বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

ক্ষিপ্তেশ্বরী

#বিভাগ_গল্প
ক্ষিপ্তেশ্বরী
ঝিলিক মুখার্জী গোস্বামী
____________________________

যুবতীর উন্মুক্ত ঘন কেশের ন্যায় সন্ধ্যা নেমেছে প্রায়। পাশের বাড়ি থেকে শঙ্খের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ভুর ভুর করে ভেসে আসছে সুগন্ধি ধূপের সুগন্ধ। ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দায় বসেই মনটা কেমন যেন হঠাৎই প্রসন্ন হয়ে উঠল। চেতন বা অবচেতন মনেই হোক এই সুগন্ধি, আমি প্রায়ই পেয়ে থাকি। উন্মুক্ত নয়নে হোক আবদ্ধ দৃষ্টিতে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে দু'টো দেদীপ্যমান মৃৎপ্রদীপের রশ্মির সাথে একে অপরকে আলিঙ্গন করার খেলা। এগুলো সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল ঠিক যেদিন...

// তামিলনাড়ু//

প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরিরত হওয়ার কারণে প্রায়ই বদলি হয় আমার। এবারে বদলির জায়গাটা ছিল তামিলনাড়ু। কোম্পানির কর্মরত মানুষজন নিমেষেই আমাকে আপন করে নিয়েছেন আমার কর্মদক্ষতার কারণেই হোক বা হোক চার্মিং লুকের কারণে।

এখানে এসে একটা মানুষের সঙ্গে সবথেকে বেশি আত্মিকতা গড়ে উঠেছিল আমার। তামিল বিনায়ক দাদা তথা কোম্পানিতে আমার বস। পরিবার ছেড়ে এসেও একটি পরিবার জুটে গিয়েছিল আমার। নইলে থাকা খাওয়ার এই ঝক্কি আমার পক্ষে সামলে ওঠা কার্যত অসম্ভব ছিল।

পেটের দায়ে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি করলেও নিজের শখটাকে একদম ভুলতে পারিনি। আমার এই শখের কথা যখন, বিনায়ক দাদা শুনলেন, জোরপূর্বক আমাকে ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন এবং পাকাপাকিভাবে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিলেন। দাদার সহধর্মীনিটিও বেশ মিশুকে স্বভাবের কারণে কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে আপন করে নিলেন।

// কলকাতা//

কিছুদিন বাদেই বাঙালির বড়ো উৎসব, দুর্গাপুজো। আকাশে বাতাসে লেগেছে তার ছোঁয়া। গঙ্গার ঘাটের কিছু অংশে ফুটে উঠেছে কাশ ফুলের মেলা। নীলাভ আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে চলেছে নিরন্তর। বাতাসের আদ্রতা এক ঝটকায় নেমে গিয়েছে যেন। হালকা হিমেল বায়ুর স্পর্শ যখন মুখমন্ডলে এসে ঝাপটা মারে, প্রাণটা জুড়িয়ে যায় তৎক্ষণাৎ। মায়ের আগমনী বার্তার সাথে সাথে ঘুম ভাঙা সকালগুলো আচমকাই ভাল হয়ে ওঠে।

প্রতিদিনকার মতো অফিস থেকে ফিরেই, ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবারটা কোনো রকমে গলাধঃকরন করে বিছানায় এলিয়ে দিই ক্লান্ত শরীরটাকে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে এক কাপ ব্ল্যাক কফি সমেত বই এর পাতা ওল্টানো আমার পুরোনো স্বভাব। সারাদিন অফিসের কাজের চাপ সামলেও টুকটাক লেখালিখির কারণে মুখপুস্তিকাতে অল্পস্বল্প পরিচিতি পেয়েছি। হয়তো কোথাও সুপ্ত অবস্থায় অবস্থান করছিল আমার লেখনীসত্ত্বা। ঠিক সেই কারণেই চাকরি-বাকরি সামলেও লেখা এবং পড়ার নেশাটিকে একদমই এড়িয়ে যেতে পারিনি।

// তামিলনাড়ু //

আজ বিনায়ক দাদার বাড়িতে অতিথিদের আনাগোনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সারা শহর সেজে উঠেছে আলোকের ঝর্না ধারায় । কাজের চাপ থেকে সাময়িক বিরতির কারণে মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল। সন্ধ্যায় এইসব আয়োজন দেখে মনটা আরও ভাল হয়ে গেল। এত আলোর বন্যার মাঝেও আকাশের চন্দ্রিমার রূপের ছটার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন পরিদৃষ্ট হচ্ছে না। আকাশের সব তারাদের ম্লান করে দিচ্ছে তার রূপের ছটা। আজ ডিসেম্বরের সতেরো। তার উপর শুভ মঙ্গলবার। তামিল ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আজ কার্ত্তিক পূর্ণিমা। এই দিন গোটা তামিলনাড়ু জুড়ে ' কার্ত্তিগাই দীপম' নামে একটি উৎসব পালিত হয়।

রাতের খাওয়া শেষ করে সবাই চলে গেলে পর বিনায়ক দাদার কাছে আর্জি জানাই, 'কার্ত্তিগাই দীপম' উৎসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার। নতুন জিনিস জানার ক্ষিদে আমাকে সর্বদা বিতাড়িত করে।

কলকাতার ডিসেম্বর গুলোর মতো এখানে এতটাও ঠান্ডার কামড় নেই। তাই বাড়ির ছাদের ওপরেই উন্মুক্ত গগনের নিম্নে বসা স্থির করলাম। আমি, বৌদি এবং বিনায়াক দাদা.... তিনজনে তিনটে চেয়ার দখল করে বসে আছি। অভ্যাসগত ভাবে হাতে রয়েছে ব্ল্যাক কফির মস্ত একটা পেয়ালা। যার থেকে ধোঁয়ার রিংগুলো উর্ধ্বমুখী হয়ে খেলে বেড়ানো শুরু করেছে। পেয়ালার সাথে ঠোঁটের সুসম্পর্ক স্থাপন করে একটা ফুৎকার আওয়াজ তুলে বিনায়ক দাদার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাব। ঠিক সেই মুহুর্তে বিনায়ক দাদা বলে উঠলেন, " তুমি যে ঘরে আছ ওই ঘরের দেওয়ালে একটা মস্ত বড় মুখোশ ঝোলানো আছে। নজর করেছ নিশ্চয়ই।"

বিনায়ক দাদার কথায় একটু ভাবার সময় নিয়ে আলতো মাথা হেলিয়ে বলি, "দেখেছি।"

বেশি কিছু বলার থেকেও জানার ইচ্ছে আমাকে গ্রাস করেছে তখন। বোধহয় বিনায়ক দাদা সেটা নজর করলেন। ক্ষণিকের নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলেন, " ওটা হল মুরুগন দেবতার। মুরুগন অর্থে ছয় মস্তক বিশিষ্ট কার্ত্তিক ঠাকুরের একটি অবয়ব। কার্ত্তিক ঠাকুরের ছয়টি শিশুরূপ ছিল।

বিনায়ক দাদা থামলে আমি প্রশ্ন করে উঠি, " ছয় জনের নাম আপনি জানেন?"

মস্তক সামান্য ওপর নীচ করে বিনায়ক দাদা পুনরাবৃত্তি করলেন, " তৎপুরুষম, অঘোরম, বামদেবম, ইশানম এবং অধোমুখম।

বিনায়ক দাদা আবারও বিরাম চিহ্ন অঙ্কিত করতেই পুনরায় বলে উঠি, সে তো বুঝলাম। কিন্তু এই উৎসবের সঠিক অর্থ এখনও বুঝলাম না।

আমার কথায় মৃদু হাসির রেখা টেনে বিনায়ক দাদা বলে উঠলেন, " অন্ধকার ঘুচিয়ে আলোকে আহ্বান করাই এই উৎসবের উদ্দেশ্য। আকাশের নক্ষত্রদের অবস্থান দেখে তামিল ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালন করে থাকি আমরা। আন্নামালাই পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত অরুনাচলেশ্বরম মন্দিরে এই উৎসব ব্যাপক ভাবে পালিত হয়।"

বিনায়ক দাদার কন্ঠস্বর থামতেই, অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস প্রকাশিত হয় আমার মনের অভ্যন্তর থেকে। স্বগতোক্তি করে উঠি, কত ধরনের পৌরাণিক কাহিনীর সাক্ষী আমাদের ভারতবর্ষ।

// কলকাতা //

ঘরের মধ্যে হঠাৎই এক সুমিষ্ট গন্ধ অনুভব করলাম। গভীর ঘুমেও অনুভূত হল একটা অদ্ভূত সুগন্ধে ভরে গেছে গোটা ঘর। কোনো কিছু বাদ্য বেজে চলার ক্ষীণ আওয়াজটা কর্ণপটহে এসে সরাসরি ধাক্কা মারছে। ঘরের মধ্যে তেরচাভাবে পড়ন্ত রাস্তার গ্যাসের আলোর হরিদ্রাভ ভাব নিমেষে বদলে গিয়ে নীলচে আকার ধারণ করেছে। ধূপ, দীপ, চন্দনের অমোঘ গন্ধে ঘরের প্রতিটি আনাচে কানাচে ভরে উঠেছে। নীলচে আলোটা ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সেই আলোকে কেন্দ্র করে একটা শরীরাবয়ব ধীরে ধীরে নিজস্ব আকার ধারণ করেছে। পরিহিত পরিধানের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই মনের মধ্যে একরাশ প্রসন্নতা উদ্ভূত হল। ময়ুরপুচ্ছ রঙা বসনে, অদ্ভূত সৌন্দর্যের অধিকারী সেই দেহাবয়বের দিকে নজর যেতেই চর্তুভূজ পেরিয়ে উর্ধ্বতন দেশে নজর পড়তেই সারা শরীরে এক অজানা হিমেল স্রোত বয়ে গেল। ষড়াণন বিশিষ্ট বারোটি চক্ষু থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে এক অকল্পনীয় দৃষ্টিস্রোত। আস্তে আস্তে ছয়টি মস্তক একত্রিত হয়ে গিয়ে একটি দীর্ঘ মস্তকে রূপান্তরিত হল নিমেষে এবং একটি অদ্ভূত দর্শনধারী লাল রঙা মুখোশে পরিণত হল। এই মুখোশ আমার বেশ পরিচিত। বিনায়ক দাদার বাড়িতে থাকার সময় এই ভীষণাকার মুখোশের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল। কিন্তু...

ঘরের মধ্যেকার মৃদু হিমেল স্রোত কখন যেন ভারী হয়ে উঠেছে। গায়ের মধ্যে জড়িয়ে থাকা চাদর ইতিমধ্যেই স্খলিত হয়ে ভূমিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনা করেছে। নগ্ন শরীরের লজ্জা নিবারণকারী পোশাক পরিচ্ছদ অবিন্যস্ত প্রায় এবং শরীরের অন্দর থেকে বেরিয়ে আসা স্বেদবিন্দুর দল পরিহিত পোশাককে স্নিক্ত করে তুলেছে প্রায়। শয্যা থেকে ওঠার ক্ষমতা যেন লুপ্তপ্রায়। ঠিক এমন সময় মুঠোফোনের কাঁপুনি অনুভব করলাম। ধীরে ধীরে চোখ মেলে এদিক ওদিক হাতড়ে মুঠোফোনের নাগাল পেতেই তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলাম। ওপ্রান্ত কৃত্রিম রাগত স্বরে বলে উঠল, " কখন থেকে তোকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছি। থাকিস কোথায় বলতো?"

ওপ্রান্ত তখনও বলেই চলেছে। আমি কোনোরকমে কয়েকটি টুকরো উত্তর দিয়ে মুঠোফোনটাকে পরম অযত্নে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে পুনরায় বিছানার মধ্যে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে বসলাম, কোথায় গেল নীলচে আলোর রেখা গুলো! ঘরের মধ্যে কাচের জানালা ভেদ করে সকাল সূর্যের রক্তিম আভা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে স্নিক্ত করার চেষ্টা করছে। ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পূর্বে অনুভূত হওয়া সেই সুমিষ্ট গন্ধরাজির বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। তাহলে এতক্ষণ যে এগুলো ঘটছিল সেগুলো কোনো অলৌকিক ঘটনা নাকি নিছকই স্বপ্ন মাত্র!

গতরাত্রে অলৌকিক দেবতাদের উপর লেখা একটা বই পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারই ফলস্বরূপ এই স্বপ্ন। এই বলে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম, প্রায় দশটা মিসড কল এবং খান কয়েক হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। সবকটাই অপরাজিতাদির। হোয়াটসঅ্যাপ ওপেন করতেই নজরে এল পুজোর জন্য লেখা চেয়ে পাঠানো, দিদির একগুচ্ছ মেসেজ। স্নেহপরায়না দিদির মেসেজ দেখা ইস্তক কিছুক্ষণ পূর্বে চাক্ষুষ করা স্বপ্ন,প্রায় বিস্মৃতির আড়ালে পাঠিয়ে দিয়েছি। হাতে বেশি সময় নেই। এই ক'দিনের মধ্যে একটা জমাটি প্লট বানিয়ে গল্প লিখতেই হবে। দিদিকে কোনো অজুহাতেই বিমুখ করা সম্ভব নয়।

অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ওই সময়টা কাজে লাগালাম গল্পের প্লট ভাবতে। অনেক ভাবনার পর একসময় ভাবনাদের ভিড়ে দীর্ঘ ছেদ টেনে আমার সব সমস্যার মুস্কিল আসান, আমার সবথেকে কাছের বন্ধুর কাছে বিবরণী মূলক কথা লিখে হোয়াটসঅ্যাপে মস্ত বড় সন্দেশ প্রেরণ করে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম নিশ্চিন্ত মনে। সাথে গতরাত্রের অলৌকিক স্বপ্নের কথাটাও উল্লেখ করতে এতটুকু ভুল করলাম না।

// তামিলনাড়ু //

প্রোজেক্টের কাজ শেষ করে এবার কলকাতা ফেরার পালা আমার। তার আগে আমার অনুরোধে বিনায়ক দাদা আমাকে দর্শন করিয়ে নিয়ে এলেন অরুনাচলেশ্বরম সহ আরও কিছু মন্দির। মন্দির অভ্যন্তরস্থ মূর্তিগুলোও যেন এক অন্যরকম প্রশস্তি এঁকে দিয়ে যায় চাঞ্চল্য চিত্তে। একটা অন্যরকম ভালোলাগার আবেশ নিয়ে কলকাতা ফিরে এলাম। সাথে নিয়ে এলাম...

//কলকাতা//

কাজের ফাঁকেই মুঠোফোনের কাঁপুনি অনুভূত হলেও তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়ায় অফিসের লাঞ্চের সময় মুঠোফোনের নোটিফিকেশন চেক করতে গিয়ে হোয়াটসঅ্যাপের বাক্স ভরে দেওয়া বন্ধুর মেসেজ গুলো চেক করতে গিয়ে ওষ্ঠাধারে হাসির রেখা ফুটে উঠল। একটি বিশেষ বিশেষণ প্রয়োগ করে গল্পের নামকরণ সমেত খানকয়েক অডিও পাঠিয়েছে। তখনকার মতো মুঠোফোন বন্দি অডিও গুলো রেখে দিয়ে পুনরায় অফিসের কাজে মন দিলাম।

অফিসের ঘড়িতে ছ'টা যখন বাজল, প্রবল দ্রুততার সঙ্গে ডেস্কটপ বন্ধ করে দিয়ে ক্যাব বুক করলাম। মিনিট কয়েকের অপেক্ষার পর আমার সমুখে ক্যাব এসে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে প্রবেশ করেই, বন্ধুর পাঠানো অডিও গুলো শোনার জন্য একপ্রকার ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

প্রথম অডিওটি চালিয়ে দিয়ে কার্যত অবাক হলাম। অপরিচিত কন্ঠস্বর শুনে কিঞ্চিৎ অবাক হলাম বৈকি। আরও একটু সময় নিয়ে বাকি অডিও গুলো একের পর এক শুনে গেলাম। অবাক হওয়ার জন্য আরও কিছু ঘটনা অপেক্ষা করেছিল। আমার জেলা মেদিনীপুরে এইরূপ একটি স্থানের মাহাত্ম্য শুনে অবাক হয়েছিলাম বৈকি। কারণ এত ঘটনা সম্পর্কে আমি ছিলাম একেবারেই অজ্ঞ। কথাটা হাস্যকর হলেও দৃঢ় সত্য। অডিও গুলো বন্ধ করে দিয়ে রাস্তার আলোর দিকে একপ্রকার আনমনা হয়েই তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। মনে মনে ঠিক করলাম, বাড়ি ফিরেই বন্ধুর সাথে এই বিষয়ে একটি দীর্ঘ হোমওয়ার্কের প্রয়োজনীয়তা কে।
**
অফিস থেকে ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সময় অপচয় না করে, বন্ধুটিকে ফোনে ধরলাম। ভাগ্যক্রমে তৎক্ষণাৎ সংযোগ স্থাপনে সফলতা পেয়েই মনের আনন্দে হিল্লোলিত হয়ে উঠি। কথার ওপর কথা না চাপিয়ে সরাসরি মূল প্রসঙ্গে প্রবেশ করি। প্রথম প্রশ্নটা আমার দিক থেকেই ছিল, মেদিনীপুর জেলার ক্ষেপুত গ্রামের 'ক্ষিপ্তেশ্বরী' দেবীকে ঘিরে এত অলৌকিক এবং পৌরাণিক কাহিনী আছে তুই জানতিস? আমি তো....

আমার মুখের কথা মুখগহ্বরেই বাধাগ্রস্ত হয়। আমার বন্ধু, পৌলোমী তৎপর হয়ে বলে ওঠে, " আমারও এই বিষয়ে বিশেষ কিছুই জানা ছিল না। নির্মল কাকু বলে একজনের থেকে এতগুলো তথ্য পেলাম।"

বেশ কিছু সময় নিস্তব্ধ থাকার পর, নিস্তব্ধতা ভেঙে পুনরাবৃত্তি করে উঠি, এতক্ষণ গল্পের প্লট নিয়ে ভাবছিলাম। এখন ভাবছি এতগুলো তথ্যেের মধ্যে গল্পের মধ্যে ঠিক কোন অংশ কতটুকু পরিবেশন করব। সাময়িক ভাবে মস্তিষ্কের কাজ করা বন্ধ হয়ে গেলে আমি একদম নীরবতা অবলম্বন করি। ঠিক সেই মুহুর্তে, পৌলোমী বলে ওঠে, " তুই বরং অলৌকিক ঘটনাগুলোকে একত্রিত করে একটা গল্প লেখ।"

ওর কথাটা শুনে মনে মনে চিন্তিত হলেও প্রকাশ না করে স্বগতোক্তি করে উঠি, অলৌকিক গল্প যে আমি কস্মিনকালেও লিখিনি। নিজের প্রতি প্রথমবার অবিশ্বাস এল। ওদিকে অপরাজিতা দিদিও বার কয়েক মেসেজ করে লেখার কথা জানতে চেয়েছে। ক্যালেন্ডার বলছে হাতে মাত্র আর তিনটি দিন। ভাবনায় ছেদ পড়ল পৌলোমীর কথায়।
" কি এত ভাবছিস! লিখে ফেল 'ক্ষিপ্তেশ্বরী' মা কে নিয়ে।" ওর কথায় ছোট্ট একটা 'হুম' বলে পুনরায় ভাবনাদের ভিড়ে যাওয়ার পূর্বে অডিও থেকে শোনা কিছু তথ্য নিয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত হলাম।
**
প্রায় ঘন্টাখানেক চেষ্টার পর সাদা খাতার ওপর অক্ষরদের সাজাতে অক্ষম হলাম যখন, বিরক্ত হয়ে সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে বিছানার ওপর শরীরটা এলিয়ে দিয়ে মুঠোফোনের অডিও গুলো পুনরায় মনযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম।
**
অনেকদিন হল বাড়ি মুখো হইনি। পুজোর ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়ে সকাল সকাল বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিই। ট্রেনে চড়ার সময় থেকে একজন মানুষের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। মানুষটিকে দেখলেই শ্রদ্ধায় বিগলিত হয় মন। কিছুটা দূর থেকেই লাল রঙা বসন পরিহিত পুরুষটির ওপর দীর্ঘক্ষণ দৃষ্টি নিক্ষেপের ব্যাপারটা তিনি বোধহয় বোধগম্য করতে পেরেছিলেন। ইশারায় তাঁর নিকটে যাওয়ার আহ্বান করলেন। আমিও কেমন যেন অমোঘ টান অনুভব করছিলাম সেই ডাকের প্রতি। কিছু না ভেবেই ওনার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওনার মুখোমুখি বসে পড়ি। মৃদু হাসির রেখা টেনে উনি যা বলে উঠলেন আমার সারা শরীর জুড়ে লাভা স্রোত বয়ে গেল যেন।

" ক্ষিপ্তেশ্বরী মা কে নিয়ে গল্প! আদৌ জানা আছে তাঁর সম্পর্কে?"

আমার মনের গভীর অবধি যিনি পড়ার ক্ষমতা রাখেন, তিনি আর যেই হন। কোনও অসাধারণ মানুষই হবেন। আমার মনের প্রতিটা কোণ তিনি যেন স্বচ্ছ ভাবে পড়তে পারছিলেন। প্রসন্ন হেসে স্নেহের স্বরে বলে উঠলেন, " আমার নাম কালিকান্ত। আমার পিতা, রমাকান্ত ছিলেন মা ক্ষিপ্তেশ্বরীর একনিষ্ঠ সাধক। পরবর্তীকালে আমার ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত হয়।"

বোধহয় আরও কিছু অবাক করার মতো ঘটনা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমার ভাবনার জাল বিস্তৃত করেছে কি করেনি সিদ্ধপুরুষটি বলে উঠলেন, " ক্ষিপ্তেশ্বরী মা কে, পিতা পেয়েছিলেন চন্দ্রেশ্বর দহ থেকে। কথিত আছে রাবণ পুত্র মেঘনাদ ছিলেন দেবীর একনিষ্ঠ উপাসক। তখন দেবী আরাধ্যা হতেন নিকুম্ভিলা নামে। একদা মেঘনাদ, যুদ্ধে জয়লাভ হেতু দেবীর উপাসনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ঠিক সেই সময় নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে উপস্থিত হন, রামচন্দ্রের পরম ভক্ত হনুমান। এইরূপ কথিত আছে হনুমান, দেবীকে সেখান থেকে উৎখাত করে সমুদ্রের গর্ভে বিসর্জিতা করেন। কালের চক্রে সেই মুর্তি ভাসতে ভাসতে রূপনারায়ণ নদ হয়ে চন্দ্রেশ্বর দহে এসে স্থির হয়। এও কথিত আছে, দুর্গাদাস নামে এক ধীবর অভ্যাসবশত চন্দ্রেশ্বর দহে মৎস আহরণ হেতু জাল নিক্ষেপ করলেও জালটি, জল থেকে তুলতে কার্যত অক্ষম হয়ে দেবীর ভীষণারূপ দেখে মুর্চ্ছিত হন এবং দেবীর আদেশে আমার পিতা তথা হুগলি জেলার সোনাটিগরী গ্রাম নিবাসী রমাকান্তকে আহ্বান করে এনে তাঁর মাধ্যমে ক্ষেপুত গ্রামে তাঁকে স্থাপিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।"

এতটুকু বলে, কালিকান্ত বাবু বিশ্রাম নিলেন ক্ষণিক। আমারও মন্দ লাগছিল না এই গল্প শুনতে। বিশ্বাস কতটা করতে পারছিলাম জানি না। এমতাবস্থায় তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন, " তোমার বোধহয় এইসব গল্প বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।"

কালিকান্ত বাবুর কথাটি শোনা মাত্র মেরুদন্ডের ওপর সত্যিই একটা লাভা স্রোত খেলে গেল এবার। আমার অবস্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে তিনি পুনরাবৃত্তি করে ওঠেন, " আমি একসময় ভীষণভাবে অজ্ঞ ছিলাম। বেদ থেকে শাস্ত্র কোনো কিছুতেই জ্ঞান ছিল না। বয়ঃপ্রাপ্ত পিতার পক্ষে দেবী আরাধনা করা কার্যত কঠিন হয়ে পড়ে। সেই সময় আমি দেবী আরাধনা করায় ব্রতী হই। মন্ত্রজ্ঞান কিছুই ছিল না। একদিন দেবী আরাধনা করার সময় দেবীর ভীষণারূপ দর্শনে মুর্চ্ছিত হয়ে পড়লে পিতা এসে দেবীর করাল গ্রাস থেকে আমাকে মুক্ত করেন এবং দেবীর বরে আমি আজ পিতার অধিক শাস্ত্রজ্ঞ হয়েছি।"

এবার সত্যিই হাসি ফুটে উঠল আমার। দেবীর আশিস যদি আমার ওপর একটু...
**
পুজো মানেই আমার কাছে ভোগ খাওয়ার চিন্তা। হাসি চেপেই ভোগের ব্যপারে জানতে ইচ্ছুক হলাম।

" দেবী ভোগের এখানে বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। শোলমাছ পোড়া এবং কারণ বারি ছাড়া দেবী সন্তুষ্ট হন না। নিত্য ভোগ হিসাবে আছাঁটা চালের ভাত, তিনরকমের তরিতরকারি থাকলেও পূর্বোক্ত দুটি জিনিসেই দেবী একমাত্র সন্তুষ্ট হন।"

কারণবারির কথাটা শুনে মুচকি না হেসে পারলাম না। আমার হাসি দেখে, কালিকান্ত বাবু কিঞ্চিৎ রাগত স্বরেই বলে উঠলেন, " ঠাকুর দেবতার প্রতি তোমার বোধহয় ভক্তি শ্রদ্ধা বিশেষ নেই। দীর্ঘক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছি তোমাকে। আজ তোমার সঙ্গে এমন অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটবে..."
**

কৃষ্ণপ্রস্তরে নির্মিতা, অষ্টভূজা, সিংহবাহিনী দেবীর পদমূলের পঞ্চমুন্ডি আসন ছাড়িয়ে ঈশান কোনের দিকে অবস্থিত পঞ্চমুন্ডি আসনের ওপর একজন বলিষ্ঠ দেহধারীর পৃষ্ঠদেশ দর্শন করলাম। পরনে তাঁর রক্তবসন। তাঁর সমুখে একটি বলির কাঠ দৃশ্যত হল। আমাকে জোর পূর্বক সেইদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হয় আমি আজ বলি প্রদত্ত হতে চলেছি দেবীর চরণে। নিকটে যেতেই মন্ত্রটা কর্ণগোচর হল:

'ত্রৈলক্যধারহেতু তমবসিন্না কলিযুগে....'

মন্ত্রটি শুনে কিঞ্চিৎ অবাক হলাম। তান্ত্রিক সাধকদের মন্ত্রের সাথে মিল খুঁজতে শুরু করলাম ওই অবস্থায় থেকেও। বলির জায়গাটি পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে। কুমকুম এবং হলুদের দ্বারা গোলাকার বৃত্ত অঙ্কিত হয়েছে। একটা সময় আমার শরীর অবশ হয়ে এল। মস্তকের অংশটি বলির কাঠের মাঝে অবস্থান করছে। জ্বলন্ত মৃৎপ্রদীপের দিকে আবছা নজর পড়তেই দেখলাম, দুটো রশ্মি একে অপরকে আলিঙ্গন করে চলেছে। মন্ত্রোচ্চারণের গতি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছে। কারণ বারির বিশ্রী গন্ধ, নাসারন্ধ্রে ঝাপটা মারছে। তারই মাঝে দেখলাম অষ্টভূজা দেবীমুর্তি ধীরে ধীরে তার রূপ ধারণ করছে। দেবীর দুইপাশে কালচে রঙা দুটি মুর্তির নৃত্য পরিলক্ষিত হল। মুর্তি দুটি দেখে মনে হল ভৈরব এবং কালভৈরবের। হঠাৎই মুখমন্ডলের উপর কারণবারির ঝাপটা পড়ল মনে হল যেন।
**

চোখে মুখে জলের ঝাপটা অনুভব করলাম। চেতনা ফিরতেই দেখলাম এক আকাশ চিন্তা নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার বন্ধু পৌলোমী। গতরাত্রে কখন যেন, নির্মলকাকুর কন্ঠস্বর মাখা অডিও গুলো শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকাল থেকে প্রায় দুপুর গড়িয়েছে। কতক্ষণ এইভাবে অচেতন ছিলাম জানিনা। মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একশত মিসড কল। মুখটা কাঁচুমাচু করে ওর দিকে তাকাতেই একরাশ ক্রোধ উগরে দিল আমার উপরে। আমাকে ফোনে না পেয়ে ফ্ল্যাটবাড়িতে এসে ওয়াচম্যানের সাহায্য নিয়ে আমার নাগাল পাওয়া গেছে। গোটা ঘটনায় আমি নিজেই প্রায় হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। ইতিউতি চেয়ে সবকিছু বুঝতে আমার আরও কিছুটা সময় লেগে গেল। অজান্তেই একটা হাত চলে গেল নিজের মাথার ওপর। আমার এহেন আচরণ দেখে, রাগত স্বরে পৌলোমী বলে উঠল, " ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক কি দেখছিস বলত? "

ওর কথার উত্তরে এটুকুই বলতে সমর্থ হলাম, আমি জীবিত আছি?

আমার কথা শুনে, পৌলোমী আমার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ওর সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে, গতরাত্রের সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত ভাবে বললাম এবং এও ঠিক করলাম এবার পুজোয় 'ক্ষিপ্তেশ্বরী' মা'র দর্শনের জন্য যাব। গল্প লেখাকে সাময়িক বিরতিচিহ্ন অঙ্কিত করলাম। এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে আমার ঠিক কতটা সময় লাগবে, অজানা নিজের কাছেই। অপরাজিতা দিদির কথা তখন মাথা থেকে প্রায় চলে গিয়েছে।
**

আমার ফ্ল্যাটবাড়িতে মাঝে মধ্যেই বিল্বপত্র সহ পুষ্পের এক অপূর্ব সুগন্ধ পাই। রাস্তার আলোর দিকে নজর গেলেই মনে হয়, ওটা বিশালাকার মৃৎপ্রদীপে পরিণতি পেয়েছে যেন। এইসব ঘটনায় কতটা বাস্তবের ছোঁয়া আছ জানি না। কালিকান্তের অভিশাপে আমার জীবনে এইসব অলৌকিক ঘটনা ঘটে চলেছে বর্তমানেও। এই ঘটনার পর থেকে আমার নিজের মধ্যে বহুল পরিবর্তনগুলো পরিলক্ষিত করি। দেব দ্বিজে ভক্তি শ্রদ্ধা একঝটকায় যেন বেড়ে গেছে।

ফ্ল্যাটবাড়ির ব্যালকনিতে বসে অজস্র চিন্তাদের ভিড়ে নিজেকে প্রায় জর্জরিত করে ফেলেছি। শিরশির করে হওয়াটা যেন কিছু বলে গেল: ' ত্রৈলক্যধারহেতু তমবসিন্না কলিযুগে...."

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু