বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বসন্ত জাগ্রত দ্বারে

চাকরী পেয়েছি দিল্লীতে, কাল রওনা হবো রাজধানী-এক্সপ্রেসে।

আমাকে বিদায় দেবার উৎসব হ’লো রাঙাবৌদি আর বসন্তদার বাড়ীতে। নিমন্ত্রিত কেবল আমি।  ওদের মেয়ে মিষ্টিকে দেখলাম না; হয়তো একটু তাড়াতাড়িই ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। জীবনে এই প্রথমবার বসন্তদা আমাকে ককটেল সার্ভ ক’রলো, সঙ্গে চিকেন নাগেটস্। তারপরে রাঙাবৌদির রাঁধা এলাহী ভোজ। লোভে পড়ে অনেকটা ভূরিভোজ করার পরে এল রাঙাবৌদির নিজের হাতে বানানো কেক। বাড়ী ফিরে শুয়ে পড়লাম, কয়েক মিনিটের মধ্যেই এল গভীর ঘুম।

 

রাতদুটোর সময় ফ্ল্যাটের দরজায় ধাক্কা; ঘুমচোখে দরজা খুলে দেখি– বসন্তদা- ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’; সঙ্গে একটা বড় স্যুটকেশ; ব’ললো, ‘তোমার সঙ্গে যাবো, মিলি’।

ব’ললো, ‘তোমার রাঙাবৌদি খুশী নয়, ছেলে হয়নি ব’লে। এছাড়া আমি এখন বেকার।‘

 

আমার সঙ্গে ট্যাক্সি ক’রে শিয়ালদহ স্টেশনে গেলো বসন্তদা– সর্বাঙ্গ বোরখায় ঢেকে; ও অনলাইনে টিকিট বুক ক’রেছে, শুধু একই ট্রেণে নয়, একই কম্পার্টমেন্টে, দুটো লোয়ার বার্থের একটা আমার আর একটা বসন্তদার, ট্রেণে ওর নাম মেহেরউন্নিসা। ঐনামে ওর এক স্কুলের বন্ধু ছিল, তার কিছু আইডেনটিটি ডকুমেন্ট আছে ওর সঙ্গে।

 

দিল্লীতে এক বেডরুমের ফার্নিশড্ ফ্ল্যাট; দুজনে মিলে সংসার পাতলাম; বসন্তদার অভিজ্ঞতা খুবই কাজে লাগলো। এখানে বসন্তদা আর মেহের নয় মৃণাল। আমার নতুন চাকরী টিসিএসে, সেখানে বললাম- আমি বিবাহিতা, স্বামী মৃণাল। টিসিএসের স্টাফেদের প্রায়ই বিদেশে গিয়ে কাজ ক’রতে হয় বলে, টিসিএস আমদের স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই পাসপোর্ট ক’রিয়ে দিতে চাইলো, মৃণাল ব’ললো, ‘দাঁড়াও পাসপোর্ট করার আগেই এফিডেভিট ক’রে নামটা ব’দলে ফেলি’। ওর নাম ছিল বসন্ত; হ’লো মৃণাল।

     

বসন্তদা কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে এমএসসি, ফার্স্ট-ক্লাস-ফার্স্ট, শ্যামবাজার স্কুলে পড়াবার সময় বিএডও ক’রেছিল; খুব সহজেই করোলবাগ স্কুলের এ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার হ’য়ে গেলো। বসন্তদা যখন আমার দরজায় এসে বলেছিল আমার সঙ্গে দিল্লি যাবে, তখন দুশ্চিন্তা ছিল – কী-ক’রে ওর খরচ চালাবো; এক সপ্তাহের মধ্যেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হ’য়ে গেলো।

 

দিল্লীতে আসার সাতদিন পরে মৃণাল প্রথম খোলাখুলি প্রেম ক’রলো আমার সঙ্গে। শুক্কুরবারের রাত, পরের দিন সকালে ওঠার তাড়া নেই। আমি বিছানায় আধশোয়া, পরণে একটা লুঙ্গি আর টি-শার্ট। দেখলাম- ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’- ডিনারের পরে ঘরে ঢুকলো মৃণাল, একটা মিষ্টি ক’রে চুমু খেয়ে আমার টি-শার্টটা খুলে নিল; অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো ঠোঁটদুটো; দেখতে চাইলো আমার রঙ্গীন লুঙ্গিটার ঢাকা খুলে; এক নির্মল আনন্দ প্রাণভ’রে উজাড় ক’রে ঢেলে দিলো আমার মধ্যে। তৃপ্তির আনন্দাশ্রু আমার দুচোখে। এর সাতদিন বাদে মৃণালকে জানালুম- পিরিয়ড হয়নি এবারে। দুজনেই খুশী– প্রথম চেষ্টাতেই বাজীমাৎ।

দশমাস পরে একটি মেয়ের জন্ম হ’লো; মেয়ের নাম দেওয়া হ’লো রিমি। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে মৃণাল ব’ললো, ‘এখন যদি মিষ্টি থাকতো এখানে..., রিমিকে নিয়ে অনেক খেলা ক’রতো। কবে যে মিষ্টিকে চুরি ক’রে নিয়ে আসবো?’

মৃণাল আর আমি ব্যস্ত হ’য়ে পড়লাম রিমিকে নিয়ে। কী ক’রে যে কাটতো সারাদিন জানিনা; পরস্পরের জন্যে সময় দেবার বড় একটা অবসর থাকতো না। রিমির বয়স তিন হবার পর আমরা দুজনেই কেরিয়ার তৈরী করার দিকে মন দিলাম। বছর পাঁচেক পার্টটাইম গবেষণার পর বসন্ত এলো আমাদের কেরিয়ারে; দুজনেই পি-এইচ-ডি ক’রলাম, মৃণাল ম্যাথেমেটিক্সে আর আমি কম্পিউটিংএ।

 

আর একটি বসন্তের কথা মনে গাঁথা থাকবে চিরদিন। যৌন সংসর্গের জন্যে আমরা সেদিন একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। দুজনে ভক্তিগীতি শুনছিলাম, মন-প্রাণ দিয়ে ধ্যান ক’রছিলাম, একদম ভাবিনি যে মনে মনে আমরা অন্তরঙ্গ হ’য়ে উঠেছি; ভক্তিগীতি যেন আমাদের ব’লছিল সহজ হ’তে, না চাইতেই আমরা যা পেয়েছি – আকাশ, আলোক, দেহ, মন, প্রাণ, আমরাও যোগ্য হবো সে মহাদানের, দান ক’রবো আমাদের নিজেদেরকে। আমি আমাকে ছেড়ে দিলাম মৃণালের হাতে; মৃণাল নিজেকে ছেড়ে দিলো আমার হাতে। হারিয়ে গেলো আমাদের দুজনের ব্যবধান, মনে হ’লো এক দেহ, এক মন আমাদের। ন’মাস পরে নির্বিঘ্নে জন্ম নিলো আমাদের ছেলে মিন্টু। এবারেও মৃণাল ব’ললো, ‘মিষ্টিকে নিয়ে আসবো!’

 

বসন্ত উধাও হ’য়ে যাবার পরে পনেরো বছর কেটে গেছে; স্বামীকে ফিরে পাবার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি করেনি রাঙাবৌদি; বসন্তদার মা-বাবাকে বারবার ফোন ক’রেছে, আমাকেও চিঠি দিয়েছে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই; কিন্তু নিজের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কাউকে বলেনি যে বসন্তদা উধাও হ’য়ে গেছে; আমি বাদে বাকী সবাই জানে বসন্তদা রাঁচীতে ওর বাবা-মার কাছে ফিরে গেছে পিএইচডি ক’রতে।  অন্তরঙ্গ বন্ধু ব’লে কেবল আমাকেই রাঙাবৌদি অনেক মনের কথা লিখেছে হয়তো প্রায় চারশো বার; আমি সহানুভূতির সঙ্গে উত্তর দিয়েছি প্রতিবার, কেবল একটা মিথ্যে কথা সত্যির চেয়েও বিশ্বাসযোগ্য ক’রে রেখেছি– আমি বসন্তদার কোন খবর জানিনা। দুবছর পার হবার রাঙাবৌদিকে জানিয়েছি– আমি মৃণাল ব’লে একটা ছেলেকে ভালবেসে বিয়ে ক’রেছি। এটা মিথ্যে কথা হ’লেও দিল্লীতে আমার সমস্ত বন্ধুরা, সহকর্মীরাও এটা সত্যি ব’লেই জানে।

 

হঠাৎ নিমন্ত্রণ পত্র পেলাম – রাঙাবৌদির বিয়ে; সঙ্গে একটা ছোট চিঠি:

“সুচরিতাসু মিলি,

রাঁচী থেকে তোর বসন্তদার বাবা জানিয়েছেন- বসন্তদার মৃত্যু হ’য়েছে সর্পাঘাতে। তুইতো জানিস বাবা মারা গেছেন প্রায় একবছর হ’লো; বাড়ীতে এখন তিন মহিলা- মা, আমি আর মিষ্টি; সংসার গুছিয়ে রাখার জন্যে একজন গৃহকর্ত্তার খুব দরকার; তাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলাম । প্লীজ আসিস্, বর-ছেলেমেয়েদের নিয়ে; মা ব’লেছেন তোকে এয়ো ক’রতে।

ভালবাসা নিস্।“

 

নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে মৃণাল আর আমি হাজির হলুম রাঙাবৌদির বাড়ীতে, বিয়ের দিন বিকেলে; বর আসার একটু আগে। ছেলেমেয়েদের রেখে গেলাম দিল্লীতে আমার বৌদির হেফাজতে। মৃণালের মনে একদিকে ধরা পড়ে যাবার ভয়, যদিও এখন গায়ে-গতরে ও অনেকটাই বেড়েছে, তবুও কেউ চিনে ফেলতে পারে; আবার অন্যদিকে বড় সাধ মিষ্টিকে একবার চোখে দেখার।

 

সিংহাসনে ব’সে টোপর-পরা বর; বরের সিংহাসনের পাশে কয়েকটি মেয়ে আর একটি ছেলে – মৃণাল বোঝার চেষ্টা ক’রছিল ওদের মধ্যে কেউ মিষ্টি কিনা। ছেলেটি আমাদের নাম শুনে একটু উচ্ছ্বসিত হ’য়ে ব’ললো, ‘আমার নামও মৃণাল’।

‘তাই নাকি?’ ব’লে মৃণাল হাত মেলালো ওর হাতে; তাকালো ওর মুখের দিকে–  সেই পনেরো বছর আগের মৃণাল আবার যেন ফিরে এসেছে।

‘বসন্ত!’ রাঙাবৌদি ডাকলো; সচকিত হ’য়ে মৃণাল সাড়া দেবার আগেই রাঙাবৌদি এসে হাজির, ব’ললো, ‘আমার নতুন বরের নাম রেখেছি – বসন্ত, ও প্রায়ই ভুলে যায় সাড়া দিতে, ওর আসল নাম নন্দন।‘

মৃণালের হঠাৎ সচকিত হওয়া, পরমুহূর্ত্তেই অপ্রতিভ হ’য়ে যাওয়া নজরে পড়লো আমার, নতুন মৃণালেরও, যদিও কেউই প্রশ্ন ক’রলো না। 

 

মিষ্টির সঙ্গে দেখা হ’লো, মৃণাল ওকে একটু আদরও ক’রলো নিজের পরিচয় না দিয়ে, মিলি-আন্টির বর মৃণালকাকু হিসেবে; ব’ললো, ‘চলো মিষ্টি আমার সঙ্গে, দিল্লীর লেডী-আরউইন ইস্কুলে পড়াবো তোমাকে।‘

মিষ্টি একটু অবাক হ’য়ে ব’ললো, ‘আপনি আমার বাবার মতো, কাকু। ইচ্ছে ক’রছে আপনার সাথে যাই। কিন্তু মা চাইবে না এত খরচ ক’রতে; এছাড়া উনি আমাকে চোখের আড়াল ক’রতে চাননা, উনি শুধু আমার মা নয় বাবা-ও।‘

 

পরে রাত্রে আমাকে একা পেয়ে মৃণাল ব’ললো, ‘তুমি তোমার রাঙাবৌদিকে একটু বলো না,  মিষ্টি আমাদের কাছে মেয়ের মতো থাকবে।‘

-   ‘দেখবো চেষ্টা ক’রে। তবে আমাদেরও দুটি ছেলেমেয়ে আছে; নতুন দিদি পেয়ে তাদের কীরকম লাগবে জানিনা।‘

আমি রাঙাবৌদিকে অনুরোধ ক’রেছিলাম, রাজী হয়নি রাঙাবৌদি।

অগত্যা বৌভাতের পরদিন মৃণাল আর আমি বেরিয়ে পড়লাম রাঙাবৌদির বাড়ী ছেড়ে, তবে সোজা দিল্লীতে ফিরলাম না; মৃণাল ব’ললো, ‘চলো রাঁচীতে বাবাকে একটা সারপ্রাইজ ভিসিট দিই। পনেরো বছর বাদে চিনতে পারে কিনা দেখি।‘

 

রাঁচীতে গিয়ে মৃণাল দেখলো তার বাবাকে। এখানে এসে দেখলো বাবাকে চেনাও দুঃসাধ্য। আট বছর হ’লো মা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন; বাবা ছাড়া বাড়ীতে আছে মাত্র আর একজন– কাজের লোক– তাকে মৃণাল জানে অমুকাকা ব’লে– রান্নাবান্নাও ক’রে, বাগানে কাজও করে। বাবা একাই থাকেন, বেশীর ভাগ সময়টাই কাটে তাঁর গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখে, কিছু সময় কাটে গান শুনে, বই পড়ে বা টিভি দেখে।

আমি ব’লতে পারলাম না যে রাঙাবৌদি আমাকে জানিয়েছিল বসন্তদার মায়ের চলে যাওয়ার কথা; মৃণালের মনে কষ্ট হবে বলে তখন ওকে জানাতে পারিনি।

বাবা চিনতে পারলেন বসন্তদাকে, ব’ললেন, ‘এতদিন কোথায় ছিলিস্?’

বসন্তদা ব’ললো, ‘দিল্লীতে, এই মিলির সঙ্গে, তোমার পুত্রবধূকে লুকিয়ে। তোমাকে বলিনি, যাতে পুত্রবধূ জিগ্যেস ক’রলে তোমাকে মিথ্যে বলতে না হয়। এখন মিলিকেই প্লীজ মেনে নাও তোমার পুত্রবধূ ব’লে; মিষ্টির পরে তোমার হ’য়েছে আর এক নাতনী রিমি, বয়স এখন ১৪ আর নাতি মিন্টু, বয়স ৮। দিল্লীতে মিলির বৌদির কাছে ওদের রেখে এসেছি।‘

বাবা ব’ললেন, ‘তুইতো আমাকে কিছুই জানাস নি, এদিকে তোর রাঙাবৌ উত্যক্ত ক’রেছে আমাকে বারবার। কতবার এসেছে এখানে তোর খোঁজে, কোনো নোটিশ না দিয়ে। ওর সব আত্মীয়স্বজনকে জানিয়েছে যে তুই এখান থেকে পি-এইচ-ডি ক’রছিস।‘

-   ‘তুমি কি জানো, রাঙাবৌ বিয়ে ক’রেছে কদিন আগে? তুমি নাকি বলেছো, আমি সাপের কামড়ে মরে গেছি?’

-   ‘এছাড়া কোন উপায় ছিল না আমার। আমি তো ভাবতেই পারিনি, মিষ্টির মতো মেয়েকে ফেলে তুই কোথাও গিয়ে বেঁচে আছিস, এক-দুদিনের জন্যে নয় পনেরো বছর ধ’রে।‘

-   ‘তুমি তো কখনও মিথ্যে বলো না, বাবা?’

-   ‘মিথ্যে বলি না বটে, তবে বই লেখার সময় অনেকটাই বানাতে হয় পাঠকদের মন রেখে; এখানেও গল্প বানিয়েছি যাতে রাঙাবৌ তোর চিন্তা ছেড়ে বাঁচতে শেখে, নিজের জন্যে ভাবতে পারে; ওকে বলেছি সর্পাঘাতে মৃত্যু হ’লে দাহ ক’রতে নেই, বাগানে মাটি চাপা দিয়ে একটা বেদী তৈরী ক’রেছি, যার উপর পুঁতেছি একটা আম গাছ।‘

একটু থেমে জানলা দিয়ে হাত বাড়ালেন বাবা; বললেন, ‘ঐখানে আমগাছটা। রাঙাবৌ ব’লেছে - কাল আসবে ওর নতুন বর আর মিষ্টিকে নিয়ে। ও ব’লেছে, নতুন বরের নাম রাখবে – বসন্ত, ও হবে আমার ছেলে। ওরা হয়তো দেখবে ঐ আমগাছ আর তার নীচের বেদীটা। তোরা দুজন ঐপাশের ঘরটায় থাকিস গা-ঢাকা দিয়ে।‘

 

‘বাবা, এই আপনার ছেলে বসন্ত’, এই ব’লে নন্দনকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো রাঙাবৌ, প্রণাম ক’রলো বসন্তের বাবাকে, দেখাদেখি নন্দনও তাই ক’রলো।

হাত বাড়িয়ে আশীর্বাদ ক’রলেন বাবা, তারপরই থমকে দাঁড়ালেন, দরজার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস ক’রলেন. ‘মিষ্টি আসেনি?’

-   ‘না, বাবা, ও পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত...’

-   ‘কক্ষনো না, এই ক’ঘন্টার জন্যে দাদুর কাছে আসার সুযোগ ও কখনও ছাড়বে না। ওর কি পছন্দ হয়নি নতুন বাবাকে?’

-   ‘নতুন বাবার সঙ্গেই তো ও ছিল সারাদিন; দাদু আর দাদুর বাড়ীর গল্প ক’রেছে নন্দনের সঙ্গে। আজ ভোর থেকে দেখছিনা ওকে....‘

পাশের ঘরে ব’সে মৃণাল আর আমি শুনছিলাম রাঙাবৌ আর বাবার কথোপকথন। রাঙাবৌয়ের কথা শেষ হ’বার আগেই এঘর থেকে ওঘরে ঝাঁপ দিল মৃণাল। গত পনেরো বছরে কখনো শুনিনি মৃণালের এমন বিধ্বংসী হুঙ্কার,- ‘আমতা আমতা ক’রছো কেন মিষ্টির মা? পরিস্কার ক’রে বলো মিষ্টি কোথায়? মেয়ের বয়সী বরকে নিয়ে কাল রাতে যখন শুয়েছিলে, তখন কি দেখেছিলে মিষ্টি দুধ খেয়ে শুতে গেছে কিনা? গুডনাইট বলেছিলে ওকে, নিজের বেডরুমের দরজায় শিকল তোলার আগে?’

‘সত্যি ব’লছি, মিষ্টির বাবা। ও রোজকার মতো হরলিকস্ খেয়ে শুতে গেছে; ওকে বিছানায় শুইয়ে আমরা ঘরে এসেছি। দরজা বন্ধ করার দরকার মনে ক’রিনি। জানি ও উঁকি মারবে না। ভোরে উঠেই খোঁজ ক’রেছি বেডটি দেবার জন্যে– কোথাও চিহ্ন নেই ওর।....তুমি এতদিন এখানেই ছিলে, মিষ্টির বাবা? হ’য়ে গেছে তোমার পি-এইচ-ডি? ফিরে চলো আমার সঙ্গে, প্লীজ।

বাবা, কেন আপনি বলেছিলেন ও সাপের কামড়ে মারা গেছে– ওর সমাধির উপর আমগাছের চারা পুঁতেছেন?’

বাবা হতভম্ব হ’য়ে কথা খুঁজছিলেন। গল্পে-উপন্যাসে জোড়াতালি দিয়ে অনেক মিলিয়েছেন উনি। এখন সাপের কামড়ে মরা ছেলের হঠাৎ ফিরে আসা, এর সমাধান করার মন্ত্র তার জানা নেই।

মৃণালও হতবাক। ও ভাবছিল বলে, ‘আমি পি-এইচ-ডি ক’রেছি ঠিকই, তবে রাঁচীতে বাবার এখানে থেকে নয়, দিল্লীর স্কুলে টিচারি করার সময় – কাজের ফাঁকে ফাঁকে গবেষণা ক’রে‘; কিন্তু সাহস ক’রলোনা কিছু ব’লতে; ও ব’লতে পারবেনা কি ক’রে ও কাজ পেলো দিল্লীর স্কুলে, ব’লতে পারবেনা যে ও মিলির সঙ্গে পালিয়ে দিল্লীতে এসেছে, রাঙাবৌয়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু মিলি বিশ্বাসঘাতকতা ক’রে এসেছে পনের বছর ধ’রে।

হঠাৎ যেন আবার যৌবন ফিরে এসেছে রাঙাবৌয়ের দেহে; ও ঝাঁপ দিয়ে হাত ধ’রলো মৃণালের; ব’ললো, ‘প্লীজ, আমাকে ক্ষমা ক’রে দাও, মিষ্টির বাবা। তুমি পনেরো বছর কি ক’রেছো, তার কোনো কৈফিয়ৎ চাইবোনা; ফিরে চলো আজ আমার সঙ্গে;  দুজনে মিলে ফিরিয়ে আনবো মিষ্টিকে, ও আর পালাবে না।‘

এতক্ষণে প্রথম শোনা গেল নন্দনের আকুতি,- ‘আমি কোথায় যাবো, রাঙাবৌ? মাত্র দুদিন হ’লো আমরা শপথ নিয়েছি সাত জন্ম কাছে থাকার...’

‘তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে নন্দন, বসন্তের ছোট ভাই হ’য়ে, তোমাকে আমি স্নেহ ক’রবো নিজের দেওরের মতো।‘

 

পাশের ঘরে ব’সে শুনছিলাম সব কথা– বাবা, রাঙাবৌদি, দুই বসন্তের কথা। এক বসন্ত রাঙাবৌদির নতুন স্বামী নন্দন, আর একজন একসময়ে আমার বসন্তদা ছিল, এখন আমার প্রিয়তম মৃণাল, সমস্ত অফিসিয়াল ডকুমেন্টে আর আমার রোজকার জীবনে ও পার্টনার– যদিও বিয়ে হয়নি আমাদের কোনদিনই। কীভাবে পাশের ঘরে গিয়ে মৃণালকে উদ্ধার ক’রে আনবো, সেজন্যে আকাশ-পাতাল ভাবছিলাম– দেখলাম আমার মোবাইলে ছোট মৃণালের ইমেল/হোয়াটস্ অ্যাপ:-

‘মিলি-আন্টি, আপনার কথামতো মিষ্টিকে নিয়ে দিল্লীতে মাসীমার বাড়ীতে উঠেছি। মাসীমাকে ব’লেছি মিষ্টির মা-বাবা দিল্লীতে থাকেন, দুদিন বাদে ওঁরা এসে নিয়ে যাবেন। মিষ্টিকেও আপনাদের কথা বলেছি; ওর আর আমার মোবাইল নাম্বার দিলাম। ফোন ক’রবেন, প্লীজ।‘

 

এবার আমার আত্মসমর্পণ না ক’রলেই নয়।

পাশের ঘরে ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম রাঙাবৌদির পায়ে, ব’ললুম, ‘আমাকে বাঁচাও, আমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা ক’রে দাও। আমিই বসন্তদাকে নিয়ে পালিয়েছিলুম। এখন আমার কাছে ও আর বসন্তদা নেই; ও এখন আমার মৃণাল, যার কথা বারবার ব’লেছি তোমাকে। তবে, ও এখনও মিষ্টির বাবা। এখন আর বসন্তদাকে চেয়ো না, প্লীজ। ওকে মৃণাল হ’য়ে বাঁচতে দাও আমার সঙ্গে... ‘

থামিয়ে দিলো রাঙাবৌদি, ‘আর ব’লতে হবে না। মানুষকে বিশ্বাস ক’রে ঠকতে রাজী আছি আমি, অবিশ্বাস ক’রে বন্ধুত্ব হারাতে চাইনি কখনও। ব’লবি, কেন বসন্তদাকে নিয়ে পালিয়েছিলি?’

উত্তর নেই আমার মুখে; ব’ললো মৃণাল, ‘দোষ মিলির নয়, আমার– আমিই পালিয়েছিলাম তোমাদের বাড়ী থেকে, ওখানে আমি অবাঞ্ছিত ব’লে। তুমি আমাকে দেখেছ এক ক্রীতদাস হিসেবে, সমান অংশীদার হিসেবে নয়। মিলির সংসারে আমরা দুজনে মিলে ঠিক করি কিভাবে চলবে আমাদের জীবন; ও আমাকে ডাকে ‘মৃণাল’ ব’লে, ‘রিমির বাবা’ বা ‘মিন্টুর বাবা’ ব’লে নয়।‘

রাঙাবৌদির দীর্ঘশ্বাস:- ‘যাও তুমি মিলির সঙ্গে। সুখে থাকো। আর মুখ দেখিও না আমাকে। ফিরে আসুক মিষ্টি; আমি থাকবো মিষ্টির মা ও বাবা হ’য়ে। কোনোদিন যদি দরকার মনে করো, ফিরে এসো আমাদের কাছে, ‘মিষ্টির বাবা’ হ’য়ে নয়, মৃণাল বসন্ত অথবা অন্য কোনো নাম নিয়ে। আশা করি, নন্দন থাকবে আমার সঙ্গে আজীবন...’

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু