বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

৯-বছর বয়সের বসন্ত

গেয়েছি রবীন্দ্রনাথের গান: “আজি  বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে কোরো না বিড়ম্বিত তারে।“ অথচ, ছোটবেলা থেকেই নিষেধ- অচেনা কারুর সঙ্গে মেলামেশা ক’রতে নেই। তবু, অন্তরঙ্গ হ’য়েছি প্রাইমারী স্কুলে, এই আচার-বিচার-নিষেধ শেখার আগে। কুণ্ঠিত হ’য়ে নিবেদন ক’রছি গ্রীষ্মের ছুটির আগে এক বসন্তের কাহিনী; আমার  বয়স তখন ৯।

 

ভাইবোনেদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলাম আমি; আমার দাদা পড়তো সেন্ট-জেভিয়ার্স কলেজে আর দিদিরা বেলতলা গার্লস স্কুলে। বাবা আমাকে দিদিদের স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি ক’রে দিয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম, আমি আমার দিদিদের সাথে একই ক্লাসে থাকবো আর পড়ার মজা নেবো। যখন বুঝতে পারলাম যে, আমাকে অন্য ক্লাসে ব’সতে হবে; আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ ক’রে দিলুম।


যখনই বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনেরা আমাদের বাড়ীতে আসতো, আমার বাবা-মা গর্ব ক’রে ব’লতেন স্কুলে তাঁদের ছেলেমেয়েদের জয়জয়কারের কথা; আমার দাদা অধিকাংশ বিষয়ে লেটার পেয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস ক’রেছিল; আমার দিদিরাও ক্লাসের মধ্যে সব চাইতে সেরা ছিল। বাবা-মা খুব দুঃখের সাথে বলতেন তাঁদের ছোটো মেয়ে মিলি অর্থাৎ আমি স্কুলে যাই না এবং জীবনে কিছু ক’রতে পারবো না। আমি নিজেকে দোষী মনে ক’রতাম আর যতটা সম্ভব বাড়িতে পড়াশোনা ক’রতাম; আমি আমার দিদিদের কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তাম, আমার নিজেরও কিছু বই ছিল।

পরের জানুয়ারীতে আমার বাবা বেলতলা গার্লস স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা ব’লতেই আমি রাজী হ’য়ে গেলাম। আমার বাবা আমাকে আবার ক্লাস ওয়ানে ভর্তি ক’রতে ইচ্ছুক ছিলেন না; গত বছর আমাকে স্কুলে ভর্তি করার ফি নষ্ট হ’য়েছে। উনি ক্লাস টুয়ের জন্যে পরীক্ষা ক’রতে অনুরোধ করলেন, টিচার এবং আমার বাবাকে অবাক ক’রে দিয়ে, আমি ক্লাস টুয়ের জন্যে যোগ্যতা দেখালাম; নিয়মিতভাবে স্কুলে যাওয়া শুরু ক’রলাম। আমার ক্লাসে কুড়িটি মেয়ে ও পাঁচটি ছেলে ছিল। সাধারণতঃ ছেলেরা দুষ্টু হ’তো আর হৈচৈ ক’রতো। ছেলে পাঁচটি সামনের বেঞ্চে ব’সতো; অলকা নামে একটি মেয়ে ক্লাসের মনিটর ছিল,  যে সময়ে টীচার থাকতো না সে সময়ে ও ক্লাসের সবাইকে চুপ ক’রিয়ে রাখতো, ভয় দেখিয়ে। খুব শীগ্গিরই আমি প্রণবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলাম,  কারণ ও আমাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকতো এবং আমরা স্কুল থেকে একসাথে বাড়ি ফিরতাম।

ক্রমে ক্রমে আমি অন্যান্য বন্ধুদের সাথেও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি, বিশেষ ক’রে বাবলু নামে একটি ছেলের সঙ্গে; ও সামনের বেঞ্চে বসতো আর টিচাররা প্রশ্ন ক’রলে সবার আগে উত্তর দিতো। ও সব সময়ে সকলের নজর আর আদর কাড়তো ব’লে আমার হিংসে হতো; তাই আমিও তাড়াতাড়ি হাত তুলতে শুরু ক’রলাম। এইভাবে আমি পড়াশোনা ভালো ক’রতে লাগলাম; ক্লাস টুয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হ’লো বাবলু, আমি সেকেণ্ড। ধীরে ধীরে, বাবলু আর আমি একে অপরকে বিশ্বাস ক’রতে শুরু ক’রলাম; যদি কোন কারণে আমাদের কেউ ক্লাসে আসতে না পারে তবে আর একজন বুঝিয়ে দিতো ক্লাসে কী শেখানো হ’য়েছে। আমি পেছনের বেঞ্চেই ব’সতে থাকলাম, বাবলু ফ্রন্ট বেঞ্চে; ক্লাস থ্রীর বার্ষিক পরীক্ষায়, ফার্স্ট হ’লুম আমি, আর বাবলু সেকেণ্ড।

আমরা ক্লাস ফোরে উঠেছি। ৪৫-দিনের গরমের ছুটি শুরু হবে মে মাসের গোড়াতে। তার এক সপ্তাহ আগে, শনিবারে দেখলাম – ক্লাসের সবাই উত্তেজিত হ’য়ে কিছু ক’রছে। শনিবারে আমাদের হাফডে, টিফিনের পর কোন ক্লাস নেই। সেই শনিবারে,  অলকা ক্লাসের সকলের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে একটা পার্টি দেবে ব’লেছিল; কী উপলক্ষ্য তার কোন ধারণা ছিল না আমার; বুঝলাম ক্লাসের শেষে, যখন অলকা আমাকে ঘরের কোণে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা লাল শাড়ী পরিয়ে দিল। অলকা ব’ললো, ‘তোকে আজ অভিনয় ক’রতে হবে’; আমার মাথায় কনের মুকুট পরিয়ে দিলো; তারপরে, আর একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো কনের আসনে।  মিনিটখানেক পরে আমার পাশের একটি সাজানো আসনে বসানো হলো বাবলুকে; ওর মাথায় বরের টোপর। তারপর প্রণব এলো পুরোহিত সেজে, কিছু সংস্কৃত মন্ত্র বলে ঘোষণা ক’রলো:- বাবলু এবং আমি এখন থেকে স্বামী-স্ত্রী।  মেয়েরা শাঁক বাজালো, উলু দিলো; ছেলেরা দিলো হাততালি। তারপরে হ’লো সিঙ্গাড়া, নিমকি, জিলিপি আর মুগের নাড়ুর ভোজ।

তারপর যখন সবার নিজের নিজের বাড়িতে ফেরার কথা, তখন অলকা এবং কয়েকটা সেয়ানা মেয়ে হুকুম দিলো, ‘বাবলুর বিয়ে হ’য়ে গেছে, কাজেই ওর নিজের বাড়িতে ফেরা চলবে না; আমাদের গার্লস স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী এখন থেকে বাবলুকে মিলির বাড়ীতে ঘরজামাই হ’য়ে থাকতে হবে’; অর্থাৎ ও যাবে আমার সঙ্গে আমাদের বাড়ীতে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, বাবলুও আমার সঙ্গে আসতে চায়। আমি তো ঘাবড়ে হতভম্ব – মা কিছুতেই তার ৯ বছরের মেয়েকে নতুন বর নিয়ে ঢুকতে দেবেনা আমাদের ২-বেডরুমের ছোট ফ্ল্যাটে, যেখানে আমার দাদা-দিদিরা আর বাবা-মা থাকে; দাদা-দিদিদের কারুরই বিয়ে হয়নি এখনো। তাই, আমি প্রস্তাব দিলাম যে প্রথমে বাবলুর ফ্ল্যাটে গিয়ে ওর মার অনুমতি নিতে হবে; ক্লাসের সবাই মিলে চ’ললাম বাবলুর বাড়ীতে।

চতুর অলকা বাবলুর মার সঙ্গে দেখা ক’রতে ভেতরে ঢুকলো আর ওঁকে অনুরোধ ক’রলো এক সপ্তাহের জন্যে বাবলুকে বন্ধুর বাড়িতে থাকতে দেওযার জন্যে। বাবলুর মা হয়তো ভেবেছিলেন যে, বাবলু অলকার সাথে থাকবে, আর অলকার মায়ের সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব ছিল, তাই কোনও আপত্তি ক’রলেন না। বাবলুর বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন; বাবলু তার মা আর চার দিদি এক-বেডরুমের ফ্ল্যাটে থাকতো; অলকার সাথে এক সপ্তাহের থাকার জন্যে তার মা খুশিমনেই মত দিলেন। বাবলু তার বইপত্র, জামাকাপড় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিটবাগে ভ’রে বেরিয়ে এলো আমার সাথে যাবার জন্যে।

বসন্ত জাগ্রত দ্বারে; উত্তেজিত আমি ন-বছরের কল্পনার যৌবনের ভারে; তবু আমার সহপাঠীদের ব’ললাম, ‘আমি বাবলুকে কাছে রাখতে চাই; কিন্তু মাকে একথা বলার সাহস নেই আমার।‘

অলকা ব’ললো, 'চিন্তা ক’রিস না; আর সবাই বাড়ি ফিরে যাক; আমি তোকে আর বাবলুকে তোদের বাড়ীতে নিয়ে যাব আর তোর মাকে বুঝিয়ে বলবো।‘

ওর যা কথা তাই কাজ; ও আমার মাকে ব’ললো, 'বাবলুর মা ওর সমস্ত দিদিদের নিয়ে ওদের মামার বাড়ীতে গেছে, কারণ দিদিমা খুবই অসুস্থ। ছুটির আগে এক সপ্তাহের জন্যে বাবলুকে স্কুলে যেতে হবে; তাই এক সপ্তাহের জন্যে কোথাও থাকতে হবে ওকে। আপনার এখানে আশ্রয় দিন ওকে। বাবলু লেখাপড়ায় ভালো; মিলির সাথে ভালো থাকবে।'

মা বাবলুর কথা আগে থেকেই জানতেন; তাই তিনি ওকে থাকার অনুমতি দিতে দ্বিধা করেননি। আনন্দে আমি আমার নতুন বরকে চুমু খেতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার এই বড় খবর মা বা ভাইবোনেদের জানানো চ’লবে না, তাই আমি মায়ের পায়ের ধুলো নিয়ে আমার কপালে ছুঁলাম; বাবলুও  ঠিক তাই ক’রলো। মা এক অনুগত কন্যা এবং তার অনুগতা সহপাঠীকে দেখে খুশি হ’লো। সাধারণতঃ শনিবার স্কুল থেকে ফেরার পরে আমি লাঞ্চ ক’রতাম। মা জিজ্ঞেস করাতে ব’ললাম, ‘আমরা স্কুলে ফিস্ট ক’রেছি’; তাই বাবলু আর আমি দুপুরের খাবার ভাগ ক’রে নিলাম।

মা দেখিয়ে দিলেন বাবলু কোথায় ওর কীটবাগ ও জামাকাপড় রাখবে; আমি দেখালুম কোথায় ওর বইপত্র রাখবে, আমার বইয়ের গাদার কাছাকাছি। বাবলু সেখানে ব’সলো আর একটি গল্পের বই পড়তে শুরু ক’রলো; আমি বেরিয়ে পড়লুম আমার বন্ধুদের সাথে পুতুল খেলার জন্যে।


সন্ধ্যায় আমি যখন বাড়ী ফিরলাম, তখন আমার সাথে ছিল আমার বন্ধু নন্দিতা। নন্দিতা আমাকে অতিরিক্ত খুশী দেখে প্রশ্ন ক’রেছিল; আমি না ব’লে পারিনি যে আমাদের ফ্ল্যাটে বাবলু র’য়েছে আর কেন র’য়েছে। নন্দিতা বাবলুকে দেখতে আগ্রহী ছিল; আমাদের বাড়ীতে বাবলু কেমন মানিয়ে নিয়েছে তা দেখার জন্যে আমিও উৎসুক ছিলাম।

ফিরে দেখলাম বাবলু খালি গায়ে একটা হাফপ্যান্ট পরে বসে, ক্যারম খেলছে দাদার সঙ্গে। নন্দিতা ওর সঙ্গে একটু কথা ব’লেই বেরিয়ে গেলো। আমি বাবলুকে ডেকে নিলাম বেডরুমে, বাবলুর সঙ্গে বসে হোমওয়ার্ক ক’রলাম; আমাদের আলাদা পড়ার ঘর ছিল না; দিদিরাও একই ঘরে পড়াশোনা ক’রতো।

ঘন্টাদুয়েক পরে মা এসে ব’ললো এবার খাবার সময় হ’য়েছে; আমরা বইপত্র তুলে রাখলুম; মা আমাদের খাবার দিলেন; আমাদের ডাইনিং টেবিল আর চেয়ার ছিল না; ঘরের মেঝে থালা পেতে মা খাবার দিলেন; আমরা মেঝে বসে থালা থেকে কপির ডানলা আর রুটি খেলাম।

ডিনার শেষ হওয়ার পর, ঘর দুটি আবার বেডরুম হ’য়ে গেলো; এক ঘরে আমার দাদা ও বাবার সঙ্গে বাবলু শুলো, বড় ঘরে মার সঙ্গে শুলাম আমরা তিন বোন  - ছেলেরা ছোট ঘরে আর মেয়েরা বড় ঘরে।


পরের দিন রবিবার; আমি সকালে জেগে উঠলাম। অফিস, কলেজ বা স্কুলে যাওয়ার জন্যে কোন তাড়া ছিল না; আমার দিদিরা আর বাবলু তখনও বিছানায় ছিল; আমি ওদের ঘরে ঢুকে হৈচৈ ক’রে সকলকে জাগিয়ে দিলুম। এর পরে শুরু হ’লো দাঁত মাজা আর বাথরুমে যাওয়ার লাইন, কারণ আমাদের একটাই বাথরুম ছিল।


আমাদের ফ্ল্যাটের লেআউটটা একটু বুঝিয়ে দিই। বড় ঘরটায় ছিল একটা লম্বা উত্তরমুখী জানলা, সেখান থেকে রাস্তা দেখা যেত। এই রুমের দক্ষিণের দরজা থেকে একটা লম্বা লবি বা গলি, যা গিয়ে পড়েছে  সিমেন্ট-করা উঠোনে। এই গলির পশ্চিমদিকে একটা দেওয়াল, যেটা পাশের বাড়ি থেকে আমাদের ফ্ল্যাটটাকে আলাদা রেখেছে; আর পূবদিকে একটা ছোট ঘর, যেখানে আমরা ছেলেরা গত রাতে ঘুমিয়েছি। সিমেন্ট-করা উঠোনের একপাশে ছোট বেডরুম, আর অন্য পাশে বাথরুম; বাথরুমের পাশে রান্নাঘর।

আমি দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে, দাঁড়িয়ে ছিলাম - বাথরুম খালি হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম, তখন বাবলু বেরিয়ে এলো বাথরুমের দরজা খুলে, কোনো কিছু না প’রেই। রান্নাঘরে ছিলেন মা,  উনি দৌড়ে এসে একটি তোয়ালে দিয়ে মুড়ে দিলেন ওকে, নিয়ে গেলেন ঘরে, ব’ললেন, 'এই বাড়ির নিয়ম, সব সময় জামাকাপড় প’রে চলাফেরা ক’রবে।'

মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্যে দেখেছি বাবলুকে মুগ্ধ হ’য়ে – ওর শরীর আমার থেকে অনেক আলাদা – তবু এত সুন্দর যে চোখের পলক পড়ে না ওকে দেখার সময় – আমার মনে তখন বসন্তের বাঁশী; মা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ব’ললেন ‘যা এবার বাথরুমে যা।‘

পরের সপ্তাহে, বাবলু ও আমি একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া-আসা ক’রলাম। সোমবারে আমি বাবলুর পাশে সামনের বেঞ্চে বসেছিলাম; কিন্তু টীচারদের মধ্যে একজন ব’ললেন যে আমরা খুব বেশি কথা ব’লছি, তাই আমাকে আমার ব্যাকবেঞ্চে পাঠিয়ে দিলেন; সারা ক্লাসে উঠলো একটা চাপা হাসির শব্দ; টীচার বুঝলেন না কেন।

 

পরের রবিবারে তেসরা মে থেকে শুরু হ’লো গরমের ছুটি; সকালে উঠে বাবলু আর আমি আলোচনা ক’রছিলাম  কিভাবে বাবলু  আরও কয়েক দিন আমাদের সাথে থাকতে পারে - ও কি স্কুল ছুটির পুরো মাসটাই এখানে থাকতে পারবে, সারা জীবনের জন্যেই বা নয় কেন? ঠিক এই সময়ে, কেউ আমাদের দরজায় ধাক্কা মারলো।

আমরা বেরিয়ে এসে দেখলাম, আমাদের বয়সী একটি মেয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে; মেয়েটি ব’ললো যে ও আমার পেনফ্রেন্ড রুচিরা মণ্ডল।

 

সে সময়ে ইন্টারনেট, ফেসবুক বা ইমেল চালু হয়নি, কিন্তু আমি ‘দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকার শিশু বিভাগে অংশ নিতাম; সেখানে আমার পেনফ্রেন্ড হ’য়েছিল বীরভূম-নিবাসী ১২ বছরের রুচিরা মণ্ডল। দূরের গ্রাম থেকে আমাকে দেখতে এসেছিল স্কুল ছুটির সময়।  আমি মাকে গিয়ে বললাম; মা এসে রুচিরাকে আমাদের সঙ্গে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এলেন; কিছু জলখাবার খেতে দিলেন ওকে। মা রুচিরার সঙ্গে কথা ব’লে বুঝলেন যে আমাদের বাড়ি ছাড়া কোলকাতায় আর কোথাও থাকার জায়গা নেই রুচিরার; অনেক আশা নিয়ে এসেছে ও কোলকাতা দেখবে ব’লে; এখন ওকে বীরভূমে ফেরৎ পাঠানো খুবই নির্দয়তা হবে। 

মা বাবলুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার মা কি ফিরে এসেছে?'

বাবলু ব’ললো, ‘আশা করি এসে গেছে’। রুচিরাকে থাকতে দেবার জন্যে বাবলুকে যেতে দিতে হ’লো।

রুচিরা আমাদের ফ্ল্যাটে তিন সপ্তাহের জন্যে ছিল; ওর সঙ্গে আমি আলিপুর চিড়িয়াখানা,  বিড়লা প্ল্যানেটারিয়াম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল ইত্যাদি অনেক কিছু দেখেছি; বাবলুও প্রতিটি জায়গাতে আমাদের সাথে ছিল। মেট্রোতে আমরা একটি সিনেমা দেখেছিলাম – ‘কিং সলোমন’স মাইনস'; বাবলু আর আমি একে অপরের সাথে লড়াই ক’রে গেছি, কে এই সিনেমাটা বেশী ভালোভাবে বুঝেছি সেটা প্রমাণ করার জন্যে।


পরের বছর বাবলুকে মেয়েদের স্কুল ছেড়ে যেতে হ’লো ; ও ভর্তি হ’লো চক্রবেড়িয়া স্কুলে; আমি বেলতলা গার্লস' স্কুলেই পড়াশোনা চালিয়ে গেলাম। বেলতলা গার্লসের মেয়েরা চক্রবেড়িয়ার বদমাইস ছেলেদের সঙ্গে মেশে না। আমি অনেকদিন বাবলুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি; আমার বয়স যখন কুড়ির মত, তখন বাবলুর বিয়ের নেমন্তন্ন পেয়ে দেখা ক’রতে গিয়ে জানতে পারলাম ওর বিয়ে আমার পেনফ্রেন্ড রুচিরা মণ্ডলের সঙ্গে। রুচিরার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইলাম:-

                           মোর        পরানে দখিন বায়ু লাগিছে,

                           কারে       দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে,

                           এই          সৌরভবিহ্বল রজনী

                           কার         চরণে ধরণীতলে জাগিছে।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু