বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

চাঁদে ঘুরে আসার রূপকথা

 

……..বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নীচু হ’য়ে প্রণাম ক’রলো সৃজা; তারপরে ডায়াসে দাঁড়িয়ে শুরু ক’রলো ওর বক্তৃতা,- বক্তৃতা নয়, বাবার ছবির সঙ্গে ওর কথা:-

“বাবা, আজ তোমাকে বিদায় জানাতে এসে শুরু ক’রছি তোমারই বারবার বলা রূপকথার গল্প দিয়ে। এটি আমার প্রথম শোনা গল্প। কতবার যে তোমার কাছে শুনেছি এ গল্প, তার কোনো হিসেব নেই। প্রতিদিন রাত্রে তোমার কাছে এ গল্পটা না শুনলে আমার ঘুম আসতো না। প্রথম প্রথম অনেক কথার মানে বুঝতাম না; তাই তুমিও খুব অল্প কথায় গল্প ব’লতে; গল্পের বেশীর ভাগ বুঝতাম তোমার হাত-পা নাড়ানো দেখে, তোমার নানান্ রকম গলার স্বর শুনে। আকাশের গায়ে মই রেখে চাঁদে যাওয়া যায় কিনা তখনও জানিনা; জানিনা কত জোরে ঢিল ছুঁড়লে ঢিলটা মাটিতে ফিরে আসবে না, পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকবে অনেকটা চাঁদেরই মতো; জানিনা পৃথিবীর চারপাশে ঘোরার সময় পৃথিবীর আকর্ষণ ছেড়ে বাইরে যাবার জন্যে কতটা বাড়াতে হবে গতিবেগ; সত্যি ব’লছি, তখন জানতাম না গতিবেগ কাকে বলে, আর কি ক’রে মাপতে হয় গতিবেগ। তখনও চিড়িয়াখানায় গিয়ে হাতী বা বাঘ দেখিনি। হয়তো, তুমি দেখিয়েছো বাঘের আর হাতীর ছবি। হাতী বা বাঘ কি ভাষায় কথা বলে জানিনা, কিন্তু তোমার গলায় শুনে অনায়াসে বুঝতে পারতাম কে কথা ব’লছে – সে হাতীই হোক্ বা বাঘ বা অন্য কোনো জন্তু। হাতীর শুঁড় দোলানোটা পরে মিলিয়ে দেখেছিলাম দেওয়াল ঘড়ির পেণ্ডুলামের সঙ্গে। বাঁই বাঁই ক’রে ঘুরিয়ে যে জোরে ছুঁড়ে দেওয়া যায় সেটা বুঝে গিয়েছিলাম আমার কথা ব’লতে শেখার পরেই; এর অনেক অনেক পরে শিখেছি কেন্দ্রাতিগ বল বা centrifugal force কাকে বলে।

মা আর জ্যাঠাইমার কাছেও শুনেছি অনেক রূপকথার গল্প - দৈত্য-দানব, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি, পক্ষীরাজ ঘোড়া, রাজা-রানী, রাক্ষস-খোক্কস, বন্দিনী রাজকন্যা, বীর রাজপুত্র, আরও কত কী নিয়ে। সে সব রূপকথায় থাকে না আমার মতো কুৎসিৎ মেয়েরা। রূপকথার শুরুতে থাকে এক রাজকুমারী যার চম্পাবতীর চাঁপার মতো রঙ - মেঘবরণী কৃষ্ণকেশী লজ্জাবতী ঢঙ; তারপরে সে হঠাৎ দেখে জ্যোত্স্না ঢাকা আলের পথ বেয়ে আসছে স্বপ্নদেশের রাজার কুমার - তার দিকেতে চেয়ে। নয়তো কোনো রূপকথায় থাকে সিণ্ডেরেলা, যার সৎমা ওকে দিয়ে বাড়ীর সব কাজ করাতো আর সৎমা তার নিজের মেয়েদের সাজিয়ে গুজিয়ে আদরে রাখতো, ভাবতো কোনোদিন এক রাজপুত্র আসবে আর ওর নিজের মেয়েদের নিয়ে যাবে বিয়ে করার জন্যে। অবশেষে এসেছিল এক রাজপুত্র, সঙ্গে নিয়ে এসেছিল এক পাটী জুতো, খুঁজছিল এমন একজন মেয়েকে যার পায়ে ঠিক-ঠিক হবে জুতোটা।  সিণ্ডেরেলাদের বাড়ীতে আসার আগে রাজপুত্র শহরের অনেক মেয়েকে জুতোটি পরাবার চেষ্টা ক’রেছে, কারুর পায়েই ঠিক হয়নি। সিণ্ডেরেলাদের বাড়ীতে এসে রাজপুত্র প্রথমে চেষ্টা ক’রেছে সিণ্ডেরেলার বোনেদের পায়ে পরাবার জন্যে; কারুরই পায়ে ঠিকমতো পরানো যায়নি। তারপর সিণ্ডেরেলার পায়ে চেষ্টা ক’রতেই দেখা গেল, ওর পায়ে জুতোটা একদম ফিট। তারপর রাজপুত্র সিণ্ডেরেলাকে নিমন্ত্রণ ক’রলো রাজপ্রাসাদে, বিয়ে করার জন্যে।

কোনো কোনো রূপকথায় আবার দেখা যায় অমানবিক শাস্তির উদাহরণ; শিশুমনের উপর এর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। দুষ্টু রাণীদের নীচে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়ে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা কোনো দেশের আইনই মেনে নেবে না। বাবা, তুমি বরাবর ব’লে এসেছো, - খারাপ ছেলেমেয়েদের ঘৃণা ক’রো না, শাস্তি দিয়ে তাদের শেষ ক’রে দেবার বদলে, শুধরে দাও তাদের, যাতে তারা কারুর ক্ষতি না ক’রে, বরং উপকার করে তার আত্মীয় আর বন্ধুদের।   

তুমি আর আমি বরাবর এও ভেবেছি, যে রূপকথাগুলোতে মেয়েরা স্বনির্ভর নয়, বিয়ে ক’রে স্বামীর উপর ভরসা ক’রেই তাদের বাঁচতে হবে। কাজেই তোমার রূপকথা বিয়ে ক’রে বাকী জীবন সুখে থাকার জন্যে নয়, তোমার রূপকথা কোনো কিছু গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখার, আর সে স্বপ্ন পুরো করার জন্যে গল্প ফাঁদার।

 

আর কোনো ভূমিকা না ক’রে তোমার, না আমার রূপকথার গল্পটা ব’লে নিই; দেখো আমার ঠিকমতো মনে আছে কিনা; তুমিও প্রতিদিনই একটু নতুন ক’রে ব’লতে, একটু নতুন নতুন শব্দ, নতুন নতুন ঘটনা জুড়ে দিতে। আমারটাও একটু আলাদা হ’তেই পারে।…

 

দোল্, দোল্, দোলনা – বাবা, আর একটু ধাক্কা দাওনা; গায়ে আমার পশমের ঢাকনা, ক্লিক্ – সীট বেল্ট বেঁধেছি দেখো না? হোক্ না এরোপ্লেন এ দোলনা; জানলা দিয়ে উড়ে যাক্ না!

জানলা দিয়ে উড়ে যাওয়া যাবে না; এ দোলনা জানলার শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে গলবে না; বাড়ীর ভিতর দিয়েই ক’রতে হবে আনাগোনা; হোম-টাস্ক ক’রতে ব্যস্ত, ব’লছে দিদিসোনা,- ‘এক টাকায় হয় ষোলো আনা’; অঙ্ক কষে লিখলো দাদা উত্তর – তিন আঠারোং চুয়ান্ন, চার আঠারোং বাহাত্তর। তাস খেলছে ঠাকুমা – ক’রলাম তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম; বেজায় খুশী ঠাকুর্দ্দা, হাতে তাঁর রঙের গোলাম।

চ’ললো দোলনা সিঁড়ি বেয়ে, পড়লো এবার ছাতে গিয়ে; সেখানে কাকা-পিসী ব্যস্ত কি নিয়ে; কাকার হাতে এক লাল ঘুড়ি; পিসি দাঁড়িয়ে লাটাই ধ’রি: এবারে দোলনা আমার যাবে উড়ি। এসেছে আমার পক্ষীরাজ হেলিকপ্টার; দোলনা আমার ফিট হ’লো ভিতরে তার। ব’ললাম, ‘ওড়ো এবার পক্ষীরাজ, নিয়ে চলো শুণ্ডি।‘ উড়লো হেলিকপ্টার শুণ্ডির দিকে তার মুণ্ডি।

খুশী হ’য়ে বিদায় দিলো পাড়ার যতো লোকজন; হাত নাড়িয়ে ব’ললো সবাই,- ‘ফিরে এসো, দোলন।‘ কাঁদছিল পাশের বাড়ীর ছেলেটি, চেঁচিয়ে বলে, ‘আমিও যাবো‘; ব’ললাম, ‘এবারে ভাই, এতটুকু জায়গা নাই; পরের বারে নিয়ে যাবো।‘ ওর মা দু-হাতে শাঁখ বাজালো, ‘ফিরে এসো’, ব’লে বিদায় দিলো; পক্ষীরাজ স্পিড বাড়ালো; দ্রুত পাড়া থেকে চলে গেলো।

চলে গেলাম পাড়া ছেড়ে; চলছি ট্রেণ লাইন ধ’রে; ধোঁয়ার লাইন মাথার উপরে; চলেছে ধোঁয়া পিছন ফিরে; ট্রেণের মাথায় পক্ষীরাজ ওড়ে; গতিবেগ তার গেলো বেড়ে; এগিয়ে চললো ট্রেণকে ছেড়ে। পেরিয়ে গেলাম কতো গ্রাম, কতো শহর; কাটলো ঘন্টা কাটলো প্রহর।

চোখে পড়লো এক নদী এর পরে; ডাঙায় তার ছাগল আর গরু চরে। শুধোলাম তারে, ‘তুমি কোথা থেকে এসেছো বলো নদী?’ ব’ললো নদী, ‘ব’লবো, ঢেউ ধ’রে ধ’রে ওপরে চলো যদি’।

চললো আমার পক্ষীরাজ নদীর তরঙ্গ ধ’রে, অ্যাঁকাব্যাঁকা পথ অনেকটা নীচ থেকে উপরে। নদীর দুপাশে ছোটো ছোটো গ্রাম পড়লো আমার চোখে। ষাঁড় নিয়ে কতো চাষা ক’রতেছে চাষ, লাঙ্গল নিয়ে কাঁধে। হলুদ পাখী উড়িয়ে দিলো একটা ছোট্ট রাখাল ছেলে; ব’ললো, ‘যা উড়ে যা পক্ষীরাজের দিকে ডানা মেলে।‘

কত ছেলে, কত মেয়ে, কত বুড়ো, কত বুড়ী নদীতে এসেছে ক’রতে স্নান; কোথায় রাখবে গামছা, কোথায় জামা, কাপড়; কখন ক’রতে হবে পরিধান। ধোপারা এসেছে কাচতে কাপড় এই নদীর ধারে ধারে; শপাং শপাং লাঠির ঘায়ে যতো ময়লা খসে খসে পড়ে। ধোপার গাধাটা দাঁড়িয়ে পাশে, না বুঝেই মাথাটা নাড়ে।

চোখে পড়লো নদীর ধারে বিরাট একটা শ্মশান। ‘বলো হরি, হরি বোল’. ব’লে কারা ধ’রেছে গান। কাঠের বিছানায় জ্বললো আগুন, উঠলো অনেক ধোঁয়া; উপরে তাকিয়ে যত পরিজনেরা; স্বর্গ কি যাবে ছোঁয়া?

অবশেষে নদীর উৎসে পৌঁছালো পক্ষীরাজ আমার। শুরু যেখানে জলের ধারার, সেখানে অনেক পাহাড়।

 

এর পরে হিমালয়ের চূড়োয় গিয়ে আমাকে, ক’রতে হ’ল অবতরণ পক্ষীরাজের থেকে; হেঁটে গেলাম এক রকেট স্টেশনের দিকে; সেখানে গিয়ে চড়লাম স্যাটার্ন-৫ স্পুটনিকে।

একটু পরে ছাড়লো রকেট তীব্র বেগে, নিদারুণ জোরে, অনেক অনেক উঁচুতে উঠে দিলো স্পুটনিকটাকে ছুঁড়ে। ঘন্টায় আটাশ হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটলো স্পুটনিক, যাতে পৃথিবীর টান ওকে নামাতে না পারে; ওর রইলো না কোনো ওজন। পৃথিবীর চার পাশে দেড় পাক ঘুরে চললো স্পুটনিক, পৃথিবী থেকে তিনশো চুরাশি হাজার চারশো কিলোমিটার দূরে, অ্যাপোলো থেকে ঈগল চাঁদে ক’রলো অবতরণ। ঈগল থেকে বেরিয়ে পা রাখলাম আমি চাঁদের মাটিতে।

নতুন জায়গায় এসে অবাক আমি; কোথায় কী আছে জানিনা; ভাবলাম কাউকে জিগ্যেস ক’রে জেনে নিই; কিন্তু জিগ্যেস ক’রবো কাকে? এখানে জনমানব নেই; এমনকি পৃথিবীতে গাছপালা, উদ্ভিদ, প্রাণী বা জন্তু জানোয়ার যা দেখেছি, তার কিছুই নেই এখানে। ঈগল থেকে নিয়ে এলাম একটা স্টেথোস্কোপ আর একটা গগল্স্ চশমা। এই স্টেথোস্কোপটা কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীকে ছোঁয়ালে তার মনের কথা ভেসে আসে আমার কানে। এই গগল্স্ চশমা দিয়ে দেখতে পাই ইতিহাস; যার দিকে তাকালাম, সে কবে কোথায় জন্মেছে, কে দিয়েছে ওর জন্ম, ওর মা ও বাবার পরিচয়, সব বুঝতে পারি আমার নিজের ভাষায়।  

আমি এখানে থাকবো মাত্র কয়েক ঘন্টা; খাদ্য, পানীয় যা আমার দরকার সবই আছে ঐ ঈগলে; দরকার পড়লে খেয়ে আসি ওখানে গিয়ে; মল-মূত্র ত্যাগ ক’রি চাঁদের মাটিতেই; হয়তো সারের কাজ ক’রবে ওগুলো। কিছু বীজ, কিছু উদ্ভিদের চারা নিয়ে এসে এখানে দিয়েছি পুঁতে; হয়তো পরে আর কেউ এসে দেখবে আমের গাছ; পেড়ে খাবে কাঁচা বা পাকা আম। একটা গামলা ভ’রে তুলে নিলাম অনেকটা চাঁদের মাটি; পৃথিবীতে নিয়ে গিয়ে এতে নানা রকমের চারা পুঁতে দেখবো কোন্ কোন্ ফসল ফলানো যায় চাঁদের মাটিতে।

এবারে ফেরার সময় হ’লো আমার। গিয়ে ব’সলাম ছোট গাড়ীর মত একটা কৌটোয়। ঈগলের মধ্যে একটা যন্ত্র আছে, কোনো কিছুকে খুব জোরে উৎক্ষেপ করা বা ছুঁড়ে দেওয়র জন্যে; এই যন্ত্রটাই ছুঁড়ে দিল কৌটোটাকে স্পুটনিক কলিনসের দিকে। স্পুটনিক কলিনস্ লুফে ধ’রলো কৌটোটা, তারপর কৌটোটা নিয়ে তিরিশ পাক প্রদক্ষিণ ক’রলো চাঁদকে। এর পরে বেরিয়ে এলো চাঁদের কক্ষপথ থেকে; শুরু ক’রলো তিনশো চুরাশি হাজার চারশো কিলোমিটার পথ পৃথিবীর দিকে।

পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছে এক পাক ঘোরার পর, পৃথিবীর কাছাকাছি এসে স্পুটনিক আমাকে একটা জীবন্ত ঈগল পাখীর পিঠে বসিয়ে ছেড়ে দিল। ঈগল পাখী আমাকে পিঠে নিয়ে ঘুরতে বেরোলো ভারতবর্ষের উপর দিয়ে।  ঈগল পাখীর পিঠে ব’সে দেখলাম, প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টির ভয়ে ভয়ার্ত্ত মানুষ ‘অশনি’র অপেক্ষা ক’রছে। তারপর এলাম সুন্দরবনের উপর; সেখানে দেখলাম হাতী, বাঘ আর কুমীরের কাণ্ড-কারখানা।….

 

দুপুরের খাওয়াটা বেশ ভালো হ’য়েছে হাতীর; বনের একপাশে দাঁড়িয়ে ঢুলতে ঢুলতে ঘুমিয়ে পড়লো হাতী। তার লম্বা শুঁড়টা দুলতে রইলো পেণ্ডুলামের মতো এপাশ থেকে ওপাশ – ডিং ডং, ডিং ডং।

ওদিকে বাঘও বেড়াতে বেরিয়েছে; বেড়াতে বেড়াতে এসে পড়লো বনের পাশে হাতীর কাছে। হাতীর দোদুল দোলা ঝোলানো শুঁড়টা দেখে ভারী মজা লাগলো বাঘের, ভাবলো শুঁড় ধরে একটু ঝুলে নিই, দুলে নিই। লাফ দিয়ে হাতীর শুঁড়ের ডগাটা কামড়ে ধ’রলো বাঘ, ঝুলতে লাগলো দোদুল-দুল।

হাতীর ঘুম গেল ভেঙ্গে, হাতী ক্ষেপে উঠলো রেগে; শুঁড় দিয়ে ধ’রে বাঘকে তুলে ধরলো মাথার উপরে; বাঁই-বাঁই করে ঘোরালো তিনবার, ছুঁড়ে দিল বাঘটাকে, শূণ্যে অনেক জোরে, অনেক দূরে।

বাঘটা উড়ে গিয়ে পড়লো দূরে, একটা পুকুরে। একটা মস্ত কুমীর ছিলো সেই পুকুরে, ওৎ পেতে, হাঁ করে; ঠিক সেই হাঁয়ের মধ্যে গিয়ে পড়লো বাঘটা।

কুমীর সঙ্গে-সঙ্গে বন্ধ ক’রলো তার মুখ, তার ধারালো দাঁতের চাপে দুখান হ’লো বাঘটা। বাঘের কোমর থেকে দুটো পা-সমেত পেছনের আধখানা রইলো কুমীরের মুখের মধ্যে; মাথা-সমেত বাঘের সামনের আধখানা পুকুরের জলে সাঁতার কাটতে রইলো সামনের দুটো পা দিয়ে, পেছনের আধখানার খেয়ালই নেই। বাঘের রক্তে পুকুরের জল উঠলো লাল হ’য়ে।

ওদিকে হাতী চলতে শুরু ক’রেছে বাঘকে ছুঁড়ে দেওয়ার পরেই। চলতে চলতে হাতী এসে পড়লো সেই পুকুরের কাছে; দেখলো আধখানা বাঘ জলে সাঁতার কাটছে। বাঘের জন্যে খুব কষ্ট হ’লো হাতীর মনে। ওকে বাঁচাতে চাইলো হাতী। কুমীরকে হুকুম দিলো মুখ হাঁ করার জন্যে।

কুমীর যেই হাঁ ক’রলো, ওর মুখ থেকে বাঘের পেছনের আধখানা তুলে নিজের পিঠে চাপালো হাতী; তারপর জলে ভাসা বাঘের সামনের আধখানাটাকেও পিঠে তুলে নিলো।

হাতীর পিঠে এখন পুরো বাঘটাই, কিন্তু দুটো আধখানা ক’রে ভাগ করা। হাতীর মোটা মাথায় এখন বড়ো চিন্তা – কী ক’রে জোড়া যাবে বাঘের দুটো আধখানাকে?

হাতী খুঁজতে বেরোলো কে জুড়তে পারবে বাঘের দুটো আধখানাকে।

 

আমি তখন ঈগলের পিঠে চড়ে বাঘ আর হাতীর কাণ্ড-কারখানা দেখছি; ভাবলাম কিছু ব’লি; কিন্তু ঈগল চায় না  - আমি এখানে নামি।

 

খুঁজতে খুঁজতে হাতী গেলো বাবুই পাখীর কাছে,- ‘বাবুই ভায়া, এই দুটো টুকরোকে জুড়ে দাওনা ভাই!’

‘ও আমার কম্মো নয়’ – ব’ললো বাবুই, - ‘আমি খড়ের সুতো দিয়ে বাসা বুনি, কিন্তু বাঘ সেলাই ক’রতে পারবো না। বাঘের দুটুকরো জুড়তে চাই সেলাই মেশিন।‘

হাতী আর বাবুই মাথা চুলকে ভেবে মরে – কী ক’রবে তারা? কী করে জুড়বে দুটো আধা বাঘ?

‘যাওয়া যাক দোলনের বাড়ী।‘, - ঠিক ক’রলো তারা।

বাবুই ব’সলো হাতীর মাথায়। মাঝে মাঝে বাবুই মাথা থেকে উঠে উড়ে উড়ে দেখায় দোলনের বাড়ীর পথ, আর হাতী যখন ঠিক সোজা পথে চলে তখন আবার হাতীর মাথায় এসে বসে। বাঘের দুটো আধখানা পিঠে নিয়ে হাতী চললো দোলনের বাড়ীর দিকে।

 

ইতিমধ্যে ঈগলের পিঠে চেপে বাড়ী পৌঁছেছে দোলন।

 

শুঁড় দিয়ে ধাক্কা মারলো হাতী দোলনের বাড়ীর দরজায়। দোলন দরজা খুলে অবাক। দরজা ভাঙতে হ’লো হাতীকে ঘরে ঢোকানোর জন্যে।

হাতী দোলনকে খুলে ব’ললো সব কথা, ব’ললো, ‘বাঘকে বাঁচাও, জুড়ে দাও বাঘের দুটো আধখানা।‘

দোলনেরও মন গ’ললো, সে একটা সাদা চাদর পেতে দিলো লম্বা টেবিলে, হাতী তার উপর শোয়ালো বাঘের দুটো আধখানাকে।

দোলনের মা পুটুম এলো তার সেলাইকল নিয়ে; বাঘের দু টুকরোকে চেপে ধরে সেলাই ক’রে দিলো জুড়ে।

‘সেলাই করা বাঘ – এখন কি ঠিকঠাক?’- জিগ্যেস ক’রলো হাতী।

চতুর দোলন নিয়ে এলো একটা দুধের বোতল, পুরে দিলো বাঘের মুখে, দেখবে দুধ পড়ে কিনা সেলাইয়ের জোড় থেকে।

সেলাই একদম ঠিকঠাক। বাঘ মন ভ’রে দুধ খেলো বোতলে মুখ দিয়ে। মুখ থেকে গলা দিয়ে দুধ নামলো বাঘের পেটে, একফোঁটাও পড়লো না সেলাইয়ের ফাঁক দিয়ে। বোতলের দুধ শেষ ক’রে ঘুমিয়ে পড়লো বাঘ।

এই সুযোগে দোলনও দুধ খেলো, তার চোখজুড়ে এলো ঘুম। তার পরেই ঘুমিয়ে পড়লো দোলনের মা আর বাবা। গল্পের হোলো শেষ।

 

শেষবার এই রূপকথার গল্পটির কিছুটা ব’লেছিলে আমার বিয়ের রিশেপসনের সন্ধ্যায়। আবার আমি দোলন হ’য়েছিলাম, না কেঁদে থাকতে পারিনি।“

-       থামলো সৃজা।

**** সমাপ্ত ****

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু