বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

' Ultimate Love'

'অালটিমেট লাভ'

     মহুয়া ঘোষ


রবীন্দ্র সরোবর এর গা ঘেঁষে পাটা জোরে চালিয়ে হাঁটছিল সুপর্ণ। আজ তাড়াতাড়ি পৌঁছনো দরকার অফিসে। নইলে অমলদার মত সেও বাতিলের খাতায় চলে যাবে। নতুন দায়িত্ব হাতে পেয়ে মালিকের ছেলেটা একেবারে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে সবাইকে।

অফিসে তো কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে ডিভোর্স হবার পর থেকেই নাকি ছোকরা এমন ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়েছে! প্রত্যেকের প্রুফ নিজে চেক না করে নিয়ে নাকি উনি বই প্রিন্টে পাঠান না! তাই যদি হয় তবে এতগুলো টাকা নিয়ে এতজন প্রুফ রিডারের রাখার কী দরকার সুপর্ণ বুঝে পায় না।


সামনে বইমেলা। দশজন নতুন লেখকের বই বার করছে এবার গুডফিল পাবলিকেশন। কমপিটিশনের মার্কেটে নিজেদের গুডউইল বজায় রাখতে গেলে চাই পাঠকের মন জয় করা।

পাঠকদের পছন্দের ডিম্যান্ড বুঝে বইয়ের সাবজেক্ট বাছার দিন এখন চলে এসছে। এখন ভূতেরা সব অতীত আর বর্তমানদের খেয়ে নিচ্ছে। সাথে রয়েছে থ্রীলার ঘরানার চমকদার সব উপস্থাপনা। মাঝখানে মধ্যবিত্ত বাঙালির মত পড়ে রয়েছে সামাজিক গল্পলেখিয়েরা। রোম্যান্টিক গল্পও আজ আর পাবলিক খায় না।

গল্প খাবে পাবলিক!  প্রথম প্রথম হোঁচট খেত এইসব কথা শুনে সুপর্ণ। এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। একটা দলা বুকের মধ্যে পাকিয়ে থাকে অবিরত। সামাজিক আর ভালোবাসার গল্প পড়েই তো কৈশোর পেরিয়ে যৌবন, যৌবন পেরিয়ে আরও বেশ কিছুটা পথ হেঁটে এগিয়ে গেছে সে।

এখনও বুকের ভেতর ভালোবাসারা ঘুমিয়ে থাকে। খুঁজে বেড়ায় অবিরত তার ফেরারী মন অন্য কোনো মনকে যেখানে নোঙর ফেলে দুদন্ড শান্তিতে জিরোনো যায়। বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা যেখানে প্রাচীর তুলে পাহাড়া দেয় ; মোহ' রা হামাগুড়ি দিয়ে সেখান থেকে পথ পালায়। কিন্তু তেমন মন আর পাওয়া হয়ে উঠছে কই! পাওয়া হয় না  আজও এমন কোনো মানবীকে যার বুকের জমিনে সুপর্ণ তার ক্লান্ত, শ্রান্ত মাথাটা কিছুক্ষণের জন্য চেপে ধরে রাখতে পারে!


একসময় দিন শেষ হয়ে রাত নামে। দূরে কুয়াশা সরিয়ে তার অবয়ব আস্তে আস্তে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসতে থাকে রোজনামচা মেনে। টিমটিমে ল্যাম্পপোস্টের লাইটে একটা কুকুর  ঘেউঘেউ করে ডেকে উঠল তাকে দেখে। খুশিতে কয়েক পাক চক্কর দিয়ে ফেলে সে। দূর থেকেই সে চিনে ফেলেছে সেই মানুষটাকে  যার আলতো হাতের স্পর্শ পাবার জন্য সে লেজ গুটিয়ে অপেক্ষায় থাকে সারাটা দিন।অনেকেই খেতে তো দেয়! কেউ বিস্কুট এক আধটা, কেউ মুড়ি ,কেউ বা পোড়া রুটি!  কিন্তু কেউ ভালোবেসে মাথায় হাতটা রাখে না। রাখে তবে নিজেকে সমাজের কাছে পশুপ্রেমী প্রমাণ করার জন্য যতটা রাখতে হয়,  ততটাই আর কী! বয়স তো আর কম হল না !  কোন্ টা মেকি আর কোন্ টা আসল....  এসব এখন বুঝে গেছে লাকি।  এলোমেলো ক্লান্ত পায়ের শব্দে  সজাগ হয়ে ওঠে ওর কানদুটো। আদুরে ঘেঁউ ঘেঁউ শব্দে সুপর্ণর পা চাটতে থাকে। অবিরত নড়তে থাকে লেজ।গালদুটো ঘঁষতে থাকে পায়ের পাতায়।সুপর্ণ বোঝে এবার দশটা মিনিট লাকির সাথেই কাটাতে হবে নইলে পথ ছাড়বে না।


ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে রাস্তার পাশে একটা নীচু রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে বসল সুপর্ণ। একটা পাবলিকেশনের প্রুফরিডার। সারাদিন যন্ত্রে মুখ গুঁজে থাকতে থাকতে নিজেই আজ যন্ত্র হয়ে গেছে। বাংলা অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সির ছাত্র হয়েও এই পেশাটা বেছে নেওয়ার পেছনে দুটো বড় কারণ ছিল। এক,মায়ের চিকিৎসার খরচ মেটানো আর দুই,বিনে পয়সায় লেখকদের গল্প পড়ার লোভ।

কিন্তু দ্বিতীয়টার প্রতি মন যেন আস্তে আস্তে উঠেই যাচ্ছে।

একেই তো গিজগিজ করছে এখন কলমধারীর সংখ্যা তায় লেখার মান এত কমে গেছে এই পেশায় যুক্ত না হলে ওর সেটা জানাই হত না।

বানানের কোনোরকম ধ্যানধারণা নেই, শব্দচয়ন ঠিকঠাক নেই, বাক্যগঠনেও অপটুতা! কতদিন যে এসবের জন্য স্ক্রিনের সামনে থেকে চোখ সরিয়ে শূন্যে তাকিয়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থেকেছে সে।  কিছু কথা মনে এলে লিখে ফেললেই কি লেখক হওয়া যায়!

তাহলে তো আমিও দু চারখানা উপন্যাস লিখে ফেলে আজ লেখক হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারতাম।

চারটে ব্যর্থ প্রেমকাহিনী নিয়ে চারটে জ্বলন্ত উপন্যাস! কিন্তু কি লাভ!  থাক্, যে যার স্বামীর সাথে! সুখে- দুঃখে! তাদের আর সবার সামনে এনে কী লাভ!


লাকিটা আবারও কুঁই কুঁই করছে।  এবার আরেকটু গলায়,ঘাড়ে,গালে পাগলের মত আদর করে দিতে হবে ওকে।

" তুইও কি আমার মতই আদর খুঁজিস রে পাগলা! তোরও বুঝি কেউ টিঁকল না! " জোরে জোরেই কথাগুলো বলে ফেলল সুপর্ণ। পাশে একজোড়া পা হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে। অবিন্যস্ত চুল মুখের ওপর এলিয়ে পড়া! চলকে যাওয়া এক কাপ চায়ের মত সময়ও যেন কোনো কোনো সময় কিছু উপড়ি পাওয়া জীবনে দিয়ে যায়।


" একটু বসতে পারি পাশে লেখক! "


" অবশ্যই পারিস। তবে আমি  লেখক নই কিন্তু।"


" তুমি ভুলে যেতে পারো তবে আমি কিন্তু ভুলিনি। একবার পাড়ার ম্যাগাজিনে  'ভালোবাসা দিবস'  নামে তুমি একটা আর্টিক্যাল লিখেছিলে....  সেটা আজও আমি  মাঝেমাঝেই পড়ি।"


" সে কি!"


" তোমার একটা লাইন আমায় খুউব নাড়া দিয়েছিল। বই লিখলেই কি লেখক হওয়া যায়! কেউ কেউ লেখক হয়েই জন্মায়।"


" কোন্  লাইনটা বল্ তো! "


" তুমি লিখেছিলে ---- জীবনে সেই নারীকেই আমি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসি যিনি আমাকে তার বুক চেরা সুধারস দিয়ে আমার তেষ্টা মেটাতেন.....  আমার 'মা'! তিনিই আমার প্রথম ও শেষ ভ্যালেন্টাইন যিনি নিঃস্বার্থভাবে, নিঃশর্তে আজীবন আমায় ভালোবেসে যাবেন।  আর কোনো নারীর আকাঙ্খা আমার নেই।"


" ওওও। এটা তো আমার বিশ্বাস থেকেই লিখেছিলাম।"


" বাকিদের ওপর  তোমার এত অবিশ্বাস! "


" তা একটু আছে! আমি এবার উঠব রে। চলি রে লাকি। মা বাড়িতে একা। চিন্তা করবে এরপর বুড়িমানুষটা। "


লাকি আবারও ঘড়ঘড় আওয়াজ করতে শুরু করল। সুপর্ণ পা বাড়াতে যেতেই মেয়েটি বলে উঠল।


" আমি একজন এমন মা হতে চাই।"


" তা বেশ তো!  হবি 'খন! আমায় বলছিস কেন? বিয়ে করলেই হবি!"


" আমি তোমার সন্তানের তেষ্টা মেটাতে চাই যে! আর কারো সন্তানের নয়।"


পা দুটো হঠাৎ থমকে গেল সুপর্ণর। চমকে তাকাল মেয়েটির দিকে। ওর চোখদুটোকে আজ আর কেন যেন অবিশ্বাস করতে মন চাইল না। মেয়েটিকে মাঝেমধ্যে রাস্তায় দেখেছে বটে! তবে নাম,ধাম কিছুই জানা নেই। কোন্ বাড়ির মেয়ে! একসময় মন শক্ত করে বলে উঠল, " আমি বাউণ্ডুলে মানুষ রে! থাকার কোনো ছিঁড়ি ছাদই নেই!"


" আমিও ভবঘুরে মেয়ে। কলেজে রাজনীতি করে,, নেশাটেশা করে কাটাতাম। দু,  চারটে আলগা পিরিত হয়েছিল তবে ঘর বানাতে ইচ্ছে করে নি কখনও।"


" তাহলে আজ ইচ্ছে করছে যে!"


" কি জানি! হয়ত তুমি বুকের ভেতর ছিলে ঘুমিয়ে আজীবন তাই ইচ্ছে করে নি। আজ ঠিক করেই রেখেছিলাম ---- সত্যিটা আজ বলেই দেব। ডিডিশন উইল বি ইওরস্।"


" যদি না  করি! "


" গাঁজার দমটা আরও বাড়বে তবে!"


" মানে! আমার জন্যেই এটা ধরেছিলিস নাকি!"


" কী করব! তোমার সব খবরই রাখতাম। বলতে পারতাম না কিছুই!  তুমি কম মেয়ে তো জীবনে দেখলে না!"


পা দিয়ে একটা পাথরকে নাড়াতে থাকে মেয়েটি। "একটা কথা বলতে পারি.... "


" নামটা যেন কী তোর? "


" এমন ভাব করছ যেন জানতে আগে,  ভুলে গেছ!  ঐশী।"


লাকি প্রবলভাবে লেজ নাড়তে শুরু করেছে। দুজনের চারদিক দিয়ে ঘুরছে সমানে। সুপর্ণ ঐশীর দিকে তাকিয়ে বলল, " আজ হঠাৎ এমন ক্ষেপলি কেন? "


" দিনটাই যে এমন! আজ না বলা হলে আর কখনোই হয়ত বলা হত না!"


ঐশীকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখল সুপর্ণ।  এই প্রথম কোনো মেয়ের শরীর থেকে বহুদিনের এক চেনা গন্ধ যেন নাকে এসে লাগছে।



              সমাপ্ত।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু