেখে ওদের দিকে তাকাতেই দেখলাম ওরা সোজা সামনে কোনো কিছুর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।আমিও ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালাম।অনতিদূরেই আধা অন্ধকার আধা কুয়াশায় ঢাকা একটা পাহাড়ের চূড়া নজরে এলো। ধীরে ধীরে চোখের সামনে দিয়ে যেন কুয়াশার পর্দা সরে আমাদের দেখার আরও উপযোগী করে তুলছে জায়গাটাকে।খানিকক্ষণ পরে পুরো পাহাড়'টা নজরে আসতেই আমার সারা শরীর শিউরে উঠলো।হিসেব মতো আর দু'দিন পরেই পূর্ণিমা। তাই সেদিন চাঁদ অনেকটা'ই গোল আর উজ্জ্বল ছিল।সেই চাঁদের আলোয় এবারে স্পষ্ট হল পাহাড়'টা।এতদিন ওখানে আছি কই কখনো তো এই পাহাড়'টা চোখে পরেনি।এই পাহাড়'টা দেখলেই কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে।বিজু আর সুখু'র দিকে তাকিয়ে দেখলাম তারা সেইদিকে তাকিয়ে রীতিমতো ঠকঠক করে কাঁপছে।ওদের থেকে দৃষ্টি পুনরায় পাহাড়ের দিকে ফেরাতেই আমার সারা শরীর শিউরে উঠলো। আমি কি ঠিক দেখলাম? মনে হল কিছু যেন একটা জ্বল জ্বল করছিল।যেন দুটো জ্বলজ্বলে চোখ!! আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।না না এ কি করে সম্ভব!!আমি ভালো করে একবার চোখ কচলে তাকালাম সেদিকে, নাহ সবকিছুই আগের মতো স্বাভাবিক। এতদিন এই পাহাড়ি এলাকায় রয়েছি।প্রথমদিকে ভালো না লাগলেও ধীরে ধীরে এখানকার প্রকৃতি,পাহাড় সবকিছুকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম।কিন্তু ওই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল যেন এক নিমেষে প্রকৃতি তার রঙ পাল্টে ফেললো।ওই যে ওই পাহাড়টা,ওই পাহাড়টাকে দেখলে মনে কোনো প্রশান্তি আসে না,আসে শুধু ভয়!!যেন কোনো প্রেতমূর্তি ওৎ পেতে আছে সেখানে তার লালসা চরিতার্থ করার জন্য।

বিজু ভয়ে ভয়ে বললো,
-" আর এখানে এক মূহুর্ত নয়।রাতের অন্ধকার গভীর হওয়ার আগেই তোরা বাড়ি যা।আর খবরদার আজ রাতে বাইরে বেড়াবি না।যাই হয়ে যাক না কেন!!বুঝেছিস??বাইরে যেন পা না পরে!! এই নিয়ে যা কথা বলার কাল সকালে বলবো! ", ব্যাস আর একটা'ও কথা সেদিন বলেনি বিজু।এক ছুট্টে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দড়াম করে দরজাটা আমাদের মুখের ওপরই বন্ধ করে দেয় সে।এরপর সুখু'ও আমার হাত ধরে বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করে। ভাগ্যিস আমার আর সুখু'র বাড়ি একদিকেই পরে নাহলে সেদিন আমার পক্ষে একা ফেরা সম্ভব ছিল না।সেদিন বাড়ি ফিরে এক মূহুর্তের জন্য স্থির হয়ে বসে থাকতে পারিনি।আমার অবস্থা দেখে মা ভেবেছিল আমার শরীর খারাপ।তাই বার বার জিজ্ঞেস করছিল আমার কি অসুবিধা হচ্ছে।কিন্তু আমি কি বলতাম তাকে?আমি তো নিজেই জানিনা কেন এমন হচ্ছিল।কি যেন একটা অজানা দমবন্ধ করা ভয় আমায় জাপ্টে ধরছিল।সেদিন কিছু না খেয়েই শুয়ে পরেছিলাম।বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে শুধু একটা কথা'ই ভাবছিলাম কখন কাল সকাল'টা হবে।

রাত তখন ক-টা জানা ছিল না।চোখে ঘুম নেই।কান আমার সজাগ হয়ে আছে।চারিপাশের নিস্তব্ধতা আজ যেন কানে তীক্ষ্ণ সূচ ফুটিয়ে যাচ্ছে।অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পর বিছানায় উঠে বসলাম।ঘরটা গুমোট হয়ে আছে।ইচ্ছে না থাকলেও মাথার কাছের জানলা'টা খুলে দিলাম।জানলার বাইরের অন্ধকারের স্তূপ আর ঘরের ভেতরের আঁধার মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।তারাভরা ছাইরঙা আকাশটার দিকে তাকিয়ে মনের এলোমেলো চিন্তাগুলো জমাট বাঁধানোর চেষ্টা করছিলাম।হঠাৎ
শরীরে বাইরের ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ পেতেই আরামে চোখ বুজে এলো।কিন্তু পরমুহূর্তে চোখ খুলতেই একটা খটকা লাগল, কি যেন একটা অস্বাভাবিক ঠেকল চোখে।ওটা কি?কোনো গাছ?নাকি কারোর অবয়ব?? যতটা সম্ভব নিজের চোখকে সংকুচিত করে দেখার চেষ্টা করলাম। নাহ ঠিক ধরেছি,ওটা কারোর অবয়বই।তবে সেটা এতক্ষণ স্থির ছিল এখন তার মধ্যে ধীরে ধীরে একটা সক্রিয়তার আভাস ফুটে উঠেছে। আমার বুকের ভেতর'টা ধক করে উঠলো। মূর্তিটা এবারে হঠাৎ হামাগুড়ি দিয়ে প্রায় আলোর গতিতে আমার জানলা লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে লাগলো।আমার হাত পা অবশ হয়ে গেছে।বুকের ভেতর'টা শূন্য হয়ে আসতে লাগল।কিন্তু কয়েক হাত দূরে থাকতেই মূর্তিটা হঠাৎ করে মিলিয়ে গেল।খটকা লাগল!আমি হ্যালুসিনেশন করছি না তো?আগুপিছু কিছু না ভেবে যতটা সম্ভব চোখ বিস্ফারিত করে,উত্তেজনায় জানলার গ্রিল ধরে বাইরের অন্ধকার ঠেলে দেখার চেষ্টা করলাম আর ঠিক তখনই কয়েক ইঞ্চি দূরে মুখের ওপারে সাঁআৎ করে ভেসে উঠলো একটা মুখ!এত কাছে যে অন্ধকারেও মণিহীন ঘোলাটে তিনটে চোখ স্পষ্ট দেখতে পারলাম।

মুখ দিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই ঘরের ভেতর ছিটকে পরলাম।মাথার পিছনে একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভূত হল।অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতেই বুঝলাম কেউ এগিয়ে আসছে আমার ঘরের দিকে।

(ক্রমশ..)


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু