বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

কাবুলিওয়ালা

চার বছরের জন্মদিনের উৎসব! কেক কাটা হ’লো; হ’লো লুচি-মাংসের ভোজ; দু-ঘন্টার হুল্লোড়ের পর আত্মীয়-স্বজনেরা একে একে বিদায় নিলো। দাদা আর দিদিও ওদের বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো। বাবা আর মা সোফায় অর্দ্ধশায়িত, দিবানিদ্রায় মগ্ন। সদ্য চার বছর হওয়া মেয়ে মিনি বাড়ির ঝি সোনাদিকে ব’ললো, ‘চলো, পার্কে বেড়াতে যাবো।‘

বাড়ীতে জেগেছিল একমাত্র মাসিমণি;  মাসিমণি মায়ের ছোট বোন, এখানে ওর দিদির কাছে থাকে। মাসিমণি চাইল মিনিকে সাজিয়ে গুজিয়ে বেড়াতে পাঠাতে। মিনির চুল আঁচড়ে, ভালো ক’রে ফ্রক পরিয়ে দিল; পরিয়ে দিল গলায় হার, হাতে চুরি-বালা, আর দু-কানে দুল; বাড়ির ঝি সোনাদি মিনিকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ খেলার পরে মিনি ব’ললো, ‘সোনাদি, ছোটো টয়লেট ক’রতে যাবো।‘

সোনাদি মিনিকে পার্কের বাথরুমে পাঠালো; কিন্তু তার আগে মিনির ফ্রক, গলার হার, হাতের চুরি-বালা, কানের দুল খুলে নিয়ে নিজের কাছে রাখলো। কিছুক্ষণ পরে. খালি ইজের-পরা অবস্থায় মিনি বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে সোনাদি কোথাও নেই।

মিনি খুব কাঁদছিল’ তখন মিনির মায়ের বয়সী এক মহিলা এসে মিনির কান্না থামালো, ব’ললো, ‘চল তোকে বাড়ী নিয়ে যাবো। তোর নাম কি?‘

‘আমার নাম মিনি; তুমি চেনো আমাদের বাড়ী যাবার রাস্তা?’

‘চিনে নেবো এখন। আপাততঃ আমার বাড়ীতে চল; ধর, আমি তোর কাকি। আমার খোকন তোর চাইতে বছরদুয়েকের বড়। খেলতে পারবি ওর সঙ্গে।‘

একটু ভালবাসার আশ্বাস পেয়ে মিনি চললো কাকির সঙ্গে এক নতুন আশ্রয়ে।

নতুন আশ্রয় দেখে একটু হতাশ হ’লো মিনি- অন্ধকার বস্তির মধ্যে ছোট একখানা ঘর। ঘরের মধ্যে একটা লম্বা তক্তাপোষে বিছানা পাতা; বিছানার উপরে ব’সে পড়াশোনা ক’রছে একটা ছেলে।

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কাকি ব’ললো, ‘এই দেখ বাবলু, তোর জন্যে আজ কি খেলনা নিয়ে এসেছি- একটা জ্যান্ত পুতুল; ওর নাম মিনি।‘

তারপর, মিনির দিকে ফিরে ব’ললো, ‘মিনি, বাবলুর সঙ্গে খেলা করো; ভালো লাগবে; বাবলু তোর একটা জামা ওকে প’রতে দে; খালি গায়ে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।‘

কাকি ব’লতে রইলো, ‘বাবলুকে খেলনা কিনে দেবার মতো টাকা নেই আমাদের। বাবলুর আর দুটো খেলনা রয়েছে এদিকে- খাঁচার মধ্যে ময়না, আর বেল্টবাঁধা কুকুর ভুলো- আমিই তুলে এনেছি।‘

বাবলু ব’ললো, ‘মিনিকে ধরে রাখার কোনো বেল্ট লাগবে না; ওর সঙ্গে আমি সারাদিন খেলবো, চোখে চোখে রাখবো; ওকে আমার স্কুলেই ভর্ত্তি ক’রে দাও।‘ 

 কাকি ব’ললো, ‘না, ওকে স্কুলে ভর্ত্তি ক’রতে পারবো না- অনেক খরচ। না-হয় তুই পড়িয়ে দিস, বাবাকেও ব’লিস রোজ তোকে যখন পড়ায় তখন ওকেও শেখাবে। ঘরের কাজ আমি শিখিয়ে নেবো।‘

এ বাড়ীতে মিনির অনেকগুলো নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠলো। শুরু হ’য়েছিল কাকিকে দিয়ে; মিনি তখন জানতো না- কাকির নাম তপতী। মিনি জেনেছিল, এ বাড়ীতে কাকাও থাকে- কাকার সঙ্গে কাকির এক নিকট সম্পর্ক আছে; মিনি তখন জানতো না- কাকার নাম মানস; জানতো না- বাবার ভাইকে কাকা বলে; কাকার জীবনসঙ্গিনীকে ‘কাকি’ ব’লে ডাকা হয়। মিনি বুঝতে পারেনি- বাবলু কাকির সন্তান না ওরই মতো কুড়িয়ে পাওয়া। মিনি কাকিকে জিজ্ঞেস করেছিল- কবে ওকে ওর বাবা, মা, মাসী, দাদা, দিদির সঙ্গে দেখা করাবে; সঠিক উত্তর পায়নি।

মিনি অভ্যস্ত হ’য়ে উঠলো ওর নতুন সম্পর্কের সংসারে- কাকি, কাকা, বাবলু, ভুলো আর ময়নাকে নিয়ে; স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, কিন্তু বাবলুর সঙ্গে সমান তালে সব বিষয়ই পড়ে চলেছে। কাকাও খুব সাহায্য ক’রেছে। প্রতি পরীক্ষার পরে বাবলু প্রশ্নপত্র নিয়ে এসে কাকাকে দিয়েছে আর কাকা মিনির পরীক্ষা নিয়েছে একই প্রশ্নপত্র দিয়ে। বাবলুর বই থেকে রবীন্দ্রনাথের লেখা ছোট গল্প ‘কাবুলিওয়ালা’ মিনিকে অভিভূত ক’রেছে – কেন ওর নিজের বাবা কাবুলিওয়ালা সেজে আসেনা ওকে ফেরৎ নিয়ে যাবার জন্যে?

এইভাবে আট বছর কেটে গেছে; বাবলু ক্লাস নাইনে উঠে কমার্স নিয়ে পড়া শুরু ক’রেছে; মিনি ভাবছিল ওকেও কমার্স পড়তে হবে। কিন্তু কাকির নজরে এসেছে- মিনি এখন বারো বছরের কিশোরী; সবে পিরিয়ড শুরু হ’য়েছে; বাবলু আর মানস দুজনেই মিনির সঙ্গ ছাড়তে চাইছেনা। কাকির মনে হ’লো মিনি আর খেলনা পুতুলের মতো নেই- যুবতী হ’য়ে উঠছে, ওকে আর খেলনা হিসেবে বাড়ীতে রাখা যাবে না; তক্তাপোষে পাতা বিছানায় চারজনের একসঙ্গে শোয়া কষ্টকর হ’য়ে উঠছে- মিনিকে বিছানার একধারে শুতে হচ্ছে। কাকির মনে হ’লো মিনিকে আর বাড়ীতে রাখা যাবে না; সুযোগ এসেছে মুনাফা ওঠাবার।

একদিন দুপুরে যখন কাকা কাজে বেরিয়েছে আর বাবলু স্কুলে গেছে, কাকি মিনিকে ব’ললো, ‘চল, তোকে একটা গার্লস হোস্টেলে নিয়ে যাই। সেখানে প্রত্যেক মেয়ে একটা ক’রে নিজের ঘর পায় থাকার জন্যে।‘

মিনি ব’ললো, ‘দরকার নেই; তাতে তোমাদের অনেক খরচ দিতে হবে। তাছাড়া, এখন কাকা আর বাবলু নেই; চলে যাওয়ার আগে ওদের সঙ্গে দেখা হবে না।‘

কাকি ব’ললো, ‘আমাদের খরচের জন্যে ভাবিস না; গার্লস হোস্টেলের মালিক আমার চেনাশোনা। বাবলু আর কাকাও তোর সঙ্গে দেখা ক’রবে মাঝে মাঝে।‘ 

কাকির উপর অনেকটা ভরসা করে মিনি; রাজী না হ’য়ে পারলো না।

কাকির বস্তি থেকে গার্লস হোস্টেল অনেকটা দূর; বাসে ক’রে যেতে হয়; জীবনে এই প্রথম বাসে চড়লো মিনি। বাস স্টপেজ থেকে দশ মিনিট হাঁটার পরে ওরা গার্লস হোস্টেলে পৌঁছালো। গার্লস হোস্টেলের মালিক মিসেস মুখার্জীকেও খুব ভালো লাগলো মিনির। কাকি ও মিনি চেয়ারে বসার পরে মিসেস মুখার্জী ওর নাম জিজ্ঞেস ক’রলেন, জানতে চাইলেন কোন ক্লাস পর্য্যন্ত পড়াশোনা ক’রেছে; তারপর জিজ্ঞেস ক’রলেন, ‘তুমি কি ছেলেদের পোষাক পরতে ভালোবাসো?’

মিনির মনে পড়লো- বারো বছর আগে, কাকির বাড়ীতে আসার আগে ও ফ্রক পরতো; কাকির বাড়ীতে আসার পর থেকে ও বাবলুর শার্ট-প্যান্ট ছাড়া আর কিছু পরেনি। মিনি ভেবে পেলোনা কী উত্তর দেবে।

মিসেস মুখার্জীর ডাক শুনে, এক তরুণী ঘরে ঢুকলো। মিসেস মুখার্জী ব’ললেন, ‘নন্দিনী, মিনিকে ওর ঘরে নিয়ে যাও আর ওর সাইজের ড্রেস দিয়ে দাও চার সেট। মিনি, তুমি ড্রেস চেঞ্জ ক’রে, প্যান্ট-শার্ট নন্দিনীকে দিয়ে দাও; নন্দিনী একটা পেপার ব্যাগে ভ’রে তপতী ম্যাডামকে দিয়ে যাবে।‘`

মিনির খুবই ভালো লাগলো গার্লস হোস্টেল; নিজের জন্যে এত বড় একটা ঘর; অ্যাট্যাচড বাথরুম; বিরাট চওড়া খাট; দুজনে- হয়তো তিনজনে - শোওয়া যায়, একদিকে বেড-হেড আর বাকী তিন দিক থেকেই খাটে ওঠা যায়। ঘরের একপাশে আলমারী আর ড্রেসিং টেবিল; অন্য পাশে ফ্রিজ, টেবিল আর দুটো চেয়ার। চার বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়ার আগে যে বাড়ীতে ছিল সে বাড়ীর কথা মিনির মনে নেই; বস্তির ঘর এঘরের চার ভাগের এক ভাগও নয়, আর সেখানে আসবাব ব’লতে একটা তক্তাপোষে বিছানা-পাতা।`

নন্দিনীকে মিনি জিজ্ঞেস ক’রেছিল- ‘ঘরের এত আসবাব কী কাজে লাগবে?’

নন্দিনী ব’লেছিল, ‘আমিও জানিনা। তোমাকে হয়তো বড় কাস্টোমারদের দেখতে হবে।‘

মিনি ভাবছিল, আরও অনেকগুলো নতুন নামহীন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে ও। জীবনের প্রথম চার বছর কতগুলো মানুষ স্নেহ দিয়ে ঘিরে রেখেছিল ওকে, সম্পর্কে তারা বাবা, মা, মাসিমণি, দাদা, দিদি; এছাড়া ছিল কাজের লোক- সোনাদি। তারপর নামহীন সম্পর্কের এক মহিলা তপতী ওকে নিয়ে এসেছিল – ‘কাকি’র পরিচয় দিয়ে; নিয়ে এসেছিল ওর ছেলে বাবলুর জ্যান্ত খেলনা হিসেবে; সেখানে নামহীন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ‘কাকি’র ছেলে বাবলু আর ‘কাকি’র স্বামী মানসের সঙ্গে; কাকি শিখিয়েছে মানসকে ‘কাকা’ ব’লে ডাকতে। এছাড়া আরও নামহীন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বাবলুর আর দুটো জ্যান্ত খেলনা- ভুলো কুকুর আর ময়না পাখির সঙ্গে। ময়না পাখিকে বাবলু উড়িয়ে দিয়েছে এক বছর পরেই; ভুলো কুকুর মারা গেছে বছর চারেক বাদে। বাবলুর নিজের জামাকাপড় পরিয়ে আর লেখাপড়া শিখিয়ে বড় ক’রছিল জ্যান্ত খেলনা মিনিকে; কাকি ওকে নিয়ে এসেছে গার্লস হোস্টেলে; এখানে নতুন নামহীন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে ও - মিসেস মুখার্জী, নন্দিনী, কাজের লোক- রাধির মা ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে।

দুদিন বাদে সকাল দশটার সময় মিনির ডাক পড়লো মিসেস মুখার্জীর অফিসে। মিনি এসে দেখলো একজন সৌম্যকান্তি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত মিসেস মুখার্জী।

মিসেস মুখার্জী ব’ললেন, ‘বসো মিনি, তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই আমার গুরুদেব আনন্দের সঙ্গে। আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে, ইনিই আমাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন মানবসেবার পদ্ধতিতে। সেই থেকেই আমার দেহ-মন-প্রাণ অর্পন ক’রেছি মানবসেবার ব্রতে। পাঁচ বছর আগে শুরু করেছি এই গার্লস হোস্টেল, যার প্রতি সদস্য এই ব্রত পালন ক’রে চলেছে আর প্রতিজনই শুরু ক’রেছে এনার দীক্ষা নিয়ে। তুমি গুরুদেবকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। উনি একজন MBBS ডাক্তার। ওনার পরীক্ষায় যদি তুমি উত্তীর্ণ হও, তবেই উনি তোমায় দীক্ষা দেবেন আর আজ সন্ধ্যে থেকেই শুরু হবে তোমার ব্রত পালনের কাজ। তবে ওনার পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হ’লে, তোমাকে এ হোস্টেল ছেড়ে চলে যেতে হবে। বেস্ট অফ লাক; এখন যাও গুরুদেবকে নিয়ে তোমার ঘরে।‘

মিনি এখন কী ক’রবে? কোনোদিন স্কুলে গিয়ে পড়েনি, পরীক্ষাও দেয়নি; এ পরীক্ষায় পাশ ক’রতে না পারলে এ হোস্টেল ছেড়ে চলে যেতে হবে? কোথায় যাবে মিনি? কাকির বস্তির ঠিকানা ওর জানা নেই; জীবনে প্রথমবার ও বাসে ক’রে এসেছে; ফেরার বাস কোথায় পাওয়া যাবে, কোন্ স্টপেজে নামতে হবে, কিছুই জানা নেই; এছাড়া বাসভাড়া দেবার জন্যে একটাও টাকা নেই সঙ্গে।

গুরুদেবকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই কান্নায় ভেঙে পড়লো মিনি, ‘আমাকে প্লীজ ফেল করাবেন না। জানিনা কী ক’রে কাকির বস্তিতে ফিরে যাবো; একটাও টাকা নেই সঙ্গে। ফেরার বাস কোথায় পাবো তা জানিনা; কাকির বস্তির ঠিকানাও আমার জানা নেই। এছাড়া, এই ড়্রেসটাওতো এখান থেকে পাওয়া। কাকির ছেলে বাবলুর যে প্যান্ট-শার্ট পরে এসেছিলাম সেগুলো কাকি ফেরৎ নিয়ে গেছে। এখান থেকে তাড়িয়ে দিলে, আমাকে বিবস্ত্র হ’য়ে রাস্তায় ভিক্ষে ক’রতে হবে।‘

গুরুদেব ব’ললেন, ‘শান্ত হও মিনি; ধৈর্য্য ধরো; ভগবান নিশ্চয়ই তোমার মঙ্গল ক’রবেন। এখন আমি যা বলছি তাই করো। বাথরুমে যাও; ওখানে দেখবে একটা বাথরুম-স্কেল আছে; সব জামাকাপড় খুলে ওর ওপর চড়ো; আর আমাকে এসে বলো তোমার ওজন কত?’

দু-মিনিট বাদে মিনি বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে, কোনো কিছু না প’রেই; ব’ললো, ‘আটত্রিশ দশমিক পাঁচ কেজি’।

গুরুদেব ব’ললেন, ‘যাও, জামাকাপড় প’রে এসো এক্ষুনি; আমি জামাকাপড় ছেড়ে ওজন নিতে বলেছি বাথরুমে গিয়ে; তারপরে জামাকাপড় প’রে নাওনি কেন?’

একটু পরে জামাকাপড় প’রে ফিরলো মিনি, ওর চোখে তখনও অশ্রু, ব’ললো, ‘গুরুদেব, বলুন আর কি কি পরীক্ষা দিতে হবে। আমি আপনাকে কোনোমতেই নিরাশ ক’রবো না। আমাকে পাশ ক’রতেই হবে।‘

গুরুদেব ব’ললেন, ‘আমি তোমাকে নিরাশ ক’রবো না মিনি, কিন্তু তোমার ওজন খুব কম; এখানের কাজে শরীরের উপর চাপ পড়ে অনেকটা; চল্লিশ কেজির কম কাউকে এ কাজের জন্যে নেওয়া হয় না।‘

-       ‘একটু প্লীজ বুঝিয়ে বলুন- কী কাজ ক’রতে হয় এখানে। মিসেস মুখার্জী ব’লছিলেন – মানব-সেবার ব্রত; একটু বুঝিয়ে বলুন না?’

-       ‘উনি যে মানব-সেবার কথা বলেছেন, সে সেবা পাওয়ার জন্যে নারীরা সাধারণতঃ উৎসুক নয়। কেবল বিশেষ ধরণের পুরুষরাই এই গার্লস হোস্টেলে আসে সেবা কিনতে। প্রতি সেবাকামী পুরুষের কাছে নিজেকে নিবেদন করে এই গার্লস হোস্টেলের কোনো একজন নারী, পারিশ্রমিক দেয় পুরুষটি। এই পারিশ্রমিকের অনেকটাই - পঞ্চাশ বা ষাট শতাংশ জমা পড়ে গার্লস হোস্টেলের তহবিলে; বাকীটা পায় সংশ্লিষ্ট সেবিকা নারীটি।‘

-       ‘একটু বুঝিয়ে বলুন না কীভাবে নিজেকে নিবেদন ক’রে সেবা ক’রতে হয় আর আমার মত মেয়ে কত পারিশ্রমিক পেতে পারে।‘

-       ‘তোমাকে দেখে মনে হয়- বয়স তেরোর বেশী নয়; অর্থাৎ তুমি নাবালিকা; তোমার ওজনও অনেক কম; তোমাকে দিয়ে এ-ধরণের কাজ করানোর ঝুঁকি আমি নিতে চাইনা।‘

-       ‘আমি ভেবেছিলাম এধরণের কাজে অনেক মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠবে; রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প পড়ে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু ক’রেছি- কোনো এক কাবলীওলা আসবে, আমার মধ্যে খুঁজে পাবে ওর মেয়েকে।‘`

-       ‘শিশুর মত সরল তোমার মন, তাই কাস্টোমারদের পিতৃস্নেহের স্বপ্ন দেখছো। বাবা, ভাই, ছেলে – এধরণের কোনো আত্মীয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে না কাস্টোমারদের সঙ্গে; গড়ে ওঠে কেবল পুরুষ ও নারীর নামহীন এক সম্পর্ক; সে সম্পর্কে মানবিকতা নেই। এখানকার কাস্টোমার চায় এক রাত্তিরের জন্যে একটা মেয়েকে যথেচ্ছভাবে উপভোগ ক’রতে; উপভোগের লিপ্সায় ও অত্যাচারে মেয়েটি শারীরিক ও মানসিকভাবে কতটা বিপর্য্যস্ত হয় তা দেখার জন্যে কাস্টোমার ভ্রূক্ষেপও করেনা’

-       ‘তাহ’লে অপনি কী দীক্ষা দেন গার্লস হোস্টেলের মেয়েদের?’

-       ‘আমি শেখাই নিজের দেহ ও মনের স্বাস্থ্য ও সম্মান অক্ষত রাখতে, দরকার হ’লে কাস্টোমারকে প্রতিরোধ ক’রতে। তোমার মতো নাবালিকাদের সে ক্ষমতা কোথায়?’

-       ‘এখন আমি কী ক’রবো তাহ’লে? বিবস্ত্র হ’য়ে রাস্তায় বেরোনোর আগে আমাকে আত্মহত্যা করার পথ দেখিয়ে দিন!’

-       ‘না, তোমাকে মরতে দেবো না আমি; যে তোমাকে এখানে বিক্রি ক’রে গেছে, তার নাম ঠিকানা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রাখা আছে মিসেস মুখার্জির কাছে, রাখা আছে ওঁর সইকরা কনট্র্যাক্ট – যদি তুমি মেডিক্যালি ফিট না হও, তবে তোমাকে ফেরৎ নিয়ে যেতে হবে আর তোমাকে বিক্রি ক’রে যে টাকা পেয়েছেন তার নব্বই শতাংশ ফেরৎ দিতে হবে।‘

-       ‘জানিনা কাকি আমাকে ফেরৎ নিয়ে যেতে চাইবে কিনা। আট বছর আগে কাকি আমাকে পার্ক থেকে তুলে এনেছিল একটা জ্যান্ত খেলনা করার জন্যে; এখন আমাকে আর খেলনা ব’লে মনে হয় না ওর কাছে। তবে বাবলু আর কাকার চেষ্টায় লেখাপড়া কিছুটা শিখেছি; স্কুলে পড়লে বাবলুর মতো আমিও ক্লাস নাইনে উঠতাম। এখানে আসার আগে কাকি ওদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেয়নি।‘

-       ‘তুমি যদি কাকির কাছে ফিরে যেতে না চাও, তবে তোমাকে অনুরোধ ক’রবো আমাদের বাড়ীতে থাকতে কয়েকবছর। তোমাকে স্কুলে ভর্ত্তি ক’রে দেবো- ক্লাস নাইনে। হয়তো আমি তোমার স্বপ্নের পিতৃস্নেহপরায়ণ ‘কাবুলিওয়ালা’ হ’তে পারবো না। দুজনের মধ্যে গড়ে তুলবো এক নতুন নামহীন সম্পর্ক – এ সম্পর্ক বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নয়, ভাই-বোনের সম্পর্ক নয়, সন্তান ও মায়ের সম্পর্ক নয়; এ সম্পর্ক এক মানুষের সঙ্গে আর এক মানুষের; আমার তুমি হবার সম্পর্ক; তোমার আমি হবার সম্পর্ক।‘

গুরুদেবের বক্তৃতা হৃদয়ঙ্গম ক’রতে পারলো না মিনি; তার দু-চোখ দিয়ে বেরিয়ে এলো অবিশ্রান্ত জলের ধারা।

***সমাপ্ত***

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু