বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বংশধর

গল্প: বংশধর (থ্রিলার)

ঝিলিক মুখার্জী গোস্বামী

_________________________ 



                                                                (১)

নীলচে আলোর রেখাগুলো বিচ্ছুরিত হয়ে একধরনের মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। রূপালী রঙা ঘুরন্ত বলটা নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে আবর্ত ক্রিয়ার মাধ্যমে। তার থেকে ছিটকে আসা রূপালী বিন্দুগুলো তেরছাভাবে ঠিকরে পড়ছে ঘরের এদিক ওদিক। অগছালো শয্যার ওপর শায়িত আছে একটা নরম তুলতুলে শরীর। শরীর থেকে হাত পাগুলো পরম ক্লান্তিতে প্রায় ঝুলে পড়েছে কংক্রিটের মেঝের ওপর। কাচের পানপাত্রের ওপর চিত্রিত হয়েছে  অধরঞ্জনীর ছাপ। খাবারের বাক্সগুলো ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছ। টুকরো খাবারের অংশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে কালো পিঁপড়ের সারিবদ্ধ দল।  খাবারের অংশ ছাড়াও, তাদের নজর পড়েছে...


 বিস্ফারিত আঁখিজোড়া একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তার মুখমন্ডল থেকে উধাও হয়েছে রাত্রিকালীন শিঙ্গার। আঁখিযুগলের নিম্নভাগে অধিকৃত হয়েছে, একদলা কাজল রেখার দাগ। ওষ্ঠাধার থেকে বিকৃত হয়েছে হাসির ঝিলিক। তার পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে একফালি শুষ্কতা। 


শয্যার ওপর শায়িত  শরীরের মধ্যে থেকে বিলুপ্ত হয়েছে ইচ্ছাশক্তির আধার। সেই জায়গায় বিরাজমান একতাল অবসন্নতা। শরীরের অংশগুলোকে টেনে তোলার সমস্ত অক্ষমতা গ্রাস করেছে তাকে। কালচে পিঁপড়ের দলটা ক্রমাগত এগিয়ে আসছে তার দিকে। কিছুটা এগিয়ে এসে আবার স্থির হয়ে যাচ্ছে। মেঝের ওপর লেপ্টে থাকা লাল-কালো লক্ষ্মণরেখা,  ডেঁয়ো পিঁপড়ের দলের অভিমুখে বাধার পথ তৈরি করে রেখেছে। 

 

**** 


সুগন্ধি ধূপের ধোঁয়ার রেখাগুলো সর্পিলভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে উর্ধ্বগামী হয়ে। সুমিষ্ট ঘ্রাণে, ক্রমশ বিহ্বল হয়ে পড়ছে মন। ধূপের সুঘ্রাণের সঙ্গে ধূনার গন্ধটা ক্রমশ  অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। এতক্ষণ যে সুঘ্রাণে আবেশিত হয়েছিল মন! বর্তমানে মনে হচ্ছে প্রাণ কোটরে সযত্নে লালিত পরাণ পক্ষী এখুনি নির্গত হবে বোধহয়। বুকের খাঁচার ওপর গরম হাপরের ওঠানামার আওয়াজ পরিদৃষ্ট হচ্ছে। গরম শলাকা  সমগ্র শরীরকে জ্বালাপোড়া করে তুলছে। নাসারন্ধ্রের বিলজোড়া কেউ যেন আবদ্ধ করে রেখেছে। ঠিক তখনই আঁখিজোড়া চারিয়ে দেখলাম সেই মাতৃমূর্তি আমার দিকে তাকিয়ে, আমাকে গ্রাস করছে তাঁর হাসির ঝিলিক দিয়ে। 


পদ্মাসনে উপবিষ্টা, চতুর্ভুজা এবং তিনটি মাথা বিশিষ্টা দেবী। হাতে তাঁর উপস্থিত খট্বাঙ্গ,  অপর হস্তে বজ্র। অপর এক হস্তে ধরে রয়েছেন তাঁর কন্ঠহার। এধরনের মূর্তি সচরাচর বৌদ্ধধর্মের দেবীমূর্তির সঙ্গে মেলে। যা কিনা আবার মহাযানী কিংবা বজ্রযানী বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে একাত্মতা সংস্থাপন করে। এই মাতৃমূর্তির সঙ্গে আমিও বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছি বেশ কয়েক বছর যাবত। কিন্তু...


স্বেদগ্রন্থি থেকে জলবিন্দুর রাশি ক্রমশ জাগ্রত হচ্ছে। অস্বস্তিকর আবহাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে প্রায়। বেশি সময় এইভাবে নিজেকে আবদ্ধ রাখলে, প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে আমার সলিল সমাধি হওয়া কিছুটা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করেও নিজেকে কিছুতেই আলগা করতে পারলাম না বিছানার নাগপাশ থেকে। একদলা কষ্টের পিন্ড দলাকৃত হয়ে কন্ঠনালী প্রায় আবদ্ধ করে রেখেছে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দরা একদম নিশ্চুপ অবস্থায় শিথিল হয়ে অবস্থান করছে। হঠাতই লক্ষ্য করলাম, দেবীর মুখমন্ডল থেকে হাসির রেখা অবলুপ্ত হয়ে, সেই জায়গায় উদয় হয়েছে ভীষণরূপ। এইরূপের অর্থ বোধগম্য করতে আমার আর বিশেষ অসুবিধা হয় না। পূর্বের মতো আর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়িনা। দেবীর এইরূপ প্রতিভাত হলেই, একরাশ নান্দনিক সুখের জাল বিস্তারিত হয় আমার শিরা উপশিরা জুড়ে। দেহমধ্যস্থ রক্তপ্রবাহের স্রোত দ্বিগুন মাত্রায় বর্ধিত হতে থাকে। দেহরসের অভ্যন্তরে পুনরায় প্রাণ কোষের প্রতিষ্ঠা জাগরুক হয়। 


দেবীর ভীষণরূপ নিমেষে মিলিয়ে গেলেই, নিজেকে মুক্ত করি স্বপ্নজাল থেকে। বিছানার ওপর উঠে বসেই একটা আড়মোড়া ভেঙে, টেবিলের ওপর রাখা জলের গ্লাস থেকে এক চুমুকে সমস্ত জল নিঃশেষ করে স্থির হয়ে বসে থাকি বছরের পর বছর বয়ে চলা একগুচ্ছ প্রশ্নবাণ নিয়ে। 

*** 

সান্ধ্যকালীন স্বচ্ছ আকাশকে গ্রাস করেছে করালদ্রংষ্টা মেঘরাশি। মাতঙ্গের গর্জনের ন্যায় গর্জিত হয়ে চলেছে আকাশ ভুবন। বিদ্যুতের ঝলক ঠিকরে পড়ছে ঘরজুড়ে। প্রবল অনিচ্ছাকৃত ভাবে ঘরের জানালা আবদ্ধ করতে উঠল, এক সুঠাম দেহধারী পুরুষ। বিদুত্যের আলোকের চাকচিক্য খেলায় ভেসে উঠল সেই বহু পুরাতন চিহ্ন, যা আজও বহন করে চলেছে বর্তমানের পৃষ্ঠদেশ। 


কোনরকমে জানালার পাল্লা অবরুদ্ধ করে, পুরুষশরীর নিজেকে সমর্পিত করল যৌবন বুভুক্ষু নারীশরীরের নিকটে। চুম্বন প্রতিচুম্বনে অস্থির হয়ে উঠল, কামতাড়িত নারীশরীর। যৌবনের ছটা যেন উপচে পড়ছে তার বক্ষদেশ জুড়ে। নরম পদ্মের পাপড়িগুলোকে জাগ্রত করার চেষ্টা করে চলেছে পৌরুষ জিহ্বার অগ্রভাগ। উভয় বৃন্তদ্বয়ে ছোট্ট দুটো টোকা মেরে, নারীর বক্ষ মাঝে মুখমন্ডলকে নিমজ্জিত করল। বক্ষদ্বয় থেকে মুখ নামিয়ে, জিহ্বা তখন অনুসন্ধানে রত নারীর নাভীমূলের দিকে। লোলুপ দৃষ্টিতে চেটেপুটে নিচ্ছে নিরাবরণ নারী শরীরকে। হস্তযুগলের খেলায় মেতে উঠছে, দুটি পুরুষালি হাত। ক্রমশ বেড়ে চলেছে শীৎকারের মাত্রা। 


ঘরের মধ্যেকার একমাত্র নীলচে আলো সাক্ষীস্বরূপ দন্ডায়মান, তাদের কামাতুর ক্রীড়াক্ষেত্রের। পৌরুষ এর অধিকারীর  পৃষ্ঠদেশ ক্রমশ ওঠানামায় ব্যস্ত। প্রজ্বলিত অগ্নির গরম ভাপের ন্যায় শ্বাস প্রশ্বাসের বায়ুরাশি। যোনিরূপী  তপ্ত লৌহ আকরে শেষ বারের মতো হাপরের আঘাত পড়ল। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ল  কামাতুর দুটি শরীর। বাইরের বজ্র নিনাদ ঘনঘটায় ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকল শিৎকার এর নিদারুণ ধ্বনি।


মদনদেবের কামবাণ থেকে নিজেকে নির্গত করে, বিশেষ পানপাত্রে অবস্থিত পানীয়র গ্লাস এগিয়ে দিল নারীমূর্তির দিকে।  নারীললাটে অঙ্কিত হল, চুম্বন চিহ্ন। পুরুষালি আঁখিদ্বয়ে খেলে বেড়াচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত নিষ্ঠুরতা। যা কিনা রয়ে গেল নারী চক্ষুর একান্ত অন্তরালে। পরম তৃপ্তিতে ছোট্ট চুমুকের স্রোত চলকে উঠল কাচের গ্লাসে। 

*** 

ঘন আঁধারকে সঙ্গী করে, ছোট্ট ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল একটা দেহাবয়ব। পূর্ব অবস্থানরত জায়গা থেকে অপসারিত করল নিজের অস্তিত্বের সমস্ত চিহ্ন। সুপটু হাতের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা বহু সময় আগের। যাওয়ার ঠিক শেষ মুহূর্তে একটা উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে দিল, শয্যার দিকে। গ্রহীতার মুখাবয়বের প্রতিচ্ছবি ঠিক উদ্ভাসিত না হওয়ার কারণে  বোধগম্য হল না তার অনুভূতি। যতটা সম্ভব আওয়াজ কম করে, ক্ষিপ্রপদে বেরিয়ে গেল নীলচেরঙা অস্থায়ী কুঠুরি থেকে। তাঁর নিষ্ক্রমণের ভার বহনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ঘরের চারটে দেওয়াল। আর রেখে গেল...


আকাশভাঙা মেঘবৃষ্টির মৃদু অপসারনে, বিদ্যুতের ঝিলিকের আলোকে পথপ্রদর্শক করে উপস্থিত হল, প্রায় পান্ডব বর্জিত এলাকায়। ইতিউতি দৃষ্টি নিক্ষেপিত হল। গভীর অথচ সাবধানী নজর দিয়ে পরিমাপ করে নিতে চাইল কিছু। যখন নিশ্চিতরূপে নিশ্চিত হল, সেখান থেকে তৎপর হয়ে তৎক্ষণাৎ নিষ্ক্রমণ করল। ব্যাকপ্যাকে রাখা ইলেক্ট্রনিক্স জিনিসটা থেকে পরবর্তী গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ঠিক তখনই, রাতচরা কুবোপাখিটা কু-ডাক ডেকে উঠল। 

*** 

__________________________________________________________ 


                                                              (২)


রানাঘাটের অদূরে অবস্থিত অজানা একটি গ্রাম। যে গ্রাম নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক রকম গল্পকথন। এই গ্রামের মাটির নীচে নাকি লুকিয়ে আছে ইতিহাসের অজানা গল্প। যে ঐতিহাসিক  গল্প ইতিহাস বইয়ের অভ্যন্তরে স্থান না পাওয়ায় লোকমুখে প্রচলিত রূপে আত্মপ্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে একপ্রকার। এই অপরিচিত গ্রামের নাম সেইভাবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বহুল আলোচিত না হলেও এখানকার গ্রামের মানুষের মুখে মুখে অনেক গল্প ভেসে বেড়ায় আজও। তৎকালীন বাংলার রাজা লক্ষ্মণ সেনকে কেন্দ্র করে অনেক গল্পের অধিকারী এই গ্রাম---- গাংনাপুরের দেবগ্রাম আনুলিয়া। এই আনুলিয়া থেকেই ১৮৯৮ সালে উদ্ধার হয়েছিল লক্ষ্মণ সেনের আমলের একটি তাম্রপট্ট।  তাম্রপট্টটির মূল বিষয়বস্তু ছিল,  ব্যাঘ্রতটীমন্ডলের অনতর্গত মাথরন্ডিয়ার একটি জমি দান করা। এও কথিত আছে এই জমি দান করেছিলেন স্বয়ং লক্ষ্মণ সেন, রঘুদেবশর্মণ নামে এক ব্রাহ্মণ ব্যাক্তিকে।  এরকম আরও কিছু তথ্যের ভিত্তিতে দেবগ্রামকে, লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী বিজয়পুর হিসাবে গণ্য করার পক্ষে সাওয়াল করেছেন ঐতিহাসিকগণ। 


এই দেবগ্রামেই অবস্থিত দেবল রাজার গড়। যে স্থান প্রায় মনুষ্যশূণ্য অবস্থায় বিরাজ করলেও, গড়ের একটি অংশে প্রায় ভগ্নদশায় অবস্থান করছে একটি জরাজীর্ণ বাড়ি। যে বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্ব পরম্পরাক্রমে করে আসছে বয়ঃপ্রাপ্ত একজন বৃদ্ধ। একমাত্র জীবিত বংশধরের প্রতীক্ষায় আজও অপেক্ষিত এই বাড়ি। আর অপেক্ষিত...

*** 

শিয়ালদহ জংশন থেকে রানাঘাট লোকাল ট্রেনটায় চড়ে বসল সৌপ্তিক। স্টেশন থেকে কিছু শুকনো খাবারের প্যাকেট সহ একটি পানীয় জলের বোতল কিনে নিল সমগ্র যাত্রার সঙ্গীস্বরূপ। কব্জিতে আটকে থাকা ঘড়ির দিকে প্রতিমুহূর্তে চোখ রেখে চলল। প্রতিটাক্ষণ তার কাছে ভীষণ মূল্যবান হয়ে উঠেছে। অপেক্ষায় থাকা সৌপ্তিকের কাছে সময়ের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকা প্রায় দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে এক্ষণে। ট্রেন ছাড়ার বাঁশি শুনে একটু নড়েচড়ে বসল, বাদামি রঙা কাঠের চেয়ারের ওপর। ট্রেনের লোহার চাকতি গড়িয়ে চলেছে, লৌহপাতের উপর। প্ল্যাটফর্মের অংশের সঙ্গে নিজের দূরত্ব প্রতিস্থাপনের কর্মে লিপ্ত হয়েছে লোহার কামরাগুলো। প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই সুমিষ্ট একটা বাতাসের পাখনা ঝাপটা মেরে দিয়ে গেল সৌপ্তিকের মুখমন্ডল জুড়ে। সেই সুগন্ধি বাতাসের সঙ্গে এমন কিছু মিশ্রিত ছিল, যা অন্তরাত্মা কম্পিত করে তুলল সৌপ্তিকের। অতিপরিচিত সুগন্ধির ঘ্রাণ, তার মনকে কিছুটা উদ্বেলিত করে দিয়ে গেল। 


স্টেশন থেকে কেনা খাবার, সৌপ্তিকের আঙ্গুলের স্পর্শ পায়নি সারাটা রাস্তায়। জলের বোতল থেকে কয়েকটি বিন্দু জলের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, নিজের শুষ্ক কন্ঠনালীতে রসের উৎকর্ষতার কারণে।


 শিয়ালদহ থেকে ট্রেন যখন রানাঘাট পৌঁছাল তখন প্রায় মধ্যদুপুর। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের সিমেন্টের চেয়ারে বসে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করল সৌপ্তিক। একটু স্থিতাবস্থা হতেই স্টেশন থেকে বেরিয়ে, তার গ্রাম দেবগ্রামে যাওয়ার জন্য একটি যানের অনুসন্ধান করতেই মিলে গেল তিন পা'ওয়ালা যানের। 


ট্রেনের পুরো পথে তার মধ্যে একবারও ক্ষুধাবৃত্তির লক্ষণ পরিস্ফুট হয়নি। কংক্রিটের শহর ছেড়ে যত না গ্রামের দিকে এগিয়েছে, সুণির্মল বাতাসে তার প্রাণবায়ু পুনরায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সবকিছু নির্নেমেষে স্মৃতিপট থেকে উধাও হয়ে গিয়ে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে প্রকৃতির সবুজের আভা। প্রাণভরে শ্বাসবায়ু টেনে নিল হৃৎপিণ্ডের অলিন্দে। 


রানাঘাট স্টেশন থেকে তার গ্রামের দূরত্ব বেশ অনেকটাই। হাতের ঘড়ির দিকে আরও একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল সৌপ্তিক। 

*** 

সৌপ্তিককে দেখে যারপরনাই অবাকই হলেন, বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষটি। মানুষটির সমুখে এগিয়ে গিয়ে এক আকাশ হাসি উপহার দিয়ে সৌপ্তিক জানাল তার মধ্যপ্রদেশের অবস্থা। ভীষণভাবে ব্যস্ত হয়ে মানুষটি চলে গেলেন বাড়ির অভ্যন্তরে। সেখানে গিয়ে কিছু নির্দেশ দিয়ে পুনরায় ফিরে এলেন নিজের জায়গায়। ফেরত আসার সময় সঙ্গী হিসাবে নিয়ে এলেন একগুচ্ছ চাবির রাশি। তাঁকে অনুসরণ করে সৌপ্তিক এগিয়ে চলল। 


চাবিরগুচ্ছ থেকে একটা চাবি আলাদা করে, মরচে পড়া তালাকে খোলার ভীষণ চেষ্টা করার আগেই খট্ আওয়াজ তুলে উন্মুক্ত করল নিজেকে। সেই সঙ্গে ক্যাঁচ্ শব্দের সঙ্গে উন্মুক্ত হল অতি পুরাতন কাঠের দরজার পাল্লা। 


কয়েকটি ঘর মাঝেমধ্যে পরিষ্কার করার কারণে, সৌপ্তিকের জন্য বরাদ্দ ঘরটিতে বিশেষ আবর্জনার ছাপ পরিলক্ষিত হলনা। বয়স্ক মানুষটি প্রস্থান করলে, ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিল মস্ত পালঙ্কের উপর।

______________________________________________________ 


                                                                    (৩)


পরপর কফির খালি কাপগুলো সাজিয়ে রাখা আছে কাচের টেবিলের ওপর।  মস্ত টেবিলের একপাশে ছড়িয়ে রাখা আছে কাগজের টুকরোর দল। একটার পর একটা ফাইল উল্টেপাল্টে প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছে কেসের সমস্ত বিবরণকে। প্রতিটা মৃত্যুর নমুনা একদম একই রকমের। কিন্তু ভীষণ চালাকির সঙ্গে মুছে ফেলা হয়েছে প্রমাণ পাওয়ার রাস্তাগুলো। প্রতিটা কেসের বিবরণী পড়ার পর নিজের মনেই মস্তিষ্কের আন্দোলিত করে, অদৃশ্য কারোর উদ্দেশ্যে কিছু শব্দের অঞ্জলি অর্পিত হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। কখনো আবার শিরা উপশিরাগুলো ফুলে গিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে শরীর থেকে। মুষ্টিবদ্ধ হাতের সঞ্চালন ঘটছে অবিরত ভাবে। 


-" শালা বাস্টার্ড!"

প্রচন্ড ক্রুদ্ধস্বরে শব্দটা উচ্চারণ করলেন অ্যান্টি ক্রাইম ব্যুরো অফিসার সীতেজ সমাদ্দার। 

*** 


শহরের বুকে শলাকারূপ যে মৃত্যুবাণ রচিত হয়ে চলেছে কয়েকবছর যাবত, সে সম্পর্কে অফিসের বড়কর্তারা অবগত হলেও প্রমাণাভাবে হত্যাকারীর কেশাগ্রও ছুঁতে পারেনি। শেষঅবধি তলব করা হয়েছে,  কর্মঠ অফিসার সীতেজ সমাদ্দারকে। হত্যাকারীর মনস্তাত্ত্বিক দিকের ব্যাপার কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও...


কঠিন মুষ্টিবদ্ধ হাত কংক্রিটের দেওয়ালকে ভেঙ্গে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করল মাত্র। প্রতিটা ঘটনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়  পদক্ষেপ  নেওয়ার পরেও কোথাও যেন একটা গভীর শূণ্যতা প্রকাশ পাচ্ছে। 

*** 


                                                                   (৪)

গঙ্গার চরে বসে ফুরফুরে মুক্ত বাতাসে নিজেকে বেশ চাঙ্গা লাগছিল সৌপ্তিকের। শরীর চাঙ্গা হলেও মনের মধ্যে তীব্র চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। দেবলগড়ে নিজের বাড়িতে আসা ইস্তক দেবীর উগ্র মূর্তির সঙ্গে একবারও সাক্ষাৎ হয়নি তার। দেবীর হঠাৎ পরিবর্তনে মনের মধ্যে কেমন একটা প্রশ্নচিহ্ন অঙ্কিত হয়েছে। দেবী তাহলে...


 আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে গ্রাস করেছে একতাল চিন্তারা। মূল কারণকে বাদ দিয়ে অপর যে কারণ তার মনের চাঞ্চল্য ঘটিয়েছে তা হল একজন অপরূপা নারী। গড়ের অভ্যন্তরে সেই নারীকে বহুবার প্রত্যক্ষ করেও নিকটে গিয়ে বাক্যালাপের সৌভাগ্য প্রদর্শিত হয়নি এখনও। গড়ে আসা ইস্তক কিছুদিন সমস্ত চিন্তাদের ছুটি দিয়ে নিজেকে পুনরায় তৈরির কারিগরি কাজে নিজেকে লিপ্ত রেখেছিল। কিন্তু সেই পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অজানা নারীটি। নারীটির অজান্তেই ধূর্ত শৃগালের লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে শুষে নিয়েছে যুবতী নারীশরীরের সমস্ত রস। প্রতিটা কামাতুর রাতে কামনা করেছে সেই নারীকে। দৃষ্ট  নারীর, সুতোবিহীন শরীরের লালিত্য কল্পনা করে পালঙ্কের ওপর পেতে রাখা শুভ্র চাদরকে সিক্ত করেছে বীর্যপাতের রস।  কল্পলোকে থেকে নরম নারীশরীরকে মর্দিত করেছে অগুনতি বার। বহির্গত  উষ্ণ প্রশ্বাসবায়ুর রাশি বিষাক্ত করে তুলেছে প্রতিটা মায়াবী রজনীকে।



প্রতি রাতের নিদারুণ পীড়া থেকে নিজেকে মুক্তি দিতেই গঙ্গার পাড়ে বসে, মনেমনে চেয়েছে মানসিক প্রশান্তি। এই পীড়া তার কাছে একেবারেই নব্য, একেবারেই ভিন্নধর্মী। নতুন নারীশরীরের মাংসল ঘ্রাণ তার জিহ্বাকে লোভাতুর করে তুলেছে এই ক'দিনেই। বংশের অশুদ্ধ লোহিত কণিকায় বাসা বেঁধে থাকা নারকীয় কীটগুলো পুনরায় জাগ্রত হচ্ছে, সৌপ্তিকের অজান্তেই। 


নারীটির কথা মনে পড়তেই, গঙ্গাপাড়ের মিঠে হাওয়াতেও নিজেকে আরও একবার উষ্ণ করে তুলল সৌপ্তিক। কিছুটা সময় ধার নিয়ে মনের মধ্যে সাজিয়ে নিল দাবার বোড়। তারপর অত্যন্ত ক্ষিপ্রপদে রওনা দিল দেবলগড়ের দিকে। সৌপ্তিকের মুখমন্ডলে ফুটে ওঠা কঠিন চোয়ালকে, কাঠিন্য যেন আরও গ্রাস করল।

**** 

পূর্ণিমা তিথির অবসানে আকাশ ঘিরে জমাট বেঁধেছে কালচে মেঘের পিন্ড। অমাবস্যা তিথির আগমনের এখনো কিছুটা সময় রয়েছে। কিন্তু সে সময়কে উপেক্ষা করে, চন্দ্রিমার শুভ্র পেলব মুখমন্ডলকে গ্রাস করেছে কয়লা কালো আঁধার। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার  অবিরত ডাকের সঙ্গে রাতচরা পাখিদের অবিরাম কু-ডাকে পরিবেশ যেন ভারী হয়ে উঠেছে। 


সৌপ্তিক, নিজের ঘরে অপেক্ষায় ছিল। একটা বড় মোমের আলো বৃহত্তর ঘরেকে উজ্জ্বলতা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে অবিরত। নিজের মধ্যেকার উত্তেজনা অপ্রকাশে ব্যর্থ হয়ে ঘরময় পায়চারি করে চলেছে সৌপ্তিক। দালানের বড় ঘড়ির ঘন্টা, ঠিক বারো বার বেজে উঠে জানান দিল তার আগমনের বার্তা। 


ঘড়ির ঘন্টার আওয়াজ থেমে গিয়ে, সেই জায়গায় উদয় হল নিক্বণের মধুর ধ্বনি। সেই ধ্বনি সৌপ্তিকের কর্ণপটহে আছড়ে পড়তেই, একটা লাভা স্রোত খেলে গেল মেরুদন্ড জুড়ে। কাঠের বড় দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল সে।


নুপুরের আওয়াজটা ক্রমাগত এগিয়ে আসছে, সৌপ্তিকের ঘরের দিকে। কথামতো দরজার ওপর টোকা পড়ার আগেই, সৌপ্তিক উন্মুক্ত করে দিল ঘরের দরজা। নারীর হাতে থাকা নীলচে আলোর বিচ্ছুরণে, সৌপ্তিকের চোখে ধাঁধিয়ে গেল। নিজেকে দরজার সমুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে, রমণীয় নারীকে ঘরের মধ্যে আসার  আহ্বান জানাল। 

*** 

ফিনফিনে শিফন শাড়ির ভাঁজে ফুটে উঠেছে শরীরের ভাঁজ। তাকে উপেক্ষা করা সৌপ্তিকের পক্ষে বেশ যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠল। মোমের আলো নিভে গিয়ে সেই জায়গায় নীল আলোর উপস্থিতিতে, উপস্থিত নারীমূর্তির রূপের ছটা, ভীষণভাবে কামাতুর করে তুলল সৌপ্তিককে। সৌপ্তিক অনুভব করল, পুরুষাঙ্গের নরম মাংসল পিন্ড ধীরগতিতে তার রূপ পরিবর্তন করছে। এর আগে বহু নারীসঙ্গমে অভিজ্ঞ সৌপ্তিক, সমুখে উপস্থিত নারীর নিকটে অনভিজ্ঞ হয়ে পড়েছে সাময়িক। অদৃশ্য রজ্জু দ্বারা কেউ তাকে আবদ্ধ করে রেখেছে যেন। 


সৌপ্তিকের অসহায় অবস্থা দেখা ইস্তক, একটি কৃত্রিম হাসি ছুঁড়ে দিল নারীটি। বাহুদ্বয় প্রসারিত করে হাতছানি দিল, অনাকাঙ্খিত বিপদের। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পালঙ্কের ওপর আছড়ে ফেলল সৌপ্তিকের পুরুষালি শরীরকে। উভয়ের শরীর থেকে উন্মুক্ত করল, শেষ বসনটুকু। একঝটকায় সৌপ্তিকের দেহের উপর চড়ে বসল নারীটি। আপন যোনিতে প্রবেশ করাল বর্মা বংশধরের অঙ্গকে। কামনার বাণবিদ্ধ নারীশরীরের প্রবল উন্মত্তায় একপ্রকার হাঁফিয়ে উঠল সৌপ্তিক।  নারীশরীরের কামোন্মত্ততায় দেহের মধ্যে প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভূত হল তার। এই যন্ত্রণা তার নিকট একেবারেই নতুন। প্রচন্ড সুখানুভূতির পরিবর্তে, নারীদেহের নাগপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করল সে।  কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সৌপ্তিকের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নির্লিপ্তপ্রায়। নারীদেহের নিষ্ঠুরতা ক্রমশ গ্রাস করছে তাকে। সর্পিল হাতের নখের দাগে ছিন্নভিন্ন হয়ে চলেছে সৌপ্তিকের শরীরের বিভিন্ন অংশ। চলমান নারীদেহের যোনিপথ ধরে আঘাতপ্রাপ্ত হতে থাকল সৌপ্তিকের নিম্নাঙ্গ। বীভৎসভাবে কঁকিয়ে উঠল সৌপ্তিক। 


ঘরের মধ্যেকার নীলচে আলোর রূপ পরিবর্তনের সঙ্গে নারীদেহের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন অনুভব করল সৌপ্তিক। এইরূপ তার ভীষণ চেনা। সেই আলোতেই ফুটে উঠল পরিচিত কিছু নারীদের অবয়ব। যা একদিন...

 

অতিপরিচিত লালচে তরলের গ্লাসটা এগিয়ে এল সৌপ্তিকের দিকে। মাথা নেড়ে অনুনয় জানালেও সেই তরল জোরপূর্বক গলাধঃকরণ করানো হল তাকে। কিছুটা চুমুক দেওয়ার পরই ক্লান্ত শরীরকে জড়িয়ে ধরল অপার্থিব  হাত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সমবেতভাবে উচ্চারিত হল হর্ষধ্বনি। 


 _____________________________________________________________________ 


                                                                (৫) 



                        "কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভব:।

                         মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্।।"


রজোগুণ থেকে সমুদ্ভত কামই মানুষকে পাপে প্রবৃত্ত করে এবং কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী এবং পাপাত্মক। 


ঠিক এই করণেই বর্মা বংশের বংশমর্যদা আজ ধূলায় লুন্ঠিত হয়েছে। বহুযুগ আগে থেকেই এই পাপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল বর্মা বংশ। পূর্বপুরুষকে অনুসরণ করে, বর্মা বংশের শেষ বংশধর...


এতবছর ধরে ঘটে চলা পাপকার্য থেকে, অদৃশ্য কোনো হাত সৌপ্তিককে বাঁচিয়ে রেখেছিল তাকে উপযুক্ত শাস্তি দানের হেতু। তার ললাট লেখনী তাকে টেনে এনেছিল দেবল গড়ের মাটিতে। ইতিহাস সাক্ষী আছে, প্রতিটা কুকর্মের উপযুক্ত শাস্তি অনিবার্য। দেবল গড় থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেও, বংশের একমাত্র কুলতিলক পূর্বপুরুষের বিষাক্ত রক্তের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারেনি। তার পূর্বপুরুষ যে পথ অনুসরণ করে ভূলন্ঠিত হয়েছিল, কালিমালিপ্ত করেছিল বর্মা বংশের বংশমর্যদায়.... আজ বোধহয় সেই পাপকর্মের অবসান ঘটল। 

*** 


পদ্মাসনে উপবিষ্টা দেবীমূর্তির মুখমন্ডল জুড়ে বিরাজ করছে পরম প্রশান্তি। দেবী মন্দিরের বদ্ধ দরজা আজ উন্মুক্ত হয়েছে। ধূপ ধূনার সুঘ্রাণে পরিপূর্ণতা পেয়েছে নির্মল বাতাস। প্রজ্বলিত প্রদীপের শিখার সামনে ভেসে উঠল একটি বার্ধক্যপূর্ণ শরীরাবয়ব। করজোড়ে স্থানুবত বসে আছে দেবীর সমুখে। আঁখিযুগলে টলটল করছে জলের রাশি। সেই জলরাশি এখুনি গড়িয়ে পড়ে দেবীর চরণ বিধৌত করবে বোধহয়। পুনরায় প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হবে মাতৃকোটরে। ধীরে ধীরে মস্তক নত করলেন বৃদ্ধ। এত বছরের জমিয়ে রাখা কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইল কন্ঠনালী ভেদ করে। 

*** 


অ্যান্টি ক্রাইম ব্যুরো অফিসার সীতেজ সমাদ্দারের কর্মঠ তকমা একেবারেই মুছে যায়নি। অকাতর পরিশ্রমের পর হত্যাকারীর সন্ধান পেয়ে যখন দেবল গ্রামে এসে পৌঁছলেন তখন সলিল সমাধি পেয়েছে সে। 


ছিন্নভিন্ন শয্যার ওপর এলিয়ে রয়েছে একটি বিধ্বস্ত পুরুষশরীর। যার শরীর জুড়ে বিরাজমান চাপ চাপ রক্তের দাগ। ওষ্ঠাধারের কোণ বেয়ে ফুটে উঠছে ফুটন্ত দুধের মতো ফেনিল ভাব। শরীরের নিম্নাঙ্গে নজর পড়তেই...

*** 

বর্মা বংশের সর্বশেষ বংশধর, সৌপ্তিক বর্মার মৃত্যুরহস্য আজও রয়ে গেছে কালের অতল গহ্বরে। ধূলি ধূসরিত ছবির জায়গায় জায়গা করে নিল, বংশধরের শেষ ছবি।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু