বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

এবারের খ্রীষ্টমাস

এবারের খ্রীষ্টমাসে শুভেন বাড়ীতে একা। এর আগেও খ্রীষ্টমাসে একা থেকেছে শুভেন; জীবনের অনেকগুলো বছর বাইরে কাজ ক’রেছে শুভেন, শুধু বাড়ীর বাইরে নয়, নিজের শহরের বাইরে, নিজের প্রদেশের বাইরে, এমনকি নিজের দেশেরও বাইরে। কিন্তু কখনও খ্রীষ্টমাসে শুভেন পুরোপুরি একা থাকেনি। বাড়ীর বাইরে যেখানেই থেকেছে শুভেন, ও থেকেছে কোনো একটি আস্তানায়; হয় ওর আস্তানায় আরও কেউ এসেছে ওর সঙ্গে খ্রীষ্টমাস কাটানোর জন্যে; নয়তো শুভেন গিয়েছে কোনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে খ্রীষ্টমাস উদযাপনের জন্যে।

***

সিডনীতে শুভেন ফ্ল্যাটে একা কাটিয়েছে ১৯৮৫ সালের খ্রীষ্টমাসে, অস্ট্রেলিয়াতে শুভেনের দ্বিতীয় খ্রীষ্টমাসে। সেবছর ডিসেম্বরের আগেই শুভেন কিনতে চাইছিল একট নিজের আস্তানা – বাড়ী অথবা ফ্ল্যাট; ফার্স্ট হোম বায়ার গ্র্যান্ট পাবার জন্যে। কিন্তু অতসীর এব্যাপারে কোন আগ্রহ ছিল না; সে উৎসুক হ’য়েছিল ঢাকুরিয়াতে গিয়ে ওর বাবুমণি আর মামণির সঙ্গে দেখা করার জন্যে, অস্ট্রেলিয়ার নতুন জগতের গল্প বলার জন্যে। অতসী শুভেনকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে শুভেন অতসীর বাবা-মাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে এক বছরের মধ্যেই ঢাকুরিয়াতে বেড়ানোর ব্যবস্থা ক’রবে; এই খ্রীস্টমাসে যাওয়া না হ’লে পরের খ্রীস্টমাস পর্যন্ত অপেক্ষা ক’রতে হবে; শুভেনের প্রতিশ্রুতি থেকে একবছর দেরী হ’য়ে যাবে।

শুভেন বিমানবন্দরে এলো অতসী আর জুয়েলকে বিদায় জানাবার জন্যে। যদিও অতসী আর জুয়েল বোম্বাই থেকে পার্থ এসেছিলো বিমানপথে; বিদেশ থেকে এই তাদের ভারতবর্ষের দেশ ফিরে যাওয়ার প্রথম যাত্রা; চেক-ইনের সময় শুভেন ছিল ওদের সঙ্গে; ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যে বহির্গমনের ফর্মটি জমা দিতে হবে সেটি ভর্ত্তি করতে সাহায্য ক’রলো। অবশেষে প্লেন উড়লো অতসী, জুয়েল আরও সমস্ত যাত্রীকে নিয়ে। পর্য্যবেক্ষন-কক্ষ থেকে শুভেন প্লেনের টেক-অফ দেখলো। শুভেন তার স্ত্রী ও মেয়ের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করলো ঈশ্বরের কাছে। ওদের পৌঁছতে ১৪ ঘন্টা লাগবে। ১৬ ঘন্টা পরে শুভেন ফোন করবে ঢাকুরিয়াতে বাবুমণিকে। প্লেন ছাডার পরে কোপ স্ট্রীটের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যেতে চাইছিল না শুভেনের মন; কিন্তু আর কিছু করার নেই এখন। দেড় ঘন্টা পরে বাড়ী ফিরলো শুভেন – ফাঁকা বাড়ী  টিভি চালালো শুভেন; দেখার মত কিছু নেই। অতসী-জুয়েলের সঙ্গে মনে মনে সে উড়ে চলেছে প্লেনে; প্লেন ভাড়ার খরচ বাঁচাবার জন্যে সে এবার যেতে পারলো না; হয়তো সিটিজেনশিপ ও তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবে একটানা দুবছর অস্ট্রেলিয়াতে থাকলে। তবে অতসী আর জুয়েল বাড়ীতে এক মাস না থাকলেও শুভেন নিয়মিত অফিস গেছে; অফিসের খ্রীস্টমাস পার্টিতেও যোগ দিয়েছে; এমনকি খ্রীস্টমাসের দিনেও ও গিয়েছিল ওদের বন্ধু দীপক আর বন্দনার ফ্ল্যাটে; দীপক আর বন্দনা পুরো খ্রীষ্টান ঐতিহ্য মেনে পালন ক’রেছিল দিনটা শুভেনের সঙ্গে।

*** ***

আর একবার, ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে গাড়ীর ধাক্কায় জখম হ’য়ে শুভেন ছিল হাসপাতালে।

অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে বাড়ি কিনেছিল শুভেন এবং অতসী; তারা ঝুঁকি নিয়েছিল যে এই দুর্দিনের বাজারে বজায় থাকবে শুভেনের চাকরী; ধার শোধ হবে সময়মতো। এর মাত্র কয়েকমাস পরে একটি দুর্ঘটণায় শেষ হ’তে পারতো শুভেনের জীবন, অথবা জীবনভোর পঙ্গু হয়ে থাকতে পারতো সে।

অতসী পাবলিক বাসে করে যাচ্ছিল তার কর্মস্থলে; রেডিয়োর খবর শুনছিল – ‘বার্ডকোভে একজন পথচারী গুরুতরভাবে আহত হয়েছে মোটরগাড়ীর ধাক্কায়’; অতসী ভাবতেও পারেনি যে সেই পথচারী আর কেউ নয়, সে তার স্বামী শুভেন।

*** ***

পরের দিন জুয়েল স্কুল থেকে ফেরার পর অতসী তাকে জানাল যে তার বাবা কাল মোটরগাড়ীর দুর্ঘটনায় আহত হ’য়েছে, হাসপাতালে আছে, এখন ভাল আছে; আজ বিকেলে দেখতে যাবে বাবাকে। অতসীর কাছে এই খবর শুনে জুয়েল একেবারে বিহ্বল হ’য়ে পড়লো; তার বিশ্বাস ছিল, বাবা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কর্ম্মক্ষম পুরুষ, কিছু হ’তেই পারে না তার অপরাজেয় বাবার। হাসপাতালের পরিদর্শনের সময়ের শুরুতেই, মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে পৌঁছালো জুয়েল। তার অপরাজেয় বাবা বিছানায় বাঁধা প্লাস্টার আর ব্যান্ডেজের আড়ালে শুধু মুখটুকু দেখা যাচ্ছে। এখনও স্যালাইনের ড্রিপ চলছে, অক্সিজেন সিলিণ্ডারও আছে পাশে।

*** ***

বড়দিনের ছুটির সময়, অনেক নার্স ছুটিতে থাকে; তাই এইসময় রোগীদের বাড়িতে গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটাতে ও বিশ্রাম করাতে উৎসাহ দেওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে হুইলচেয়ার নিয়ে, পঙ্গুদের জন্য বিশেষ সুবিধাসমেত ট্যাক্সিতে চড়ে শুভেন তার বাড়ীতে যেতে পারতো; কিন্তু অতসীর সঙ্গে আলোচনা ক’রে ঠিক ক’রলো যে ও বাড়ী যাবে না বড়দিনের ছুটি কাটাতে, বাড়ীর মধ্যে হুইলচেয়ার নিয়ে ঘোরাফেরা ক’রতে খুবই অসুবিধে হবে।

খ্রীস্টমাসের দিনে, অতসীর মন চাইলো না শুভেনকে ছাড়া বাড়ীতে দুপুরের খাওয়া খেতে; ও জুয়েলকে পাঠালো বন্দনাদের বাড়ীতে খ্রীস্টমাস লাঞ্চ করার জন্যে। শুভেন যা যা খেতে ভালবাসে – লুচি, মাংস, কপির তরকারী – রান্না ক’রে, একটি টিফিন ক্যারিয়ারে ভ’রে নিয়ে চললো হাসপাতালে। অতসী লাঞ্চ নিয়ে আসবে একথা ভাবতে পারেনি শুভেন; সে তার পাশের বিছানার রোগীর সঙ্গে আলোচনা করছিল – খ্রীস্টমাসে কী বিশেষ লাঞ্চ দেবে হাসপাতালে, বিয়ার ও অন্য পানীয়ও নাকি পাওয়া যাবে। যখন অতসী এসে পৌঁছাল লোভনীয় খাবারের টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে, তখন শুভেন একটু সমস্যায় পড়লো। যে রোগী বন্ধুদের সঙ্গে হাসপাতালের খ্রীস্টমাস লাঞ্চ করার ঠিক ক’রেছিল শুভেন, তাদের বাদ দিয়ে ও কি-ক’রে খাবে বাড়ীর তৈরী সুস্বাদু খাবার? অতসীকে হাসপাতালের লাঞ্চ-হলে নিয়ে যাওয়া চলবে না, সেখানে অতসীর প্রবেশ নিষিদ্ধ। আবার অতসীর আনা খাবার কেবল দুজনের জন্যে যথেষ্ট; অন্য রোগী বন্ধুদের ভাগ দেবার উপায় নেই। শুভেনের ধর্ম্মবিশ্বাস ব’লতে গেলে নেই। খ্রীস্টমাস তার কাছে কোনো বিশেষ অর্থ নিয়ে আসে না; হাসপাতালের লাঞ্চে বিয়ার পাওয়া যাবে, এটাই তার মনে ধরেছিল। এতক্ষণে তার হৃদয়ঙ্গম হ’লো অতসীর এখানে আসার কারণ; হয়তো ওর ব্রেকফাস্ট করার সময় হয় নি এতসব রান্না ক’রে বেরোনোর আগে। অতসী গাড়ী চালাতে শেখেনি তখনও; পাবলিক বাস বদল করে আসতে সময় লেগেছে অনেকটা। অতসীর সঙ্গে ওর হাতে রাঁধা লাঞ্চ খাওয়ার স্বাদ বা দাম অনেক বেশী হাসপাতালের এক গ্লাস বিয়ারের তুলনায়। শুভেন উঠে বসলো হুইলচেয়ারে, অতসীকে ব’ললো টেবিল থেকে জলের বোতল নিয়ে হুইলচেয়ারের কাপ-হোল্ডারে রাখতে। হুইলচেয়ার চালিয়ে শুভেন চললো হাসপাতাল ভবনের বাইরে – বাগানে। অতসী সঙ্গে এলো টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে। একটা গাছের ছায়ায় বেঞ্চে বসে, শুভেন আর অতসী একসঙ্গে খেলো তাদের খ্রীস্টমাস লাঞ্চ - লুচি, মাংস, কপির তরকারী। টিফিন ক্যারিয়ারের খাবার হয়তো তেমন সুস্বাদু নয়। হাসপাতালের বাগানে বসে ভালবাসার অশ্রু মিশিয়ে অমৃত হয়ে উঠলো খ্রীস্টমাস লাঞ্চ, শুভেনের প্রত্যাশিত বিয়ারের গ্লাসের চাইতে অনেক বেশী উপাদেয়।

*** ***

এর পরে সবচেয়ে বড় পরিবর্ত্তন এসেছে জুয়েলের বিয়ের পরে - জুয়েলের বিয়ে হ’য়েছে এক খ্রীষ্টান ছেলে জনের সঙ্গে; অস্ট্রেলিয়াতেই জন্ম জনের। জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই, শুভেন আর অতসী নিয়মিতভাবে খ্রীষ্টমাস উদযাপন ক’রতে শুরু ক’রেছে। ছোটবেলায় শুভেনের বাবা-মা খ্রীষ্টমাস উদযাপন ক’রতেন না; বাড়ীতে খ্রীষ্টমাস ট্রী কখনো লাগানো হয়নি; কোনো গিফ্টও কেনা হয়নি কারুর জন্যে; কদাচিৎ বাবা কেক কিনে এনেছেন নিউ মার্কেট থেকে; ভাইবোনেরা ভাগ ক’রে খেয়েছে। জন-জুয়েলের বিয়ের পর থেকে, ওদের বাড়ীতে খ্রীষ্টমাস উদযাপন ক’রতে যেতো শুভেন আর অতসী।

এর পরে, জন আর জুয়েল লণ্ডনে থাকা শুরু ক’রলো; ওদের প্রথম সন্তান সোনিয়ার জন্ম হ’লো ডিসেম্বরে। শুভেন আর অতসী ওদের সঙ্গে হোয়াইট খ্রীষ্টমাস উদযাপন ক’রলো লণ্ডনে। এর পরের বছরেই, শুভেন আর অতসী ক’লকাতায় গিয়েছিল ছুটি কাটাতে; সেখানে এসে যোগ দিল জন, জুয়েল আর সোনিয়া। ক’লকাতার গ্র্যাণ্ড হোটেলে খ্রীষ্টমাস ব্রেকফাস্ট উপভোগ ক’রলো সকলে।

*** ***

লণ্ডনে কয়েক বছর কাটানোর পরে সিডনীতে ফিরলো জন, জুয়েল আর সোনিয়া; ওরা বাড়ী কিনলো শুভেন আর অতসীর বাড়ীর খুব কাছে; হেঁটে যেতে দশ মিনিট লাগে। এর পর থেকে, আবার জন, জুয়েলের বাড়ীতে প্রতি বছরে খ্রীষ্টমাস উদযাপন শুরু হ’লো।

২০২০ আর ২০২১ সালে কোভিড রোখার নিষেধাজ্ঞার জন্যে খ্রীষ্টমাস উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। ২০২০ সালের মাঝামাঝি হাঁটু বদলানোর অপারেশন ক’রে, শুভেন ঠিকমতো হাঁটতে পারেনা। তবু ২০২২এর নভেম্বরে, ফ্লাইটের টিকিট কিনলো শুভেন আর অতসী – জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে ক’লকাতায় বেড়াতে যাওয়ার জন্যে।

ঠিক এর পরেই, জন আর জুয়েল জানালো যে এবারে খ্রীষ্টমাস উদযাপন ওদের বাড়ীতে হবে না; এবারে খ্রীষ্টমাস অনুষ্ঠিত হবে হক্সবেরীতে জনের বাবা-মায়ের বাড়ীতে; আর তার ঠিক আগে ছ-দিনের জন্যে ওরা গোল্ডকোস্টে তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট বুক ক’রছে শুভেন আর অতসীর সঙ্গে থাকার জন্যে। জন, জুয়েল আর সোনিয়া গোল্ডকোস্টে যাবে ড্রাইভ ক’রে; সঙ্গে ওদের কুকুরও থাকবে;  শুভেন আর অতসীকে প্লেনে যেতে হবে।  শুভেন জানালো, ও এখন প্লেন-ভাড়ার জন্যে খরচ ক’রতে রাজী নয়; কারণ সিডনী-কলকাতা-হায়দ্রাবাদের বিজনেস্ ক্লাস টিকিট কাটতে অনক খরচ হ’য়ে গেছে। শুভেনের আপত্তিতে জন গোল্ডকোস্টের বুকিং ক্যনসেল ক’রলো; তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট বুক ক’রলো ক্রেসেন্ট হেডে; ১৭ই ডিসেম্বর থেকে ২৩শে ডিসেম্বর পর্য্যন্ত ছ’দিনের ভাড়া ছ’হাজার ডলার। শুভেন আর অতসীকে যেতে হবে ওদের গাড়ী ড্রাইভ ক’রে; জন ও জুয়েল ড্রাইভ ক’রবে ওদের নিজেদের গাড়ী – গাড়ীতে থাকবে সোনিয়া, কুকুর, বোট, নানান রকমের খেলার সামগ্রী আর খাদ্যদ্রব্য। গত দশ বছর ধরে অতসী শুভেনকে লম্বা ড্রাইভ ক’রতে দেয় না; ছ-ঘন্টার ড্রাইভ একাই ক’রতে হবে অতসীকে। ২৩শে ডিসেম্বর তারিখে, বিকেল ৪টে/পাঁচটা নাগাদ সিডনীতে পৌঁছে, মাত্র এক রাত্তির কাটাতে পারবে সিডনীর বাড়ীতে। তার পরদিন ২৪শে ডিসেম্বর দুপুরে ড্রাইভ শুরু ক’রতে হবে হক্সবেরীতে জনের বাবা-মায়ের বাড়ীর দিকে। জনের ইমেলে প্রস্তাব আসার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পাঠাতে যাচ্ছিল শুভেন – ক্রেসেন্ট হেডের জার্নির জন্যে সময় বা ডলার কোনটাই খরচ করার ইচ্ছে বা সামর্থ্য নেই তার। সেই মুহূর্ত্তে সামনে ছিল অতসী; অতসী বাধা দিল; ও ব’ললো, ‘এসব কথা ইমেলে লিখো না; ওদের বাড়ীতে গিয়ে বুঝিয়ে ব’লবো।‘

জন-জুয়েলের বাড়ীতে মিটিং হ’লো ১২ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায়; ক্রেসেন্ট হেডের বুকিং তখনও ক্যানসেল করা যাবে কিনা শুভেনের জানা নেই। শুভেন জুয়েলকে বুঝিয়ে ব’ললো, ‘চলচ্ছক্তিহীনতার জন্যে সামান্য চলাফেরা ক’রতেও আমার অনেক সময় লাগে। তাই স্বার্থপরের মতো ব’লছি, দিনে যেটুকু সময় পাই, সেটুকু সময় যদি সিডনীর বাড়ীতে কাটাতে পারি, তাহ’লে ঐ সময়টুকুতে আমার পছন্দমতো কিছু লিখতে পারি, পছন্দমতো টিভি-প্রোগ্রাম দেখতে পারি, মার্টিনের সঙ্গে টেবিল-টেনিস খেলতে পারি বাড়ীর গ্যারেজে। হয়তো, এই তিনটের কোনোটাই হয়তো ক্রেসেন্ট হেডের বাড়ীতে ক’রতে পারবো না। এছাড়া আজকেই খবর পেলাম, ভারতবর্ষের এক পাবলিশিং প্রেস জানিয়েছে যে, ৯ই ডিসেম্বর থেকে ২৩শে ডিসেম্বরের মধ্যে ঐ প্রেসের মাধ্যমে প্রকাশিত পুস্তক বিনা খরচে লেখকের ভারতবর্ষের ঠিকানায় পাঠানো হবে।‘

জন ব’লছিল, ‘বাপী, এখন রিল্যাক্স করার সময়; বই-লেখাটা কাজ হিসেবে দেখবেন না।‘

শুভেন ব’ললো, ‘এগুলোকে ঠিক কাজ হিসেবে দেখিনা; কিন্তু নিজের এবং আত্মীয়স্বজনদের মন বুঝতে চাই বোঝাতে চাই লেখার মাধ্যমে।‘

জুয়েল বুঝলো যে, শুভেনের কাছে সময় বড়ই দুষ্প্রাপ্য; ও ব’ললো, ‘বাপী, তুমি যদি চাও, সিডনীর বাড়ীতেই থেকে যাও। মা একাই চলুক ক্রেসেন্ট হেডের বাড়ীতে।‘

এবারে অতসী ব’ললো, ‘শুভেন না গেলে, আমিও যাবো না। শুভেন একবার বাড়ীর সামনের উঠোনে আর একবার বাড়ীর ভেতরে পড়ে গিয়েছিল। কেউ বাড়ীতে না থাকলে, কে তুলবে ওকে, পড়ে গেলে?’

শুভেন ব’ললো, ‘দুবারই পড়েছিলাম থেরাব্যাণ্ড লাগিয়ে এক্সারসাইজ করার সময়; থেরাব্যাণ্ড খুলে গিয়েছিল হুক থেকে; ঐ এক্সারসাইজগুলো আর ক’রিনা।‘

অতসী ব’ললো, ‘কোনো রিস্ক নিতে চাই না, আমি।  তুমি না গেলে, আমিও যাবো না।‘

অগত্যা শুভেনকে রাজী হ’তে হ’লো; হয়তো সময়ও ছিল না।

১৭ই ডিসেম্বর সকাল সাড়ে নটায় যাত্রা শুরু করার আগে, শুভেন চারদিন সময় পেয়েছিল স্যুটকেশ গুছোনোর জন্যে আর বই প্রকাশের প্রস্তুতিতে। ঐদিন বিকেল চারটে নাগাদ সকলে পৌঁছেছিল ক্রেসেন্ট হেডের বাড়ীতে। জিনিসপত্র, জামাকাপড় তিনটে ঘরে গুছিয়ে রাখার পরে, জুয়েল শুভেনকে ব’ললো, ‘বাপী, এখানে তোমার ল্যাপটপটা লাগিয়ে নাও; আর তোমার বই লেখার কাজ শুরু করো।‘

শুভেন সিডনী থেকে বেরোবার আগেই একটি উপন্যাস আর দুটি গল্পগুচ্ছ প্রকাশকের কাছে পেশ ক’রে এসেছে; এখানে এসে আরও তিনটি উপন্যাসের প্রচ্ছদ ডিজাইন শুরু ক’রলো।

১৮ই ডিসেম্বর সকালে, শুভেন ব্রেকফাস্ট ক’রতে বসেছে, এমন সময় সোনিয়া হাজির হ’লো Early Christmas Giftএর তিনটে বাক্স নিয়ে। ব্রেকফাস্ট সেরে গিফ্টের প্যাকেটগুলো খুললো শুভেন; একেবারে মনের মতো গিফ্ট - একটা প্যাকেটে দুটো টেবিল-টেনিস ব্যাট, দ্বিতীয় প্যাকেটে একটা স্প্রিং দেওয়া টেবিল-টেনিস নেট, আর তৃতীয় প্যাকেটে কুড়িটা টেবিল-টেনিস বল।

জন শুভেনকে ব’ললো, ‘বাপী, আপনি চান ইত্যাদি সেরে আসুন। এখানের স্নুকার রুমের পাশের রুমে যে ডাইনিং টেবিলটা আছে, সেখানে নেটটা লাগিয়ে দেবো।‘

স্নান সেরে বেরোলো শুভেন হাফশার্ট আর সর্টস্ পরে। সোনিয়া আর জনের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে চললো টেবিল-টেনিস খেলার চেষ্টা; নেটটা একপাশে খুলে পড়ে যাচ্ছে। নেট ছাড়াই ওরা খেললো কিছুক্ষণ; পয়েন্ট গুণে হারজিতের খেলা নয়; বলটাকে মাটিতে পড়তে না দিয়ে কতবার টেবিলের এদিক থেকে ওদিকে পাঠানো যায় তারই খেলা।

গেমরুমে ছিল দুটো পিন-বল মেশিন আর একটা স্নুকার টেবিল। এছাড়া স্ক্র্যাবল্, তাস, আরও অনেক গেম নিয়ে এসেছিল জন আর জুয়েল। একটা খেলায় প্রত্যেক খেলোয়াড়কে বলা হ’লো, চারটি কাগজের স্কোয়ারের প্রত্যেকটিতে একটা সিনেমার নাম লিখে, কাগজের স্কোয়ারগুলো ভাঁজ ক’রে মুড়ে একটা বাক্সে ফেলে দিতে। সব কাগজের স্কোয়ার বাক্সে ফেলা হ’লে খেলা শুরু হবে। প্রথম প্রতিযোগী কে হবে সেটা লটারী ক’রে ঠিক হবে। প্রথম প্রতিযোগী বাক্স থেকে একটা কাগজের মোড়ক তুলে দেখবে ঐ মোড়কে কোন্ সিনেমার নাম লেখা আছে; তারপর কোনো কথা না ব’লে, কেবল অঙ্গভঙ্গীর ইঙ্গিত দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা ক’রবে সিনেমার নামটি কি। যে প্রতিযোগী সিনেমার নাম ঠিক ঠিক ব’লতে পারবে, সে হবে দ্বিতীয় প্রতিযোগী, যে বাক্স থেকে আর একটা কাগজের মোড়ক তুলে দেখবে ঐ মোড়কে কোন সিনেমার নাম লেখা আছে; তারপর কোনো কথা না ব’লে, কেবল অঙ্গভঙ্গীর ইঙ্গিত দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা ক’রবে সিনেমার নামটি কি। খেলা শেষ হবে সব সিনেমার নাম ঠিকমতো বলা হ’লে।

১৮ই ডিসেম্বর থেকে ২২শে ডিসেম্বর পর্য্যন্ত রুটিন প্রায় একই ধরণের ছিল। সকালে ব্রেকফাস্টর পর, অতসী, জন, জুয়েল আর সোনিয়া যেতো এমন কোনো এক বীচে, যেখানে ওদের কুকুরকেও সঙ্গে রাখা যাবে। এই সময়টা শুভেন বসতো ল্যাপটপ নিয়ে, ওর বই প্রকাশ করার কাজ নিয়ে। ওরা ফিরতো প্রায় দেড়টা নাগাদ; লাঞ্চ রান্না ক’রে সবাই দুপুর দুটো নাগাদ টেবিলে ব’সে খেতো। খাওয়ার পরে চলতো পিন বল, স্নুকার ইত্যাদি নানা ধরণের খেলা। এর পরে সন্ধ্যে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত সবাই ডিনার ক’রতো। এর পরে রাত সাড়ে আটটা থেকে লাউঞ্জের বড় টিভিতে জন সিনেমা দেখাতো – নানান ধরণের ছবি; শুভেনের যে ছবিটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে, সেটার নাম ‘Spirited’.

এই রুটিনের বদল হ’য়েছিল ২২শে ডিসেম্বর তারিখে; শুভেনের কাজ শেষ হ’য়ে গেছে ব’লে শুভেনও বীচে গিয়েছিল; পরদিন গাড়ী চালাতে অনেক পরিশ্রম হবে ব’লে অতসী বীচে যায়নি। লাঞ্চের পরেই সুটকেশ ইত্যাদি গুছিয়ে ফেললো অতসী ও শুভেন; অতসী গাড়ীতে রেখে এলো শুভেনের ওয়াকার, সুটকেশ ইত্যাদি। ২৩শে ডিসেম্বর সকাল দশটার মধ্যে এ বাড়ী ছেড়ে যেতে হবে।

২৩শে ডিসেম্বর, সকাল সাড়ে নটার সময় অতসী ও শুভেন বাড়ীর দিকে যাত্রা শুরু ক’রলো। পথে পনেরো মিনিটের জন্যে টয়লেট ব্রেক নিয়েছিল; ঠিক বিকেল চারটের সময় বাড়ী ফিরেই শুভেন অতসীকে ব’ললো, এই ক’দিনে ও খুব ক্লান্ত হ’য়ে পড়েছে; হক্সবেরীতে জনের বাবা-মায়ের বাড়ীতে আরও দু-রাত্তির কাটাতে পারবে না। শুভেন জনের কাছে মেসেজ পাঠালো ওর বাবা-মার অ্যাপোলজি চাইবার জন্যে। জুয়েল জানালো, হক্সবেরীতে যাওয়ার সময় জুয়েল থাকবে অতসীর সঙ্গে।

খ্রীষ্টমাস গিফ্ট যা দেবার আছে, সব প্যাক করাই ছিল; অতসী ওগুলোকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে ২৪শে ডিসেম্বর দুপর দুটোয় রওনা হ’লো। সাড়ে চারটের সময় হক্সবেরীতে জনের বাবা-মায়ের বাড়ীতে পৌঁছালো। অতসী সময়মতো খ্রীস্টমাসের সব খবর শুভেনকে হোয়াটস্ অ্যাপ ক’রে পাঠাচ্ছিল। শুভেন সবচেয়ে খুশী হ’লো, যখন অতসী জানালো স্যান্টা এই চিঠিটা পাঠিয়েছে সোনিয়াকে:-

‘স্নেহের সোনিয়া,

মেরী খ্রীষ্টমাস! হো! হো! হো!

খুবই ভালো কেটেছে তোমার বছরটা! তুমি হাই স্কুলে গিয়ে দেখিয়েছো তোমার গুণপনা – মেধাশক্তি। তুমি যে নিজের পরিচয় দিতে পেরেছো, এতেই আমি খুশী। আমি জানি, তোমার বাবা ও মা তোমার চেষ্টা দেখে খুশী হ’য়েছে। তুমি মানুষের মতো মানুষ হ’তে চলেছো। এই প্রয়াস বাঁচিয়ে রাখো।

পরের বছর আরো ভালো বাস্কেট-বল, বোর্ড আর কম্পিউটার গেমস খেলো।

তোমার আরো নতুন বন্ধু হোক, পুরোনো বন্ধুরাও সঙ্গে থাক্।

অনেক ভালবাসা নিও।

স্যান্টা’

*** সমাপ্ত ***

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু