বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

সীমানার সীমা - অসীম

পাপাই আর পিংকি দুজন খুব ভালো বন্ধু।না ছোটবেলাকার নয়, তবে তাহলেও দুই বান্ধবীর ভালোবাসা অনেক গাঢ়। দুজনের দেখা হয় কলেজের প্রথম দিন, কিন্তু কথা প্রথম দিনই হয় না। দ্বিতীয় দিন ক্লাসের পর, হঠাৎই পাপাই পিংকি কে পিছন থেকে ডাক দেয় "শুনছো! বলছি আমি পাপাই, তুমি তো  পিংকি? ক্লাসে প্রফেসর তোমার নাম ধরে ডাকছিলেন।"  পিঙ্কি ও সিড়িতে দাঁড়িয়ে ধার ঘুরিয়ে হাসিমুখে জবাব দেয় "হ্যাঁ"....পাপাই বলে, "তুমি আমার বন্ধু হবে? আমার তোমাকে বেশ লেগেছে"। পিংকি বলে," হতে পারি যদি এই তুমি তুমি বলাটা বন্ধ করিস"........সেটা শুনে দুজনেই  একসাথে খুব জোরে হেসে ওঠে, শুরু হয় পি স্কোয়ারের বন্ধুত্ব। 

পাপাই সাদাসিদে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছোট মেয়ে খুবই আদরের আর  পিঙ্কি বড়লোক পরিবারের ছোট মেয়ে যে কিনা আরো আদরের।  একই দাদা  নেভিতে কাজ করে আর তাই বোনকে অনেক দামি দামি উপহার এনে দেয় আর পিংকি সেসব এনে কলেজে দেখায় পাপাইকে। পাপাইয়ের মন খারাপ হয় ঠিকই কিন্তু সিধেসাদা ভাবে মানুষ হওয়ায় খুব একটা ফারাক পড়ে না। দুজনের বন্ধুত্ব নিটোল গাঢ় হতে থাকে। পিঙ্কি বরাবরই একটু দেশি মর্ডান আর পাপাই ছিমছাম সালোয়ার পরা মেয়ে। পিংকির চাপে ধীরে ধীরে পাপাই কেউ সেই মডার্ন আদব কায়দায় নিজেকে রাঙিয়ে নিতে হয়। কিন্তু পাপাই নিজেকে একটা শালীনতার সীমারেখায় আবদ্ধ করে রাখে সব সময়, তবে তা বুঝতে দেয় না কাউকে কখনোই পাছে পিংকি খারাপ পায়। যখন পিঙ্কি জিন্স প্যান্ট আর হাত কাটা গেন্জি পরে তখন পাপাই থ্রি কোয়ার্টার বা ফুলহাতা খুব একটা সুন্দর টপ দিয়ে  জিন্স প্যান্ট পরে ফলে দুজনে মডার্ন হলেও সীমারেখার সীমা কিন্তু অলক্ষে থেকেই যায় দুজনের ফ্যাশনে। 

এইভাবে দিনের পর দিন যায় দুজনের একসাথে ওঠা বসা খাওয়া দাওয়া আর গাঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চলতে থাকে  দিব্যি। এরপর দুজনের বন্ধুত্ব আরো অনেকের সাথে হয়, অর্থাৎ একটা গ্রুপ তৈরি হয়, যারা একসাথে আড্ডা মারা, হইচই করে খাওয়া দাওয়া করে পড়া শুনা করা। এইভাবে মেলামেশা করতে করতে একটা সময়  পিংকি শুরু করে নেশা করা। নেশা অর্থাৎ এই ধরুন সিগারেট খাওয়া, মদ খাওয়া, এবং অন্য আরো নেশা। আর পাপাই কেউ তা করার জন্য  জোরাজুরি করতে থাকে। কিন্তু পাপাই পরিবারের দোহাই দিয়ে তা এড়িয়ে যায়। তাতে অবশ্য পাপাই কে শুনতে হয় যে সে বড্ড সেকেলে। 

এরপর হঠাৎ পিংকি জড়িয়ে পড়ে একটি ছেলের সাথে এবং বলে যে ছেলেটি তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পাপাই তাকে সাবধান করে যে এই বয়সে এই ধরনের কোন কিছু বাড়িতে না বলে করাটা বোধ করি ঠিক নয়, কিন্তু পিং কি তাকে বোঝায় যে, জীবনকে নাকি এই ভাবেই উপভোগ করতে হয়। পাপাইয়ের চোখে তখন রং্গিন স্বপ্ন, সে ভাবে হয়তো এটাই ঠিক। কিন্তু কোন কারনে সে নিজেকে সে পথে চালিত করতে পছন্দ করে না। এইভাবে একটা দুটো তিনটে করে ধীরে ধীরে  পিংকির জীবনে চলতে থাকে জীবনসঙ্গী আগমনের ধারাবাহিকতা, আর তার সাথে চলতে থাকে জীবন কাটাবার নানান  রঙিন প্রতিশ্রুতিও। পাপাই বহু বারণ করে কিন্তু পিংকি  শোনেনা। পাপাই বরাবরই বাড়িতে সবার সাথে বড্ড ফ্রি তাই সে তার এই গল্পগুলো বলে তার একমাত্র  বন্ধু তার দিদিভাইকে এবং তা শুনে  তার দিদি তাকে ধীরে ধীরে পিংকির সাথে  মেলামেশা কমিয়ে দিতে বুদ্ধি দেয়। তখন কথাটা খারাপ লাগে বটে কিন্তু সে বরাবরই বড়দের কথা শুনে চলতে ভালবাসে এবং তাই তার দিদির কথা  চুপচাপ শুনে সেখান থেকে চলে আসে।

 এরপর ধীরে ধীরে পরীক্ষার চাপে পিংকি আর পাপাই পড়া শুরু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়।পরীক্ষা শেষ হয়,দুজনে একসাথে সবাই কাটাবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে হল থেকে বাড়ির পথে রওনা হয়।বাড়ি ফিরে পাপাই জানতে পারে সে বাবা মার সাথে  ফ্যামিলি ট্যুরে যাবে, তাই খুশি হয়ে সে পিংকি কে বলে যে সে ফিরে এসে দেখা করবে পিংকি একটু তামাশার সরে বলে "বাবা এত বড় হয়ে গেছিস তাও বাবার সাথে ঘুরতে যাস,লজ্জা লাগে না। আমাকে তো আমার বাবা-মা ফুল প্রাইভেসি দিয়ে রেখেছে"। পাপাই একটু হেসে  ল্যান্ড ফোনের রিসিভারটা "রাখছি রে" বলে নামিয়ে রাখে। ভীষণ খুশি হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে পাপাই ঘুরতে চলে যায় বাবা মার সাথে। 

দারুন মজা করে দশ দিন পর ফিরে এসে প্রথমে পিংকিকে ফোন লাগায় তাকে সব গল্প বলবে বলে। কিন্তু ফোনটা কেউ ধরে না, সে ভাবে পরে হয়তো পিংকি ফোন করে নেবে এবং যথারীতি ব্যস্ত হয়ে যায় অন্য কাজে। হঠাৎ সে ফোনে রিংয়ের শব্দে এসে ফোনটা ধরে তাড়াতাড়ি,  ভাবে বুঝি পিংকি ফোন করেছে কিন্তু ফোনের ওপাশে অন্য গলা "হ্যালো আমি মিমি বলছি, কে পাপাই? "পাপাই এক পলক চুপ করে থেকে বলে," হ্যাঁ বলছি, বল!" "কিরে কবে ফিরলি?" "এইতো আজ সকালে।" "আমিতো ভাবিনি তোকে ফোন করে পাব আগেও ফোন করেছিলাম কেউ তোলেনি"। "হ্যাঁ  আমরা সবাই গেছিলাম তো তাই। আচ্ছা বল কি হয়েছে"? "তুই তো শুনিস নি নিশ্চয়ই ছিলিনা যখন"। "কি শুনবো"? "জানিস তো পিংকি কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছিল".......শুনে পাপাইয়ের যেন পায়ের তলার মাটিটাই সরে গেল," কি বলছিস কি? কেন"? মিমি আবারো বলল," আরে কোন একটা ছেলের চক্করে ফেসে গেছিল তো বাজে ভাবে, সেই ছেলেটা কি সব নেশা করে সেই জন্য  পুলিশ ধরে নিয়ে গেছিল ওদের দুজনকেই আরো অনেকে ছিল নাকি তারপরে ওর বাবা গিয়ে ছাড়িয়ে গেছে তাই জন্য এখন ওর বাড়িতে কারোর সাথে মেলামেশা করা এলাও করছে না"। পাপাই স্তব্ধ পাথরের মত কথাগুলো শুনছিল মিমি বললো "জানিস তো মাঝে একদিন ওদের বাড়ি গেছিলাম ওর মা বলছিল পিংকি ভীষণ সিনসিয়ার ওতো তোর বা পাপায়ের মতো নয় যেমন তেমন করে একটা পাশ করলেই হয়ে গেল ওর ক্যারিয়ার এর টার্গেট অনেক বড়  ও তোদের মত সাধারণ নয় দেখলি তো দেখিয়ে দিল ওর টার্গেট, আচ্ছা রাখি রে! পরে আবার ফোন করবো"। পাপাই 'হুম' বলে ফোনটা ছেড়ে দিল। নির্বাক নির্বোধের মত একা বসে নিজেকে দোষারোপ করতে থাকলো "আমি যদি না ঘুরতে যেতাম তাহলে বোধ করি পিংকি এত বড় বিপদে পড়তো না"। হঠাৎ পাপাই মা এসে পড়াতে পাপাই কেমন যেন কল চালানো পুতুলের মত গড়গড় করে মাকে সে সব ঘটনা জানিয়ে দিল এবং বলাই বাহুল্য তার মা খুব স্নেহের সুরে এবং কড়া ভাষায় জানিয়ে দিল এবার পিংকির সাথে সব সম্পর্ক যেন সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইতি টানে। পাপাই কিছু না বলে চুপ করে থাকলো। 

যথারীতি পরের দিন কলেজ গেলো, কলেজে সবাই কানাঘুষো করছে পাপাই শুনতে পেল। অপেক্ষা করলো পিংকি আসলে তাকে জিজ্ঞাসা করবে কেন সে এমন করেছে কিন্তু পিংকি এলোনা। তিন দিন পর পিংকি এলো খুব বিধ্বস্ত, এসে পাপাই কে বলল আজি তার শেষ দিন কলেজে, সে সমস্ত ফরমালিটি পুরো করতে এসেছে আগামী সপ্তাহে তার বিয়ে এবং বিয়ের পরই তার বাকি যা পড়াশুনো তা তাকে পুরো করতে হবে শ্বশুরবাড়িতে।এ কথা অমান্য করায় তার বাবা তাকে বেল্টের বাড়ি মেরে সমস্ত গা ফুলিয়ে দিয়েছে। পাপাই স্তব্ধ হয়ে শুধু চেয়ে থাকলো পিংকির মুখের দিকে। পিংকি যাবার আগে একবার পেছন ফিরে খুব করুন চোখে তাকিয়ে বলল," আসি বন্ধু! মনে রাখিস"..... তারপর চোখের আড়াল হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও  পিংকির কোন খোঁজ তারপর আর পাইনি পাপাই।

পাপাই আজ একটা অনেক বড় মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির সিনিয়র ম্যানেজার, তার সাথে সে অর্জন করেছে উচ্চশিক্ষার বহু সার্টিফিকেটও। হঠাৎ পাপাইয়ের কাছে চাকরি সূত্রেই সুযোগ আসে বাইরে বিদেশে যাবার।  যাবার আগে পুরনো বন্ধুদের মনে করে একটা পুরনো ডায়েরি থেকে নাম্বার ডায়াল করতে থাকে তার নতুন কেনা মোবাইল ফোনে, হঠাৎ মিমির বাড়ির ল্যান্ড লাইনের নাম্বারটা লেগে যায়, কথা হয় মিমির সাথে। অনেক স্মৃতি  আওড়ানো চলে দুজনে মিলে। হঠাৎ পাপাই জিজ্ঞাসা করে," পিংকির কোন খবর জানিস রে?" মিমি একটু চুপ করে থেকে বলে "একই পাড়ায় থাকি তো, তাই মিথ্যে বলব না,শুনেছি ভালো নেই রে। শুনেছি শ্বশুর বাড়িতে খুব অত্যাচার করে। আর পিংকির বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর দাদা বৌদি তেমনভাবে ওর মাকে আর পিংকির সাথে তেমন যোগাযোগ রাখতে দেয় না। কথাটা  শুনলো পাপাই চুপচাপ, মনটা যেন বিষিয়ে গেল নিমেষে। বলল," রাখি রে যোগাযোগ রাখিস "।ফোনটা রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পাপাই আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবলো ছোটবেলা থেকে মা রেগে গেলে বলতো "পাপাই সীমার বাইরে যাস না কিন্তু, আমি কিন্তু মেরে পিঠ ভেঙ্গে দেব" তখন বুঝতো না সীমার পরিধি কি আর তার বাইরে গেলেই বা কি হবে?  কিন্তু আজ হয়তো সে বড় বেশি বুঝতে পারছে, জীবনের সীমানার সীমাটা কতটা প্রয়োজনীয়। যে সীমানার সীমাবদ্ধতায় নিজেকে বেঁধে রেখে পাপাই আজ বিদেশের পথে পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাগ গোছাচ্ছে, সেই একই জীবনকে সীমানার সীমাবদ্ধতার বাইরে এক অসীম আকাশে হারাতে গিয়ে হারিয়ে গেছে পিংকির স্বাভাবিক সাবলীল জীবনযাত্রা। সেদিন পিংকির গল্প শুনে পাপাইয়ের মনে হতো যদি  বাবা-মাও পিংকির বাবা মার মত এত ফ্রি হতো না জানি ভালো হতো আজ মনে হচ্ছে বাবা-মা হলে যেন সব সন্তানের বাবা-মা তার বাবা মার মত হয়। যারা তাদের সন্তানের জীবনকে সীমানার সীমাবদ্ধতায়  শৃংখলাবদ্ধ করতে চায়, যাতে তারা তাদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করে এগিয়ে যেতে পারে উন্নতির পথে। যেন তাদের পিংকির মতো নিজেদের স্বপ্নগুলোর লাশের উপর দিয়ে হেঁটে তলিয়ে যেতে না হয় গহীন অন্ধকারে। হঠাৎ মায়ের ডাকে পাপাইয়ের সম্বিত ফেরে, আকাশের দিকে তাকিয়ে চলে যাবার আগে চোখ বন্ধ করে পিংকির মুখটা মনে করে শুধু মনে মনে বলে, "ভালো থাকার চেষ্টা করিস বন্ধু,  আর এবার জীবনটাকে সীমার মধ্যে রেখে  তবেই অসীম আকাশে হারবার স্বপ্ন দেখিস", "আসি মা"!!..... বলে, একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে পাপাই বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে চলে যায় মায়ের কাছে।।



পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু