বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

ফাগুন হাওয়া

"রাকেশ, গাড়ি বার করো। আমি বেরোবো।"

"জি ম্যাডাম।"

বলাকা মিত্রের নির্দেশমতো গ্যারাজ খুলে ফোর হুইলারটিকে বার করে রাকেশ। ম্যাডামকে এগিয়ে আসতে দেখে গাড়ির দরজাটা খুলে দিল সে। তারপর ড্রাইভিং সিটে উঠে স্টার্ট দিতে যাবে, ঠিক তখনই তীব্র কণ্ঠে ধমক দিয়ে উঠলেন বলাকাদেবী, "এ কি রাকেশ! সিটবেল্ট পরোনি কেন? তোমায় আমি এর আগেও বহুবার বলেছি যে, ড্রাইভিংয়ের সময় সিটবেল্ট পরে নেবে।"

"সরি ম্যাডাম, ভুল হয়ে গেছে।"

"ভুল! জানো এই ভুলের পরিণাম কী হতে পারে? একটা ছোটোখাটো ভুলই বড়ো বিপদের ঘূর্ণিঝড় বয়ে আনে জীবনে। আমি তো জানি..." শেষের কথাগুলো নিজের মনেই বিড়বিড় করতে করতে একসময় মিলিয়ে আসে বলাকাদেবীর কণ্ঠস্বর।

জনহীন হাইওয়ের উপর দিয়ে সজোরে ছুটে চলেছে গাড়িটা। গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে বেজে চলেছে, "ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান..." আধখোলা জানালার কাঁচটি সম্পূর্ণ নামিয়ে দিলেন বলাকাদেবী। বসন্তের মিঠে হাওয়া ক্রমাগত ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর চুলগুলোকে।

"অ্যাই, কি গো! তুমি তো কিছুই বলছ না। কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?"

"উফ! এত প্রশ্ন কোরো না তো। একটু শান্ত হয়ে বসো।"

"কিন্তু আমার চোখের কাপড়টা খুলে দাও না, প্লিজ! সেই কখন থেকে..."

"চুপ করে বসো। চলে এসেছি প্রায়। এই আরেকটু গেলেই..."

কথাটা শেষ করতে পারেন না অখিলেশ মিত্র। বারো চাকার লরিটা কখন যে একেবারে তাঁদের গাড়ির মুখোমুখি এসে পড়েছে, তা খেয়াল করেননি তিনি। তৎক্ষণাৎ গাড়ির স্টিয়ারিংটা ঘোরাতে যাবেন, কিন্তু সজোরে ধাক্কা লাগল দৈত্যাকৃতি লরিটার সঙ্গে।

হঠাৎই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা। একটা অস্ফুট শব্দ করে গোঙিয়ে উঠলেন বলাকাদেবী। তীব্র যন্ত্রণার অনুভূতি নিয়েও তিনি হাত বুলিয়ে চলেছেন পেটের উপর।

"গাড়ির কাঁচটা তুলে নিন ম্যাডাম। কেউ রঙ-টঙ ছুঁড়তে পারে।"

রাকেশের কথায় খানিক নড়েচড়ে উঠলেন বলাকাদেবী। একটা লম্বা জ্যামের সামনে আটকে পড়েছে গাড়িটা। পাশে চোখ পড়তেই বলাকাদেবী দেখলেন, কিছুটা দূরে মেঠো রাস্তার দু'ধারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পলাশ গাছ। বসন্তের হাওয়ায় ঝরে পড়া ফুলের পাপড়িগুলো যেন রাঙিয়ে দিয়েছে সমগ্র রাস্তাটাকে!

"রাকেশ, আমরা কি এসে পড়েছি?"

"হ্যাঁ ম্যাডাম, আর মিনিট পাঁচেক গেলেই..."

কথাটা শেষ হতেই গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়েন বলাকাদেবী। দূর থেকে ভেসে আসছে রাঙামাটির গন্ধ। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো আবির হাতে ছুটে চলেছে একটা সরু রাস্তা ধরে। বলাকাদেবী এগিয়ে গেলেন সেইদিকে।

"রাঙাদিদি তুমি?" ওদের মধ্যে একটা মেয়ে এগিয়ে আসে বলাকাদেবীর সামনে। ওর নাম, বিন্নি।

"কেমন আছ তোমরা সবাই? আর বাকিরা কোথায়?"

"আমরা সবাই খুব ভালো আছি রাঙাদিদি। বাকিরা আশ্রমবাড়িতে। তুমি যাবে তো?" ওদের মধ্যে থেকে বলে উঠল পিকলু।

"যাব তো! একটু দাঁড়াও..."

ভ্যানিটি ব্যাগটা থেকে একটা পার্সেল বার করলেন বলাকাদেবী। পিকলুর হাতে দিয়ে বললেন, "এর মধ্যে বিভিন্ন রঙের আবির আছে। সবাই আনন্দ করে রঙ খেলো, কেমন?"

আবিরের বাক্সটা পেয়ে বাচ্চাগুলো বেজায় খুশি! ওদের মুখের রঙিন হাসিগুলো দেখে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে বলাকাদেবীর। স্বামী ও গর্ভজাত সন্তানকে হারানোর পর প্রতিবছর এই দিনটাতে বাচ্চাগুলোর সঙ্গে সময় কাটিয়ে সেইদিনের দুঃখকে ভুলে থাকেন তিনি। তবে জীবনের সব দুঃখ কি এত সহজে ভোলা যায়? কিছু কিছু দুঃখ এতটাই পীড়াদায়ক হয় যে সেটা থেকে মুক্তির উপায় নিজেকেই অনুসন্ধান করতে হয়। আর দুঃখের মধ্যেও এক চিলতে সুখ খুঁজে নিতে ক'জনই বা পারে!

"শুভ দোলযাত্রা, রাঙাদিদি।" কচি-কচি হাতগুলোর সচকিত স্পর্শে ভাবনার আঁধার কেটে যায় বলাকাদেবীর মন থেকে। তিনিও ওদের সঙ্গে রঙ খেলায় মেতে উঠেছেন।

"রাকেশ, এবার চলো।" ডোর খুলে ব্যাকসিটে উঠে বসলেন বলাকাদেবী। তাঁকে এগিয়ে দিতে আশ্রমের বাচ্চাগুলো এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। মৃদুবেগে গাড়িটা চলতে থাকল রাঙামাটির পথ ধরে। বিকেলের অস্তগামী সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে। বলাকাদেবীর মনের আঙিনা জুড়ে তখনও খেলে বেড়াচ্ছে বাচ্চাগুলো। সকালের গানটাই পুনরায় বেজে চলেছে স্পীকারে...

"পূর্ণিমাসন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়

রূপসাগরের পাড়ের পানে উদাসী মন ধায়,

তোমার প্রজাপতির পাখা–

আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন-স্বপন-মাখা

তোমার চাঁদের আলোয়–

মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান

তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান...

ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান...

আমার আপনহারা প্রাণ আমার বাঁধন-ছেঁড়া প্রাণ

তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান...

ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান...

ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান..."

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু