বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বিদেশিনীর সান্নিধ্যের সীমারেখা

আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী!
তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী!

দেখেছি শারদপ্রাতে তোমায়,
দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে,
ওগো বিদেশিনী!

আমি আকাশে পাতিয়া কান
শুনেছি শুনেছি তোমারি গান;
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ, ওগো বিদেশিনী!

ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে;

আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ, ওগো বিদেশিনী!

 

রবীন্দ্রনাথের গানটির সংক্ষেপায়ন ও গদ্যকবিতায় রূপান্তর করার জন্যে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

এই কবিতাটি পড়ে পাঠকের মনেও স্বভাবতঃই কামনা জাগবে বিদেশিনীকে কাছে পাবার, বা বিদেশিনীর অতিথি হওয়ার। কিন্তু, কে এই বিদেশিনী? এ বিদেশিনী কি শুধুই কল্পনা না কি কোনো পুতুল? না কি জীবন্ত রক্ত-মাংসের এক নারী? সে নারী কি কুমারী? অথবা বিবাহিতা? অথবা বিধবা? অথবা বিবাহ-বিচ্ছিন্না? কিভাবে কোন মায়া জাগাবে বিদেশিনীর সঙ্গ, সান্নিধ্য, কথোপকথন? বিদেশিনীর কি আছে কোনো বিশেষ আকর্ষণ যা তাকে স্বদেশিনীর তুলনায় অনেক বেশী লোভনীয়া ক’রে তোলে। এক বাঙালী সাহিত্যিকের অভিমত:- বাঙালী পুরুষের মতে বাঙালী মহিলার মধ্যে পাওয়া যায় রোজকার ডাল-ভাতের স্বাদ; অবাঙালী মহিলার সান্নিধ্যে পাওয় যায় বিরিয়ানী আর মুর্গমসল্লম খাওয়ার আনন্দ। এই অভিমতের পরে পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে; এখন এটাও সত্যি: বাঙালী মহিলার মতে বাঙালী পুরুষের মধ্যে পাওয়া যায় রোজকার ডাল-ভাতের স্বাদ; অবাঙালী পুরুষের সান্নিধ্যে পাওয় যায় বিরিয়ানী আর মুর্গমসল্লম খাওয়ার আহ্লাদ।

একটু আগেই বলছিলাম যে, বিদেশিনীর সান্নিধ্য পাওয়ার দুটি উপায়: ১) বিদেশিনীদের এদেশে আনা ২) বিদেশে বিদেশিনীদের সান্নিধ্য পাওয়া।

১) বিদেশিনীদের এদেশে আনা - এদেশে এমন কোনো সুযোগের ব্যবস্থা করা, যে সুযোগ নেবার জন্যে বিদেশিনীরা স্বেচ্ছায় আসবে এদেশে। এরকম একটি সুযোগ সহজলভ্য ভারতবর্ষের এক প্রান্তে – প্রেগন্যান্সী ট্যুরিজম্ বা অন্তঃসত্ত্বা হবার জন্যে পর্য্যটন। এখানে সুন্দর ও রূপবান ব্রোকপাস পুরুষরা বিদেশ থেকে আগত মহিলাদের গর্ভবতী করে। এই পরিষেবার জন্য ব্রোকপাস পুরুষরা বিদেশিনীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের দক্ষিণা নেয়। এই পরিষেবাই প্রেগন্যান্সী ট্যুরিজম্ পর্যটন শিল্প।

২) বিদেশে বিদেশিনীদের সান্নিধ্য পাওয়া - এমন কোনো দেশ যেখানে বিদেশী বা বিদেশিনীর সঙ্গে সহবাস করা এতদিন আইনসম্মত ছিল; উদাহরণ ইন্দোনেশিয়ার শহর ‘বালী’। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া সরকার 'বালি বঙ্ক ব্যান' আইন পাস করেছে, যা তিন বছর পরে জারী হবে। এই আইন অনুযায়ী, বিবাহের সম্পর্ক ব্যতীত যৌন ক্রিয়াকলাপ নিষিদ্ধ। কাজেই, বালীতে বিদেশী বা বিদেশিনীর সঙ্গে সহবাস অবৈধ অপরাধ হবে, এই আইন জারী হওয়ার পর থেকে।      


১) বিদেশিনীদের এদেশে আনা -  প্রেগন্যান্সি ট্যুরিজম বিদেশিনীদের লেহতে ডেকে আনে

বিভিন্ন ধরনের পর্যটন সম্পর্কে গল্প শোনা যায়। কিন্তু প্রেগন্যান্সি ট্যুরিজম বা ‘গর্ভবতী হওয়ার জন্যে ভ্রমণ’এর কথা সাধারণতঃ শোনা যায় না। কিন্তু ভারতের কিছু অংশে প্রেগন্যান্সি ট্যুরিজম ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বৃহত্তম শহর লেহ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চারটি গ্রাম ধা, হনু, গারকন এবং দারচিক গর্ভবতী হওয়ার উদ্দেশ্যে পর্যটনের জন্য বিদেশ থেকে নারী পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
এই গ্রামগুলিতে থাকে ব্রোকপাসের মানুষেরা, যারা আর্য জাতির সবচেয়ে বিশুদ্ধ নমুনা, সেই কারণে সুন্দর ও রূপবান।
 
এটা বিশ্বাস করা হয় যে, গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের অধীনে যারা  কাজ করেছিল ব্রোকপাসের মানুষেরা সেই সেনাবাহিনীর বংশধর। এরা প্রায় ২,০০০ বছর আগে লেহ অঞ্চলে ফিরে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
জার্মান নারীরা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে, তারা ব্রোকপাস দ্বারা গর্ভবতী হওয়ার জন্য লেহ পর্য্যটন করে, কারণ প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ব্রোকপাসরা আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর উত্তরাধিকারী।
প্রথমদিকে, ব্রোকপাস পুরুষরা বিদেশ থেকে আসা মহিলাদের গর্ভবতী ক’রতো। পরে তারা তাদের পরিষেবার জন্য তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া শুরু করে যা একটি ছোট আকারের পর্যটন শিল্প শুরু করে।
ব্রোকপাস পুরুষদের ঔরসে গর্ভধারণের জন্য বিদেশিনীরা লেহে আসতে শুরু করে। ব্রোকপাস উপজাতির জনসংখ্যা সারা বিশ্বে মাত্র ৪০০০ এবং শুধুমাত্র লেহ অঞ্চলেই ১৯০০ জনসংখ্যা রয়েছে।
ব্রোকপাস পুরুষদের সঙ্গে বিদেশিনীদের যৌন ক্রিয়াকলাপ সম্ভবতঃ পুরুষদের বা বিদেশিনীদের কারুর দেশেই আইনসঙ্গত নয়, এবং সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী নয়।  
 
২) বিদেশে বিদেশিনীদের সান্নিধ্য পাওয়া -  'বালি বঙ্ক ব্যান'এর জন্যে কি বালিতে বিদেশিনীদের সান্নিধ্য নিয়ে পর্য্যটকদের কি চিন্তিত হওয়া উচিত?
ডিসেম্বর-২০২২ এর দ্বিতীয় সপ্তাহে, ইন্দোনেশিয়া সরকার একটি নতুন বিতর্কিত আইন পাস করেছে, যা ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক এবং বিদেশ থেকে আসা পর্য্যটক উভয়ের জন্যেই প্রযোজ্য। এই আইন অনুযায়ী, (১) বিবাহের সম্পর্ক ব্যতীত যৌন ক্রিয়াকলাপ নিষিদ্ধ, (২) অবিবাহিত দম্পতিদের একত্রে বসবাস নিষিদ্ধ, (৩) মহিলাদের গর্ভপাত করানো দণ্ডনীয় অপরাধ এবং (৪) রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতায় কিছু বিধিনিষেধ থাকবে।
এই নতুন আইনগুলি ইন্দোনেশিয়ার পর্যটনকে প্রভাবিত ক’রবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যে বিদেশী পর্যটকেরা বালি বা ইন্দোনেশিয়ার অন্য কোনো অংশে ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা ক’রেছে, তারা উদ্বিগ্ন হ’য়ে পড়ছে।
৭ই ডিসেম্বর, ২০২২ সকালে এবিসি রেডিওতে কথা বলার সময়, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এমেরিটাস প্রফেসর গ্রেগ ফিলি বলেছেন যে পর্য্যটকরা প্রভাবিত হবে এমন সম্ভাবনা কম, কিন্তু অসম্ভব নয়।

প্রফেসর ফিলি বলেছেন, ‘বালির মতো জায়গায়, পুলিশ পর্য্যটকদের ভয় দেখাতে আগ্রহী হবে না। বাস্তবে, এই আইনের প্রধান লক্ষ্য হল ইন্দোনেশিয়ান নাগরিকেরা।‘

যাইহোক, আইনের ধারাগুলির বিভিন্ন ব্যাখ্যা সম্ভব; পরিস্থিতি অনুযায়ী আইনের অর্থ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পাবে পুলিশ। যেমন, রাষ্ট্রপতি বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে অপমান করার ব্যাপারে- আসলে অপমান কী, সেটা নির্দিষ্ট করা নেই। প্যানকাসিলার জাতীয় মতাদর্শের বিপরীতে চলে এমন কোনো মতাদর্শের বিরুদ্ধেও বিধান রয়েছে।

[প্যানকাসিলা হল ইন্দোনেশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা, যা পাঁচটি নীতির সমন্বয়ে গঠিত: একেশ্বরবাদ, সভ্য মানবতা, জাতীয় ঐক্য, সংকল্প।]

ইন্দোনেশিয়াবাসীদের সমাজ মূলতঃ রক্ষণশীল; তাই ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতির ব্যাপক প্রবণতা অনুসারে সরকার একতরফাভাবে এই আইনটি পাস করেছে।

সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় ইন্দোনেশিয়াবাসীদের জিজ্ঞাসা করা হয় - তারা কীসের মধ্যে নৈতিক সমস্যার সম্ভাবনা দেখছে; উত্তরে ইন্দোনেশিয়াবাসীরা LGBTQI+ আচরণ এবং বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে বিশেষ উদ্বেগ দেখিয়েছে৷ এই সমীক্ষায় জনমত - ইন্দোনেশিয়ায় যৌন সংখ্যালঘুরা সমাজের শত্রু। এই জনমতই প্রতিফলিত হ’য়েছে এই আইনে।

যৌন ক্রিয়াকলাপে প্ররোচিত করার অভিযোগ পর্য্যটকরা নিজের দেশের দূতাবাসে জানাবে কিনা তা সম্ভবতঃ আইনের বাস্তবায়নের উপর নির্ভর ক’রবে, যা কয়েক বছর পরে ঘটবে।

আশা করা যায় যে, ইন্দোনেশিয়া সরকার পর্য্যটকদের জন্যে এই আইন প্রয়োগ করার সময় বিচক্ষণতা ব্যবহার ক’রবে।

তাই পর্য্যটকদের উচিত অন্য সব দেশের মতো ইন্দোনেশিয়ারও স্থানীয় আইন সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং পর্য্যটকদের মতামত নির্বিশেষে স্থানীয় অধিবাসীদের এবং তাদের মূল্যবোধকে সম্মান দেওয়া।

 

বিদেশী বা বিদেশিনীর দৈহিক সান্নিধ্যের আগে সংশ্লিষ্ট মানুষদের সচেতন থাকতে হবে, শুধু সংশ্লিষ্ট দেশগুলির আইনের বাধা-নিষেধের ব্যাপারে নয়, নর-নারীর সমান অধিকার এবং মানবিকতার ব্যাপারেও।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু