বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মায়াবী রাতের হাতছানি

দুর্গাপুজো  শেষ হবার পরই  বাঙালির ঘুরতে  যাওয়াটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, আর তাই আমিও তার অন্যথা না করে যথারীতি একাদশীর দিন কু-ঝিকঝিক শব্দে বেরিয়ে পড়ি শহর থেকে দূরে বহু পরিচিত কিন্তু তবু অচেনা পাহাড়ের মায়াবী হাতছানির ডাকে সাড়া দিতে। শহুরে যানজটের বাইরে কটা দিন একটু নিরিবিলিতে কাটাতে পৌঁছে গেলাম এক জংলি সৌন্দর্য্য আবৃত পাহাড়ি কটেজে, শহর থেকে দূরে এই পাহাড়ি কটেজে বোধ করি চিরশান্তি বিরাজমান। তাই সেই আশা নিয়ে ব্যাগ পত্র নির্ধারিত রুমে রেখে ফ্রেশ হয়ে লাগোয়া বারান্দায় এসে বসি পাহাড়ি হাওয়ার খবরাখবর নিতে। পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায় আর সেই পড়ন্ত গোধূলি লগ্নে লাল সূর্যের আভায় আমার ভীষণ প্রিয় পাহাড় যেন সেজে ওঠে নববধূর সাজে। বেয়ারা ট্রেতে চা আর ভাজাভুজি রেখে রাতের খাবারের অর্ডার তখনই নিয়ে চলে যায়। পাহাড়ের কোলে দিবালোক সুন্দর সুখী মুহূর্তের মত, স্বল্প স্থায়ী আর তাই সন্ধ্যা রানীর আগমন হয় খুব তাড়াতাড়ি। যদিও চা আমার তেমন পছন্দের নয়, তবু এই পরিবেশে পাহাড়ের সাথে এরূপ মনোরম আড্ডায় সেটা ছাড়া ঠিক জমেও না। তাই সেটা উপলব্ধি করেই সেই গরম পানীয় গলাধঃকরণ করতে করতে হারিয়ে যাই পাহাড়ের মনোরম পরিবেশে, অপলক চাহনিতে চেয়ে থাকি তার এই অপরূপ রূপমাধুরীর দিকে। চলতে থাকে রং-বেরঙের খেলা প্রকৃতি আর আকাশের মাঝে, আর তাদের মাঝেই ধ্যানমগ্ন সাধকের ন্যায় ধীর অথচ দৃঢ়  দাঁড়িয়ে আছে আমার ভালোবাসার পাহাড়ের চূড়া।আঁধার ঘন হবার সাথে সাথেই এক বিশালাকার  ঘুমন্ত জন্তুর ন্যায় রূপ ধারণ করে আমার সেই অতি পরিচিত পাহাড় আর আকাশের তারারা যেন নেমে আসে তার বুকে, ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠে পাহাড়ি রাস্তা-ঘরের আলো গুলো ঠিক যেন মরীচিকার মত।আমার আর পাহাড়ের অপূর্ণ নির্বাক প্রেম নিবেদন চলতে থাকে এইভাবে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন থেকে ভেসে আসে এক কণ্ঠস্বর "মেম সাব" আর তার সাথেই সেই অভূতপূর্ব অনুভূতির ছন্দপতন ঘটে। তাই খানিকটা বিরক্তির সাথেই জবাব দিই  "হাঁ ঠিক হ্যায়,অন্দর রাখ দিজিয়ে"  ভাবি বুঝি রাতের খাবার দিয়ে গেল। আর তারপরেই আবার হারিয়ে যাই সেই অবর্ণনীয় পাহাড়ি অনুভূতিতে। জানিনা ঠিক কতক্ষণ পরে হঠাৎ সম্বিত ফিরে পাই আবারো সেই একই কণ্ঠস্বরে, "মেমসাব", এবার পিছন ফিরে তাকাই,  কিন্তু একি! বুকের ভেতরটা এক পলক কেঁপে ওঠে। নিকষ কালো আঁধারকেও কালো চাদরে ঢেকে দিয়ে দরজার কোণে দাঁড়িয়ে একটি  ছোট ছেলের ছায়া মূর্তি। ঠিক ঠাওর করতে না পারলেও এটুকু বুঝতে পারি তার পরনে একখানি প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই নেই বিশেষ। নিজেকে একটু  সামলে নিয়ে  তাকে জিজ্ঞাসা করি "কউন হো তুম"? কিন্তু কোন উত্তর আসে না  বরং সেই প্রশ্ন পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে আমারই কাছে।এবার একটু অদ্ভুত লাগতে শুরু করে, আরো কিছু জিজ্ঞাসা করব ভাবছি এমন সময় হঠাৎই সেই কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, "মেমসাব হামারা বাবা কাহা হ্যায়?" সেই প্রশ্নে খানিকটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ি, নিজেকে বোঝাই যে হয়তো এই কটেজের অন্য কোন পর্যটক পরিবারের ছেলে সে, তাই এবার একটু মমত্ব ভরা গলায় জিজ্ঞাসা করি  "কে তোমার বাবা? কি নাম? আমি তো ঠিক জানিনা,তবে জেনে রিসেপশন থেকে তোমাকে বলে দিতে পারি। " সেই আঁধারের ছায়া মূর্তি আবারও জিজ্ঞাসা করে," মেমসাব হামারা বাবা কাহা হ্যায়"? তবে এবার সেই কণ্ঠস্বর জোরালো নয় বটে কিন্তু  দৃঢ়  আর কেমন যেন খ্যান খ্যানে। আর সেই কণ্ঠস্বরে আশেপাশের পরিবেশ কেমন যেন গা -  ছমছমে হয়ে ওঠে।  শিরায় বহমান শোণিতধারা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে যায়। সে আবারও প্রশ্ন করে, "মেরা বাবা কাহা হ্যায়?" আমি বলি আমি জানিনা তবে জেনে বলতে পারি  আর ঠিক তখনই এক হৃদয় বিদারী চিৎকারে সেই ছায়া মূর্তি ছেলেটি বলে ওঠে "সব ঝুটা সব ঝুটা" আর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই ছায়ামূর্তি হাওয়ার বেগে কটেজের পাশের পাহাড়ি রাস্তায় গিয়ে পড়ে আর সেখান থেকে ছুটতে থাকে পাশের খাদের দিকে। আমি পাগলের মতো ছুটে যাই,চিৎকার করে বলি "যেও না ওদিকে যেওনা, ও যে খাদের পথ ওদিকে মৃত্যু তার থাবা মেলে বসে আছে কি জানি কার প্রতীক্ষায়" কিন্তু সে থামেনি শুধু একবার পিছু ফিরে বলেছিল "সব ঝুটা সব  ঝুটা" আর তারপরই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল খাদে। তাকে বাঁচাতে সেদিন হয়তো আমি পড়েই যেতাম যদি না দু খানা হাত পেছন থেকে আমাকে আটকাতো। চমকে গিয়ে পিছন ফিরে দেখি এ তো সেই বেয়ারা ছেলেটা, তাকে চিৎকার করে বলি "ওকে বাঁচাও! ওকে বাঁচাও! ও যে আসন্ন মৃত্যু মুখী" বেয়ারা ছেলেটি আমাকে বলল,"কেয়া হুয়া ম্যাডাম" আর তারপরই আমি লুটিয়ে পড়ি মাটিতে। জ্ঞান যখন আসে তখন দেখি আমি কটেজের ম্যানেজার বাবুর ঘরের বিছানায় শুয়ে আর পাশে দাঁড়ানো ম্যানেজার বাবু আর সেই বেয়ারা ছেলেটি। আমি উঠতে চেষ্টা করলে ম্যানেজার বলেন, "ম্যাডাম উঠিয়ে মৎ, " আমি একটু ইতস্তত বোধ করি, বলি "আমি খুবই লজ্জিত" তা শুনে ম্যানেজার বাবু  আধা বাংলা আধা হিন্দি মিশিয়ে বলেন "কই নেহি, এখন কেমন আছেন ম্যাডাম?" আমি বলি "ভালো, কিন্তু ওই ছেলেটি! ও কেমন আছে? বেঁচে আছে তো?" কেউ কোন কথার উত্তর দেয় না শুধু বলে "ম্যাডাম  আপ রেস্ট কিজিয়ে কিছু লাগলে ডাকবেন হামলোগ বাহার হি হ্যায়" তারা চলে যায় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে।ঘুমোনোর বহু চেষ্টা করেও দু চোখের পাতা এক করতে পারিনা। শুধু মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে সেই শিশু ছায়া মূর্তি। হঠাৎ কেমন যেন এক অপান্তেও নিস্তব্ধতা গ্রাস করে গোটা ঘরটাকে। অনুভব করতে পারি, আমার মাথার  শিয়রে কারো উপস্থিতি, গোটা শরীরটা  কেমন যেন অসাড়, হাত-পা কিছুই নাড়াতে পারছি না, কণ্ঠস্বর স্তব্ধ, অনেক চেষ্টা করছি বাইরে থাকা ওদের ডাকি, কিন্তু কারো অদৃশ্য খাবা যেন গলার নলি টা বদ্ধ করে দিচ্ছে, শুধু অনুভব করতে পারছি সারা শরীরটা ঘামে ভিজে গেছে আর ঘাড়ের কাছে কারো ঠান্ডা নিঃশ্বাস প্রশ্বাস পড়ছে আর ফিসফিস করে কেউ যেন কান্না জড়ানো আবছা স্বরে বলছে "সব ঝুটা সব ঝুটা"। কতক্ষণ ঠিক বলতে পারবো না কিন্তু হঠাৎ সেই বেয়ারা ছেলেটি দরজা খুলে ভেতরে আসতেই যেন অসার শরীরে প্রাণের সঞ্চার হলো, ফিরে পেলাম বাকশক্তি। তখনই প্রাণ পনে চিৎকার করে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম "সত্যি করে বলো কে ওই ছেলে? বলো নাহলে আমি পুলিশ ডাকবো কি রহস্য লুকিয়ে রাখছো তোমরা?" সেই চেঁচামেচিতে ম্যানেজারও ঘরে ঢুকে আসেন এবং তখন তাকেও ঠিক একইভাবে কর্কশ গলায় সেই একই প্রশ্ন করার পর জানতে পারি, সেই শিশু ছায়ামূর্তি ছেলেটির নাম বিজয় আর তার বাবার নাম মহেন্দ্র। মহেন্দ্র এই কটেজেই একসময় বেয়ারার কাজ করতো। এক অভিশপ্ত রাতে নেশার ঘোরে ঘর যাবার পথে পা পিছলে পড়ে যায় খাদে। দুদিন পরে লাশ মেলে তার। বিজয় তার বাবা ছাড়া এ পৃথিবীতে একমাত্র শুধু পাহাড়কেই নিজের বলে জেনেছে আর তাই বাবা চলে যাবার পরে নিষ্পাপ সেই শিশু জনে জনে জিজ্ঞেস করেছে তার বাবার হদিশ আর সবাই বলেছে জানিনা জেনে জানাবো আর সেই আশা বুকে নিয়ে ছোট্ট সেই প্রাণ দিনের পর দিন বসে থেকেছে এই কটেজের গেটে। একদিন ঠিক এমনি করে বাবাকে খুঁজতে এসে না পেয়ে মলিন মুখে রওনা হয় ঘরের পথে।  সে রাত ছিল ঝড় জলের রাত, ম্যানেজার বাবু বলে চলেন,  অনেক মানা করেছিলাম ম্যাডাম, কিন্তু বলল,"নেহি সাব,বাবা আগর চলে আসবে তো আমায় দেখতে না পেয়ে চিন্তা করবে আর বেরিয়ে গেল কটেজ থেকে"। ঠিক তারপরেই এক গোলমালের শব্দে কটেজের সকলে ছুটে গিয়ে জানতে পেল একটা গাড়ির ধাক্কায় ছোট একটা ছেলে পড়ে গেছে খাদের গহিন গর্তে। ম্যানেজার আরো কত কিছু বলে চলেন কিন্তু আমি যেন আর কিছুই শুনতে পাই না, সব শব্দ কেমন আবছা হয়ে আসে। বাইরে অঝোরে বৃষ্টির শব্দ ভেসে আসে আর সেই শব্দের সাথেই ভেসে আসে আবছা কন্ঠস্বর,  "মেমসাব মেরা বাবা কাহা হ্যায়"?  ম্যানেজার বলেন "শোনা যায় পুলিশ নাকি সেই গাড়ির চালককে কোন শাস্তি দেয়নি কারণ সেই গাড়িটি ছিল কোন এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের আর বিজয়, সে তো কেবলি এক পাহাড়ি রাস্তার চঞ্চল পাহাড়ি অনাথ। সমস্ত ভয় দুশ্চিন্তা এক নিমিষে কেমন যেন মমতার চাদরে ঢাকা পড়ে গেল। রাত্রির কালো আঁধার কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটেছে, বৃষ্টিও থেমে গেছে। বাইরে পাহাড়! আমার ভালবাসার পাহাড় আজ নতুন সবুজ সতেজ সাজে সজ্জিত, ঘন কুয়াশার ওড়না উড়িয়েছে চতুর্দিকে আর সেই মায়াবী হাতছানি যেন উপেক্ষা করার সাধ্য কারো নয়। কিন্তু আজ আমি চলে যাব, চলে যাব আমার ভালোবাসার  পাহাড়ের অলৌকিক হাতছানি উপেক্ষা করে। চলে যাব বিজয়ের জন্য। তৈরি হয়ে বিল মিটিয়ে নিচে গাড়িতে গিয়ে বসলাম মালপত্র আগেই বেয়ারা গাড়িতে তুলে দিয়েছিল। গাড়ির দরজা বন্ধ করছি এমন সময় সেই বেয়ারা ছেলেটি বলল "ম্যাডাম ফির মিলেঙ্গে" আমি একটা স্মীত হাসি দিয়ে তার হাতে সাধ্যমত কিছু টিপস দিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করলাম। ম্যানেজার বাবু তখন অন্য আগত পর্যটকদের সামলাতে ব্যস্ত। গাড়ি চলতে শুরু করল, মনে মনে বললাম," পৃথিবীর কোন কোণে হয়তোবা কিন্তু এখানে আর নয়"। বিজয়, মহেন্দ্র, খাদ, প্রশ্ন, উত্তর, ভয়, মমত্ত সবকিছু  মিলেমিশে একাকার আজ। এই সব কিছু পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি নিজের গন্তব্যের দিকে, গাড়ির জানালায় মাথাটা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে  আনমনে বললাম,সেদিন বোধ করি, মহেন্দ্রর স্নেহের হাতছানি নিয়তি কে বাধ্য করেছিল বিজয়কে এই মায়াবী রাতের মোহ মায়া থেকে মুক্ত করে তার বাবার কোলে পাঠিয়ে দিতে। হয়তো,  হয়তো পাহাড়ের মায়াবী রাতের হাতছানি এমনই হয় যা কাউকে পাগল পারা করে তার অলৌকিক রুপমাধুরীতে হারিয়ে যেতে আবার কাউকে ঠেলে দেয় অনন্ত শয্যায়। কু- ঝিকঝিক শব্দে ফিরে চলেছি আজ, কিন্তু কোন উত্তেজনা বা রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে নয়, চলেছি এক মনোকষ্ট, যন্ত্রণা আর মনের মনিকোঠায় বিজয়কে নিয়ে। আর তাকে মনে মনে শুধু এইটুকুই বলছি," বিজয় বিশ্বাস করো তোমার মেমসাব ঝুটা নয়, আমি সত্যিই সেদিন জানতাম না কি তোমার বাবার হদিশ"....

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু