বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

পাঁচিলগুলো অন্তর্হিত

“যেথা গৃহের প্রাচীর…..

বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,”

সবারে ভালবাসি বীর,

যত পাঁচিল ভেঙে অখণ্ড পৃথ্বী গড়ি।

 

মার গর্ভের পাঁচিল ঘেরা আশ্রয়টি না পেলে, কোনোদিনই ‘আমি’ হ’য়ে উঠতুম না; বাবা-মায়ের পাঁচিল-ঘেরা কুটির আমাকে বাঁচিয়েছিল ঝড়-রোদ-বৃষ্টি থেকে, দুধে-ভাতে-শিক্ষায় মানুষ ক’রে তুলেছিল আমাকে। মানুষ হ’তে হ’তে দেখলাম আরও অনেক পাঁচিলের অবরোধ…

এখন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ মন-প্রাণ দিয়ে জানে, হাড়ে হাড়ে টের পায় Black Lives Matter –এ প্রতিবাদ, এ শ্লোগান মূলতঃ কালো মানুষদের উপর জোর ক’রে চাপিয়ে দেওয়া নিয়মগুলোর প্রতিবাদ, চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় নিয়মগুলো ভাঙার জন্যে মারণাত্মক শাস্তি দেওয়ার প্রতিবাদ, সন্দেহভাজনের ঘাড়ে হাঁটুর চাপ দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ ক’রে মারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যখন সারা পৃথিবী সোচ্চার পাঁচিলের দুপাশের মানুষদের মধ্যে অসমান সুবিধা ও শাস্তির বিরুদ্ধে, তখন দেখা দরকার শুধু কালো-সাদার মধ্যে পাঁচিলটাই নয়, আরও কত রকম পাঁচিল মানুষের জীবনে,- ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, বিবাহিত-অবিবাহিত, দেশি-বিদেশি, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, জাত-পাত, তারুণ্য-বার্ধক্য...। প্রতিটি পাঁচিলের দুপাশের মানুষদের সমান সুযোগ সুবিধা চাই – বাঁচার জন্যে, থাকা-খাওয়া পরার জন্যে, জীবনকে উপভোগ করার জন্যে।

জন্মেছিলাম উচ্চশিক্ষিত কিন্তু গরীব বাবার সন্তান হ’য়ে। খুব অল্প বয়সেই বুঝেছিলাম- নানা পাঁচিলের ওপাশের লোকগুলোর সঙ্গে আমাদের তফাৎটা কি কি।

১৯৪৭সালের ১৫ই আগস্ট। সবাই আনন্দে মশগুল; বাবা টিউশনি ক’রতে গিয়ে ফেরৎ এলেন- ছাত্ররা  আজ পড়বে না; বাবার ঐদিন এক মাসের মাইনে পাওয়ার কথা ছিল; সেটাও বাবাকে দেওয়া হয়নি; এদিকে বাড়ীতে মা শুধু ভাত রান্না ক’রেছে; বাবা ফিরে বাজার ক’রে আনলে তরকারি রাঁধা হবে; বাবা ফেরার পরে দেখলেন- একটাও পয়সা নেই বাজার করার মতো। বাবা অনেক খুঁজলেন- বাড়ীতে কোথাও পয়সা নেই, যা দিয়ে কিছু কেনা যায়। তখন নজর পড়লো দাদার হাতে তৈরী কাগজের ক্যারম বোর্ডটার উপরে- উনিশটা ফুটো পয়সা- ৯টার উপর সাদা চক দিয়ে রঙ করা, ৯টা কালো চক দিয়ে আর ১টা লাল চক দিয়ে; বাবা উনিশটা ফুটো পয়সা তুলে নিয়ে বাজার ক’রে আনলেন। পাঁচিলের এপাশ আর ওপাশের তফাৎটা তখন থেকেই বুঝেছিলাম।

স্কুলে গিয়েও ধনী-দরিদ্রের পাঁচিলটা প্রায়ই বাধা দিয়েছে। আমার সৌভাগ্য- আমি ছিলাম বুদ্ধিমান ও পারদর্শী; এর উপর আমার চেয়ে তিন ক্লাস উঁচুতে পড়তো দিদি, একই ঘরে- আমার সঙ্গে, কোনো পাঁচিল ছিল না সেখানে; শুনে শিখে ফেলতাম। আমার ক্লাসে কাল কী পড়াবে, সেটা আগেই অনুমান ক’রতে পারতাম। প্রাইমারী স্কুল শেষ ক’রে ভর্ত্তি হ’লাম বেলতলা স্কুলে। ক্লাসের মধ্যে আমি যে সেরা তার প্রথম ঈঙ্গিত পেলাম যখন মাস্টারমশায় essay লেখার খাতা ছাত্রীদের ফেরৎ দিলেন। এখানে সবচেয়ে উপরে আমার খাতা। ধনী-নির্ধনের কোনো পাচিলে আটকায়নি আমার সেরা হওয়া।

পাঁচিলটা আবার চোখে পড়লো ক্লাস নাইনে ওঠার পরে। সেবছর থেকেই ১১-বছরের হায়ার সেকেণ্ডারী কোর্স শুরু হ‘য়েছে; বেলতলা স্কুলে কেবল কমার্স পড়ার সুযোগ ছিল। বিজ্ঞান পড়তে হ’লে কমলা ইনস্টিটিউশনে ভর্ত্তি হ’তে হবে, আর এ পাঁচিল পেরোতে হ’লে সুপারিশ চাই। সৌভাগ্যক্রমে একজন মাস্টারমশাই যিনি আমার দিদিকে বেলতলা স্কুলে পড়িয়েছিলেন. তিনি কমলা ইনস্টিটিউশনে পড়াচ্ছেন; তাঁর সুপারিশে ভর্ত্তি হ’লাম; ফ্রিস্টুডেন্টশিপও পেলাম এই সর্ত্তে যে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট ক’রতে হবে; তিন বছরই অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ফার্স্ট হ’লাম; ফ্রিস্টুডেন্টশিপ বজায় রইলো। Higher Secondary Examএ আমার rank ছিল 20th; National Scholarship পেয়েছিলাম।

ধনী-দরিদ্রের পাঁচিলটা আবার চোখে পড়লো ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ভর্ত্তি হওয়ার সময়। আই.আই.টি.-র admission testএ Electriical Engineeringএ সবচেয়ে উপরে আমার নাম; কিন্তু হোস্টেলে থাকার খরচ দেবার সঙ্গতি ছিল না বাবার। পড়লাম যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে; পাঁচ বছরই প্রথম স্থানে থেকেও অবশেষে সেকেণ্ড হ’য়েছিলাম।

ইঞ্জিনীয়ার হবার পরে আরও অনেক পাঁচিল দেখলাম চাকরী পাওয়ার পথে। যখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ভর্ত্তি হ’য়েছিলাম, তখন ডাঃ বিধান রায় পশ্চিমবঙ্গকে শিল্পসমৃদ্ধ করার প্রয়াসী ছিলেন; আমার ফার্স্ট ইয়ারের শেষ দিকে ডাঃ রায় ইহলোক ছেড়ে গেলেন; শিল্পায়নের প্রয়াসও শেষ হ’লো। চাকরী পাওয়া দুরূহ হ’য়ে উঠলো; আর একটা পাঁচিল অবরোধ ক’রলো ভালো চাকরী পাওয়ার সুযোগ- চেনা-জানা থাকার পাঁচিল। বেকার ছিলাম না, তবে কম মাইনের চাকরী ক’রলাম হাওড়ায়।

তিন বছর পরে কাজ পেলাম জামসেদপুরের ইণ্ডিয়ান টিউবে। সেখানে চার বছর কাজ করার পরে বাবা-মার অনুরোধে বিয়ে ক’রতে রাজী হ’লাম। এখানে আর একটা পাঁচিল বড় হ’য়ে দাঁড়ালো- জাত-পাত; আমার বাবা-মা scheduled casteএর নয়, কিন্তু নীচু জাতের। এজাতে উচ্চশিক্ষিত চাকুরীরত অবিবাহিত পাত্র বিরল। বি.এ.পাশ বেকার হিমাংশুর সঙ্গে আমার বিয়ে হ’লো।

বাড়ীর বাইরের ছেলেদের সঙ্গে মিশতে নেই; বরাবরই মেনে এসেছি এই নিষেধের পাঁচিল। আশা ছিল, বিয়ের পরে আমার আর পার্টনারের মধ্যে এ পাঁচিল থাকবেনা। ফুলশয্যার পরের দিনই হিমাংশুর বাবা জানালেন- হিমাংশু আমার জামসেদপুরের কোয়ার্টারে বেড়াতে যাবে, কিন্তু স্থায়ীভাবে থাকবে না; ক’লকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ পড়বে। অগত্যা, আমি বাবা-মাকে নিয়ে এলাম জামসেদপুরের কোয়ার্টারে। 

হিমাংশু পাঁচিল দিয়ে আমার থেকে আড়ালে রইল; কিন্তু পরে বুঝলাম ওর কলকাতার আরও কয়েক মহিলার জন্যে হিমাংশু এ পাঁচিল বজায় রাখেনি। একথা বুঝতে পারলাম যখন বাবা খুব অসুস্থ হ’য়ে জামসেদপুরের হাসপাতালে ছিলেন; হিমাংশু এসেছিল শ্বশুরকে দেখতে; কিন্তু বেশী ব্যস্ত ছিল ক’লকাতায় চিঠি পাঠাতে।

 

বাবা হাসপাতাল থেকে ফেরার পর রাত্তিরে ডিনার খাওয়ার পরে হিমাংশুকে একা ঘরে পেয়ে বললাম, ’আমি  জানতে চাই রবীন্দর কে আর তার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক।‘

‘একথা কেন জিগ্যেস ক’রছো? রবীন্দর পাড়ার মহিন্দরদার বৌ আর আমার খুব নিকট বন্ধু।‘

‘তবু আমি জানতে চাই তোমার এই নিকট বন্ধুর সঙ্গে তুমি কী কী করো।‘

‘তোমার মতো বুড়ীরা ভাবে ছেলেদের খালি ছেলে বন্ধুই থাকবে। আজকাল সব ছেলেরই মেয়েবন্ধু থাকে, অনেক কথা মেয়েবন্ধুদের বলা যায়, যা ছেলেদের বলা যায় না।‘

‘হিমাংশু, তুমি এখানে আসার পরে রোজই অনেক চিঠি লিখছো, আমি তার হিসেবও রাখছিলুম না। একদিন সকালে তুমি পোস্ট ক’রতে দিলে রবীন্দরকে লেখা একটা চিঠি, আবার লাঞ্চের সময় যখন এলুম আবার তুমি পোস্ট ক’রতে দিলে রবীন্দরকে লেখা আর একটা চিঠি। আমি জিগ্যেস ক’রেছিলাম এত তাড়াতাড়ি আবার লেখার দরকার পড়লো কেন, তুমি জবাব দাওনি; এখন আমার জবাব চাই।‘

‘তোমর জানার দরকার নেই; একটা জরুরী কথা লেখার দরকার ছিল তাই লিখেছি।‘

‘কী সেই জরুরী কথা? বলো আমাকে–‘

‘সেটা আমার আর রবীন্দরের মধ্যে; তোমাকে ব’লতে পারবো না।‘

‘তোমার চিঠিটা পোস্ট করার আগে আমি রবীন্দরের চিঠিটা পড়েছি; রবীন্দর লিখেছিল, ওর পিরিয়ড শুরু হ’য়েছে আবার, প্রেগন্যান্ট ক’রতে পারোনি তুমি-‘

হিমাংশু ঝাঁপিয়ে প’ড়ে আমার পায়ে মাথা রাখলো; ব’ললো, ’ক্ষমা করো, এরকম আর কখনো হবে না।‘

আমি ব’ললাম, ’ঐদিন তোমার লেখা চিঠিটাও পড়েছিলাম,– তুমি বড়াই ক’রে লিখেছিলে রবীন্দরকে নিয়ে কী ক’রেছ; তুমি নিশ্চিত ছিলে- রবীন্দর প্রেগন্যান্ট হবেই, ব’লেছ– মেরা বাজী জিৎ গয়া।‘

হিমাংশু হাঁটু গেড়ে ব’সে আমার পা জড়িয়ে ধ’রে কাঁদলো, ’একথা আর কাউকে ব’লো না দীপ্তি; আমি মুখ দেখাতে পারবো না; বাবুমণি মেরে ফেলবেন আমাকে. কথা দিচ্ছি আর কোনোদিন কথা ব’লবো না রবীন্দরের সঙ্গে। আমি যদি এখন জামসেদপুরে ফিরে আসি, আমাদের বন্ধুরা, পাড়াপড়শীরা সবাই সন্দেহ ক’রবে, বাবুমণিকে, মামণিকে, আমাকে জেরা ক’রে জানতে চাইবে কেন আমি ক’লকাতায় থেকে এম-এ পড়া শেষ ক’রছিনা।‘ 

 

হিমাংশুর কথামতো কলকাতায় গিয়ে আমি অভিনয় ক’রলাম; হিমাংশুর বাবা-মা অবাক হ’য়ে গেলো আমাদের কথাবার্তা শুনে; ওঁরা ভাবতেই পারছিলেনা যে আমরা স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে এতো ভালবাসি।

আমাকে একবার একা পেয়ে জিগ্যেস ক’রলেন শ্বশুরমশাই, ’হিমাংশুর সঙ্গে এত ভাব হ’লো কীক’রে তোমার? রবীন্দরের ব্যাপারে যা লিখেছিলে, তা ওকে ব’লেছিলে?’

আমি হেসে ব’লেছিলাম, ’কিছুই হয়নি দুজনের মধ্যে। একটু মজা করার জন্যে ওরা চিঠি চালাচালি ক’রেছিল; ওদের ঘুণাক্ষরেও ধারণা ছিল না চিঠিগুলো আমার হাতে পড়তে পারে।‘

আমি যখন ব’ললাম- হিমাংশু ক’লকাতা থেকেই পড়ুক, ওর আমার সঙ্গে জামসেদপুরে ফেরার দরকার নেই, তখন শ্বশুরমশাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

আমি তখন বুঝতে পারেনি যে হিমাংশুকে সমস্ত বদনাম থেকে বাঁচানোর জন্যে আমার একটি মিথ্যা কথা বলার সুযোগ নিয়ে হিমাংশু আমার আইন-সম্মত স্বামী হওয়ার সুযোগ নিয়ে আমাকে সারা জীবন শোষণ ক’রবে, কিন্তু মজবুত পাঁচিল থাকবে দুজনের মধ্যে।

 

অনেকদিন কেটে গেছে এর পর। চল্লিশ বছর হ’লো হিমাংশু, আমি আর আমাদের ছেলে কুমার অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হ’য়েছি। কিন্তু হিমাংশু আর আমার মধ্যে পাঁচিলটা থেকে গেছে। আমার কাজ ছিল নানা দেশের ব্যাঙ্কের সফ্টওয়্যার ম্যানেজমেন্ট; কাজেই হিমাংশুকে অস্ট্রেলিয়াতে রেখে অনেকটা সময় কাটিয়েছি নানা দেশে-বিদেশে। এখন দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত, তবু একসঙ্গে কিছু ক’রিনা; যে যার ইচ্ছেমতো সময় কাটাই। পঞ্চাশতম বিবাবার্ষিকী আসবার আগেই আমার একটা পালানোর সুযোগ এলো।

প্রতি শুক্রবারে এখানের কমিউনিটি হলে টেবিল-টেনিস খেলতে যাই। এই শুক্রবারটা একটু আলাদা; কারণ সাত দিনের জন্যে হিমাংশু ব্রিসবেনে কুমারের বাড়ীতে গেছে।

টেবিল-টেনিস খেলোয়াড় লখিন্দর জিজ্ঞাসা ক’রলো, ‘দীপ্তি! বাড়ীতে স্বামী না থাকার সুযোগে, তুমি কি আমাদের সঙ্গে কোথাও একটু ঘুরে আসতে চাও?’
‘কোথায় যেতে চাও আর তোমার সঙ্গে আর কে কে থাকবে?’, আমি ব’লেছিলাম।
‘আমি স্ত্রীর সঙ্গে আগামীকাল শ্রীলঙ্কা যাচ্ছি। Qantas ফ্লাইটে যাবো’, ব’ললো লখিন্দর।
‘টিকিট পেলে আমিও যাবো।’, আমি ছুটে গেলাম কম্পিউটারে। Qantas ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ারকে ফোন ক’রে  লখিন্দরের ফ্লাইটেই আমার সীট বুক ক’রলাম।
লখিন্দর ব’ললো, ’এখন বাড়ি যাই। আগামীকাল বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ একটা ট্যাক্সি নিয়ে এখানে আসবো, তোমাকে তুলে নেবার জন্যে।’
পরদিন ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো আমার বাড়ীর দরজায়। লখিন্দর ট্যাক্সি থেকে নেমে আমকে লাগেজ তুলতে সাহায্য ক’রলো আর ওর স্ত্রী বেহুলার সাথে পরিচয় ক’রিয়ে দিলো। আমি একটু অবাক হ’য়ে দেখলাম যে বেহুলার মুখ অবিকল আমর মুখের মতো।
কারাগরের পাঁচিল থেকে পালিয়ে, শ্রীলঙ্কা যাবার আনন্দে খুশী ছিল মন….
 
রিসর্টে চেক-ইন ক’রে, `সুইমিং কস্টিউম প’রে আমবা বেন্টোলা বীচে নামলুম।
আমি সাঁতার জানিনা; এখানে সমুদ্র সৈকতে মিনিট দশেক হাঁটলাম; চশমাজোড়া হারিয়ে গেল, কিছু ভালো ক’রে দেখা যাচ্ছে না; তাই লখিন্দর-বেহুলাকে জানিয়ে তীরে ফিরে গেলাম।

বেহুলা-লখিন্দর অনেকটা সমুদ্রের মধ্যে গিয়েছিল। ওদের ফেরার অপেক্ষায় তীরে বসেছিলাম।
কুড়ি মিনিট পরে, বিধ্বস্ত লখিন্দর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলো- ’বেহুলাকে বাঁচাতে পারিনি, টেনে নিয়ে গেছে ঢেউয়ের নীচের টানে’।
‘হেল্প প্লীজ’, চিৎকার ক’রে লাইফগার্ডকে ডাকলাম।
লখিন্দর সিংহলী ভাষায় বোঝালো লাইফগার্ডদের,- কী হ’য়েছে তার বর্ণনা দিয়ে। তারা প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে লখিন্দরের কথা শুনে চেষ্টা ক’রেছিল; তবুও বেহুলার দেহের কোনও সন্ধান পায়নি।
লাইফগার্ডরা ব’লেছিল. ‘এই মামলায় একটি রিপোর্ট লিখতে হবে; নামগুলো বলুন’। লখিন্দর ব’ললো, ’যাকে, আমরা সাগরে হারিয়েছি, তার নাম সানদুন।‘, চোখের জলে রুদ্ধ লখিন্দরের কন্ঠস্বর, ’কলম্বো থেকে ক্যান্ডি যাওয়ার সময় ট্রেনে আমাদের প্রথম দেখা হয় ওর সাথে’ তখন থেকে সানদুন আমাদের আত্মীয়ের মতো হ’য়ে গেছে। কিন্তু আমরা ওর ঠিকানা আর নিকট আত্মীয়ের নাম জানি না।’
তারপরে লখিন্দর নিজের পরিচয় দিয়েছিল, আর আমাকে ওর স্ত্রী বেহুলা হিসাবে পরিচয় দিয়েছিল।
লাইফগার্ডরা ওখান থেকে চলে গেল। আমি লখিন্দরকে জিজ্ঞেস ক’রলুম, ’এর পরে কী ক’রবো আমরা?’ লখিন্দর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেছিল, আর কেঁদে ব’লেছিল, ’জানিনা আমি! তুমি আমার বেহুলা হবে কি এখন থেকে? বাঁচাবে আমাকে বিপত্নীক হওয়া থেকে?’
আমি অনেক বছর ধ’রে লখিন্দরের সাথে টেবিল টেনিস খেলেছি, কিন্তু কখনও ধারণাও ক’রতে পারেনি যে এই দুর্দান্ত শক্তিশালী খেলোয়াড়টির মন এত স্পর্শকাতর। স্বতঃপ্রবৃত্ত হ’য়ে লখিন্দরকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে চুমু খেলাম আমি; লখিন্দরের জিভও ছুঁয়ে গেলো আমার জিভ।  সুইমিং কস্টিউমের ফাঁক দিয়ে আমার বুক দুটোকে আদর না ক’রে পারলো না লখিন্দর। আমি পিছিয়ে এসে ব’ললুম, ’এ আমরা কি ক’রছি, লখিন্দর? বেহুলা এইমাত্র চলে গেছে; কিংবা হয়তো এখনও যায়নি!’

লখিন্দর ব’ললো, ‘আর কোনো পাঁচিল নেই আমাদের দুজনের মধ্যে। বাড়ীতে একটা টেবিল-টেনিস বোর্ড লাগাবো; প্রতিদিন খেলবো দুজনে। কিছু ক’রতে হবে যাতে ড্রাইভার থারিন্ডু তোমাকে চিনতে না পারে।’
লখিন্দর আমার মুখের একপাশে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল, যাতে থারিন্ডু ব্যান্ডেজ বাঁধা কণ্ঠের পিছনে আসলে কে আছে তা সনাক্ত ক’রতে না পারে।
 

ড্রাইভার থারিন্ডু লখিন্দর আর আমাকে ক্যান্ডিতে ফেরৎ নিয়ে এলো। শুরু হ’লো আমার নতুন জীবন। এখন থেকে সারা জীবন, আমাকে বেঁচে থাকতে হবে শ্রীলঙ্কার নাগরিক হ’য়ে, লখিন্দরের প্রিয়তমা স্ত্রী বেহুলা হ’য়ে, যাতে লখিন্দরকে বিপত্নীক হ’তে না হয়।
লখিন্দরের অনুরোধে, আমি অতিথির ঘর থেকে চলে এলুম ওর শোবার ঘরে। লখিন্দরের নির্দেশে, বেহুলা এতদিন যা জামাকাপড় প’রতো আমি তা প’রতে শুরু ক’রলো, যাতে প্রত্যেকে, এমনকি লখিন্দরও বিশ্বাস ক’রতে থাকে যে একই বেহুলা এখনও বাড়িতে রয়েছে।
‘এখন থেকে তোমাকে কী ব’লে ডাকবো?’ লখিন্দর আমাকে জিগ্যেস ক’রলো, ’তোমাকে বেহুলা ব’লতে অদ্ভুত লাগবে আর তোমাকে আমি ‘দীপ্তি’ ব’লে ডাকতে চাই না। আমি তোমাকে ’বেলা’ ব’লে ডাকব।’
আমি জবাবে ব’ললুম, ’তুমি একেবারে আমার মনের কথাটা ব’লেছো। আমি তোমাকে ’লক্ষীটি’ ব’লে ডাকবো।’
তখন থেকে আমি বেলার মতো থাকতুম এবং বেহুলা এতদিন যা ক’রতো তাই ক’রতুম; যখন শপিং সেন্টারে যেতুম, বেহুলার কামিজগুলোই প’রতুম। আমি স্কুলেও গিয়েছিলুম এবং সেখানে জানিয়েলুম যে আমি বধির বাচ্চাদের পড়াবো, আর যদি কোনও সুযোগ পাওয়া যায় তবে ইংরেজী, বিজ্ঞান আর গণিতও পড়াবে।

লখিন্দরের নজরে পড়লো- বেহুলার পাসপোর্ট শেষ হ’য়ে যাবার তারিখ মাত্র দু মাস পরে। ও ইমিগ্রেশন এবং এমিগ্রেশন বিভাগের ওয়েবসাইটে গিয়ে, ক্যান্ডি শাখায় বেহুলা হিসাবে লগ ইন ক’রলো, এবং পাসপোর্ট রিনিউ করার জন্যে আবেদন ক’রলো। লখিন্দর বেহুলার ডায়েরি থেকে সমস্ত পাসওয়ার্ড এবং গোপন প্রশ্নের উত্তর দেখে নিয়েছিল। সময় হ’লে আমার অর্থাৎ বেলার ফটো দিয়ে নতুন পাসপোর্ট হ’লো বেহুলার নামে।
লখিন্দর আমার জন্য অনলাইন কোর্সের ব্যবস্থা ক’রেছিল, যাতে আমি সিংহলী উপভাষা তাড়াতাড়ি শিখতে পারি। আমার একাডেমিক কেরিয়ার বরাবরই ভাল ছিল। সিংহলী উপভাষায় পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন ক’রতে এক সপ্তাহের বেশী লাগেনি। বেলা যেমন দেখতে বেহুলার মতো আর তেমনই সিংহলী ভাষায় কথা ব’লতো সাবলীলভাবে, কোনও লোকই তার ছদ্মবেশ ধারণের ব্যাপারে সন্দেহ ক’রতো না। আমি ইতিমধ্যে সিংহলের জাতীয় সংগীত ’শ্রীলঙ্কা মাতা’ শুনে মুগ্ধ হ’য়েছিলাম; আমি শুনেছিলাম যে শ্রীলঙ্কার সুরকার আনন্দ সমরোকুন বাঙালী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা অনুপ্রাণিত হ’য়ে গানটিতে সুর দিয়েছিলেন। লখিন্দর ভাবলো ও-ও এই সঙ্গে বাংলা শিখবে, যাতে কোনও সময়ে, দরকার পড়লে তারা দুজনে বাংলায় কথা ব’লতে পারবে, পারবে একসাথে রবীন্দ্র-সংগীত গাইতে।
সারাজীবন ধ’রে চেষ্টা ক’রেছি যাতে যে-কেউ যে-কোনো দেশের পাঁচিল পেরিয়ে, সেখানে থেকে, জীবিকার্জ্জন ক’রতে পারে, বারবার ব্যর্থ হ’য়েছি পাঁচিল পেরোতে। আজ আমাদের মধ্যে শ্রীলঙ্কা, ভারতবর্ষ, অস্ট্রেলিয়ার পাঁচিলগুলো হঠাৎ হ’লো অন্তর্হিত।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু