বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

কোয়েলের চিঠি

২০০১ এর মাঝামাঝি কোয়েল আর ওর বয়ফ্রেণ্ড ডিকি ঠিক ক’রলো এখানে ওটাওয়ার ভালো মাইনের কাজ ছেড়ে দিয়ে লণ্ডনে গিয়ে থাকবে- ওখানে ছুটিতে কাজ করার ভিসা নিয়ে।

এয়ারপোর্টে, ডিকি ও কোয়েল ইমিগ্রেশন আর বোর্ডিং-এর জন্যে চলে গেল, সুভদ্রা আর আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। আমি আর সুভদ্রা গেলাম ভিউয়িং গ্যালারীতে - ওদের প্লেনের উড়ে যাওয়া দেখার জন্যে; ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না ওদের প্লেন কোনটা।

প্লেন ছাড়তে এখনও কয়েক মিনিট বাকী; সুভদ্রা ব’ললো,- ‘এবার আমরা পড়তে পারি কোয়েলের চিঠিগুলো।‘ ঐদিনই সকালে কোয়েল সীল করা দুটো এনভেলপ দিয়েছে আমাকে আর সুভদ্রাকে; ব’লেছে– ‘আমরা প্লেনে চড়ার আগে খুলোনা এই খামগুলো’।

কয়েক সেকেন্ড পরে, আমি আর সুভদ্রা একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম, দুজনের চোখই অশ্রুভরা।

 

সুভদ্রাকে লেখা চিঠি:-

‘মা, আজ তোমাকে এই চিঠি লিখছি, কারণ কখনও তোমাকে ব’লতে পারিনি- তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি আর কতটা তোমার উপর নির্ভর করি। এখন, যখন চিঠি লিখছি, মনে হচ্ছে তুমি আর আমার কাছে নেই, ভরসা ক’রে দাঁড়াবার জন্যে জমি নেই পায়ের তলায়; অথচ এখনও আমি তোমাদের ছেড়ে যাইনি। তবুও এই ভেবে ভরসা পাচ্ছি যে খুব শীগগিরই আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে। তুমি যখন এসেছিলে দেশ ছেড়ে তখন তোমার ঠিক ধারণা ছিল না তোমার মামণি-বাবুমণির সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে আর আদৌ দেখা হবে কিনা। আমি সেরকম সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছি না। তোমার আর বাপীর স্নেহচ্ছায়া, আশ্রয় ছেড়ে যেতে ভয় লাগছে; কিন্ত তুমি আর বাপী আমাকে তৈরী ক’রেছো নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্যে। আমি জানি আমাকে কী ক’রতে হবে; তবে ক’রতে পারবো কিনা সেটা পরে বোঝা যাবে। আমার পাশে ডিকি আছে; আমরা দুজনেই দায়িত্ব নিয়ে কাজ ক’রি; সেটাই আমাদের পরস্পরের উপর বড় ভরসা। আমি তোমাকে খুবই ভালবাসি, যেটুকু তোমার চোখে পড়ে তার চাইতে অনেক বেশী। হয়তো অনেকসময় ধ’রে নিই, তুমি আমার জন্যে ক’রবেই, আমার না ব’ললেও চলবে।

আশা করি তুমি যা চাও তা পেয়ে খুশী হবে একদিন; কোনোদিন গল্প ক’রবে আমার সঙ্গে। তুমি সবচেয়ে নিঃস্বার্থভাবে যত্ন নিয়ে আমার দেখাশোনা ক’রেছো। আশা করি যেন কিছুটা তোমার মতো হ’তে পারি।‘

 

সুভদ্রার থেকে সামান্যই দূরে ব’সে পড়ছি আমাকে লেখা কোয়েলের চিঠি।

‘বাপী, তুমি হয়তো ভাবছিলে কেন এই চিঠিটা আমরা প্লেনে ওঠার আগে খুলতে দিইনি। কারণ, এই চিঠির কথাগুলো ব’লে দিলে তুমি আমাকে লণ্ডনে যেতে দিতে না; আর তোমার চোখের জল দেখলে আমিও ছেড়ে যেতে পারতাম না। কিন্তু, তোমার জীবনই আমার কাছে একটা বড় উদাহরণ– জন্মভূমি, নিকট আত্মীয়দের ভালোবাসার বাঁধন কাটিয়ে বিদেশে যাওয়ার, পুরোনো অভ্যেস ছেড়ে নতুন জীবন শুরু করার। আমাকে এদেশে এনেছো ব’লে আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ, শুধু আমি একা নয়, ডিকিও বারবার এই কথা বলে।

জানি, তুমি খুব চেষ্টা ক’রছো আর একটা কাজ পাওয়ার জন্যে; সে কাজ কবে পাবে আর কীরকম হবে সে কাজ– তার কোনো ধারণা নেই তোমার। পিএইচডি-র জন্যেও রয়েছে তোমার উদ্বেগ, জানোনা কবে তুমি পাবে এ খেতাব, আদৌ পাবে কিনা কোনোদিন। আমি জানি তুমি চাও যে আমি মাস্টার্স ক’রি, সম্ভব হ’লে পিএইচডি ক’রি তারপর। কিন্তু মাস্টার্স আর ডক্টোরেট করার পরিশ্রম না ক’রেই যদি আমি ভালো রোজগার ক’রতে পারি, তবে জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়টা কেন নষ্ট ক’রবো? 

আমি জানি তুমি খুব চেষ্টা ক’রছো Java আর XML-এ ওয়াকিবহাল হওয়ার জন্যে, বই পড়ছো, জার্নাল দেখছো সুযোগ পেলেই। সম্প্রতি, ডিকি এবং আমি জাভা প্রোগ্রামিং-এর তিন-মাসের কোর্স ক’রেছি; তার একটা বই তোমার টেবিলে রেখে গেলুম; যখন তোমার সময় হবে, ইচ্ছে হবে প’ড়ো বইটা। আমাদের একটা বই-ই যথেষ্ট। আমরা, আশা ক’রি, ফিরে আসবো খ্রীস্টমাসের সময়; তোমাদের আশীর্বাদে আশা ক’রি এই ক’মাস নিরাপদে কাটবে।

আপাততঃ, এখানেই থামছি; এই চিঠির পেছনে রয়েছে তোমার ডায়েরী থেকে ছেঁড়া কয়েকটা পাতা। তোমার ডায়েরীটা তোমার টেবিলেই রাখা থাকে; এটি এখনও তোমার জীবন্ত ডায়েরী; এখনও তুমি লিখে চলেছো এতে; তুমি কখনও আমাকে বারণ করোনি এ ডায়েরী পড়তে, তাই সুযোগ হ’লেই পড়েছি তোমার ডায়েরী; নজরে পড়েছে যে – কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে ফেলা হ’য়েছে এ ডায়েরী থেকে; তারপরে কৌতূহলভরে অনেক খুঁজেছি পাতাগুলো; অনেক অনুসন্ধানের পরে পেয়েছি বইয়ের আলমারীর এক কোণায়; এখন জানি তুমি আমার কাছে বাবার চাইতেও বেশী আপন।…    

** ডায়েরীর ছেঁড়া পাতার শুরু **

বৃহস্পতিবার ৪ঠা আগস্ট, ১৯৭৭

একটু আগে এই চিঠিটা এসেছে মন্দিরার উকিলের অফিস থেকে - পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ হ’য়েছে মন্দিরা আর আমার মধ্যে; এখন অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে সময় কাটালে আইনের আর আপত্তি নেই।
 

দুপুর দুটো; লাঞ্চ সেরে এক কাপ গরম চা নিয়ে ব’সেছি রেডিও-র খবর শুনবো ব’লে।

দরজায় ধাক্কার আওয়াজ; ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখি – পাশের বাড়ীর বৌদি – ওর কোলে ওর তিন বছরের মেয়ে কোয়েল, রক্তাক্ত ওর কপাল আর কনুই, উনি ব’ললেন, ‘আমাকে বাঁচান…’

মনে পড়লো, মাত্র ছ’মাস আগে বাঁচিয়েছিলাম এই বৌদিকে – আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা থেকে। বৌদির চিৎকার শুনে ছুটে গিয়েছিলাম; বন্ধ দরজা – লাথি মেরে ভেঙ্গে ফাঁক ক’রেছিলাম; বৌদির পরা জামাকাপড়ে শাড়ীতে দাউ দাউ ক’রে জ্বলছে আগুন – বৌদিকে জোর ক’রে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিলাম, গড়িয়ে দিয়েছিলাম একপাশে; ব’লেছিলাম, ‘জোরে জোরে গড়াতে থাকুন; এতে আগুন নিভবে হাওয়া – অক্সিজেন না পেয়ে…’। ছুটে গিয়েছিলাম ওদের বাথরুমে, এক বালতি জল এনে ঢেলে দিয়েছিলাম বৌদির উপরে – যাতে সব আগুন নিশ্চিতভাবে নেভে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম বৌদিকে; পনেরো দিন ধ’রে নানা চিকিৎসার পরে বৌদি বাড়ী ফিরেছিল; কোনো পুলিশ কেস হয়নি, কারণ বৌদি ওর স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো নালিশ করেনি; ব’লেছিল – অসাবধানে কেরোসিন স্টোভ থেকে কাপড়ে আগুন ধ’রে গেছে।  

অগ্নিকাণ্ডের কয়েক ঘন্টা পরে ফিরে এসেছিল ওর স্বামী – ও যা ভেবেছিল, তা হয়নি। ওর স্বামী ভেবেছিল – ও চাবি দিয়ে বাড়ীর দরজা খুলবে, তারপর ঘরে ঢুকে দেখবে ওর স্ত্রীর আগুনে পোড়া মৃতদেহ, ও তখন পুলিশে খবর দেবে – স্ত্রী আগুনে পুড়ে মারা গেছে, সম্ভবতঃ আত্মহত্যা। বাড়ী ফিরে এসে দেখেছিল:- বাড়ীর দরজা ভাঙ্গা, ভিতরে কেউ নেই; তখন ও আমাদের বাড়ীতে এসে খোঁজ ক’রেছিল; তখন বাড়ীতে ছিল আমার স্ত্রী মন্দিরা; মন্দিরা জানিয়েছিল যে আমি ওর স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে গেছি; ও হাসপাতালে নিয়মিত এসেছিল ওর স্ত্রীর খোঁজ নিতে; ডিসচার্জ হবার পরে বাড়ী নিয়ে গেছিল; এর আগে মেরামত ক’রেছিল বাড়ীর – বিশেষ ক’রে আমার ভাঙ্গা দরজাটির।

এই সময়ে আমার নজরে পড়েছিল – আগুনে পোড়া বৌদির পেটে সন্তান রয়েছে, বেশ বড়ো-সড়ো, শুনেছিলাম – বৌদি ছ-মাস ধ’রে অন্তঃসত্ত্বা।

সে ঘটনার পরে ছ-মাস কেটে গেছে; বৌদি একটি মেয়ের জন্ম দিয়েছে; সেই মেয়েটিই এখন বৌদির কোলে, বয়স তিন মাস, মেয়েটির নাম রেখেছে ‘কোয়েল’, এখন জানি বৌদির নাম ‘সুভদ্রা’।

 

বৌদি সুভদ্রা ব’ল্লো, ‘আমাকে বাঁচান… আমি খুন ক’রে ফেলেছি ওকে।’

হতভম্ব আমি জিগ্যেস ক’রলাম, ‘কী ক’রে?’

সুভদ্রা ব’ল্লো, ‘একটা ডাব-কাটা কাটারী হাতে নিয়ে ও হঠাৎ নৃশংস হ’য়ে উঠেছিল; মরিয়া হ’য়ে ছুটে আসছিল কোয়েল আর আমাকে কেটে ফেলবে ব’লে। আমি বুঝতে পারছিলাম না – কি ক’রে রুখবো ওকে; কোয়েলের বিছানা থেকে ওর পাশ-বালিশটা নিয়ে ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে, পাশ-বালিশটা গিয়ে পড়লো ঠিক ওর পায়ের নীচে; পাশ-বালিশটা উপর ভর দিয়ে দৌড়তে গিয়ে ও পড়লো মেঝের উপর – কাটারীটা ওর হাত থেকে পড়লো মেঝেতে – আমার কাছাকাছি – আমি দৌড়ে গিয়ে তুলে নিলাম কাটারীটা – ছুঁড়ে দিলাম জানলার দিকে, যাতে কাটারীটা জানলা দিয়ে উঠোনে গিয়ে পড়ে; কিন্তু ঠিক তা হ’লো না; ও ঝাঁপ দিলো কাটারীটা লুফে নেবার জন্যে; কিন্তু পারলো না লুফতে – কাটারীটা গিয়ে লাগলো ওর ঘাড়ে; ও প’ড়ে গেলো, আর উঠলো না; আমি চেষ্টা ক’রলাম, কিন্তু জ্ঞান ফেরাতে পারলুম না; প্লীজ একবার আসুন আমার সঙ্গে – দেখি ওকে বাঁচানো যায় কিনা – খবর দিতে হবে পুলিশ আর অ্যাম্বুল্যান্সকে।‘

গেলাম সুভদ্রার সঙ্গে – চেষ্টা ক’রলাম ওর স্বামীকে বাঁচাতে; পারলাম না; খবর দিলাম পুলিশকে। পুলিশ এসে ব’ললো যে, ওরা সুভদ্রার স্বামীর দেহ প্রথমে পাঠাবে জেলের হাসপাতালে; সেখানে দেখা হবে – ওর দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব কিনা; যদি সম্ভব না হয়, তবে দেহ পাঠানো হবে মর্গে – মৃত্যুর সময় ও কারণ জানার জন্যে।

পুলিশ ব’ললো, ওরা সুভদ্রাকে খুনী সন্দেহে গ্রেফতার ক’রবে; আমি ব’ললাম - খুনী সন্দেহে আমাকে গ্রেফতার করা হোক, সুভদ্রাকে নয়। পুলিশ ব’ললো, সুভদ্রাকে ছাড়া যাবেনা; সেই সঙ্গে আমাকেও গ্রেফতার করা হবে। আমি একথা জানালাম আমার উকিলকে। উকিল এসে জামীনের ব্যবস্থা ক’রলো সুভদ্রা আর আমার – দুজনের জন্যেই। জেল থেকে ফিরে এলাম আমরা, কিন্তু সুভদ্রার বাড়ী ফেরার উপায় নেই; পুলিশ দখল ক’রে রেখেছে ওদের বাড়ীটা – ফরেনসিক তদন্তের জন্যে – কি ক’রে এখানে মানুষ খুন হ’য়েছে তার অনুসন্ধানের জন্যে।

সুভদ্রাকে ব’ললাম, ‘চলুন, একবার আপনার বাড়ীতে যাই; ওখানে পুলিশের অনুমতি নিয়ে- নিয়ে আসবো যা আপনার বা আপনার মেয়ের আজ দরকারে লাগবে।‘

পুলিশের অনুমতি নিয়ে, সুভদ্রা অনেক কিছুই নিয়ে এলো এ-বাড়ীতে; প্রথমে ওর ঝোলায় ভ’রলো মেয়ে কোয়েলের যাবতীয় সরঞ্জাম – ওর বিছানা, ওর জামা, প্যান্ট, ওর খেলনা, পুতুল, ওর বেবীফুড ইত্যাদি; তারপরে নিলো নিজের জামা-কাপড়, রাতে শোবার জন্যে পাজামা কামিজ, গায়ে ঢাকা দেবার জন্যে চাদর ইত্যাদি; সবশেষে নিলো সকালে রান্না করা কিছু খাবার – রুটি, ধোঁকার ডানলা আর চাটনী।

সুভদ্রার রান্না-করা রুটি তরকারী দিয়েই রাতে ডিনার হ’লো আমাদের। ডিনার খাবার সময় একটু আক্ষেপ ক’রে ব’ললো সুভদ্রা, ‘পুলিশ চলে গেলেও, ও বাড়ীতে গিয়ে থাকা হয়তো আর হবে না।‘

‘কেন?’, একটু অবাক হ’য়ে জিগ্যেস ক’রলুম আমি।

-       ‘গত দু-মাস ভাড়া দেওয়া হয়নি; ঘরে টাকা-পয়সা কিছু নেই। আর এক মাস ভাড়া না দিলে হয়তো বার ক’রে দেবে বাড়ী থেকে।‘

-       ‘আমি সাধারণতঃ টাকা দিইনা কাউকে; দান ধ্যানে একটুও বিশ্বাস করিনা। আপনি কি কোনো কাজ করেন যাতে মাসে মাসে কিছু টাকা ঘরে আসে? কতটা লেখাপড়া ক’রেছেন আপনি?’

-       ‘না, আমি কখনও কাজ ক’রিনি। দু-বছর আগে আমার বিয়ে হ’য়েছিল; তার আগে বি.এ. পাশ ক’রেছি। ও ঠিকে মজদুরের কাজ ক’রতো; ওর আয় থেকে কোনোমতে চ’লতো।‘

-       ‘বুঝতে পারছিনা কী ক’রে আপনার সমস্যার সমাধান ক’রবো। শুধু বি.এ. পাশ ক’রে একটা চাকরী পাওয়া- ধ’রতে গেলে অসম্ভব।‘

-       ‘স্কুলের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট টিউশন দিতে পারি –‘

-       ‘সেই সুযোগ কে দেবে আপনাকে? কোনো বাবা-মাই তাদের ছেলেমেয়েকে ছেড়ে দেবে না অনভিজ্ঞ টিউটরের কাছে।‘

-       ‘কী ক’রবো তাহ’লে?’

-       ‘আপনি কি বাবা-মাকে জানিয়েছেন আজকের দুর্ঘটনার কথা? ওনাদের কাছে গিয়ে উঠতে পারেন কি?’

-       ‘এখনও জানাইনি ওদের; কোন মুখে জানাবো? সব ভালো রোজগেরে পাত্ররাই যৌতুক চাইছিল; আমার বাবা-মায়ের সেরকম সঙ্গতি নেই যে ওরা পাত্রপক্ষের দাবী মেটাতে পারবে; শেষে আমি পালিয়ে বিয়ে ক’রে ঠকে গেলাম।‘

-       ‘বুঝেছি। আপনার এই সমস্যার মধ্যে আমি একটা নতুন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি…. প্লীজ কিছু মনে ক’রবেন না। আমার মনে হ’চ্ছে – বাড়ীর কাজের জন্যে আমার একজন কাজের লোক চাই। আপনি কি রাত-দিন কাজ ক’রতে পারবেন এ বাড়ীতে থেকে? আপনার ও আপনার মেয়ের থাকা, খাওয়ার, জামা-কাপড়ের সমস্ত খরচ আমার উপরে; মাঝে মাঝে আমার সুবিধে অনুযায়ী কিছু হাত-খরচও দেবো, কিন্তু তার কোনো গ্যারান্টী নেই।‘

-       ‘এর চাইতে বেশী আর কে দেবে আমাকে? কিন্তু ভয় হচ্ছে – পাড়া-প্রতিবেশীরা কি ব’লবে? এনারা আমাদের দুজনকেই চেনেন; এক বাড়ীতে রাত কাটালে নানা ধরণের গুজব তুলবে; তখন আপনি বাড়ী থেকে বেরোতেই পারবেন না।‘

-       ‘বুঝেছি; এ পাড়ায় বেশী দিন থাকবো না আমরা; কাল থেকেই একটু দূরের কোনো পাড়ায় একটা দু-বেডরুমের ফ্ল্যাট খুঁজবো; কোর্টের ঝামেলাটা মিটে গেলেই আমরা এখান থেকে শিফ্ট ক’রে যাবো।‘

-       ‘অশেষ দয়া আপনার; ধন্যবাদ ছাড়া আর কিছু দেবার সাধ্য নেই আমার।‘

-       ‘সাহস ক’রে আর একটা খবর দিই আপনাকে?’

-       ‘আপনি এত উপকার করার পরে, একটু কথা ব’লতে দ্বিধা ক’রছেন!’

-       ‘দ্বিধা ক’রছি; কারণ এর মধ্যে একটা অনেক বড়ো প্রস্তাব আছে – এদেশ থেকে অনেক দূরে আমার সঙ্গে কানাডায় গিয়ে থাকার প্রস্তাব।‘

-       ‘আপনি কি ব’লছেন, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না!’

-       ‘আপনাকে কখনও বলার সুযোগ হয়নি যে আমি কানাডার হাইকমিশনে দরখাস্ত পাঠিয়েছিলুম – পাকাপাকিভাবে ওখানে গিয়ে থাকার জন্যে।‘

-       ‘আচ্ছা।‘

-       ‘এই সপ্তাহে সেই দরখাস্তের উত্তর এসেছে – কানাডায় থাকার অনুমতি দিয়ে।‘

-       ‘তার মানে কি – আপনি আর বেশী দিন দেশে থাকবেন না; আপনার চলে যাওয়ার আগে আমাকে অন্য কোনো কাজ যোগাড় ক’রতে হবে।‘

-       ‘তার দরকার নাও হ’তে পারে, যদি আপনাকেও আমার সঙ্গে কানাডায় নিয়ে যেতে পারি।‘

-       ‘তার মানে?’

-       ‘অ্যাপ্লিকেশনে আমার নামের সঙ্গে আমার স্ত্রী মন্দিরারও নাম ছিল। তাই আমি আর মন্দিরা দুজনে একসঙ্গে কানাডায় গিয়ে থাকার অনুমতি পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন মন্দিরার সঙ্গে ডিভোর্স হ’য়ে গেছে; ওকে আর নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই আমার প্রস্তাব – আপনি প্লীজ আমার সঙ্গে রেজিস্ট্রী বিয়ে ক’রুন, তারপরে আমি কানাডিয়ান হাইকমিশনে জানাবো যে, আপনি আমার বর্ত্তমান স্ত্রী, তাই আপনাকে সঙ্গে নিয়ে কানাডায় থাকতে চাই।‘

-       ‘আমি বুঝতে পারছিনা, এটা সত্যি না স্বপ্ন। আপনার বাড়ীতে কাজের লোক হিসেবে মেয়েকে নিয়ে থাকাটাই আমি পরম ভাগ্য ব’লে ভাবছিলুম, এ প্রস্তাব তার চাইতে অনেক বেশী আপন ক’রে নেওয়া। একটু জড়িয়ে ধ’রে চুমু খেতে দেবেন আমাকে?’

‘নিশ্চয়ই’ – ব’লে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি, সুভদ্রাকে জড়িয়ে ধ’রে চুমু খেলাম। ব’ললাম, ‘দেখবো, কালই রেজিস্ট্রী ক’রতে পারি কিনা।‘

 

খাবার টেবিল থেকে প্লেটগুলো নিয়ে বেসিনে ধুয়ে দিলাম।

সুভদ্রা ব’ললো, ‘নতুন কাজের লোক বহাল হ’লো; অথচ সাহেব নিজেই সব কাজ ক’রছে।‘ 

আমি ব’ললাম, ‘আমার খাটে কোয়েলের বিছানাটা ক’রে দিন; তার পাশে আপনিও শুয়ে পড়ুন।‘

-       ‘তাহ’লে আপনার বালিশ কোথায়? আপনি কোথায় শোবেন?’

-       ‘আমার বালিশটা সোফায় রেখেছি।‘

-       ‘এখানেই নিয়ে আসুন; অনেক জায়গা আছে; কাল থেকে তো আমরা আইন মেনে স্বামী-স্ত্রী হবো।‘

ঠিক এই সময়েই কোয়েল কেঁদে উঠলো।

সুভদ্রা ব’ললো, ‘ওকে একটু কোলে নিয়ে বারান্দায় ঘুরে আসুন প্লীজ; আমি ঠিক ক’রে বিছানাটা পেতে দিই।‘

আমি কোলে নিতেই কোয়েলের কান্না থেমে গেলো; ওকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে রাস্তা দেখালুম, তারপরে চাঁদ দেখালুম গাছের ফাঁক দিয়ে; খুব খুশী ও, কিন্তু ঘুমোবার ইচ্ছে নেই এতটুকু; তখন একটা গল্প ফেঁদে, ব’লতে শুরু ক’রলাম – খুব আস্তে আস্তে:-  ‘কোয়েল তুমি এখন কোথায়? তাকিয়ে দ্যাখো, আমরা এখন বাড়ীর বারান্দায়।‘

‘বলো তো এটা কি?’ ব’ললাম বারান্দার রেলিং-এর উপর হাত বুলিয়ে; কোয়েল কান্না থামিয়ে দেখলো রেলিংটা; ব’ললো, ‘উঁ’। আমি ব’ললাম, ‘হুঁ, এটা রেলিং; রেলিং-এর ওপাশে তাকাও; দেখছো পাতার ঝালর-দেওয়া একটা গাছ – কী ওটা?’

কোয়েল চুপ, তারপর একটু ভেবে ব’ললো, ‘উঁ’।

আমি ব’ললাম, ‘হুঁ, এটা তালগাছ – একপায়ে দাঁড়িয়ে; বলো তো তালগাছের পাশে ঐ আলোর চাকাটি কি?’

কোয়েলের মুখে হাসি, ও যেন একটা সহজ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে; ব’ললো, ‘আঁ’।

আমি ব’ললাম, ‘হুঁ, এটা চাঁদ; কোয়েলের মতো চাঁদেরও দুধ খাওয়া হ’য়ে গেছে। কোয়েল শুয়েছে লেপ মুড়ি দিয়ে। আর চাঁদ শুয়েছে মেঘ মুড়ি দিয়ে।‘

আমি ব’লতে রইলাম, ‘চাঁদ ব’লেছে – ঘুমোবে, কিন্তু তার আগে গল্পো চাই; কোয়েল ব’লেছে – ওরও গল্পো চাই। এখন কীসের গল্পো?‘

আমি দোলনা থেকে দুটো নরম পুতুল নিয়ে কোয়েলের সামনে ধ’রলুম – একটা বাঘ পুতুল, আর একটা হাতী পুতুল।  

আমি ব’লতে রইলাম, ‘আজকে ব’লবো হাতী আর বাঘের গল্প।…

……..দুপুরে পেট ভ’রে খেয়েছে হাতী; বনের একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ও। ওর লম্বা শুঁড়টা দুলতে রইলো পেণ্ডুলামের মতো এপাশ থেকে ওপাশ – ডিং ডং, ডিং ডং।......

ওদিকে বাঘও বেড়াতে বেরিয়েছে; এসে পড়লো বনের পাশে হাতীর কাছে। হাতীর দোদুল দোলা ঝোলানো শুঁড়টা দেখে ভারী মজা লাগলো বাঘের, ভাবলো শুঁড় ধরে একটু ঝুলে নিই, দুলে নিই। লাফ দিয়ে হাতীর শুঁড়ের ডগাটা কামড়ে ধ’রলো বাঘ, ঝুলতে লাগলো দোদুল-দুল।‘

 

আমার হাতে ধরা কোয়েলকেও দোল খাওয়ালুম - দোদুল-দুল। ঘুম আসছে কোয়েলের, বুজে আসছে চোখ দুটো।  আমি ব’লতে রইলাম, ‘হাতীর ঘুম গেলো ভেঙ্গে, হাতী ক্ষেপে উঠলো রেগে; শুঁড় দিয়ে ধ’রে বাঘকে তুলে ধ’রলো মাথার উপরে; বাঁই-বাঁই করে ঘোরালো তিনবার, ছুঁড়ে দিল বাঘটাকে, শূণ্যে অনেক জোরে, অনেক দূরে।

বাঘটা উড়ে গিয়ে পড়লো একটা পুকুরে। একটা মস্ত কুমীর ছিলো সেই পুকুরে, ওৎ পেতে, হাঁ ক’রে; ঠিক সেই হাঁয়ের মধ্যে গিয়ে পড়লো বাঘটা।

কুমীর সঙ্গে-সঙ্গে বন্ধ ক’রলো তার মুখটা, তার ধারালো দাঁতের চাপে দুখান হ’লো বাঘটা। বাঘের কোমর থেকে দুটো পা-সমেত পেছনের আধখানা রইলো কুমীরের মুখের মধ্যে; মাথা-সমেত বাঘের সামনের আধখানা পুকুরের জলে সাঁতার কাটতে রইলো সামনের দুটো পা দিয়ে, পেছনের আধখানার কথা খেয়ালই নেই বাঘের। বাঘের রক্তে পুকুরের জল উঠলো লাল হ’য়ে।‘

 

বুজে আসছে কোয়েলের চোখ দুটো; তবুও শুনছে মন দিয়ে।

আমি ব’লতে রইলাম, ‘ওদিকে হাতী চলতে শুরু ক’রেছে বাঘকে ছুঁড়ে দেওয়ার পরেই। চলতে চলতে হাতী এসে পড়লো সেই পুকুরের কাছে; দেখলো আধখানা বাঘ জলে সাঁতার কাটছে। বাঘের জন্যে খুব কষ্ট হ’লো হাতীর মনে। ওকে বাঁচাতে চাইলো হাতী। কুমীরকে হুকুম দিলো মুখ হাঁ করার জন্যে।

কুমীর যেই হাঁ ক’রলো, ওর মুখ থেকে বাঘের পেছনের আধখানা তুলে নিজের পিঠে চাপালো হাতী; তারপর জলে ভাসা বাঘের সামনেটাকেও পিঠে তুলে নিলো।

হাতীর পিঠে এখন পুরো বাঘটাই, কিন্তু দু-আধখানা ক’রে ভাগ করা। হাতীর মোটা মাথায় এখন বড়ো চিন্তা – কী ক’রে জোড়া যাবে দুটো আধখানাকে?

হাতী খুঁজতে বেরোলো- কে জুড়তে পারবে বাঘের দুটো আধখানাকে। খুঁজতে খুঁজতে হাতী গেলো বাবুই পাখীর কাছে,- “বাবুই ভায়া, এই দুটো টুকরোকে জুড়ে দাওনা ভাই!”

“ও আমার কম্মো নয়” – ব’ললো বাবুই, - “আমি খড়ের সুতো দিয়ে বাসা বুনি, কিন্তু বাঘ সেলাই ক’রতে পারবো না। বাঘের দু-টুকরো জুড়তে চাই সেলাই মেশিন।“

হাতী আর বাবুই মাথা চুলকে ভেবে মরে – কী ক’রবে তারা? কী ক’রে জুড়বে দুটো আধা বাঘ?

“যাওয়া যাক কোয়েলের বাড়ী।“, - ঠিক ক’রলো তারা।‘

 

কোয়েল এখনও জেগে; জোর ক’রে খুলে রেখেছে চোখ কান। আমিও চালিয়ে গেলাম; ব’লতে রইলাম, ‘বাবুই ব’সলো হাতীর মাথায়। মাঝে মাঝে বাবুই হাতীর মাথা থেকে উঠে উড়ে উড়ে দেখায় কোয়েলের বাড়ীর পথ, আর হাতী যখন ঠিক সোজা পথে চলে তখন আবার মাথায় এসে বসে। বাঘের দুটো আধখানা পিঠে নিয়ে হাতী চললো কোয়েলের বাড়ীর দিকে।

শুঁড় দিয়ে ধাক্কা মারলো হাতী কোয়েলের বাড়ীর দরজায়। কোয়েল দরজা খুলে অবাক। দরজা ভাঙতে হ’লো হাতীকে ঘরে ঢোকানোর জন্যে।

হাতী কোয়েলকে খুলে ব’ললো সব কথা, ব’ললো “বাঘকে বাঁচাও, জুড়ে দাও বাঘের দুটো আধখানা।“

কোয়েলেরও মন গ’ললো, সে একটা সাদা চাদর পেতে দিলো লম্বা টেবিলে, হাতী তার উপর শোয়ালো বাঘের দুটো আধখানাকে।‘

 

একটু থামলাম; দেখি আমার সামনে কোয়েল বাঘ-পুতুলের গায়ে হাত বুলোচ্ছে। ও কি ভাবছে যে বাঘটা তো গোটাই রয়েছে; কেটে আধখানা হয়নি তো? আমি ভাবলাম, বাঘ-পুতুলটা কেটে দুটো আধখানা ক’রে দিই; কিন্তু আধখানা ক’রে কাটলে ভেতরের তুলোগুলো বেরিয়ে আসবে, আর জোড়া দেওয়া যাবে না। অগত্যা একটা রাবার ব্যাণ্ড লাগালুম বাঘের কোমরে, যাতে মনে হয় বাঘটির ঠিক কোমরের কাছে কাটা।    

 

আবার ব’লতে রইলাম, ‘কোয়েলের মা এলো তার সেলাইকল নিয়ে; বাঘের দু টুকরোকে চেপে ধরে সেলাই ক’রে জুড়ে দিলো।

“সেলাই করা বাঘ – এখন কি ঠিকঠাক?”- জিগ্যেস ক’রলো হাতী।

চতুর কোয়েল নিয়ে এলো একটা দুধের বোতল, পুরে দিলো বাঘের মুখে, দেখবে দুধ পড়ে কিনা সেলাইয়ের জোড় থেকে।

সেলাই একদম ঠিকঠাক। বাঘ মন ভ’রে দুধ খেলো বোতলে মুখ দিয়ে। মুখ থেকে গলা দিয়ে দুধ নামলো বাঘের পেটে, একফোঁটাও পড়লো না সেলাইয়ের ফাঁক দিয়ে। বোতলের দুধ শেষ ক’রে ঘুমিয়ে পড়লো বাঘ।

এই সুযোগে কোয়েলও দুধ খেলো, তার চোখজুড়ে এলো ঘুম।

তার পরেই ঘুমিয়ে পড়লো কোয়েলের মা আর বাবা। গল্পের হোলো শেষ।‘

 

আমার খেয়াল হ’লো – কোয়েল অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কতটা বুঝেছে বা কী বুঝেছে জানিনা, কিন্তু শুনছিল খুব মন দিয়ে; যদি সত্যি সত্যি ও আমার নিজের মেয়ে হ’তো।

 

কোয়েলকে কোলে নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম; কোয়েলের কাঁথা, বালিশ, পাশবালিশ পাতা রয়েছে ঠিক খাটের মাঝখানটায়; সাবধানে শুইয়ে দিলাম কোয়েলকে – অচেতন ও ঘুমে; কোয়েলের একপাশে শুয়ে রয়েছে সুভদ্রা; সুভদ্রাও ঘুমে অচেতন। কোয়েলের আর একপাশে আমার বালিশ পাতা; শুতে যাচ্ছিলাম; ভাবলাম – এখন থেকে বিছানায় শুয়ে সিগারেট খাওয়া চলবে না। বারান্দায় গেলাম সিগারেট খেতে – আজকের দিনটা জীবনের সবচেয়ে ঝামেলার দিন – আবার হয়তো সবচেয়ে খুশী হওয়ার দিন।

** ডায়েরীর ছেঁড়া পাতার শেষ **

         

আমাকে লেখা কোয়েলের চিঠিটা পড়া শেষ হ’লো; ভাবলাম – সুভদ্রাকেও জানানো দরকার যে কোয়েল আমার ডায়েরীর ছেঁড়া পাতাগুলো পড়ে ফেলেছে।

*** সমাপ্ত ***

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু