বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বিবর্ণ পাতায় সুবর্ণ রেখা

বিবর্ণ পাতায় সুবর্ণ রেখা

১৭ই ডিসেম্বর,

শতরূপাকে আজ দেখলুম।

দরজার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক মাত্র। চাঁদকে ঘিরে ধরেছে একঝাঁক জ্যোৎস্না।

সে চলে গেল। আমি মনোনিবেশ করি আমার অংকে। কিন্তু মন কি আর বসে?

২১শে ডিসেম্বর

গত তিনদিন কিছু লেখা হয় নি। আমার গবেষণা নিয়েই বড় রাত হয়ে যাচ্ছে। আবার গত তিনদিন যা শীত পড়েছিল তা আর কী বলব। চেয়ারে বসে থাকাই যাচ্ছিল না। খাটে লেপ ঢাকা দিয়ে ভাবতে না ভাবতেই ঘুম আমার চোখে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।  

২৫শে ডিসেম্বর

আজ শীতটা জব্বর পড়েছে। সবাই বড়দিনের আনন্দ করছে। এক ছাত্রের বাড়ির টিভিতে দেখলুম সেলিব্রিটি্রা কেক কাটছে। রাস্তায় কত ভিড়। ওই ভিড়ে আমার মন খুঁজে বেড়াচ্ছিল একজনকে।

একটু আগে মা এসেছিল একবাটি পায়েস নিয়ে। কাজু কিসমিস দিয়ে মায়ের বানানো পায়েস আমি খুব ভালবাসি।

-কাজুটায় একটু গন্ধ হয়ে গেছে। আসলে অনেকদিন কৌটোয় রাখা ছিল তো। দেখ যদি না খেতে পারিস তো-

মা কুন্ঠিত কিন্তু পায়েস আমার খুব ভাল লাগে।

--এই বড়দিনে তো তোকে আমি কেক করে দিতে পারি না বাবা। আর টাটকা কাজু কিনব সে পয়সা-

চোখের জল লুকিয়ে মা চলে গেল।

মা কাঁদলেও আমি হাসছিলুম। আমার ভাগ্য আমার সঙ্গে ব্যঙ্গ করছিল। তাই হাসি এসে গেল।

২৬শে ডিসেম্বর

সারা দিন আজ আমার কাটল প্রচন্ড কর্মব্যস্ততার মধ্যে। আজ দশ জায়গায় দরখাস্ত করেছি। ব্যাংক ড্রাফটের পেছনে কত খরচ হল এখনও হিসেব করি নি। মা আজ যাবার আগে বলেছিল, যেখানে যাচ্ছিস যা। কিন্তু দুটো মিষ্টি আর ফল অন্তত কিনে খাস বাবা। খালিপেটে থাকিস না।

মায়ের কথা রাখতে পারি নি। কারণ পকেটে আর পয়সা ছিল না।

আজ ফিরেছি রাত প্রায় নটায়। ফিরে বই নিয়ে বসেছি। আমি ‘গবেষণা’ কথাটা এখন নিজের কাছে বলতেও লজ্জা পাই। মা এল চা নিয়ে। দুটো রুটিও এনেছে। সারা দুপুর খাইনি। কেন খাইনি সেই কথাটা ফর্মাল ভাবে মা আর জিজ্ঞেস করে নি। কারণ সেটা মা জানে। কারণ সে তো আমার মা।

টেবিলে কাপ ডিস রেখে মা আবার হাত দিয়ে নিজের থুতনিটা চেপে ধরল। মায়ের পোকা ধরা দাঁতটা বড় ভোগাচ্ছে। একজন ডেন্টিস্টের কাছে যেতে বলেছিল। কিন্তু খরচের কথা ভেবে মা আমাকে বলে নি। আমি অনেক করে চেপে ধরতে মা সেটা ব্যক্ত করল।

আমি মাকে ‘কেন তুমি যাও নি’ বলে একটা মৃদু ফর্মাল ধমক দিলুম। মা কেন যায় নি সেটা তো আমার জানা। তবু—

১০ জানুয়ারি

গত বছরটা কেটে গেল। সবাই বিগত বছরের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব করছে। আমার চাওয়ার তুলনায় পাওয়ার তালিকা খুব ছোট। তাই আমি সেটা নিয়ে আর ভাবি না। কেমন অলসতা আর অনিচ্ছা আসে।

বলতে ভুলে গেছি চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে তৃতীয় এক ব্যক্তি আমাকে সবচেয়ে বেশি জ্বালাচ্ছে। সেটা হল ‘দেওয়া’। আমি যে দুটো টিউশনি করি তার বেশির ভাগ অর্থ এই মাঝের তৃতীয় জন কেড়ে নেয়। দরখাস্তের ফর্ম, ফি, মোবাইলের ডেটা রিচার্জ (এখন অনেক কাজ আবার স্মার্ট ফোন ছাড়া হয় না) আরও আরও কত কী। আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেও আবার। শারীরিক আর মানসিক শক্তিহীন একটা শরীর থেকে শুরু করে আড়ময়লা গায়ের শার্ট এমন কী মুচিকে দিয়ে অনেক বার সেলাই করা একজোড়া চটি পর্যন্ত। আমি খুব কৃতজ্ঞ এত উপহার পেয়ে। আমার বুট আর এক জোড়া ভাল জামাপ্যান্ট আমি তুলে রেখেছি যত্ন করে। যদি কখনও বেড়ালের কপালে শিকে ছেঁড়ে তার জন্যে। মানে ইন্টারভিউ আর কী।

পাওয়া? হ্যাঁ এর মধ্যেই একটা ভাল জিনিস আমি পেয়েছি। আজ আর নয় বড্ড ঘুম পাচ্ছে। কাল লিখব সে কথা।

১১ই জানুয়ারি

কাল তাকে স্বপ্নে দেখেছি। জ্যোৎস্না যাকে ঘিরে রাখে। সে কাল আমাকে ঘিরে রেখেছিল স্বপ্ন দিয়ে। ইকো পার্কে বোটিং করেছি দুজনে। সব টাকা সে দিয়েছে। একটা বেশ বড় পার্স বার করে আমাকে বলল, তুমি একটুও হেজিটেট করবে না কিন্তু নীলুদা।

আমার নাম নীলাম্বর। মা আমাকে আদর করে নীলু বলে ডাকে। কী আশ্চর্য এই মেয়েটা মায়ের আদরেও ভাগ বসাবে নাকি?

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গেছে। স্বপ্নটাও। অসময়ে হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছে। আমাদের রান্নাঘরের চাল টিনের। ভারি সুন্দর সুর উঠেছে তার ওপর জল পড়ার। কিন্তু কাল সকালে উঠে মায়ের হয়ত কান্না পাবে। চালটা সারান হয় নি। তার সব আনাজ পাতি কি মশলা হয়ত জলে চান করে মাকে ভেংচি কাটবে।

আবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি ঘড়ি দেখেছি। রাত এখন তিনটে পনের। এই মাঝরাতের স্বপ্ন কি কখনও সত্যি হয়? সে তো একটা সাইবারে সামান্য ডিটিপি করে। তার কি করে পেটমোটা পার্স হবে?

৩১শে জানুয়ারি

আজকাল ডায়েরি লেখা আর নিয়মিত হচ্ছে না। বড় সময় নষ্ট হচ্ছ তার স্বপ্ন ঘিরে। এসব চাঁদ-তারা-জ্যোৎস্না কবিদেরই মানায়। আমার মত নিত্য সমস্যা জর্জরিত বেকার যুবকের নয়।

এখন একটু গবেষণায় মন দিয়েছি। আমার এক ছাত্রীর বাবা ডেন্টিস্ট। তিনি একটু কম পয়সায় মায়ের দাঁত তুলে দিয়েছেন। আজ আমার বড় খুশির দিন। তবে আর একটা খুশির দিন ছিল। আমি লিখতে লিখতেও তার কথা লিখতে ভুলে গেছি।

আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই তো কাফেটা। শতরূপার সঙ্গে তো প্রায় দেখা হয়। এগারটায় সে আসে। পাঁচটায় ছুটি হয়। মাঝে মাঝে তার ওখানে আমাকে যেতে হয়। আজকাল অনেক কিছু অনলাইনের ফর্ম ফিল আপ বা অফলাইনের ফর্ম টাইপ করতে যেতে হয়।

-নীলুদা তোমার এক্ষুনি এটা লাগবে?

কেন এ প্রশ্ন করছে সে আমি বুঝেছি। আজ অসম্ভব ভীড় ছিল। আমি ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিই, না,  আপাতত বিকেলে হলেও চলবে। নিজেকে প্রতিবাদী ভাবতে আমার যেন কেমন ক্লান্ত লাগে। তাই সব কিছু মানিয়ে নিতে নিতে আর অজস্র এপ্লিকেশন ফর্ম সাবমিট করতে করতে আমি এখন একেবারে সাবমিসিভ হয়ে গেছি। আসলে আমার ভেতরের সব শক্তি আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। এই বত্রিশ বছরের জীবনে অনেক সমস্যার দেখা পেয়েছি, কিন্তু দেখা হয় নি সামান্য একটা অল্প টাকার যাহোক চাকরিরও।

সেদিনের সেই মারাত্মক ভেঙ্গে পড়ার কথা বলি। ক্লান্ত হয়ে সাড়ে তিনটেতে বাড়ি ফিরেছি। মায়ের মুখে আশার মৃদু আলো। একটা ইন্টারভিউ ছিল। মায়ের আশা-উজ্জ্বল মুখে একটা নিরুচ্চারিত প্রশ্নের ছায়া আমি দেখেছিলুম। প্রশ্নটা হল, কেমন ইন্টারভিউ হল বাবা?

মায়ের মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি নি। আধঘন্টা ধরে আমাকে অনেক অবাস্তব আর অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে শুধুই বিব্রত করে গেছে। আর একটা প্রশ্নে আমার বড় কান্না পেয়ে গিয়েছিল তখনই। কিন্তু ইন্টারভিউতে তো আর কাঁদা যায় না। তাই চুপ করে বসেছিলুম।

-আচ্ছা মিঃ নীলাম্বর আপনি গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন অন্তত দশ বার বছর আগে। কিন্তু এখনও কোনও চাকরি পান নি বলছেন। আমরা কি ধরে নিতে পারি চাকরি করতে কিংবা তার দরখাস্ত করতে আপনার মনে কিছু আলস্য আসে?

অবাক কান্ড! আমি এত বয়েসেও চাকরি পাই নি এ দায় আমার ঘাড়েই ঠেলে ফেলতে চাইছে। আর এই অবাস্তব উদ্ভট প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিতে পারাকে আমার অপদার্থতা হিসেবে চালাতে চাইছে।

আমার মনে হয়েছিল—

থাক সেটা আর করি নি। আমরা চাকরি প্রার্থী। আমাদের মান-সম্মান থাকলে চলে না। আর রাগ বস্তুটাকে জলে চুবিয়ে মনকে বেশ ঠান্ডা করে আসতে হয়। তাই আমি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেছিলুম। না না মনে মনে। দেখিয়ে তো আর এসব হয় না। আমার কান্না এদের হাসি যোগাক এটা চাইনি।

মা উৎসুক হয়ে মুখে সামান্য হাসি এনে তাকিয়েছিল।

যে কান্নাটা ইন্টারভিউ বোর্ডে কাঁদতে পারি নি সেটা এখন মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে সেরে নিলুম। একটু পরে কান্ন থামিয়ে বলেছিলুম, চাকরি তো পাব না। এবার হয়ত মুটেগিরিই করতে হবে। তা- আমার তাতেও লজ্জা নেই।

মা চুপ করে ছিল। কিছুক্ষণের আশার আলো সরে গিয়ে মুখে এখন বেশ গুমোট ভাব। হাসির হালকা মেঘগুলো এখন ঘন আর কঠিন আর কালো হয়েছে।

--তুই গ্রাজুয়েট হয়েও মুটেগিরি করলে লজ্জা তোর নয় বাবা। এ লজ্জা দেশের-=

-মা!

মা এসব বলছে কি? আমি ছুটে এসে আমার আঙ্গুল সজোরে মায়ের ঠোঁটে চেপে ধরি। কাতর প্রার্থনার সুরে বলি, এতবড় কথাটা তুমি বল না মা। আশেপাশে কত লোক ঘোরাঘুরি করে কেউ যদি শুনে ফেলে তো-

এরপর মায়ের ঠোঁট থেকে আর কথা বেরোয় নি। কিন্তু চোখ থেকে জল বেরিয়েছিল- একেবারে অঝোর ধারায়। আমি সেই মূল্যবান জলে আমার হাত, মুখ আর কপাল ধুতে ধুতে বলেছিলুম, তুমি কোনও প্রভাবশালী অর্থবান ছেলের মা নয় যে রেহাই পেয়ে যাবে। মনে রেখ তুমি এক শিক্ষিত বেকার গরিব ছেলের মা। দুদিন পরে হয়ত তোমাকে খেতেও দিতে পারব না তেমন করে। তো রক্ষা করব কি করে বল?

১লা ফেব্রুয়ারি

কালকের লেখা ডায়েরিটা বড্ড বড় হয়ে গেছে। হয়ত নিজের অক্ষমতার কথা বলতে বলতে একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলুম। তা কি আর হবে? কেউ বিরক্ত হবে না। কাউকে পড়াবার জন্যে তো আর এই ডায়েরি নয়। যদি বেঁচে থাকি তবে এই স্মৃতি আমার অনুভূতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবে। অনুভূতিগুলো হারিয়ে আমি আর কি করে মানুষ থাকব?

কাল আমার ‘জ্যোৎস্নার’ কথা লিখতে লিখতে অন্য কথায় চলে গিয়েছিলুম।

-তবে তুমি একটু কষ্ট করে বিকেলে এসে নিয়ে যেয়ো। সে বলেছিল।

সারা দুপুর তো আমায় ঘুরতে হয়েছে। কয়েকটা জায়গায় ইন্টারভিউ ছিল। আমার ফিরতে ফিরতে সে চলে গেছে। কী সর্বনাশ! কাল সকাল দশটার মধ্যে এটা ফিল আপ করে আমাকে বেরোতে হবে। সে তো আসবে সেই এগারটা। আর মুশকিল হল আমি তার বাড়ি চিনি না।

এই গলিটা শেষ হলে সেটা বড় রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। সেখানে বাস স্টপ। শতরূপা সেখান থেকে বাসে উঠে পড়বে। যদি উঠে পড়ে? আমি প্রায় দৌড়তে থাকি। আমার শরীরের থেকে মন আনেক বেশি দৌড়তে লাগল। আর তার সেই দ্রুতগতি ডেকে আনল অনেক দুর্ভাবনাকে। এই ফর্ম ফিল আপ করে সরাসরি গিয়ে জমা দিতে হবে কোলকাতার এক অফিসে। ওরা একটা প্রজেক্টের জন্যে বায়োকেমিস্ট্রির কিছু লোক চাইছে। লিখেছে পি-এইচ-ডি বা এম-এস-সি হলে ভাল হয়। তবে যদি তাদের তেমন পাওয়া না যায় তবে সাধারণ গ্র্যাজুয়েট হলেও চলবে। বিষয় অবশ্যই বায়োকেমিস্ট্রি হতে হবে।

সেই আশায় ছাই পড়তে চলল নাকি?

মোড়ের মাথায় একটা ফুচকার আড্ডা বসে। ফুচকাওলাকে ঘিরে একটা চক্রাকার ভীড়। একটা সাধারণ হালকা সবুজ রঙের চুড়িদার ফুচকা খাচ্ছে। এই চুড়িদার আমি চিনি। পোশাকে কোনও আভিজাত্য নেই। কিন্তু তার দেহ ঘিরে আছে সেই সৌন্দর্য বলয়।

এই রূপে আমি কখনও দেখি নি তাকে। এই রূপ যে তার শত রূপের অন্যতম। আমার বুক কেঁপে উঠল। হৃদয়ের ছন্দ আমার শরীরের ছন্দকে নষ্ট করে দিল। আমার পা যেন আর এগোতেও চাইল না। কিন্তু এগোতে যে আমাকে হবেই।

-ওমা নীলুদা? আচ্ছা তোমার সেই কাগজগুলো। দাঁড়াও দিচ্ছি ব্যাগ থেকে বার করতে হবে।

বলে সে আর একটা ফুচকা মুখে পুরে দিল। আর সেই অবস্থাতেই আমাকে বলল, নীলুদা ফুচকা খাবে? খাওনা।

আমি আপত্তি করার আগেই সে তার খালি হাত দিয়ে আমার হাতটা টেনে এন রাখল সেই ফুচকাওলার কাছে। কিছু মেয়ে সরে গেল সামান্য তফাতে। কিন্তু আমি জানি এখানে এখন ফুচকার খালি পাতাগুলোই জড় হচ্ছে তাই নয়। জড় হচ্ছে অনেকের অনেক কৌতূহল।

আমি একটু সংকোচে বললুম, না না-

কিন্তু ফুচকাওলা ততক্ষণে আমার হাতে পাতার বাটি ধরিয়ে দিয়েছে।

ফুচকার দাম শতরূপাই দিয়ে দিল। বলল, কানের কাছে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল, তোমাকে ভালবাসে এমন কেউ দিচ্ছে মনে কর না।

শতরূপা রুমালে হাতমুখ মুছে ব্যাগ খুলে আমার কাগজ বার করে দিল। মুখে তার খুব সুন্দর হাসি ছিল। বলল, জানি এগুলো কাল তোমার খুব সকালে লাগবে। ভাবছিলুম কি করে পৌঁছে দেব। হয়ত দেখা না হলে তোমার বাড়িতেই দিয়ে আসতে হত।

আমার কাছ থেকে টাকা নিল না সে।

-কিন্তু-

-আরে বাবা ও কিছু নয়। কিছু ফালতু কাগজ পড়ে ছিল। আমি সেই দিয়েই বানিয়ে দিয়েছি।

আমি চুপ করেছিলুম।

-নীলুদা-

আমি চমকে যাই খানিক।

-তুমি আজ ফুচকা খেলে আমার খুব ভাল লেগেছে।

ওর বাস এসে গেল। একেবারে এক দৌড়ে ছুটে গেল সে।

১লা মার্চ

বেশ গরম পড়ে গেছে। মাঝে মাঝে হালকা লোডশেডিং হচ্ছে।

প্রায় একমাস কিছু লেখা হয় নি। চাকরির পেছনে দৌড়ন বন্ধ করে দিয়েছি। বদলে আমার গবেষণা নিয়ে মেতে আছি। মায়ের মুখ একটু ভার। একদিন বলল, এসব ছেড়ে চাকরির পড়াটা একটু করলে তো পারতিস বাবা।

এই রকম একটা কথা কে যেন একদিন বলেছিল।

এখন মনে পড়ে গেছে। সেদিন রাস্তায় কুন্তলবাবুর সঙ্গে দেখা। উনি বেশ পরিচিত লোক। বায়োকেমেস্ট্রির ডক্টরেট। একটা কলেজের অধ্যাপক।

বেশ হেসে বললেন, এখন কী করছ?

-গবেষণা।

মনে হল ভয়ানক একটা বিষাক্ত বিছে ওনাকে কামড়ে দিয়েছে। চোখমুখের এমন অবস্থা। সামলে নিয়ে বললেন, পি-এইচ-ডি করছ? বেশ ভাল কথা।

মুখ দেখে মনে হল বেশ অবিশ্বাসের সুরে বললেন। আমি সামান্য গম্ভীর ভাবে বললুম, না না।

-আচ্ছা এম-এস-সি পাশ করে বসে আছ? হ্যাঁ তবে তো গবেষণার কথা ভাবতেই হবে।

আমি ঘাড় নাড়ি, এম-এস-সি পাশ করি নি- পড়ছিও না।

-শুধুই অনার্স? তা ভর্তি হয়ে যাও ইউনিভার্সিটতে।

এরপর যখন শুনলেন আমি অর্ডিনারি গ্র্যাজুয়েট তখন সানুকম্পায় এগিয়ে এলেন উপদেশ দিতে।

-শুধু একটা সাধারণ গ্র্যাজুয়েট হয়ে স্বপ্ন দেখ গবেষণা করার?

-বায়োকেমিস্ট্রির-

এরপর বেশ কিছুক্ষণ চোখের পলক না ফেলে আমার দিকে চেয়ে মনে মনে বোধহয় দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, পাগল বলব না কেন না দিব্বি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছ। তবে বাবা এইসব আজে বাজে পেট গরম হওয়া দুঃস্বপ্ন না দেখে অন্তত ডেন্টাল সায়েন্সের গ্র্যাজুয়েশনটা তো করে নিতে পারতে? একটা দাঁতের ডাক্তার হলেও তো কিছু রোজগারের ধান্দা করা যায় নাকি? তা নয়-

বাকিটা হয়ত মনে মনে বললেন।

যেন পায়ে একঝাঁক জোঁক ছেঁকে ধরেছে ছাড়াতে পারছেন না এক্ষুনি নুন খুঁজতে যেতে হবে এমন ভাবে কুন্তলবাবু অত্যন্ত দ্রুত প্রস্থান করলেন। তাঁর যাওয়াটা দেখে আমি মনে মনে হেসে উঠেছিলুম। আজ এই এত রাতে নিজের গবেষণা নিয়ে নিজেরই হাসি পেয়ে যাচ্ছে বেদম।

১০ই এপ্রিল

চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে। আজ সন্ধ্যায় দেখা হল তার সঙ্গে। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতে বলল একটা ছোট হামানদিস্তা কিনতে। ওর দাদুর চানাচুর খাওয়ার শখ এদিকে একটাও দাঁত নেই। আর বাঁধাবার টাকা নেই।

আমাকে বলল, এমন মনমরা কেন নীলুদা?

ওকে বলতেই হল। ও যে আমার জ্যোৎস্না। আমার গবেষণার জন্যে কিছু জিনিস কিনতে হবে। বেশ কিছু টাকার দরকার। মায়ের শুধু একজোড়া দুল পড়ে আছে। কোথাও যেতে পরে।

-তুমি একবার কাল বিকেলে বাসের স্ট্যান্ডে আসতে পারবে আচ্ছা কাল নয় পরশু এস।

১৩ই এপ্রিল

গবেষণাটা বন্ধই হয়ে যাচ্ছিল। আসলে গবেষণা জিনিসটার তো কোনও প্রাণ নেই। সে কি করে আমার অর্থাভাব বুঝবে? সে শুধু বোঝে তার প্রয়োজনের কথা।

সে যা হোক। আমার মন জোৎস্নায় ভরে গিয়েছিল যেদিন শতরূপা তার গলার সরু সুতলি হার আর কানের ছোট্ট ছোট্ট দুল বেচে আমার গবেষণার টাকা জুটিয়েছিল।

-আমার ইমিটেশইনেই বেশ চলে যাবে।

লাজুক হেসে সে পা বাড়িয়েছিল।

৬ই জুন

এই দীর্ঘকালের ব্যবধানে আমার ডায়েরি লেখা হয় নি। গবেষণা শেষ হয়ে গেছে। জানাশোনা সবাইকে বলেছি একটু তারা যেন আমাকে সাহায্য করে। কিন্তু নানা ধরণের হাসির স্যাম্পেল তারা দেখিয়েছে বটে তবে আশার আলো কিছু দেখাতে পারে নি। মাঝে মাঝে শতরূপার সঙ্গে আমার দেখা হয় বটে কিন্তু আমি বিশেষ আমল দিতে পারি না। আমার গবেষণার ফল হয়ত শূন্য। ওকে হার আর দুল বিক্রির টাকা এ জন্মে আর ফেরত দিতে পারব কিনা জানিনা।

১০ই জুলাই

এখন কোনও কাজ নেই। না কাজ খোঁজার না গবেষণার। বাইরে এখন সচরাচর বেরোই না। মাত্র কটা টিউশনি আছে। শুধু সেগুলোর জন্যে বেরোতে হয়। বাইরের দরজার পাল্লা আমি আর খুলে রাখিই না। কি জানি সেই ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্নার ছটা যদি ঢুকে পড়ে তো বুক গুড় গুড় করে। শুধু শুধু আশা জাগিয়ে আর কি হবে? তাছাড়া সেই টাকাটা ফেরত দিতে না পারার দুঃখটা কি কম? মেয়েটা হয়ত গরিব বলেই আমার গবেষণাকে ব্যঙ্গ করে নি। নইলে কে আর ছাড় দিয়েছে?

২০ জুলাই

আমার মা আমার দুঃখটা হয়ত বুঝেছে। তার নীরব চোখদুটো দেখলে আমি বুঝি। সন্তানের দুঃখ মা ছাড়া আর কে বুঝবে বল? আমি যেন কেমন একটা হয়ে গেছি। সারাদিন শুধু শুয়ে থাকি। ধীরে ধীরে আমি একটা শুকনো কাঠ হয়ে যাচ্ছি যেন।

১০ই আগস্ট

আজ শতরূপার সঙ্গে আবার দেখা। শতরূপা আমাকে ফুচকা খাওয়াতে চাইল। আমি এড়িয়ে গেলুম। সেও খেল না। তার সঙ্গে হেঁটে বাসস্টপ পর্যন্ত এলুম। কাল নাকি ওর দাদুকে মা খুব ধমক দিয়েছে। দাদু বলেছিল রোজ রোজ গুঁড়োন চানাচুর তার ভাল লাগে না খেতে। সে তার নিজের দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খেতে চায়। বাঁধান দাঁত দিয়ে। শতরূপার তো বাবা দাদা কেউ নেই। একা ডিটিপি করা এই মেয়েটার ওপর সংসার দাঁড়িয়ে আছে।

১৬ই ডিসেম্বর

আজ আমি আনন্দে কেঁদে ফেলেছি। মা যখন শুনল তখন সেও কাঁদল। আশ্চর্য! আনন্দে এত কান্না আসে? মা আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছে। তাই আজ লিখতে দেরি হয়ে গেল। রাত এখন সাড়ে বারটা। মা ঘুমোচ্ছে পাশের ঘরে। শুয়ে আছে ঘুমোচ্ছে কিনা বলতে পারব না।

আমার ঘুম আসছে না।

আজ একটা দারুন খবর এল। আজ আর বেশি লিখতে পারছি না।

১৭ই ডিসেম্বর

গতকাল সেই বিশাল আনন্দের খবরটা আর আমি লিখতে পারি নি। কাল রাত ঠিক আটটায় আমার স্মার্ট ফোনে একটা মেসেজ এসেছে দেখি। প্রথমে তো কোথা থেকে এসেছে তা বুঝতেই পারি নি। কেবল এক লাইনের মেসেজ ছিলঃ ইওর প্রজেক্ট ইজ হাইলি এপ্রেজড অ্যান্ড আল্টিমেটলি এক্সেপ্টেড।

পরে চিন্তা করে দেখলুম আমার প্রজেক্ট মানে গবেষণার বিষয় আমি সাবমিট করেছিলুম জার্মানির এক প্রতিষ্ঠানে। আজ ছ’মাস পরে তার উত্তর এল।

এরপর একটা ফোন এল। মনে হল এটা আমাদের দেশের বাইরের কোনও দেশ থেকে এসেছে এটা। কারণ এটা ছিল আই-এস-ডি কল।

-হাই!

চিবিয়ে চিবিয়ে অদ্ভুত ইংরেজি উচ্চারণে একজন বলল। আমি ঘাবড়ে যাওয়া কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলুমঃ হেলো-

এরপর সে যা বলল তা হল সে ফোন করছে জার্মানির সেই প্রতিষ্ঠান থেকে। সে বলল, অ্যাম আই উইথ ডক্টর নীলাম্বার বোস?

-সরি স্যার আই অ্যাম নট ডক্টর। ইভেন নট অ্যান অনার্স গ্র্যাড। মিয়ার এ পাস গ্র্যাড ইন বায়োকেমিস্ট্রি।

-সো হোয়াট? ইউ আর এ জিনিয়াস।

আমার এই গবেষণা তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। তারা এটার পেটেন্ট আমাকে নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। আমি ইচ্ছে করলে জার্মানিতে গিয়ে এই প্রজেক্টের বাকি অংশ করতে পারব। এরপর বাকি সব কাগজপত্র আমার ইমেল ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে বলে বলল।

আমার কানের কাছে শুধু ভাসছিল সেই কথাটাঃ সো হোয়াট? ইউ আর এ জিনিয়াস।

আবার সেই সঙ্গে কুন্তলবাবুর কথাটাওঃ শুধু একটা সাধারণ গ্র্যাজুয়েট হয়ে স্বপ্ন দেখ গবেষণা করার?

২০ ডিসেম্বর

আজ তার সঙ্গে আবার দেখা। আমি কিছু বলার আগেই দেখি তার মুখে খুব সুন্দর হাসি। কি ব্যাপার সে জেনে গেল নাকি? বললুম সব কথা। মন খারাপ করে বলল, তুমি তবে চলে যাবে?

-কি করে যাই বল? আমার তো পাসপোর্ট করান নেই। গরিবের কি আর বিদেশ দেখা ভাগ্যে থাকে? তাই করাই নি।

সে একটা ফোন নং দিল। অল্প সময়ের মধ্যে ইমার্জেন্সি পাসপোর্ট বানিয়ে দিতে পারে। তবে পাসপোর্ট অফিসে তাকে যেতে হবে কয়েকবার। আর কিছু টাকা লাগবে সেটা-

আবার আমাকে ঋণী করল মেয়েটা। বলল, আমার একটা আংটি আছে। তোমার মুখে তো তোমার প্রজেক্টের কথা অনেক শুনেছি। আমি চাই—

আমি ওকে থামালুম। বাকি কথা আপাতত গোপনই থাক।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, আমি কি যাব?

ডি-টি-পি করা মেয়েটা হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল, অফ কোর্স তুমি যাবে নীলুদা।

-তোমার মন খারাপ করবে না?

-তাই বলে আমি একটা জিনিয়াসকে আটকাব?

-আমি যদি আর না ফিরি? তোমাকে যদি ভুলে যাই?

-তাতে কী? তোমার এই গবেষণা কত লোকের উপকার করবে—ওঃ আমি ভেবেই পাচ্ছি না। আমার দাদুর-

আমার হাত ওর মুখে বসিয়ে দিয়ে থামাই আমি। এতসব এর মধ্যে ফাঁস হয়ে যাওয়া ঠিক নয়।

৩১শ জুলাই  

আমি এখন জার্মানিতে। আমার তৈরি করা ওষুধ এখানে কেউ অর্ডিনারি বায়োকেমিস্ট্রির গ্র্যাডের তৈরি করা বলে নাক কুঁচকে সরিয়ে রাখে নি। ওরা জিনিয়াস বলে গ্রহণ করেছে। বেশ কিছু পরীক্ষায় সফল হয়েছে।

প্রথম প্রথম অবশ্য একটা দ্বিধা ছিল। মানুষের দাঁত তো মাত্র দুবার বেরোয়। দেড় থেকে দুবছরের মাথায় দুধে দাঁত এর সংখ্যা মাত্র কুড়িটি। এরপর এগুলো পড়তে থাকে আর তার বদলে স্থায়ী দাঁত বেরোয় বত্রিশটি। কিন্তু এগুলো পড়লে আর ওঠে না। আমার আবিষ্কৃত ওষুধ দেড় মাসের মধ্যে আবার দাঁত তৈরি করতে পারে।

এটা কি সম্ভব? ওষুধে দাঁত গজানোটা-

আমি বলেছি, হ্যাঁ সম্ভব। একটা ঘা হলে কোষ বিনষ্ট হয়। কিন্তু ওষুধেই তা সেরে যায়। তাই দাঁতের ক্ষেত্রেও তেমন। বিনা সার্জারি বা দাঁত না বাঁধিয়েই তা সম্ভব।

২৫শে ডিসেম্বর,

এখানে আমি যেমন একটা চাকরি পেয়েছি তেমনি পেয়েছি এম-এস-সি পড়ার সুযোগ। যিনি আমার সঙ্গে প্রথম ফোনে কথা বলেছিলেন তিনি এক কলেজের প্রিন্সিপ্যাল আর এই প্রতিষ্ঠানের সর্বময় কর্তা।

বলতে ভুলে যাচ্ছি শতরূপার কাছ থেকে ফোন পেয়েছি। ওর দাদুর সব দাঁতগুলো আবার গজিয়ে গেছে। এখানে আসার আগে আমি ওষুধটা দিয়ে এসেছিলুম। চানাচুর খেতে আর হামানদিস্তের দরকার হয় না।

কিছু দিনের মধ্যে ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে শতরূপাকে বিয়ে করব আমি। না ওকে আমি ভুলি নি।

সেকথা জেনে শতরূপা ফোনেই হেসেছে আর বলেছে, এবার ফুচকার দাম আর আমি দেব না কিন্তু।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু