বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

চন্দ্রাবতীর দোল

চন্দ্রাবতী প্রতিবছরের ন্যয় এবছরেও সকাল থেকে সেই একই বায়না ধরেছেন। আজকেও তাকে বুড়ো শিব-তলার মাঠে নিয়ে যেতেই হবে। এখন প্রায় বেলা দশটা বেজে গেছে অথচ মুখে একটি কুটোটিও কাটেননি তিনি। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যতক্ষণ না তাকে বুড়ো শিব-তলার মাঠে না নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ততক্ষণ তিনি জল পর্যন্ত স্পর্শ করবেন না।

বড় ছেলে শিবশংকর তাঁর ঘরে এসে দু-বার হাতে পায়ে ধরেছে কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। চন্দ্রাবতী একইভাবে গোঁ  ধরে বসে রয়েছেন। 

বড়-বৌমা নন্দিনী, ছোট-বৌমা উমা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসছেন। উমা তো বলেই ফেলল, “বাবাহ, মায়ের কি সখ দেখোনা দিদি। পঁচাশি বছর বয়স হতে চলল, নাতি নাতনির বিয়ে হয়ে গেল, ছেলে বৌমা’রা সব বুড়ো বুড়ি হয়ে গেলাম, আর তিনি এখনও নাকি বুড়ো শিব-তলায় গিয়ে দোল খেলবেন।“

শিবশংকর এসে বলল, “মা এই প্রতিবছর এই দিনে তোমার একই অবস্থা। এত বয়স হয়ে গেল তবুও তোমার দোল খেলার শখ মিটল না। এই বয়সে কে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দোল খেলে মা?”

চন্দ্রাবতী চশমার আড়াল থেকে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার মধুটা থাকলে আমায় নিয়ে যেত। এ বছর সে এখনও আসেনি, তাই তোদের এত তেল মাখানো। আমাকে… আমাকে না নিয়ে গেলে আমি গলায় দড়ি দোব। এই বলে দিলুম।”

বড় ছেলে বিরক্ত হয়ে বলল, “দোল খেলতে নিয়ে যাব না বলে গলায় দড়ি দেবে তুমি? এ কেমন কথা মা? আমি-তো বুঝিনা এই বাড়ির উঠোনে তোমার দোল খেলতে অসুবিধা কোথায়? প্রতিবছর বাড়ি থেকে এতটা দূরে গিয়ে কি যে করো!“

ঠিক সেই সময় বাইরে ভটভট করে একটা বাইকের আওয়াজ পাওয়া গেল। চন্দ্রাবতী সেই আওয়াজ শোনামাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরলেন। পাশে রাখা লাঠিটা হাতে নিয়ে যেমন করে হোক ছেলের পাশ কাটিয়ে বাড়ির বাইরে বেরোতে বেরোতে বললেন, “ওই-যে… ওই-যে আমার মধু এসে গেছে। আর তোদের কাউকে যেতে হবে না।“ তারপরেই চিৎকার করে ডাকলেন, “মধু ও মধু এলি বাবা? আমাকে নিয়ে যাবি বুড়ো শিব-তলায়? বাবা আমাকে নিয়ে যাবি?”

বাইকটা থেকে নেমে উঠোনে দাঁড়াল বছর পঁচিশের এক যুবক। পরনে হলুদ পাঞ্জাবী, সাদা পাজামা… মাথায় ফেট্টি বাঁধা। ততক্ষণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উঠোনেই নেমে গেছেন চন্দ্রাবতী। 

যুবকটি এসে জড়িয়ে ধরল চন্দ্রাবতীকে, তারপর পায়ে আবীর দিয়ে নমস্কার করে বলল, “তুমি কি করে ভাবলে ঠাম্মি আজকের দিনে তোমার মধু তোমায় দেখতে আসবে না?”

চন্দ্রাবতী যুবকের মুখে পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “চ বাবা আমায় নিয়ে চ…”

ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন নন্দিনী। মধুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আজকের দিনেও বাড়ি ঢুকবি না বাবা? দুটো খেয়ে যা না মানিক আমার!”

মায়ের পায়ে নমস্কার করে মধু বলল, “না মা, এই বাড়িতে মধু খেলে তোমার বরের সম্মানহানি হতে পারে। আমার আদর্শ আমাকে এই বাড়ির অন্ন খেতে মানা করে মা।“

নন্দিনীর চোখে জল এলো। আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছে সে বলল, “তোদের বাপ ছেলের আদর্শের মাঝে আমার কি দোষ বলত! আমি কেন আমার ছেলের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হব?”

মা’কে জড়িয়ে ধরে মধু বলল, “বাবা যাদের পেটে লাথি মারে আমি তাদের পেটে ভাত জোগাই মা। ওই জঙ্গলের মানুষেরা এই তথাকথিত ভদ্র ঘরের মানুষদের থেকে অনেকাংশে ভালো। ওঁদের সারাটাজীবন একটু সাদা ভাতের জন্য লড়তে হয়। আর ওঁদের সেই সাদা ভাতের জোগান দেওয়ার দায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। আর এই বাড়িতে থেকে সেই কাজ আমি করতে পারব না, তোমার স্বামী আমাকে সেই কাজ করতে দেবে না। তাই আজ পাঁচটা বছর আমি আলাদা তোমাদের থেকে। ওই জঙ্গল আমাকে ডাকে মা, ওঁদের ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।”

পাশ থেকে চন্দ্রাবতী মধুর মাথায় পরম স্নেহে হাত বোলালেন। আজ তাঁর আর একজনের মুখ মনে পড়ছে। সেই মানুষটাও ঠিক এমনটাই ছিলেন।


একটা টোটো ভাড়া করে চন্দ্রাবতীকে বুড়ো শিব-তলায় নিয়ে এসেছে মধু। বাইকে তিনি বসতে পারেন না। তাই বাইকটা বাড়ির উঠোনেই রেখে এসেছে। প্রতিবছর দোলের দিন চন্দ্রাবতী এখানে আসেন। বুড়ো শিব-তলার বট গাছটার নীচে মিনিট পনেরো বসে থাকেন, আবার বাড়ি চলে যান। 

সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো থানে গিয়ে বসলেন চন্দ্রাবতী। মধুও এসে বসল তাঁর পাশে। কিছুটা দূরে কয়েকজন ছেলেমেয়ে দোল খেলছে। বুড়ো শিব-তলার থানের উপর নানা রঙের আবীর ভর্তি। 

সামনের দিকে তাকালেন চন্দ্রাবতী। মধু তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ঠাম্মি, প্রতিবছর এখানে এসে কি দেখো তুমি অমন করে তাকিয়ে? এতবছর ধরে তোমায় জিজ্ঞেস করি কিন্তু তুমি বলো না। আজ তোমাকে বলতেই হবে।”

চন্দ্রাবতী নিজের ঝোলা চামড়ার হাতটা মধুর মাথায় রাখলেন, তারপর খুব শান্ত স্বরে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলে, “আমার যৌবন দেখি মানিক আমার… আমার যৌবন।”

মধু ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমার যৌবন মানে? “

চন্দ্রাবতী মুচকি হেসে বললেন, “আমার প্রথম প্রেম, আমাদের প্রথম ছোঁয়া সব যে এখানেই। আজকের দিনেই তিনি আমাকে প্রথম রাঙিয়েছিলেন, এই এখানেই। এই বুড়ো শিব-তলার মাঠেই।“

মধু হাসল। তারপর বলল, “ও এই ব্যাপার তাহলে… দাদুর সাথে তাঁর মানে এখানেই দেখা তোমার!”

চন্দ্রাবতীও হাসলেন, বললেন, “ধুর পাগল ছেলে। তোর দাদুকে তো আমার বাবা দেখেছিলেন, আমি দেখিনি। বিয়ের দিকে সরাসরি দেখেছিলাম ওঁকে। আমি যাকে দেখেছিলাম সে অন্য কেউ, সে অন্যরকম, অন্য ধারার, অন্য আদর্শের মানুষ।“

মধু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “মানে? আমি কিছু বুঝলাম না ঠাম্মি।”

চন্দ্রাবতী আবারও সামনের দিকে তাকালেন। ফিরে গেলেন আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগের সেই দোলের দিনে। যেদিন তাঁকে ছুঁয়েছিল প্রেম, নিজের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল তাঁকে সেই মানুষটা।

সেইদিন প্রথম দেখা করতে এসেছিল চন্দ্রাবতী সেই মানুষটার সঙ্গে এই বুড়ো শিব-তলার মাঠে। দিনটা দোলের দিন। এমনিতে প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার পথে দেখা হত দিবাকর এর সাথে। ঘণ্টে কাকার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেত ছেলেটা আর আড় চোখে তাকিয়ে থাকত চন্দ্রাবতীর দিকে।

চন্দ্রাবতী তখন এগারো ক্লাসে পড়ে। গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের মত স্কুল ছাড়িয়ে বিয়ে দেননি তাঁর বাবা। এই গ্রামে সেই একমাত্র মেয়ে ছিল সে সময়ের যে উচ্চ-মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরিয়েছিল। 

ছ’ফুট লম্বা, রোগা, মুখে চাপ দাড়ি, চাপা বর্ণের দিবাকর প্রতিদিন স্কুল ছুটির সময় দাঁড়িয়ে থাকত ঘণ্টে কাকার চায়ের দোকানে। চোখে চোখে কথা হয়েছিল দুজনের কিন্তু সামনা-সামনি কথা তখনও হয়নি।

দোলের দিন বন্ধুদের সাথে এই বুড়ো শিব-তলায় দোল খেলছিল চন্দ্রাবতী। ঠিক সেই সময় তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল দিবাকর। আবীরের পাত্র থেকে লাল আবীর তুলে রাঙিয়ে দিয়েছিল চন্দ্রাবতীর মুখ। সেই প্রথম ছুঁয়েছিল ভালোবাসা চন্দ্রাবতীকে, রাঙিয়ে দিয়েছিল নিজের রঙে। 

চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল চন্দ্রাবতী। আর ঠিক তখনই একটা বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠেছিল চারিদিক। চন্দ্রাবতী যখন চোখ খুলেছিল তখন দেখেছিল দিবাকর তাঁর পায়ের কাছে লুটিয়ে পরেছে, তাঁর পরনের সাদা পাঞ্জাবীটা লাল হয়ে উঠেছে কাঁচা রক্তে। দূরে থেকে ছুটে আসছে একদল পুলিশ বাহিনী।

গুলিটা দিবাকরের মাথায় লেগেছিল। মাথার পেছন থেকে ঢুকে ভেতরে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল মৃত্যু। 

চন্দ্রাবতীর বন্ধুরা ওঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে। পাথর হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। তাঁর প্রথম ভালবাসা তাঁর পায়ের কাছে রক্তে রাঙা হয়ে লুটিয়ে পরেছিল। তাঁর দোলের রঙ ফুটে উঠেছিল দিবাকরের কাঁচা রক্তে।

মধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ওর চোখের কোণে চিকচিক করছে কষ্ট। আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল চন্দ্রাবতীকে, “কিন্তু ওঁকে মারল কেন ঠাম্মি?”

চন্দ্রাবতী সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “পরে শুনেছিলাম ও নাকি কোন এক মাওবাদী সংগঠনের সাথে কাজ করত। জঙ্গলের মানুষদের মুক্তির জন্য লড়ত ঠিক তোর মত।“

মধু হাসল। চন্দ্রাবতী লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মনে মনে ভাবলেন, “সবটা তোকে বলতে পারলাম না মধু। আমাকে ক্ষমা করিস। সেদিন দিবাকরের কাঁচা রক্তে আমার সিঁথিটা ভরে উঠেছিল। আমি আজও তাঁরই প্রেমিকা। সে আজও আমার কৃষ্ণ আর আমি আজও তাঁর রাধা।”

ওঁরা দুজনে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। কি জানি এই পঁচাশি বছরের রাধা আগামী বছরে তাঁর কৃষ্ণের কাছে আসতে পারবে কিনা! নাকি পরলোকে তাদের মিলন ঘটবে, যেখানে দিবাকর আজও হয়ত চন্দ্রাবতীর অপেক্ষায় দিন গুনছে।



সমাপ্ত 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু