বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

চড়ুইভাতি জমজমাটি

"শীতের আমেজ,মনের মাঝে নাচছে ঘোড়া-হাতি;

ভারি মজা করব সবাই আজকে চড়ুইভাতি।। "

"বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ"এটা বহু প্রচলিত একটা উক্তি,আর সেই অনুরুপ যেকোন ঋতু কিম্বা উপলক্ষ্যকে পার্বণ বা অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। আর তাই বাঙালির এইরূপ মনোভাবকে মুল্য দিতেই বোধ করি প্রকৃতিও সেজে ওঠে নানারূপে। যেমন কালবৈশাখীর ভীষণ করাল রূপের ছটায় পরিবেশের উষ্ণতা,তপ্ততাকে উড়িয়ে শরীর শীতল করে গ্রীষ্মকাল, তেমনি আবার পাকা আমের ভাটিয়ালি সুবাস ছড়ায় সেই গরমকাল।বাঙালির প্রেমিক হৃদয়,কবি হদয় উন্মোচিত করে যেমন বর্ষাকাল, তেমনি আবার ঐতিহ্যবাহী বাঙালীকে পরিচিত করায় শরৎকাল। আর এইসবের একত্রে সমাবেশ ঘটে যে সময়,তা আমাদের মোটামুটি সকলের প্রিয় শীতকাল। এবার হয়তো আমার প্রিয় পাঠকগণ ভাবছেন,শিরোনামে অন্য কিছু দেওয়া অথচ ঋতু বর্ণনা চলছে, ব্যাপারটা কী? আসুন তাহলে বলি এই ঋতুবন্দনার কারণ। 


যেমন বললাম যে,শীতকাল বাঙালির সব ধরনের চারিত্রিক গুণগুলোকে তুলে ধরে তেমনি এই শীতকালের মরশুমে ভোজনরসিক,ভ্রমণপিপাষু বাঙালির পরিচয় যেটা ছাড়া অসম্পূর্ণ,সেটা হল চড়ুইভাতি বা বনভোজন বা যাকে আমরা বলি পিকনিক। আজ বলব তেমনি এক অভিজ্ঞতার কথা।


আমি তখন সদ্য কলকাতা ছেড়েছি,উচ্চশিক্ষার কারণে এসেছি ব্যাঙালোরে। ফলতঃ বুঝতেই পারছেন কতটা মনখারাপ আর বিষন্নতা একজন কলকাতাবাসীর হতে পারে। গঙ্গার হাওয়া,মেট্রোরেল, শিয়ালদহ স্টেশনে হকারের ডাকাডাকি,বইমেলা, ফুচকা,,,,,, এককথায় সব আবেগকে পিছু ফেলে চলে আসা।এখানে এসে নানা ভাষাভাষী, নতুন বন্ধু হয়েছিল ঠিকই কিন্তু মন সারাদিনে একবার বাংলায় কথা বলার জন্য ছটফট করত,কত আর কলকাতা ফোন করে মন ভরে বলুন।


সেদিন ক্লাসে আমাদের পরিচয়পর্ব চলছে,সবাই কে কোথা থেকে এসেছি আর জায়গার কি বিশেষত্ব তাই নিয়ে আলোচনা চলছে,এমন সময় একজন বলে উঠলো যে সে গুয়াহাটি থেকে। ওতেই হবে,বাংলা জানা বাঙালি, আর কি চাই......বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগলো না। ধীরেধীরে জানতে পারলাম আমরা বেশ কয়েকজনই বাঙালি আছি, জমে উঠল আড্ডার আসর পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে। একদিন তেমনি সবাই গল্প করছি,স্মৃতিচারণ করছি,হঠাৎ একটি ছেলে বলল,"আচ্ছা! আমরা এখানেই মিনি কলকাতা করতে পারি না? মানে ধর্, সবকিছু যদি সবাই মিলে এখানেই পালন করি".......... কথাটা বেশ মনে ধরল সবারই।সবাই মিলে তাই ঠিক করলাম এর সূচনা করব পিকনিক দিয়েই। এখানে দুই ধরনের স্টুডেন্ট ছিলো, এক আমরা,যারা হস্টেলে থাকতাম;আর এক দল যারা বাইরে থাকত।পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা রান্নার ভার নিলাম আর ওরা গাড়ি এবং যাবতীয় অন্যান্য। কিন্তু প্রশ্ন হল টাকা, এই কয়েকজন মিলে তো এতকিছুর আয়োজন হবে না,তাছাড়া কলেজ থেকে পারমিশন পাওয়া যাবে না।তাই ঠিক করলাম আরও লোকজন বলব এবং সেইমতো সবাইকে দলে নিতে শুরু করলামও। যেহেতু সবাই ইয়াং তাই ঘুরতে যাবার কথায় একপায়ে রাজি হ'য়ে গেল,কাউকেই রাজি করাতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। শুরু হলো আয়োজন। 


সবাই ছেলেমানুষ, তাই বুদ্ধিতে যেমন এল, করা হল বাজার,ব্যবস্থা হলো গাড়ির। কিন্তু রান্নার কি হবে?গ্যাস-চুলা কোথায় ভাড়া দেয় জানা নেই, আর বেশি টাকাও ওঠেনি তাই ঠিক হলো সবাই মিলে রান্না করে হস্টেল থেকেই নিয়ে যাওয়া হবে।সেইমতো হস্টেলের ছোট ছোট ইলেকট্রিক হিটারে শুরু হলো কাঁচা-পাকা হাতের রন্ধনপ্রক্রিয়া।

সে যেন এক ধুন্ধুমার কান্ড। তেলে ঝোলে একাকার। ওইটুকু হিটারে যেমন তেমন ভাবে তৈরি করা হল পনির,আলু-ফুলকপি,জিরা-রাইস্, আলুভাজি, আর মুরগির মাংস, যদিও মাংসটা বাইরে থাকা একটা মেয়ে বানিয়ে এনেছিল।যাই হোক,বানানোতো হল যেমন-তেমন ভাবে কিন্তু নিয়ে যাওয়া হবে কিসে? শেষে অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করা হল সবার স্নানের বালতি ধুয়ে তাতেই নিয়ে যাওয়া হবে।যেমন ভাবনা তেমন কাজ,বালতিতে সব ভরে খবরের কাগজ দিয়ে মুখ ঢেকে দেওয়া হল। সব কিছু করে উঠতে প্রায় রাত তিনটে বেজে গেল,তারপর উত্তেজনায় কারও আর ঘুম আসে কি? তাই সবাই কে কি পরবে তাই ঠিক করতে একে অন্যের ঘরে ভিড় জমালাম।

সবাই স্নান সেরে সেজেগুজে অপেক্ষা করতে থাকলাম গাড়ির। মুশকিল হলো কলেজ থেকে আমরা অনুমতি  পাইনি,শুধু কয়েকজন প্রফেসর আমাদের সাপোর্ট করেছিলেন। রবিবার, ভোর ৫ঃ৩০মিনিটে তাই বিনা অনুমতিতেই ভয়ে ভয়ে রওনা হলাম করতে চড়ুইভাতি। জায়গাটা হল শিবসমুদ্রম্, দারুণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মনোরম ঝর্ণা।ঠিক বাঙালি নিয়ম মেনে শুরু হল সবকিছু। যেহেতু, আমি মেন আয়োজক ছিলাম তাই সকালের খাবারে বাঙালি কায়দায় ছিল পাউরুটি, ডিম,কলা,মাখন আর কেক।আপনজনের থেকে আলাদা, সবাই যেন খুশিতে আত্মহারা হ'য়ে যায় এই আয়োজনে। যথারীতি গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পৌঁছতে রোদ চড়া হয়ে যায়,তার উপর সারা রাস্তা নাচ-গান করতে করতে আধা ক্লান্ত। 

গন্তব্যে পৌঁছে  শুরু হল আসল মজা। গানের লড়াই, ক্রিকেট, আড্ডা,জলে লাফালাফি এইসব চলল প্রাণ খুলে।তারপর যথারীতি বিছানার চাদর পেতে শুরু হল মধ্যান্নভোজন। সবাই যেন সেই পরিবেশে একসাথে খেতে-খেতে মনে হলো বাড়িতে বসে খাচ্ছিলাম। সব শেষে এবার ফেরার পালা।সবার মন খারাপ,এই দিনটা যদি এখানেই থেমে যেত, কিন্তু হায়! সময় তো কারো বাধা থাকে না। ফেরার পথে আবার একবার গাড়ি থামিয়ে একটা ছোট বিরতি নিলাম,আসলে যতটা সময় সেদিনের সেই আনন্দকে লুটে নেওয়া যায় সেটাই উদ্দেশ্য।

আমরা যারা হস্টেলের তাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি বাকিদের নিয়ে চলে গেল।দারুণ ক্লান্তি আর মজার রেশ নিয়ে যে যার ঘরে গিয়ে কোনরকমে শরীরটাকে টেনে নিয়ে পরিস্কার হয়ে এলিয়ে গেলাম বিছানায়।পরদিন কলেজ যাওয়ার পর যদিও খুব বকা খেতে হয়েছিল প্রিন্সিপালের থেকে, এভাবে যাওয়ার জন্য কোন অভিভাবক ছাড়া,তবে পরে যেকোন ঘোরার আয়োজনে আমাদেরই ডাক পড়তো সবার আগে। সে যাই হোক,সেদিনের সেই সাহসী চড়ুইভাতির জমজমাটি আয়োজন আর তার অনাবিল আনন্দ হৃদিপটে আঁকা রয়ে গেছে অনন্তকালের জন্য। পকেট মানি আর নিজেদের খাটুনি দিয়ে আয়োজিত সেই চড়ুইভাতি বা পিকনিক আমার সেরা পিকনিকের অভিজ্ঞতা। আর আজ সেই আনন্দ আমার পাঠক পরিবারের সাথে ভাগ করে নিতে গিয়ে আবারও একবার স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়ে যেন সেই একইভাবে অনাবিল আনন্দের আমেজে ভিজিয়ে নিলাম নিজেকে।।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু