বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

গোলাপ

🌹🌹🌹🌹গোলাপ🌹🌹🌹🌹


মাদার টেরেসা সরণি আর আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোড এর ক্রসিংয়ে অবস্থিত লোয়ার সার্কুলার রোড সিমেট্রিটার সামনে দাঁড়িয়ে আইরিন। পরনে সাদা চুড়িদার, রেশমী চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো উড়ছে।কাঁধে একটা লম্বা ব্যাগ,তাতে বেশ বড়ো সড়ো একটা বাক্স।

শ্মশান থেকে কাল ফেরার পর মায়ের ড্রেসিং টেবিলের সামনে এই বাক্সটা পেয়েছিল আইরিন।খুলে দেখল বেশ কিছু মোটা বাঁধানো খাতা। তাতে ডাইরির মত করে কিছু লিখেছে মা। সবথেকে নিচের খাতাটা থেকে শুরু করে পাতা উল্টে পড়তে লেগেছিল সে।


প্রথম পাতায় এক সুদর্শন জার্সি পরা তরুণের ছবি,পায়ের তলায় ফুটবল।' বাব্বা,পাপা ফুটবলও খেলত?' আইরিন মনে মনে অবাক হলো।সব দিন না,কিছু কিছু দিনের টুকরো টুকরো কথার এন্ট্রি রেখেছেন অপর্ণা।কিন্তু তাতেই ভাবনা আর অনুভূতিরা স্পষ্ট।টগবগে তরুণ ফুটবল প্লেয়ার জোনাথন এর সাথে ম্যাচ দেখতে গিয়ে প্রথম দেখা,তরুণীর মনে গড়ে ওঠা অন্য রকম এক অনুভূতি,14ই February তে পাওয়া প্রথম গোলাপ, অসবর্ণ প্রেমের কথা জানার পর বাড়িতে হওয়া অশান্তি আর অত্যাচার,সবার অমতে দুজনের বিয়ে,আইরিনের জন্ম,মাতৃত্বের স্বাদের অনুভূতি, জোনাথন এর পায়ের আঘাত ও খেলার সমাপ্তি টুকরো টুকরো অথচ সুন্দরভাবে বর্ণনা করা।পড়তে পড়তে কখনো আইরিনের চোখে আসছিল জল, কখনো আলতো হাসি,কখনো সমাজের উপর ক্রোধে চোখে জ্বলছিল আগুন।

আইরিন খেয়াল করলো প্রতি 14ই ফেব্রুয়ারি ডাইরিতে আটকানো একটা করে গোলাপ।মৃদু হাসলো সে, পাপার মাকে দেওয়া ভালোবাসার উপহার তবে এগুলো।

এক জায়গায় এসে থমকে গেলো আইরিন।2015 সালের 14ই ফেব্রুয়ারির পাতা তেও একটা গোলাপ আটকানো।কিন্তু এ কিভাবে সম্ভব?পাপা তো সেই বছর 12ই ফেব্রুয়ারি একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে-------

তাড়াতাড়ি পাতা উল্টালো আইরিন।পরের পাতায় লাল কালিতে লেখা," প্রিয়তম জন,

                            সবাই বলছে তুমি নাকি আর নেই?সেদিন নাকি রাস্তায় ছড়ানো ছিল অনেক রক্ত?না না,ওরা জানে না কিছু।তুমি তো আমায় বলে গিয়েছিলে,তোমায় অফিসের কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে।আজ ভালোবাসার দিন,এই প্রথমবার তুমি থাকতে পারবে না।কিন্তু বলেছিলে আমি যেন তোমার বসানো গোলাপ গাছ থেকে একটা ফুল তুলে ডাইরির পাতায় রাখি, ওটাই হবে তোমার দেওয়া।আমি রেখেছি,তোমার ফেরার অপেক্ষায় রইলাম ----"

আইরিন তাড়াতাড়ি পরের বছরের 14ই ফেব্রুয়ারির পাতা খুললো।একই ভাবে একটা গোলাপ,নিচে লেখা

        " আছো তুমি আমার পাশেই,তোমার স্পর্শ অনুভব করতে পারি আমি,তোমার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই। সকলে শুনলে পাগল বলবে,কিন্তু আমি জানি, সত্যি।"

স্তম্ভিত হয়ে গেলো আইরিন,মা চিরকাল খুব শক্ত,নিজের অনুভূতিগুলো কাউকে বুঝতে দেয়নি কখনো।তাই সেও কখনো বোঝেনি মা পাপাকে শেষ দিন পর্যন্ত মনের আসনে কতটা বাঁচিয়ে রেখেছে।ডাইরির প্রতি পাতায় পাপার উপস্থিতির জীবন্ত বর্ণনা। জানলার বাইরের লাল গোলাপের গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখেছিল একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে গাছটা।

" দিদি সরুন একটু",একটি বাচ্চা মেয়ের ডাকে বর্তমানে ফিরে এলো আইরিন।চোখ থেকে একফোঁটা জল মুছে সেমিট্রির ভিতরে ঢুকলো সে। এখানকার অদ্ভুত শান্ত পরিবেশে মনটাই অন্যরকম হয়ে যায়।মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধির দিকে একবার তাকিয়ে পায়ে পায়ে পাপার সমাধির কাছে এগিয়ে গেলো।কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে সমাধির উপরের বেশ কিছুটা মাটি সরিয়ে গর্ত করে সে বাক্সটা বার করে গর্তে রাখলো।তারপর আবার মাটি চাপা দিয়ে দিল। পাপার জন্য জমানো এত অনুভূতি,এত অপেক্ষা,এত ভালোবাসা আর গোলাপগুলো পাপার কাছেই পৌঁছে দিতে এসেছিল সে,ওগুলো পাপার কাছেই থাক।

আজ ভালোবাসার দিনে আইরিনের সবচেয়ে ভালোবাসার দুজন মানুষ তার কাছে নেই।বাবার সমাধিতে মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছিল সে, এমন সময় কাঁধের উপর অনেকখানি বিশ্বাস আর নির্ভরতা ভরা একটা হাতের স্পর্শ পেলো।চমকে তাকাল পিছন ফিরে,অতীন দাঁড়িয়ে আছে,চোখে অনেকটা ভালোবাসা,ঠোঁটে স্মিত হাসি আর হাতে একগুচ্ছ লাল ডাচ গোলাপ।🌹🌹🌹

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু