বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বুড়ি দিম্মার গাঁয়ে

 

হীকপুরের রাজকুমার হিরণ কুমারের দুষ্টুমিতে সবাই অতিষ্ট। এদিকে রাজকুমারের লেখাপড়াতেও মন নেই। তাই রাজামশাই ঠিক করলেন হিরণ কুমারকে পাঠিয়ে দেবেন বুড়িদিম্মার আবাসিকে। বুড়িদিম্মার কাছে গেলেই দুষ্টু দুষ্টু সব রাজকুমার এক্কেবারে শান্তশিষ্ট হয়ে যায়। তাই রাজামশাই ঠিক করলেন তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী যদুনাথের সঙ্গে রাজকুমারকে পাঠিয়ে দেবেন। যদু আগেও অনেকবার সেখানে গিয়েছে, বুড়িদিম্মার সঙ্গে তার ভারী ভাব। তাই একদিন সকাল সকাল রাজকুমারকে সঙ্গে নিয়ে যদু চলল বুড়িদিম্মার গাঁয়ে। অনেকটা পথ যাওয়ার পর হিরু অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর কতদূর গো?”

“এই তো এই জঙ্গলটা পেরোলেই বুড়িদিম্মার গাঁ।” উত্তর দিল যদু।

যদুর কথা শুনে হিরু আশেপাশে তাকাল। এটা আবার জঙ্গল, তাহলে এমন  ফাঁকা ফাঁকা কেন! তাদের রাজ্যের  পুব দিকে যে জঙ্গলটা রয়েছে সেটা এর চেয়ে অনেক বেশী ভাল, কত্ত গাছপালা সেখানে। সে কথা যদুকে বলতেই যদু হেসে উঠে বলল, “এই জঙ্গলটা ফাঁকা বটে কিন্তু বুড়ি দিম্মার গাঁয়ের পেছন দিকে আছে নীল পাহাড়, সেই নীল পাহাড়ের গায়ে যে জঙ্গল আছে সেই জঙ্গল দেখলে দিনেরবেলাতেও পিলে চমকে ওঠে।“

এরপর যদু আর কিছু বলার আগেই হিরু দেখল জঙ্গলটা শেষ হয়ে এসেছে, সামনেই একটা গ্রাম। কিন্তু গ্রামটা কেমন যেন একটা লাগছে না! হিরুর মনের কথাটা যদুও বোধহয় টের পেল। সে বলল, “আগেও এসেছি কিন্তু এমন তো লাগেনি কখনও!” 

“কেমন?

“সেটাই তো বুঝতে পারছি না রে হিরু, মনে হচ্ছে কিছু যেন একটা নেই কিন্তু কী নেই সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না। যাইহোক, বুড়ি দিম্মার ওখানে একবার পৌঁছাতে পারলেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।” এই বলে গাড়িটাকে আরও জোরে ছোটাল যদু। গাড়িটা এত জোরে ছুটছিল যে আশেপাশের আর কিছু যেন ঠিক করে ঠাহর করতে পারছিল না হিরু, কিন্তু তার মনের আস্বস্তিটা ক্রমশ বেড়েই চলছিল। 


    দেখতে দেখতে পাঁচিল ঘেরা আশ্রমের সামনে এসে উপস্থিত হল তারা। হিরু বুঝল এটাই তবে বুড়িদিম্মার আবাসিক। যদুর নির্দেশে গাড়ি থেকে নামল হিরু। তারপর যদুর হাত ধরে পাঁচিলের ফটক পেরিয়ে ঢুকল তারা। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই যদুর পা যেন মাটির সঙ্গে আটকে গেল, একটা গাছের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল সে। হিরু অবাক হয়ে যদুর হাতে টান দিল, “ও যদু দাদা, কী হল? থামলে কেন?”

যদু কাঁপা কাঁপা হাতে একটা গাছের দিকে ঈশারা করে কোনোক্রমে বলে উঠল, “ও… ওই স্বর্ণচাঁপা গাছের এমন অবস্থা কী করে হল?” 

হিরু কোনো জবাব দেওয়ার আগেই এক গম্ভীর মহিলা  কণ্ঠ ভেসে এলো, “কে? কে এল এখানে?"

হিরু তাকিয়ে দেখল কিছুটা দূরে ঝুড়ি হাতে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধার মাথার চুলগুলো শনের মত সাদা, ফরসা গালদুটো বেশ গোলগাল কিন্তু চোখের তলায় কালি, দেখে মনে হয় যেন অনেকদিন ঘুম হয়নি। এই কি তাহলে বুড়িদিম্মা! কিন্তু এনাকে দেখে তো একটুও ভয় লাগছে না, উল্টে মনে হচ্ছে যেন উনিই ভয় পেয়ে আছেন। বৃদ্ধাকে দেখেই ছুটে গেল যদু, “দিম্মা এসব কী? স্বর্ণচাঁপার সেই উজ্জ্বল সোনালী রঙ কোথায় গেল?”

“কে?” বৃদ্ধা কুতকুতে চোখে খানিকক্ষণ যদুকে দেখার পর চিনতে পারলেন বোধহয়, কিন্তু পারার সঙ্গে সঙ্গে চাপা গলায় আর্তনাদ করে বলে উঠলেন, “ওরে যদু কেন এসেছিস এই অভিশপ্ত গাঁয়ে? পালা...পালা... এখুনি পালা।“

“কেন দিম্মা! কী হয়েছে?” 

“ওসব বলার সময় নেই রে বাছা, সন্ধ্যে নামলেই তারা চলে আসবে। তুই এক্ষুনি পালা।“

“কারা আসবে দিম্মা? আর তাছাড়া আমরা এতটা পথ এখন যাব কী করে? ঘোড়াগুলো ক্লান্ত, সন্ধেও নেমে যাবে।“

যদুর কথা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেলেন দিম্মা, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কেন যে আসতে গেলি এই ছোটো কুমারকে নিয়ে! আয় আজকের রাতটা বিশ্রাম নে, কাল ভোর হলেই চলে যাবি এখান থেকে।“  

এই বলে বুড়িদিম্মা ঈশারা করলেন তাঁর পেছন পেছন যেতে। যদু আর হিরু বুড়িদিম্মার সঙ্গে ঘরের ভেতর ঢুকল। বুড়িদিম্মা দুটি আসন পেতে ওদের বসতে দিলেন, তারপর দুটো বড় বড় গ্লাসে শরবত আর কাঁসিতে মুড়ি বাতাসা এনে দিলেন। খিদে পেয়েছিল খুব, হিরু তাই মন দিয়ে খাওয়া শুরু করল। এদিকে যদু একগাল মুড়ি মুখে তুলেই প্রশ্ন করল, “এবার সব কিছু খুলে বলত দিম্মা, এসব কী হচ্ছে? প্রথমে গাঁয়ে ঢুকে সন্দেহ হলেও কিছু টের করতে পারিনি কিন্তু এখানে এসে তোমার প্রিয় স্বর্ণচাঁপা গাছটা দেখতেই ব্যাপারটা টের পেলাম। গাঁয়ের সব রঙ কোথায় গেল দিম্মা?” 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুড়ি দিম্মা বললেন, “ঘটনাটা ঠিক তিনদিন আগের। হঠাৎ করে রাতের বেলা ওই নীল পাহাড়ের গায়ে কেমন আলো জ্বলে উঠতে দেখেছিলাম, প্রথমে ভেবেছিলাম জঙ্গলে আগুন লেগেছে হয়ত। কিন্তু তারপরেই বুঝলাম তা নয়। তখন ভাবলাম বৃষ্টি হবে তাই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বোধহয়। আর আমল দিলাম না ব্যাপারটাকে। তারপরের দিন সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ খুব ঝড় উঠল, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে সে কী ঝড়! কিন্তু অবাক কথা গোটা গাঁয়ে কিন্তু ঝড় হল না, গাঁয়ের মাঝামাঝি খানিকটা জায়গাতেই সেই ঝড় বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সে থামল। সন্ধ্যেবেলা বলে কিছু টের পাওয়া যায়নি, কিন্তু পরের দিন সকাল হতেই গাঁয়ের সকলে দেখল যেখানটায় ঝড় হয়েছিল সেই জায়গা থেকে সব রঙ যেন ঝড়ের সঙ্গে উড়ে গেছে। এমন অদ্ভুত ঝড়ের কথা তো আমরা আগে শুনিনি। সবাই এই নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। এমন করে পরের দিন অন্য জায়গায় আবার ঝড় হল, আবার সেখানের সব রঙ উধাও।  গোটা গাঁয়ে শোরগোল পড়ে গেল। এমন অলুক্ষুণে কান্ড দেখে আমি আমার আবাসিকের সব রাজকুমারদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি আজ। কিন্তু এখন তোরা আবার এসে পড়লি...” 

“এ তো অবাক ব্যপার গো দিম্মা, এমন ঝড়ের কথা আমি আগে তো শুনিনি।“

“কেউই শোনেনি। কিন্তু শোন তোরা এখন ঘরে গিয়ে দরজা জানালা লাগিয়ে বসে থাক, ভুলেও খুলবি না, সন্ধ্যে নামলেই ওরা আসবে নিশ্চয়।“

*** 

ঘরে ঢুকেই সারাদিনের পথশ্রমের ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে এল যদুর চোখে, কিন্তু হিরুর চোখে ঘুম নেই। তার মাথায় ঘুরছে একটাই চিন্তা- এতদিন তো কতরকমের ঝড় দেখেছে সে- বড় ঝড়,  ছোটো ঝড়, শুকনো ঝড়, ভেজা ঝড়; কিন্তু রঙ চোষা ঝড়ের কথা তো সে শোনেনি আগে! ঝড়ের কথা ভাবতে ভাবতেই একটু একটু ঘুম পাচ্ছিল হিরুর কিন্তু আচমকা শনশন শব্দ আর মানুষজনের চিৎকার শুনে ঘুম ভাবটা কেটে গেল। সে লাফিয়ে উঠে বসল বিছানায়। তবে কি ওই ঝড় সত্যিই এল! জানালা বন্ধ, তাই শব্দগুলো খুব আস্তে শোনা যাচ্ছে বটে কিন্তু হিরুর কৌতূহল বাড়ছে ক্রমশ। জানতে ইচ্ছে করছে এই ঝড় কেমন দেখতে, অন্য ঝড়ের মতই সাধারণ নাকি কোনো বিশেষ ব্যাপার আছে। একবার পাশে তাকিয়ে দেখল হিরু, যদু গভীর ঘুমে আছন্ন। হিরু উঠে গিয়ে দাঁড়ালো বন্ধ জানালাটার সামনে, বুকটা দুরুদুরু করছে তার। একদিকে মনে পড়ছে বুড়ি দিম্মার সাবধানবাণী, অন্যদিকে জানালার ওপারে তাণ্ডব করতে থাকা বিচিত্র ঝড়টা দেখার তীব্র আকর্ষণ... বকুনি আর পিটুনিকে যে হিরু ভয় করে না তা নয় কিন্তু কোনো কিছু জানতে ইচ্ছে করছে অথচ না জানতে পারলে পেটটা যেভাবে গুড়গুড় করে তার তুলনায় একটু বকুনি কিছুই নয়। অতঃপর জানালাটা টুক করে খুলে ফেলল হিরু। যদু দাদা টেরও পেল না। শরীরটাকে কসরত করে জানালার ওপরে তুলে বাইরে বেরতে যেতেই হঠাৎ হিরুর খেয়াল পড়ল রং-চোষা ঝড় তার গায়ের রঙটা যদি চুরি করে নেয় কী হবে তখন! না না হিরু সাদাকালো রাজকুমার হয়ে থাকতে পারবে না, তার চেয়ে বরং একটা উপায় ভাবা যাক। এই বলে হিরু আবার লাফিয়ে নেমে পড়ল জানালা থেকে, তারপর বুড়ি দিম্মার দেওয়া কালো চাদরটা কোমরে বেঁধে নিয়ে আবার টুক করে উঠে পড়ল জানালায়, তারপর ঝুপ করে বাইরে নেমে ছুট ছুট... ঝড়ের শব্দটা যেদিক থেকে আসছিল সেদিকেই ছুটল হিরু। কাছাকাছি গিয়ে দেখলো একটা বড় কালো হাওয়ার ঘূর্ণি বনবন করে ঘুরছে আর সেই সঙ্গে আশেপাশের গাছপালা, মাটি, জিনিসপত্র সব কিছুর থেকে রঙ যেন চরকির মত পাক খেয়ে গিয়ে মিশে যাচ্ছে ওই ঝড়ে। বুড়ি দিম্মা তবে ঠিকই বলেছিল- এ ভয়ানক ঝড়, এমন ঝড় আগে কেউ কোনোদিন না দেখেছে, না শুনেছে। হিরু তাড়াতাড়ি করে কালো চাদরটাকে গোটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিল, ফাঁকা থাকল শুধু তার চোখদুটো। এরপর হিরু গুটিগুটি পায়ে আরেকটু এগিয়ে গেল। তার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে এতো রঙ যাচ্ছে কোথায়! কিন্তু একী হিরু এগিয়ে যেতেই ঝড়টা পাক খেতে খেতে হিরুকেও টেনে নিল তার মধ্যে, চিৎকার করে উঠল হিরু কিন্তু কেউ শুনতে পেল না তার সেই চিৎকার। ঝড়টা হিরুকে নিয়ে পাক খেতে খেতে এগিয়ে চলল, হিরু বুঝল ঝড়গুলোর বোধহয় আজকের মত রঙ শুষে নেওয়া শেষ। তারা ফিরে যাচ্ছে নীল পাহাড়ের দিকে। ঝড়গুলো বনবন করে পাক খাচ্ছে আর তাদের সঙ্গে পাক খেতে খেতে চলল হিরু...

***

ঘুরতে ঘুরতে হিরুর মাথা ঘোরাতে শুরু হয়েছিল, তাই আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল সে। কিন্তু আচমকা শরীরটা মাটির ওপর দুম করে পড়তেই চমকে উঠে চোখ খুলল হিরু। সে দেখল সে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে কিন্তু ওই ঘূর্ণি ঝড়টা আস্তে আস্তে দু’ফাঁক হয়ে গেল, তারপরেই ঝড়ের চেহারা আস্তে আস্তে পাল্টাতে শুরু করল। হিরু অবাক হয়ে দেখল ঝড়ের পরিবর্তে এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে দুটো ছোট্ট ছোট্ট রাক্ষস। তাদের একজনের গায়ের রঙ লাল আর অন্যজনের নীল। দুজনেরই মাথায় শিং, লম্বা লম্বা দাঁত আর সাদা কালো গোলগোল চোখ। নাকের জায়গায় শুধু দুটো ফুটো। রাক্ষস বলতে এতদিন হিরু বেশ ভয়ানক কিছুকেই জেনে এসেছে কিন্তু আজকে এই ভুঁড়োপেটো দুটোকে দেখে তো মোটেই ভয় লাগছে না, বরং মনে হচ্ছে এরাও হিরুর মত পুঁচকে দুটো বাচ্চা। রাক্ষসদুটো ওদের কোমর থেকে একটা সাদা বলের মত জিনিস বের করল, তারপর লাল রাক্ষস বলল, “চল নীল, ডাইনি চিৎকার করার আগেই ওর হাতে আজকের সব রঙ তুলে দিই।”

“তাই চল।” এই বলে রাক্ষস দু'টো কোনদিকে যেন চলে গেল। 

হিরু উঠে দাঁড়াল। আশেপাশে তাকাতেই বুঝতে পারল নীল পাহাড়ের গায়ের কোনো বড় গুহাতে এসে পড়েছে সে, এই গুহাতেই কি তবে রাক্ষসগুলোর বাস! আর ওই কালো ঘূর্ণি আদপে তো কোনো ঝড়ই নয়, ওই রাক্ষসগুলোই আসলে ঝড় সেজে রঙ চুরি করে। আর ওরা রঙ চুরি কোনো ডাইনিকে দেয়। কিন্তু কেন?  হিরুর মাথায় সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল, সে ঠিক করল এই গুহাতে বসে ওই রাক্ষসগুলোর অপেক্ষা করবে। 

    যেমন ভাবা তেমন কাজ, হিরু কালো চাদরটা মুড়ি দিয়ে গুহার এক কোণে চুপটি করে বসে রইল। একটু পরেই রাক্ষস দু'টো ঢুকল গুহায়, তাদের চোখমুখ দেখে মনে হল তাদের মন খারাপ। নীল রাক্ষসটা এসে ধুপ করে গুহার মেঝেতে বসে পড়ল তারপর বলল, “উফফ! যাই করি, ডাইনি যে কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। রোজ বলে আরও রঙ চাই, আরও রঙ চাই!”

“আমার তো ভয় লাগে কবে না আমাদের রঙগুলোই নিয়ে নেয়।” হতাশ গলায় বলল লাল। সেই শুনে আঁতকে উঠে নীল বলল, “এমন কথা বলিস না ভাই, এই রঙ ছাড়া আর কী আছে আমাদের!” 

“কী রে দুষ্ট ছানা রাক্ষসেরা তোরা আমায় নিয়ে মজা করিস!” আচমকা একটা বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই চমকে উঠল রাক্ষস দু'টো। এতদিন তো তারা ডাইনির গলাই শুনে এসেছে শুধু, এ আবার কে এল! তারা ভয়ে ভয়ে বলল, “ক্ক... কে?”

“আমি ঝড়। তোরা দেখছি দিনের পর দিন আমার ছদ্মবেশ নিয়ে বুড়িদিম্মার গাঁয়ের মানুষগুলোকে নাজেহাল করছিস, তোদের এত বড় সাহস!” 

রাক্ষস দুটো যতই ঝড় সেজে গিয়ে গাঁয়ের মানুষকে ভয় দেখাক, আদপে তো তারা ছোটো ছানা। এমন গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনে তারা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। 

“কী রে উত্তর দিচ্ছিস না যে বড়? তোদের আজকে এমন শাস্তি দেব যে...” 

একথা শুনে নীল রাক্ষসটা তো ভয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল। লাল রাক্ষসটা তুলনামূলক একটু সাহসী, সে কোনো মতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “বিশ্বাস করুন ঝড় মশাই, আমরা এসব ইচ্ছে করে করি না। সব কিছু ওই ডাইনির ভয়ে করি। আমরা যে ওর কাছে বন্দি, ও যা বলে আমাদের তাই করতে হয়।“

“তোরাও বন্দি?”

“হ্যাঁ গো। বিশ্বাস করুন  আমাদের এসব করতে একটুও ভালো লাগে না।“

“আচ্ছা বুঝলাম, কিন্তু ওই ডাইনি এইসব রঙ চুরি করে কী করে?”

“ও ভারী হিংসুটে, ওর গায়ের রঙ সাদাকালো। তাই তো ও কোনো রঙ সহ্য করতে পারে না, সবার থেকে রঙ চুরি করে নিয়ে সবাইকে সাদা কালো করে দিতে চায়। এক জায়গার রঙ চুরি শেষ হলে আবার অন্য জায়গায় যায় আমাদের নিয়ে।“

“এ তো ভয়ানক দুষ্টু কথা!” বলল ঝড়, “কিন্তু তোরা তো রাক্ষস, তোরা কিছু করতে পারিস না?”

“না। ওটাই তো সমস্যা। আমরা নিজের ইচ্ছেতে কিছুই করতে পারি না।“

“তাহলে কি ওকে থামানোর কোনো উপায় নেই?”

“সে আছে কিন্তু না থাকার মতই।“

“কেন কেন?”

“ওই ডাইনির প্রাণ ধরা আছে একটা চিলের মধ্যে। সেই চিলটা  একটা রুপোর খাঁচায় রাখা থাকে ডাইনির শয়ন কক্ষে। ওই চিলটাকে মেরে ফেলতে পারলেই ডাইনিও মরে যাবে।“

“এ তো ভারী সহজ কাজ, কেউ করে না কেন?”

“সহজ নয়কো মোটেই। ওই খাঁচার আশেপাশে ডাইনি মন্ত্র বলে এমন এক অদৃশ্য দেওয়াল তুলে রাখে যে কেউ ওই দেওয়াল ভেদ করতে পারে না, দেওয়াল ভেদ করতে গেলেই তার গায়ে আগুন ধরে যাবে।”

“কিন্তু ডাইনির কক্ষটা কোথায়?”

“এই তো এই পাহাড়েরই একটা গুহাতে, ডাইনি যেখানেই যায় সেখানেই নিজের জন্য একটা সুন্দর করে কক্ষ বানিয়ে নেয় আর আমাদের বেলায় কিচ্ছু নেই।“ দুঃখী দুঃখী মুখ করে এবার কথাগুলো বলল নীল রাক্ষস। 

ঝড় বলল, “সবই বুঝলাম, মনে হচ্ছে তোরা মিথ্যে বলছিস না। শোন এবার যদি চুপচাপ চোখটি বন্ধ করে শুয়ে থাকিস তাহলে তোদের আর কোনো শাস্তি দেব না।”  

ঝড়ের মুখে এমন কথা শুনে ভয়ে ভয়ে লাল আর নীল রাক্ষস সঙ্গে সঙ্গে চোখটি বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। 


      রাক্ষস দুটো শুয়ে পড়তেই চাদরের ভেতর থেকে মুখ টিপে হাসল হিরু। আসলে তো সেই এতক্ষণ ঝড়ের গলায় কথা বলছিল ওদের সঙ্গে। তাদের রাজ্যের হরবোলা দাদার কাছ থেকে হরেকরকম গলার স্বর বের করার কৌশলটা কাজে লাগল অবশেষে। 

 

    হিরু এবার পা টিপে টিপে ওই গুহা থেকে বেরিয়ে এল। পাশেই আরও একটা বড় গুহা। এটাই নিশ্চয় ডাইনির আস্তানা হবে। হিরু ভেতরে ঢুকেই চমকে গেল। ভেতরটা কোনো গুহা নয়, রাজপ্রাসাদের কক্ষ বলে মনে হচ্ছে, কী সুন্দর করে সাজানো, কিন্তু সবই সাদাকালো। রঙিন কিছুই নেই। ইতিউতি তাকাতেই হিরু দেখতে পেল তাকে--- কালোসাদা আধাআধি চুল, তোবড়ানো গান, শীর্ণ শরীর, খোঁচাখোঁচা দাঁত আর দুটো বড় বড় কালো কালো চোখ নিয়ে যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখে ভয় পাওয়ার বদলে মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল হিরুর। ডাইনিটা কাঁদছে, আর আয়নায় নিজেকে দেখে বলছে--- “কেউ আমাকে ভালবাসে না, আমার কেউ নেই।  সবাই কত আনন্দে থাকে কিন্তু আমি! আমার সবকিছু সাদা কালো। ওই জন্য তো আমি রঙ চুরি করে নিই সবার থেকে, সবাই থাকুক সাদাকালোতে।” 

ডাইনির কথা শুনে অবাক হয়ে গেল হিরু। ডাইনির মনে এত দুঃখ! তবুও নিজের দুঃখ বলে অন্যদের ক্ষতি করাটাও তো ভালো কথা নয়। রাক্ষসদুটো বলছিল একটা চিলের মধ্যে ডাইনির প্রাণ ধরা আছে, কিন্তু আশেপাশে কোথাও তো চিলের সেই রুপোলী খাঁচাটা দেখা যাচ্ছে না! কিভাবে সেই চিলের সন্ধান পাওয়া যাবে...! ভাবতে ভাবতেই হিরুর মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি খেলে গেল। সে নিজেকে একটা থামের আড়ালে নিয়ে গিয়ে চিলের ডাক নকল করে চিলচিৎকার শুরু করল। আর সেই ডাক শুনে চমকে উঠল ডাইনি। সে তড়িঘড়ি আয়নার কাছ থেকে সরে এসে ইতিউতি তাকাল, কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে না পেয়ে সে মনে মনে কী যেন বিড়বিড় করতে শুরু করল। দেখতে দেখতে ডাইনির কক্ষের একদিকে একটা সবুজ কাঁচের দেওয়াল দেখা গেল। হিরু বুঝল এটাই সেই জাদু দেওয়াল যার কথা রাক্ষসদুটো বলছিল। ডাইনি এবার সেই দেওয়ালটার কাছে যেতেই সেটা দু’ ফাঁক হয়ে গেল। হিরু এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। ডাইনি সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকে যেতেই হিরুও হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। ডাইনি তখন চিলের চিৎকার শুনে এতটাই উত্তেজিত ছিল যে হিরুকে খেয়ালই করল না। ভেতরে ঢুকেই একটা চৌকির ওপর রাখা রুপোলী খাঁচাটা তুলে নিয়ে উঁকি দিল তার ভেতরে। দেখল চিলটা নিশ্চিন্তে বসে আছে। ডাইনি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল এবং খাঁচাটা আবার তার জায়গায় রেখে বেরিয়ে যাবে বলে পেছন ঘুরল। আর সেই সুযোগে হিরু গুটিগুটি পায়ে গিয়ে খাঁচাটা তুলে নিল টুক করে। অচেনা মানুষ দেখে ডাইনির চিল এবার সত্যিকারের চিৎকার করে উঠল। ডাইনি আবার চমকে উঠে পেছন ফিরে হিরুকে দেখে হতবাক হয়ে গেল। সেই সঙ্গে রাগে তার দুই চোখ থেকে আগুন ঝরে পড়ল কিন্তু তাও সে হিরুকে কিছু করতে পারল না কারণ হিরু ততক্ষণে চিলটার টুঁটি চেপে ধরেছে। ডাইনি চিৎকার করে উঠল, “ছেড়ে দে বলছি, নয়তো আমি তোর কী করব দেখ...”

“তুমি আমার কিছুই করতে পারবে না কারণ আমার হাতে এখন তোমার প্রাণপাখি।” দৃঢ় গলায় বলল হিরু। ওর সাহস দেখে ডাইনিটা এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল। তার শুকনো চোখমুখ আরও শুকিয়ে গেল। সে কাতর গলায় বলল, “ওকে ছেড়ে দে লক্ষ্মী ছেলে, ও না থাকলে আমি যে মরে যাবো!”

“আচ্ছা? আর তুমি যে বুড়িদিম্মার গাঁয়ের সব রঙ চুরি করে নিয়েছো, সবাইকে নাজেহাল করছ তার বেলা!” এই বলে হিরু চিলটার টুঁটি আরও জোরে টিপে ধরল। ডাইনিটাও সঙ্গে সঙ্গে নিজের গলা চেপে ধরে মাটিতে পড়ে কঁকিয়ে উঠল, তার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। হিরু বুঝল চিলটার টুঁটিতে আরেকটু চাপ দিলেই ডাইনির খেলা শেষ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে চাপ দিতে গিয়েও হিরুর হাতটা কেঁপে উঠল। তার মনে পড়ে গেল একটু আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ডাইনিটার কথাগুলো। নিজের অজান্তেই হিরুর হাতটা একটু আলগা হয়ে গেল, ডাইনিটাও সেটা নিজের গলায় টের পেয়ে অবাক হয়ে তাকাল হিরুর দিকে। হিরু নরম স্বরে বলল, “ডাইনি মাসি তুমি এমন করে রঙ চুরি কেন করো?”

“আমার জীবনে কোনো রঙ নেই তাই, আমার যা আছে শুধু দুঃখ। তাই আমি চাই না আর কারুর জীবনে রঙ থাক।” কোনোমতে কঁকিয়ে কঁকিয়ে বলল ডাইনিটা।  

হিরু বলল, “এ তো ভারী অন্যায় কথা। জান ডাইনি মাসি আমার এক হরবোলা দাদা আছে, সে আমাকে সবসময় বলে জীবনে আনন্দটা নাকি খুঁজে নিতে হয়। এমনি এমনি আনন্দ আসে না। সবকিছুকে যদি তুমি দুঃখ দিয়ে দেখো তাহলেই দুঃখ আর নয়তো না।“

ডাইনি অবাক চোখে হিরুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “ধুরর… ধুরর তুই কিছু বুঝিস না।“

হিরু ঠোঁট উল্টে জবাব দিল, “সে তো তুমিও বোঝো না, তাই তো সবসময় দুঃখ পাও। আচ্ছা ডাইনি মাসি তুমি আমার সঙ্গে যাবে আমাদের রাজ্যে? হরবোলা দাদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব তোমার।” 

ডাইনি আরও একবার অবাক চোখে তাকাল হিরুর দিকে, এই প্রথম কেউ তার সঙ্গে এতো ভালো করে কথা বলছে। সে কথা হিরুকে বলতেই সে হেসে বলল, “শুধু শুধু কী কেউ কারুর সঙ্গে খারাপ করে কথা বলে? আর তাছাড়া আমি তো জানি তুমি আসলে খারাপ নও। ও মাসি যাবে আমার সঙ্গে?”


***

পরের দিন সকালে বুরিদিম্মার গোটা গাঁয়ে শোরগোল পড়ে গেছে। রাতের ঝড় শুধু এবার রঙই চুরি করেনি, সঙ্গে নিয়ে গেছে রাজকুমার হিরণ কুমারকেও। যদু আর বুড়িদিম্মা তো চিন্তায় অস্থির, কেমন করে তারা মুখ দেখাবে রাজামশাইয়ের কাছে! এমন সময় হঠাৎ করে দেখা গেল একটা কালো ঝড় বনবন করে ধেয়ে আসছে গাঁয়ের দিকে। গাঁয়ের লোক তো ভয়েই অস্থির। এবার ওই দুষ্ট ঝড় দিনেরবেলাও হানা দেবে নাকি! কিন্তু ওমা ঝড়টা এমন দুভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে কী করে! দেখতে দেখতে ঝড়টা দু’ভাগ হয়ে দুটো ভুঁড়োপেটো ছানা রাক্ষসের রূপ নিল আর তার  তাদের মধ্য থেকে এক এক করে বেরিয়ে এল হিরু আর ডাইনি। ডাইনিকে দেখেই তো সবাই ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু হিরু সবাইকে অভয় দিয়ে বলল তার ‘ডাইনি মাসি’-কে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ডাইনি মাসি খুব ভাল। সে এসেছে সবার রঙ ফিরিয়ে দিতে। এরপর ডাইনি একটা বড় গোলক হাতের তালুতে তুলে ধরে বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র বলা শুরু করল, আর দেখতে দেখতে সেই গোলক থেকে হরেক রকম রঙ পাক খেতে খেতে বেরিয়ে সব বেরঙ হয়ে যাওয়া জিনিসপত্রে মিশে গেল, সেই সঙ্গে বুড়ি দিম্মার গাঁ আবার আগের মতই রঙিন হয়ে উঠল।

    সব রঙ ফিরে আসার পর  হিরুর মুখে ডাইনির সব গল্প শুনে আনন্দে তাকে বুকে চেপে ধরলেন বুড়িদিম্মা। তারপর  যদুকে বললেন, “ওরে যদু রাজামশাইকে গিয়ে বলিস হিরের টুকরো ছেলে পেয়েছেন উনি। সবাইকে যে সত্যিকারের ভালবাসতে পারে সেই তো আসল রাজকুমার। তার একটু আধটু দুষ্টুমি করলেও ক্ষতি নেই।”

 

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু