বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

চরিত্র বোঝা দায়?


                চরিত্র বোঝা দায়!
(সামাজিক বাস্তবতায় ছোট উপন্যাস)


  লেখক :- শংকর হালদার শৈলবালা।
দত্তপুলিয়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
হোয়াইট অ্যাপ নম্বর :- 8926200021

শিরোনাম :- চরিত্র বোঝা দায়!
শ্রেণী:- সামাজিক বাস্তবতায় ছোট উপন্যাস।
বিষয় :- নারী পুরুষের চরিত্র নিয়ে সাংসারিক জীবনের ঘটনা।
লেখকের নাম :- শংকর হালদার শৈলবালা।
শ্রেণী :- ছোট উপন্যাস।

    ----------------------------------------------------------
            

                  ।।  প্রথম অধ্যায় ।।


সুরেন্দ্র দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে নমিতার খোঁজ খবর রাখে না। নমিতা পুরনো শহর ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছে । অফিস থেকে জানাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। সুরেন্দ্র ব্যবসার জন্য একটি শহরে বসবাস শুরু করেছে। একদিন বিকালবেলা ক্লান্ত শরীর নিয়ে পার্কে  ঘাসের উপর বসে আছে। হঠাৎ একটি কিশোর এসে পিছনের দিক থেকে জামা ধরে টানতে শুরু করে। 


সুরেন্দ্র বিরক্ত হয়ে বলে :- কেন বিরক্ত করছো ? মায়ের কাছে যাও ,না হয় অন্য কোন জায়গায় গিয়ে খেলা করে। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।

 কিশোর পড়ে যাওয়ার অভিনয় করে কান্না শুরু করে দেয়।

সুরেন্দ্র কান্না শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখে ভাবে মনে:- আমার ছেলে নলিনী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এই শহরে আসবে কি করে! ওর মা তো চাকরি করে। কাছে ডেকে নিয়ে আদর করতে করতে পরীক্ষা করার পর নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারে এই সন্তান নমিতার ছাড়া অন্য কাহারো নয়।


কিশোর টি সুরেন্দ্রের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, এমন ভাবে দেখছে কত দিনের আপনজন হারিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ দেখা হয়েছে।


সুরেন্দ্র কিশোর টি কে কোলের উপর বসিয়ে বলে :-  তোমার নাম কি ?


কিশোর টি বলে :- আমাকে সবাই দুখিরাম বলে ডাকে কিন্তু এই নামটি আমার একদম পছন্দ না।


 সুরেন্দ্র বলে :- তোমার ভালো আর নাম নেই!


 কিশোর টি বলে :- আছে, স্কুলের নাম নলিনী দত্ত।

 সুরেন্দ্রের বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে। 


দুখিরাম বলে :-কাকা, আমার নাম শুনে আপনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন কেন ?


সুরেন্দ্র বলে :- তোমার মায়ের নাম কি ?


দুখিরাম বলে :-  আপনি উল্টো প্রশ্ন করছেন, সবাই তো বাবার নাম জিজ্ঞাসা করে।


 সুরেন্দ্র বলে :- তোমার বাবা-মায়ের নাম বল।


দুখিরাম বলে :- বাবার নাম সুরেন্দ্র নাথ দত্ত আর মায়ের নাম নমিতা দত্ত।


সুরেন্দ্র বলে :- তোমার বাবা বাড়িতে থাকেন!

বলে ভাবনা জগতে চলে যায়। পুরনো দিনের স্ত্রী ও ছেলে হারানোর যন্ত্রণা আবার সামনে চলে আসে, বুকের মাঝে চিনচিন করে ব্যথা শুরু হয়।


দুখিরাম বলে :- কাকাবাবু মায়ের মুখে শুনেছি, আমার যখন সাত বছর বয়স- সেই সময় বাবার সাথে মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে। কেন বিবাহ বিচ্ছেদ হয়! আমাদের মতো শিশুদের কথা এইসব মা-বাবারা একদম ভাবে না। তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষা করতে, আমাদের মত শিশুদের অনাথ বানিয়ে চলে যায় । তাহলে আমাদের মতো শিশুদের কেন জন্ম দেয় ?  বাবার জন্য আমার মনে অনেক কষ্ট হয়। যখন অন্য বন্ধু-বান্ধবদের স্কুল ছুটির পর বাবা মা তার সন্তানদেরকে আদর করে বাড়িতে নিয়ে আসে। আদর করে কথা কথা বলে। তখন বাবাকে কল্পনা করতে থাকি, তবুও বাবা তো আসে না। আদর করে কোলে তুলে নেয় না। আবার বাবার উপর ভীষণভাবে রাগ হয়। আমাকে ও মাকে কেন ছেড়ে চলে গেল! লোকের মুখে শুনেছি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক ঝামেলা ও অশান্তি হলে নাকি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে কিন্তু আমাদের মতো শিশুদের মুখের দিকে চেয়ে সমাধান সূত্র বের করতে পারে।


সুরেন্দ্রের, কিশোর দুখিরামের কথা শুনে পাষাণ হৃদয়ে আঘাত লাগে, ভাবে মনে মনে আমার উদ্দেশ্যে অজান্তেই কথাগুলো বলছে। চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।


 দুখিরাম তার কোমল হাত দিয়ে সুরেন্দ্রের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে :- কাকা, আমার মত আপনার মনের মধ্যে অনেক দুঃখ আছে কি?

সুরেন্দ্র ভাবে মনে বাবা হয়ে আজ সন্তানের কাছে থেকে কাকা ডাক শুনতে হচ্ছে। এর থেকে লজ্জার আর কি আছে? নমিতার খামখেয়ালীর জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ হলো।

 সুরেন্দ্র আবেগের বশবর্তি হয়ে  দুখিরাম

 কে জড়িয়ে ধরে বলে :- বাবা, আমিও তোমার মতো একটি সন্তানকে হারিয়ে ফেলেছি। হয়তো বেঁচে থাকলে তোমার মতই বড় হয়েছে।  আমিও সন্তানকে হারিয়ে তোমার মতই দুঃখের সাগরে বিরাজ করছি। তোমার বাবার মুখ মনে আছে!


দুখিরাম বলে :- কয়েকদিন আগে মায়ের আলমারিতে আমার কিছু জিনিস খুঁজতে গিয়ে, একটা ছবি দেখেছিলাম। একটি ছবিতে মায়ের সঙ্গে তিনজন আছে। তার মধ্যে  বাবা-মায়ের সাথে আমার শিশুকালের ছবি আছে। তৃতীয় ছবির সঙ্গে আপনার চেহারা মিল খুঁজে পাচ্ছি। আপনি কি আমার সেই হারানো বাবা?


 সুরেন্দ্র বলে :- না বাবা, মানুষের চেহারার সাথে মানুষের মিল থাকতে পারে। তুমি আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে, প্রতিদিন আমরা এখানে গল্প করবো।


দুখিরাম বলে :- ঠিক আছে বন্ধুত্ব করলাম।


সুরেন্দ্র ভাবে মনে মনে :- নলিনীর প্রাপ্তবয়স্ক হতে এখনো ছয় বছর বাকি আছে। ছয় বছর পরে  নমিতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কিন্তু সন্তানের অধিকারের দাবি করতে পারবো। এখন আমার পরিচয় গোপন রাখতে হবে।


 দুখিরাম বলে :- এত কি ভাবছেন?


সুরেন্দ্র বলে :- বাড়িতে যাও আর মন দিয়ে পড়ালেখা করবে এবং মায়ের অবাধ্য হবে না।

বাবার  স্নেহ ভালোবাসা না পেলেও কিন্তু মা তো তোমার পাশে আছে।

         ------------------------------------   

        

                 ।। দ্বিতীয় অধ্যায় ।।


পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিসের কর্মচারীদের বিশ্রাম ঘরের মধ্যে দুজন নর-নারী পাশাপাশি বসে বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে।


নরেন নামে এক সাধারণ অফিসার, নমিতার হাতে হাত রেখে  বলে :- আর কতজনকে তোমার রূপের মহিমায় জড়িয়ে নাটক করে যাবে।


নমিতা হাত সরিয়ে নিয়ে বলে :- যতদিন ইচ্ছা ভালবাসা চালিয়ে যাবো। দীর্ঘদিন এককি অফিসের ছাদের নিচে বসবাস করছি কিন্তু হঠাৎ করে আজ এই প্রশ্ন করছো কেন?


 নরেন বলে :- কেন প্রশ্ন করছি, চোখের সামনে যা দেখি কিন্তু তা কখনো অস্বীকার করতে পারবোনা। আমাদের অফিসের সর্বময় কর্তা সুরেন্দ্র বড় বাবুর সঙ্গে যেভাবে চলাফেরা ঢলাঢলি করছো। তাতে সময়ের চক্করে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে নিয়ে আসবে। বড়বাবু অবিবাহিত থেকে রক্তে মাংসে নারী পিপাসু।


 নমিতা মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বলে :- পিপাসার জল দান করব। আমার মত সুন্দরী, স্বাস্থ্যবান দেহ ও শিক্ষাগত মর্যাদা অনুসারে কিন্তু এই অফিসে আমার কর্ম পেয়েছি কি ?


নরেন বলে :- কি পাওনি! তুমি কয়েক বছরের মধ্যে যা সুযোগ সুবিধা পেয়েছো কিন্তু তা দীর্ঘদিন কোন কর্মচারী পায়নি। ভাগ্যচক্র কে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের অনেকের থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকা সত্ত্বেও কিন্তু সুরেন্দ্র বাবু  অফিসের বড় অফিসার।


নমিতা বলে :- বড় অফিসার হতে বর্তমান শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। ছলচাতুরি আর কাজের অভিজ্ঞতার সাথে টাকার জোর। আমার চিন্তা ধারা বাস্তবায়ন করার জন্য কিন্তু আমি কোন দিন কোন মানুষের সাথে আপস করিনি। আমাকে আরো উপরে উঠতে হবে। যদি বড় বাবুর সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতে হয়, তা কিন্তু দীর্ঘদিন চালিয়ে যাবো। নরেন; যৌবনের আবেগের বশবর্তী হয়ে তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু কখনোই অধিকারের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না। 


নরেন বলে :- না, আমি আর চেষ্টা করবোনা।  তোমাকে ভালোবাসি বলেই সাবধান করে দিচ্ছি, কারণ আমি এই অফিসে দীর্ঘদিন চাকরি করছি। আমার চোখের সামনে কতনা অঘটন ঘটেছে। প্রত্যেকটি ঘটনাই তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি।


 নমিতা বলে :- জানিয়েছো বলেই কিন্তু বড় বাবুর দুর্বলতার জায়গা গুলো খুঁজে পেয়েছি। আমি থেমে থাকার জন্য জন্ম নেইনি। তোমার মিনমিনিয়ে স্বভাবের কারণে কিন্তু আমার ঠিক সবসময় পছন্দ হয় না। তবুও তোমার সঙ্গ দিয়ে চলেছি কারণ তুমি আমার বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করে।

 

সুরেন্দ্র বাবু কে আসতে দেখে দুজনেই চুপচাপ হয়ে যায়। সুরেন্দ্র বাবু ও নমিতার মধ্যে চোখাচোখি হতে থাকে। নরেন তাড়াহুড়ো করে হলঘরের চেয়ার ছেড়ে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে অফিসের নির্দিষ্ট নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। অফিসের একটা ফাইল খুলে দেখতে থাকে। 

           ------------------------------------


                ।। তৃতীয় অধ্যায় ।।


নমিতার বিবাহ বিচ্ছেদের দীর্ঘ কয়েক বছর পর, এক রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্মৃতির পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে ভাবতে থাকে। একদিন হঠাৎ করে অফিস ছুটির মুহূর্তে সুরেন্দ্র বাবুর অফিসের নিরাপত্তা রক্ষী কে দিয়ে-আমাকে জরুরি কাজের জন্য অফিস রুমে ডেকে নিয়ে আসে। 


আমি (নমিতা) ফাইল পত্র নিয়ে হাসি হাসি মুখে বড়বাবুর অফিসের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিরাপত্তা রক্ষী না থাকায় বুকের কাপড় হালকা করে সরিয়ে, খোলা দরজা দিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়ি। হাত পা নেড়ে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে শরীরের গোপন অঙ্গ দেখানোর চেষ্টা করি।

 

দুস্টুমি করে হাসি হাসি মুখ করে বলি :- বলুন স্যার, কেন ডেকেছেন ?


সুরেন্দ্র বাবু মুগ্ধ নয়নে আমার অর্ধ অনাবৃত বুকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে :- বিশেষ কাজের জন্য ডেকেছি। দুরে দাড়িয়ে কেন! আমার পাশের চেয়ারে বসুন।


আমি (নমিতা) ফাইলগুলো টেবিলের উপর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলি :- স্যার, নজর লেগে যাবে। মনে হচ্ছে ভিন্ন গ্রহের নারী কে দেখছেন। এভাবে দেখার কি আছে?


সুরেন্দ্র বাবু বলে :- বহু মানুষের মাঝে কাজের মাধ্যমে দেখেছি। এত কাছে থেকে একা রুমের মাঝে নিরিবিলি পরিবেশে কিন্তু তোমার দেহ পল্লবীর শাখা প্রশাখা দেখিনি। দেখার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু হয়তো তুমি বুঝতে চাওনি।


আমি (নমিতা) সুরেন্দ্র বাবুর আরো কাছে এসে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলি :- সমুদ্রের নোনা জলে সাঁতার কাটার ইচ্ছা হয়েছে। গভীর সমুদ্রের মাঝে হাবুডুবু খাবে কিন্তু তবুও সমুদ্রের নিচের মাটি খুঁজে পাবে না।


সুরেন্দ্র বাবু আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কিন্তু প্রথমে হাত চেপে ধরে। তারপর কিছু বলছি না দেখে আমাকে (নমিতা) বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। আমি পুরুষের পরশ পেয়ে আনন্দিত মনে চুপচাপ থাকি।


সুরেন্দ্র বলে :- চলে পাশের রুমে যায়।


আমি কলের পুতুলের মতো সুরেন্দ্রের সাথে পাশের রুমে ঢুকে দেখি, রুমের মধ্যে খাট বিছানা সব ব্যবস্থা আছে। সেদিন আমার মনের ও শরীরের মধ্যে এক রোমান্টিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। 

সুরেন্দ্র আমাকে আদর করতে করতে বিছানায় নিয়ে আসে।


আমি (নমিতা) কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে নাটক করে বলি :- ছাড়ুন, ছাড়ুন। আমি এখনো কুমারী কিন্তু আমার কুমারীত্বের সর্বনাশ করবেন না। সেই দিন বড়বাবুর কাছে মন প্রাণ দেহমন যৌবন সমাপন করে দিয়েছিলাম। মুখে বারবার বলছিলাম, আমার কুমারীত্ব সর্বনাশ করবেন না। 

 

সুরেন্দ্র বাবু আমার  আদর করতে করতে বলে :- না, না করে না। একমাত্র আমার ইচ্ছায়, তুমি না বলতেই অফিসে সব রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছো। তোমাকে চাকরির আরো উঁচু জায়গায় পৌঁছাতে হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো। শুধু তুমি আমাকে একটু ভালোবাসা দাও।


 আমার মন ও প্রাণ আদরে আদরে সারারাত ধরে ভরিয়ে দিয়েছিল। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ বড়বাবু। আমাকে কয়েক দিনের জন্য ছুটি দেয় আর টাকার বান্ডিলের সাথে সোনার অলংকার, দামী কাপড় উপহার দিয়েছিলেন। এরপর দুইজনেই কয়েক বছর ধরে যৌবনের উন্মাদনার খেলায় মেতে উঠি। হঠাৎ একদিন অনুভব করি আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছি। 


একদিন রাতে সুরেন্দ্র সাথে শয্যাশায়ী হয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে বলি :- আমার অসাবধানতার কারণে তুমি বাবা হতে চলেছে। সমাজ ব্যবস্থার হাত থেকে মান সম্মান বাঁচানোর জন্য কিন্তু আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে‌। আমাকে ও আগত সন্তান কে সমাজের কাছে স্বীকৃতি দাও।


সুরেন্দ্র  উত্তেজিত হয়ে আমাকে পাশে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে উঠে বলে :- তোমার সন্তানের দায়ভার নিতে পারবো না।  এই সন্তান কে আমি স্বীকার করি না কারণ আমি ছাড়াও তোমার গোপনে গোপনে নরেনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। বরং বাচ্চাটি কে গর্ভের মধ্যে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।


আমি (নমিতা) রাগে গজগজ করতে করতে বলি :- আমার গর্ভের শিশু কিন্তু তোমার সন্তান। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরীর আগে নরেন কে ভালবাসতাম কিন্তু দৈহিক মিলনের কোনো চাহিদা ছিল না। আমাকে বিয়ে করে অবশ্যই সন্তানের বাবার পরিচয় তোমাকেই দিতে হবে।


সুরেন্দ্র বলেছিল :- আমাকে তো টাকা আর পদমর্যাদা লাভের জন্য ব্যবহার করে চলেছ। এখন আবার অবৈধ সন্তানের স্বীকৃতি। পতিতা নারীর অবৈধ সন্তানের সামাজিক স্বীকৃতি কেউ কোনদিন দেয়নি আর কোন দিন দেবে না। টাকার বিনিময়ে দেহ ভোগ করতে দিয়েছো। বলো গর্ভপাত করার জন্য কত টাকা চাই!


আমি (নমিতা)  অসমাপ্ত যৌনক্ষুদায় উত্তেজিত হয়ে কিন্তু উত্তেজনাবশত বলি :- তুমি; কয়েকবছর ধরে আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেহ ভোগ করে চলেছে কিন্তু এখন সন্তানকে অস্বীকার করছো ! আমি তোমাকে ছাড়বো না। থানা পুলিশ করে ছাড়বো। টাকা দিয়ে আমার মুখ বন্ধ রাখতে পারবে না। তুমি অন্য সব মেয়ে পাওনি, আমি মান সম্মানের ভয় পায় না। আমার স্বার্থে আঘাত লাগলে কিন্তু বিষধর নাগিনী হয়ে ছোবল মারতে জানি। এক ছোবলে ছবি বানিয়ে ঘরে টানিয়ে দেবো।


সুরেন্দ্রের সাথে সেই রাতে তর্ক বিতর্ক করতে করতে এক সময় মারামারি শুরু হয়ে যায়। আমাকে যেমন আঘাত করে রক্তাক্ত করেছিল, কিন্তু আমি সুরেন্দ্র কে আঘাত করে নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়ে রক্ত ঝরিয়ে ছিলাম। আমার লম্বা লম্বা চুলগুলো আমার সাথে ভীষণ ভাবে শত্রুতা করেছিল। সুরেন্দ্র আমার চুল ধরে ঘরের মেঝেতে শুয়ে দিয়ে কিন্তু গর্ভের সন্তান নষ্ট করার জন্য বুকের উপর উঠে প্রচন্ড বেগে তলপেটে আঘাত করেছিল। প্রচণ্ড আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কিন্তু সুরেন্দ্রের নাকে ঘুষি মেরে পালিয়ে জীবন রক্ষা করি।

          ------------------------------------------


                 ।। চতুর্থ অধ্যায় ।।


নমিতা হাসপাতালে গিয়ে আঘাতের চিহ্ন গুলো দেখিয়ে অত্যাচারের এবং অন্তঃসত্ত্বার রিপোর্ট তৈরি করে। তারপর সোজা থানায় গিয়ে সুরেন্দ্রের নামে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস, অন্তঃসত্ত্বা সন্তানের অস্বীকার করা ও গর্ভ নষ্ট করার জন্য মারধরের অভিযোগ করে মামলা দায়ের করে।


পুলিশ নমিতার অভিযোগের ভিত্তিতে সুরেন্দ্র কে অফিস থেকে গ্রেপ্তার করে। উকিলের মাধ্যমে ছয় মাসের আগে জামিন না পায় তার ব্যবস্থা করে। অফিসের উপর মহলের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত অনুসারে সুরেন্দ্র কে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। মামলা আদালতে বিচারাধীন কিন্তু দেখতে দেখতে নমিতার গর্ভ দশ মাস দশ দিন পূর্ণ হয়ে যায়। কুমারী মা তার সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে কিন্তু অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। একসময় নার্সিং হোমের সঙ্গে যোগাযোগ করে বহু টাকার বিনিময়ে প্রসূতি নিস্তার পায়।


সুরেন্দ্র ছয় মাস পর জামিন পাওয়ার পর আবার নমিতা আদালতে উপস্থিত হয়ে সুরেন্দ্র ও শিশু নলিনী কে ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য আবেদন করে।

আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে ছেলে ও বাবার ডিএনএ পরীক্ষায় সুরেন্দ্রের সন্তান নমিতার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে প্রমাণিত হয়।


সুরেন্দ্র জেল খাটার দায় থেকে মুক্তি পাবার জন্য উকিলের মাধ্যমে ভুল স্বীকার করে। নমিতাকে বিয়ে করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানায়। নমিতা এক কথায় রাজি হয়ে যায়।

 আদালতের বিচারকের সিদ্ধান্ত অনুসারে আদালত প্রাঙ্গণে নমিতা শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে সুরেন্দ্রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। 


কয়েক বছর যেতে না যেতেই সংসারে আবার চরম আকারে অশান্তি শুরু হয়। সুরেন্দ্র সন্তানের কোন দায়িত্ব পালন করে না কিন্তু নমিতার সামনে সন্তানের জন্য লোক দেখানো দরদ উথলে ওঠে। 


 একদিন রাত আটটার সময় নমিতা অফিস থেকে বাসা বাড়িতে আসার পর, সুরেন্দ্র উত্তেজিত হয়ে বলে :- চাকরি ছেড়ে দিয়ে, সন্তানের দেখাশুনার দায়িত্ব নাও; চাকর-বাকর দিয়ে সন্তান লালন পালন হয় না। আমি তো একটা কাজ করি।


 নমিতা উত্তেজিত হয়ে বলে :- তুমি যে কাজ করো, তাতে আমার পোশাক-আশাক, প্রসাধনী খরচ, এই দামি ফ্ল্যাট ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ,চাকর বাকর ও সংসারের ভালো খাবার জুটবে না-সন্তান মানুষ করা তো অনেক দূরের কথা। সন্তানের জন্য মাসে কত খরচ তা জানো। তোমার টাকা আমি ছুঁয়ে দেখি না বরং আমার টাকায় তোমার ফুটানি। 


 সুরেন্দ্র করুণ সুরে বলে :- সবই তো তোমার জন্যই হারিয়েছি। আমার চাকরি চলে গেল আর তোমার পদোন্নতি ঘটলো। আমার জাগায় তুমি বসলো। আর আমাকে জেলে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ও প্রতারনার ফাঁদে ফেলে হুমকি দিয়ে বিয়ে করলে। তাহলে এখন কেন আমার উপর মানসিক নির্যাতন করছো! রাতে স্বামী হিসেবে এক ঘরে থাকার তোমার অনুমতি নেই। তুমি বেশি টাকা আয় করে বলে কিন্তু সব সময় তোমার কথা মতো চলতে পারবে না।


নমিতা উত্তেজনা বশতঃ বলে :- আমি চাকরি ছাড়তে পারবে না বরঞ্চ প্রয়োজনবোধে তোমার মতো অপদার্থ পুরুষ মানুষ ছেড়ে দিতে পারি।


সুরেন্দ্র উত্তেজিত হয়ে বলে :- এখন তো তুমি আর সাধারণ কর্মচারী না। অফিসের বড় অফিসার দিদি মনি আবার ইচ্ছা করলেই শত পুরুষ তোমার পায়ের কাছে গড়াগড়ি দেবে। যার শীল যার নোরা তার ভাঙ্গলো দাঁতের গোড়া। বিশ্বাসঘাতক বেমানান বড় অফিসার হয়েছে।


নমিতা উত্তেজিত হয়ে বলে :- আমার চরিত্রকে নিয়ে সমালোচনা ও সন্দেহ করা হচ্ছে! তোমার নিচু মন মানসিকতার কারণে আমার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছো। নিজের চরিত্র যোনো ফুলের মতো পবিত্র। অফিসের অনেক মেয়েদের সর্বনাশ করেছে। মেয়েরা গঙ্গা জলের মতো স্বচ্ছ ও পবিত্র। তোমার মতো ঘোলা পচা দুর্গন্ধযুক্ত নয়। 


সুরেন্দ্র বলে :- অফিসের নরেন; এখনোও তোমার ভালবাসার ডালি সাজিয়ে অপেক্ষা করে আছে।

 প্রাক্তন প্রেমিকের উপর কত দরদ, রাতে একদিন ফোন না করলে ঘুম আসে না।


নমিতা আঙ্গুল উঁচু করে বলে :- সাবধান; নরেন কে নিয়ে কোন বাজে মন্তব্য করবে না। তোমার মত চরিত্রহীন লম্পট নয়-মেয়েদের দেখলেই কিন্তু লিঙ্গ  থেকে লালা ঝরা শুরু করে। সাবধান; আমার সাথে শত্রুতা করলে কিন্তু তোমার পায়ের নিচেই কোন রকম দাঁড়িয়ে থাকার মাটি খুঁজে পাবে না।


নমিতা রাগে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে বড় বড় পা ফেলে নিজের রুমের দিকে চলতে থাকে।


 একদিন রাতে একলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সুরেন্দ্র ভাবে :- আর কতদিন এভাবে একা থাকবো। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে কয়েক বছরে বিশাল আকারে ফাটল ধরেছে আর এক ছাদের নিচে বসবাস করা যাবে না। আমারও তো কোন নারীর আশ্রয় চাই কিন্তু একঘেয়েমি জীবন আর ভালো লাগছে না। হয়তো যৌবনের উন্মাদনায় কিছু ভুল করে ফেলেছি আবার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার অনেক চেষ্টা করলাম। নমিতার একঘেয়েমি মনোভাব ও চলাফেরা আর ভালো লাগেনা। সংসারের সিংহভাগ ব্যয় বহন করে বলে বড় অহংকার হয়েছে কিন্তু আজকের এই পদমর্যাদা কার জন্য পেয়েছে।

 আমি এই বাড়ির এখন চাকরের যোগ্য নই কারণ নমিতা আমার থেকে বাড়ির চাকর বাকরের সঙ্গে অনেক ভালো ব্যবহার করে থাকে।

 ইদানিং দেখছি নমিতার রূপের অহংকার অনেক বেড়ে গিয়েছে কারণ বাইরে বেরোলেই দামি দামি শাড়ি গয়না প্রসাধনী ব্যবহার করেই বাড়ি থেকে বাহির হয়। হয়তো অন্য কোন পুরুষের আকর্ষণ করে দেহের আগুন নিবারণের চেষ্টা করে। 

নমিতা আগের দিন গুলোতে প্রতি রাতে দেহ সুখ ছাড়া থাকতে পারতো না কিন্তু এখন বছরের পর বছর থাকে কি করে?


প্রতিদিনের ঝগড়া অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় সুরেন্দ্র ও নমিতা উভয়ের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে উত্তেজনাপূর্ণ কথা কাটাকাটির মাধ্যমে আদালতের বিচারকের দারস্থ হয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। 

আদালতের বিচারকের রায় অনুসারে সাত বছরের শিশু সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব নমিতাকে পালন করতে হবে। আজকের শিশু সন্তান ১৮ বছরের প্রাপ্তবয়স্ক হলে পিতার অধিকার থাকে কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কার কাছে থাকবে। 


সুরেন্দ্র আদালতে দাঁড়িয়ে ভাবে মনে মনে :- তাহলে ১১ বছর পরে কিন্তু নমিতার কাছ থেকে ছেলে নলিনী কে কেড়ে নিয়ে চরম অপমানের সঠিক জবাব দেবো।


নমিতা শিশু সন্তানকে নিয়ে নতুন ভাড়া বাড়িতে চলে আসে আর সুরেন্দ্র পিতৃ-মাতৃভূমি নিজের গ্রামে চলে যায়।


 নমিতা তার শিশু সন্তানকে নামিদামি একটি স্কুলে পড়াশোনার জন্য ভর্তি করে দেয়। 

      ------------------------------------------------


                ।। পঞ্চম অধ্যায় ।।


নমিতা এখন সমাজের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে কিন্তু মনের দিক থেকে কোন শান্তি লাভ করতে পারছে না।


নমিতা ভাবে মনে মনে :- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কখনো শান্তি আবার কখনো অশান্তির মধ্যে দিয়েই সংসার চক্র চলে কিন্তু সুরেন্দ্র কে ত্যাগ করে ভালো কাজ করিনি। ছেলে নলিনীর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার যন্ত্রণাদায়ক বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে পড়েছি। কোথায় কোথায় বলবে নিশ্চয়ই বাবার সাথে তুমি ভীষণ খারাপ ব্যবহার করেছিল, তা না হলে বাবা তোমাকে ত্যাগ করে চলে গেল কেন!

ইদানিং বলা শুরু করেছে বাবার সাথে প্রতারণা করে চাকরির পদোন্নতি ঘটিয়ে আবার বাবাকে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করেছো । কিন্তু এসব তথ্য জানলো কি করে?  আমি সুরেন্দ্র ও নরেন ছাড়া আর তো কেউ জানে না। তাহলে কি ছেলের সাথে নরেনের যোগাযোগ হয়েছে! নরেন আমাকে না পাওয়ার বেদনায় হয়তো ছেলের কাছে সব ঘটনা বলে দিয়েছে। আমার সাজানো গোছানো সংসার টা আবার ভাঙতে চলেছে।  যার জন্য দেশের মায়া ত্যাগ করে বহু দূরে এসে বাড়িঘর তৈরি করলাম। বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনের মুখ দেখবো না বলে।

 আবার ছেলের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। সুরেন্দ্র তো হুমকি দিয়ে রেখেছে ১৮ বছর পূর্ণ হলে সন্তানকে ছিনিয়ে নেবে। হয়তো সুরেন্দ্র প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ছেলে ও বাবার দেখা হয়ে যায়নি তো!  আমাকে ভুল বুঝে সন্দেহ করার জন্যই তো, সুরেন্দ্র কে ত্যাগ করলাম। নরেনের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই, এই কথা ওকে বোঝাতে পারলাম না। আমি স্বীকার করছি তোমার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার আগে, নরেনের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কিন্তু কোনো শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন হয়নি।


 বিশ্বাস নামক শব্দটি যখন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়, তখন সংসারের এক ছাদের তলায় বাস করা যায় না। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সুরেন্দ্র সবসময় আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতো এবং  আমাকে কোন পুরুষের সাথে বা অফিসের পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা পর্যন্ত পছন্দ করত না। অফিসের পুরুষ সহকর্মীদের সন্দেহ করে কিন্তু তাদের মান সম্মান নষ্ট করতে। সুরেন্দ্রের বহু জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারে কিন্তু  বাধ্য হয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অন্তর থেকে এখনো ভালবাসি। 


আমারও তো একজন পুরুষের সাথে থাকার মন চায় এবং সামাজিক ভাবে একজন পুরুষ অভিভাবকের বিশেষ প্রয়োজন। স্বামী হিসেবে বট গাছের মতো ছায়া দান করে তার স্ত্রী কে বাঁচিয়ে রাখবে। বিবাহিত জীবনে পুরুষ অভিভাবক বিহীন সংসারে ও সমাজের বুকে কত রকম বাজে বাজে কথা শুনতে হয়। এই সমাজ ব্যবস্থা আমাকে বারবার পিছনের কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়।  স্বামী নামক পুরুষটি আমাকে বহু পুরুষের সঙ্গ করি, পতিতা অপবাদ দিয়ে কলঙ্কিত করল। সুরেন্দ্র; অসভ্যর মতো বাজে কথাবার্তা বলতে শুরু করলো। কোন পুরুষ টাকা দিলেই নাকি, আমি সেই পুরুষের শয্যাশায়ী। খোলা বাজারের পতিতা হয়ে গেছি।


হে স্বামী নামক পুরুষ সুরেন্দ্র নিজের চরিত্র খানা একবার আয়নায় দেখেছেন। অফিসের প্রতিটা নারীকে তোমার যৌন লালসার শিকার হতে হয়েছে। আমি তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার ভালো ভাবে জীবন যাপনের কোন সৎ ইচ্ছা নেই। মান-সম্মান মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে নোংরা কাজগুলো করবে।


আমার মান-সম্মান, আভিজাত্য ও চাকরি কে বজায় রাখার জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না। তোমার মুখ দেখবো না বলেই, রাগ করে স্থান পরিবর্তন করেছি কিন্তু অন্তর্জগতের মাঝে বারবার তোমার স্মৃতিগুলো ভেসে আসে।  

  

 হয়তো, তুমি স্বাধীনভাবে জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে আরও না কত নারীর সর্বনাশ করে চলেছো। 


আমার যত বয়স বৃদ্ধি হচ্ছে, ততই নানা রকম ভাবনা এসে উপস্থিত হচ্ছে । আমাকে, ছেলে নলিনী বাবা বাবা করে পাগল করে দেবে কিন্তু বাবাকে এখন কোথা থেকে এনে দেবো! 


ছেলেটা, মায়ের কথা একবারও ভাবে না। কত কষ্টের মধ্যে দিয়ে লালন পালন করে বড় করেছি। মায়ের দুঃখ টা একবার বোঝার চেষ্টা করে না।


ছেলে কে বলেছি :- তোর জন্মদাতা পিতার স্বীকৃতি লাভের জন্য আমাকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।


ছেলে বলে কিনা; সেটা তোমার ভুল। উল্টে আমাকে প্রশ্ন করে; কেন জেনেশুনে আমাকে পৃথিবীতে এনেছে, বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করার জন্য! হয়তো বাবার সাথে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অন্যায় কাজ করেছ- যা বাবার একদম অপছন্দ।

যেমন বাপ তেমন ছেলে, অন্যের কথার কোন মূল্য নেই- নিজে যেটা ভালো মনে করবে সেটাই করবে। কিন্তু একটাই সান্ত্বনা বাপের মত চরিত্রহীন ছেলে হয়নি।


মা মা বলে ছেলে দুখিরাম দরজায় ধাক্কা দেয়। নমিতার চিন্তার চমক ভাঙ্গে ছেলের ডাক শুনে।


দুখিরাম মায়ের পাশে এসে বসে কপালে হাত দিয়ে বলে :- মা, এখনও শুয়ে আছো! অসুখ-বিসুখ করেনি তো?


নমিতার ভাবনার জগতে ডুবে গিয়ে ভাবে :- ছেলের বাবা, লোকটা যতই খারাপ হোক না কেন! আমার এই ভাবে শুয়ে থাকা দেখলেই, অস্থির হয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছেলেটা ঠিক , সেই রকম বাপের মতো।


দুখিরাম মায়ের চোখের জল মুছতে মুছতে বলল :- মা, তোমাকে তো কোনদিন কান্না করতে দেখিনি। কথা বলছ না কেন! তোমার কি হয়েছে? 


নমিতা ছেলে কে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। অজানা কোন আতঙ্কের ভয়ে। বাবা, আমাকে ছেড়ে কোনদিন চলে যাবে না তো!


 দুখিরাম বলে :- মা তুমি কি পাগল হয়ে গেছে! তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব বলতো?


নমিতা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলে :- আজ তাড়াতাড়ি চলে আসলি।


দুখিরাম বলে :- পার্কে, বয়স্ক এক বন্ধুর সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা বলি কিন্তু আজ উক্ত বয়স্ক ব্যক্তি শরীরটা ভাল নেই বলে দেখা করে চলে গিয়েছে।

 জানো মা পার্কের ওই ভদ্রলোকের মনে অনেক দুঃখ, আমার মতো ছেলে নাকি হারিয়ে গিয়েছে আবার দেখতে ঠিক আমার বাবার মতো ।


 নমিতা চমকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে :- তোর বাবার মত কি করে বুঝলি! তুই তো বড় হয়ে বাবার ছবি পর্যন্ত দেখিসনি?


দুখিরাম বলে :- ওই সাত বছর বয়সের সময়, বাবা আমাকে অনেক আদর করতে-বাবার  স্মৃতি আমার অন্তরের অন্তর স্থলে গেঁথে রেখেছিলাম, সেই হিসাবে বললাম। এই ভবঘুরে চালচুলোহীন মানুষটি আমার বাবা হতে যাবে কেন? আমার বাবা হবে মায়ের মত আভিজাত্যপূর্ণ ও অহংকারী।


 নমিতা বলে :- ওই ব্যক্তির নাম কিরে!


 দুখিরাম বলে :- ওই কী যেন বললে ভজহরি মান্না। বিকালের থেকে রাত অবধি পার্কে বসে থাকে।  সব সময় কি যেন চিন্তা করে!


 নমিতা বলে :- ওই লোকটার চেহারার বর্ণনা দো তো।


 দুখিরাম বলে:- আমার বন্ধুর চেহারার বিবরণ শুনে তোমার কি লাভ?

 বললাম তো বাবার মতো চেহারা কিন্তু বাবা নয়। 


নলিনী মুখ কালো করে বলে :- ঠিক আছে বাদ দে, একদিন না হয়-গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসবো। 


দুখিরাম মায়ের সঙ্গে ইয়ার্কি করে বলে :- সেই ভালো হবে। যদি সত্যি সত্যি বাবা হয়ে যায়। 


নলিনী বলে :- বাজে কথা রেখে চল, খেতে যাবি।

 

 নলিনী বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকে। তাহলে ছদ্দবেশী সুরেন্দ্র নয়তো! হয়তোবা বলেছে আমি তোমার বাবা, না হলে সাত বছর বয়সের স্মৃতি মনে থাকার কথা নয়। হে ঈশ্বর আমার সুখের সংসার টা আবার ভেঙে যাবে।

 হয়তো ছেলের অধিকার সূত্রে আবার আমার সাথে সম্পর্ক তৈরি করে, সম্পত্তির ভাগ নিতে চাইবে। কি যে করি বারবার কোর্ট-কাচারি আর ভালো লাগেনা।

          ------------------------------------------


                    ।। ষষ্ঠ অধ্যায় ।।

দুখিরাম অর্থাৎ নলিনী দত্তের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়ে দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে অর্থাৎ ২০ বছরের যুবক। নমিতার চিন্তায় চিন্তায় ঘুম খাওয়া-দাওয়া হারাম হয়ে গেছে। কোন কিছুই আর ভালো লাগছে না। কোনো রকম কোনো শব্দ শুনতে পেলেই, চমকিত হয়ে উঠে ভাবে-ছেলেকে নেওয়ার জন্য

এই বুঝি সুরেন্দ্র এলো। 


সুরেন্দ্র এক রবিবারের দুপুর বেলায় সদর দরজায় দাঁড়িয়ে নমিতা নমিতা বলে ডাকতে ডাকতে কলিংবেলে চাপ দেয়। সুরেন্দ্র এতো জোরে চিৎকার করেছে, নমিতার দোতলার রান্না ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। নমিতা রান্নার দায়িত্ব কাজের মাসিকে দিয়ে দুরুদুরু বুকে ভয়ে আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে। নিচের তলার সদর দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবে সুরেন্দ্রের সামনে যাওয়ার কোন মুখ নেই কিন্তু পা আর এগিয়ে যাচ্ছে না। 


দুখিরাম সদর দরজার গেট খুলে বন্ধু কে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বাড়ীর মধ্যে নিয়ে আসতে আসতে চিৎকার করে বলে :- মা নিচের দিকে আসবে, আমার সেই বন্ধু এসেছে। বলেছিলাম না বাবার মতো দেখতে । দেখে যাও দেখে যাও।

সুরেন্দ্র ঘরের ভিতরে ঢুকতে গিয়ে নমিতার সাথে দেখা হয়ে যায়। নমিতা ভয়ে আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে।


দুখিরাম মায়ের হাত বলে :- দেখো দেখো মা, একদম বাবার মত দেখতে।


 সুরেন্দ্র বলে :- নলিনী; বাবার মত দেখতে নয়, তোমার জন্মদাতা বাবা সুরেন্দ্রনাথ দত্ত ও মা নমিতা দত্ত আর তুমি তাদের ভালবাসার ফসল নলিনী রঞ্জন দত্ত। নমিতা তাহলে পরিচয় করে দাও।


দুখিরাম বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাবা বাবা বলে ডাকতে ডাকতে প্রশ্ন করে। বাবা দীর্ঘ কয়েক বছর আগে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে কিন্তু পরিচয় না দিয়ে, এতদিন বাবার স্নেহ ভালোবাসা থেকে কেন বঞ্চিত করে রেখেছেন?


 সুরেন্দ্র চোখের জল মুছে পকেট থেকে আদালতের রায়ের কাগজখানা বের করে, নলিনীর হাতে দিয়ে বলে :- বাবা, এতদিন তোমার মায়ের সাথে কথা বলার বা দেখা করার কোন অধিকার ছিল না। আদালতের নির্দেশ অনুসারে তোমার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলে, তোমার মায়ের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সন্তানের অধিকারের দাবি জানাতে পারব। নমিতা আমি আমার সন্তানকে নিতে এসেছি।


নমিতা চিৎকার করে উঠে বলে :- না, আমার সন্তানকে কাউকে দেব না। আমার একার অধিকার, আমি জন্ম দিয়েছি-লালন পালন করেছি। তুমি সন্তানের বাবা হয়ে ছেলের জন্য কি করেছো ! জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না।


নমিতা, সুরেন্দ্রর কাছে থেকে নলিনী কে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার মতো টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বলে :- বাবা, আমাকে ছেড়ে চলে যায় না, তাহলে আমি আর বাঁচবে না। এই ব্যক্তি তোর বাবা আমি স্বীকার করছি কিন্তু আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই।


নলিনী মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে মায়ের বুকে মাথা রেখে ভাবে মনে মনে :- মা ও বাবাকে হারাতে চাই না। হে ঈশ্বর; তুমি নাকি পতিত পাবন হরি বিপদ ভঞ্জন কারি আমার এই জটিল সমস্যা থেকে উদ্ধার করো। আমার কর্তব্য নির্ধারণ করে দাও এবং বাবা মায়ের মনে শান্তি ফিরিয়ে দাও।


নমিতা উচ্চ কন্ঠে বলে :- নলিনী, তোর উড়ে এসে জুড়ে বসা বাবাকে বল একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।


সুরেন্দ্র বলে :- আমি রাজি।


দুজনে একটি রুমের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

নমিতা বলে :- বলো, ছেলের বিনিময়ে তোমার কত টাকা চাই কিন্তু ছেলেকে ছেড়ে যেতে হবে।


সুরেন্দ্র বলে :- জানি তুমি কোটিপতি কিন্তু তোমার সর্বোচ্চ ধন সম্পত্তি ব্যাংকের টাকা, আমাকে দিলেও- আমি সন্তানকে বিক্রি করবে না। 


নমিতা বলে :- তাহলে, ছেলের নাম করে বার বার আমাকে প্রতারণা করবে।


সুরেন্দ্র বলে :-  এখানে প্রতারণার কথা আসছে কেন! আমার ছেলে কে দিয়ে দাও। নিয়ে চলে যাবে আর কোন দিন তোমার সম্মুখে আসবে না।


নমিতা বলে :-  আমার বুঝতে বাকি নেই, আমি তোমার চরিত্র সম্পর্কে তো জানি। আমার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ভাগ নিতে চাও ! মুখে বলবে সততার কথা আবার অন্তরে বিষাক্ত বিষ ঢালবে।


সুরেন্দ্র পকেট থেকে ব্যাংকের পাসবুক বের করে নমিতার সামনে রেখে বলে :- আমি; তোমার টাকা সম্পত্তি ভাগ নিতে আসিনি, একমাত্র সন্তানের ভাগ নিতে এসেছি। বিবাহ বিচ্ছেদের পর আমাকে দয়া করে প্রতি মাসে দশ হাজার করে গত মাস  পর্যন্ত ব্যাংক একাউন্টে টাকা জমা করেছো, দেখে নাও তোমার একটি টাকাও হাজার বিপদের সময়েও খরচ করি নাই। আমি অর্থলোভী ছিলাম কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের পর সব পরিবর্তন করতে শুরু করেছি। 


সন্তান কে যদি না দাও তাহলে এবার আমি আদালতের মাধ্যমে ছেলেকে নিয়ে যাবে। উকিলের সাথে কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে। আমি যেমন ১৫ টি বছর স্ত্রী ও ছেলেকে হারিয়ে যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, সেই যন্ত্রণা আমিও তোমাকে সারা জীবন দিতে চাই।


নমিতা বলে :- নিশ্চয়ই তুমি বিয়ে করে সংসার করছো, তোমার সংসারে তো আরো সন্তান আছে। হাত জোড় করে বলছি আমাকে এই সন্তানকে দান করো। নলিনী ছাড়া আমি বাঁচতে পারবে না। তোমার পায়ে ধরে বলছি, আমাকে দয়া করে।


সুরেন্দ্র উত্তেজিত হয়ে বলে :- তোমার নাটক অনেক দেখেছি আর আমাকে তোমার মায়া কান্নায় ভোলাতে পারবে না। স্বামী কে ত্যাগ করে, ঘটা করে শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পড়ে আছে। যেন সতী সাবিত্রী, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না।  আমি দ্বিতীয় কোনো সংসার করিনি, তাহলে আদালতে যায়। 


বলে চলা শুরু করে দরজার কাছে আসতেই, নমিতা হাত ধরে জোর করে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলে :- রাগ করেছো কেন ? তোমার সন্তানকে তুমি নিয়ে যাবে, আমি বাঁধা দেওয়ার কে ! আমি এখনো তোমার মঙ্গল কামনা করে প্রতিদিন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তোমার আগে যোনে শাঁখা সিঁদুর নিয়ে যেতে পারি। আমার উপর রাগ করে, পাঠানো টাকা ছুঁয়ে দেখোনি-তাতে আমার কোন দুঃখ কষ্ট নেই।


নমিতা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আকাশ পাতাল ভাবনা চিন্তা করে বলে :- নলিনী বাবা, সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে, আমাদের মধ্যে মীমাংসা করে নিলে হয় না। আমরা আগের মতো আবার মিলিত করতে পারিনা। ভুল মানুষ মাত্রই করে কিন্তু আদালত কি সঠিক বিচার করতে পারে! আমরা দুজনেই ভুল সাজা পেয়েছি। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে সন্তানকে কেড়ে নিয়ে নতুন করে আবার আমাকে আর সাজা দিওনা।


সুরেন্দ্র বলে :- তা কি করে সম্ভব! দুই জন দুই মন মানসিকতার মানুষ।


নমিতা বলে :- সব সম্ভব গো, শুধু মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। আইন আদালত তো মানুষের জন্য কিন্তু সঠিক সমাধান নিজেদের করে নিতে হয়। আমাদের হারিয়ে যাওয়া জীবনের  বিগত ১৫ বছর আর কোন ফিরে আসবে না। তোমার দুর্ব্যবহার ও আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার জন্যই কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে তোমার সঙ্গ ত্যাগ করেছি। মনের থেকে কোনদিন ত্যাগ করতে পারিনি কারণ তুমি সন্তানের বাবা। তাই আজও তোমার দেওয়া শাঁখা-সিঁদুর পরে তোমার নামেই পরিচিত হয়ে আছি। স্বামীর নামটা বাদ দিতে পারিনি। এই বাড়ি ঘর সম্পত্তি যা কিছু করেছি, সবকিছুই আমার পাশাপাশি তোমাকেও তো রেখেছি কারণ তোমার সাথে আমার সম্পর্ক না থাকলেও অন্তর থেকে আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার উপরের উগ্র রূপ দেখেছো কিন্তু ভালোবেসে কোনদিন অন্তরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছ!  আমার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেই জায়গায় তুমি থাকলে- নিশ্চয়ই তুমিও আমার মত ব্যবহার করতে। আমিতো আমার নারীত্বের অস্তিত্ব বজায় রাখার লড়াই করেছিলাম। যে নারী কুমারী অবস্থায় সন্তান জন্ম দেয়, সমাজে তার স্থান কোথায়?


সুরেন্দ্র চুপচাপ থেকে ভাবতে শুরু করে।


নমিতা; সুরেন্দ্রের পায়ের কাছে বসে পড়ে আর চোখের জলে পা ধৌত করতে করতে বলে :- নলিনীর বাবা, আর যে জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিনা-আমাকে ক্ষমা করে দাও। সন্তানকে তো আর কেটে টুকরো করা যায় না। একটি সন্তানকে নিয়ে আমরা দুজন আবার মিলিত হই। তুমি যেভাবে বলবে, আমি ঠিক সেই ভাবে চলবে। আমি উপলব্ধি করেছি ,সংসারে পুরুষ অভিভাবক বিহীন ভাবে চলাফেরা করা ও স্বামী জীবিত থাকাকালীন সমাজের বুকে ভীষণভাবে বিপদজনক। পুরুষের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও, সম্পূর্ণ দোষ নারীর চরিত্রের উপর পড়ে। বাস্তবে কেউ বুঝতে চায় না। সংসারের মাঝে যত দোষ নারী কিন্তু পুরুষ মানুষের কোনো দোষ নেই।

 

সুরেন্দ্র; নমিতা কে পায়ের কাছে থেকে তুলে জড়িয়ে ধরে বলে :- তুমি; আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমার প্রতি ভীষণ ভাবে অন্যায় করেছি। নমিতা স্বামী কে জড়িয়ে ধরে।


হঠাৎ দরজার কাছে থেকে আওয়াজ আসে। আরো সুরেন্দ্র বাবু মান অভিমানের পালা শেষ করুন। নাটকের নতুন প্রজন্মের নতুন পালা শুরু হবে।

 

নমিতা তাড়াহুড়ো করে স্বামীর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বলে :- আরো মহেন্দ্র বাবু আপনি ।


মহেন্দ্র বাবু রুমের মধ্যে ঢুকে সোজা সুরেন্দ্রের কাছে গিয়ে ঘাড়ে হাত রেখে বলে :- আরে মশাই, এখন ছেলেমেয়েরা মান-অভিমানের পালা করবে- তা, না আপনাদের মান-অভিমানের পালা  ভাঙানোর জন্য কিন্তু ছেলে-বৌমার দরকার হয়ে পড়েছে। নমিতার উদ্দেশ্য করে বলে বিয়ান তাড়াতাড়ি বরণডালা সাজিয়ে নিয়ে আসুন। একসাথে আজ দুটো বিয়ে দিয়ে ছাড়বো। আমার নাম মহেন্দ্রনাথ শান্তি ঘটক কিন্তু অশান্তি একদম পছন্দ করি না। মা বাসন্তী এদিকে আয় তো।


 বাসন্তী তার মায়ের সাথে করে রুমের ভিতরে ঢুকে সুরেন্দ্র ও নমিতা কে প্রণাম করে।


 মহেন্দ্র বাবু; সুরেন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলে :- মশাই, আপনার ছেলে আর আমার মেয়ে ৫ বছর ধরে ভালোবাসা করছে, অঘটন ঘটার আগেই চার হাত এক করে দিতে চাই। 


নমিতা, সুরেন্দ্রের কাছে এসে কানে কানে বলে :- কি করবে গো ?


সুরেন্দ্র কানে কানে বলে :- আমি, সব জানি কিন্তু তোমার মতো অঘটন ঘটায়নি । ছেলে কার দেখতে হবে তো । নলিনী নলিনী বলে ডাকতে থাকে।


নলিনী রুমের মধ্যে ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ে। সুরেন্দ্র; নলিনী ও বাসন্তী কে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে চার হাত এক করে দেয়।  সেই মুহূর্তে শঙ্খধ্বনি ও উলুর ধ্বনি বেজে ওঠে। 


নমিতা বৌমার কে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে :- তোমার শ্বশুর বাবা কে, এবার আমরা দুজন মিলে এমন ভাবে বেঁধে রাখবে-পালানোর পথ খুঁজে না পায়। 


সুরেন্দ্র বৌমার উদ্দেশ্য বলে :- বৌমা, আমিতো সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই। তোমার শাশুড়ি তো কোনদিন পারিনি, তবে তোমার মেয়ে এসে যদি পারে। 


কাজের মাসি তালা ভরে মিষ্টি নিয়ে এসে বলে :-  তাহলে হারানো জামাইবাবু কে দিয়ে শুরু করি।


মহেন্দ্র বাবু মিষ্টি মুখে দিয়ে চিবাতে চিবাতে বলে :- আমার মেয়ের বিয়েতে ও বিয়ান নমিতা বিয়াই  সুরেন্দ্রের পুনরায় মিলন উপলক্ষে সবার সপরিবারে নেমন্তন্ন রইল, আসবেন কিন্তু।

----------------------------------------------------------

রচনাকাল :- ২৮ নভেম্বর ২৯২১ সালে।  

স্থান :- দত্তপুলিয়া যুব গোষ্ঠী ক্লাবের রুমে, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

----------------------------------------------------------

                      ।। সমাপ্ত ।।

----------------------------------------------------------


  প্রথম অধ্যায় ।।

সুরেন্দ্র দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে নমিতার খোঁজ খবর রাখে না। নমিতা পুরনো শহর ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছে । অফিস থেকে জানাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। সুরেন্দ্র ব্যবসার জন্য একটি শহরে বসবাস শুরু করেছে। একদিন বিকালবেলা ক্লান্ত শরীর নিয়ে পার্কে ঘাসের উপর বসে আছে। হঠাৎ একটি কিশোর এসে পিছনের দিক থেকে জামা ধরে টানতে শুরু করে। 

সুরেন্দ্র বিরক্ত হয়ে বলে :- কেন বিরক্ত করছো ? মায়ের কাছে যাও ,না হয় অন্য কোন জায়গায় গিয়ে খেলা করে। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
 কিশোর পড়ে যাওয়ার অভিনয় করে কান্না শুরু করে দেয়।
সুরেন্দ্র কান্না শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখে ভাবে মনে:- আমার ছেলে নলিনী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এই শহরে আসবে কি করে! ওর মা তো চাকরি করে। কাছে ডেকে নিয়ে আদর করতে করতে পরীক্ষা করার পর নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারে এই সন্তান নমিতার ছাড়া অন্য কাহারো নয়।

কিশোর টি সুরেন্দ্রের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, এমন ভাবে দেখছে কত দিনের আপনজন হারিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ দেখা হয়েছে।

সুরেন্দ্র কিশোর টি কে কোলের উপর বসিয়ে বলে :- তোমার নাম কি ?

কিশোর টি বলে :- আমাকে সবাই দুখিরাম বলে ডাকে কিন্তু এই নামটি আমার একদম পছন্দ না।

 সুরেন্দ্র বলে :- তোমার ভালো আর নাম নেই!

 কিশোর টি বলে :- আছে, স্কুলের নাম নলিনী দত্ত।
 সুরেন্দ্রের বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে। 

দুখিরাম বলে :-কাকা, আমার নাম শুনে আপনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন কেন ?

সুরেন্দ্র বলে :- তোমার মায়ের নাম কি ?

দুখিরাম বলে :- আপনি উল্টো প্রশ্ন করছেন, সবাই তো বাবার নাম জিজ্ঞাসা করে।

 সুরেন্দ্র বলে :- তোমার বাবা-মায়ের নাম বল।

দুখিরাম বলে :- বাবার নাম সুরেন্দ্র নাথ দত্ত আর মায়ের নাম নমিতা দত্ত।

সুরেন্দ্র বলে :- তোমার বাবা বাড়িতে থাকেন!
বলে ভাবনা জগতে চলে যায়। পুরনো দিনের স্ত্রী ও ছেলে হারানোর যন্ত্রণা আবার সামনে চলে আসে, বুকের মাঝে চিনচিন করে ব্যথা শুরু হয়।

দুখিরাম বলে :- কাকাবাবু মায়ের মুখে শুনেছি, আমার যখন সাত বছর বয়স- সেই সময় বাবার সাথে মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে। কেন বিবাহ বিচ্ছেদ হয়! আমাদের মতো শিশুদের কথা এইসব মা-বাবারা একদম ভাবে না। তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষা করতে, আমাদের মত শিশুদের অনাথ বানিয়ে চলে যায় । তাহলে আমাদের মতো শিশুদের কেন জন্ম দেয় ? বাবার জন্য আমার মনে অনেক কষ্ট হয়। যখন অন্য বন্ধু-বান্ধবদের স্কুল ছুটির পর বাবা মা তার সন্তানদেরকে আদর করে বাড়িতে নিয়ে আসে। আদর করে কথা কথা বলে। তখন বাবাকে কল্পনা করতে থাকি, তবুও বাবা তো আসে না। আদর করে কোলে তুলে নেয় না। আবার বাবার উপর ভীষণভাবে রাগ হয়। আমাকে ও মাকে কেন ছেড়ে চলে গেল! লোকের মুখে শুনেছি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক ঝামেলা ও অশান্তি হলে নাকি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে কিন্তু আমাদের মতো শিশুদের মুখের দিকে চেয়ে সমাধান সূত্র বের করতে পারে।

সুরেন্দ্রের, কিশোর দুখিরামের কথা শুনে পাষাণ হৃদয়ে আঘাত লাগে, ভাবে মনে মনে আমার উদ্দেশ্যে অজান্তেই কথাগুলো বলছে। চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।

 দুখিরাম তার কোমল হাত দিয়ে সুরেন্দ্রের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে :- কাকা, আমার মত আপনার মনের মধ্যে অনেক দুঃখ আছে কি?
সুরেন্দ্র ভাবে মনে বাবা হয়ে আজ সন্তানের কাছে থেকে কাকা ডাক শুনতে হচ্ছে। এর থেকে লজ্জার আর কি আছে? নমিতার খামখেয়ালীর জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ হলো।
 সুরেন্দ্র আবেগের বশবর্তি হয়ে দুখিরাম
 কে জড়িয়ে ধরে বলে :- বাবা, আমিও তোমার মতো একটি সন্তানকে হারিয়ে ফেলেছি। হয়তো বেঁচে থাকলে তোমার মতই বড় হয়েছে। আমিও সন্তানকে হারিয়ে তোমার মতই দুঃখের সাগরে বিরাজ করছি। তোমার বাবার মুখ মনে আছে!

দুখিরাম বলে :- কয়েকদিন আগে মায়ের আলমারিতে আমার কিছু জিনিস খুঁজতে গিয়ে, একটা ছবি দেখেছিলাম। একটি ছবিতে মায়ের সঙ্গে তিনজন আছে। তার মধ্যে বাবা-মায়ের সাথে আমার শিশুকালের ছবি আছে। তৃতীয় ছবির সঙ্গে আপনার চেহারা মিল খুঁজে পাচ্ছি। আপনি কি আমার সেই হারানো বাবা?

 সুরেন্দ্র বলে :- না বাবা, মানুষের চেহারার সাথে মানুষের মিল থাকতে পারে। তুমি আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে, প্রতিদিন আমরা এখানে গল্প করবো।

দুখিরাম বলে :- ঠিক আছে বন্ধুত্ব করলাম।

সুরেন্দ্র ভাবে মনে মনে :- নলিনীর প্রাপ্তবয়স্ক হতে এখনো ছয় বছর বাকি আছে। ছয় বছর পরে নমিতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কিন্তু সন্তানের অধিকারের দাবি করতে পারবো। এখন আমার পরিচয় গোপন রাখতে হবে।

 দুখিরাম বলে :- এত কি ভাবছেন?

সুরেন্দ্র বলে :- বাড়িতে যাও আর মন দিয়ে পড়ালেখা করবে এবং মায়ের অবাধ্য হবে না।
বাবার স্নেহ ভালোবাসা না পেলেও কিন্তু মা তো তোমার পাশে আছে।
         ------------------------------------   
        
                 ।। দ্বিতীয় অধ্যায় ।।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিসের কর্মচারীদের বিশ্রাম ঘরের মধ্যে দুজন নর-নারী পাশাপাশি বসে বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে।

নরেন নামে এক সাধারণ অফিসার, নমিতার হাতে হাত রেখে বলে :- আর কতজনকে তোমার রূপের মহিমায় জড়িয়ে নাটক করে যাবে।

নমিতা হাত সরিয়ে নিয়ে বলে :- যতদিন ইচ্ছা ভালবাসা চালিয়ে যাবো। দীর্ঘদিন এককি অফিসের ছাদের নিচে বসবাস করছি কিন্তু হঠাৎ করে আজ এই প্রশ্ন করছো কেন?

 নরেন বলে :- কেন প্রশ্ন করছি, চোখের সামনে যা দেখি কিন্তু তা কখনো অস্বীকার করতে পারবোনা। আমাদের অফিসের সর্বময় কর্তা সুরেন্দ্র বড় বাবুর সঙ্গে যেভাবে চলাফেরা ঢলাঢলি করছো। তাতে সময়ের চক্করে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে নিয়ে আসবে। বড়বাবু অবিবাহিত থেকে রক্তে মাংসে নারী পিপাসু।

 নমিতা মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বলে :- পিপাসার জল দান করব। আমার মত সুন্দরী, স্বাস্থ্যবান দেহ ও শিক্ষাগত মর্যাদা অনুসারে কিন্তু এই অফিসে আমার কর্ম পেয়েছি কি ?

নরেন বলে :- কি পাওনি! তুমি কয়েক বছরের মধ্যে যা সুযোগ সুবিধা পেয়েছো কিন্তু তা দীর্ঘদিন কোন কর্মচারী পায়নি। ভাগ্যচক্র কে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের অনেকের থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকা সত্ত্বেও কিন্তু সুরেন্দ্র বাবু অফিসের বড় অফিসার।

নমিতা বলে :- বড় অফিসার হতে বর্তমান শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। ছলচাতুরি আর কাজের অভিজ্ঞতার সাথে টাকার জোর। আমার চিন্তা ধারা বাস্তবায়ন করার জন্য কিন্তু আমি কোন দিন কোন মানুষের সাথে আপস করিনি। আমাকে আরো উপরে উঠতে হবে। যদি বড় বাবুর সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতে হয়, তা কিন্তু দীর্ঘদিন চালিয়ে যাবো। নরেন; যৌবনের আবেগের বশবর্তী হয়ে তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু কখনোই অধিকারের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না। 

নরেন বলে :- না, আমি আর চেষ্টা করবোনা। তোমাকে ভালোবাসি বলেই সাবধান করে দিচ্ছি, কারণ আমি এই অফিসে দীর্ঘদিন চাকরি করছি। আমার চোখের সামনে কতনা অঘটন ঘটেছে। প্রত্যেকটি ঘটনাই তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি।

 নমিতা বলে :- জানিয়েছো বলেই কিন্তু বড় বাবুর দুর্বলতার জায়গা গুলো খুঁজে পেয়েছি। আমি থেমে থাকার জন্য জন্ম নেইনি। তোমার মিনমিনিয়ে স্বভাবের কারণে কিন্তু আমার ঠিক সবসময় পছন্দ হয় না। তবুও তোমার সঙ্গ দিয়ে চলেছি কারণ তুমি আমার বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করে।
 
সুরেন্দ্র বাবু কে আসতে দেখে দুজনেই চুপচাপ হয়ে যায়। সুরেন্দ্র বাবু ও নমিতার মধ্যে চোখাচোখি হতে থাকে। নরেন তাড়াহুড়ো করে হলঘরের চেয়ার ছেড়ে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে অফিসের নির্দিষ্ট নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। অফিসের একটা ফাইল খুলে দেখতে থাকে। 
           ------------------------------------

                ।। তৃতীয় অধ্যায় ।।

নমিতার বিবাহ বিচ্ছেদের দীর্ঘ কয়েক বছর পর, এক রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্মৃতির পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে ভাবতে থাকে। একদিন হঠাৎ করে অফিস ছুটির মুহূর্তে সুরেন্দ্র বাবুর অফিসের নিরাপত্তা রক্ষী কে দিয়ে-আমাকে জরুরি কাজের জন্য অফিস রুমে ডেকে নিয়ে আসে। 

আমি (নমিতা) ফাইল পত্র নিয়ে হাসি হাসি মুখে বড়বাবুর অফিসের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিরাপত্তা রক্ষী না থাকায় বুকের কাপড় হালকা করে সরিয়ে, খোলা দরজা দিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়ি। হাত পা নেড়ে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে শরীরের গোপন অঙ্গ দেখানোর চেষ্টা করি।
 
দুস্টুমি করে হাসি হাসি মুখ করে বলি :- বলুন স্যার, কেন ডেকেছেন ?

সুরেন্দ্র বাবু মুগ্ধ নয়নে আমার অর্ধ অনাবৃত বুকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে :- বিশেষ কাজের জন্য ডেকেছি। দুরে দাড়িয়ে কেন! আমার পাশের চেয়ারে বসুন।

আমি (নমিতা) ফাইলগুলো টেবিলের উপর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলি :- স্যার, নজর লেগে যাবে। মনে হচ্ছে ভিন্ন গ্রহের নারী কে দেখছেন। এভাবে দেখার কি আছে?

সুরেন্দ্র বাবু বলে :- বহু মানুষের মাঝে কাজের মাধ্যমে দেখেছি। এত কাছে থেকে একা রুমের মাঝে নিরিবিলি পরিবেশে কিন্তু তোমার দেহ পল্লবীর শাখা প্রশাখা দেখিনি। দেখার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু হয়তো তুমি বুঝতে চাওনি।

আমি (নমিতা) সুরেন্দ্র বাবুর আরো কাছে এসে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলি :- সমুদ্রের নোনা জলে সাঁতার কাটার ইচ্ছা হয়েছে। গভীর সমুদ্রের মাঝে হাবুডুবু খাবে কিন্তু তবুও সমুদ্রের নিচের মাটি খুঁজে পাবে না।

সুরেন্দ্র বাবু আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কিন্তু প্রথমে হাত চেপে ধরে। তারপর কিছু বলছি না দেখে আমাকে (নমিতা) বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। আমি পুরুষের পরশ পেয়ে আনন্দিত মনে চুপচাপ থাকি।

সুরেন্দ্র বলে :- চলে পাশের রুমে যায়।

আমি কলের পুতুলের মতো সুরেন্দ্রের সাথে পাশের রুমে ঢুকে দেখি, রুমের মধ্যে খাট বিছানা সব ব্যবস্থা আছে। সেদিন আমার মনের ও শরীরের মধ্যে এক রোমান্টিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। 
সুরেন্দ্র আমাকে আদর করতে করতে বিছানায় নিয়ে আসে।

আমি (নমিতা) কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে নাটক করে বলি :- ছাড়ুন, ছাড়ুন। আমি এখনো কুমারী কিন্তু আমার কুমারীত্বের সর্বনাশ করবেন না। সেই দিন বড়বাবুর কাছে মন প্রাণ দেহমন যৌবন সমাপন করে দিয়েছিলাম। মুখে বারবার বলছিলাম, আমার কুমারীত্ব সর্বনাশ করবেন না। 
 
সুরেন্দ্র বাবু আমার আদর করতে করতে বলে :- না, না করে না। একমাত্র আমার ইচ্ছায়, তুমি না বলতেই অফিসে সব রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছো। তোমাকে চাকরির আরো উঁচু জায়গায় পৌঁছাতে হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো। শুধু তুমি আমাকে একটু ভালোবাসা দাও।

 আমার মন ও প্রাণ আদরে আদরে সারারাত ধরে ভরিয়ে দিয়েছিল। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ বড়বাবু। আমাকে কয়েক দিনের জন্য ছুটি দেয় আর টাকার বান্ডিলের সাথে সোনার অলংকার, দামী কাপড় উপহার দিয়েছিলেন। এরপর দুইজনেই কয়েক বছর ধরে যৌবনের উন্মাদনার খেলায় মেতে উঠি। হঠাৎ একদিন অনুভব করি আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছি। 

একদিন রাতে সুরেন্দ্র সাথে শয্যাশায়ী হয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে বলি :- আমার অসাবধানতার কারণে তুমি বাবা হতে চলেছে। সমাজ ব্যবস্থার হাত থেকে মান সম্মান বাঁচানোর জন্য কিন্তু আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে‌। আমাকে ও আগত সন্তান কে সমাজের কাছে স্বীকৃতি দাও।

সুরেন্দ্র উত্তেজিত হয়ে আমাকে পাশে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে উঠে বলে :- তোমার সন্তানের দায়ভার নিতে পারবো না। এই সন্তান কে আমি স্বীকার করি না কারণ আমি ছাড়াও তোমার গোপনে গোপনে নরেনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। বরং বাচ্চাটি কে গর্ভের মধ্যে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

আমি (নমিতা) রাগে গজগজ করতে করতে বলি :- আমার গর্ভের শিশু কিন্তু তোমার সন্তান। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরীর আগে নরেন কে ভালবাসতাম কিন্তু দৈহিক মিলনের কোনো চাহিদা ছিল না। আমাকে বিয়ে করে অবশ্যই সন্তানের বাবার পরিচয় তোমাকেই দিতে হবে।

সুরেন্দ্র বলেছিল :- আমাকে তো টাকা আর পদমর্যাদা লাভের জন্য ব্যবহার করে চলেছ। এখন আবার অবৈধ সন্তানের স্বীকৃতি। পতিতা নারীর অবৈধ সন্তানের সামাজিক স্বীকৃতি কেউ কোনদিন দেয়নি আর কোন দিন দেবে না। টাকার বিনিময়ে দেহ ভোগ করতে দিয়েছো। বলো গর্ভপাত করার জন্য কত টাকা চাই!

আমি (নমিতা) অসমাপ্ত যৌনক্ষুদায় উত্তেজিত হয়ে কিন্তু উত্তেজনাবশত বলি :- তুমি; কয়েকবছর ধরে আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেহ ভোগ করে চলেছে কিন্তু এখন সন্তানকে অস্বীকার করছো ! আমি তোমাকে ছাড়বো না। থানা পুলিশ করে ছাড়বো। টাকা দিয়ে আমার মুখ বন্ধ রাখতে পারবে না। তুমি অন্য সব মেয়ে পাওনি, আমি মান সম্মানের ভয় পায় না। আমার স্বার্থে আঘাত লাগলে কিন্তু বিষধর নাগিনী হয়ে ছোবল মারতে জানি। এক ছোবলে ছবি বানিয়ে ঘরে টানিয়ে দেবো।

সুরেন্দ্রের সাথে সেই রাতে তর্ক বিতর্ক করতে করতে এক সময় মারামারি শুরু হয়ে যায়। আমাকে যেমন আঘাত করে রক্তাক্ত করেছিল, কিন্তু আমি সুরেন্দ্র কে আঘাত করে নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়ে রক্ত ঝরিয়ে ছিলাম। আমার লম্বা লম্বা চুলগুলো আমার সাথে ভীষণ ভাবে শত্রুতা করেছিল। সুরেন্দ্র আমার চুল ধরে ঘরের মেঝেতে শুয়ে দিয়ে কিন্তু গর্ভের সন্তান নষ্ট করার জন্য বুকের উপর উঠে প্রচন্ড বেগে তলপেটে আঘাত করেছিল। প্রচণ্ড আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কিন্তু সুরেন্দ্রের নাকে ঘুষি মেরে পালিয়ে জীবন রক্ষা করি।
          ------------------------------------------

                 ।। চতুর্থ অধ্যায় ।।

নমিতা হাসপাতালে গিয়ে আঘাতের চিহ্ন গুলো দেখিয়ে অত্যাচারের এবং অন্তঃসত্ত্বার রিপোর্ট তৈরি করে। তারপর সোজা থানায় গিয়ে সুরেন্দ্রের নামে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস, অন্তঃসত্ত্বা সন্তানের অস্বীকার করা ও গর্ভ নষ্ট করার জন্য মারধরের অভিযোগ করে মামলা দায়ের করে।

পুলিশ নমিতার অভিযোগের ভিত্তিতে সুরেন্দ্র কে অফিস থেকে গ্রেপ্তার করে। উকিলের মাধ্যমে ছয় মাসের আগে জামিন না পায় তার ব্যবস্থা করে। অফিসের উপর মহলের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত অনুসারে সুরেন্দ্র কে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। মামলা আদালতে বিচারাধীন কিন্তু দেখতে দেখতে নমিতার গর্ভ দশ মাস দশ দিন পূর্ণ হয়ে যায়। কুমারী মা তার সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে কিন্তু অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। একসময় নার্সিং হোমের সঙ্গে যোগাযোগ করে বহু টাকার বিনিময়ে প্রসূতি নিস্তার পায়।

সুরেন্দ্র ছয় মাস পর জামিন পাওয়ার পর আবার নমিতা আদালতে উপস্থিত হয়ে সুরেন্দ্র ও শিশু নলিনী কে ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য আবেদন করে।
আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে ছেলে ও বাবার ডিএনএ পরীক্ষায় সুরেন্দ্রের সন্তান নমিতার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে প্রমাণিত হয়।

সুরেন্দ্র জেল খাটার দায় থেকে মুক্তি পাবার জন্য উকিলের মাধ্যমে ভুল স্বীকার করে। নমিতাকে বিয়ে করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানায়। নমিতা এক কথায় রাজি হয়ে যায়।
 আদালতের বিচারকের সিদ্ধান্ত অনুসারে আদালত প্রাঙ্গণে নমিতা শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে সুরেন্দ্রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। 

কয়েক বছর যেতে না যেতেই সংসারে আবার চরম আকারে অশান্তি শুরু হয়। সুরেন্দ্র সন্তানের কোন দায়িত্ব পালন করে না কিন্তু নমিতার সামনে সন্তানের জন্য লোক দেখানো দরদ উথলে ওঠে। 

 একদিন রাত আটটার সময় নমিতা অফিস থেকে বাসা বাড়িতে আসার পর, সুরেন্দ্র উত্তেজিত হয়ে বলে :- চাকরি ছেড়ে দিয়ে, সন্তানের দেখাশুনার দায়িত্ব নাও; চাকর-বাকর দিয়ে সন্তান লালন পালন হয় না। আমি তো একটা কাজ করি।

 নমিতা উত্তেজিত হয়ে বলে :- তুমি যে কাজ করো, তাতে আমার পোশাক-আশাক, প্রসাধনী খরচ, এই দামি ফ্ল্যাট ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ,চাকর বাকর ও সংসারের ভালো খাবার জুটবে না-সন্তান মানুষ করা তো অনেক দূরের কথা। সন্তানের জন্য মাসে কত খরচ তা জানো। তোমার টাকা আমি ছুঁয়ে দেখি না বরং আমার টাকায় তোমার ফুটানি। 

 সুরেন্দ্র করুণ সুরে বলে :- সবই তো তোমার জন্যই হারিয়েছি। আমার চাকরি চলে গেল আর তোমার পদোন্নতি ঘটলো। আমার জাগায় তুমি বসলো। আর আমাকে জেলে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ও প্রতারনার ফাঁদে ফেলে হুমকি দিয়ে বিয়ে করলে। তাহলে এখন কেন আমার উপর মানসিক নির্যাতন করছো! রাতে স্বামী হিসেবে এক ঘরে থাকার তোমার অনুমতি নেই। তুমি বেশি টাকা আয় করে বলে কিন্তু সব সময় তোমার কথা মতো চলতে পারবে না।

নমিতা উত্তেজনা বশতঃ বলে :- আমি চাকরি ছাড়তে পারবে না বরঞ্চ প্রয়োজনবোধে তোমার মতো অপদার্থ পুরুষ মানুষ ছেড়ে দিতে পারি।

সুরেন্দ্র উত্তেজিত হয়ে বলে :- এখন তো তুমি আর সাধারণ কর্মচারী না। অফিসের বড় অফিসার দিদি মনি আবার ইচ্ছা করলেই শত পুরুষ তোমার পায়ের কাছে গড়াগড়ি দেবে। যার শীল যার নোরা তার ভাঙ্গলো দাঁতের গোড়া। বিশ্বাসঘাতক বেমানান বড় অফিসার হয়েছে।

নমিতা উত্তেজিত হয়ে বলে :- আমার চরিত্রকে নিয়ে সমালোচনা ও সন্দেহ করা হচ্ছে! তোমার নিচু মন মানসিকতার কারণে আমার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছো। নিজের চরিত্র যোনো ফুলের মতো পবিত্র। অফিসের অনেক মেয়েদের সর্বনাশ করেছে। মেয়েরা গঙ্গা জলের মতো স্বচ্ছ ও পবিত্র। তোমার মতো ঘোলা পচা দুর্গন্ধযুক্ত নয়। 

সুরেন্দ্র বলে :- অফিসের নরেন; এখনোও তোমার ভালবাসার ডালি সাজিয়ে অপেক্ষা করে আছে।
 প্রাক্তন প্রেমিকের উপর কত দরদ, রাতে একদিন ফোন না করলে ঘুম আসে না।

নমিতা আঙ্গুল উঁচু করে বলে :- সাবধান; নরেন কে নিয়ে কোন বাজে মন্তব্য করবে না। তোমার মত চরিত্রহীন লম্পট নয়-মেয়েদের দেখলেই কিন্তু লিঙ্গ থেকে লালা ঝরা শুরু করে। সাবধান; আমার সাথে শত্রুতা করলে কিন্তু তোমার পায়ের নিচেই কোন রকম দাঁড়িয়ে থাকার মাটি খুঁজে পাবে না।

নমিতা রাগে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে বড় বড় পা ফেলে নিজের রুমের দিকে চলতে থাকে।

 একদিন রাতে একলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সুরেন্দ্র ভাবে :- আর কতদিন এভাবে একা থাকবো। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে কয়েক বছরে বিশাল আকারে ফাটল ধরেছে আর এক ছাদের নিচে বসবাস করা যাবে না। আমারও তো কোন নারীর আশ্রয় চাই কিন্তু একঘেয়েমি জীবন আর ভালো লাগছে না। হয়তো যৌবনের উন্মাদনায় কিছু ভুল করে ফেলেছি আবার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার অনেক চেষ্টা করলাম। নমিতার একঘেয়েমি মনোভাব ও চলাফেরা আর ভালো লাগেনা। সংসারের সিংহভাগ ব্যয় বহন করে বলে বড় অহংকার হয়েছে কিন্তু আজকের এই পদমর্যাদা কার জন্য পেয়েছে।
 আমি এই বাড়ির এখন চাকরের যোগ্য নই কারণ নমিতা আমার থেকে বাড়ির চাকর বাকরের সঙ্গে অনেক ভালো ব্যবহার করে থাকে।
 ইদানিং দেখছি নমিতার রূপের অহংকার অনেক বেড়ে গিয়েছে কারণ বাইরে বেরোলেই দামি দামি শাড়ি গয়না প্রসাধনী ব্যবহার করেই বাড়ি থেকে বাহির হয়। হয়তো অন্য কোন পুরুষের আকর্ষণ করে দেহের আগুন নিবারণের চেষ্টা করে। 
নমিতা আগের দিন গুলোতে প্রতি রাতে দেহ সুখ ছাড়া থাকতে পারতো না কিন্তু এখন বছরের পর বছর থাকে কি করে?

প্রতিদিনের ঝগড়া অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় সুরেন্দ্র ও নমিতা উভয়ের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে উত্তেজনাপূর্ণ কথা কাটাকাটির মাধ্যমে আদালতের বিচারকের দারস্থ হয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। 
আদালতের বিচারকের রায় অনুসারে সাত বছরের শিশু সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব নমিতাকে পালন করতে হবে। আজকের শিশু সন্তান ১৮ বছরের প্রাপ্তবয়স্ক হলে পিতার অধিকার থাকে কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কার কাছে থাকবে। 

সুরেন্দ্র আদালতে দাঁড়িয়ে ভাবে মনে মনে :- তাহলে ১১ বছর পরে কিন্তু নমিতার কাছ থেকে ছেলে নলিনী কে কেড়ে নিয়ে চরম অপমানের সঠিক জবাব দেবো।

নমিতা শিশু সন্তানকে নিয়ে নতুন ভাড়া বাড়িতে চলে আসে আর সুরেন্দ্র পিতৃ-মাতৃভূমি নিজের গ্রামে চলে যায়।

 নমিতা তার শিশু সন্তানকে নামিদামি একটি স্কুলে পড়াশোনার জন্য ভর্তি করে দেয়। 
      ------------------------------------------------

                ।। পঞ্চম অধ্যায় ।।

নমিতা এখন সমাজের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে কিন্তু মনের দিক থেকে কোন শান্তি লাভ করতে পারছে না।

নমিতা ভাবে মনে মনে :- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কখনো শান্তি আবার কখনো অশান্তির মধ্যে দিয়েই সংসার চক্র চলে কিন্তু সুরেন্দ্র কে ত্যাগ করে ভালো কাজ করিনি। ছেলে নলিনীর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার যন্ত্রণাদায়ক বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে পড়েছি। কোথায় কোথায় বলবে নিশ্চয়ই বাবার সাথে তুমি ভীষণ খারাপ ব্যবহার করেছিল, তা না হলে বাবা তোমাকে ত্যাগ করে চলে গেল কেন!
ইদানিং বলা শুরু করেছে বাবার সাথে প্রতারণা করে চাকরির পদোন্নতি ঘটিয়ে আবার বাবাকে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করেছো । কিন্তু এসব তথ্য জানলো কি করে? আমি সুরেন্দ্র ও নরেন ছাড়া আর তো কেউ জানে না। তাহলে কি ছেলের সাথে নরেনের যোগাযোগ হয়েছে! নরেন আমাকে না পাওয়ার বেদনায় হয়তো ছেলের কাছে সব ঘটনা বলে দিয়েছে। আমার সাজানো গোছানো সংসার টা আবার ভাঙতে চলেছে। যার জন্য দেশের মায়া ত্যাগ করে বহু দূরে এসে বাড়িঘর তৈরি করলাম। বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনের মুখ দেখবো না বলে।
 আবার ছেলের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। সুরেন্দ্র তো হুমকি দিয়ে রেখেছে ১৮ বছর পূর্ণ হলে সন্তানকে ছিনিয়ে নেবে। হয়তো সুরেন্দ্র প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ছেলে ও বাবার দেখা হয়ে যায়নি তো! আমাকে ভুল বুঝে সন্দেহ করার জন্যই তো, সুরেন্দ্র কে ত্যাগ করলাম। নরেনের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই, এই কথা ওকে বোঝাতে পারলাম না। আমি স্বীকার করছি তোমার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার আগে, নরেনের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কিন্তু কোনো শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন হয়নি।

 বিশ্বাস নামক শব্দটি যখন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়, তখন সংসারের এক ছাদের তলায় বাস করা যায় না। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সুরেন্দ্র সবসময় আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতো এবং আমাকে কোন পুরুষের সাথে বা অফিসের পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা পর্যন্ত পছন্দ করত না। অফিসের পুরুষ সহকর্মীদের সন্দেহ করে কিন্তু তাদের মান সম্মান নষ্ট করতে। সুরেন্দ্রের বহু জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারে কিন্তু বাধ্য হয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অন্তর থেকে এখনো ভালবাসি। 

আমারও তো একজন পুরুষের সাথে থাকার মন চায় এবং সামাজিক ভাবে একজন পুরুষ অভিভাবকের বিশেষ প্রয়োজন। স্বামী হিসেবে বট গাছের মতো ছায়া দান করে তার স্ত্রী কে বাঁচিয়ে রাখবে। বিবাহিত জীবনে পুরুষ অভিভাবক বিহীন সংসারে ও সমাজের বুকে কত রকম বাজে বাজে কথা শুনতে হয়। এই সমাজ ব্যবস্থা আমাকে বারবার পিছনের কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়। স্বামী নামক পুরুষটি আমাকে বহু পুরুষের সঙ্গ করি, পতিতা অপবাদ দিয়ে কলঙ্কিত করল। সুরেন্দ্র; অসভ্যর মতো বাজে কথাবার্তা বলতে শুরু করলো। কোন পুরুষ টাকা দিলেই নাকি, আমি সেই পুরুষের শয্যাশায়ী। খোলা বাজারের পতিতা হয়ে গেছি।

হে স্বামী নামক পুরুষ সুরেন্দ্র নিজের চরিত্র খানা একবার আয়নায় দেখেছেন। অফিসের প্রতিটা নারীকে তোমার যৌন লালসার শিকার হতে হয়েছে। আমি তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার ভালো ভাবে জীবন যাপনের কোন সৎ ইচ্ছা নেই। মান-সম্মান মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে নোংরা কাজগুলো করবে।

আমার মান-সম্মান, আভিজাত্য ও চাকরি কে বজায় রাখার জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না। তোমার মুখ দেখবো না বলেই, রাগ করে স্থান পরিবর্তন করেছি কিন্তু অন্তর্জগতের মাঝে বারবার তোমার স্মৃতিগুলো ভেসে আসে।  
  
 হয়তো, তুমি স্বাধীনভাবে জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে আরও না কত নারীর সর্বনাশ করে চলেছো। 

আমার যত বয়স বৃদ্ধি হচ্ছে, ততই নানা রকম ভাবনা এসে উপস্থিত হচ্ছে । আমাকে, ছেলে নলিনী বাবা বাবা করে পাগল করে দেবে কিন্তু বাবাকে এখন কোথা থেকে এনে দেবো! 

ছেলেটা, মায়ের কথা একবারও ভাবে না। কত কষ্টের মধ্যে দিয়ে লালন পালন করে বড় করেছি। মায়ের দুঃখ টা একবার বোঝার চেষ্টা করে না।

ছেলে কে বলেছি :- তোর জন্মদাতা পিতার স্বীকৃতি লাভের জন্য আমাকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।

ছেলে বলে কিনা; সেটা তোমার ভুল। উল্টে আমাকে প্রশ্ন করে; কেন জেনেশুনে আমাকে পৃথিবীতে এনেছে, বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করার জন্য! হয়তো বাবার সাথে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অন্যায় কাজ করেছ- যা বাবার একদম অপছন্দ।
যেমন বাপ তেমন ছেলে, অন্যের কথার কোন মূল্য নেই- নিজে যেটা ভালো মনে করবে সেটাই করবে। কিন্তু একটাই সান্ত্বনা বাপের মত চরিত্রহীন ছেলে হয়নি।

মা মা বলে ছেলে দুখিরাম দরজায় ধাক্কা দেয়। নমিতার চিন্তার চমক ভাঙ্গে ছেলের ডাক শুনে।

দুখিরাম মায়ের পাশে এসে বসে কপালে হাত দিয়ে বলে :- মা, এখনও শুয়ে আছো! অসুখ-বিসুখ করেনি তো?

নমিতার ভাবনার জগতে ডুবে গিয়ে ভাবে :- ছেলের বাবা, লোকটা যতই খারাপ হোক না কেন! আমার এই ভাবে শুয়ে থাকা দেখলেই, অস্থির হয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছেলেটা ঠিক , সেই রকম বাপের মতো।

দুখিরাম মায়ের চোখের জল মুছতে মুছতে বলল :- মা, তোমাকে তো কোনদিন কান্না করতে দেখিনি। কথা বলছ না কেন! তোমার কি হয়েছে? 

নমিতা ছেলে কে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। অজানা কোন আতঙ্কের ভয়ে। বাবা, আমাকে ছেড়ে কোনদিন চলে যাবে না তো!

 দুখিরাম বলে :- মা তুমি কি পাগল হয়ে গেছে! তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব বলতো?

নমিতা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলে :- আজ তাড়াতাড়ি চলে আসলি।

দুখিরাম বলে :- পার্কে, বয়স্ক এক বন্ধুর সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা বলি কিন্তু আজ উক্ত বয়স্ক ব্যক্তি শরীরটা ভাল নেই বলে দেখা করে চলে গিয়েছে।
 জানো মা পার্কের ওই ভদ্রলোকের মনে অনেক দুঃখ, আমার মতো ছেলে নাকি হারিয়ে গিয়েছে আবার দেখতে ঠিক আমার বাবার মতো ।

 নমিতা চমকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে :- তোর বাবার মত কি করে বুঝলি! তুই তো বড় হয়ে বাবার ছবি পর্যন্ত দেখিসনি?

দুখিরাম বলে :- ওই সাত বছর বয়সের সময়, বাবা আমাকে অনেক আদর করতে-বাবার স্মৃতি আমার অন্তরের অন্তর স্থলে গেঁথে রেখেছিলাম, সেই হিসাবে বললাম। এই ভবঘুরে চালচুলোহীন মানুষটি আমার বাবা হতে যাবে কেন? আমার বাবা হবে মায়ের মত আভিজাত্যপূর্ণ ও অহংকারী।

 নমিতা বলে :- ওই ব্যক্তির নাম কিরে!

 দুখিরাম বলে :- ওই কী যেন বললে ভজহরি মান্না। বিকালের থেকে রাত অবধি পার্কে বসে থাকে। সব সময় কি যেন চিন্তা করে!

 নমিতা বলে :- ওই লোকটার চেহারার বর্ণনা দো তো।

 দুখিরাম বলে:- আমার বন্ধুর চেহারার বিবরণ শুনে তোমার কি লাভ?
 বললাম তো বাবার মতো চেহারা কিন্তু বাবা নয়। 

নলিনী মুখ কালো করে বলে :- ঠিক আছে বাদ দে, একদিন না হয়-গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসবো। 

দুখিরাম মায়ের সঙ্গে ইয়ার্কি করে বলে :- সেই ভালো হবে। যদি সত্যি সত্যি বাবা হয়ে যায়। 

নলিনী বলে :- বাজে কথা রেখে চল, খেতে যাবি।
 
 নলিনী বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকে। তাহলে ছদ্দবেশী সুরেন্দ্র নয়তো! হয়তোবা বলেছে আমি তোমার বাবা, না হলে সাত বছর বয়সের স্মৃতি মনে থাকার কথা নয়। হে ঈশ্বর আমার সুখের সংসার টা আবার ভেঙে যাবে।
 হয়তো ছেলের অধিকার সূত্রে আবার আমার সাথে সম্পর্ক তৈরি করে, সম্পত্তির ভাগ নিতে চাইবে। কি যে করি বারবার কোর্ট-কাচারি আর ভালো লাগেনা।
          ------------------------------------------

                    ।। ষষ্ঠ অধ্যায় ।।
দুখিরাম অর্থাৎ নলিনী দত্তের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়ে দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে অর্থাৎ ২০ বছরের যুবক। নমিতার চিন্তায় চিন্তায় ঘুম খাওয়া-দাওয়া হারাম হয়ে গেছে। কোন কিছুই আর ভালো লাগছে না। কোনো রকম কোনো শব্দ শুনতে পেলেই, চমকিত হয়ে উঠে ভাবে-ছেলেকে নেওয়ার জন্য
এই বুঝি সুরেন্দ্র এলো। 

সুরেন্দ্র এক রবিবারের দুপুর বেলায় সদর দরজায় দাঁড়িয়ে নমিতা নমিতা বলে ডাকতে ডাকতে কলিংবেলে চাপ দেয়। সুরেন্দ্র এতো জোরে চিৎকার করেছে, নমিতার দোতলার রান্না ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। নমিতা রান্নার দায়িত্ব কাজের মাসিকে দিয়ে দুরুদুরু বুকে ভয়ে আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে। নিচের তলার সদর দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবে সুরেন্দ্রের সামনে যাওয়ার কোন মুখ নেই কিন্তু পা আর এগিয়ে যাচ্ছে না। 

দুখিরাম সদর দরজার গেট খুলে বন্ধু কে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বাড়ীর মধ্যে নিয়ে আসতে আসতে চিৎকার করে বলে :- মা নিচের দিকে আসবে, আমার সেই বন্ধু এসেছে। বলেছিলাম না বাবার মতো দেখতে । দেখে যাও দেখে যাও।
সুরেন্দ্র ঘরের ভিতরে ঢুকতে গিয়ে নমিতার সাথে দেখা হয়ে যায়। নমিতা ভয়ে আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে।

দুখিরাম মায়ের হাত বলে :- দেখো দেখো মা, একদম বাবার মত দেখতে।

 সুরেন্দ্র বলে :- নলিনী; বাবার মত দেখতে নয়, তোমার জন্মদাতা বাবা সুরেন্দ্রনাথ দত্ত ও মা নমিতা দত্ত আর তুমি তাদের ভালবাসার ফসল নলিনী রঞ্জন দত্ত। নমিতা তাহলে পরিচয় করে দাও।

দুখিরাম বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাবা বাবা বলে ডাকতে ডাকতে প্রশ্ন করে। বাবা দীর্ঘ কয়েক বছর আগে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে কিন্তু পরিচয় না দিয়ে, এতদিন বাবার স্নেহ ভালোবাসা থেকে কেন বঞ্চিত করে রেখেছেন?

 সুরেন্দ্র চোখের জল মুছে পকেট থেকে আদালতের রায়ের কাগজখানা বের করে, নলিনীর হাতে দিয়ে বলে :- বাবা, এতদিন তোমার মায়ের সাথে কথা বলার বা দেখা করার কোন অধিকার ছিল না। আদালতের নির্দেশ অনুসারে তোমার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলে, তোমার মায়ের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সন্তানের অধিকারের দাবি জানাতে পারব। নমিতা আমি আমার সন্তানকে নিতে এসেছি।

নমিতা চিৎকার করে উঠে বলে :- না, আমার সন্তানকে কাউকে দেব না। আমার একার অধিকার, আমি জন্ম দিয়েছি-লালন পালন করেছি। তুমি সন্তানের বাবা হয়ে ছেলের জন্য কি করেছো ! জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না।

নমিতা, সুরেন্দ্রর কাছে থেকে নলিনী কে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার মতো টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বলে :- বাবা, আমাকে ছেড়ে চলে যায় না, তাহলে আমি আর বাঁচবে না। এই ব্যক্তি তোর বাবা আমি স্বীকার করছি কিন্তু আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই।

নলিনী মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে মায়ের বুকে মাথা রেখে ভাবে মনে মনে :- মা ও বাবাকে হারাতে চাই না। হে ঈশ্বর; তুমি নাকি পতিত পাবন হরি বিপদ ভঞ্জন কারি আমার এই জটিল সমস্যা থেকে উদ্ধার করো। আমার কর্তব্য নির্ধারণ করে দাও এবং বাবা মায়ের মনে শান্তি ফিরিয়ে দাও।

নমিতা উচ্চ কন্ঠে বলে :- নলিনী, তোর উড়ে এসে জুড়ে বসা বাবাকে বল একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।

সুরেন্দ্র বলে :- আমি রাজি।

দুজনে একটি রুমের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
নমিতা বলে :- বলো, ছেলের বিনিময়ে তোমার কত টাকা চাই কিন্তু ছেলেকে ছেড়ে যেতে হবে।

সুরেন্দ্র বলে :- জানি তুমি কোটিপতি কিন্তু তোমার সর্বোচ্চ ধন সম্পত্তি ব্যাংকের টাকা, আমাকে দিলেও- আমি সন্তানকে বিক্রি করবে না। 

নমিতা বলে :- তাহলে, ছেলের নাম করে বার বার আমাকে প্রতারণা করবে।

সুরেন্দ্র বলে :- এখানে প্রতারণার কথা আসছে কেন! আমার ছেলে কে দিয়ে দাও। নিয়ে চলে যাবে আর কোন দিন তোমার সম্মুখে আসবে না।

নমিতা বলে :- আমার বুঝতে বাকি নেই, আমি তোমার চরিত্র সম্পর্কে তো জানি। আমার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ভাগ নিতে চাও ! মুখে বলবে সততার কথা আবার অন্তরে বিষাক্ত বিষ ঢালবে।

সুরেন্দ্র পকেট থেকে ব্যাংকের পাসবুক বের করে নমিতার সামনে রেখে বলে :- আমি; তোমার টাকা সম্পত্তি ভাগ নিতে আসিনি, একমাত্র সন্তানের ভাগ নিতে এসেছি। বিবাহ বিচ্ছেদের পর আমাকে দয়া করে প্রতি মাসে দশ হাজার করে গত মাস পর্যন্ত ব্যাংক একাউন্টে টাকা জমা করেছো, দেখে নাও তোমার একটি টাকাও হাজার বিপদের সময়েও খরচ করি নাই। আমি অর্থলোভী ছিলাম কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের পর সব পরিবর্তন করতে শুরু করেছি। 

সন্তান কে যদি না দাও তাহলে এবার আমি আদালতের মাধ্যমে ছেলেকে নিয়ে যাবে। উকিলের সাথে কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে। আমি যেমন ১৫ টি বছর স্ত্রী ও ছেলেকে হারিয়ে যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, সেই যন্ত্রণা আমিও তোমাকে সারা জীবন দিতে চাই।

নমিতা বলে :- নিশ্চয়ই তুমি বিয়ে করে সংসার করছো, তোমার সংসারে তো আরো সন্তান আছে। হাত জোড় করে বলছি আমাকে এই সন্তানকে দান করো। নলিনী ছাড়া আমি বাঁচতে পারবে না। তোমার পায়ে ধরে বলছি, আমাকে দয়া করে।

সুরেন্দ্র উত্তেজিত হয়ে বলে :- তোমার নাটক অনেক দেখেছি আর আমাকে তোমার মায়া কান্নায় ভোলাতে পারবে না। স্বামী কে ত্যাগ করে, ঘটা করে শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পড়ে আছে। যেন সতী সাবিত্রী, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। আমি দ্বিতীয় কোনো সংসার করিনি, তাহলে আদালতে যায়। 

বলে চলা শুরু করে দরজার কাছে আসতেই, নমিতা হাত ধরে জোর করে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলে :- রাগ করেছো কেন ? তোমার সন্তানকে তুমি নিয়ে যাবে, আমি বাঁধা দেওয়ার কে ! আমি এখনো তোমার মঙ্গল কামনা করে প্রতিদিন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তোমার আগে যোনে শাঁখা সিঁদুর নিয়ে যেতে পারি। আমার উপর রাগ করে, পাঠানো টাকা ছুঁয়ে দেখোনি-তাতে আমার কোন দুঃখ কষ্ট নেই।

নমিতা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আকাশ পাতাল ভাবনা চিন্তা করে বলে :- নলিনী বাবা, সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে, আমাদের মধ্যে মীমাংসা করে নিলে হয় না। আমরা আগের মতো আবার মিলিত করতে পারিনা। ভুল মানুষ মাত্রই করে কিন্তু আদালত কি সঠিক বিচার করতে পারে! আমরা দুজনেই ভুল সাজা পেয়েছি। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে সন্তানকে কেড়ে নিয়ে নতুন করে আবার আমাকে আর সাজা দিওনা।

সুরেন্দ্র বলে :- তা কি করে সম্ভব! দুই জন দুই মন মানসিকতার মানুষ।

নমিতা বলে :- সব সম্ভব গো, শুধু মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। আইন আদালত তো মানুষের জন্য কিন্তু সঠিক সমাধান নিজেদের করে নিতে হয়। আমাদের হারিয়ে যাওয়া জীবনের বিগত ১৫ বছর আর কোন ফিরে আসবে না। তোমার দুর্ব্যবহার ও আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার জন্যই কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে তোমার সঙ্গ ত্যাগ করেছি। মনের থেকে কোনদিন ত্যাগ করতে পারিনি কারণ তুমি সন্তানের বাবা। তাই আজও তোমার দেওয়া শাঁখা-সিঁদুর পরে তোমার নামেই পরিচিত হয়ে আছি। স্বামীর নামটা বাদ দিতে পারিনি। এই বাড়ি ঘর সম্পত্তি যা কিছু করেছি, সবকিছুই আমার পাশাপাশি তোমাকেও তো রেখেছি কারণ তোমার সাথে আমার সম্পর্ক না থাকলেও অন্তর থেকে আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার উপরের উগ্র রূপ দেখেছো কিন্তু ভালোবেসে কোনদিন অন্তরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছ! আমার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেই জায়গায় তুমি থাকলে- নিশ্চয়ই তুমিও আমার মত ব্যবহার করতে। আমিতো আমার নারীত্বের অস্তিত্ব বজায় রাখার লড়াই করেছিলাম। যে নারী কুমারী অবস্থায় সন্তান জন্ম দেয়, সমাজে তার স্থান কোথায়?

সুরেন্দ্র চুপচাপ থেকে ভাবতে শুরু করে।

নমিতা; সুরেন্দ্রের পায়ের কাছে বসে পড়ে আর চোখের জলে পা ধৌত করতে করতে বলে :- নলিনীর বাবা, আর যে জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিনা-আমাকে ক্ষমা করে দাও। সন্তানকে তো আর কেটে টুকরো করা যায় না। একটি সন্তানকে নিয়ে আমরা দুজন আবার মিলিত হই। তুমি যেভাবে বলবে, আমি ঠিক সেই ভাবে চলবে। আমি উপলব্ধি করেছি ,সংসারে পুরুষ অভিভাবক বিহীন ভাবে চলাফেরা করা ও স্বামী জীবিত থাকাকালীন সমাজের বুকে ভীষণভাবে বিপদজনক। পুরুষের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও, সম্পূর্ণ দোষ নারীর চরিত্রের উপর পড়ে। বাস্তবে কেউ বুঝতে চায় না। সংসারের মাঝে যত দোষ নারী কিন্তু পুরুষ মানুষের কোনো দোষ নেই।
 
সুরেন্দ্র; নমিতা কে পায়ের কাছে থেকে তুলে জড়িয়ে ধরে বলে :- তুমি; আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমার প্রতি ভীষণ ভাবে অন্যায় করেছি। নমিতা স্বামী কে জড়িয়ে ধরে।

হঠাৎ দরজার কাছে থেকে আওয়াজ আসে। আরো সুরেন্দ্র বাবু মান অভিমানের পালা শেষ করুন। নাটকের নতুন প্রজন্মের নতুন পালা শুরু হবে।
 
নমিতা তাড়াহুড়ো করে স্বামীর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বলে :- আরো মহেন্দ্র বাবু আপনি ।

মহেন্দ্র বাবু রুমের মধ্যে ঢুকে সোজা সুরেন্দ্রের কাছে গিয়ে ঘাড়ে হাত রেখে বলে :- আরে মশাই, এখন ছেলেমেয়েরা মান-অভিমানের পালা করবে- তা, না আপনাদের মান-অভিমানের পালা ভাঙানোর জন্য কিন্তু ছেলে-বৌমার দরকার হয়ে পড়েছে। নমিতার উদ্দেশ্য করে বলে বিয়ান তাড়াতাড়ি বরণডালা সাজিয়ে নিয়ে আসুন। একসাথে আজ দুটো বিয়ে দিয়ে ছাড়বো। আমার নাম মহেন্দ্রনাথ শান্তি ঘটক কিন্তু অশান্তি একদম পছন্দ করি না। মা বাসন্তী এদিকে আয় তো।

 বাসন্তী তার মায়ের সাথে করে রুমের ভিতরে ঢুকে সুরেন্দ্র ও নমিতা কে প্রণাম করে।

 মহেন্দ্র বাবু; সুরেন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলে :- মশাই, আপনার ছেলে আর আমার মেয়ে ৫ বছর ধরে ভালোবাসা করছে, অঘটন ঘটার আগেই চার হাত এক করে দিতে চাই। 

নমিতা, সুরেন্দ্রের কাছে এসে কানে কানে বলে :- কি করবে গো ?

সুরেন্দ্র কানে কানে বলে :- আমি, সব জানি কিন্তু তোমার মতো অঘটন ঘটায়নি । ছেলে কার দেখতে হবে তো । নলিনী নলিনী বলে ডাকতে থাকে।

নলিনী রুমের মধ্যে ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ে। সুরেন্দ্র; নলিনী ও বাসন্তী কে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে চার হাত এক করে দেয়। সেই মুহূর্তে শঙ্খধ্বনি ও উলুর ধ্বনি বেজে ওঠে। 

নমিতা বৌমার কে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে :- তোমার শ্বশুর বাবা কে, এবার আমরা দুজন মিলে এমন ভাবে বেঁধে রাখবে-পালানোর পথ খুঁজে না পায়। 

সুরেন্দ্র বৌমার উদ্দেশ্য বলে :- বৌমা, আমিতো সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই। তোমার শাশুড়ি তো কোনদিন পারিনি, তবে তোমার মেয়ে এসে যদি পারে। 

কাজের মাসি তালা ভরে মিষ্টি নিয়ে এসে বলে :- তাহলে হারানো জামাইবাবু কে দিয়ে শুরু করি।

মহেন্দ্র বাবু মিষ্টি মুখে দিয়ে চিবাতে চিবাতে বলে :- আমার মেয়ের বিয়েতে ও বিয়ান নমিতা বিয়াই সুরেন্দ্রের পুনরায় মিলন উপলক্ষে সবার সপরিবারে নেমন্তন্ন রইল, আসবেন কিন্তু।
----------------------------------------------------------
রচনাকাল :- ২৮ নভেম্বর ২৯২১ সালে।  
স্থান :- দত্তপুলিয়া যুব গোষ্ঠী ক্লাবের রুমে, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
----------------------------------------------------------
                      ।। সমাপ্ত ।।
----------------------------------------------------------


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু