বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

স্বপ্ন

গল্প- স্বপ্ন 

কলমে- সোমা ছবি চক্রবর্তী

(সত্যি ঘটনা)


বেলুড় মঠে গঙ্গার পাড়ে বসে রঞ্জন সৌমিকে বলল- বুঝলে সৌমি,  মেয়েটা চাকরিটা পেলেই আমরা স্বামী- স্ত্রী দুজনেই ভারমুক্ত হয়ে যাব।  তারপর আমরা দুজনে দুজনকেই অনেকটা সময় দিতে পারবো। মেয়ের তো বিয়ে একপ্রকার ঠিক হয়েই আছে। এক বছরের মধ্যেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে বাইরে দেশে- বিদেশে অনেক জায়গায় ঘুরবো চিন্তামুক্ত মন নিয়ে।


 একুশ বছরের মেয়ে পেছন থেকে হঠাৎ বাবাকে উদ্দেশ্য করে ডাকল- বাবা দেখো, এখানে ফুলে ফুলে কি সুন্দর প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে! সৌমি আর রঞ্জনও উড়ন্ত প্রজাপতির ডানা মেলে ওড়া দেখতে উঠে পড়ল। সৌমি বলে উঠল-- মাম্ এবার আমরাও বাড়ির বাগানে অনেক অনেক দেশী বিদেশী গাছ এনে লাগাব। - হ্যাঁ বাবা। আমাদের বাগানটাও খুব সুন্দর হয়ে উঠবে তাহলে -- মেয়ে আনন্দে বলে উঠল। 


বিবাহিত জীবনে সৌমি রঞ্জনকে কোনওদিনই সময় দিতে পারে নি। বাবার বাড়িতে আদরে বড় হওয়া সৌমি শ্বশুর বাড়ির বড় ফ্যামিলিতে সকলের মন যুগিয়ে চলতে চলতে সময় করেই উঠতে পারতো না রঞ্জনের সাথে জমিয়ে কথা বলার। শুধু রাতের বেলায় ঘুমানোর সময় কিছুক্ষণের জন্য সামান্য কিছু দরকারী কথাই হ'ত ।


সৌমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতো, তারা বাইরে বেড়াতে গেছে। অফুরন্ত সময়...। রিসর্টে দু'জনে দু'জনার মুখোমুখি বসে - অনেক কথা বলে চলেছে  , অনেক আদর, ভালবাসা ইত্যাদি আরও অনেক কিছুই মনের আকাশে ছুঁয়ে যেত । রঞ্জনও স্বপ্ন দেখতো, সুন্দর মনোরম জায়গায় শুধু সে আর সৌমি। সৌমি অনর্গল কথা বলে চলেছে আর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। 


  বাস্তব জীবনে সৌমি শুধুই ব্যস্ততার মধ্যেই দিন কাটাত। রঞ্জনের সকালে ঘুম থেকে উঠেই অফিসের ব্যস্ততা, উচ্চপদে দায়িত্বপূর্ণ চাকরি। অবহেলা করলে চলবে না। ছুটির দিনে বাইরের ক্লাব আর বাড়িতে মেয়েকে প্রাইভেট টিউটরের কাছে নিয়ে যাওয়া- এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যেত। এরই মধ্যে জীবনের কিছু সুখ, কিছু আনন্দ খুঁজে নিতে হ'ত ।


ধীরে ধীরে মেয়ে ভিন্ রাজ্যের নামী সংস্থায় চাকরি পেয়ে চলে গেল। সৌমি আর রঞ্জনই মেয়েকে দিয়ে এল  জয়েনিং এর সময় ত্রিবান্দ্রম শহরে। কেরলের রাজধানী। অপূর্ব জায়গা। প্রথম কয়েকদিন কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান ও সমুদ্র ঘোরা হ'ল। কোভালাম বীচ, পদ্মনাভ টেম্পল থেকে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারিকা, বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল পর্যন্ত । বহুদিন খাঁচায় বন্দী পাখির মুক্তি পাওয়ার মতো আনন্দে দু'চোখ মেলে হৃদয় প্রসারিত করে নিঃশ্বাস নিল সৌমি। তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীকার বিস্তৃত ভারত মহাসাগর যেন বাম হাতে আরব সাগর আর ডান হাতে বঙ্গোপসাগরের পিঠে হাত দিয়ে, অসীম, অনন্ত আকাশের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।  সৌমির ইচ্ছে করছিল মেয়েকে নিয়ে বালির ওপরে চাদর বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে অনন্ত আকাশের মহাসাগরের সাথে মিশে যাওয়ার রূপ দেখতে। 


কিন্তু এই প্রথম বাইশ বছরের মেয়ে চাকরীসূত্রে দূরে থাকবে- এই মন খারাপের হৃদয় নিয়ে ভ্রমণটা ঠিক মধুময় হ'ল না। মেয়েকে তার হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে হোটেলের রুমে ফিরতেই মেয়ের জন্য মন খারাপ করতে লাগল। রঞ্জন সৌমির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, দুঃখ কোর না। আমরা এবার নিজের মতো করে বাঁচব। 


ফেরার সময় ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় দু'জনেই জানালার ধারে চা খেতে খেতে দু'জনের দিকে তাকিয়েই হেসে ফেলল। রঞ্জন বলল- দেখো সৌমি, এবার তুমি আমাকে পর্যাপ্ত সময় দেবে আর আমিও তোমাকে। বাড়ির সামনের বাগানটা আমরা আরও সুন্দর করে সাজাবো। 


রাতে লোয়ার বার্থে শুয়ে সৌমি স্বপ্ন দেখছিল- বাড়ির সামনের বাগানে ডালিয়া, গোলাপ, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা থরে থরে লাইন করে ফুটে রয়েছে। সেখানে দুজনে দুটো চেয়ার পেতে চা খেতে খেতে গল্প করে চলেছে। আর রঞ্জন হা হা করে হাসছে...। খাবারের অর্ডার নিতে এসে রেলের ক্যান্টিনবয় স্বপ্নটা ভাঙিয়ে দিল। ক্যান্টিন বয়ের ওপরে বেশ বিরক্ত হল সৌমি এমন সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে গেল বলে ...।


বাড়ি ফিরে সৌমি, রঞ্জন অফিস থেকে বাড়িতে ফিরলেই ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এখন। বিকেলে মাঝে মাঝেই দু'জনে মিলে শপিং মলে যায়।  ছুটির দিনগুলোতে সময় নিয়ে  দু''জনে মিলে অনেক ফুল গাছ লাগিয়েছে। ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ , দোলন চাঁপা আরও অনেক গাছ। 


একমাস পরে মেয়ে স্যালারি পেয়ে বাবা, মা'র জন্য দামী গিফট্ পাঠাল আর মায়ের হাত খরচের জন্যও টাকা পাঠাল। সৌমির চেয়েও রঞ্জন সন্তানের গিফট্ পেয়ে আনন্দে অভিভূত হয়ে গেল। রাতে সৌমিকে অনেক আদর করে বলল- আজ আমাদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন সফল হয়েছে...। মেয়ে জন্মানোর পরে পুত্র সন্তান হয় নি বলে বাড়ির সকলেই তোমাকে অনেক তাচ্ছিল্য করত। সে'সব দিনের কথা আমার সবই মনে আছে। সৌমি বলে-- থাক্ ওসব কথা। এবার ঘুমিয়ে পড়ো। 


এরপর ঠিক দু'সপ্তাহ পর একদিন বিকেলবেলা বাগান থেকে ড্রয়িং রুমে ঢোকার সময় রঞ্জন মেঝেতে পড়ে গেল। পাশের ঘরে সৌমি তখন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিল- কেরলের কোভালাম বীচ এ রঞ্জনের সাথে ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎই রঞ্জন বালির ওপরে পড়ে গিয়ে গোঙাতে লাগল। চমকে ঘুমটা ভেঙে যেতেই সৌমি দেখল-  স্বপ্ন তো নয়!! সত্যিই তো রঞ্জন পাশের ঘরে গোঙাচ্ছে!!! 


সৌমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে দেখল মেঝেতে পড়ে  আছে রঞ্জন।  সেরিব্রাল অ্যাটাক।  সঙ্গে সঙ্গেই একাকী সৌমি রঞ্জনকে নিয়ে ছুটল কলকাতার নামীদামী হসপিটালের খোঁজে। আত্মীয়দের খবর  দেওয়া,  প্রতিবেশীদের সাথে  আলোচনা, সবা চেষ্টাই করল। এরপর কলকাতার নামী নার্সিংহোমে ছোটাছুটি- একুশ দিনে সৌমির জীবনের সব স্বপ্নই শেষ হয়ে গেল।... 

চোখের জলে বিছানার চাদর ভেসে যায় সৌমির। সেই চোখের জলে জীবনের লাল, নীল, হলদে, সবুজ বিভিন্ন রঙগুলোও ধুয়ে যায়। থাকে নোনা স্বাদের রঙহীন  স্বচ্ছ জল  , শুধুই জল। মহাসাগরের প্রচণ্ড ঢেউগুলো তখন সৌমির হৃদয়ের ভেতরে উথাল, পাথাল করতে থাকে। রঞ্জন কোনদিনই ওকে কোনও বাইরের কাজ করতে দেয় নি। কিভাবে ও বাঁচবে ! কি করবে বুঝতে পারে না। 


এখন রাতে সৌমির স্বপ্নে রঞ্জন এসে করুণ চোখে সৌমির মনকে ছুঁয়ে যায় রোজই-- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত,বসন্ত সব ঋতুতেই...।


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু