বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মানিক উপাখ্যান

ডাকাবুকো একখান ছেলে। কুস্তি লড়তেন একসময়। তারপর নিজের বর্তমানের সঙ্গে অতীতকে মেলাতে চেষ্টা করতেন। বহুবার, অনেকবার। তার চিন্তাভাবনা যতদূর অতীতে যায়, নিয়ে যেতেন। মনে পড়ত কিছু, কিছু মনে পড়ত না। সেই স্মৃতিগুলোকে এক গ্লাসে ঢেলে বর্তমানটাকে সেখানে মেশানোর আপ্রান চেষ্টা করতেন। সে পাঁকে পুঁতে মৃত্যু সামনে থেকে দেখা হোক অথবা খাটের নিচে নরুন দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটাই হোক।


কলেজে পড়াকালীন বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। তার পাশাপাশি চলছিল সাহিত্য চর্চা। যে সে সাহিত্য চর্চা নয়, একেবারে মন প্রান দিয়ে ডুবে গিয়েছিলেন সাহিত্যের মধ্যে। ফলস্বরুপ পরপর দু-বার ফেল। বড়দা রেগে গেলেন। চিঠি লিখে জানালেন তিনি আর টাকা পাঠাতে পারবেন না। কালোমানিক উত্তরে থেকে লিখলেন “আপনি দেখে নেবেন, কালে কালে লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমার নাম ঘোষিত হবে।’’ নিজের উপর, নিজের স্বপ্নের উপর ঠিক কতটা বিশ্বাস থাকলে মানুষ এই কথাটি বলতে পারে?


“পদ্মা নদীর মাঝি” “পুতুলনাচের ইতিকথা” যাঁর কলমের ডগা থেকে বেরিয়েছিল, যিনি একদিন দাদাকে গর্ব করে বলেছিলেন সে রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র বাবুর মত বড় সাহিত্যিক হবেন। তিনি একদিন বললেন ‘‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’’ এবার ভাবুন একজন লেখক কতটা ক্ষত-বিক্ষত হলে তবে এই কথা বলতে পারেন। আমাদের ভাবনার বাইরে সে-সব।


যিনি এত কালজয়ী সৃষ্টি আমাদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন তাঁর প্রথম সন্তান যখন মারা গেল। তখন তাঁর স্ত্রী কমলা দেবী হাসছেন। একচোখ জল নিয়েও তিনি হাসছেন। আর কালোমানিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। মানিক বাবু নিজের ডাইরিতে লিখলেন ‘‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।’’  একজন মায়ের জন্য তাঁর সন্তান মারা যাওয়ার পর মুখে হাসি রাখার মানে হয়ত আমরা আজ বুঝি, কিন্তু সেইদিন কেউ বুঝিনি।


মধ্য জীবন থেকেই মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। আর সেই রোগ ভুলতেই নাকি অবাধে চলত মদ্যপান। কিন্তু শুধু কি রোগ ভুলতে? নাকি, এই জং ধরা, পচা-গলা সমাজটার মরে যাওয়া এক অবয়ব আপন চোখে সয্য করতে পারতেন না তিনি। জানিনা, আজও সেই পচা-গলা সমাজেই বাস করছি আমরা। যেখানে এখনও কিছু প্রকাশক একজন লেখকের লেখা থেকে নয়, মুখ দেখে লেখা ছাপেন।


যাই হোক, সেই কথা বলতে এই লেখা নয় যদিও। তিনি প্রবোধকুমার বন্দোপাধায় ওরফে কালোমানিক আর আমাদের কাছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সালটা ১৯৫৬। ২ ডিসেম্বর নীলরতন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বর্তমানের সেই মানিককে। পাশে একমাত্র স্ত্রী কমলা, তাঁর ভালোবাসার ডলি। সবথেকে মর্মান্তিক ব্যাপার হল যখন একজন লেখক মানিক বাবুকে দেখতে এসে স্ত্রীকে বললেন “ বৌদি যখন এমন অবস্থা তখন আমায় খবর দেননি কেন?”


ডলি দেবী হেসে বলেছিলেন “তাতেও পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই, সেটাই নাই”।


একজন লেখকের অসুস্থতার খবর দেওয়ার জন্য তাঁর স্ত্রীর কাছে ফোন করার টাকা নেই। সেই অসহায়তা আমাদের মাথার উপর দিয়ে যাবে হয়ত।


৩ ডিসেম্বর মারা গেলেন ৪৮ বছরের শুকনো, কয়েকটা হাড়-পাঁজরের উপর মাংসের একটা আস্তরণ দেওয়া, পেটে কাটা মানুষটা। সময়ের পাঁকে, নেশার তীরে, আর মানুষের অবহেলায় একজন লেখকের সমাপ্তি ঘটল। সেইদিন নাকি ফুলে ফুলে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল তাঁর নিথর দেহ। ভাবলেও হাসি পায়, মানুষটা বেঁচে থাকতে তাকে সম্মান দেওয়া হলনা, মরে যেতে তাকে ফুলে ঢেকে দেওয়া হল।


সেইদিন তাঁর এক বন্ধু লিখলেন “সামনে পিছনে, দুইপাশে বহু মানুষ। সর্বস্তরের মানুষ। মোড়ে মোড়ে ভিড়। সিটি কলেজের সামনে মাথার অরণ্য। কিন্তু কাল কেউ ছিল না, কিছু ছিল না...জীবনে এত ফুলও তিনি পাননি।’’


আজ তাঁর মৃত্যুদিনে তাঁকে অন্তরের শ্রদ্ধা।


তথ্য: আনন্দবাজার, ইন্টারনেট

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু