বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মায়াতুলি

আজ কতদিন হল বাবা, মা আর পরিবারের সবাইকে হারিয়েছে রাজকুমারী চন্দ্রমুখী। শুধু তাই নয় দৈত্যের ভয়ে সবাই ছেড়ে গেছে এই রাজ্য।

কী সাংঘাতিক ভয়ের ছিল সেই দিন। আজও কেঁপে কেঁপে উঠতে হচ্ছে তাকে। বিশাল দৈত্যটা দপ দপ করে মাটিতে পা ফেলে এল। সেই দপদপানিতে দূরের পাহাড়টা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। আসার আগে অবশ্য বিরাট একটা ঝড় উঠল। জঙ্গলের গাছ লন্ডভন্ড হয়ে গেল। পশুপাখিরা ছুটোছুটি শুরু করে দিল। 

দৈত্যটার হাতের মাসল নয় যেন এক একটা থাম। তাতে একটা কাছির মত মোটা তাগা বাঁধা ছিল। সেটা খুলে সে মাটিতে ফেলে দিল। তাগা হয়ে গেল বিরাট এক সাপ। তার মুখ দিয়ে হিস হিস শব্দ আর আগুনের ভয়ংকর শিখা উঠল। সবাই ভয়ে পেয়ে জড় হয়ে গেল একদিকে। সেই ভয়ংকর সাপটা তখন সবাইকে লেজ দিয়ে পেঁচিয়ে নিল।

চন্দ্রমুখীর বাবা ভীষণকেতু ভীষণ লড়াই লড়তে এলেন সুদীর্ঘ তলোয়ার উঁচিয়ে। কিন্তু সেই সাপের মুখ দিয়ে বেরোন আগুনের উত্তাপে সে তলোয়ার গলে গেল। রাজাকে নিজের ফণার ওপরে তুলে নিল সাপটা।

তারপর সবাইকে নিয়ে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল সে শিগগির ফিরে আসবে আর রাজকুমারীকে বিয়ে করবে। এই রাজ্যের রাজা সে হয়ে বসবে আর রাজ্যের সবাই পণবন্দী থাকবে যতদিন না রাজকুমারী তার দাবী মেনে নেয়।

সেই থেকে রাজকুমারী একা। রাজ্যে আর কেউ নেই। দাসদাসী এমন কী রান্নাবান্না করার লোক পর্যন্ত কেউ নেই। ভয়ে কেঁপে মরে চন্দ্রমুখী। খিদে পেলে বাইরে বেরিয়ে শুধু গাছের ফলমূল খায়।

তেমনি একদিন সন্ধ্যায় ছাদে বসে আছে। পাশে মাটি থেকে উঠে আসা মিষ্টি এক ফল গাছের ফলভর্তি ডালটা আনন্দে রাজকুমারীর গায়ের ওপর যেন নুয়ে পড়েছে। গাছের ফল ছিঁড়ে খেতে খেতে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবছিল চন্দ্রমুখী। তখন সন্ধ্যেবেলা, আকাশে চাঁদ উঠে গেছে। চাঁদের হাসি দেখে মনের মধ্যে যেন বাবার ছাড়া পাবার একটু আশা জাগছিল।

এমন সময় তার পায়ের কাছে কী একটা এসে পড়ল। কৌতূহল বশে কাছে গিয়ে দেখল সেটা একটা অদ্ভুত ধরণের তুলি। সাধারণ কাঠের নয়। পেছনটা তৈরি হয়েছে ময়ুরের পালকের গুচ্ছ দিয়ে। আবার সামনের দিকে হরিণের লেজের চুল দিয়ে তৈরি।

কিন্তু অপূর্ব সুন্দর এই তুলিটা কে দিল? আশেপাশে তো কেউ নেই? সে অমনি আকাশের দিকে তাকাল। মনে হল বিরাট বড় গোলাকার চাঁদটা যেন তার দিকে চেয়ে হাসছে। সে কুড়িয়ে নিয়ে চলে গেল নিচে তার ঘরে। ঘরে তো আলো ছিল না। কারণ আলো জ্বালাবার তো কেউ নেই। হঠাৎ আলোয় ঝলমল করে উঠল সেই ঘর। বাঁধভাঙ্গা আলোর সঙ্গে আবার বাঁধভাঙ্গা হাসি। কী ব্যাপার এত আলো এল কোথা থেকে? কেউ তো নেই? তবে আলোর সঙ্গে সঙ্গে হাসি আসছে কোথা থেকে?  

রাজকুমারী দেখল হাজার হাজার জোনাকি একসঙ্গে জড় হয়ে ঝকঝকে সাদা আলোর এক মশাল তৈরি করেছে। আর হাসছে তারাই। হেসে বলল, রাজকুমারী তোমার ভয় নেই। আমরা থাকতে তুমি অন্ধকারে থাকবে না। বাইরে চাঁদ যেমন আলো দিচ্ছে তেমনি ভেতরে আমরা।

চন্দ্রমুখী বেশ সাহস পেল। তার আনন্দ হল খুব। বলল, তোমাদের পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু তোমাদের ভয় করে না? রাজ্যটা সেই দৈত্যের দখলে জানো তো?

হাজার হাজার গলা একসঙ্গে বলে উঠল, ভয় কেন করবে রাজকুমারী। ওই অতবড় দত্যি আর অতবড় সাপ কি আমাদের মত ছোট্ট প্রাণীদের ধরতে পারে?

জোনাকিদের রাণী হীরকদ্যুতি বলল, কিন্তু অমাবস্যা খুব কাছেই। আর দেরি নেই। এদিনের মধ্যেই আমাদের রাজা ভীষণকেতুকে উদ্ধার করতেই হবে রাজকুমারী। প্রতি অমাবস্যার অন্ধকারে হাজার হাতির বল পায় এই দত্যিটা।

খুব চিন্তায় পড়ল চন্দ্রমুখী। এই অমাবস্যা এলে তবে আরও হাজার হাতির বল? তার আগেই কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী করতে পারে সে? লড়াই জানে না, তলোয়ার চালাতে পারে না। তাহলে কি ওই বীভৎস দর্শন দৈত্যের শর্তে রাজি হয়ে তাকে বিয়ে করতে হবে? ভাবতেই গা-টা কেমন শিউরে শিউরে উঠছে। ভয়ে আর ঘেন্নায়।

কেঁদে ফেলল সে, কী জানি বাবা এখন কোথায় আর কেমন আছে।

জোনাকি রাণী হীরকদ্যুতি বলল, এত ভেঙ্গে পড় না রাজকুমারী। তুমি তো ছবি আঁকতে জানো?

ছবি? আরে ছবির কথাটা তো তার মনে ছিল না একেবারে। আজ আকাশের চাঁদ হাসিমুখ করে তাকে কেমন সুন্দর আঁকার তুলি উপহার দিয়েছে মনে পড়ে গেল। কিন্তু কাগজ কোথায়? আর কালি?

হীরকদ্যুতি বলল, রাজকুমারী, এমন ভাবছ কেন? তুমি আঁকবে আমাদের দেওয়া সাদা আলোর পিঠে তোমার মনের দুঃখের কালি দিয়ে। দেখবে কী সুন্দর আঁকা বেরোবে।

রাজকুমারী তাই করল। সে তখনি সুন্দর তুলিখানা নিজের বুকে ছুঁইয়ে আলোর পিঠে বোলাতে  লাগল। আর অবাক কান্ড। সে তুলি যেন নিজেই চলতে লাগল। আর আঁকা হয়ে গেল এক বিরাট প্রাসাদের ছবি। সেই প্রাসাদ গভীর অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত। নানা হিংস্র জন্তু বিকট গর্জন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রাসাদের প্রধান গেটের পাশে সেই বিশাল সাপটা লেজ আছড়াচ্ছে।  

কিন্তু সে এমন একটা ছবি আঁকল কী করে ভেবেই পাচ্ছে না।

--তুমি ভাবছ এমন ভয়ংকর প্রাসাদের ছবি তুমি আঁকলে কি করে?

হীরকদ্যুতির কথায় তো সে অবাক। সে জানল কী করে রাজকুমারীর মনের কথা?

--কী করে সম্ভব হল জোনাকি রাণী?

-- ছবিটা যে তুমি তোমার মনের ভয় আর আশঙ্কার কালি দিয়ে এঁকেছ। আর তাই জন্ম হয়েছে এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্যের। তবে যা এঁকেছ তা কিন্তু সত্যি। অমন ভয়ঙ্কর এক জঙ্গলের মধ্যে আছে দৈত্যের সেই প্রাসাদ। আর তার মধ্যেই আছে তোমার বাবা আর সব লোকজন। তোমাকে যেতে হবে আর উদ্ধার করতে হবে এদের।  

অমনি সব জোনাকিরা চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ উদ্ধার করতেই হবে।  

-কিন্তু- কী করে?

--তোমার বাবার কথা ভাব।

--আমার বাবার সাহস আছে। আবার তেমন দীর্ঘ বিশাল তলোয়ার আছে।

-আর তোমার হাত আছে। সব জোনাকিরা একসঙ্গে বলে উঠল।

হীরকদ্যুতি আবার বলল, মনে রেখ এই অমাবস্যা পর্যন্তই সময়। এরপর আর কিছু করতে পারবে না।

হাতের কথা বলতেই ছবির সেই বড় গেটের ওপর নিজের আঙ্গুল ছোঁয়াল চন্দ্রমুখী। অবাক কান্ড। ছবির সেই গেট খুলে গেল। উঠে পড়ল রাজকুমারী। গেটের খোলা দরজা দিয়ে এগিয়ে চলল ভেতরে।

একটা শব্দ। পেছনে তাকিয়ে দেখল গেট নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অবাক হয়ে দেখল পেছন পেছন জোনাকির দল আসছে। প্রাসাদের ভেতরটা অন্ধকার ছিল, কিন্তু জোনাকিরা আসতেই মুহূর্তে সব অন্ধকার দূর হয়ে গেল। আর দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। সেখানে কোনও মানুষ নেই। সারি সারি পুতুল দাঁড়িয়ে আছে। চলে না, নড়ে না, কথা বলে না। নিশ্চল  সব কালো পাথর দিয়ে তৈরি। বাবার মূর্তির দিকে তাকাল চন্দ্রমুখী। বাবার স্থির দৃষ্টি তাকে যেন বলতে চাইছে এখান থেকে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে। নিরূপায় চন্দ্রমুখী কী করবে বুঝতে না পেরে বাইরে বেরিয়ে এল। গভীর জঙ্গলে হিংস্র পশুরা তাকে দেখছে। হিংস্র চোখে তাকিয়ে হুংকার দিচ্ছে।

গেটের বাইরে বেরোল না চন্দ্রমুখী। গেটের বাইরে সেই বিশাল সাপ এসে হাজির। প্রায় পাঁচ ছ’ফুট লকলকে জিভটা সে গেটের ওপর বুলিয়ে যাচ্ছিল। ভয়ে শিউরে উঠতে হচ্ছে। এই গেটের ভেতরে যতক্ষণ সে আছে ততক্ষণ নিরাপদ।

প্রাসাদের ভেতরে গেট থেকে একটু দূরে তার নজর গিয়ে পড়ল। একটা বড় বটগাছের নিচে কেউ যেন বসে বসে চোখ বুজে ধ্যান করছে। অবাক হয়ে ভাবল এটা কি সে এঁকেছিল? হবে হয়ত। কিন্তু মুনি ঋষী এরা তো সব ত্রিকালজ্ঞ হন। এই ব্যাপারে যদি কিছু উত্তর দিতে পারেন।

কাছে এসে দাঁড়াতে সেই মুনি চোখ না খুলেই বললেন, প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলে তোর সাফল্য আর নাহলে চোখ চাইলেই আমার চোখ দিয়ে আগুন ছুটবে আর সে আগুনে তুই ভস্ম হয়ে যাবি। একটাই প্রশ্ন আর একবারই বলা হবে।

ভয়ে ভয়ে চন্দ্রমুখী বলল, প্রশ্নটা বলুন প্রভু।

-সিংহকে জব্দ করার সবচেয়ে ভাল উপায় কী?

প্রথমে সংকটে পড়লেও বেশ কিছুটা ভেবে চন্দ্রমুখী বলল, যেকোনো উপায়ে তার পিঠে চড়ে বসা। সে তো তার পিঠে বসা শত্রুর মোকাবিলা করতে পারবে না।

অমনি সেই সাধু আর সেই বটগাছ একেবারে হাওয়া। এবার তবে কী? অনেক ভেবে আবার চাঁদের দেওয়া সেই তুলিটা বার করে অন্ধকারের ওপরে সাহস আর বুদ্ধির সাদা রঙ দিয়ে সে আঁকল সেই ভয়ানক সাপটাকে। আর সাপের পিঠে মাথার কাছে আঁকল নিজের ছবি। সাপের মাথার লাল মণিটা আঁকড়ে ধরে সে বসে আছে।

যেই না আঁকা অমনি সে ছবি উধাও। দেখা গেল অজগরের মাথার ওপর ঠিক তেমন ভাবে মণি আঁকড়ে রাজকুমারীকে বসে থাকতে। আর তার এই দুঃসাহস দেখে সাপটা প্রচন্ড ভয় পেয়ে প্রচন্ড বেগে ছুটতে শুরু করল। লক লক করছে তার সেই লম্বা জিভ। কিন্তু স্পর্শ করতে পারছে না চন্দ্রমুখীকে। স্পর্শ করতে গেলে মণি স্পর্শ করতে হয় আর তাহলে মণির থেকে আলো বেরোন বন্ধ হয়ে যাবে আর অন্ধকার হয়ে যাবে চারিদিক। তখন সে ছুটবে কী করে?

কিন্তু সাপটা ছুটে যাচ্ছে কোথায়? সেটা তো বোঝা যাচ্ছে না।

ক্রমে চারিদিকের অন্ধকার হালকা হয়ে এল। আকাশের পূর্ব দিকে তখন পাহাড়ের কোলে লাল রঙে রাঙা হয়ে সূর্য উঠছে। সেটা দেখে বেশ ভাল লাগল চন্দ্রমুখীর। তার মানে ভোর হয়ে আসছে। অন্ধকারের থেকেও আলোতে শত্রুর সঙ্গে লড়া সহজ। কিন্তু শত্রুটাকে মানে এই বিশাল সাপটাকে সে জব্দ করবে কী করে? ভাল হত যদি তার হাতে একটা ধারাল তলোয়ার থাকত। সে তলোয়ার চালাতে জানে না বটে তবে সাপের কাছে কোনও তলোয়ার নেই এটাই ভরসার।

পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফ জমেছে। তার ওপর তার সেই জাদুতুলি দিয়ে হিংস্রতার কালো রঙে আঁকল তার মাপের একটা ছোট তলোয়ার। আর সেই তলোয়ার দিয়ে সে কোপাতে উদ্যত হল সাপটার পিঠে আর মাথায়।

-প্রিয় রাজকুমারী দোহাই তোমায়। সাপটা স্পষ্ট মানুষের ভাষায় বলে উঠল, আমাকে বাঁচতে দাও। কথা দিচ্ছি আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না।

একটুখানি ভাবল রাজকুমারী। এই ভয়ংকর সাপটা তার লেজে জড়িয়ে তার বাবা আর সবাইকে নিয়ে এসেছে। এখন তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা করছে। কিন্তু বিষয়টা ভাল করে জানতে হবে। না জেনে ওকে আঘাত করাটা ঠিক নয়।

-আমি কে তা ঠিক সময়ে বলব রাজকুমারী। তবে এটা জেনে রেখ আমি তোমারই মত এক মানুষ আর বাধ্য হয়ে মানে দৈত্যের কবলে পড়ে এমন খারাপ সব কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি।

সাপটা কি সত্যি বলছে? বুঝতে পারল না চন্দ্রমুখী। তবে সে ভাবল কাউকে হত্যা করতে গেলে আগে তার নিজের মুখ থেকে কিছু শুনতে হয়। বলল, বেশ তা যখন বলছ তখন আপাতত তোমাকে আমি মারব না। কিন্তু তুমি আমাকে এখানে আনলে কেন? এখানে কী আছে?

-পাহাড়ের ওপারে এই দৈত্যের আসল বাস। কিন্তু সে আশেপাশের সমস্ত রাজ্যগুলো দখল করে মানুষের বদলে দৈত্য আর অসুরের রাজত্ব চালাতে চায়।

-আমি কি সেই দৈত্যটাকে মারতে পারি না?

-তা পার। তোমার বাবার কথা জানি। তিনি অসম্ভব বীর রাজা। কিন্তু এই দৈত্য অতি ভয়ংকর আর অসীম বলশালী। শুধু তাই নয় সে মায়াবীও বটে।

রাজকুমারী বলল, তা হোক আমিও তো বীর রাজা ভীষণকেতুর মেয়ে।

সাপ ভেবে বলল, সে তুমি মেরে ফেলতেই পার। কিন্তু কতবার মারবে শুনি?

চন্দ্রমুখী অবাক হয়ে বলল, মানে?

আসলে এই গভীর জঙ্গলে এক অশুভ দেবী থাকেন যিনি দৈত্য আর দানবদের আরাধ্যা দেবী। কোনও দৈত্য যদি কোনও কারণে মারা যায় তবে এই দেবী তাকে আবার বাঁচিয়ে তোলে মায়াবলে। আর যতবার সে বেঁচে ওঠে ততবার শক্তি তার বেড়েই যায়। সে পায় শত হস্তির বল।  

রাজকুমারী বললেন, সে পরে দেখা যাবে। আপাতত এই দৈত্যটাকে মারার উপায় বল।

-এই পাহাড়ের কোলে এই যে চমৎকার এক হ্রদ দেখছ যার সুন্দর স্বচ্ছ নীল জল? তাতে রোজ সকালে ডুব গেলে চান করে আর অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার কাটে এই দৈত্য। এইটাই হল তাকে মারার উপযুক্ত সময়।

-বেশ তাই হবে।

-আমি এখন এই হ্রদের জল পান করব। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার দেহের তীব্র বিষ ছেড়ে দেব সেই জলে। তারপর কী হয় দেখ।

সাপ চলে গেল জল খেতে আর রাজকুমারী চুপ করে একটা ঝাঁকড়া গাছের ডালে পাতার আড়ালে লুকিয়ে রইল। সাপটা জল খেয়ে উঠে গেল। হ্রদের সমস্ত জল হয়ে গেল কালো। রাজকুমারী বুঝল সাপের শরীরের সব বিষ মিশে গেছে সেই জলে।

এমন সময় বিরাট আওয়াজ করে দৈত্যটা পাহাড় থেকে লাফিয়ে চলে এল হ্রদের কাছে। তার বিকট চেহারা দেখে রাজকুমারীর তো ভয়ে বুক দূর দূর করতে লাগল। এত বড় দৈত্য সে কখনও দেখে নি। তার সারা শরীর বড় বড় লোমে ঢাকা। সে  যখন গর্জন করছে তখন তার নাক আর চোখ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে লকলকে আগুনের শিখা। সে আগুনে কে পুড়ছে আর কী পুড়ছে সে নিয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই তার।

রাজকুমারী ভাবতে লাগল এমন একটা ভয়ংকর দৈত্যকে তো কোনও তলোয়ার দিয়েই মারা সম্ভব নয়। তাছাড়া তলোয়ার চালাতেও সে শেখেনি। একটা তলোয়ারকে সে বড় জোর একটা ছুরির মত ব্যবহার করতে পারে আর সামান্য আঘাত করতে পারে এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

সারা আকাশ কালো করে মেঘ জমল। বিদ্যুৎ চমকাল। সেই কা্লো মেঘে হ্রদের জল এমনিতেই কালো দেখাল। দৈত্যের সন্দেহ হল না এতটুকু। সে মনের আনন্দে ঝপাং করে লাফিয়ে পড়ল জলে।   

দিব্বি সাঁতার কাটছে। কিছুক্ষণ পরেই হ্রদের জলে প্রচন্ড আলোড়ন। সে কী বীভৎস ডাক দৈত্যটার। রাজকুমারীর মনে হল বিষের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সে তো আদৌ মরে নি। সে উঠে পড়েছে পাড়ে আর খুঁজে বেড়াচ্ছে কে তাকে এমন করল। আকাশের মেঘ সরে গেছে। আবার আলো ঝলমল করে উঠেছে চারিদিক। হাওয়ায় গাছের পাতা এলোমেলো হচ্ছিল। সেই  আলোয় হঠাৎ তার চোখ পড়ে গেল ঝাঁকড়া গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাজকুমারী চন্দ্রমুখীর ওপর। প্রচন্ড রেগে হুংকার দিয়ে বলল, আমাকে মারার চেষ্টা? তোর এত সাহস? নিজের রাজ্য ছেড়ে তুই চলে এসেছিস আমার রাজ্যে?

বলে হা হা করে সে কী অট্টহাসি। চারিদিকে যেন হাজার হাজার ঢাক বাজতে লাগল। সাহস হারাল না চন্দ্রমুখী। বলল, আমার বাবাকে আর প্রাসাদের সব লোকেদের ছেড়ে দাও বলছি।

-হ্যাঁ ছেড়ে তো দোবই আগে তুই আমার শর্ত পূরণ কর।

এমন সময় হিস হিস করে শব্দ। চন্দ্রমুখী দেখল সেই বিশাল সাপটা ফিরে এসেছে আর তাকে বলছে, না না একদম রাজি হয়ো না রাজকুমারী। তুমি ওকে কিছুতেই বিয়ে কর না। বিয়ে করলেও ও তোমার বাবাকে ছাড়বে না।  

আবার হা হা করে অট্টহাসি। দৈত্য আগুন চোখে সাপটার দিকে চেয়ে বলল, তবে তুই আমাকে ছেড়ে এর সঙ্গে যোগ দিয়েছিস? তোকে আমি মহাময়ূর দিয়ে খাওয়াব দেখ। অমনি আকাশে কী একটা ছুঁড়ল আর আকাশ কালো হয়ে এল। বিকট এক ময়ূর ডাকতে ডাকতে চলে এল আর অজগরের মাথার ওপর আকাশে চক্কোর কাটতে লাগল।

এক মুহূর্তের অন্যমনস্কতার জন্যে সাংঘাতিক বিপদে পড়ে গেল রাজকুমারী চন্দ্রমুখী। এই সুযোগে খপ করে তাকে একটা হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিল দৈত্যটা। রাজকুমারী ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকাল। এ তো মহা বিপদ। সে দৈত্যের হাতে বন্দি আবার তার বন্ধু সেই সাপটাও তখন মাথার ওপরে বিশাল মহাময়ূরের সঙ্গে লড়াই করছে। এমনিতেই সাপেরা ময়ূরের কাছে জব্দ। আবার এই ময়ূর তো যে সে ময়ূর নয়-- মহাময়ূর।

কী হবে এখন। রাজকুমারী ভাবল এবার সে বুঝি ভয়েই মরে যাবে। কিন্তু হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল। চেঁচিয়ে সাপটাকে বলল, শিগগির তুমি এই দৈত্যটাকে জড়িয়ে ধর।

সাপ তাই করল। সে দৈত্যকে পায়ের দিক থেকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল। আর ময়ূরের কি অত জ্ঞান আছে? সাপ তার শত্রু তাই সাপকে ঠোকরাচ্ছে ভেবে দৈত্যকেই ঠোকরাতে শুরু করল। ধারাল ঠোঁট আবার দুই পায়ের ধারাল দশ দশটা নখের আঁচড়ে কামড়ে দৈত্যের অবস্থা খুবই খারাপ। একেই তো হ্রদের জলে অজগরের মহাহলাহল তার সারা শরীরে মেখে সে ভীষণ কাবু। তাতে আবার এই উৎপাত।

হঠাৎ একটা কথা মাথায় এল চন্দ্রমুখীর। তার মনে হল তার হাতেই আছে এর সমাধান। চোখ পড়ল সেই হ্রদের জলে। সাপের বিষে সেই স্বচ্ছ নীল জল এখন একেবারে কালো। সেই কালো জলের ক্যানভাসে তার হাতের মায়াতুলি আর সাহসের সাদা রঙ দিয়ে আঁকল এক বিশাল তলোয়ার। চকিতে সে তলোয়ার চলে এল তার মুঠোয়। কোথা থেকে যেন এক পাকা যোদ্ধার মত জোর পেল মুঠিতে। সাহস, বুদ্ধি আর কৌশল। দৈত্য তো এমনিতেই অনেক কাবু হয়ে ছিল। তলোয়ারের কোপের পর কোপ পড়তেই সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আর একেবারে স্থির। একটা বিরাট ভূমিকম্প হল যেন।

তার হাতের আলগা মুঠি খুলে বেরিয়ে এল চন্দ্রমুখী। তার মুখে ফিরে এল স্বস্তির চিহ্ন। কিন্তু সে কতক্ষণ? অমনি আকাশে মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের চমক। মৃত দৈত্যের দেহের ওপর বিদ্যুতের ঝলক পড়তেই সে নড়ে উঠল।

সাপটা চেঁচিয়ে উঠল, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ রাজকুমারী। ঐ হল এই দৈত্যের আরাধ্যা দেবী। তুমি যতবার মারবে ততবার এই ভয়ংকর দেবী তাকে বাঁচিয়ে তুলবে আর সে পাবে বাড়তি একশ হাতির বল।

তবে কী হবে? রাজকুমারী ভাবতে বসল।

-দৈত্যকে পুরো শেষ করতে এই দেবীকে আগে শেষ করতে হবে। সাপ বলল, শিগগির তুমি আমার মাথায় উঠে বস ঠিক যেমন আগে বসেছিলে।

-কিন্তু তোমার জিভ দিয়ে যে বিষ ঝরছে এর ছোঁয়ায় আমি যদি মারা যাই?

এদিকে দৈত্য একশ হাতির বল বাড়তি পেয়ে বেঁচে উঠেছে। সে উঠে বসে রাজকুমারীর দিকে এগোচ্ছে। উদ্বেগের সঙ্গে সাপ বলল, তাড়াতাড়ি কর রাজকুমারী।   

ঝট করে মাথায় খেলে গেল বুদ্ধি। মনে পড়ল সেই চাঁদের হাসিমাখা মুখটার কথা। কালো আকাশের পটে সাদা জ্যোৎস্নার রঙ দিয়ে আঁকল সেই সাপটার ছবি। তার পিঠে মাথার মণিকে ধরে রাজকুমারী বসে আছে।

অমনি তাই হল। রাজকুমারী চন্দ্রমুখী চলে গেল সাপের মাথায়। সাপ বলল, তাড়াতাড়ি আমার মাথার মণি আকাশে ছুঁড়ে দাও রাজকুমারী। রাজকুমারী তাই করল। যত পারল গায়ের জোরে সাপের মাথার মণি খুলে আকাশে ছুঁড়ে দিল। অমনি আকাশ থেকে সেই ভয়ংকর দেবী অদৃশ্য হয়ে গেল। তার কান্না বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল।   

সাপ বলল, যাক অপদেবী মারা গেছে। এখন এই মণি আকাশ থেকে পড়বে তোমার হাতে। সাবধান এটা যেন মাটিতে না পড়ে। তবে দেবী কিন্তু আবার বেঁচে যাবে।

সেটা হতে দিল না রাজকুমারী চন্দ্রমুখী। লুফে নিল সেটা।

আশেপাশে এক অদ্ভুত দৃশ্য। দৈত্যের বিশাল দেহটা ভূপতিত। হ্রদের জল এখনও কাঁপছে। গাছের ডাল আর পাতা ভেঙ্গে পড়েছে চারিদিকে। একেবারে যেন লন্ডভন্ড দশা।  

সাপ বলল, এখন চল আমাদের যেতে হবে।

--কোথায়?

-আমাদের প্রাসাদে। যেখানে তোমার বাবা পাথরের পুতুল হয়ে আছে।

রাজকুমারী ভ্রূ কোঁচকাল, আমাদের প্রাসাদ মানে?  

-মানে পরে বুঝবে এখন সময় নেই।

সাপটা ছুটে চলল। তার পিঠে চন্দ্রমুখী। হাতে যার সাপের মাথার মণি। প্রাসাদে এসে পড়তেই সাপ বলল, প্রাসাদের দেওয়ালে এই মণি জোরে ছুঁড়ে দাও রাজকুমারী রাজকুমারী।

তাই হল। প্রচন্ড শব্দ করে প্রাসাদের দেওয়ালে আঘাত করে ভেঙ্গে চুর চুর হয়ে গেল মণিটা। আর তার আলো ঢুকে গেল প্রাসাদের ভেতরে আর বিচ্ছুরিত হতে লাগল কোণায় কোণায়। ঘুরে ঘুরে ফিরতে লাগল সেই পাথরের পুতুলগুলোর চারপাশে। আর অমনি জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল সেগুলো।

আনন্দে পাগল হয়ে গেল রাজকুমারী চন্দ্রমুখী। ইচ্ছে হল এখুনি ছুটে যায় বাবার কাছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু যাবে কী করে সে তো এখনও সাপটার মাথায় বসে আছে।

-নামো, নামো রাজকুমারী। আর কতক্ষণ আমার কাঁধের ওপর বসে থাকবে? আমার বুঝি লাগে না? এবার নেমে বাবার কাছে যাও।

রাজকুমারী অবাক হয়ে সাপের দিকে চোখ নামাল। অবাক কান্ড। সাপ কোথায়? সে তো চেপে বসে আছে এক পরম সুন্দর রাজপুত্রের কাঁধের ওপর। খুব লজ্জিত হয়ে বলল, আমাকে মাপ করে দিন রাজকুমার।

রাজকুমার হেসে তাকে নামিয়ে দিল। চন্দ্রমুখী ছুটে গেল তার বাবার কাছে। এদিকে মণির বিচ্ছুরিত আলো ছুটে যাচ্ছে চারিদিকে। সব পুতুল তো মানুষ হল। আর সব মায়াবী হিংস্র জন্তুরা অদৃশ্য হয়ে গেল।

এই ভয়ংকর দৈত্যের গল্প বলছিল রাজকুমার দিব্যকান্তি। মানে সেই বিশাল সাপটা। এই মারাত্মক দৈত্য তাদের আক্রমণ করে সবাইকে পাথর বানিয়ে রেখেছিল। সে চেয়েছিল এই রাজ্যের রাজা হতে। রাজকুমার তা হতে দেয় নি। সে আক্রমণ করেছিল। তাই দৈত্য তাকে হিংস্র সাপ বানিয়ে দিয়ে তাকে দিয়ে খারাপ খারাপ কাজ করাতো। চন্দ্রমুখীকে দেখে তাকে বিয়ে করার ইচ্ছে হয় দৈত্যটার আর সে সেই রাজ্য আক্রমণ করে। সাপকে দিয়ে সবাইকে পেঁচিয়ে তুলে এনেছিল এখানে। তারপর পাথর করে দিয়েছিল। রাজকুমারী বিয়ে করতে রাজী হলেও দৈত্য তার রাজ্যের সবাইকে কিছুতেই আর মানুষ করত না।

রাজা ভীষণকেতু এগিয়ে এলেন রাজকুমার দিব্যকান্তির দিকে। বললেন, তোমার বীরত্ব দেখে আমি মুগ্ধ। আর অবশ্যই মুগ্ধ আমার মেয়ে চন্দ্রমুখীর সাহস দেখে। তোমরা দুজনে যদি একসঙ্গে থাকো তবে কোনও দৈত্য, কোনও অপদেবতা আমাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। আমরা আমাদের রাজ্যে ফিরে যাব। এই রাজ্য তোমাদের থাকবে দিব্যকান্তি। তবে আমাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি হবে।

কী করে? সবাই তো অবাক। নিশ্চয় খুব আনন্দের খবর হবে এটা।

এমন সময় সন্ধ্যা নামল। সূর্য ডোবার পর অন্ধকার। অমনি সেই হাজার জোনাকি এসে গেল। সারা বাড়ি সারা বাগান ঝলমল করতে লাগল সাদা আলোয়। জোনাকীরা গান গাইতে গাইতে বলতে লাগলঃ চন্দ্রমুখী দিব্যকান্তির বিয়ে হবে শিগগির। সারারাত ধরে আমরা নাচব, গাইব আর আনন্দ কর। কী মজা কী মজা।

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু