বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

হেমন্তিকার প্রেম

শরৎ প্রাণখোলা দিলদরিয়া প্রকৃতির ছেলে৷ তার নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দের আয়োজনে নিত্যদিনের গতানুগতিক জীবনের সুখদুঃখ তেমন ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে না৷শরতের সেই আনন্দের উদযাপনে কিন্তু অনাবশ্যক আড়ম্বর নেই, পরিবর্তে রয়েছে এক নিরাভরণ আত্মস্থতা! তার সরল আনন্দপ্রবণ মন অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় থেকেই ঠিক খুঁজে নিতে জানে ভালো থাকার রসদ৷ কখনো সে শিউলি ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠে, নীলাকাশের শ্বেতশুভ্র ভেলায় চড়ে, পাড়ি জমায় অজানার সন্ধানে; আবার কখনো সারি সারি কাশের মাঝেই আত্মবিস্মৃত হয় সে৷ কখনো আবার আপাত অকারণেই, তার মনসায়রে সুখসরোজ সহস্র পাপড়ি মেলে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে! এরকম ভাবেই আত্মভোলা শিল্পী সত্তার শরৎ সর্বদাই তার নিজের সৃষ্ট জগতেই বিচরণ করে৷ বৈষয়িক জ্ঞান-বুদ্ধি, বিচার-বিবেচনা তাকে ভাবিত করে না কখনোই— পারস্পরিক এক অলিখিত চুক্তিতে যেন একে অপরকে সযত্নে এড়িয়েই চলে তারা!

   হেমন্তিকা দারুণ রূপসী, লাবণ্যময়ী— কিন্তু তার সেই অপরূপ সৌন্দর্য্য কোনো এক আসন্ন অমঙ্গলের অব্যক্ত আশঙ্কায় যেন সর্বদাই সঙ্কুচিত হয়ে থাকে৷ আড়ালে আবডালে আত্মগোপনের ছল খোঁজে সে নিরন্তর! তবু দেখবার মত চোখ ঠিক চিনে নেয়, পথের পাশের অকিঞ্চিৎকর নবীন কিশলয়ের উপর, রোদ পড়ে মুক্তোর মত ঝলমল করতে থাকা শিশির সদৃশ, হেমন্তিকার অনিন্দ্যসুন্দর রূপমাধুরী৷ বলাই বাহুল্য সেই সুযোগ্য নয়নযুগলের অধিকারী শরৎ ভিন্ন আর কেউ নয়! প্রথম দিকের শব্দহীন নির্নিমেষ চেয়ে থাকা অব্যক্ত অনুভূতিরা, ক্রমশ ভাষা খুঁজে পেতে থাকে৷ চিরকালীন অভ্যাসের মনন-অবগুণ্ঠন উন্মোচিত হতে থাকে ধীরে ধীরে৷ প্রাণচঞ্চল শরৎ আর গহীনমননা হেমন্তিকা আসতে থাকে একে অপরের কাছাকাছি৷ গন্ধরাজ, দেবকাঞ্চনের সৌরভে সুরভিত হয়ে ওঠে হেমন্তিকার অন্তরাত্মা৷ হেমন্তিকার সাদাকালো নিস্তরঙ্গ জীবনে লাগে বিচিত্র বর্ণময়তার মিষ্টি ছোঁয়া৷ নতুন খাদ্যশস্যের সমাহারে গোলা ভরে উঠলে যেমন গাঁয়ের ঘরে ঘরে আনন্দের হিল্লোল জাগে, তেমনই এক অপূর্ব পরিপূর্ণতায় ভরে ওঠে হেমন্তিকার মন৷ সে চায় শরতের মনের উৎসবের যোগ্য অংশীদার হয়ে উঠতে—বিষণ্ণতাকে চিরবিদায় জানাতে৷ কিছুটা সফলও হয় হেমন্তিকা, কিন্তু ফল্গুধারার মত তার মনের মাঝে গোপনে প্রবহমান থাকে এক বিষাদময় অনুভূতি— এত যে সুখ, তাকেই হারিয়ে ফেলার শঙ্কা৷

  হায় রে জাগতিক নিয়মতান্ত্রিকতা! শরৎ-হেমন্তিকার সেই সুখস্বপ্নের দিনগুলো দীর্ঘস্থায়ী হল না৷ হেমন্তিকার বাবা দিবাকরবাবু প্রকৃতিগত ভাবে খুবই তেজস্বী ও রাশভারী৷ সঙ্গত কারণেই চালচুলোহীন বাউন্ডুলে শরতের সাথে হেমন্তিকার মেলামেশা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি তিনি৷ তাই সর্বতভাবে যোগ্যতম হিসেবে তিনি শৈত্যপ্রকাশ'কে চিহ্নিত করেন৷ শৈত্য স্হিতধী, বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন, সুপ্রতিষ্ঠিত মধ্যবয়স্ক৷ শৈত্যর মধ্যে আবেগ অনুভূতির বাহুল্য নেই, নেই প্রাণপ্রাচুর্যের স্বতস্ফূর্ত প্রকাশও৷ কিন্তু বরফের মত ঠান্ডা মগজ তার৷ বিপদে বিচলিত হয় না কখনো; স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির প্রসারে সদাই নিয়োজিত তার সেই হিমশীতল মস্তিষ্ক৷ এরকম পাত্রই হেমন্তিকার জন্য উপযুক্ত বই কি! অন্তত দিবাকরবাবুর তেমনটাই সিদ্ধান্ত৷ তাঁর উপরে কথা বলবার মত মনের জোর ছিলো না হেমন্তিকার৷ ফলে এতদিন যে আশঙ্কা মনের মাঝে ছিলো হেমন্তিকার, তার বাস্তবায়ন ঘটলো এবারে৷ সে সামান্যতম প্রতিবাদও করতে পারলো না, কারণ সে তো জানেই শরৎ শিল্পী সত্তা ও প্রেমিক সত্তার অধিকারী হলেও ন্যূনতম বাস্তববোধের অধিকারী নয়—আর হবেও না কোনদিন! মনের বেদনা মনেই চেপে রেখে, সময়ের একমুখী অভিঘাতে শৈত্যপ্রকাশের দিকেই এগিয়ে যেতে হয় হেমন্তিকা'কে৷

  শৈত্যপ্রকাশের কাছে আবেগ অনুভূতির আবেদন আশা করা সোনার পাথরবাটির মত বিষয়! তাই কাঙ্ক্ষিত উষ্ণতার বড়ই অভাব একাকিনী হেমন্তিকার নিঃসঙ্গ জীবনে৷ কখনো পড়ন্তবেলার মনখারাপ করা আলো দেখে হেমন্তিকা মনে মনেই ফিরে যায় সেই সুখের স্বপ্নমাখা দিনগুলিতে৷ পুরনোদিনের স্মৃতিমাখা দখিনা বাতাস কখনো বা বয়ে আনে শিউলিফুলের গন্ধ!

   শরৎও আর আগের মত নেই৷ তার আনন্দের আয়োজনে মাঝেমধ্যেই ভাঁটা পড়ে আজকাল৷ তার মনের স্বচ্ছ নীলাকাশে আগে পেঁজাতুলোর মত শ্বেতশুভ্র মেঘরাজি ভাসতো, আর এখন? এখন প্রায়সই ঘন কৃষ্ণবর্ণের মেঘ জমে শরতের মনে৷ অকালে অবিরত বর্ষণ হয়ে ঝরে পড়ে তার অব্যক্ত দুঃখগুলো৷

    কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না৷ আবারো কোন হেমন্তিকার প্রেমে পড়ে অন্য কোন শরৎ৷ চক্রাকারে আবর্তিত হয় সেই বেদনাময় "না-মানুষ" প্রেমগাথা৷ শরৎ আর হেমন্তিকার প্রেমগাথা কি কখনো সম্পূর্ণতা পাবে? তা বোধ হয় সম্ভব হবে না কখনোই, কারণ বিধাতার নিঠুর পরিহাসে শরৎ আর হেমন্তিকার একাত্মতা আর সৃষ্টির নাশ সমার্থক হয়ে গেছে! মিলন-বিরহের এই চক্রাকার পরিণতি অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে—যত দিন না বিনাশকাল সমাগত হয়৷সেই বিনাশের মহালগ্নে বুঝি পূর্ণতা পাবে এক মহাজাগতিক অসম্পূর্ণ প্রেমগাথা! অশ্রুসজল চোখে খেলে যাবে খুশির ঝিলিক, শুষ্ক ওষ্ঠে ফুটে উঠবে মৃদু হাসি৷ কেবল আমরা কেউ তার সাক্ষী থাকবো না৷ নাই বা থাকলাম—নিভৃতেই হোক হৈমন্তিক প্রেমযাপন!


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু