বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বুদ্ধিমান টিয়া আর দুই রাজকুমার

 

একবার রাজকুমার হান্স শিকারে গিয়ে এক হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে সঙ্গী সাথীদের থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। এমনকি তাঁর পোষা টিয়া শেরনও কোথায় যেন হারিয়ে গেল। জঙ্গলের মাঝে দিন শেষ হতে লাগল হুড়মুড়িয়ে কিন্তু অনেক ঘুরেও সঙ্গীদের দেখা পেলেন না রাজকুমার। ছুটে ছুটে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি, ক্ষুধা পিপাসায় তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছিল। অবসন্ন দেহে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে একটি ঝর্নার ধারে পৌঁছালেন রাজকুমার। ঝর্নার টলটলে নীল জল দেখে তাঁর চোখ যেন জুড়িয়ে গেল। পাথরের উপর পা রেখে আঁজলা ভরে জল খেতে লাগলেন রাজকুমার। কিন্তু আচমকা ঝর্ণার আশেপাশের পাথরগুলো যেন কেঁপে উঠল। চমকে গিয়ে আশেপাশে তাকাতেই কিছুটা দূরে রাজকুমার দেখতে পেলেন একটা দৈত্য দুটো প্রকাণ্ড পিপেতে জল ভরছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, জঙ্গলে তিনি একটা দৈত্যের সঙ্গে একা--- কথাটা ভাবতেই রাজকুমারের বুকটা একটু যেন কেঁপে উঠল। কিন্তু পরক্ষনেই দৈত্যটার মুখটা একঝলক চোখে পড়তেই বেশ অবাক হলেন রাজকুমার। ওই লোমে ঢাকা প্রকাণ্ড শরীরটা বাদ দিলে দৈত্যটার মুখটা কেমন যেন মায়া ভরা। চোখ দুটোয় যেন লেগে আছে বহুদিনের বিষণ্নতা। এমন মুখ কোনো দৈত্যের হতে পারে! ঠিক যেন বিশ্বাস হল না রাজকুমারের। ইতিমধ্যেই দৈত্যটার জল নেওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে পিপে দুটো বাঁকে তুলে ঝর্ণার জলে হাত ডুবিয়ে খপ করে একটা মাছ ধরে ফেলল, তারপর সবকিছু নিয়ে হাঁটা লাগাল। রাজকুমার তরবারিটা মুঠোয় চেপে ধরে গোপনে অনুসরণ করতে লাগলেন দৈত্যটাকে। তাঁর ভারী কৌতূহল হচ্ছিল।
দেখতে দেখতে দৈত্যটা যেখানে গিয়ে থামল সেই জায়গাটা দেখে চমকে গেলেন রাজকুমার। দেখলেন জঙ্গলের ধারে এক অতিকায় প্রাসাদ। এককালে যে এই প্রাসাদের জৌলুস ছিল জোরদার তা আর বলে দিতে হয় না, তবে এখন সে সব হারিয়ে গিয়েছে। প্রাসাদের স্থানে স্থানে জমেছে শ্যাওলা, দেওয়ালে লতার সাজি। প্রাসাদের বাগানেও লম্বা লম্বা ঘাস আর গাছের জঙ্গল। রাজকুমার হান্সের কৌতূহল আরও বেড়ে গেল—এ কার প্রাসাদ! কারাই বা থাকত এখানে! এমন সুন্দর প্রাসাদের এই অবস্থা হলই বা কী করে! আর দৈত্যটার সঙ্গে প্রাসাদটার কী সম্পর্ক! এসব কথা জানার জন্য মনটা ছটফট করে উঠল রাজকুমারের। দৈত্যটা পিপে দুটো মহলের ভেতর রেখে আবার বেরিয়ে এলো বাইরে, এবার তার কাঁধে একটা ঝোলা। দৈত্যটা আবার জঙ্গলের পথে হাঁটা লাগাল, তবে এবার অন্য মুখে। রাজকুমার আবার গোপনে তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন। দেখতে দেখতে দৈত্যটা একটা বুনো ফুলের ঝোপের সামনে এসে উপস্থিত হল। তারপর বেছে বেছে সবচেয়ে টাটকা ফুলটা তুলে নিয়ে ঝোলায় ভরল। তারপর আবার হাঁটা লাগাল। জঙ্গলের পথে এঁকেবেঁকে যাচ্ছিল একটা সাপ, দৈত্যটা তাকেও খপ করে ধরে ঝোলায় পুরে ফেলল। তারপর আবার হাঁটা লাগাল। হাঁটতে হাঁটতে এবার সে যে জায়গায় এল সেখানে অনেকগুলি আপেল গাছ ছিল। দৈত্য বেছে বেছে একটি সতেজ আপেল তুলে নিয়ে ঝোলায় ভরল। রাজকুমার এতক্ষণ খিদে ভুলে ছিলেন কিন্তু আপেল দেখে আবার তার খিদেটা জোর পেয়ে গেল। রাজকুমার তাই লুকিয়ে দুটো আপেল তুলে নিয়ে খেতে খেতে দৈত্যকে অনুসরণ করতে লাগলেন। দৈত্য এবার যে জায়গায় এল সেখানে অসংখ্য ব্যাঙের ছাতা ফুটে রয়েছে, তার তলায় ব্যাঙগুলো বসে ডাকছিল গ্যাঙর গ্যাং… গ্যাঙর গ্যাং... । দৈত্যকে দেখা মাত্রই চিৎকার চেঁচামেঁচি জুড়ে দিল তারা, “পালাও পালাও আবার সেই বদমাইশ দৈত্যটা আমাদের ধরতে এসেছে... পালাও পালাও...” এই বলে ব্যাঙগুলো যে যেদিকে পারল ছুটে পালাতে লাগল কিন্তু তাও শেষরক্ষা হল না। একটা ছোটো ব্যাঙ পালাতে পারল না, দৈত্যটা ধরে ফেলল তাকে। এবার বোধহয় দৈত্যটার জিনিস সংগ্রহ করা শেষ হল, সে ফেরার পথ ধরল। দৈত্যটা এসব জিনিস কেন সংগ্রহ করছিল, কী তার উদ্দেশ্য- কিছুই বুঝতে পারলেন না রাজকুমার। তিনি স্থির করলেন দৈত্যটাকে তিনি অনুসরণ করেই যাবেন।
দৈত্যটা প্রাসাদের কাছাকাছি আসতেই রাজকুমার তরবারি বের করে আটকে দিলেন তার পথ। তারপর যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, “কে তুমি? কী তোমার পরিচয়? এই প্রাসাদে করছটাই বা কী?”
রাজকুমার অবাক হয়ে দেখলেন তাঁকে দেখে অতবড় দৈত্যটা কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আপনি কে? এখানে কী করছেন? এখানে থাকবেন না। পালান এক্ষুণি। তাড়াতাড়ি পালান…"
অবাক হয়ে গেলেন রাজকুমার। এই দৈত্য তাকে আক্রমণ না করে পালাতে বলছে কেন! তিনি কি এতই ভীতু নাকি যে পালিয়ে যাবেন। তিনি ঘাড় উঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন, “কেন পালাবো শুনি? আগে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দাও, তারপর দেখছি কী করব।“
দৈত্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনার পোশাক দেখে বোধ হচ্ছে আপনি কোনো রাজকুমার। ভালো কথা বলছি, দুষ্টু ডাইনি দেখার আগে এখান থেকে পালান, নয়ত আপনারও আমার মত অবস্থা হবে।“
এবার দৈত্যের কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলেন রাজকুমার হান্স। তিনি অবাক গলায় জানতে চাইলেন, “দুষ্টু ডাইনি! কোথায় সে? আর তোমার মত অবস্থা বলতে কী বলতে চাইছো? তুমি কি কোনোভাবে ওই ডাইনির হাতে বন্দি? আমাকে সব খুলে বল।“
দৈত্য রাজকুমারের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “কুমার এসব কথা বলার সময় নেই আমার হাতে, আমাকে এই জিনিসগুলো ডাইনির কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু তার আগে আপনি পালান। আমি চাই না আমার মত অবস্থা অন্য কারুর হোক।“
এদিকে রাজকুমার হান্সও নাছোড়বান্দা। তিনি বললেন, “না না আমি সবটা না জেনে কিছুতেই যাব না এখান থেকে।“
দৈত্য অধৈর্য্য হয়ে বলল, “উফফ আপনি তো দেখছি আমার কোনো কথাই শুনবেন না। আচ্ছা দাঁড়ান তবে, মহলের মধ্যে খবরদার ঢুকবেন না। এখানে লুকিয়ে বসে থাকুন কোথাও, আমি আসছি একটু পরে।“
এই বলে দৈত্য সুরুৎ করে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে প্রাসাদের মধ্যে ঢুকে গেল। রাজকুমার কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে একটা বড় গাছের আড়ালে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন দৈত্যটার। যদিও দৈত্যদের কথায় বিশ্বাস করার কোনো অর্থ হয় না, কিন্তু এই দৈত্যটাকে দেখে কেমন না জানি অন্যরকম লাগছিল তাঁর, কেমন মায়াভরা ওর চোখ দুটো। তাই রাজকুমার স্থির করলেন দৈত্যের কথা মেনে তিনি এখানেই অপেক্ষা করবেন।

 

 


বেশ খানিক পরে দৈত্যটা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল চুপিচুপি, একটু মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখার পর রাজকুমার যে গাছের আড়ালে ছিল, সেখানে এসে বসল যুৎ করে। তারপর বলতে শুরু করল তার গল্প।
“সে অনেকদিন আগের কথা কুমার, আমাকে আজ যেমনটা দেখছেন আমি কিন্তু তেমনটা মোটেই ছিলাম না। আমিও আপনার মতই এক সুদর্শন রাজকুমার ছিলাম। আমার নাম ছিল পিটার। এই প্রাসাদ ছিল আমার বাবার, আমাদের রাজ্য ছিল ছোটো কিন্তু শান্তিপূর্ণ। তখন আমার বয়স দশ কী বারো হবে, আমার একটা ছোট্ট বোন হল। আমাদের বংশে পরপর ছেলেই হত। তাই বহু বছর বাদে বংশে মেয়ে এসেছে বলে আমাদের পরিবারে খুশির সীমা রইল না। এদিকে আমার ছোট্ট বোনটার এমন সুন্দর রূপ যে কি বলব--- সোনার বরণ চুল, টলটলে দিঘির মত নীল চোখ, ফুলের পাপড়ির মত গোলাপি গাল, আপেলের মত লাল ঠোঁট। সবাই বলতে লাগল স্বর্গ থেকে যেন কোনো পরি নেমে এসেছে আমাদের প্রাসাদে। রাজ্যের সকলে তো ছিলই আশেপাশের রাজ্য থেকে অনেকে লোক বোনকে দেখতে আসতে লাগলেন, প্রতিবেশী রাজারা পাঠালেন উপঢৌকন। রাজ্য জুড়ে বোনের নামকরণের উৎসব শুরু হল। এই উৎসবের দিনেই এক বৃদ্ধা বোনকে দেখতে এলেন। মা বাবা আপত্তি করলেন না, ভাবলেন বয়স্ক মানুষের আশীর্বাদ পেলে বোনের মঙ্গল হবে। আমার বোন জন্মের পর থেকেই সবসময় হাসত, ওর হাসি দেখলে যে কেউ তার নিজের দুঃখ ভুলে যেত। কিন্তু ওর নামকরণের দিন ঘটল এক ভারী আশ্চর্য ঘটনা। সেই বৃদ্ধা বোনকে কোলে নেওয়া মাত্রই বোন চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল, আমরা তখনও কেউ কিছুই বুঝতে পারিনি। বৃদ্ধা এরপর বোনকে আদর করে চুমু দিতেই বোনের কান্না থেমে গেল বটে কিন্তু বোন আর হাসল না। বৃদ্ধা তখন তার ঝোলার থেকে দুটো কাঁচের বল বের করে বোনকে উপহার দিল, সেই বল দুটোর একটা ছিল লাল আর একটা ছিল সাদা। বোন দুটো বল ধরতে পারল না, তার হাত থেকে সাদা বলটা খসে পড়ল মেঝেতে, ঝনঝন শব্দে বলটা ভেঙ্গে গেল আর তার থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে একটা সবুজ ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারিদিকে। ওই টুকু বল থেকে সে কী শক্তিশালি ধোঁয়া যে বের হতে লাগল বলার নয়, সেই ধোঁয়ার চোটে আস্তে আস্তে মহলের সবাই ঘুমিয়ে পড়তে লাগল। ধোঁয়াও মহলের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে বাইরে বেরিয়ে গেল তারপর আমাদের এই ছোট্ট রাজ্যর অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ল। উৎসবে মাতোয়ারা মানুষগুলো ঘুমিয়ে পড়ল অনন্তকালের জন্য। এখানেই শেষ নয়, ধোঁয়া নাকে এসে লাগলেও আমি আর বোন ঘুমোলাম না অন্যদের মত। বোন লাল বলটাও হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলল, আর সেটা ভাঙতেই তার থেকে বেরিয়ে এলো দুটো গবলিন, টোবো আর গোবো। আমি ভয়ে ঘরের এক কোণে লুকিয়ে পড়েছিলাম, আমি দেখলাম বৃদ্ধার শরীরটা আস্তে আস্তে পাল্টে গিয়ে এক ভয়ানক ডাইনিতে রুপান্তরিত হয়ে গেল--- গাঢ় সবুজ তার শরীর, মুলোর মত লম্বা নাক, কুলোর মত ঝোলা কান, ডিমের মত বড় বড় চোখ, কুঁচকানো চামড়া, শনের মত সাদা চুল, বেগুনি আলখাল্লা আর বেগুনি টুপি পরা সেই ডাইনি খিকখিক করে হাসতে হাসতে বোনকে তুলে দিল সেই গবলিনদের হাতে। তারপর আমাকে আড়াল থেকে খুঁজে বের করে কী সব মন্ত্র বিড়বিড় করতে শুরু করল, আমি অনুভব করলাম আমার শরীরে খুব জ্বালা করছে, তারপর দেখতে দেখতে আমার হাত পা গুলো এত্ত বড় বড় হয়ে গেল, শরীর জুড়ে বেরিয়ে এলো বড় বড় লোম আর আমি রাজকুমার থেকে এমন দৈত্য হয়ে গেলাম। ডাইনির এমন জাদুর প্রভাব যে আমি ইচ্ছেমত কোথাও যেতে পারি না, এমনকি আমার মহলেও নয়। শুধু সূর্য ডুবলে বাইরে বেরতে পারি তা ডাইনির প্রয়োজনে। সেই দিন থেকে আজ অবধি আমার বোন এই মহলে থাকা সত্ত্বেও আমি তাকে চোখে দেখিনি। কেমন আছে তা জানি না, ভাল যে নেই সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। সে যে এতদিনে কত বড় হয়েছে, কেমন সুন্দরী হয়েছে তাও জানতে ইচ্ছে করে খুব, কিন্তু উপায় নেই। রোজ আমাকে ডাইনির জন্য ঝর্ণার নীল জল, জ্যান্ত মাছের চোখ, বিষাক্ত সাপের বিষথলি, ব্যাঙের নাড়িভুঁড়ি, একটা টাটকা আপেল, আর সবথেকে কচি রুয়েন্ডার ফুল জোগাড় করে এনে দিতে হয়। আরেকটা জিনিস সে নিজেই সংগ্রহ করে।“
“সেটা কী?” অবাক গলায় জানতে চাইলেন রাজকুমার হান্স।
রাজকুমার পিটার আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিলেন, “আমার চোখের জল আর আমার বোনের একটা চুল।“
উত্তরটা শুনে আরও অবাক হয়ে গেলেন রাজকুমার হান্স, তিনি বললেন, “এগুলো নিয়ে ওই ডাইনি করেটা কী?”
“ডাইনির তেল বানায়, তারপর সেই তেল চৌবাচ্চায় ঢেলে তাতে সারারাত নিজের শরীর ডুবিয়ে রাখে, এতে ডাইনির যৌবন কখনও ফুরায় না।“ বললেন রাজকুমার পিটার।
রাজকুমার হান্স ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “কিন্তু তুমি তাকে এসব জোগাড় করে এনে দাও কেন? না দিলেই তো...”
“সে উপায় নেই কুমার, আমি জোগাড় করে না এনে দিলেই ওর পোষা গবলিনরা আমার বোনকে মেরে ফেলবে। আমি চোখে নাই বা দেখতে পেলাম, কিন্তু আমার বোন তো এই মহলেই আছে।“ মাথা মাথা নাড়তে নাড়তে দুঃখী গলায় নিজের অসহায়তার কথা জানালেন রাজকুমার পিটার।
রাজকুমার হান্স আস্তে আস্তে রাজকুমার পিটারের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “সত্যি আমি তোমার গল্প শুনে বিস্মিত হয়ে যাচ্ছি। কী দারুণ কষ্টই না সহ্য করে আসছ তুমি আর তোমার বোন। তবে চিন্তা কোর না, আজ থেকে তোমার বন্ধু হলাম আমি। আমি তোমাদেরকে ওই ডাইনির কবল থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করব।“
নতুন বন্ধুর আশ্বাস বাণী শুনে প্রথমে রাজকুমার পিটারের চোখ দুটো চকচক করে উঠলেন পরক্ষণেই তার মুখে আবার আঁধার নেমে এল। তিনি বললেন, “কিন্তু কিভাবে? তুমি কোথাও যেতে গেলেই তো ওই ডাইনি টের পেয়ে যাবে!”
রাজকুমার হান্স নিজের গালে হাত দিয়ে বললেন, “ভাবতে হবে বন্ধু, সবার আগে তোমার বোনকে ওই গবলিন দুটোর হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে।“
“কিন্তু কেমন করে?”
“সেটাই তো ভাবছি, প্রাসাদে না ঢুকে কিভাবে তার সন্ধান করব!”
“চিন্তা কিসের... চিন্তা কিসের? আমি আছি তো?”
আচমকা একটা তৃতীয় কন্ঠ শুনে দুই রাজকুমার চমকে উঠলেন। পরক্ষণেই দেখলেন একটা টিয়া পাখি এসে বসেছে রাজকুমার হান্সের কাঁধে। রাজকুমার হান্স আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললেন, “শেরন তুই!”
শেরন সুর করে বলল, “হ্যাঁ রাজকুমার, সারাদিন তোমায় খুঁজছি, অবশেষে পেলাম।“
“উফফ কী যে আনন্দ হচ্ছে শেরন, তোকে কী বলব!“ এই বলে শেরনকে চুমু দিলেন রাজকুমার হান্স।
শেরন মাথা নেড়ে বলল, “আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি কুমার। আমি তোমাদের সাহায্য করব। রাজকুমার পিটার, ডাইনি আজকের মত রাজকুমারীর চুল নিয়ে চলে এসেছেন কি?”
“না, মধ্যরাত্রে যাবে।“ জবাব দিলেন রাজকুমার পিটার।
শেরন মাথা নেড়ে বলল, “বেশ। রাজকুমার হান্স মহলে ঢুকলে ডাইনি টের পেয়ে যেতে পারে কিন্তু আমি উড়ে উড়ে গেলে কিচ্ছু টের পাবে না।“
এরপর বাকি পরিকল্পনাটাও দুই রাজকুমারকে বেশ ভালো করে বুঝিয়ে দিল শেরন। রাজকুমার পিটার অবাক হয়ে শেরনকে দেখছিলেন। সেটা দেখে রাজকুমার হান্স হেসে বললেন, “শেরন কোনো সাধারণ টিয়া নয় পিটার, ও এক পণ্ডিত জাদুকরের কাছে মানুষ হয়েছিল। জাদুকর মারা যাওয়ার আগে আমাকে উপহার হিসেবে দিয়ে যান শেরনকে। তাই শেরনের জ্ঞান আর বুদ্ধির কাছে অনেকসময় আমাকেও হার মানতে হয়।

তখন মধ্যরাত্রি। রাজকুমার পিটার ফিরে গেছেন ডাইনির কাছে। বাইরে রাজকুমার হান্স অপেক্ষা করছেন শেরনের জন্য। শেরন চুপিসারে ডাইনির কক্ষের সার্সিতে বসে দেখল ডাইনি একটা বিরাট কড়ায় জল নিয়ে উনুনে বসাল। তারপর দুলতে দুলতে একে একে সেই কড়ায় রাজকুমার পিটারের সংগ্রহ করে আনা জিনিসগুলো মিশিয়ে দিল। কাঁচের কয়েকটা বয়াম থেকে আরও কী কী সব নিয়ে মেশাল সেই জলে আর সঙ্গে সঙ্গে নীল জলটা গাঢ় সবুজ হয়ে ফুটতে লাগল। ডাইনির মুখে ফুটে উঠল তৃপ্তির হাসি। সে এবার কড়াই ছেড়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে তার উড়ন্ত ঝাড়ুতে চড়ে রাজকুমারীর কক্ষের দিকে রওনা হল। শেরন নিরাপদ দুরত্বে থেকে তাকে অনুসরণ করতে লাগল। আর এদিকে ডাইনির তেল ফুটতে থাকল কড়ায়। আড়াল থেকে এই সুযোগটারই অপেক্ষা করছিলেন রাজকুমার পিটার। তিনেক তার পোশাকের ভেতর থেকে বের করে আনলেন একটা বৃদ্ধ গিরগিটির মৃতদেহ। এটাও শেরনেরই জোগাড় করা। তারপর রাজকুমার পিটার সেটাকে মিশিয়ে দিলেন ডাইনির তেলে, ভুড়ুক ভুড়ুক শব্দে সেই বৃদ্ধ গিরগিটির দেহটা মিশে গেল সবুজ তেলে; ডাইনি কিছু টেরও পেল না।
অন্যদিকে শেরন ডাইনিকে অনুসরণ করে পৌঁছে গেল একটা ছোট্ট অন্ধকার কক্ষে। কক্ষ অন্ধকার হলে কি হবে, কক্ষের মধ্যে ছিন্ন পোশাকে যে বসেছিল তার রূপের ছটায় ঘরটা যেন আলোকিত হচ্ছিল। আর মেয়েটাকে ঘরের বাইরে বসে পাহারা দিচ্ছিল দুটো গবলিন। ডাইনি এসে মেয়েটার একটা চুল ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল। শেরনও ফুড়ুৎ করে বাইরে বেরিয়ে এসে খবরটা দিল রাজকুমার হান্সকে।
রাজকুমারীর চুল এনে রাজকুমারের চোখের জলের সঙ্গে মিশিয়ে ফুটন্ত তেলে মিশিয়ে দিল ডাইনি। মনে তার ভারী আনন্দ। আজকে অবশ্য রাজকুমারের চোখে জল আনতে একটু বেগ পেতে হচ্ছিল ডাইনিকে। অন্য দিন তো একটুতেই সে কেঁদে ফেলে, আজকে কী হল কে জানে! যাইহোক, ডাইনি তাতে বিশেষ পাত্তা দিল না। একটু কসরৎ করতেই জল বেরিয়ে এল।
এদিকে বাইরে থেকে শেরনের দেখানো কক্ষের দিকে তাকালেন রাজকুমার হান্স। অনেক উঁচু সেই কক্ষ। তবে ভয় পেলেন না রাজকুমার, যুদ্ধবিদ্যায় এমন উঁচু দেওয়াল বেয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তিনি। তরবারির কোপে বাগানের কিছু বৃদ্ধ গাছের ঝুরি কেটে দড়ির মত বানালেন তিনি। পোশাকের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট ধারাল অস্ত্র বের করে দড়ির মাথায় আটকে দিলেন। তারপর সেই দড়ি ছুঁড়ে দেওয়ালে আটকে দিয়ে দড়ি বেয়ে বেয়ে উঠতে লাগলেন। অন্যদিকে শেরন উড়ে গিয়ে ওপরে উঠে পাহারাদার টোবো গবলিনের মাথা নোংরা করে দিল। টোবো তো রেগে লাল, সে শেরনকে ধরতে গেল কিন্তু শেরন আরও উঁচুতে উঠে গেল। টোবো আর গোবো মিলে শেরনকে ধরার জন্য লম্ফঝম্প করতে লাগল। তাদের খেয়ালই রইল না রাজকুমারীর কথা। এদিকে রাজকুমার হান্স চুপিচুপি এসে দাঁড়ালেন রাজকুমারীর কাছে। রাজকুমারী তো অবাক, তিনি তো এর আগে কোনোদিনও মানুষ দেখেননি। রাজকুমার হান্স যখন তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন যে তিনি তাঁকে উদ্ধার করতে এসেছেন, তখনও রাজকুমারীর যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না, কিন্তু তিনি ভাবলেন ডাইনির কাছে বন্দি থাকার চেয়ে আর কী খারাপ হতে পারে! তাই তিনি রাজকুমারের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন।
শেরনের পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত গবলিন দুটোর যখন খেয়াল হল রাজকুমারীর কথা, ততক্ষণে রাজকুমারী রাজকুমার হান্সের সঙ্গে চলে গিয়েছেন। গবলিন দুটো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছুটল ডাইনিকে খবরটা দিতে কিন্তু তারা পৌঁছানোর আগেই ডাইনি চৌবাচ্চায় তার তেল ভরে পরম নিশ্চিন্তে ডুবিয়ে দিল তার শরীর। কিন্তু অন্যদিনের মত আরাম লাগার পরিবর্তে তার গোটা শরীর জুড়ে প্রচণ্ড জ্বলুনি শুরু হল। চিৎকার করে চৌবাচ্চা থেকে উঠে পড়তে চাইল ডাইনি কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। বিষাক্ত তেলে ডাইনির শরীরটা গলে গলে পড়তে লাগল একটু একটু করে... দেখতে দেখতে রাজকুমার পিটারের চোখের সামনে ডাইনির সমস্ত শরীরটা গলে মিশে গেল তেলে। আর সঙ্গে সঙ্গে পিটারের শরীরেও এক অদ্ভুত আলোড়ন শুরু হল, তার শরীরের বড় বড় লোম উধাও হতে লাগল, দৈত্যের মত প্রকান্ড হাত পা ছোটো হয়ে আসল রাজকুমার পিটারের শরীরটা ফিরে এল। তবে এখন আর বালক পিটার নয় নিজেকে যুবক রূপে দেখলেন তিনি। প্রাসাদ এবং রাজ্যে এতদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোও জেগে উঠতে লাগল আস্তে আস্তে। বাইরে দাঁড়িয়ে রাজকুমার হান্স আর রাজকুমারী দেখলেন প্রসাদটাও ফিরে পাচ্ছে তার নতুন রূপ। আনন্দে বহু বছর বাদে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন রাজকুমারী।

শেরনের ডাক শুনে পুব দিকে তাকিয়ে হান্স দেখলেন নতুন ভোরের সূর্য উঠছে সেখানে।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু