বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

গল্প শব্দ সঞ্চয়ণ -প্রথম খন্ড।

 

 

 

 

 

 

 

 

( প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা :- ১২ )

         ১৫ টি গল্পের একক রচনা সমগ্র গ্রন্থ। 

           গল্প শব্দ সঞ্চয়ন- প্রথম খন্ড।

                             

         গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

              বাঙালি লেখক সংসদ পরিচালিত।

                       

         ।। উৎসর্গ ।।

 

◆ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

মৃত্যু :- ৭ আগস্ট ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে।

 

◆ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

মৃত্যু :- ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে।

 

◆ মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক।

মৃত্যু :- ১ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে।

◆ সিকদার আবু জাফর।

মৃত্যু :- ৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে।

◆ মাহবুবুল আলম।

মৃত্যু :- ৭ আগস্ট ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে।

◆ সৈয়দ মুজতবা আলী।

মৃত্যু :- ৮ আগস্ট ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে।

◆ হুমায়ুন আজাদ।

মৃত্যু :- ১২ আগস্ট ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে।

◆ গিরিশ চন্দ্র সেন (কুরআন অনুবাদক)

মৃত্যু :- ১৫ আগস্ট ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে।

◆ শামসুর রাহমান।

মৃত্যু :- ১৭ আগস্ট ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে।

◆ মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ।

মৃত্যু :- ১৮ আগস্ট ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে।

◆ আবু জাফর শামসুদ্দীন।

মৃত্যু :- ২৪ আগস্ট ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ।

◆ অতুল প্রসাদ সেন।

মৃত্যু :- ২৬ আগস্ট ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে।

◆ বিমল কর।

মৃত্যু :- ২৬ আগস্ট ২০০০ খ্রিস্টাব্দে।

◆ শিবরাম চক্রবর্তী।

মৃত্যু :- ২৮ আগস্ট ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে।

 

প্রথম প্রকাশ :- ২৯ আগস্ট ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭ তম বছরের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে।

 

বইয়ের নাম :- গল্প শব্দ সঞ্চয়ন- প্রথম খন্ড।

লেখকের নাম :- শংকর হালদার শৈলবালা। যোগাযোগ :- 91 8926200021

 

শ্রেণী : সামাজিক, ইতিহাস, রাজনৈতিক, উন্নয়ন, কুসংস্কার ও গবেষণা মূলক গল্প।

বিষয় :- বিভিন্ন ধরনের ১৫টি গল্প নিয়ে গল্প সংকলন।

   

◆ প্রকাশনায় :- টিউলিপ প্রকাশনী।

ঠিকানা :- ওয়ার্ড-২, সিউড়ি সমন্বয় পল্লী, বীরভূম, ৭৩১১০২, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

মোবাইল :- 91 96744 47849

 

◆ মুদ্রণে :- লোশন প্রেস।

No 50 chettiyar Agaram MAin Road,vanagaram, chennal, Tamilndu, 600095

 

◆ প্রচ্ছদ শিল্পী :- শান্তনু দাস। 

◆ মোবাইল :- 91 96744 47849

 

◆ গ্রন্থ ও রচনার স্বত্ব :- শংকর হালদার ।

 

© লেখক ও লেখিকা দ্বারা সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত। এই প্রকাশনার কোন অংশ পুনরুৎপাদন, সংরক্ষণ, একটি পুনরুদ্ধারের পদ্ধতির মাধ্যমে বা কোন আকারে অথবা বৈদ্যুতিক, যান্ত্রিক, ফটোকপি আবার অন্যভাবে প্রেরণ করা যাবে না। কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ।

 

             ভূমিকা 

 

শংকর হালদার শৈলবালা রচিত ১৫ টি গল্প নিয়ে একক গল্প সংকলন "গল্প শব্দ সঞ্চয়ন"- প্রথম খন্ড। সামাজিক অবক্ষয়ের গল্প সহ বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ইতিহাসমূলক ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় দেখতে পেলাম। যা সমাজের কল্যাণ মূলক গল্পগুলো বলা চলে।

 

এক সময় ছাত্রদের উপর শিক্ষকগণ শাসনের নাম করে ভীষণ ভাবে মারপিট করে অত্যাচার করতেন "প্রতিবাদী ছাত্র" নামক গল্পের মাধ্যমে লেখক তার ছাত্র জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার কাহিনী তুলে ধরেছেন। 

 

 বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ভ্রমণ করতে গিয়ে লেখকের জীবনের প্রথম ভালোবাসার ছোট গল্প "বসন্তের লাল ওড়না" 

প্রকৃতির বর্ণনা গল্পের মাধ্যমে জানা যায়।

 

লেখক তীর্থ ভ্রমণ কালীন সময়ে শ্রী শ্রী বৃন্দাবন ৮৪ ক্রোশ পরিক্রমা মার্গের উমরালা মণি কুন্ড আশ্রম অবস্থান কালীন সময়ে একজন বাঙালি বৈষ্ণব বাবাজীর আত্মচরিত রচনা করেন। 

 

"নিম্ন বর্ণের উপর অত্যাচার" নামক আত্মচরিত গল্পের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে  

"নিম্ন বর্ণের উপর অত্যাচারের নিগূঢ় তথ্য গুলো তুলে ধরেছেন। শোনা যায় লেখকের সাথেও জাত পাতের বিষয়ে অনেক সময় বহু ঝামেলা হয়েছে। তিনি ভ্রমণ কালে ব্রাহ্মনের নয় গুণ পৈতা ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

 

"ধর্মের নামে জাতপাতের লড়াই।" নামক গল্পের মাধ্যমে সমাজের নিম্ন বর্ণের মানুষের উপর হওয়া অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরেছেন।

 

 পিছিয়ে থাকা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও কর্মসংস্থান দেওয়ার গাফিলতির কারণে লেখক তার "বিদ্রোহী আদিবাসী কিশোরী" গল্পের মাধ্যমে শাসকদলের বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

 

বিখ্যাত লেখক শেক্সপিয়ার বলেছেন, নিজের প্রচার কিন্তু নিজেকেই করতে হয়।

 

শংকর হালদার শৈলবালার একক গল্প সংকলন প্রকাশ করার উদ্যোগে স্বাগত জানাই। তার সার্বিক মঙ্গল কামনা করি।

 

                                                  ডাক্তার অনিরুদ্ধ পাল।

                                                              কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ।

 

 

 

                     ।। গল্পের সূচিপত্র ।।

 

◆ (০১) বসন্তের লাল ওড়না । 

( বসন্ত উৎসবে রঙের খেলায় ভালোবাসার ছোঁয়া ছোট গল্প।

◆ (০২) স্বামীর খুনি লীলাবতী। 

( সামাজিক অবক্ষয়ের বাস্তব শিক্ষামূলক ছোট গল্প)

 

◆ (০৩) বিদ্রোহী আদিবাসী কিশোরী।

 (সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রবন্ধ যুক্ত বড় গল্প। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস গবেষণা মূলক ও উন্নয়ন মূলক। বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার গাফিলতির আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এক কিশোর প্রতিবাদী কন্ঠের কাহিনী। )

 

◆ (০৪) ধর্মের নামে জাতপাতের লড়াই।

 (সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারের লড়াইয়ের ছোট গল্প।)

 

◆ (০৫) দারিদ্র্যের স্বপ্নভঙ্গ।

 ( বিপর্যয় করোনা ভাইরাসের অনুগল্প)

 

◆ (০৬) শ্মশান যাত্রা-মৃত্যুর মিছিল। 

(মদ্যপানের পরিণতি ভয়ংকর শিক্ষামূলক বাস্তব ছোট গল্প।) 

 

◆ (০৭) খেলা মারাত্মক নেশা।

 ( লুডু খেলার নেশাগ্রস্ত ভয়ানক পরিণতি। শিক্ষামূলক বাস্তব ছোট গল্প।

 

◆ (০৮) ফোনের নেশায় সন্তান বিক্রি। 

( উচ্চ আকাঙ্ক্ষা বিপর্যয়ের শিক্ষামূলক বাস্তব অনুগল্প)

 

◆ (০৯) প্রতিবাদী ছাত্র।

 ( ছাত্রদের উপর শিক্ষকগণ শাসনের নাম করে ভীষণ ভাবে মারপিট করা অত্যাচারের বাস্তব প্রতিবাদী কাহিনী। সামাজিক ও ঐতিহাসিক বড় গল্প।

 

◆ (১০) ছেলের হাতে বাবা খুন। 

( সামাজিক অবক্ষয় ও শিক্ষামূলক বাস্তব অনুগল্প। )

 

◆ (১১) বৌমার অত্যাচার শাশুড়ির।

 (সামাজিক অবক্ষয় শিক্ষামূলক বাস্তব অনুগল্প।)

 

◆ (১২) নিম্ন বর্ণের উপর অত্যাচার।

 ( জাতপাতের অত্যাচারের এক বৈষ্ণব বাবাজির আত্মচরিত বাস্তব ছোট গল্প।)

 

◆ (১৩) ট্রেনের অযাচিত প্রেম। 

( ভ্রমণ কালীন ভালোবাসার এক ছোট গল্প)

 

◆ (১৪) পরের বউ অতি সুন্দর।

 ( সামাজিক শিক্ষামূলক অনুগল্প। পরকিয়া প্রেমের কাহিনী)

 

◆ (১৫) বন্দিদশায় বালক। 

( সামাজিক শিক্ষামূলক অনুগল্প। নোটবন্দি সমস্যায় বিপদগ্রস্ত বালকের কাহিনী।)

 

            ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

                                                          গল্প নাম্বার :- ১

 

        বসন্তের লাল ওড়না। 

             লেখক :- শংকর হালদার শৈলবালা ।

 

{ শান্তিনিকেতনে ভ্রমণ কালীন বাংলা সাহিত্যের লেখক শংকর হালদার শৈলবালার প্রথম রচিত ছোট গল্প। 

                                 সম্পাদক শান্তনু দাস।}

 

রচনার শ্রেণী :- সামাজিক। বসন্ত উৎসবে রঙের খেলায় ভালোবাসার ছোঁয়া ছোট গল্প।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ প্রকৃতির নিয়মে শীতের শেষে ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে বসন্তের আগমন ঘটে। চারিদিকে হালকা বাতাস বয়ে চলে গাছে গাছে ফুল ফুটে ওঠে। 

 

◆ গোলক বৃন্দাবন, বৈকুণ্ঠ লোক, ব্রহ্ম লোক, স্বর্গলোক, দেবলোক, ও পাতাল লোক সহ ইত্যাদি ইত্যাদি লোকের বাসিন্দা সহ মর্ত্যলোকের মানুষেরা রঙের উৎসবে মেতে ওঠে। রং মেখে ও অন্যকে রং মাখিয়ে রঙিন মনকে আরো রঙিন করে তোলে।

 

◆ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিময় জায়গা শান্তির নিকেতনে প্রতি বছর রাঢ় বঙ্গে বসন্ত উৎসব পালিত হয়। প্রকৃতির লীলা খেলায় বসন্তের আগমনে মেতে উঠে নর-নারী, শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই মেতেছে আনন্দ উল্লাসে দোল উৎসবের রঙে।

 

◆ গৌড়বঙ্গ নবদ্বীপ ও মায়াপুর শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্ম তিথি উপলক্ষে বৈষ্ণব ধর্মীয় মতো দোল ও হোলি উৎসব পালিত হয়ে থাকে।

 

◆ বাসন্তী মজুমদার দক্ষিণ বঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বনভূমি থেকে বসন্তের আনন্দ উপভোগ করতে শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হয়। 

 

◆ মাথার উপর খোলা আকাশ চারপাশে বনভূমি, বসন্তের আগমনে মৃদু মৃদু বাতাসে বনভূমির ঘাসের উপর বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করা সহ কবি ও সাহিত্যিকদের আগমনে সাহিত্যের চর্চা।

 

◆ নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ পাখিদের কোলাহল ছাড়া আর কিছু নেই, চারিদিকে বিভিন্ন লতাপাতা ও গাছ-পালায় সম্মোহিত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। বিভিন্ন বনফুলের গন্ধে মনের মাঝে প্রকৃতির ভালোবাসার নতুন ছোঁয়া লাগে।

 

◆ বনের মাঝে বিভিন্ন ধরনের পাখির কিচিরমিচির শব্দের মাঝে কোকিল জানায়, কুহু কুহু সুরে প্রকৃতির অন্তরে বসন্ত আসিল, রৌদ্রের তাপে চোখ গেলো, প্রিয়জনের সাথে কথা কথা কও ও বউ কথা কও সহ বিভিন্ন ধরনের সুরের মাধ্যমে জানতে থাকে।

 

◆ বনের মাঝে ঘুরতে ঘুরতে বুনো ফুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে ভেসে আসে আর বনের মধ্যে দিয়ে কোপায় ও খেয়াই নদীর ধারা বসন্তের আগমনে আনন্দে ছল ছল শব্দ করে বয়ে চলেছে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানব জাতি কে তার বুকে জলকেলির মাধ্যমে আলিঙ্গনের আহ্বান জানায়। 

 

◆ নদী তার শব্দের তরঙ্গের মাধ্যমে জানায়, বসন্তের রঙের আবির মেখে আমার বুকে এসো আর লীলার ছল করে জলকেলির মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করে। মনের যত ময়লা মাটি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেবো।

 

◆ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য মন্ডিত শান্তিনিকেতন বনভূমির মাঝে বসন্তের উৎসবের আয়োজন। দূরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে মাইকের আওয়াজ ভেসে আসছে, হোলির সেই বিখ্যাত গান বসন্ত এসেছে রং দেব না তা কি কখনো হয়?

 

◆ সকল বয়সের নারী পুরুষ মিলিত হয়ে, রঙিন মনে প্রকৃতি সাজো সাজো রবে বিভিন্ন রঙের খেলায় মেতে উঠেছে। চারদিকে ফুলে ফলে ভরে উঠেছে প্রকৃতির এক অপরূপ সুন্দর্য।

 

◆ চেনা ও অচেনা সকল কিশোর-কিশোরী যুবক-যুবতী ও বয়স্ক ব্যক্তিরাও প্রকৃতির লীলাময় বনের মাঝে বসন্তের উৎসবের আমেজে মেতে উঠেছে। কবি-সাহিত্যিক তাদের কাব্য চর্চা ও সাহিত্য নিয়ে ব্যস্ত।

 

◆ বাসন্তী হাতে রঙ নিয়ে একজন অচেনা যুবকের গালে রং মাখিয়ে দিয়ে বলে :- বন্ধু; বসন্তের আগমনের কারণে সবার মনে রঙের ছোঁয়া লেগেছে কিন্তু আজ তোমাকে কে রং দেবোনা তা কি কখনো হয়?

 

◆ প্রকৃতির মনে রং লেগেছে শুধু তোমার-আমার নয়, চারিদিকে গাছে গাছে ফুটে উঠেছে নতুন ফল ও ফুলে আর কচি কচি পাতা।

 

◆ অচেনা যুবক বাসন্তির মুখে ও মাথায় রং মাখিয়ে দিতে থাকে। আর সেই মুহূর্তে

হাওয়ার মনে লেগে দোল, বাসন্তীর গায়ের ওড়না কে উড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। ওড়না হাওয়া কে জড়িয়ে ধরে, আপন মনে উড়তে থাকে।

 

◆ বাসন্তী বলে :- হে হাওয়া ওড়না নিয়ে যাচ্ছে কোথায়! বুকের লজ্জা নিবারণ করবে কেমন করে?

 

◆ ওড়না দাও-ওড়না দাও বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে শুরু করে।

 

◆ হাওয়ার ইচ্ছা অনুসারে উড়ন্ত ওড়না আপন গতিতে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবে, ওড়না কে কেন্দ্র করেই বসন্ত আগমনে হোক দুটি হৃদয়ের মিলন। 

 

◆ ওড়না হাওয়ায় উড়তে উড়তে বসন্ত নামক এক যুবককে দেখতে পেয়ে আনন্দিত হয়ে নড়েচড়ে খেলা করতে শুরু করে। ওড়না হাওয়ার গতিতে বসন্তের মাথা উপর পাক খেতে খেতে চোখ মুখ ঢেকে দেয়।

 

◆ যুবক বসন্ত আনন্দিত মনে ভাবে :- বসন্তের আগমনের উৎসবে প্রকৃতির লীলা খেলায় হাওয়াই উড়ে এসেছে কোন সুন্দরী রমণীর অসাধারণ ওড়না খানা।

 

◆ কোন যুবতী মনে বসন্তের রঙের দোল লেগেছে আর ভালোবাসার ছোঁয়ার ওড়না উড়িয়ে দিয়েছে। তার স্পর্শে আমার মনে লেগেছে দোল কিন্তু সেই যুবতী কে বিশাল মনের মাঝে কোথায় পাব তারে।

 

◆ যুবতী বাসন্তী মুক্ত আকাশে মুক্ত পরিবেশে বন্ধন বন থেকে মুক্ত হয়ে মনের আনন্দে

রঙয়ের ছোঁয়া আর আবিরে আবিরে অপরূপা রঙয়ের সুন্দরী হয়ে উঠেছে।

 

◆ বাসন্তী ওড়নার পাওয়ার জন্য উপরে দিকে তাকিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। আনন্দের জোয়ারে চলতে চলতে অসাবধানতার কারণে অসমতল রাস্তায় গর্তের মধ্যে পা পড়ার কারণে ছিটকে গিয়ে চোখ মুখ ওড়না দিয়ে ঢাকা এক যুবকের সাথে ধাক্কা লাগে।

 

◆ হঠাৎ করে ধাক্কা লাগার জন্য যুবকের স্বপ্নের রাজকন্যার হারিয়ে যায়, আর চিৎকার করে উঠে বলে কে কে। দুজনের মুখোমুখি সংঘর্ষের মাধ্যমে প্রকৃতির ধরাতলে পড়ে যায়। বাসন্তী ভয়ে আতঙ্কে বসন্ত কে জড়িয়ে ধরে আর লাল মাটিতে গড়াগড়ি দিতে দিতে নিচের দিকে চলতে থাকে।

 

◆ গড়াতে গড়াতে চাষ দেওয়া জমির মধ্যে থেমে যায়। বাসন্তীর বুকের উপর বসন্ত নামের এক যুবকের দেহ। বাসন্তী চোখ মেলে তাকায় আর যুবক বলে, বসন্তের রঙের ছোঁয়ায় ভালোবাসা ও অন্তরঙ্গ।                     

 

                    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ রচনা কাল :- ২ মার্চ ২০১৮ সাল (১৭ ফাল্গুন ১৪২৪ বঙ্গাব্দ) হোলি ও বসন্ত উৎসব। শান্তিনিকেতন, বোলপুর, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ।

◆ সংশোধনের তারিখ :- ১ আগস্ট ২০২৩ সালে। আশ্রম খাটুরা-দোলন ঘাটা, মাঝদিয়া, নদীয়া।

 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

 

 

                      গল্প নাম্বার :- ২

 

স্বামীর খুনি লীলাবতী।

 

গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

(সামাজিক অবক্ষয়ের বাস্তব গল্প "স্বামীর খুনি লীলাবতী" নামক গল্পটি নীরব আলো শারদ সংখ্যা 2021 পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।)

 

রচনার শ্রেণী :- সামাজিক অবক্ষয়ের বাস্তব শিক্ষামূলক ছোট গল্প।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ বাইরে প্রচন্ড গরম প্রকৃতি যেন রুষ্ট। গাছের পাতা গুলো স্থির তীব্র অস্বস্তিকর পরিবেশ। ঠিক রাত আটটার সময় ঘরের মধ্যে এক পুরুষ কন্ঠের আর্তনাদ চিৎকার। তারপর তাকে বিছানায় ও ঘরের মেঝেতে রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। 

 

◆ এই দৃশ্য দেখে ঘরের মধ্যে থাকা আরেকজন পুরুষ ভয়ে আতঙ্কে পালানোর চেষ্টা করে। দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির সদর দরজার লোহার গেটের সামনে এসে দুই হাত দিয়ে গেটে সজোরে ধাক্কা দিতে শুরু করে।

 

◆ ভয়ে পিছনের দিকে তাকাতে তাকাতে চিৎকার করে বলে :- নরেশ দরজা খুলে দে, তোর বৌ মেরে ফেলবে। মদ পান করার সময় দশ হাজার টাকা দিয়ে ছিলাম, তোর বউয়ের সাথে দৈহিক সম্পর্ক করার জন্য কিন্তু ….. আর সে ইচ্ছা নেই। বন্ধু, গেট খুলে দে ….আমাকে বাঁচাতে দে। তোকে আরো অনেক টাকা দেবে । দয়া করে বাঁচা আমাকে ……..।

 

◆ লীলাবতী মা কালির মতো বিবস্ত্র হয়ে, খড়গ না পেয়ে কিন্তু সবজি কাটার বটি হাতে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে গেটের সামনে আসে আর গায়ের জোরে ঝারা কোপ মারে। সেই মুহূর্তে গেট খুলে যায় কিন্তু সাথে সাথেই আরেক বার কোনো পুরুষ কন্ঠ তীব্র আর্ত চিৎকার করে উঠে।

 

◆ লীলাবতী ঊর্ধ্ব নয়ন নিম্ন দিকে নামাতে তার স্বামীর খণ্ডিত দেহ দর্শন করে জল বিহীন চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। 

 

◆ ধর্ষিতা উলঙ্গ শরীরে স্বামীর নামক নর পশুর খন্ডিত দেহের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে লাথি মারতে মারতে বলে :- বিয়ে করা বউকে মদের টাকার জন্য বিক্রি করার প্রতিশোধ নিয়েছি। বন্ধুদের মাধ্যমে আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।   

 

◆ লীলাবতী তার স্বামীর খন্ডিত দেহের উপর বসে পড়ে আর পাগলের মতো দুই হাত দিয়ে স্বামীর রক্ত মাখতে মাখতে বিভিন্ন বিলাপ করতে থাকে। নরেশের বন্ধু এই দৃশ্য দেখে ভয়ে শিউরে উঠে আর পালানোর চেষ্টা করে।

 

◆ লীলাবতীর পাশে রাখা বোঁটি ছুড়ে মারে আর নরেশের বন্ধুর পায়ে লেগে আঘাত হয়ে চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যায়। মনের আনন্দে আত্মহারা হয়ে রক্তের হোলি খেলতে থাকে। 

 

◆ কিছু সময় পর লীলাবতী এক হাতে স্বামীর কাঁটা মুন্ডু ও অন্য হাতে বলি দেওয়া বটি নিয়ে রাস্তা দিয়ে নটবর শিবের মতো প্রলয়কারী নৃত্য করতে করতে চলতে শুরু করে।

 

 ◆ রাস্তার দুই পাশে সমস্ত লোকজন ভয়ে ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ভয়ঙ্কর রূপ দেখে কেউ লীলাবতীর পথ অবরোধ করে না। অজানা আশঙ্কা নিয়ে ভয়ার্ত চোখে সকলেই এক বিরল দৃশ্য দেখতে থাকে । তারই মাঝে চাপা স্বরে ভিড়ের মধ্যে থেকে নানান মন্তব্য ভেসে আসে। পথের আঁকে বাঁকে--- "বেশ্যা, কুলটা, দুশ্চরিত্র বাজে মেয়ে ---- ঘরে স্বামী থাকতে অন্য পুরুষের ঘরে নিয়ে আসে। 

 

 ◆ স্বামী হয়তো দেখে ফেলেছিল পরকীয়া প্রেমের লীলা, সেই কারণেই খুন করে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দিলো………। 

 

◆ অনেক মহিলারা কথাবার্তা বলতে বলতে লীলাবতীর বাবা-মাকে গালাগালি দিতে শুরু করে। মেয়েকে নিশ্চয় কোন শিক্ষাই দেয়নি, না হলে এমন কাজ কেউ করে করে। এ যেন কল্পনারও অতীত নিজের হাতে স্বামীর খুন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে লীলাবতীকে ধিক্কার জানায় ।

 

◆ বিশেষত মহিলারা ঝগড়া, কুকথা, অশান্তি বাধানোর ও গালিগালাজ করার বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী। নারীদের উপর শত অত্যাচারের ঘটনা কিন্তু নারীদের কারণে চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।

 

 ◆ লীলাবতী রাস্তার শত শত মানুষের ভিড় ঠেলে ও সকলের কটুক্তি উপেক্ষা করে সোজা থানায় গিয়ে উপস্থিত হয়।

 

 ◆ থানায় নিরাপত্তা রক্ষী পুলিশ এই দৃশ্য দেখে ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে দৌড়াতে দৌড়াতে থানার ভিতরে ঢুকে পড়ে।

 

◆ লীলাবতী থানার অফিস ঘরে ঢুকে বড় লম্বা টেবিলের উপর কাঁটা মুন্ডু ও বটিটা রাখে। রক্তে টেবিল ভেসে গিয়ে মেঝেতে গড়াতে থাকে। 

 

◆ তারপর কাঁদতে কাঁদতে দুই হাত উপরে তুলে পাশের দেওয়ালে সজোরে আঘাত করতে করতে নিজের হাতের শাঁখা পলা ভেঙে দিয়ে বলে - আমাকে গ্রেফতার করুন। আমি স্বামীকে খুন করে তার রক্তে হোলি উৎসব করেছি ও কাঁটা মুন্ডু দিয়ে ফুটবল খেলেছি।

 

◆ হঠাৎ এমন ভয়ানক পরিস্থিতির জন্য থানায় কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। সবাই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ভয়ে আতঙ্কিত, স্তম্ভিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। একে-অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, এখন কী করণীয়?  

 

◆ থানার ভারপ্রাপ্ত বয়স্ক অফিসার দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে লীলাবতীর কাছে এসে হাতজোড় করে বলেন, "মা, শান্ত হও। তোমার সব কথা শুনবো, অপরাধীর অবশ্যই সাজা পাবে।

 

◆ লীলাবতী তার শরীরের দিকে চোখ রাখতেই লজ্জা পেয়ে দুই হাত দিয়ে স্তনদয় চেপে ধরে ঘরের এক কোণায় মেঝেতে বসে পড়ে । 

 

◆ ভারপ্রাপ্ত অফিসার মহানন্দা মহাশয় একজন মহিলা পুলিশের নির্দেশ দেন- "তাড়াতাড়ি ঐ মেয়েটিকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে রক্তাক্ত শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে স্নান করান। তারপর কাপড় পরিয়ে আমার কাছে নিয়ে আসুন। কিন্তু সাবধান, ওনার সাথে উত্তেজিত ভাবে কথা বলবেন না।

 

◆ সেই মুহূর্তে নরেশের পাড়ার কয়েক জন প্রতিবেশী তাড়াহুড়ো করে থানায় আসে। "স্যার, আমাদের পাড়ায় লীলাবতী নামে বিবাহিত মহিলা অবৈধ সম্পর্ক ধরা পড়ে দুটো খুন করেছে। একজন গুরুতর জখম, হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যাবে। 

 

 ◆ অফিসারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী প্রতিবেশীদের সঙ্গে লীলাবতীর বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর লীলাবতীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। 

 

◆ পুলিশ কর্মকর্তা মহানন্দা মহাশয় পাশে বসিয়ে লীলাবতীকে বলেন - বলে মা; কেন খুন করলে স্বামী সহ তার বন্ধুদের ?

 

◆ লীলাবতী বয়স্ক অফিসের দিকে তাকিয়ে কিছু সময় চুপচাপ থাকার পর নিস্পৃহ ভাবে বলতে শুরু করে।  

 

 ◆ তিন বছর আগে উভয় পক্ষের অভিভাবকের দেখাশোনা করে আমাদের দুজনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর জানতে পারি, স্বামীর মদ আর জুয়া খেলা ছাড়া দ্বিতীয় কোন কাজ নেই। 

তবুও বিধির বিধান মনে করে দুঃখ কষ্ট সহ্য করেই সব কিছু মেনে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়।

 

◆ সংসারের হাল ধরে রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে কিন্তু স্বামীর অনেক অন্যায় অত্যাচার ও আবদার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। সংসার বাঁচানোর জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। 

 

◆ আমার বাবার বাড়ি থেকে দেওয়া সোনা-গয়না, টাকা-পয়সা সহ বাড়ির বাসন-কোসন একে একে সব কিছু মদ আর জুয়ার পিছনে চলে গেছে। তবুও সংসারের হাল ছাড়িনি কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের ছেলেকে ত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে গেছে।

 

◆ একসময় সংসারে অনটন শুরু হয়। দুটি লবণ ভাত জোটানো মুশকিল হয়ে পড়ে । লজ্জা ঘৃনা ত্যাগ করে বাবার কাছে থেকে টাকা নিয়ে আসি আর সেলাই মেশিন কিনে নিয়ে বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ শুরু করি। 

 

◆ মাঝে মধ্যে স্বামীর মদের টাকার চাহিদা মেটাতে হতো। তার মধ্যে অনেক কষ্ট করে একটা মেশিন থেকে আরো তিনটে মেশিন কিনি। কিছু লোক দিয়ে কাজ করিয়ে বাড়তি রোজগারের চেষ্টা করি।

 

◆ আমার আয়-রোজগার দেখে স্বামী হিংসা শুরু করে। বন্ধুদের কথা মতো বাড়িতে মদ-জুয়ার আসর বসায়। সেই সাথে শুরু হয় আমার উপর নির্যাতন আর অত্যাচার ।

 

◆ কাল রাতে জুয়া খেলায় হারতে হারতে কয়েক হাজার টাকা হেরে যায়। তারপর শেষে আমাকে বাজী রাখে কিন্তু বন্ধুদের চক্রান্তে এবার গো হারা হেরে যায়। 

 

◆ বন্ধুদের শর্ত অনুসারে ওর সামনেই স্বামীর দুই বন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। আমি ওদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে কোনোমতে পালিয়ে এসে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয়।

 

◆ ভেবেছিলাম রাতের মধ্যে মদের নেশা চলে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। আজ সারাদিন সেলাইয়ের কাজ করেছি। রাতে মেশিনে কাজ শেষ করার পর খাওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরোতেই স্বামীর দুই বন্ধু মিলে জোর করে আমাকে বিছানায় নিয়ে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করে।

 

◆ ধর্ষণ চলাকালীন সময়ে উপায়ন্তর না দেখে হাতের কাছে বটি পেয়ে যাই আর চালিয়ে দেয়। সেই শয়তান চিৎকার করে মেঝেতে পড়ে যায়। 

 

◆ স্বামীর আরেক বন্ধু পালানোর চেষ্টা করছিল। আমি আক্রমণাত্মক হয়ে ওর পিছন পিছন গেটের সামনে এসে জানতে পারি। আমাকে ধর্ষণ করার জন্য স্বামী নামক শয়তান দুই বন্ধুর কাছে থেকে বার হাজার টাকা নিয়েছে। স্বামী তার বন্ধুদের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেটের বাইরে তালা লাগিয়ে অপেক্ষা করছিল।

 

◆ আমি দ্বিতীয় শয়তানটাকে খুন করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে কোপ বসিয়ে দেয় কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার স্বামী গেট খুলে বন্ধু কে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলো। ধারালো বটির কোপে স্বামীর দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায়।

 

 ◆ থানার অফিসার সবকিছু শোনার পর লীলাবতীকে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করে জেলার জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। আর নরেশের দ্বিতীয় বন্ধুকে হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন। ধর্ষণের মামলা এখন কোর্টের বিচারাধীন।  

                ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ রচনাকাল :- 5 সেপ্টেম্বর 2021 সালে। দত্তপুলিয়া যুব গোষ্ঠী ক্লাব, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। 

◆ সংশোধনের তারিখ :- ২ আগস্ট ২০২৩ সালে। আশ্রম খাটুরা-দোলন ঘাটা, মাঝদিয়া, নদীয়া।

 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

                                                    গল্প নম্বর :- ৩

 

       

বিদ্রোহী আদিবাসী কিশোরী।

              গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

◆ " আদিবাসী বিদ্রোহী নারী" নামে গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে। সঙ্গমে বিপর্যয় ( দ্বিতীয় গল্প সংকলন।) প্রথম প্রকাশ :- ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ। কলকাতা বইমেলা ও দত্তপুলিয়া ( নদীয়া জেলা) বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত।

 

◆ বিষয় ও শ্রেণী :- সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস গবেষণা মূলক ও উন্নয়ন মূলক প্রবন্ধ যুক্ত গল্প।

শিক্ষা ব্যবস্থার গাফিলতির আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এক কিশোর প্রতিবাদী কন্ঠের কাহিনী। 

 

◆ ৩ আগস্ট ২০২৩ সংশোধনের মাধ্যমে

 " আদিবাসী বিদ্রোহী নারী" নাম পরিবর্তন করে "বিদ্রোহী আদিবাসী কিশোরী" রাখা হয়েছে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ আদিবাসী কুইরি সম্প্রদায়ের মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের প্রথম স্থান অধিকারী কিশোরী লাজবতী কুইরি (কাল্পনিক নাম)। তৎকালীন সময়ের রাজ্যের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শিক্ষা, বাসস্থান, কর্মস্থান, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও কুইরি সমাজের উন্নয়নের জন্য প্রতিবাদ করেছিল। রাজনৈতিক নেতাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

 

◆ জঙ্গলের বাসিন্দাদের কথা কোন রাজ্য 

সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার কেউই বুঝতে চায় না। ন্যায্য অধিকার আদায়ের লড়াই করতে গেলে সন্ত্রাসবাদী, আতঙ্কবাদী ও মাওবাদী নামে দেশের সরকার আখ্যায়িত করে, শাসনের নামে চরম নির্যাতন আর অত্যাচার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর নেমে আসে।

 

◆ এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের দিকে কোন সরকারের নজর নেই। এই জঙ্গলমহলে বিভিন্ন সময়ে সরকারের সাথে জঙ্গল বাসীদের বিভিন্ন আন্দোলন হিংস্র ঘটনা ঘটেছে। বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তবুও তাদের কন্ঠরোধ বা আন্দোলন ঝিমিয়ে যায়নি।

 

◆ সরকার মাওবাদী নামে চিহ্নিত করে কত মানুষের না জীবন নিয়েছে। জঙ্গলমহলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী কেন প্রতিবাদী হয়ে উঠে! মাওবাদী দলে নাম লেখায় তা কিন্তু একবার কোন সরকার খতিয়ে দেখেন না।

 

◆ লাজবতী শিশু কাল থেকে কিশোরী কালের সময়ে লেখাপড়া শিখতে গিয়ে জাত পাতের লড়াইয়ে উচ্চবর্ণের কাছ থেকে বারবার লাঞ্ছিত বঞ্চিত হয়েছে। উচ্চশিক্ষা লাভ করে সমাজের উন্নয়নের কাজে ব্রতী হন।

                ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

        স্বাধীনতা আন্দোলনে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমিকা।

 

 ◆ ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি বৃহৎ জেলা মেদিনীপুর ছিল। পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যার ভিত্তিতে বর্তমান রাজ্যের শাসক দল জেলাটিকে ভেঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম নামে তিনটি জেলায় ভাগ করে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার বেশকিছু অঞ্চল বর্তমানে সরকারের ঘোষিত ‘জঙ্গলমহল’ নামে পরিচিত লাভ করেছে। 

 

◆ বিশেষ করে জঙ্গলমহল এলাকায় বিভিন্ন ধরণের জাতি-উপজাতি বাসবাস করে। তারা নানা ধরণের রীতি-নিয়ম, প্রথা ও ব্রততে বিশ্বাসী। ঝাড়গ্রাম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে শাল মহুল, আম, জাম, শিমূল ইত্যাদি গাছের সবুজ জঙ্গল রয়েছে। 

 

◆ জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আদিবাসীদের ছোট ছোট গ্রাম রয়েছে। এই সমস্ত গ্রামে সাঁওতাল, শবর, লোধা, মুণ্ডা ইত্যাদি জনজাতি আদিম যুগ থেকে একটা সময় পর্যন্ত জীবনধারণের জন্য সম্পূর্ণভাবে জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল। 

 

◆ জঙ্গলের ফল-মুল,শাক-পাতা খেয়ে, পশুপাখি শিকার করে, জঙ্গলের কাঠ ও বনজ উপকরণ দিয়ে ঘর-গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় নানান জিনিস বানিয়ে বিক্রি করে কিন্তু তাদের দিব্যি জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। 

 

◆ সারাদিন খাটুনির পর সন্ধ্যাবেলা মহুল ও সিমুলের তলায় বসে হাঁড়িয়া খেত আর মাতাল হয়ে মেয়ে-মরদ একে অপরের কোমর জড়িয়ে নাচ আর গান গাইতে থাকে। 

 

◆ সেই প্রাণ খোলা আনন্দের মুহূর্ত গুলো চোখে না দেখলে কথাকথিত আধুনিক সভ্য সমাজের মানুষেরা অনুভব করতে পারবে না। সেই সব আনন্দের দিনগুলো বর্তমানে সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়নি কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে।       

 

◆ অখন্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের 

ইতিহাসের পাতায় সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল অতিপরিচিত ঘটনা। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে একজোট হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, পুরুলিয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠী- সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ গুলো। 

 

◆ সিধু, কানু, চান্দ ও ভৈরবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক বছরের মাথায় বিদ্রোহ স্তিমিত হয় বটে কিন্তু গোটা ভারতের মোহনিদ্রা ভেঙে দিয়ে গেল। অধিকার সচেতনতার লড়াইয়ের জন্ম নেয়। পরের বছর থেকেই এই মাটিতে একের পর এক বিদ্রোহ শুরু হয়।  

 

◆ ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার প্রথম বিদ্রোহ আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী শুরু করেন। পরবর্তীতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। 

 

◆ অখন্ড ভারতবর্ষ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত ভারত বর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে কিন্তু বর্তমান ভারতবর্ষে সেই আদিবাসী ও সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কতটুকু রাষ্ট্রীয় ভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। তাদের কি কোন উন্নয়ন হয়েছে? 

ভারত সরকারের উদ্যোগে তাদের খাদ্য, নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে কি?

 

◆ পুরনো ইতিহাস থেকে জানা যায়, উত্তর 

ভারত থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার আইল্যান্ড অব্দি বিস্তৃত অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন।

 

◆ আনুমানিক ত্রিশ হাজার বছর আগেই তারা ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়া যায়। সেই অস্ট্রিক গোষ্ঠীরই উত্তরাধিকারী বর্তমানের সাঁওতাল উপজাতি। সাঁওত বা সামন্তভূমিতে বাস করার কারণে সাঁওতাল নামে পরিচিত হয়।

        ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

                  ।। ঝিয়ের কাজের প্রতিবাদ ।।  

 

◆ পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার আদিবাসী জনগোষ্ঠী এলাকার জামবনির গ্রামের কুঁইরি পাড়ার শিবে কুঁইরির মেয়ে লাজবতী কুঁইরি, সকালবেলা উঠানে বসে শীতের ঝলমলে মিষ্টি মিষ্টি রৌদ্রের তাপে পিঠ দিয়ে দুলে দুলে ক্লাস সেভেনের পাঠ্য বই থেকে সামন্ত রাজার ইতিহাস পড়ে মুখস্ত করতে বাস্ত।

 

◆ কিশোরী লাজবতী কিছু সময় পড়াশোনা করার পর ভাবে মনে মনে :- 'মা, বাবুপাড়ার দে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। কাজের বিনিময়ে ফেলে দেওয়া বাসি পান্তা খাদ্য ও মাসের শেষে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়। যে টাকা দেয় তা দিয়ে নুন আনতে পান্তা ভাত খাওয়া হয় না। 

 

◆ ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়ে মায়ের শরীর টা একদম ভেঙে গিয়েছে। মায়ের শরীরে মাঝে মধ্যেই জ্বর আসে। আর জ্বর আসলে মা তালপাতার ঘরের বারান্দায় খেজুরের পাটিতে একা একা চুপচাপ শুয়ে থাকে। অভাবের সংসারে টাকার জন্য মায়ের চিকিৎসা হচ্ছে না। এই এলাকার মধ্যে বহু গ্রাম থাকা সত্ত্বেও কোন সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই। 

 

◆ আছে শুধু, রাজনীতির বড় বড় বক্তৃতা আর প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ভোট আদায় করা। ভোট চলে গেলে আমাদের মত হতদরিদ্র মানুষের কথা কোন রাজনৈতিক নেতাদের মনে থাকেনা।

 

◆ বাবা বলেছেন; স্বাধীনতার বহু বছর পরে রাজ্যের জনগণ পুরনো শাসক কে বাদ দিয়ে অনেক আশা ভরসা নিয়ে নতুন সরকার গঠন করে। আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠী এলাকায় কোন উন্নয়ন হয়নি।

 

◆ বইকে পড়ি শিক্ষা নাকি জাতির মেরুদন্ড কিন্তু বাস্তবে আমাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। অনেক দূরে বাবুদের ছেলে মেয়ের স্কুলে আমাদের যেতে হয়। আমরা নাকি অস্পর্শ জাতি ছুঁয়ে দিলে স্নান করতে হয়। তাই স্কুলের সহপাঠী গণ আমাদের স্পর্শ বাঁচিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে সব সময় চলে।

 

◆ আজ মায়ের শরীরে জ্বর এসেছে ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাই দাওয়াই শুয়ে আছে কিন্তু আজ দে বাড়ির কাজে যেতে পারেননি।

 

◆ দে বাড়ির বড় গিন্নি লোক মারফত বহুবার খবর পাঠিয়েছে। মায়ের প্রচন্ড জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে, তবুও দে বাবুর গিন্নি সে কথা শুনতে চায় না। টাকা দিয়ে পোষা চাকরানী মরে যাক আর বাঁচো থাক, তা তারা দেখতে চাই না কিন্তু সবসময় তাদের কাজ করে দিতে হবে।

 

◆ লাজবতীর দিদিমা বুড়ি রৌদ্রের তাপে বসে

ছেঁড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে বিড়ি ফুকছিল।

 

◆ কিশোরী লাজবতী কাছে এসে বই বন্ধ করে দিয়ে দিদিমা বুড়ি বলেন :- এখন পড়াশোনা করতে হবে না। যা বোন দে বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাজ গুলো করে দিয়ে আয়।

 

◆ কিশোরী লাজবতী অনিচ্ছাসত্বে বাড়ির দিদিমা একপ্রকার জোর করেই কিন্তু মায়ের অনুপস্থিতিতে ঝিয়ের কাজের জন্য দে বাবুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

 

◆ কিশোরী লাজবতী দে বাড়িতে গিয়ে পুরানো ফটক ঘেরা বড় উঠান সহ উঠানোর চারিদিকে বড় বড় ঘরের এবং বড় বড় বারান্দা সব জায়গায় ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে সবেমাত্র পা বাড়িয়ে দিয়েছে।

 

◆ ঠিক সেই মুহূর্তে দে বাড়ির বড় গিন্নি বলেন :- লাজবতী কোথায় যাচ্ছি? এখনো কাজ শেষ হয়নি।

 

◆ কিশোরী লাজবতী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

 

◆ দে গিন্নি এক গাদা এঁটো বাসন নিয়ে এসে লাজবতী সামনে রেখে বলেন :- এই বাসন গুলো পরিষ্কার করার পর ভালো করে ধুয়ে মুছে রাখ।

 

◆ কিশোরী লাজবতী প্রতিবাদী কন্ঠ বলে :- আমি; আপনাদের এঁটো বাসন ধুয়ে দিতে পারবে না।

 

◆ দে গিন্নি রাগে উত্তেজিত হয়ে বলেন :- কি বললি তুই? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। ছোট জাত হয়ে বড় বড় কথা বলা। তোর মা, তোর দিদিমা, তোর দিদিমার মা ও তোর চৌদ্দগুষ্টি সবাই এই দে বাড়িতে বহু কাল ধরে এঁটো বাসন ধুয়ে ধুয়ে মরে গেছে। এখন তোর মা মরতে চলছে, তাদের মেয়ে হয়ে আমাদের বাড়ির এঁটো বাসন ধুয়ে দিতে পারবে না। আমাদের এঁটো খাবার খেয়ে তোরা বেঁচে থাকিস।

 

◆ কিশোরী লাজবতী ভাবে, এই সভ্য সমাজের ধনী মানুষেরা আমাদের মত গরিব মানুষের ছোট জাত বানিয়ে রেখেছে আর চিরকাল শোষণ, শাসন ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।

 

 ◆ দে বাড়ির বড় গিন্নী উত্তেজিত হয়ে বলেন :- কিরে লাজবতী, কানে কথা যাচ্ছে না। দুই ক্লাস লেখাপড়া শিখে বড় অহংকারী হয়ে উঠেছে। আমাদের উপর কথা বলার এত বড় সাহস পেলি কোথায়!

 

◆ দে বাড়ির বড় গিন্নির চোখের দিকে তাকিয়ে লাজবতী বলে :- বললাম তো, আপনাদের এঁটো বাসন ধুয়ে দিতে পারবে না। আপনারা কাজের লোক দেখে নিন আমি চললাম।

 

◆ লাজবতী নিজেকে অপমানিত বোধ অনুভব করে আর নিজের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর রাগে উত্তেজিত হয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

 

◆ দে বাড়ির লোকজন সবাই অপমানিত বোধ করে। কিশোরী লাজবতী বাবা শিবে কুইরির কে রাস্তায় পেয়ে কিন্তু লোকজনের মধ্যে অপমান ও বিভিন্ন ভাবে ঝামেলা করতে শুরু করে। ছোট জাত পাত তুলে গালিগালাজ করতে থাকে।

 

◆ সন্ধ্যার সময় মাহাতোদের ধান কাটার পর শিবে কুইরি বাড়িতে ফিরে আসে। 

 

◆ শিবের মা তার ছেলের কাছে অভিযোগ করে বলেন :- তোর মেয়ে দুই পাতা পুঁথি পড়ে বড় পন্ডিত হয়ে গেছে, ছোট মুখে বড় বড় কথা বলে। আরে আমরা হলাম ছোট জাত বাবুদের সাথে ঝামেলা অশান্তি করে আমরা কি বাঁচতে পারি? 

 

◆ কিশোরী লাজবতী লেখা পড়ার বিষয় সহ প্রতিবাদ করার সাহস দেখে সত্য মিথ্যা শিবের মা তার ছেলের কাছে মহাভারতের সাতকাহন বলতে শুরু করে।

 

◆ লাজবতীর মা হাড়ির মধ্যে ধানের কুড়া দিয়ে আগুন জ্বলে মাঘ মাসের সন্ধ্যায় সময় শীতের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গা-হাত-পা সেঁক দিয়ে শরীরকে গরম রাখার চেষ্টা করছে।

 

◆ কিশোরী লাজবতী ভাবে :- বাবার মাথায় ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বুকে হাত দিয়ে চাপরাছে কারণ বাবুদের কাছে থেকে অপমানিত হয়ে হৃদয়ের মাঝে আগুন জ্বলে উঠেছে। 

 

◆ বাবা কখনো উত্তেজিত স্বভাবের মানুষ না কিন্তু আজ ভীষণ ভাবে দুঃখ পেয়েছেন। আমি তো সত্যি কথা বলেছি কিন্তু কতদিন আর বাবুদের দ্বারস্থ হয়ে থাকতে হবে। আমাদের এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ গুলো কবে বুঝবে লেখাপড়া শেখার প্রয়োজনীয়তা।

 

◆ শিবে কুইরি কিছু সময় ধরে অপমানের দুঃখ জ্বালা ভোলার জন্য চোখের জল ফেলতে থাকে। আরো কিছু সময় পর চোখ মুছতে মুছতে তার প্রতিবাদী মেয়ের কাছে এসে বসে। 

 

◆ লাজবতী বাবা তার মেয়েকে কাছে নিয়ে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে উচ্চ কন্ঠে বলেন :- লাজবতী তুই যা করেছিস ভীষণ ভাবে ভালো করেছিস। আমি চাই; আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো সবাই প্রতিবাদী হয়ে উঠুক। আর কতকাল এই বাবুদের শাসন শোষণ নির্যাতন সহ্য করবো।

 

◆ তোর মা, তোর মায়ের বংশপরম্পরায় সবাই বাবুদের বাড়িতে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে আসছে। বাবুদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছে কিন্তু তাতে হয়েছে কি? তাতে হয়েছে কি ?

 

◆ বাবুদের কাছে আমরা ছোট জাত কিন্তু তাই বলে আমাদের কি কোন মান সম্মান থাকতে নেই?

 

◆ কিশোরী লাজবতী বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে :- ঠিকই তো, আমাদের কি কোন মান সম্মান নেই। আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নারীদের বাবুরা কোনো মূল্যই দিতে চাই না। অকারণে নারীদের উপর শাসনের নাম করে শোষণ চালিয়ে যায়। দেখে মনে হয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মহিলারা বাবুদের কেনা সারা জীবনের ক্রীতদাসী। বাবুদের ইচ্ছা মত চলতে হবে নিজস্ব স্বাধীনতা বলে কিছুই থাকবে না।

 

◆ বাবা শিবে কুইঁরি ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়ে লাজবতীর হাত ধরে উঠানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে চিৎকার করে বলেন :- মা লাজবতী, মনে রাখিস তুই কিন্তু পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করার জন্য জন্ম হয়নি। যত বড় লাট সাহেব হোক না কেন; নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে কারো কাছে মাথা নত করবে না। 

 

◆ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তোকে লেখাপড়া শেখানো হচ্ছে , তোর থেকে সবাই শিখতে পারবে। না হলে আমাদের মতো দিন দরিদ্র মানুষের ঘরে আছে কি ?

 

 ◆ এই যে আমার জাত ভাইয়েরা শুনো, আজ একটা পুচকে মেয়ে বাবুদের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ করেছে কিন্তু তোমরা যা কোনদিন করতে পারোনি কিন্তু আর ঘুমিয়ে থেকো না প্রতিবাদী হয়ে ওঠো।

 

◆ লাজবতী রাতে ঘরের শত ছিদ্র দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবে :- মেয়েদের কি সমাজের বুকে কোন স্বাধীনতা নেই , না আছে অক্ষর জ্ঞান না আছে মান সম্মান।

 

◆ ছোট থেকে শুনে আসছি মা, কাকিমা, দিদিমা ও বয়স্কদের মুখে মেয়ে মানেই মাটি। দুই দিন পর পরের ঘরে গিয়ে কিন্তু রান্নাঘরে জায়গা হবে, তা লেখাপড়া শিখে কি লাভ হবে?

 

 ◆ একগাদা সন্তান লালন-পালন করতে করতে আর মাঠে-ঘাটে কাজ করতে করতেই দিন চলে যাবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বৈদিক নিয়ম অনুসারে স্ত্রী তার স্বামীকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাকে কাজ করে সংসার চালাবো। 

 

◆ আমাদের জনগোষ্ঠীর সব দায়-দায়িত্ব নাকি মহিলাদের উপর, এটাও একটা চরম অন্যায় কাজ করে চলেছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পুরুষেরা কিন্তু নারীকে ভোগের সামগ্রী বানিয়ে রেখেছে।

 

 ◆ এই সংসার চালাতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম সহ বহু নারীদের কে বাবুদের সাথে কত রকম ছলচাতুরি করতে হয়। এমনকি নিজের মান সম্মান বিসর্জন দিয়ে পর পুরুষের সাথে টাকার জন্য থাকতে হয়।

 

◆ আর বেশিরভাগ পুরুষগুলো সারাদিন মদ মাতাল হয়ে কাটিয়ে দেবে। স্বামীদের কে আবার চুল্লু কেনার পয়সা দিতে হবে কিন্তু উক্ত নারী টাকা কোথা থেকে আনবে সে চিন্তা একবার করে না।

 

 ◆ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সভ্য সমাজের বাবুরা তাদের উপর ক্ষমতায়ন দেখায়। পুরুষরা এক বোতল বিদেশি মদ হোক আর দেশী লোকাল চুল্লু পেলে কিন্তু মহা সন্তুষ্ট। অন্যায় কাজ হলেও কিন্তু বাবুদের সমর্থন যোগাবে।

 

◆ গাঁয়ের কয়েকজন ভালো মনের বাবুরা বলে, দ্যাখ লাজবতী, মন খারাপ করলেই কিন্তু তুমি হেরে যাবে আর বহু দূর পর্যন্ত পিছিয়ে পড়তে হবে। লোকে যে যা বলে বলুক না কিন্তু এক কান দিয়ে শুনবে আর অন্য কান দিয়ে বের করে দেবে। তোমার পড়াশোনা চালিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্য পথে এগিয়ে চলে।

 

◆ কয়েক বছর পর লাজবতীর বাবা এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় দীর্ঘ সময় ধরে অসুস্থতার জ্বালা যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে কিন্তু একদিন শরীরের মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুর কোলে চিরনিদ্রায় শুয়ে পড়ে। 

 

◆ মা ও মেয়ে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তবুও লাজবতী বহু কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন মজুরের কাজ কর্ম করে দারিদ্রতার সাথে লড়াই করতে করতে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে একসময় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আসে।

         ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

                     ।। শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।।

 

◆ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কয়েক মাস পর হঠাৎ একদিন ভোর বেলায় পাশের গ্রামে বসবাসকারী জামবনি স্কুলের হেডমাস্টার মহাশয় লাজবতীর মাটির বাড়িতে এসে লাজবতী লাজবতী লাজবতী লাজবতী ডাকাডাকি করতে শুরু করেন। 

 

◆ অনেক ডাকাডাকি করার পর লাজবতীর মা দরজা খুলে মাস্টারমশাই সহ পাড়া প্রতিবেশী লোকজন দেখে হতভম্ব ও আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করে :- বাবুরা, আমরা কি কোন অন্যায় করে ফেলেছি! আর মাস্টারমশাই আপনি।

 

◆ মাস্টার মশাই আনন্দিত মনে মাথা নিচু করে কুঁড়ে ঘরে ঢুকে বলেন :- 'মা লাজবতী, তুই পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফলাফলে সর্ব প্রথম স্থান অধিকার লাভ করে কিন্তু আমাদের স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছিস।

হেড মাষ্টারের কথা শুনে লাজবতী জরাজীর্ণ বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে।

 

◆ লাজবতী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে :- 'মাস্টারমশাই, আমি কি স্বপ্ন দেখছি? আমার মত অভিভাবকহীন আদিবাসী কালো মেয়ে শুধুমাত্র স্কুলের ক্লাসের মাস্টারের কাছে পড়াশোনা করে প্রথম হতে পারে না। মাস্টার মশাই হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।

 

◆ মাস্টার মশাই লাজবতী মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন :- 'মা, সত্যি তুমি প্রথম স্থান অধিকার করেছো। এই সংবাদ দেওয়ার জন্য ভোরবেলা এসেছি। না হলে আবার কাজে চলে যাও। মা আমি আসছি বলে, ঘরের বাইরে এসে চলতে শুরু করেন।

 

◆ পরীক্ষা পাসের খবর শুনে আনন্দের অশ্রুধারা ঝরতে থাকে মা ও মেয়ের। সকাল বেলায় চাঁদের হাট বসেছে ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরের উঠানের মাঝে। 

 

◆ লাজবতী তার অসুস্থ মাকে জড়িয়ে ধরে বলে :- আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতে ভীষণ খুশি হতো কারণ বাবার উদ্যোগের কারণে লেখাপড়া শিখতে পেরেছি। বলে দুই হাত তুলে কপালে ঠেকিয়ে স্বর্গীয় বাবার উদ্দেশ্যে কয়েক বার প্রণাম করে। 

 

◆ দিনের আলো উদিত হওয়ার পর দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে লাজবতীর মাটির কুড়ে ঘরের উঠানোর মাঝে গ্রামের প্রতিবেশী সহ, অঞ্চল প্রধান, উপ প্রধান, মেম্বার ও রাজনৈতিক দলের নেতারা হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দলে দলে আসতে শুরু করে।

 

◆ লাজবতীর মা এত লোকের আনাগোনা খাবারের প্যাকেট দেখে ভাবে মনে মনে :- বহুদিন যে অনাহারে থেকেছি কিন্তু তখন কেউ তো খোঁজ করেনি। হয়তো রাজনৈতিক কোনো ফায়দা লোটার জন্য নেতারা বাড়ির উঠানে এসেছে। মেয়ের পড়াশোনার জন্য একটা বই খাতা কেউ দিয়েছে। 

 

◆ মাধ্যমিকের বই কেনার জন্য কত নেতার পিছনে পিছনে ঘুরতে হয়েছে। তবুও একটা বই কেউ কিনে দেয়নি। তাদের নোংরা প্রস্তাব মেনে নিলে কিন্তু অনেক কিছু পাওয়া যেতে। এই সব স্বার্থবাদী নেতাদের মুখে থু থু থু থু থু থু থু থু।

 

◆ স্কুলের প্রধান মাস্টারের সহযোগিতায় কিছু পুরনো বইয়ের সংগ্রহ করে লাজবতী মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে। হে ঈশ্বর তুমি লাজবতী কে রক্ষা করো।

 

◆ প্রথম স্থান অধিকারী লাজবতীর ছবি তোলার জন্য টিভি চ্যানেলের ও দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকগণ ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

 

◆ ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তৎকালীন শাসকদলের এক রাজনৈতিক নেতা বলেন :- তোমাদের মতো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মেয়েরা যদি উঠে আসে, তবে ভারতবর্ষ উঠে আসবে।

 

◆ লাজবতী ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলে :- নেতা মশাই; কথাটা ভীষণ সত্যি বলেছেন কিন্তু বাস্তবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মেয়েদের উঠে আসার রাস্তা যে এখনো আপনারা তৈরি করে দেননি। 

 

◆ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের কিন্তু নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক ভাবে নিচু জাত বানিয়ে রেখেছে। 

 

◆ নিচু জাত বলে আমাদেরকে সবসময় অবহেলিত করে নিচের দিকে ফেলে দিয়েছেন, কিন্তু কেন? 

◆ আমাদের জনগোষ্ঠী কি ভারতবর্ষের নাগরিক নয়?

 ◆ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবো না।

 

◆ খাড়া পাহাড়ে ওঠা সহজ নয়, উঠতে হলে ভীষণ পরিশ্রম করতে হয় আর শরীর ও মনের জোর আর বিশ্বাস চাই।

 

◆ একটি দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক বলেন :- আপনার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

 

◆ লাজবতী ভাবে সেই ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ের ঘটনা ছাড়া আমার আর কিছু মনে আসছে না। দে বাড়ির ঘটনা উল্লেখ করে বলতে শুরু করে। ঘটনা শেষ হওয়ার পরে চারিদিকে হাততালি পড়তে থাকে।

 

◆ টিভি সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে বলে :- তুমি যে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সর্বপ্রথম হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় তোমার পড়াশোনার জন্য উদ্যোক্তা সবচাইতে বেশি কে ?

 

◆ লাজবতী বলে :- আমার বাবা আমার পড়াশোনা করার জ্ঞানের আলোর বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার লেখাপড়ার জন্য বাবা কে কিন্তু বাবুদের কাছে বহু অপমানজনক কথা বার্তা শুনতে হয়েছে।

 

◆ প্রথম যেদিন দে বাবুদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজের এঁটো বাসন ধোয়ার বিষয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম।

 

◆ সেই দিন আমার বাবা মাথায় হাত রেখে বলেছিল :- লাজবতী; তুই ঠিক করেছিস আর কতকাল বাবুদের এঁটে বাসন ধুয়ে বেড়াবে আমাদের জাতির মানুষেরা, তোকে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হতে হবে।

 

◆ আজ আমাদের কুড়ে ঘরে অপ্রত্যাশিত সূর্যের আলো দেখে কিন্তু বাবা বেঁচে থাকলে ভীষণ খুশি হতেন।

 

◆ যখন আমি প্রথম লেখাপড়া শিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু ছোট জাত বলে সমাজের উচ্চ জাত নামধারী বাবুরা আমাকে সহযোগিতার বদলে করেছিল অবহেলা ও অপমানজনক কথা বার্তা। সেই কথাগুলো আমি আজও ভুলতে পারি।  

 

◆ আজ মাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকার করেছি বলে ছোট জাতের তালপাতার কুঁড়েঘরে লোকে-লোকারণ্য হয়েছে কিন্তু কেন ? 

আমাকে দেখিয়ে রাজ্যের মান বাড়ানো আর উন্নয়নের নামে নেতাদের বাড়বাড়ন্ত।

 

◆ আমাদের সুখ দুঃখের খবর কয়জন রাখে। আজ বড় বড় ক্যামেরা নিয়ে বলছেন, অনেক বড় বড় কথা, দুদিন পরে হারিয়ে যাবে আমাদের কুঁইরি সমাজের মানুষেরা সব কথা। স্মৃতির পাতায় শুধু স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবে কুঁইরি পাড়ার মানুষগুলো।

 

◆ লাজবতী ভাবছে :- আমাদের তালপাতা দিয়ে ঘেরা কুড়ে ঘরে কত মানুষ আসছে। মন্ত্রী আসবে বলে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আবার অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।

 

◆ কয়েক দিন পর শীতের দুপুরে রৌদ্রের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের পাহারায় লাল মাটির ধুলা উড়িয়ে লাজবতীর মাটির কুড়ে ঘরের সামনে মন্ত্রীর গাড়ি বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে আসে। শিক্ষামন্ত্রী সহ আরো রাজনৈতিক নেতাগণ গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। 

 

◆ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তার দামী গাড়ি থেকে নেমে বলেন :- লাজবতী কুঁইরি কোথায় ?

 

◆ লাজবতী তার অসুস্থ মায়ের হাত ধরে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে আর হেড মাষ্টারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

 

◆ হেডমাস্টার মশাই বলেন :- প্রণাম কর লাজবতী প্রণাম কর।

 

◆ লাজবতীর পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে মন্ত্রীমহোদয় বলেন :- তুমি, দিন মজুরের কাজ কর্ম করে সংসার চালিয়ে বহু কষ্টে মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। শুনি ভীষণভাবে আনন্দিত হলাম তাই তোমাকে দেখতে চলে এলাম। তোমাদের সত্যিই ভীষণ দারিদ্র্য অবস্থা কিন্তু দারিদ্র্য দূরীকরণের চেষ্টা আমাদের সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অঞ্চল প্রধান কোথায়।

 

◆ অঞ্চল প্রধান তাড়াহুড়ো করে মঞ্চের উপরে উঠে আসে।

 

 ◆ লাজবতী দিকে তাকিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন :- তুমি; এখনো ঘর পাওনি বলে পাশে থাকা অঞ্চল প্রধানের দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনার অঞ্চলের হত দারিদ্র্য মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে হবে। তা না করে আপনি ভীষণভাবে সর্বহারা মানুষের যুক্তফ্রন্ট পার্টির সুনাম নষ্ট করেছেন। লাজবতী যদি ঘর না পাই তবে পাবে কে? 

 

◆ তারপর লাজবতীর দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমাদের মত মেয়েরা যাতে উঠে আসে, তার জন্যই তো আমাদের পার্টি ও তোমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য সরকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

 

 ◆ একজন জেলা পর্যায়ে আদিবাসী নেতা মন্ত্রীর কানে কানে কিছু বলে আর মন্ত্রী চুপচাপ হয়ে যায়।

 

◆ কিছু সময় পর মন্ত্রী মহোদয় দশ হাজার টাকার চেক লাজবতীর হাতে দিয়ে বলেন :- লাজবতী, তোমাকে আমরা আরও ফুলের মালা দিয়ে বড় মঞ্চ তৈরি করে সংবর্ধনা জানাবো। আরো অনেক টাকা তুলে দেবো। এই টিভির লোক গুলো ক্যামেরা এদিকে নিয়ে এসে ভিডিও করুন।

 

◆ মন্ত্রী চেক প্রদান করছেন উন্নয়নের জন্য চারিদিক থেকে ছোট-বড় নানা ধরনের ক্যামেরা ঝলসে ওঠে আলোয়।

 

◆ লাজবতী ভাবে :- বাপের সেই গাম্ভীর্য মুখ খানা অন্তর থেকে বাবা বলেন:- না, না লাজবতী টাকা নিবি না।

 

◆ লাজবতী চিৎকার করে উঠে বলে :- না, না এই টাকা আমি নিতে পারবো না আর আপনারা আমাকে যে ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দেবেন, তাও আমার লাগবে না।

 

◆ হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো লাজবতীর মুখে কথা শুনে মন্ত্রী ঢোক গিলতে শুরু করে এবং একদম নিস্তব্ধ পরিবেশ হয়ে যায়। 

 

◆ লাজবতী ভাবে মনে :- মা, যে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন, সেই দে বাড়ির গিন্নির বড় ছেলে এখন পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের বড় নেতা। এঁটো বাসন ধুতে পারবো না বলে প্রতিবাদ করেছিলাম কিন্তু বাবা কে করেছিল মানুষের মাঝে অপমান সেই দিনের কথা গুলো এখনো ভুলিতে পারি নাই।

 

◆ দে বাড়ির বড় গিন্নির বড় ছেলে স্থায়ী এলাকার বড় নেতা ভিড় ঠেলে লাজবতীর কাছে এসে বলে :- কেন রে কি হয়েছে! লাজবতী টাকা নিবি না? তুই তো একদিন আমাদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতিস?

বল তোর আর কি কি লাগবে ? ভালোভাবে খুলে বল সব দেবে আমাদের সর্বহারা পার্টি।

 

◆ লাজবতী চিৎকার করে বলে :- এই রাজ্যের মধ্যে আমার মতো হাজার হাজার কুঁইরি মেয়ে লাজবতী আছে। আমি শিবে কুইরির মেয়ে অজপাড়াগাঁয়ের মধ্যে বসবাস করি। 

এই পাড়ার কঁইরি ছেলে মেয়েরা যতদিন অন্ধকারে পড়ে থাকবে, যতদিন লেখাপড়ার জন্য কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়-ততদিন কোন বাবুর ও মন্ত্রীর দয়া আমার লাগবে না। শুনেছেন আপনারা আমার কোন দয়া লাগবে না।

 

◆ মন্ত্রী বলে :- কেন, মা তুমি রাগ করছো ?

 

◆ লাজবতী বলে :- আমার বাবা বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরে গিয়েছে। আমার মায়ের মতো শত শত মা এই গ্রামে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে কিন্তু নিম্নতম প্রাথমিকভাবে তাদের কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এই গ্রামে কোন স্কুল নেই অন্য কোন গ্রামে গিয়ে বাবুদের হাতে পায়ে ধরে তাদের ইচ্ছা মত পড়াশোনা করতে হয়। 

 

◆ কিন্তু কেন আমাদের জনগোষ্ঠীকে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন!

◆ সরকারের স্কুল আমাদের গ্রামে কি প্রয়োজন নেই। 

◆ সর্বহারা মানুষের জন্য নাকি আপনাদের দল কিন্তু ক্ষমতায়নের পর সর্বহারা মানুষের জন্য কি করেছেন?

◆ রাজ্যের অন্যান্য জেলার ছেলেমেয়েরা শিক্ষা ব্যবস্থা সবকিছু পেয়ে থাকে কিন্তু আমাদের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল গুলোতে পাই না কেন?

◆ আর লোক দেখানো চেক দিয়ে আমি কি করব? 

◆ আপনারা ভালই জানেন আদিবাসী মানুষের কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই আর চেক ভাঙ্গাতে পারবে না। এটাও কি আপনাদের রাজনীতির খেলা?

 

◆ যদিও অন্যের একাউন্টে জমা দেওয়া হয়, তাহলে হনুমানের মত রুটি ভাগ করতে করতে আমার ভাগে আর কিছু থাকবে না।

 

◆ আপনারা রাজ্য পার্টির বড় নেতা ও মন্ত্রী। কেমন রাজ্য পরিচালনা করেন ?

 

◆ লাজবতী কে থামানোর জন্য এক নেতা অনুরোধ করে।

 

◆ মাহাত বাবুর দিকে তাকিয়ে লাজবতী বলে :- আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এই জেলার বড় নেতা মাহাত বাবু কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর জন্য আপনি কি করেছেন?

 

◆ মাওবাদীদের দমন আইনের আওতায় পড়ে নিজেকে বাঁচানোর জন্য শাসক দলে যোগদান করেন। তারপর আদি জনগোষ্ঠীর কথা বাদ দিয়ে নিজের আখের গোছানোর ব্যবস্থা করে চলেছেন। 

 

◆ আমি মাথা গোঁজার ঘর পায় না আর আপনি নিজে তো বড় বড় বাড়ি তৈরি করে জমি জমা ব্যবসা-বাণিজ্য আরো বড় করে তুলেছেন। 

 

◆ আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বার্থনেশী মানুষগুলো আমাদের চরম শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

◆ তারপর মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে লাজবতী বলে, এইতো আপনার সর্বহারা পার্টির হালচাল। 

 

◆ গরিব মানুষকে শোষণ না করলে কিন্তু কেউ কোনদিন বড়লোক বা ধনী ব্যক্তি হতে পারে না।

 

◆ খাতা কলমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন দেখানো হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে না। তাহলে উন্নয়নের টাকাগুলো যাচ্ছে কোথায়?

 

◆ আমি মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি বলেই, ভোট পাওয়ার আশায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের নাম করে আমাদের কে সান্তনা দিতে এসেছেন।

 

◆ এতদিন কোথায় ছিলেন? যখন বই খাতার অভাবে পড়াশোনা করতে পারছিলাম না, বিদ্যালয়ে গিয়ে বার বার অপমানিত হতে হয়েছে। 

 

◆ হাই স্কুলের হেডমাস্টার মহাশয় কে আমার শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই কারণ তার সহযোগিতায় আমি মাধ্যমিক পাস করতে পেরেছি।

 

◆ দে বাড়ির বড় গিন্নির বড় ছেলে এলাকার বড় নেতা হয়ে, জনসমুদ্রের মাঝে শিবে কুইরির মেয়ে লাজবতী কে ঝিয়ের কাজের অপবাদ দিয়ে কিন্তু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অপমান করলো কেন?

 

◆ আমাদের কুঁইরি সমাজের মানুষেরা চিরকাল হতদরিদ্র আর অশিক্ষিত হয়ে থাকবে কি?  

 

◆ আপনারা শিক্ষিত সমাজের মানুষ হয়ে আমাদের উন্নয়নের জন্য কি করেছেন?

 

◆ না করেছেন একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, না করেছেন গ্রামের কোন উন্নয়ন, না কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। 

 

◆ সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের টাকা গুলো আত্মসাৎ করেছেন।  

 

◆ আমাদের মত হতদরিদ্র ব্যক্তি হয়ে আজ পার্টির উচ্চ পর্যায়ের নেতা, গ্রাম পঞ্চায়েতের মেম্বার ও এলাকার নেতা হলে লাখপতি আর কোটিপতি হয়ে যায় কি করে?

 

◆ আমাদের এলাকার অঞ্চল প্রধান হওয়ার পর তার বাড়ি দোতলা আর আমার বাড়ি তালপাতার কুঁড়েঘর তা চোখে দেখতে পায় না। 

 

◆ প্রতিবাদ করতে গেলে তার কন্ঠ রোধ করে তার উপর মাওবাদী আখ্যা দিয়ে জেল আর নির্যাতন। এই তো হলো রাজনৈতিক খেলা।

 

◆ যে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গৌরব করছেন কিন্তু এখনো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমাজের ছেলেমেয়েদের স্কুলে গেলে কোন মূল্যায়ন করা হয় না।

 

◆ শিশু কালে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছি, স্কুলের বারান্দায় বসে বসে আমাদের ছোঁয়া নাকি স্নান করতে হয়।

 

◆ যদি কিছু করার সৎ ইচ্ছা থাকে তাহলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমাজের উন্নয়নের জন্য কিছু করুন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুন আর বাসস্থান দিতে হবে না।

 

◆ লাজবতী হাত জোড় করে বলে, মন্ত্রী মহোদয় আমার জন্য আপনার কিছুই করতে হবে না। আমি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার হলে আরো লড়াই চালিয়ে যাবো।

 

◆ নেতা ও মন্ত্রীদের মুখে আর কোনো কথা নেই। মন্ত্রীমহোদয় গভীর চিন্তায় মুখ কালো করে ভাবতে থাকে। বাস্তবে উন্নয়ন না করে উন্নয়নের কথা বলে বেশিদিন রাজনীতি চলে না। এর মধ্যে যে আগুনের লেলিহান শিখা জেগে উঠেছে তা ধপ করে নেভানো যাবে না।

 

◆ একটা কিছু অবশ্যই করে দেখাতে হবে। লেখাপড়া শিখে মানুষ গুলো প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। এখন থেকে নতুন ভাবে রাজনীতি শুরু করতে হবে।

 

◆ লাজবতী মাথা ঝাড়া দিয়ে দ্রুত পায়ে মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসে আর মায়ের হাত ধরে ভাঙ্গা কুড়ে ঘরের দিকে চলতে থাকে।

           ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

             ।। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ।।

 

◆ লাজবতীর কলেজ চলাকালীন সময়ে অপ্রত্যাশিতভাবে বিদ্যালয়ের বয়স্ক ইতিহাস শিক্ষক অশোক মহাশয় লাজবতী কে কাছে ডেকে নিয়ে "আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস" মূলক প্রবন্ধের বই হাতে দিয়ে বলেন :- এই বইটি মন দিয়ে পড়বে আরো বই সংগ্রহ করে দেবো। তোমাকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে হবে। পড়াশোনা করার মাধ্যমে তোমার সমাজের মানুষকে শিক্ষিত করতে হবে।

 

◆ লাজবতী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা ও কিছু বিশিষ্ট মানুষের সান্নিধ্যে গবেষণা শুরু করে।

 

◆ প্রাচীনকাল থেকে সর্বপ্রথম এই 

ভারতবর্ষের ভূখণ্ডে যে জনগোষ্ঠী বসবাস করত, তাদেরই “আদিবাসী” জনগোষ্ঠী বলা হয়ে থাকে। আদিবাসী শব্দ কথাটিরই অর্থ হল আদি বাসিন্দা বা সর্বপ্রথম বাসিন্দা। 

 

◆ বর্তমানে প্রায় সমস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ভারতীয় সংবিধান অনুসারে Scheduled Tribe বা তপশীলি উপজাতি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কিছু কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠী হয়ত Scheduled Tribe বা তপশীলি উপজাতি তালিকাভুক্ত হননি, তাঁরা অন্তর্ভুক্তর জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।

 

◆ আদিবাসী জনগণ কে প্রাথমিক দিকের 

প্রথম জাতি, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, আদিম মানুষ ও উপজাতি প্রভৃতি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে।

 

 ◆ যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে, তারাই আদিবাসী। নিজেরাই এক একটি আলাদা জাতি।

 

◆ পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশের ৪০টির বেশি দেশে বসবাসরত প্রায় ৫,০০০ আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩২ থেকে ৩৫ কোটি। 

 

◆ নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ায় যুগে যুগে এদের অনেকে প্রান্তিকায়িত, শোষিত, বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত হয়েছে এবং যখন এসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকারের স্বপক্ষে তারা কথা বলেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা দমন নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। 

 

◆ এক সময়ে উত্তর ভারত থেকে প্রশান্ত 

মহাসাগরের ইস্টার আইল্যান্ড অব্দি বিস্তৃত ছিল অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ। নাক চওড়া ও চেপ্টা, গায়ের রং কালো এবং মাথার চুল ঢেউ খেলানো। আনুমানিক ত্রিশ হাজার বছর আগেই তারা ভারত থেকে অস্ট্রোলিয়া যায়। সেই অস্ট্রিক গোষ্ঠীরই উত্তরাধিকারী বর্তমানের সাঁওতাল। খুব সম্ভবত সাঁওত বা সামন্তভূমিতে বাস করার কারণে সাঁওতাল নামে পরিচিত হয়ে পড়েছে।  

 

◆ যুগের ব্যবধানে ভারতের ভূমিতে এসেছে আর্য, গ্রীক, আরব এবং মোঙ্গলদের মতো অজস্র জাতি। সেই অর্থে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বিভিন্ন দেশের বহিরাগত। এদের কেউ কেউ নিজেদের কে মহাভারতে বর্ণিত বীর একলব্যের বংশধর মনে করেন। তবে তাদের উৎস এবং আদি নিবাসভূমি সম্পর্কে বলতে বহুল প্রচলিত এক লোককথাকে ‍গুরুত্ব দেয়া হয়।

         ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

           ।। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্মের ইতিহাস।।

 

◆ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে। "সাঁওতাল পুরাণ" নামক গ্রন্থে হাঁস ও হাঁসিল গল্প থেকে জন্মের ইতিহাস জানা যায়।

 

◆ সেই মুহূর্তে পৃথিবী নামক গ্রহের জন্ম হয়নি কিন্তু শুধু জল আর জল। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে কাহিনী।

 

◆ একদিন চন্দ্রের কন্যা স্নান করতে এসে শরীরের ময়লা থেকে সৃষ্টি করলেন হাঁস এবং হাঁসিল নামে দুটি পাখি। বহু বছর জলের উপর ভেসে থাকার পর একদিন তাদের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের (ঠাকুর জিউ) নিকট খাবারের জন্য প্রার্থনা জানাই। তাদের প্রার্থনা শুনে ঈশ্বর অর্থাৎ ঠাকুর জিউ পৃথিবী সৃষ্টির মনস্থ করলেন। ভাবলেন সৃষ্টির জন্য মাটির দরকার কিন্তু মাটি রয়েছে সমুদ্রের তলদেশে।

 

◆ জলচর প্রাণী বোয়াল কে ডাকা হল। সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর নির্দেশ দিলেন, সমুদ্রের তলা থেকে মাটি নিয়ে আসার কিন্তু প্রথমে বোয়াল ও তারপর কাকড়া মাটি আনতে ব্যর্থ হলে।

 

◆ কেঁচো নামক এক প্রাণী এগিয়ে এলো। কচ্ছপ কে জলের উপর ভাসতে বলে কেঁচো নিজে লেজ রাখল তার পিঠে। তারপর কেঁচো মাটি খেয়ে তা লেজ দিয়ে বের করে কচ্ছপের পিঠে রাখতে শুরু করে। এই ভাবে দীর্ঘ হাজার হাজার বছর ধরে চেষ্টার ফলে পৃথিবীর জন্ম নিল। 

 

◆ সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর অর্থাৎ ঠাকুর জিউ নরম মাটিকে শুকনো করার জন্য পৃথিবীতে ঘাস শাল ও মহুয়া সহ নানা প্রজাতির বৃক্ষ রোপন শুরু করলেন।

 

◆ আরো কিছুদিন পর মেয়ে পাখিটা দুটি ডিম দিল এবং নয় মাস দশ দিন পর ডিম পরিপুষ্ট হয়ে উঠে। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে ডিম ফেটে যায়। জন্ম হয় একজন পুরুষ পিলচু হাড়াম ও একজন নারী পিলচু বুড়ি। 

 

◆ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুড়ি পৃথিবীর প্রথম নর নারী। হিহিড়ি-পিহিড়ি নামক স্থানে তারা বসবাস করলে লাগলো।

 

◆ ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাদের দৈহিক সম্পর্ক তৈরি হয় ও মিলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় সাতটি পুত্র ও আটটি কন্যা।

 

◆ ঈশ্বর (ঠাকুরজিউ) এবার পিলচু হাড়ামকে পুত্রদের নিয়ে সিংবীরে ও পিলচু বুড়িকে কন্যাদের নিয়ে মানবিরে যাবার নির্দেশ দিলেন। ঈশ্বরের (ঠাকুর জিউ) আদেশ পালিত হলো দ্রুত গতিতে।

 

◆ দীর্ঘ কয়েক বছর পর শিকার করতে করতে ভুলক্রমে সাত পুত্র এক বিলের ধারে চলে আসে। সেখানে শাক তুলছে আট কন্যা। পরস্পরকে দেখে আকর্ষিত হলো। ধীরে ধীরে সেই আকর্ষণ গড়ালো দৈহিক মিলনের পর্যায়ে। ছোট কন্যাকে বাদ রেখে দেয়। ভাইদের মধ্যে যে বড় সে বড় বোনকে এইভাবে সাত জন পুরুষ সাত জন নারীকে গ্রহণ করে।  

 

◆ সেই সাত পুত্র থেকে জন্ম নিলো সাতটি বংশ- হাঁসদা, মূর্মূ, কিস্কু, হেমব্রোম, মারাণ্ডি, সোরেন এবং টুডু। তখন থেকেই মূলত গোত্রপ্রথা এবং বিয়ে প্রথার শুরু হয়।

 

◆ তারপর তারা খোজা-কামান দেশে গিয়ে বসবাস করতে লাগলো। নৈতিক অবক্ষয়, অন্যায় ও অত্যাচারে লিপ্ত হবার কারণে ঈশ্বর (ঠাকুরজিউ) তাদের উপর রুষ্ট হয়ে পড়ে।

 

◆ সাতদিন সাতরাত টানা অগ্নি বৃষ্টির মাধ্যমে পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুড়ির বংশধরদের ধ্বংস করে। হারাতা পর্বতে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে গেলো পিলচু হাড়াম এবং পিলচু বুড়ি। ধ্বংসলীলার শেষে প্রথমে সাসাংবেদা এবং পরে চায়চাম্পাতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং ঈশ্বর (ঠাকুরজিউ) আবার সন্তানাদি দান করলেন।

 

◆ বর্তমান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর 

সামাজিক অবস্থান। সমাজ ও বিচারের কাঠামো। বহু যুগ যুগ ধরে হিন্দু এবং মুসলিমদের সাথে বসবাস করার পরেও সাঁওতালরা তাদের সামাজিক স্বাতন্ত্র্য হারায়নি। বস্তুত রাষ্ট্রীয় বিধানাবলির চেয়ে সামাজিক প্রথার প্রতি তাদের আনুগত্য অধিক। তার অন্যতম প্রমাণ বিচারব্যবস্থা। 

           ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

             ।। সাঁওতাল গ্রাম পঞ্চায়েতের নিয়ম।।

 

◆ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজস্ব ভাবে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু আছে। সাঁওতাল গ্রামের বিশেষ পাঁচজনকে নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে গ্রাম পঞ্চায়েত গঠিত হয়। গ্রাম পঞ্চায়েতের পদ গুলো হলো, মাঝি হাড়াম বা গ্রামপ্রধান, পরাণিক, জগমাঝি, গোডেৎ এবং নায়েকে। আবার কয়েকটি গ্রামের প্রধানদের নিয়ে গঠিত হয় পরগণা পঞ্চায়েত। এর প্রধানকে বলা হয় পারগাণা। এর থেকেও বৃহত্তর ব্যবস্থা দেশ পঞ্চায়েত। সাঁওতাল সমাজের দেশ বলতে নির্দিষ্ট এলাকাকে বোঝানো হয়। 

 

◆ সাধারণত দেশপ্রধানের অধীনে পাঁচ থেকে ছয় জন পারগণা ও মাঝি হাড়াম থাকতে পারে। এই তিন স্তরের বিচারব্যবস্থার বাইরে ল’বীর বা সুপ্রিম কোর্ট আছে। জটিল বিষয়াদি নিয়ে বছরে মাত্র একবার এই আদলত বসে।     

 

◆ সাঁওতালদের একটি বৈঠক। মাঝি হাড়াম বলতে গ্রামপ্রধানকেই বোঝানো হয়। শুধু বিচারিকভাবে না, সার্বিকভাবে গ্রামের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। তার সহায়ক হিসেবে বাকি পদগুলো সৃষ্ট। 

 

◆ পরাণিক পালন করে সহকারি গ্রাম প্রধানের দায়িত্ব। মাঝি হাড়াম অসুস্থ কিংবা অনুপস্থিত থাকলে তার দায়িত্ব বর্তায় পরাণিকের উপর। জগমাঝি পালন করে উৎসব তদারকির ভার। সেই সাথে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা তার মাধ্যমেই নিজেদের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে। সে হিসেবে তিনি যুব প্রতিনিধি। গোডেৎ এর কার্যাবলী অনেকটা চৌকিদারের অনুরূপ। আর নায়েকে বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পূজা উপলক্ষে বলি দেওয়ার মতো বিষয়ের দায়িত্ব পালন করে।

 

◆ স্থানীয় সমস্যাগুলো মীমাংসা করা হয় গ্রাম পঞ্চায়েতে। গ্রাম পঞ্চায়েতে অমীমাংসিত বিষয়গুলো পরগণা পঞ্চায়েতে উত্থাপিত হয়। দেশ পঞ্চায়েতে উঠে পরগণা পঞ্চায়েতে অমীমাংসিত সমস্যা। সবার শেষে স্থিত ল’বীরের মুঠোতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা।

            ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

                 ◆ ◆ গোত্র বিন্যাস।◆ ◆ 

 

বাংলার আবহাওয়াই গোত্রব্যবস্থার অনুকূল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রে বিভক্ত হিন্দু সমাজের দেখাদেখি এখানকার মুসলমান সমাজও বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল সৈয়দ, শেখ, পাঠান ও দেশি মুসলিম হিসেবে। তবে তাদের কারোরই প্রভাব সাঁওতাল সমাজে পড়েনি।

 

◆ বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মধ্যে বসবাসকারী সাঁওতাল সমাজ মূলত ১২টি ভাগে বিভক্ত। তারা হলো- কিস্কু, হাঁসদা, মূর্মূ, হেমব্রম, মারণ্ডি, সোরেন, টুডু, বাস্কি, গুয়াসোরেন, বেসরা, পাউরিয়া এবং চোঁড়ে। 

 

◆ পৃথিবীতে প্রায় ৫,০০০ আদিবাসী গোষ্ঠী আছে। ভারতে প্রায় ৭০০ এরও অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। পশ্চিমবাংলায় মোট ৪০ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে Scheduled Tribe বা তপশীলি উপজাতি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

             ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

                    ◆ ◆ দৈনন্দিন জীবনাচার।◆ ◆ 

 

সাঁওতালদের খাদ্যতালিকা বাঙালি হিন্দু কিংবা মুসলমানের খাদ্যতালিকার মতোই। ভাত, মাছ, মাংস নিরামিষ কিংবা বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক পিঠা তাদের খাবার হিসেবে বিদ্যমান। 

 

◆ নেশা জাতীয় খাদ্যের মধ্যে হাড়িয়া বা ভাত পচানো মদ প্রধান। এছাড়া ভাঙ, তাড়ি, হুকা এবং গাঁজা আছে। অনেক মেয়ে হাড়িয়া ও ধূমপানে অভ্যস্ত থাকলেও সব সাঁওতাল ধূমপান করে না। অতি ‍উৎসাহী অনেকেই তাদের খাদ্যাভ্যাসে কাঠবিড়ালী, গুইসাপ এবং কাঁকড়ার নাম উল্লেখ করেন।

 

◆ গরীব পুরুষদের প্রধান পরিধেয় নেংটি। পোশাকটি একসময় বাংলার অধিকাংশ মানুষই পরিধান করতো বলে এখনো পরিচিত। তবে স্বচ্ছলদের মধ্যে সাধারণ পোশাক হিসাবে ধুতি এবং পাগড়ি বেশ জনপ্রিয়। 

 

◆ আধুনিক শিক্ষিতরা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের অনুরূপ প্যান্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি ও পায়জামা প্রভৃতি পরিধান করে। মেয়েদের পোশাক মোটা শাড়ি বা ফতা কাপড়। তবে স্বচ্ছল পরিবারের মেয়েরা বাঙালি মেয়েদের মতোই শাড়ি, ব্লাউজ এবং পেটিকোট পরে। 

 

◆ ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সাঁওতাল নারী ও পুরুষ। সাঁওতাল রমণীগণ সৌন্দর্য সচেতন। স্বর্ণালঙ্কারের প্রচলন না থাকলেও গলায় হাঁসুলি, মালা ও তাবিজের ব্যবহার দেখা যায়। 

 

◆ এছাড়া কানে দুল, নাকে নথ ও মাকড়ী, সিঁথিতে সিঁথিপাটি, হাতে বালা, চুড়ি এবং বটফল, বাহুতে বাজু, কোমরে বিছা, হাতের আঙুলে অঙ্গুরী, পায়ের আঙুলে বটরী প্রভৃতি অলঙ্কার বেশ জনপ্রিয়। কখনো খোঁপায় ফুল গুঁজে, কখনো কাঁটা ও রঙিন ফিতা দিয়ে চুল বাঁধা হয়। দরিদ্র মেয়েরা বিশেষ প্রকার মাটি ব্যবহার করে শরীর মাজতে, যা নাড়কা হাসা নামে পরিচিত।

 

◆ ক্ষুদ্রাকার ঘরগুলো বেশ পরিচ্ছন্ন। নিম্নাংশ রঙিন করা ছাড়াও দেয়ালে আঁকা হয় নানা রঙের ছবি। বাসায় আসবাবপত্রের আধিক্য নেই। কাঠ, বাঁশ ও পাট ব্যবহারের প্রাচুর্য দেখা যায়। তীর ধনুক ও টোটা প্রায় সব সাঁওতাল বাড়িতেই আছে।

          ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

 ◆ উৎসব-অনুষ্ঠান সাঁওতাল সমাজ উৎসব প্রধান। ◆ 

 

সাধারণত দুই ধরনের উৎসব দেখা যায়। জন্ম-বিবাহ ও মৃত্যুকেন্দ্রিক উৎসব এবং পার্বণিক উৎসব। সব অনুষ্ঠান ঝাঁকঝমকপূর্ণ না হলেও বিয়ে ও পার্বণিক অনুষ্ঠানগুলো ঘটা করে পালিত হয়।

 

◆ বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের মতো সাঁওতাল শিশু জন্মের পাঁচ কিংবা পনেরো দিনে অনুষ্ঠিত হয় অন্নপ্রাশন। এছাড়া নামকরণ, কানে ছিদ্র করা এবং সিকা দেওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় উৎসব। সিকার বদলে মেয়েরা ব্যবহার করে ঈশ্বরের চিহ্ন। 

          ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

          ◆ ◆ সাওতাল সমাজের বিয়ের নিয়ম। ◆ ◆ 

 

সাঁওতাল সমাজে চার ধরনের বিয়ের ব্যবস্তা প্রচলিত আছে। অভিভাবকের পছন্দ মাফিক বিয়ে হলে তাকে বলা হয় ডাঙ্গুয়া বাপ্লা বা আনুষ্ঠানিক বিয়ে। আগে থেকে বিদ্যমান প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ালে সেই বিয়েকে বলা হয় আঙ্গির বা প্রেমঘটিত বিয়ে।

 

◆ এছাড়া আর দুই প্রকারের বিয়ে হলো অ-র বা বলপূর্বক বিয়ে এবং ইতুত বা কৌশলে বিয়ে। অ-র বিয়েতে কোন তরুণ তার পছন্দের তরুণীকে জোর করে সিঁদুর পরিয়ে দেয়।

 

◆ পরবর্তীতে বৈঠক ডেকে তরুণীর মতামত নেওয়া হয়। তরুণী হ্যাঁ বললে কিছু করার থাকে না কিন্তু না বললে তরুণকে দণ্ডিত করা হয়।

 

◆ ইতুত বিয়েটাও প্রায় কাছাকাছি। শুধু এক্ষেত্রে তরুণ সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে সিঁদুর পাতা গ্রামপ্রধানের কাছে জমা দেয়। গ্রামপ্রধান যুবতীর মত জানতে চান। হ্যাঁ হলে বিয়ে হয়ে গেছে বলে ধরা হয়। 

 

◆ সাঁওতাল সমাজে পণপ্রথা প্রচলিত আছে। তবে তা খুবই নগণ্য। সর্বনিম্ন ১২ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা। বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে তিনটা কাপড় প্রদান করে। কনের দিদিমা কে দেয়া শাড়িকে বলা হয় বোঙ্গা শাড়ি। বাকি দুটি পায় কনের পিসিমা এবং মা।

 

◆ বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। বিধবাকে সেই সমাজে বলা হয় ‘রাণ্ডি’। অন্যদিকে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রাপ্তা মেয়েদের বলা হয় "ছাডউই"।

            ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

           ◆ ◆ সাঁওতাল সমাজের অনুষ্ঠানাদি। ◆ ◆  

 

 মৃত ব্যক্তির আত্মার জন্য পালিত হয় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান। সাঁওতালর মৃতকে কবর দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে।

 

◆ ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ কথাটা সাঁওতাল সমাজের জন্য আরো বেশি করে সত্য। বাংলা ফাল্গুন মাসে উদযাপিত হয় নববর্ষ। চৈত্রমাসে বোঙ্গাবুঙ্গি, বৈশাখে হোম, জ্যৈষ্ঠ মাসে এরোয়া, আষাঢ়ে হাড়িয়া, ভাদ্র মাসে ছাতা, আশ্বিনে দিবি, কার্তিকে নওয়াই এবং পৌষ মাসে সোহরাই উৎসব পালিত হয়। ধর্ম-কর্ম, উৎসব-অনুষ্ঠান সবকিছু কে ঘিরে থাকে নৃত্য আর গান।

          ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

            ◆ ◆ ধর্ম-কর্ম।◆ ◆ 

 

সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষা আছে, কিন্তু বর্ণ লিপি নেই; ধর্ম আছে, কিন্তু লিখিত কোন ধর্মগ্রন্থ নেই। মানুষের মুখে মুখে শ্রুতি হিসাবে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে।

 

◆ ধর্মের আদি দেবতা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। সিং বোঙ্গা হলো সূর্যদেবতা। সূর্যের এমন প্রকাশ অনেক ধর্মেই দেখা যায়। চান্দো শব্দের অর্থও সূর্য। অন্যদিকে মারাংবুরু আদিতে একটি পাহাড়ের নাম ছিল। ধীরে ধীরে তা পরিণত হয় মহাজাগ্রত দেবতায়। বস্তুতপক্ষে সিং বোঙ্গা, চান্দো এবং মারাংবুরুর সাথে ঈশ্বরের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। 

 

◆ শ্রেষ্ঠদেবতা অর্থে ঠাকুরজিউ ব্যবহৃত হয়। খুব সম্ভবত তা পরবর্তীকালে সংযোজিত। অনুরূপ কথা ধর্মদেবতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 

 

◆ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষের বিশ্বাস মতে, আদি দেবতা নিরাকার। স্বর্গ-নরক কিংবা জন্মান্তরবাদের তেমন কোন ধারণা তাদের মধ্যে নেই। ধর্ম-কর্ম আবর্তিত হয় পার্থিব জীবনের মঙ্গল অমঙ্গলকে কেন্দ্র করে। বোঙ্গা মানে নৈসর্গিক আত্মা। তাদের মতে, আত্মা কখনো মরে না; সর্বদা পৃথিবীতেই বিচরণ করে। 

 

◆ বোঙ্গারাই সুখ-দুঃখের নিয়ন্তা। সাঁওতাল ধর্মীয় জীবনের অধিকাংশ স্থান জুড়ে বোঙ্গাদের অবস্থান। এমনকি প্রত্যেক বাড়ির জন্য গৃহদেবতা হিসেবে আবে বোঙ্গা থাকে। আদিতে মূর্তিপূজা না থাকলেও ইদানিং দূর্গা ও শ্যামা পূজার মতো দাঁসাই উৎসব এবং মাই বোঙ্গার পূজা চালু হয়েছে। 

 

◆ লোক-সংস্কৃতি সাঁওতাল সমাজ একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। জীবনের নানান সত্যকে বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করার জন্য গড়ে উঠে লোকজ গল্প ও কাহিনী এবং শ্লোক। যেমন-

 

◆ দারে সাকাম সাগে নেনা

ঞুরুঃলাগিৎ চান্দো পালোঃ লাগিৎ

নিংমাঞ জানা মাকান নোয়া ধারতিরে

বাংদঞ টুণ্ডোং চান্দো বাং দঞ বাং আ।।

 

◆ ভাবার্থঃ গাছের পাতা ঝরে যাবার জন্য আসে। আর পৃথিবী থেকে সরে যাবার জন্য আমি জন্মগ্রহণ করলাম।

 

◆ এরকম অজস্র গল্প রয়েছে। আবার যাপিত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ভেতর জন্ম নিয়েছে নানান বিশ্বাস ও সংস্কার। অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় ফসল লাগালে অমঙ্গল হয়, চুল ছেড়ে গোশালায় গেলে গৃহপালিত পশুর অকল্যাণ ঘটে, রাতে এঁটো থালা বাইরে ফেললে দারিদ্রতা আসে- প্রভৃতি কালের ব্যবধানে বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়েছে। 

 

◆ এছাড়া সুলক্ষণা ও কুলক্ষণা নারীর বৈশিষ্ট্য, যাত্রা শুভ কিংবা অশুভ হবার কারণ, বৈবাহিক সম্পর্কের ঠিক-ভুলের প্রতীক প্রভৃতি তাদের বিশ্বাস ও সংস্কারে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে লোক-সংস্কৃতির অফুরন্ত উপাদানে সমৃদ্ধ সাঁওতাল সমাজ। 

 

◆ হাজার হাজার বছর ধরে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির লালন করছে কিন্তু হাজার বছর ধরে হিন্দু ও মুসলমান সমাজের সাথে বসবাস করেও সাঁওতাল সমাজ তাদের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হতে দেয়নি। ক্ষুন্ন হতে দেয়নি দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা। 

 

◆ প্রতিদিনের প্রকৃতি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিশ্বাস এবং নৈতিক মূল্যবোধের আদর্শকেও কালিমালিপ্ত হতে দেয়নি। আদিবাসী সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য এখানেই।

 

◆ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অনেকটা বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করছিল। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের দামিনিকোতে বসবাস নির্দিষ্ট করে। স্থানটির পরবর্তী নাম হয় সাঁওতাল পরগণা।

           ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

           ◆ ◆ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহ।◆ ◆ 

 

ভারতীয় ইতিহাসের সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটে ১৮৫৫-৫৬ সালে। ১৯৪৫ সালে ঠাকুরগাঁওয়ে তেভাগা আন্দোলনে শহিদ ৩৫ জনের অনেকেই সাঁওতাল কৃষক ছিলেন। তারা ১৯৫০ সালে নাচোলে কৃষক বিদ্রোহের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন।

 

◆ ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন। ইংরেজ শাসন, জমিদার এবং নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হঠাৎ বীরভূমের মাটিতে আগুন জ্বলে উঠে। নেহায়েত দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আধুনিক বন্দুক কামানের মুখোমুখি হয়েও ব্রিটিশ মসনদ কাঁপিয়ে দিয়ে ছিল। সিধু, কানু, চান্দ ও ভৈরবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক বছরের মাথায় বিদ্রোহ স্তিমিত হলো বটে। কিন্তু গোটা ভারতের মোহনিদ্রা ভেঙে দিয়ে গেলো। জন্ম নিলো অধিকার সচেতনতা। 

 

◆ তার দলিল ঠিক পরের বছর থেকেই এই মাটিতে একের পর এক বিদ্রোহ। বিপ্লব ছোঁয়াচে রোগের মতো কী না! ইতিহাসের পাতায় ঘটনাটি সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল নামে স্বীকৃত। আর এর মধ্যে দিয়ে আলোচনায় আসে একটা আদিবাসী জনগোষ্ঠী- সাঁওতাল।

 

◆ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও সাঁওতাল যুবকদের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল।

 

◆ বিদ্রোহের পর ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের পরাজয়ের ফলে আবার বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে তারা। ছড়িয়ে পড়ে বাংলা, ত্রিপুরা ও উড়িষ্যায়। দীর্ঘদিন বন জঙ্গলে কেটেছে।

 

◆ জমি হারানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট থেকে ভারতের অন্তত ১৭টি রাজ্য থেকে ১০ লাখেরও বেশি বনবাসী উপজাতি ও অন্যান্য জনজাতি পরিবারগুলিকে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন।

 

◆ ২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কিছু অরণ্যপ্রেমী সংগঠনের দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে এই নির্দেশ৷

 

◆ এদের উচ্ছেদ করার পেছনে আপাত কারণ হলো, খনি ও কলকারখানার জন্য আরো জমি চাই৷ জীববৈচিত্র্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিল্পোদ্যোগীদের হাতে জমি তুলে দেওয়া চাই৷ ঝাড়খন্ডে কয়েক হাজার বনভূমি এলাকা আদানি কোম্পানির লোকজন দখল করে নিয়েছে।

           ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

        ◆ ◆ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ।◆ ◆ 

 

◆ ভারতে প্রায় চার কোটি হেক্টর বনভূমিতে বসবাস করে প্রায় ১০ কোটির বেশি আদিবাসী ও অন্যান্য জনজাতি৷ আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে প্রায় ৩২ থেকে ৩৫ কোটি। 

 

◆ এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ার ইনুইট বা এস্কিমোস, উত্তর ইউরোপের সামি, নিউজিল্যান্ডের মাওরি অন্যতম। মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ আদিবাসী বলিভিয়ায় আছে। পেরু ও গুয়াতেমালায় অর্ধেক লোকই আদিবাসী। চীন, মায়ানমারেও বহু আদিবাসী রয়েছে। 

 

◆ ভারতে প্রায় ১০.৪ কোটি আদিবাসী জনগণ বসবাস করেন যা ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮.৬ %। পশ্চিমবাংলায় প্রায় ৬০ লক্ষ আদিবাসীর বাস যা পশ্চিমবাংলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬ %। মূলধারার জনগোষ্ঠীর থেকে আদিবাসীদের পৃথক জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস আছে।

 

◆ পশ্চিমবাংলায় মোট ৪০ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘Schedule Tribe (ST) বা তফশিলি উপজাতি’ হিসেবে সরকারী সুযোগ সুবিধা প্রদান করার জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

           ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ ◆ সংযুক্ত রাষ্ট্র সংঘের (United Nations Organization – UNO) ◆ ◆ 

 

আলোচনায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এ বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়েছে। ১৯৯৩ সালকে “আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠী বর্ষ“ ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত “আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠী দশক“ ঘোষণা করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসীদের উদ্বেগের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া। 

 

◆ এছাড়া ১৯৯৫ সালের ৯ আগস্ট কে “বিশ্ব আদিবাসী দিবস“ ঘোষণা করা হয়। সংযুক্ত রাষ্ট্রসংঘ (United Nations Organization – UNO) ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়।

       ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

              ।। কর্মজীবন ও বিবাহ ।।

 

◆ লাজবতীর মা ঘুম থেকে উঠে তার মেয়ে কে বলেন:- ভোর হয়ে গেছে বই রেখে একটু ঘুমিয়ে নে। বলে বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইগুলো গোছগাছ করে হারিকেনের আলো নিভিয়ে দেয়।

 

◆ কয়েক এক সপ্তাহ পর কলেজ জীবনের এক অন্তরঙ্গ বন্ধু বিকাল চারটার সময় একটা কাগজ হাতে করে লাজবতী বাড়িতে সাইকেল নিয়ে উপস্থিত হয়।    

 

◆ লাজবতী সাইকেলের আওয়াজ শুনে দুই রুম বিশিষ্ট পাকা ঘর থেকে বেরিয়ে বলে :- আরে সত্যানন্দ তুমি তা কি মনে করে! ঘরের মধ্যে এসো বসো।

 

◆ দুজনেই ঘরের বারান্দায় আসে তারপর লাজবতী উপস্থিত পাড়ার ছেলে মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলে :- তোমরা আজ বাড়ি চলে যাও, কাল থেকে আবার পড়াবো।

 

◆ সত্যানন্দ বলে :- তোমার জন্য একটা সুখবর আছে কিন্তু তুমি কলেজে যাচ্ছ না কেন! 

 

◆ লাজবতী এক গাল হেসে বলে :- কিছু সমস্যা আছে তাই। তোমার মতো আর আদরের ঘরের দুলালী নয়। পড়াশোনার পাশাপাশি আবার পেট ভরানোর জন্য কাজ কর্ম করতে হয়।

 

◆ সত্যানন্দ বলে :- তুমি বিএ পাস করেছো বলে কাগজ হাতে ধরিয়ে দেয়।

 

◆ লাজবতী ফলাফলের কাগজ হাতে নিয়ে মা মা বলে ডাকতে থাকে।

 

◆ সত্যানন্দ বলে :- তোমার কথা বাবা মাকে জানিয়ে দিয়েছি।

 

◆ লাজবতী বলে :- উত্তর দিলেন নিশ্চয়ই, ওই কালো আদিবাসী মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না।

 

◆ সত্যানন্দ বলে :- না, বাবা মা বিয়েতে রাজি আছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে আসবে।

 

◆ লাজবতী বলে :- আমার কপালে এত সুখ সইবে তো।

 

◆ সত্যানন্দ হাসতে হাসতে ব্যাগ থেকে মিষ্টির প্যাকেট বের করে বলে :- শাশুড়ি কে দেখতে এলাম, তাই মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এলাম। 

 

◆ লাজবতী হাসতে হাসতে বলে :- শাশুড়ির মেয়েকে তো নয়। তাহলে যাই শাশুড়ির জামাইয়ের জন্য কিছু জল খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়ে আসি। তোমার শাশুড়ি মা কিছু জিনিসপত্র আনার জন্য দোকানে গিয়েছে।

 

◆ সত্যানন্দ বলে :- এখনো কি তোমরা দিনমজুরির কাজ করো?

 

◆ লাজবতী বলে :- তিনটে প্রাইভেট পরিয়ে আমাদের চলবে কিভাবে! মাঝে মধ্যে মায়ের সাথে যেতে হয়। বিকালে একটি গ্রুপে পাড়ার ছেলে মেয়েদের বিনামূল্যে পড়ানো হয়। যাতে শিক্ষার আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

 

◆ সত্যানন্দ বলে :- তোমার মায়ের দায়িত্ব আমি নিলাম আর তোমাদের দিনমজুরির কাজে যেতে হবে না। আমি তো পড়াশোনার পাশাপাশি একটা ছোটখাটো ব্যবসা করছি।

 

◆ লাজবতী বলে :- দেখো তোমার শাশুড়ি কি বলে?

 

◆ সত্যানন্দ মুড়ি চিবাতে চিবাতে বলে :- তুমি তো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহী নারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছো কিন্তু আমার বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ করে উঠবে না তো।

 

◆ লাজবতী হাসতে হাসতে বলে :- সংসার জীবনে তুমি যদি অন্যায় কাজ কর, তাহলে তো আমাকে বিদ্রোহী বউ করতেই হবে। না হলে বিদ্রোহী নারীর সম্মান থাকবে।

 

◆ সত্যানন্দ বলে :- তোমার সংগঠনের কাজকর্ম কেমন চলছে।

 

◆ লাজবতী বলে :- কয়েকটি এনজিও র মাধ্যমে উন্নয়নের চেষ্টা করছি।

 

◆ সত্যানন্দ বলে :- প্রয়োজন হলে বলে যদি সহযোগিতা করতে পারি।

 

◆ কয়েক মাসের মধ্যে লাজবতী মা মারা যায়। তারপর লাজবতী মায়ের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আবার দাম্পত্য জীবনের সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সংসারের মাঝে থেকেই শশুর শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করতে থাকে।        

 

              --------------------------------------------~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ রচনাকাল :- ৬ মার্চ ২০২২ সালে।

শ্রী শ্রী মা সেবাশ্রম,খাটুয়া,দোলন ঘাটা,মাঝদিয়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ,ভারত।   

◆ সংশোধন :- ৩ আগস্ট ২০২৩ সালে।

আশ্রম খাটুরা-দোলন ঘাটা, মাঝদিয়া, নদীয়া।

 

 

।। অবলম্বনে ও তথ্য সূত্রে ।।

◆ (০১) দেবব্রত সিংহ রচিত কবিতা 'তেজ' ।

মু জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু 

 কঁইরির বিটি সাঁঝলি বটে। 

◆ (০২) বাংলাদেশের সাঁওতাল: সমাজ ও সংস্কৃতি, মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, নভেম্বর ১৯৯১

◆ (০৩) বাংলাদেশের আদিবাসী সংস্কৃতি, ড. মাযহারুল ইসলাম তরু, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৭, পৃষ্ঠা- ৩১-৪২ এবং ১০৭-১১৭

◆ (০৪) বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা, খুরশীদ আলম সাগর, শোভা প্রকাশ, ঢাকা

◆ (০৫) আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি: সাঁওতাল

 

----------------------------------------------------------~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

 

                                                         গল্প নম্বর :- ৪

 

ধর্মের নামে জাতপাতের লড়াই।

 

         গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

◆ রচনার শ্রেণী :- সামাজিক ছোট গল্প। 

বিষয় :- সমাজের জাত পাতের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কাহিনী।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ অনিন্দিতা রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবে :- আধুনিক সভ্য সমাজের ভদ্রলোক লোকেরা একুশ শতকে দাঁড়িয়ে, উচ্চ বর্ণের তৈরি করা আদিকালের নিয়ম অনুসারে ছোট জাতের মানুষের সাথে উচু সমাজের মানুষের মেলামেশা পর্যন্ত করতে দেওয়া হয় না।

 

◆ ছোট জাতের লোক কোন কারণবশত উচ্চ বর্ণের মানুষের স্পর্শ হয়ে যায় তবে হনুমানের লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দেয়।

 

◆ শিশু কাল থেকে শুনছি আমাদের হরিজন জাত নাকি সমাজের কাছে সব থেকে নিকৃষ্ট জাতির মানুষ।

 

◆ উচ্চ বর্ণের হিন্দু পন্ডিত গণ বলেন :- ধর্ম শাস্ত্র চার বর্ণের মানুষের কথা উল্লেখ আছে কিন্তু নিম্নবর্ণের হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষের কথা উল্লেখ নেই। বেদ ধর্মের বাইরের নিম্ন বর্ণের মানুষ , যাদের সংস্পর্শে পাপ হয়। 

 

◆ ব্রাক্ষণ সর্ব জাতির শ্রেষ্ঠ তাকে সম্মান করা সকল বর্ণের কর্তব্য। তাদের কাজ পূজা পার্বণ করা আর ধর্ম বিষয়ক সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মের জ্ঞান দান করা।

 

◆ অনিন্দিতা আপন মনে বলে উঠে :- কিন্তু ধর্মের নামে অপপ্রচার ও নিজেদের অর্থাৎ সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে জাত পাতের লড়াই লাগিয়ে দিয়ে কিন্তু উচ্চ বর্ণের মানুষের স্বার্থ কে বজায় রাখতে বিভিন্ন নিয়ম কানুন তৈরি করছেন। 

 

◆ আবার একই ঈশ্বরের সৃষ্টি মানুষ কে ছোট জাতের মানুষ বানিয়ে সামাজিক ভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন করা কি কখনো ঠিক?

 

◆ আধুনিক সভ্যতার সময়ে দাঁড়িয়ে এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাত পাতের দোহাই দিয়ে কথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের শিক্ষা লাভের থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে।

 

◆ ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় রাজনীতি শাসক দল 

প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের সম্প্রদায়ের কতজন মানুষ পাকা ঘর পেয়েছে। এখনো সেই মাটির ঘর আর উপরে খয়ের চাল দিয়ে বসবাস করতে হয়।

 

◆ বি আর আম্বেদকর সাহেব বাবার সংবিধান অনুসারে নিম্ন বর্ণের মানুষের উন্নয়ন করার কথা উল্লেখ আছে কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধার মতো কেউ নেই। কারণ লোকসভা ও বিধানসভার সকল সদস্যরা উচ্চ বর্ণের মানুষ।

 

◆ অনিন্দিতা আবার পুরনো দিনের স্মৃতির পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে ভাবে শিশু কালের প্রথম স্কুল জীবনের কথা।

 

◆ আমি বাবার সাথে পড়াশোনা করার আগ্রহ নিয়ে মনের আনন্দে স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম।

 

◆ উচ্চ বর্ণের সমাজের মাস্টার মশাই ব্যঙ্গ করে বলেন :- अरे पेची; जब आप अपनी शिक्षा सीखेंगे तो आपका क्या होगा? 

पढ़-लिख के विद्वान बनने की जरूरत नहीं है। घर जाओ और अपनी माँ के काम में मदद करो और मजदूरी के लिए खेतों में काम करो, लेकिन तुम अपने पिता के परिवार के लिए बहुत सारे पैसे लाओगे।

 

◆ অনুবাদ :- আরে পেচি; তোরা হোলি ছোট জাত তা তোদের লেখাপড়া শিখে কি হবে? লেখাপড়া শিখে বিদ্বান হওয়ার কোন দরকার নেই। বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাজে সহযোগিতা কর আর মাঠে ঘাটে দিন মজুরির কাজ করলে কিন্তু বাবার সংসারে অনেক টাকা আসবে।

 

◆ আমি সেই মুহূর্তে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে ছিলাম।

 

◆ বাবা কয়েক এক সপ্তাহ ধরে স্কুলের দরজায় ঘোরাঘুরি করা সহ বিভিন্ন ব্যক্তির হাতে পায়ে ধরে কিন্তু কোন কাজ হয় না । 

 

◆ আমার পড়াশোনা করার আকুল আগ্রহ ও কান্নাকাটি করতে দেখে কিন্তু মধ্যে বর্ণের এক শিক্ষক মহাশয় সকল শিক্ষকদের সাথে লড়াই করতে থাকে, তারপর উক্ত শিক্ষকের দয়া ক্রমে কিন্তু লেখাপড়া করার সুযোগ পায়।

 

◆ অনিন্দিতা দুই হাত উপরে দিকে তুলে কপালে ঠেকিয়ে বলে :- সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক স্বর্গীয় অরবিন্দ শর্মা মহাশয় কে আমার প্রণাম জানাই। 

 

◆ অনিন্দিতা ভাবে :- আমি ছোট জাতের শিশু হওয়ার কারণে স্কুল রুমের দরজায় আসতেই, একজন মাস্টারমশাই চিৎকার চেঁচামেচি করে।

 

◆ মাস্টারমশাই রাগাম্বিত হয়ে আমার দিকে ছুটে আসে আর দূরত্ব বজায় রেখে বেত উঁচু করে দেখিয়ে বলেন :- স্কুল রুমের মধ্যে ছেলে-মেয়েদের সাথে বসা চলবে না। ক্লাস রুমের বাহিরে দরজার পাশে বসতে হবে। আর কোন ছেলে মেয়ে কে স্পর্শ পর্যন্ত করা যাবে না। যদি কোন রকম বেয়াদবি করো, তাহলে ছাল ছাড়িয়ে স্কুল থেকে বিদায় করে দেবো।

 

◆ আমি কিন্তু ভীষণ ভাবে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

 

◆ অনিন্দিতা স্কুল জীবনের প্রথম দিনের ঘটনা স্মরণ করে চোখে জল এসে যায়।

 

◆ অনিন্দিতা চোখের জল মুছে ভাবে, সেই দিন আমার শিশু মনের হৃদয় থেকে বারবার বলছিল, তোকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে হবে। তোর সম্প্রদায়ের মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হবে। 

 

◆ আমি উচ্চবর্ণের ছেলেমেয়েদের স্পর্শ বাঁচিয়ে পড়াশোনা করার জন্য বাড়ি থেকে বসার জন্য পাটের বস্তু নিয়ে যেতাম।

 

◆ আমাদের সম্প্রদায়ের তিন জন ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে পড়াশোনা করতাম, তার মধ্যে একমাত্র আমি মেয়ে ছিলাম।

 

◆ আমি অনিন্দিতা প্রতিদিন স্বপ্ন দেখতাম, যে বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে আমাদের ছোট হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষের শিক্ষা লাভ সহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইত্যাদি বিষয়ে ভাবনা করতাম।

 

◆ সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে লড়াই করতে করতে আমি অনিন্দিতা কখনো ক্লান্ত বোধ অনুভব করিনি।

 

◆ উচ্চ শিক্ষা লাভ করে জীবনের ছোট বেলার দেখা স্বপ্ন কে এক এক করে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি । উত্তর প্রদেশের রাজ্য সরকারের সাথে লড়াই করে করে হরিজন সম্প্রদায়ের গ্রামের মধ্যে প্রাথমিক স্কুলের ব্যবস্থা করেছি।

 

◆ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এখনো জাতপাতের ধর্মের কারণে হিংসা বিরাজমান । আমি অনিন্দিতা উত্তর প্রদেশ , রাজস্থান ও হরিয়ানা সহ বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে দেখেছি উচ্চ বর্ণের সাথে নিম্ন বর্ণের মানুষের হিংসা, অত্যাচার, নির্যাতন ,খুন, ধর্ষণ ও সম্মানহানির ঘটনা।

 

◆ অনিন্দিতা আপন মনে বলে উঠে :- নিম্ন বর্ণের জন্য সরকার যাহা দেয় ,তাহা কিন্তু উচ্চ বর্ণের মানুষের হাত ধরে আসে। কারণ নিম্ন বর্ণের মানুষেরা এখনো সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি আবার রাজনৈতিক দিক দিয়ে মূল্যায়ন করা হয় না।  

 

◆ ভোটের সময় এদের ভোট নাকি ভীষন মূল্যবান। তাই রাজ্যের বড় বড় রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রী আসে, আর গাল ভরা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে। ভোটের পরে যেমন কুঁড়েঘরে বাস তেমনি বাস করতে হয়।

 

◆ সরকারের দেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের কিছু পাওয়ার জন্য কিন্তু উচ্চ বর্ণের মানুষের দয়ার উপর নির্ভর করতে হয়। 

 

◆ উচ্চবর্ণের মানুষ বলে, নিম্নবর্ণের মানুষেরা কিন্তু লেখাপড়া শিখে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে গেলে- আমাদের মূল্যায়ন থাকবে না, যতদিন পারা যায় দাবিয়ে রাখতে হবে।

 

◆ সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে জাত পাতের লড়াই কয়েক হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে।

 

◆ ভারতবর্ষের সংবিধান রচনা কিন্তু এই আমার মতো নিম্ন বর্ণের মানুষ বি আর আম্বেদকর করেন কিন্তু আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষ গুলো কতখানি উন্নতি লাভ করেছে।

 

◆ তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের মহর জাতি অধিভুক্ত ছিলেন। যারা অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে এবং প্রচণ্ড আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। 

 

◆ যদিও ভাগ্যক্রমে আম্বেদকরের বিদ্যালয়ে যাওয়ার অনুমতি লাভ করেন কিন্তু তাকে অন্যান্য অস্পৃশ্য শিশুর ন্যায় আলাদা করে দেওয়া হয়। 

 

◆ শিক্ষকগণ তাদের প্রতি ভীষণ ভাবে অমনোযোগী ছিলেন এবং কোনোরূপ সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করতেন না। 

 

◆ তাদের শ্রেণিকক্ষের ভিতরে বসার অনুমতি ছিল না, এমনকি তাদের যদি তৃষ্ণা পেলো উচ্চবর্ণের কোনো একজন অনেক উঁচু থেকে জল ঢেলে দিতেন কারণ যাতে নিচু জাতের শিক্ষার্থীরা জল পান করা ও পানীয় পাত্র স্পর্শ না করতে পারে । 

 

◆ সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে কয়েকটি প্রদেশের কিছু অংশ বাদে অবহমান কাল ধরে বর্তমান সময় পর্যন্ত জাত পাতের অস্পর্শ প্রথা চলে আসছে।

 

◆ একজন ব্যক্তি কয়েক ফুট উঁচু থেকে জল ঢেলে দেয় তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির দুই হাতের তালুর উপর আর তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি নিজের হাতের তালুতে মুখ লাগিয়ে জল পান করতে থাকে। 

 

◆ ঘটি অর্থাৎ লোটাতে থাকা জলের এক তৃতীয়াংশ মাটিতে পড়ে যায় কিন্তু আবার নতুন করে জল চাইলে, তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি কে অশ্লীল ভাষায় খিস্তি খামারি ছোট জাত বলে বাক্য বানে জর্জরিত করে দেবে।

 

◆ আমি অনিন্দিতা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখেছি, বর্তমান যুগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চবর্ণের মানুষ কিন্তু নিম্ন বর্ণের মানুষকে কোন প্রকার জলপান করতে দেয় না।

 

◆ উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণ মানুষের জন্য আলাদা আলাদা ভাবে জলের কূপের ব্যবস্থা আছে। ভুল করেও কিন্তু কেউ কারের জলের কুপ স্পর্শ করে না। স্পর্শ করলেই কিন্তু মহা বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।

 

◆ বি আর আম্বেদকর উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, জল পান করানো কাজটি সাধারণত আম্বেদকরের জন্য করতো বিদ্যালয়ের চাপরাসি অর্থাৎ স্কুলের পিয়ন। কোন কারণে যদি পিয়ন না থাকতো বা না আসতো, তখন সারাদিন জল ছাড়াই নিম্ন বর্ণের ছাত্রদের কাটাতে হতো।

 

◆ আম্বেদকর এই অবস্থাকে এভাবে আখ্যায়িত করেছেন - "পিয়ন নাই আর পানীয় জল নেই" (নো পিয়ন, নো ওয়াটার)।

 

◆ অনিন্দিতা আপন মনে বলে উঠে :- বি আর আম্বেদকর সাহেব বাবা উচ্চবর্ণের মানুষের সাথে বহু লড়াই আন্দোলন করেও কিন্তু সমাজ থেকে অস্পর্শ প্রথা জাত পাতের জ্বালা যন্ত্রণা অত্যাচার সমূলে বিতাড়িত করতে পারেননি।

 

◆ একুশ শতাব্দীতে সভ্য সমাজের মানুষ বলে অহংকার করে দাবি করে কিন্তু আজও নিম্ন বর্ণের মানুষের স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছে?

 

◆ ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সকল ব্যক্তিগণ সবাই উচ্চবর্ণের মানুষ আর তারা কখনোই চাইবে না নিম্ন বর্ণের মানুষের উন্নয়ন হোক। শিক্ষা দীক্ষায় সামনের দিকে এগিয়ে যাক।

 

◆ অনিন্দিতা বাংলার কোন জনপদ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, বাংলার নিম্ন বর্ণের মানুষ চন্ডাল বা নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর নিজের সম্প্রদায়ের জন্য সমাজ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন করেন এবং সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

 

◆ নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের কিন্তু এখনো উচ্চ বর্ণের মানুষের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। 

 

◆ আমি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেখেছি, ভারতবর্ষের অন্যান প্রদেশের থেকে পশ্চিমবাংলায় জাত পাতের লড়াই ঝগড়া বহু অংশে কম আছে।

 

◆ এখানে ছোট জাত ও বড় জাতের মানুষ কে একসাথে মিলেমিশে চলতে এবং খাওয়া দাওয়া করতে দেখেছি।

 

◆ আমি একজন উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করে ছিলাম। আমি নিম্ন বর্ণের হরিজন সম্প্রদায়ের মেয়ে জানতে পারা সত্ত্বেও কিন্তু আমার জাতপাতের লড়াইয়ে সম্মান জানিয়েছে । তাদের পরিবারের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলে আনন্দ ফুর্তি করে কয়েকদিন কাটিয়ে ভীষণ আনন্দ পেয়েছি।

 

◆ বাংলায় একেবারে জাত পাতের উৎপাত নেই তা কিন্তু বলা যাবে। অন্য প্রদেশ থেকে এখানে অনেক অনেক কম আছে।

 

◆ আমি জন্মসূত্রে উত্তরপ্রদেশের মথুরা জেলার বাসিন্দা ও সমাজের তথাকথিত নিম্ন বর্ণের বাবা-মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। হিন্দু ধর্মের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এখানে জাতপাতের লড়াই ভীষণভাবে সমাজের মধ্যে প্রচলিত আছে।

 

◆ বাংলার জাতপাতের বিরুদ্ধে শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর, লালন ফকির, স্বামী বিবেকানন্দ সহ বহু কবি ও সাহিত্যিক, মুনি-ঋষি এবং জ্ঞানী ব্যক্তিগণ লড়াই ও আন্দোলন করেছেন। 

 

◆ এক ঈশ্বর বাদের সাধনায় মধ্য দিয়ে জাত পাতের লড়াই দূর করার জন্য একসময় ব্রাহ্ম সমাজের আবির্ভাব ঘটেছিল। এই ব্রাহ্ম সমাজে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগদান করেছেন।

 

আমি অনিন্দিতা ধর্ম ও জাত পাত নির্বিশেষে বাংলার মায়ের বুক ভরা ভালোবাসা পেয়েছি, সকল মানুষকে হৃদয় থেকে আমার প্রণাম জানাই।

                        -----------------------------------------------------------~~~~~~~~~~~-----------

◆ রচনাকাল :- ২৬ জুন ২০২৩ সাল।

 দত্তপুলিয়া যুব গোষ্ঠী ক্লাব, নদীয়া।

◆ সংশোধনের তারিখ :- ৪ আগস্ট ২০২৩ সালে। আশ্রম খাটুরা-দোলন ঘাটা, মাঝদিয়া, নদীয়া।

 

----------------------------------------------------~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

 

                                                গল্প নাম্বার :- ৫

 

                 দারিদ্র্যের স্বপ্নভঙ্গ।

       লেখক :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

◆ রচনার শ্রেণী :- বিপর্যয় করোনা ভাইরাসের অনুগল্প।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ সুবীর রাতে স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে মাটির ঘরের মেঝেতে গরিবের খেজুরের পাটির উপর কয়েকটি কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে চালের দিকে তাকিয়ে ভাবে, দারিদ্র্যের সংসারে অনেক স্বপ্ন ছিল কিন্তু সেই স্বপ্ন করোনা নামক ভাইরাসে ভেঙে দিয়েছে। বর্ষা আসার আগেই ঘরের চাল মেরামত করার দরকার, রাতে চাঁদের আলো দেখতে বাইরে যেতে হচ্ছে না। 

 

◆ জীবন জীবিকার কর্মসংস্থান হারিয়ে ফেলেছি। দিন আনা দিন খাওয়া সংসার আর চলছে না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে জমানো টাকা বসে বসে খাওয়া দাওয়া করতে করতে শেষ হয়ে গেছে। ঘর খানা মেরামত করার স্বপ্ন দেখেছিলাম।

 

◆ করোনা ভাইরাসের কারণে মহা বিপদে পড়ে স্বপ্ন দেখা ভুলে গিয়েছি। কর্মের জন্য ঘুরে বেড়ায় কেউ দেয় না কাজ। লোকে বলে কাজ করাতে গিয়ে যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ি।

 

◆ ভয়ে আতঙ্কে সবাই মুখে লাগিয়ে মুখ পট্টি বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাহির হয় না। 

তারপর আবার পুলিশের অত্যাচার, মুখ পট্টি ও দলবদ্ধ ভাবে চলা জমায়েত করা নিষেধ।

 

◆ সরকারি চাকরি করে যারা শতকরা আশি জন কর্ম না করে বেতনের টাকা অ্যাকাউন্ট সরাসরি আসে। আর সাধারণ জনগণের সপ্তাহে কয়েক এক কিলো চাল গম আটা দিয়ে করছে সন্তুষ্ট। 

 

◆ ধনী ও মধ্যবিত্তের মানুষেরা রেশনের জিনিস খায় না, কিন্তু গরু, ছাগল, হাঁস মুরগির খাবার হয়েছে। আমার মত হতদরিদ্রদের নেই কোন উপায়, সরকারের দান মনে করে করি তা আহার। 

 

◆ চারদিকে কর্মহীন ছেলে-মেয়ে আর গৃহিণী, বাজারে দোকান গুলো, গাড়ি-ঘোড়া, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ হয়ে আছে । টাকার অভাবে ছেলে মেয়েদের ব্যক্তিগত পড়ানোর মাস্টারের আসা-যাওয়া বন্ধ। 

 

◆ গৃহিণীর রান্না ঘরে চাল, ডাল, তেল, লবণ ও কাঁচা সবজি নেই কিছু কিন্তু সরকার দান খয়রাতের মাধ্যমে চলবে আর কতদিন।

 

◆ দারিদ্রতা শ্রেণীর মানুষগুলো ভীষণ ভাবে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। ব্যাংকে জমানো টাকা বহুদিন আগে পেটের মধ্যে গিয়ে হজম হয়ে গেছে। 

 

◆ দেনার দায়ে জর্জরিত লোনের কিস্তি ফেল, ঋণদাতা সংস্থার দিদিমণি বলে, কিস্তির টাকা পরিশোধ না করলে আগামী সপ্তাহে এসে ছাগল, গরু,হাঁস মুরগি, সাইকেল ও মোবাইল যা পাবো তুলে নিয়ে যাবো।

               

◆ খাদ্যের অভাবে মানুষ মরতে বসেছে লোন সংস্থা বাড়াবাড়ি সরকার ও প্রশাসনের চোখে পড়ে না। পঞ্চায়েতে অভিযোগ জানিয়ে হয়নি তার কোন সুরাহা। ঋণের দায়ে সব তুলে নিয়ে যায়, জলের দামে বিক্রি করে তবুও ঋণ হয় না শোধ। মরলেও নাকি সব টাকা হবে না শোধ।

 

◆ এই মুহূর্তে মরলেও নাকি শান্তি নাই, মৃতদেহ সৎকার করার কোন লোক নাই। মোটা অংকের টাকা দিয়ে আনতে হবে সরকারি লোক। সাধারণভাবে মৃত্যু হলেও কিন্তু করোনা ভাইরাসের দোষ।

 

◆ সবাই যেন বড় অসহায় করোনা ভাইরাসের কাছে, দেশের অর্থনৈতিক ভেঙ্গে পড়েছে ।

 অর্থনীতি কবে হবে চাঙ্গা হবে আমরা হারিয়ে যাওয়া কাজ ফিরে পাবে।

 

◆ দেশের সরকার কিছু দিন খাবার দিয়েছে কিন্তু মানুষের হয়নি সমস্যার সমাধান, মানুষকে করেছে পঙ্গু । ভিক্ষা নয় কাজ চাই উঠেছে তার স্লোগান।

 

◆ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের কারণে খাদ্য কেলেঙ্কারি সহ অর্থ কেলেঙ্কারি হয়েছে। চোরে চোরে মাসতো তো ভাই তার হয়নি কোনো বিচার। গরীব আরো গরীব হয়েছে আর ধনীরা আরো ধনী হয়েছে, এই তো দেশের হালচাল।

 

◆ করোনা ভাইরাস বিপর্যয়ের মধ্যে আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের বড় বড় বক্তৃতা আর প্রতিশ্রুতি ও ভোট ব্যাংকের লড়াই।

 

◆ এভাবেই যদি চলতে থাকে করোনা ভাইরাস, তাহলে স্বপরিবারে আত্মহত্যা করতে হবে। গরিবের স্বপ্ন কখনো হবে না সফল।

       ------------------------------------------~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ রচনা কাল :- ২৫ ডিসেম্বর ২০২১ খ্রিস্টাব্দে।

 দত্তপুলিয়া বাড়ি থাকাকালীন, নদীয়া।

◆ সংশোধনের তারিখ :- ৫ আগস্ট ২০২৩ সালে। আশ্রম খাটুরা-দোলন ঘাটা, মাঝদিয়া, নদীয়া।

----------------------------------------------------------~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

 

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

 

                                                 গল্প নম্বর :- ৬

 

 শ্মশান যাত্রা-মৃত্যুর মিছিল।

         লেখক :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

◆ রচনার শ্রেণী :- মদ্যপানের পরিণতি ভয়ংকর বাস্তব শিক্ষামূলক ছোট গল্প।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ পাড়ার মধ্যে হঠাৎ করে একটি বাড়িতে মহিলাদের সমবেত কণ্ঠে কান্নার রোল ওঠে। বাড়ির পুরুষেরা ও প্রতিবেশী মানুষেরা ছুটে আসে।

শাশুড়ি মা আর ইহজগতে নেই, ঘরের মধ্য থেকে আওয়াজ ভেসে আসে।

 

◆ বাড়ির বধূরা চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ির পুরুষদের প্রতি বলে :- মায়ের লাশ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে উঠানের তুলসী তলায় নিয়ে যাও। আর ঘরের মধ্যে থাকার কোন অধিকার নেই। যতক্ষণ মৃতদেহ ঘরের মধ্যে থাকবে ততক্ষন তোমাদের অমঙ্গল হবে।

 

◆ বাড়ির বধূরা মৃতদেহের গাঁয়ের সোনার গয়না গুলো খোলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় যে যেমন ভাবে পারে সব খুলে নিতে থাকে। মৃত দেহের তো আর কষ্ট বোধ নেই, হয়তো দেহের কোন অংশ ছিঁড়ে গেল তবুও গয়না কিন্তু হাত ছাড়া করা যাবে না।

 

◆ সংবাদ শুনে মৃতের দুই মেয়ে কান্নাকাটি করতে করতে চোখের জলে বুক ভিজিয়ে তাড়াহুড়ো করে মায়ের পাশে এসে হা হুতাশ করে আক্ষেপ করে বলে :- মা; মরতে না মরতেই মায়ের গয়না গুলো কোথায় গেল? 

 

◆ বাড়ির বড় বধু বলে :- মায়ের গয়না গুলো সব বাক্সে আছে কিন্তু ননদী ভাগ নিতে হলে আমার দল ভারী করো। 

 

◆ ছোট মেয়ে মায়ের মৃতদেহের কাছে গিয়ে কান্না করতে করতে বলে :- "মা, তুমি চলে গেলে কিন্তু আমার ছেলে-মেয়ের জন্য কিছু দিয়ে গেলে না, দাদা-বৌদিরা আমাদের কি আর নগদ টাকা ও গয়নার ভাগ দেবে?

 

◆ লোকে বলতে থাকে, সুমনের মা রোগে শোকে ভোগের চেয়ে চলে গিয়ে ভালোই হয়েছে। এখন লোকজন দেখে মৃতের দেহ সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে। 

 

◆ একজন বয়স্ক প্রতিবেশী এসে বলে :- আরো সুমন, তোর মাকে কোন শ্মশানে নিয়ে যাবে। 

 

◆ বাড়ির বড় বউ কান্না করতে করতে বলে :- মা; মরার আগে নবদ্বীপ গঙ্গার ঘাটে তার দেহ সৎকাজ করার কথা বলে গিয়েছেন।

 

◆ বয়স্ক প্রতিবেশী বলেন :- তাহলে তোমার মাকে নবদ্বীপ গঙ্গা ঘাটে নিয়ে গিয়ে মৃত মায়ের আত্মার শান্তি দান করো। তার আগে প্রতিবেশীদের নবদ্বীপ যাওয়ার জন্য নেমন্তন্ন করে আসো।

 

◆ বাড়ি মেজো ছেলে স্বপন আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের নবদ্বীপ যাওয়ার জন্য আহ্বান করতে থাকে। বাড়ির বড় ছেলে এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করে একটি লরি নিয়ে সন্ধ্যার সময় উপস্থিত হয়। 

 

◆ মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার আগেই কিছু সংখ্যক মানুষ ও লরি চালক মৃতের বাড়ির পাশের বনের মধ্যে গিয়ে বিভিন্ন গাছপালা ঘেরা বনের অন্ধকারের মধ্যে পরিষ্কার জায়গা দেখে মদ পানের আসর শুরু করে। শ্মশান যাত্রীদের মদ্যপান করা, সমাজের মানুষের কাছে প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মদ্যপান নাকি দুঃখ ভুলে এক আনন্দ উৎসব। 

 

◆ একজন মদপানকারী চালকের উদ্দেশ্য বলে:- এই তুই বেশি খাস না কিন্তু গাড়ি চালাতে হবে।

 

◆ অন্য আরেকজন শ্মশান যাত্রী প্লাস্টিক গ্লাসের মদ পান করে বলে :- মৃতের বাড়ি থেকে দামি মদ দিয়েছে কিন্তু চাট (খাবার) ভালো হয়নি, বাদাম ছোলা দিয়ে এই মাল খাওয়া যায়। সুমনের টাকার অভাব নেই কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর বড় ছেলে হিসেবে সুমন বাড়ির অভিভাবক।

 

◆ চালক বলে :- আরে এইটুকু মদ পান করে কি হয় ? এর থেকে কত বেশি বেশি মদ পান করে কলকাতার রাস্তায় গাড়ি চালায় । 

 

◆ আশুতোষ নামে একজন শ্মশান যাত্রী পকেট থেকে দুশত টাকা বের করে মদনের হাতে দিয়ে বলে :- মদনা; পাশের বাজার থেকে ঘুগনি, চপ ও সিগারেট নিয়ে আয়। আর টাকা বাঁচলে তোর যা মন চায় নিয়ে আসবে। 

 

◆ মৃতের বাড়ির টাকায় মদ পেয়ে বিভিন্ন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তাদের বাড়ির আশপাশ সহ বিভিন্ন জায়গায় মদের আসর বসে। বাড়িতে কিছু লোকজন ঘরের মধ্যে আড়ালে গিয়ে শোক কে ভোলার জন্য হালকা করে পান করে নেয়। মৃতের বাড়িতে আশপাশ দেখে মনে হচ্ছে শোকের বদলে পুরুষদের মধ্যে মদ্যপানের আনন্দ চলছে। 

 

◆ ব্যতিক্রম শুধু মেয়েরা তাদের নাকি এইসব ছোঁয়া একদম বারণ, শুধু কান্নাকাটি করে যেতে হবে । বাড়ির বৌ সহ মেয়েরা যত বেশি কান্নাকাটি করবে, মৃতের আত্মা নাকি বেশি শান্তি পাবে। 

 

◆ শ্মশান যাত্রীদের পরিচালক পাড়ার শৈলেন বিশ্বাস চারদিকে ঘোরাঘুরি করে দেখার পর আরেক প্রতিবেশীর উদ্দেশ্য করে বলেন :- আধুনিক সভ্যতায় শিক্ষিত নারীদের মধ্যে সীমিত সংখ্যায় হলো লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরের মধ্যে মদ্যপান করতে দেখা গিয়েছে কিন্তু এটা নাকি নারী স্বাধীনতা ভোগের আধুনিকতার ছোঁয়া। 

 

◆ শৈলেন বিশ্বাসের তৎপরতায় অবশেষে শ্মশান যাত্রীগণ মদ পান করা শেষ করে, বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দিক থেকে মৃতের বাড়িতে আসতে থাকে। 

 

◆ পুরুষেরা মদ্যপানে উত্তেজিত হয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে উঠে, বলো হরিবোল বলো হরিবোল বলতে বলতে মৃতদেহের যথাযথ গ্রামের আচার ও মেয়েলি আচরণ পালন করার পর উঠানের থেকে মৃতদেহ লরিতে তোলার ব্যবস্থা করতে থাকে। আর মৃতের পিছনে থাকা বাড়ির বউ গুলো গোবর জলের ঝাঁটা দিয়ে ঝাঁট দিতে থাকে। অর্থাৎ মৃত দেহকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেওয়া।

 

◆ একটা ম্যাটাডোরের মধ্যে মরদেহ তোলার পর আর একটা লরি ও কয়েকটি প্রাইভেট গাড়ি সহ জীবিত মানুষগুলো রওনা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে বলো হরিবোল বলো হরিবোল চিৎকার করতে থাকে। 

 

◆ ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বাগদা থানার সিন্দ্রানি পঞ্চায়েতের অধীনে নলডুগারি এলাকা পার মদন ফরেস্ট (অর্থাৎ বিভূতিভূষণ অরণ্য) নামক গ্রামের বৃদ্ধা শিবানী মুহুরী ২৭ শে নভেম্বর ২০২১ সালের শনিবার দুপুর তিনটে নাগাদ মারা যান। আর রাতে তার দেহ দাহ করার জন্য শিশু, মহিলা ও পুরুষদের নিয়ে প্রায় ৪৭ জন শ্মশান যাত্রী নবদ্বীপ শ্মশানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। 

 

◆ মৃত শিবানী মুহুরীর প্রতিবেশী গ্রামের ছেলে প্রসেনজিৎ দাস একুশ বছরের যুবক চালকের আসনে বসে। শ্মশান যাত্রীগণ কে নিয়ে দ্রুত লড়ি চলতে থাকে, পার মদন ফরেস্ট গ্রাম থেকে বেরিয়ে নলডুগারি, সিন্দ্রানি ও নদীয়া জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম দত্তপুলিয়া হয়ে বগুলা এলাকার একটি বারের (অর্থাৎ মদের কাউন্টার) সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেয়। দীর্ঘক্ষণ ধরে খাওয়া-দাওয়া সাথে মদ্যপানের আসর চলতে থাকে।

 

◆ বগুলা থেকে কৃষ্ণনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় কিন্তু ঊর্ধ্বে গতিতে গাড়ি চলতে থাকে। কেবিনের মধ্যে থাকা মানুষেরা চালককে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও কিন্তু গাড়ি গতিবেগ কমাতে রাজি হয়নি। 

 

◆ চালক প্রসেনজিৎ দাস বলে :- গাড়ির গতিবেগ এমন কিছু নেই, চিন্তা করবেন না। আপনারা ঘুমিয়ে পড়ুন আর নবদ্বীপ শ্মশানে নিয়ে গিয়ে ডেকে দেবো। গাড়ি চালানোর সময়ে কিন্তু একদম আমাকে বিরক্ত করবেন না।

 

◆ অতিরিক্ত মদ পানের কারণে চালক প্রসেনজিৎ দাস ঝিমাতে ঝিমাতে গাড়ি চালাতে থাকে। গাড়ি দ্রুত গতিতে চলতে চলতে হাঁসখালি পেরিয়ে ফুলবাড়ী গ্রামের একটি মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে কেবিনের মধ্যে থাকা লোকজন কিছু বুঝে উঠার আগেই, বিকট আওয়াজ হয়ে রাত একটা নাগাদ ভয়াবহ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। ২৮ শে নভেম্বর ২০২১ সালের রবিবার। 

 

◆ রাস্তার পাশে বসবাসকারি পরিতোষ বিশ্বাস টোটো চালক আওয়াজ শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পায়। প্রধান সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের লরির সঙ্গে মৃত লাশের ম্যাটাডোর ভয়াবহ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।

 

◆ ম্যাটাডোরের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষেরা দলা পাকিয়ে আছে। রক্তে রাস্তা ভেসে যাচ্ছে। মৃতের লাশের সাথে জীবিত মানুষ গুলো পড়ে আছে। লাশের ও মানুষের চাপা পড়ে আতঙ্কে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ম্যাটাডোর দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে গিয়েছে। অসংখ্য মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে এবং সাথে সাথে কয়েক জনের মৃত্যু ঘটে।  

 

◆ চালক গাড়ির স্টারিং এর মধ্যে মাথা ঢুকে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে। এমন ভয়ঙ্কর অবস্থা অর্ধ মৃত মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি করতে ভুলে গেছে। চারদিকে লাশ আর লাশ। পরিতোষ বিশ্বাস তৎপরতার সাথে থানা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে। 

 

◆ পরিতোষ বিশ্বাস বলেন :- বাথরুম করার জন্য উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দ্রুত বেগে গাড়িটি বেড়িয়ে যায় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিকট আওয়াজ ভেসে আসে।

 

◆ দুর্ঘটনাস্থল থেকে তিন জন মানুষকে উদ্ধার করতে পেরেছি। চিৎকার চেঁচামেচি করে লোকজন উপস্থিত হলেও, শীতের রাতে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার কাজে কোন সহযোগিতা করেনি।

 

◆ হয়তো পুলিশের ঝামেলার ভয়ে বা মরার গাড়ি বলে। স্থানীয় লোকজন যদি সহযোগিতা করতেন, তাহলে ৪৫ মিনিটে আরো অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারতাম।

 

◆ রাত ১:৪৫ নাগাদ হাঁসখালি থানার পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স উদ্ধার কাজ শুরু করেন। এরপর রাত দুটো ৫ মিনিট নাগাদ আহতদের নিয়ে প্রথম গাড়ি কৃষ্ণনগর শহরের শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ঢুকে পড়ে।

 

◆ উদ্ধারের কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারাদেশে খবরের শীর্ষে চলে আসে। 

 

◆ স্বজন হারানো ব্যক্তির অভিযোগ :- হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ও ডাক্তারদের গাফিলতি এবং সহযোগিতা না করার জন্য অনেক রোগী মারা গিয়েছে, প্রায় চার ঘণ্টা পর চিকিৎসা শুরু করা হয়েছে।

 

◆ স্বজন হারানো আরেক ব্যক্তি বলেন :- পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবে কিন্তু আহত মানুষের চিকিৎসা তৎপরতা শুরু হয়।

◆ সাধারণ মানুষের কথার কোন মূল্য নেই। নির্দেশ যখন দিতে হবে, তখন রাতে কেন দেয়নি। 

◆ দেশের রাজনৈতিক নেতাদের তৎপরতায় কিন্তু মৃতের সংখ্যা কমানো যায়নি।

◆ মোট ২১ জন মৃত ব্যক্তির মধ্যে কিন্তু একই পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু ঘটেছে। 

◆ রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রী আসে কিন্তু তবুও লাশের সংখ্যা বেড়ে যায়। 

 

"সময়ের অবহেলায় সাধারণ মানুষের, অকারণে জীবন চলে যায়।" 

 

◆ রাজনৈতিক নেতারা ও সরকারি আমলা গণ মানুষের মৃত্যুর পরে লোক দেখানো, নানা রকম আয়োজনের মাধ্যমে ঘটা করে বক্তৃতা ও অনুষ্ঠান চলতে থাকে । 

 

◆ দেশে মদ পান করার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না করে কিন্তু দেশের কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজনৈতিক নেতারা টিভির পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে বড় বড় বক্তৃতা আর গাল ভরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলছে । আসল কাজের বেলায় সব ফাঁকা কিন্তু আজকের যুব সমাজ মদের জন্য একদম শেষ।

 

◆ সাধারণ মানুষ বলছে :- মদের দাম কমানোর জন্য কিন্তু মদ্যপায়ীরা বেশি বেশি করে মদ পান করা শুরু করেছে। মদ বিক্রি করে নাকি সরকারের সবচেয়ে বেশি রাজকোষে টাকা আসে। 

 

◆ এর জন্য মাস্টার পদ্ধতিতে মদের দাম কমিয়ে দিয়েছে। বেশি বিক্রি হলে বেশি লাভের আশায়। 

◆ একটি মানুষের জীবনের দাম মাত্র দু লাখ টাকা নির্ধারণ করেছেন।

 

◆ স্থানীয় রাজনীতি এক নেতার কথা :- মদ বেশি করে বিক্রি না হলে মাসে মাসে জনগণকে খয়রাতের টাকা দেবে কি করে ? লক্ষ্মী ভান্ডার সহ আরো যে কত ভান্ডারের টাকা দিতে হয়।

 

◆ স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ :- রাস্তায় মানুষের কোন নিরাপত্তা নেই। 

◆ রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাত পেতে টাকা নেওয়ার জন্য পুলিশ ও সিভিক আছে কিন্তু মদ পান করে গাড়ি চালকের নিয়ন্ত্রণ করার সময় পুলিশ বা সিভিক নেই কেন? 

 

◆ রাতে হাঁসখালি বাসস্ট্যান্ড পুলিশ পাহারা থাকে কিন্তু সেই রাতে কোথায় ছিল ? 

 

◆ প্রতক্ষদর্শী মানুষ গুলো বলেন :- হাঁসখালির রাস্তা দিয়ে ম্যাটাডোর দ্রুত বেগে ছুটে চলেছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করার মতো সেই সময়ে কোন পুলিশ পাহারায় ছিল না। 

 

◆ সরকারের প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা খরচ করে, এই সব দায়িত্বহীন পুলিশের রেখে লাভ কি?

 

◆ মানুষের বাঁচার কি কোনো পথ নেই?

                    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~-----------------------------------

◆ রচনাকাল :- ২৯ শে নভেম্বর ২০২১ খ্রিস্টাব্দে। স্থান :- দত্তপুলিয়া যুব গোষ্ঠী ক্লাবের, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

◆ সংশোধনের তারিখ :- ৬ আগস্ট ২০২৩ সালে। কবি বিপুল ঘোষ মহাশয়ের বাড়ি,মাজদিয়া, নদীয়া।      

----------------------------------------------------------~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

          

                                                           গল্প নম্বর :- ৭

 

 খেলা মারাত্মক নেশা।

 

লেখক :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

◆ রচনার শ্রেণী :- লুডু খেলার নেশাগ্রস্ত ভয়ানক পরিণতি। শিক্ষামূলক ছোট গল্প

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ ভারতবর্ষের প্রাচীন গ্রন্থ মহাভারতের কাহিনী থেকে জানা যায়। পঞ্চপান্ডব হস্তিনাপুর রাজসভায় একদিন পাশা খেলায় সবকিছু হারিয়ে সর্বশেষে তাদের স্ত্রী দ্রৌপদীকেই বাজি রেখেছিলেন। বিপক্ষের কাছে পঞ্চপান্ডব পরাজিত হয় আর রাজসভার মধ্যে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মধ্য দিয়ে শ্লীলতাহানির প্রচেষ্টা হয়েছিল। এই শ্লীলতাহানির কারণে ভয়ংকর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

 

◆ ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের প্রতাপগড় এলাকার রামপুর বেলহার বাসিন্দা রেনুকা নামের এক মহিলার লুডু খেলার নেশায় মত্ত হয়ে বাড়ির মালিকের কাছে হেরে গিয়ে রক্ষিতা হয়ে বসবাস করছেন। ঘটনা ৫ ডিসেম্বর ২০২২ সালে প্রকাশ্যে আসে।

 

◆ রেনুকার স্বামী অনিন্দ্যম কর্মসূত্রে রাজস্থানের জয়পুর বসবাস করে। তার স্বামী প্রয়োজনমত নিয়মিত টাকাও পাঠাতে থাকে। স্বামীর টাকায় রেনুকা তার বাড়ির মালিকের সাথে নিয়মিত বাজি ধরে লুডু খেলার পিছনে খরচ করতে থাকে। ধীরে ধীরে মারাত্মক লুডু খেলার নেশায় জড়িয়ে পড়ে। স্বামী কর্মক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার কারণে কিছুদিন টাকা পাঠাতে অসুবিধা হয়। রেনুকা দুটি সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে ওঠে তারপর বাড়ি ভাড়া দীর্ঘদিন ধরে বাকি পড়ে যায়।

 

◆ বাড়ির মালিক একদিন লুডু খেলা শুরু করার আগে বলেন :- বাজি না ধরলে খেলা করতে পারব না।

 

◆ রেনুকা বলে :- সংসার চালাতে পারছি না তারপর বাজি ধরার মতো কোনো টাকা আমার কাছে নেই।

 

◆ বাড়ির মালিক বলেন :- কে বলেছে তোমার কাছে কিছু নেই।

 

◆ রেনুকা চিন্তিত হয়ে কিছুক্ষণ পর বলে :- ঠিক বুঝতে পারলাম না, আপনি কি বলতে চেয়েছেন?

 

◆ বাড়ির মালিক বলেন :- রূপ যৌবন ক্ষণস্থায়ী তাকে উপভোগ করে নেওয়া কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ।

 

◆ রেনুকা বলে :- এই ধরনের প্রস্তাব আপনার মুখ থেকে শুনতে চাইনা।

 

◆ বাড়ির মালিক বলেন :- বাড়ি ভাড়া তো দীর্ঘদিন বাকি পড়ে আছে। তারপর সংসারে খরচ আমাকে চালাতে হচ্ছে। আমার চাওয়া অন্যায় হতে পারে না, আমার সব টাকা তাহলে শোধ করে দাও। টাকা পয়সা সোনা দানা কিছুই তো আর দেওয়ার নেই, তাহলে কিন্তু তোমার দেহ কে বাজি রাখো। 

 

◆ রেনুকা বলে :- জিতে গেলে আপনি কি দেবেন?

 

◆ বাড়ির মালিক বলেন :- আমি হেরে গেলে তোমার সব টাকা শোধ হয়ে যাবে আর এক বছর এই বাড়িতে বিনামূল্যে থাকতে পারবে।

 

◆ রেনুকা বলে :- আমি হেরে গেলে আপনার রক্ষিতা হয়ে থাকবো কিন্তু আমার ইচ্ছা হলে আপনাকে ছেড়ে যেতে পারবো। 

 

◆ বাড়ির মালিক বলেন :- কমপক্ষে ১২ বছর আমার কাছে থাকতে হবে, ছেলে-মেয়ে সহ তোমার দায়িত্ব আমি নেব।

 

◆ রেনুকা বলে :- চুক্তিপত্র হওয়া অবশ্যই দরকার।

 

◆ বাড়ির মালিক বলেন :- তাহলে কয়েকদিন অপেক্ষা কর। চুক্তিপত্র স্বাক্ষর হওয়ার পর খেলা শুরু হবে। তিনবার খেলা হবে কিন্তু দুবার যে জিতবে সেই বিজয় হিসেবে ঘোষণা হবে ।

 

◆ রেনুকা বলে :- লুডু খেলা চলাকালীন সাক্ষীর জন্য তৃতীয় পক্ষের একজন ব্যক্তি চাই।

 

◆ বাড়ির মালিক বলেন :- ঠিক আছে দুজন ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে রাখা হবে।

 

◆ একদিন সকাল বেলা দুজনের মধ্যে খেলা শুরু হয়, কিন্তু তিনবার খেলায় রেনুকা দুবার হেরে গিয়ে চুক্তি অনুসারে বাড়ির মালিকের রক্ষিতা হয়ে বসবাস করতে থাকে।

 

◆ রেনুকা তার স্বামীকে ফোনের মাধ্যমে জানান, আমি লুডু খেলায় দেহ কে বাজি রেখে বাড়ির মালিকের কাছে হেরে গিয়ে কিন্তু তার রক্ষিতা হয়ে আছি। তুমি এসে, আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে যাও কারণ আমি আর তোমার সংসার করতে চাই না।

 

◆ রেনুকার স্বামী অনিন্দ্যম এলাকার লোকাল থানায় তার স্ত্রী ও বাড়ির মালিকের নামে মামলা দায়ের করে।

 

◆ মামলার বিচার কালীন সময়ে আদালতে রেনুকা জানায়, আমি; আমার স্বামীর সাথে থাকতে চাই না। বাজিতে বাড়ির মালিকের সাথে লুডু খেলার সূত্র ধরে তার কাছে হেরে গিয়ে লিখিত চুক্তির অনুসারে স্বেচ্ছায় কিন্তু তার রক্ষিতা হয়েছি। বাড়ির মালিক কে আমার অভিভাবক ও স্বামী বলে দাবি করছি।     

 

◆ রেনুকার উকিল বাবু বিচারপতি কে বলেন :- মাননীয় বিচারপতি মহাশয়; ভারতবর্ষে পরকীয়া বিষয়ক আইন ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট ‘পরকীয়া সম্পর্ক’ বিষয়ে চরম রায়টি দিয়েছেন। সংবিধানের ৪৯৭ ধারাটি আংশিকভাবে নয় সামগ্রিকভাবে এই রায়ে আলোচিত হয়েছে। যার মূলগত ভিত্তি হল সংবিধানের তিনটি ধারা। ধারা ১৪, ধারা ১৫ ও ধারা ২১  

 

◆ ধারা: ১৪ অনুযায়ী, প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিক রাষ্ট্রর চোখে সমান এবং রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককে সমানভাবে সুরক্ষিত রাখবে।

 

◆ ধারা: ১৫ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের কাছে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ ও জন্মস্থান নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিক প্রতি সমান অর্থাৎ কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না।

 

◆ ধারা: ২১ অনুযায়ী, কোনো ভারতীয় নাগরিক তার জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। আইন প্রত্যেক নাগরিকের এই দুই অধিকার কে সুনিশ্চিত করবে।

 

◆ নাগরিকের অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে প্রেম ও প্রেমজনিত প্রয়োজনকে একপ্রকার মৌলিক প্রয়োজন হিসাবে মান্যতা সুপ্রিমকোর্ট দিয়েছেন। ‘পরকীয়া’ সম্পর্ক প্রেম প্রসঙ্গে সাংবিধানিকভাবে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার যেভাবে বুঝে পেল।

 

◆ এই রায়টি কার্যত নারীপুরুষের যৌথ সম্পর্ককেন্দ্রিক। সে সম্পর্ক বৈবাহিক সম্পর্ক বা অবৈবাহিক সহবাস সম্পর্ক বা ‘পরকীয়া সম্পর্ক’ যাই হোক। কারণ এই তিনধরণের সম্পর্ক পরস্পরের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে। একটি ধরণের সম্পর্ককে কেন্দ্রে রেখে আলোচনা হলে তা অন্য দুটিকে টেনে আনবেই। তবে তা কেবল ‘কেন্দ্রিক"। 

 

◆ এই যৌথ সম্পর্ক প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে আলোচনায় উঠে এসেছে নানা ধরণের সাংবিধানিক অধিকারের কথা, নাগরিকের মর্যাদার কথা ও রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক দায়িত্বের কথা।

 

 ◆ রায়টি থেকে বোঝা যায়, তার প্রতিটি বাক্য লিঙ্গ সমতা বিষয়টিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছে, নাগরিকের জীবনের ব্যক্তিগত পরিসরের বোঝাপড়ার প্রতি যেন তুলনায় যত্নশীল হয়েছে। 

 

◆ নাগরিকের ব্যক্তিগত মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে আধুনিক মন নিয়ে ভাবতে পেরেছে। এমনকি প্রেম, যৌনতা, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ সর্বোপরি প্রেমঘটিত ‘সম্পর্ক’কে ভিন্ন সামাজিক চোখে দেখার কথা বলেছে।

 

◆ পরকীয়া সম্পর্ককে কেবল এই রায়ে নয়, গোড়া থেকেই ‘যৌন সম্পর্ক’ দ্বারা আইনত সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। পরকীয়া সম্পর্ককে ‘প্রেম বিষয়ক’ এমনটা বোঝাতেই সম্ভবত প্রামাণ্য সূত্র হিসাবে ‘যৌন সম্পর্ক’ শব্দদুটি ব্যবহৃত হয়েছে।

 

◆ রায়টি ‘পরকীয়া’ প্রসঙ্গ উত্থাপনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে যা উল্লেখ করেছে, তা হল, নারী পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্কে নারীটি তার পুরুষসঙ্গীর ‘সম্পত্তি’ নয়। সম্পর্কে অধঃস্তন অবস্থান কোনো সঙ্গীরই নয়, উভয়ই সমান।

 

◆ আগের আইনে পরকীয়া প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে যে, কোনো পুরুষ যদি কোনো বিবাহিত নারীর সঙ্গে তার ‘স্বামী’-র সহমতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন তবে সেই যৌন সম্পর্ক ‘অপরাধ’ হিসাবে পরিগণিত হবে। 

 

◆ পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় পরকীয়া সম্পর্কে লিপ্ত নারীটির ‘স্বামী’র অভিযোগের ভিত্তিতে, বিচার সাপেক্ষে পরকীয়ায় লিপ্ত পুরুষটির পাঁচবছর কারাবাস ও জরিমানাও হতে পারে। 

 

◆ নতুন রায়ে পরকীয়া সম্পর্কে ‘স্বামী’-র সহমতিদানের বা তার অভিযোগের কোনো সুযোগই থাকছে না, কারণ, নতুন রায় অনুযায়ী পুরুষসঙ্গীটি আর নারীসঙ্গীটির ‘কর্তা’ নয়।

 

◆ অপরদিকে, আগের আইনানুসারে ‘পরকীয়া’ নামক ‘অপরাধ’-এ জড়িত ‘নারী’টি কোনোভাবেই আইনের চোখে অপরাধী হত না। মনে করা হত যে, সে অপরাধী তো নয়ই, পরকীয়াঘটিত যৌনসম্পর্কের যে ‘অপরাধ’, তাতে স্বেচ্ছায় যোগদান করেও সে অপরাধে ‘যোগদানকারী’ বা ‘সাহায্যকারী’ বা ‘উৎসাহপ্রদানকারী’ও নয়। 

 

◆ আপাত স্বস্তিকার এই ব্যবস্থাপনা নারীকে ‘অপরাধের শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করে বটে, তবে একই সঙ্গে অস্বীকার করে তার স্বাতন্ত্র্যকে, সামর্থ্যকে, বৌদ্ধিক যোগ্যতাকে, আত্মবিশ্বাসকে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কে। এমন কি নাগরিক মর্যাদা কে?

 

◆ সম্ভবত, মনে করা হত, যৌনসম্পর্কে প্ররোচনা দেওয়ার মতো উচ্চ বৌদ্ধিক স্তরের কাজ করতে পারে কেবল মস্তিষ্কধারী পুরুষ, নারী সেসবের যোগ্য নয়, নারী কেবল চালিত হতে পারে। অতঃপর সে শিশুর মতোই নির্বোধ, তাকে শাস্তি দেওয়া চলে না।

 

◆ পুরানো আইনটি দর্শনগতভাবে সংবিধানের ধারা ১৪ ও ধারা ১৫- এর বক্তব্যের বিরোধী ছিল। একই ‘অপরাধ’-এ স্বেচ্ছায় অংশ নেওয়া নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে আইন সমান ছিল না, আইন একপ্রকার লিঙ্গবৈষম্য ঘটিয়ে একই পরিস্থিতিতে দুই নাগরিকের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করত। 

 

◆ আবার পরকীয়ায় জড়িত বিবাহিত পুরুষটির স্ত্রীর অভিযোগ করার বা বিচার চাওয়ার যেহেতু কোনো উপায় থাকত না, তাই তার সুরক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত করতে আইন ব্যর্থ হত।

 

◆ ২৭ শে সেপ্টেম্বরের রায় অনুযায়ী ‘স্বামী-র সহমতি’ বিষয়টির কোনো প্রাসঙ্গিকতা রইল না, কারণ নারী-পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্কে পুরুষটি নারীর আইনসম্মত জীবনসঙ্গী হলেও দর্শনগতভাবে আর তার ‘স্বামী’ রইল না। 

 

◆ তাহলে কি ‘স্বামী’-র সহমতি থাক বা না থাক ‘পরকীয়া’ সততই ‘অপরাধ’ হয়ে দাঁড়ালো? না! বরং উল্টো। 

 

◆ এই রায় কেবল ‘নারী’-কে ব্যক্তিগত সম্পত্তিরূপে দেখার মূলেই কুঠারাঘাত করল না, ‘পরকীয়া’-কে সার্বিকভাবেই আর ‘অপরাধ’ হিসাবে দেখতে রাজি হল না।

 

 ◆ বলা যেতে পারে, সম্পর্কের জটিল চলন গমনকে কোনোক্রমে সরলীকৃত করে ‘বিবাহ’ বন্দোবস্তে তার পরিণতি দেওয়ার গোঁজামিলের আইনিব্যবস্থায় ‘পরকীয়া’কে আইনের চোখে ‘অপরাধ’ হিসাব না দেখা একটি আশার ও দায়িত্বশীল দেখা।

 

 ◆ রায়টিতে উল্লেখ আছে, সঙ্গীর সহমতিনিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও ‘পরকীয়া’ বিবাহকেন্দ্রিক একটি বিষয় যদিও তা দুটি মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।

 

◆ এমতবস্থায় আইনের এ হেন ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রতিবিধানের উদযোগ করা বা অপরাধ হিসাবে দেখে তার বিচার করা একপ্রকারে সংবিধানের ধারা ২১ বিরোধী।

 

◆ নতুন রায় অনুযায়ী নাগরিকের জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার (ধারা ২১) সুনিশ্চিত করতে পরকীয়া প্রসঙ্গে আইন নাগরিকের জীবনের সঙ্গে যুক্তিযুক্ত দূরত্ব বজায় রাখবে এবং বিষয়টিকে কেবল বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্র হিসাবে গ্রাহ্য করবে।

 

◆ বিচারপতি তার রায় ঘোষণা করে বলেন :- রেনুকা দেবী সংবিধানের ৪৯৭ ধারা অনুসারে তাদের সম্পর্কে আইন মতে বৈধতা দেওয়া হলো। তার স্বামী অনিন্দ্যম বর্তমানে রেনুকা দেবীর কাছে অবৈধ।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 অবলম্বনে ও তথ্যসূত্র :- (০১) "ভারতবর্ষে পরকীয়া বিষয়ক আইন" প্রবন্ধ লেখিকা সর্বশিক্ষা মিশনে কর্মরত এবং সামাজিক কর্মী।

(০২) লুডো খেলার মারাত্মক নেশা! নামক প্রবন্ধ । বিশ্ব বাংলা সংবাদ।

             ~~~~~~~~~~~~~~~~~----------------------------------------------------------------------

◆ রচনাকাল :- ২ আগস্ট ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে। শ্রী শ্রী মা সেবাশ্রম। দোলেনঘাটা,খাটুরা,মাজদিয়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ।

◆ সংশোধনের তারিখ :- ৭ আগস্ট ২০২৩ সালে। দত্তপুলিয়া বাড়ি থাকাকালীন, নদীয়া।

 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

 

 

 

 

                                                       গল্প নম্বর :- ৮

 

 ফোনের নেশায় সন্তান বিক্রি।

          লেখক :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

◆ রচনার শ্রেণী :- উচ্চ আকাঙ্ক্ষা বিপর্যয়ের শিক্ষামূলক বাস্তব অনুগল্প।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার পানিহাটি গঙ্গানগর এলাকার সাথী ঘোষ ও জয়দেব ঘোষ বাসিন্দা। আইফোন-১৪ কিনে রিল শ্যুট করবেন এই উদ্দেশ্যেই আট মাসের পুত্রসন্তান কে বিক্রি করে দেওয়া দেয়। 

 

◆ আট মাসের পুত্রসন্তান ছাড়াও দম্পতির এক সাত বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। 

 

◆ সাথী ঘোষ তার স্বামীকে বলে :- আমার একটা আইফোন দরকার।

 

◆ স্বামী জয়দেব ঘোষ মোবাইলে চার্জ করে বলে :- আইফোন ১৪ প্রো ম্যাক্স-এর ২৫৬ জিবি ভেরিয়েন্ট দাম ১,৪৯,৯০০ টাকা। কিন্তু এত টাকা কোথায় পাবো?

 

◆ সাথী ঘোষ বলে :- আইফোন হলে ইনস্টাগ্রামে রিল ভিডিও বানিয়ে লাখ লাখ টাকা আয় করা যাবে আবার লোকের কাছে সম্মান পাওয়া যাবে। আমি তো অন্য মেয়েদের থেকে কোন অংশে কম নয়। ভিডিও প্রকাশ করলে লাখ লাখ কমেন্ট, শেয়ার ও মন্তব্য আসতে থাকবে।

 

◆ স্বামী জয়দেব ঘোষ বলে :- আমারও তো অভিনয় করার ইচ্ছা আছে কিন্তু টাকা কোথায় পাবো।

 

◆ সাথী ঘোষ কিছু সময় চুপচাপ থেকে চিন্তা ভাবনা করার পর বলে :- আমাদের আট মাসের ছোট ছেলেকে কোন নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করে দিলে কয়েক লক্ষ টাকা বিক্রি করতে পারব।

 

◆ স্বামী জয়দেব ঘোষ উত্তেজিত হয়ে বলে :- তা কখনোই সম্ভব না, আমি সন্তানকে বিক্রি করতে পারবো না।

 

◆ সাথী ঘোষ বলে :- উত্তেজিত হচ্ছে কেন! সন্তান উৎপাদন করার মেশিন যখন আমাদের কাছে আছে, তখন আবার সন্তান জন্ম দিয়ে দেবো কিন্তু বর্তমান সন্তান বিক্রি করে সংসারের দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্ত হয়ে অর্থনীতির স্বনির্ভর হয়ে উঠবে। আর ছেলেকে বড় করে লাভ কি? বৃদ্ধকালে আমাদের দেখবেই না।

 

◆ স্বামী জয়দেব ঘোষ বলে :- সন্তান বিক্রি করা তো আইনত অপরাধের কাজ। দেখুক আর না দেখুক কিন্তু আমাদের কর্তব্য করে যেতে হবে।

 

◆ সাথী ঘোষ উত্তেজিত হয়ে বলে :- রাখো; তোমার আইন-কানুন আর সমাজের ব্যবস্থা। টাকা থাকলে কিন্তু সব আইন কানুন পকেটে ভরে রাখা যায়। দেশে কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারি হচ্ছে তার কয়জনের সাজা হয়েছে।

 

◆ স্বামী জয়দেব ঘোষ বলে :- এই কাজে তোমাকে সাহায্য করতে পারব না।

 

◆ সাথী ঘোষ বলে :- তোমাকে কিছুই করতে হবে না, যা করার আমিই করব। আমি সন্তান পেটে ধরেছি আমার দুঃখ হচ্ছে না কিন্তু তোমার মনে হচ্ছে দুঃখে একদম হার্টফেল করে ফেলবে।

 

◆ ঘোষ দম্পতির মধ্যে চরম অশান্তি সৃষ্টি হয়। তবুও সাথী ঘোষ তার ছেলেকে বিক্রি করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে শুরু করে। নিঃসন্তান দম্পতি প্রিয়াংকা ঘোষ নামের এক গৃহবধূর সাথে কথাবার্তা ও দর কষাকষি চলতে থাকে।

 

◆ পাড়া-প্রতিবেশীগণ হঠাৎ করে সাথী ও তার স্বামীর পোশাক আশাক কথাবার্তা ব্যবহার চালচলন পরিবর্তন সহ হাতে আইফোন দেখতে পায়। বিভিন্ন সময় প্রাইভেট গাড়ি করে বিভিন্ন জায়গায় আসা-যাওয়া করতে থাকে। 

 

◆ প্রতিবেশীদের সন্দেহ হওয়ার কারণে তাদের বাড়িতে খোঁজ করে ৮ মাসের সন্তানের সন্ধান পায় না।  

 

◆ প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসার উত্তরে সাত বছরের মেয়ে টুম্পা বলে :- ভাইকে কয়েক সপ্তাহ ধরে মা-বাবার সাথে দেখতে পাচ্ছি না। জিজ্ঞাসা করলে কোন উত্তর দেয় না বরং বাবা-মা, আমার উপর বকাবকি করে ভয় দেখাতে থাকে। কাকু; আমরা হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে গিয়েছি। ভালো ভালো খাবার আর পোশাক সহ আরো কত কিছু আমার জন্য নিয়ে এসেছে।

 

◆ কয়েকজন প্রতিবেশী থানায় গিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে ঘোষ দম্পতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার তাৎক্ষণিক তার দলবল নিয়ে সাথী ও জয়দেব কে খোঁজ করতে বেরিয়ে পড়ে।

 

◆ তারপর সাথী ও জয়দেবকে তুলে থানায় নিয়ে এসে জেরা করতে শুরু করে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ঘোষ দম্পতি তাদের সন্তান বিক্রির কথা স্বীকার করে।

 

◆ জয়দেব ঘোষ বলে :- সন্তান বিক্রির ব্যাপারে আমি সবসময় প্রতিবাদ করেছিলাম কিন্তু স্ত্রী সাথীর কূটবুদ্ধির কাছে আমি হার মানতে বাধ্য হয়েছি। আমার অবর্তমানে পিয়াংকা ঘোষের সাথে গোপনে লেনদেন হয়েছে। 

 

◆ সাথী ঘোষ উত্তেজিত হয়ে বলে :- ধরা পড়ে যত দোষ আমার কিন্তু টাকা নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করার সময় তো একবারও প্রতিবাদ করলে না।

 

◆ পুলিশ তাৎক্ষণিক ক্রেতা প্রিয়াঙ্কা ঘোষ ও তার স্বামী কে গ্রেফতার সহ শিশুকে উদ্ধার করে হোমে পাঠিয়ে দেয় আর ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় দম্পতির নামে মামলা দায়ের করে কোর্টে চালান করে দেয়।

        ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

অবলম্বনে ও তথ্যসূত্র :- সদ্যোজাত সন্তানকে বিক্রি করে আইফোন কিনলেন দম্পতি! প্রবন্ধ। জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো। 28 জুলাই, 2023 সাল।

                  

◆ রচনাকাল :- ৩ আগস্ট ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে। শ্রী শ্রী মা সেবাশ্রম। দোলন ঘাটা, খাটুরা, মাজদিয়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ।

◆ সংশোধনের তারিখ :- ৮ আগস্ট ২০২৩ সালে। দত্তপুলিয়া বাড়ি থাকাকালীন, নদীয়া।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

 

 

                                                  গল্প নম্বর :- ৯

 

                       প্রতিবাদী ছাত্র। 

 

     লেখক :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

◆ রচনার শ্রেণী :- সামাজিক ঐতিহাসিক বড় গল্প । ছাত্রদের উপর শিক্ষকগণ শাসনের নাম করে ভীষণ ভাবে মারপিট করে অত্যাচারের প্রতিবাদের কাহিনী। ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ ব্যস্ততম এক শহরে পথ চলতি মানুষ গুলো হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ে আর কৌতুহল নিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, শহরের মাঝে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান গেটের সামনে বহু মানুষের জমায়েত কেন! 

 

◆ বয়স্ক করিম চৌধুরী কৌতুহলবশত এক পা দু'পা করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে, চারিদিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে না পেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক কে বলে :- ভাতিজা; এখানে কি হয়েছে! বহু মানুষের সমাগম।

 

 ◆ যুবক পরিতোষ বলে :- কাকাবাবু; দুই ছাত্রের মধ্যে মারামারি হয়েছে।

 

◆ করিম চাচা বলেন :- দুই ছাত্রের নাম কি?

 

◆ যুবক পরিতোষ বলে :- নদীর ওপারের নীলকান্ত পাল আর এপারের আলমগীর সেখ। দুজনে দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। লাঠি সোটা নিয়ে পিঠাপিঠি হয়েছে। নীলকান্ত কিন্তু আলমগীরের মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। কয়েকজন মাস্টার মশাই হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। এখনো রাস্তায় তাজা রক্তের দাগ হয়েছে।

 

◆ করিম চাচা বলেন :- নীলকান্তের বাবা একজন সমাজের ভালো মানুষ আর তাকে এলাকার মানুষ যথেষ্ট সম্মান করে আর তার ছেলে মস্তানি করে, মদ্যপান ও বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া পান করে টাকা নষ্ট করে। অসৎ ছেলেদের সাথে মিশে অসামাজিক হয়ে উঠেছে, মনের মধ্যে বিশ্বের বদমাইশি বুদ্ধি ভরা। 

 

◆ যুবক পরিতোষ বলে :- নীলকান্তের কয়েক জন হিন্দু ও মুসলিম যুবকদের নিয়ে একটি দল করেছে কিন্তু আলমগীর ওদের দলের একজন সদস্য।

 

◆ মধ্য বয়স্ক সঞ্জয় বিশ্বাস বলেন :- হয়তো ওদের নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের কোন ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে।

 

 ◆ করিম চাচা বলেন :- গত বছর একবার ওদের দুর্গা পুজোর বিসর্জনের দিনে নীলকান্ত নদীর পানির মধ্যে নৌকার উপর মারামারি করে, সে এক বিশাল ভয়ানক কান্ড ঘটে যায়। নৌকাডুবি হয়ে অনেকেই মরার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। সেই গন্ডগোলের মধ্যে ও নৌকা ভ্রমণের নৌকার মধ্যে আমাদের মুসলিম যুবকরা ছিল। 

 

◆ নুরুল ইসলাম হাত উঁচু করে ক্রোধের সাথে বলেন :- আরো শয়তান বিচ্ছু তোদের পুজো আর তোরা যদি মারামারি ও অশান্তি করিস, তাহলে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষগুলো কি করবে? 

 

◆ অল্প বয়সের এক যুবক আবিদ খান চিৎকার করে বলে :- মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বাস করে কিন্তু এত সাহস কখনোই ভালো না। যেকোনো মুহূর্তে বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।

 

◆ নুরুল ইসলাম বলে :- হিন্দু-মুসলমানের গন্ডগোল বাধলে তো মুসলমানদের দোষারোপ করবে কারণ এই জেলার মধ্যে হিন্দুরা সংখ্যালঘু।

 

◆ করিম চাচা বলেন :- থানা পুলিশ হয়ে কয়েক দিন থানাতে নীলকান্ত কে আটকিয়ে রেখে ছিল। তাও কিন্তু ছেলেটার কোন শিক্ষা হয়নি, কত বার যে জেল হাজতে গিয়েছে। 

 

◆ এলাকার তরুণ সাংবাদিক সমীর সরকার বলে :- দেশের শাসক দলের রাজনৈতিক নেতারা আবার মুক্ত করে নিয়ে এসেছে কিন্তু রাজনীতিক নেতাদের জন্যই দেশের যুবসমাজ অধঃপতনে দিকে অগ্রসর হচ্ছে ।

 

◆ যুবক পরিতোষ বলে :- দেখুন; এ বার কি হয়! জল কোন দিকে গড়াই।

 

◆ করিম চাচা বলেন :- আমার ছেলে তো নীলকান্তের বড় প্রশংসা করে বলে, সমাজসেবক পরোপকারী। ওই তো তার নমুনা নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি। নীলকান্ত হারামজাদা কোথায়! পালিয়ে গেছে নাকি? কিন্তু আসল ঘটনা কি ঘটেছে! আমাকে জানতেই হবে। 

 

◆ যুবক অনিল বলে :- না; পালাতে পারেনি। গন্ডগোলের সময় আমি এখানে উপস্থিত ছিলাম। নীলকান্ত কিন্তু আলমগীর সেখ কে মারতে মারতে বলছিল, বিনা কারণে পন্ডিত (হরকান্ত ভট্টাচার্য) স্যার কে দিয়ে বেতের লাঠির মার খাওয়ালি কিন্তু তোকে না মারলে তো আমার শরীরের যন্ত্রণা যাবে না। বলতে বলতে চোঁখ কান বন্ধ করে লাঠি দিয়ে মারতে থাকে‌। 

 

◆ করিম চাচা বলেন :- তাহলে হয়তো আলমগীরের কোন দোষ নিশ্চয়ই আছে।

 

আব্দুল হামিদ বলে :- আমি যতদূর জানি নীলকান্ত বিনা কারণে কারো সাথে অশান্তি ঝগড়া করে না।

 

◆ যুবক পরিতোষ বলে :- তুই তো ওর বন্ধু না।

 

আব্দুল হামিদ বলে :- নীলকান্ত আমার বন্ধু না হলেও পরম বন্ধু। আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লে পাড়ার কেউ না গেলেও নীলকান্ত হাসপাতালে গিয়েছিল এবং যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল।

 

◆ যুবক পরিতোষ বলে :- সেই সময়ে স্যারেরা এসে নীলকান্ত কে ধরে টানতে টানতে স্কুলের অফিস রুমে নিয়ে যায়। অফিস রুমের মধ্যে কি হচ্ছে জানি না! কিন্তু স্কুল আজকের মতো ছুটি দিয়ে দিয়েছে। 

 

◆ করিম চাচা বলেন :- লাঠি কোথায় পেলে, সাথে করে নিয়ে এসেছিল কি?

 

◆ যুবক আবিদ খান আঙ্গুল উচু করে দেখিয়ে বলে :- আরো চাচা; ঐ ব্যাংকের পিছনের দিকে সাহা বাবুদের পরিত্যক্ত বাগান হয়েছে। ঐ বাগানের মধ্যে লাঠি চাকু থাকে আর মাঝখানে পরিস্কার করে রাতে গাঁজা, মদ্যপান আর বিড়ির ধোঁয়ায় পূর্ণিমার রাত কে অমাবস্যার রাত মনে হবে। 

 

◆ করিম চাচা বলেন :- যায় দেখি স্কুলের অফিস রুমের দিকে, আমাকে ঘটনাটি জানতে হবে।

 

◆ নীলকান্ত কে অফিস রুমের মধ্যে সব মাষ্টার গণ ঘিরে ধরে রেখেছে। কোন কোন মাষ্টার নতুন বেত নিয়ে অবাধ্য ছাত্র কে পেটানোর জন্য তৈরি হয়ে আছে । আর পন্ডিত মাস্টার হরকান্ত ভট্টাচার্য মোটা মোটা দেখে চার খানা বেত একত্র করে সুযোগের অপেক্ষায় আছে।

 

◆ এক মাস্টার মহাশয় ধৈর্য রাখতে না পেরে বেত তুলে নীলকান্ত কে মারতে উদ্যত হয়। সেই মুহূর্তে নীলকান্ত লাফ দিয়ে মাস্টার মশাইয়ের হাতের কব্জি চেপে ধরে এক হাত দিয়ে অন্য হাত দিয়ে বেত ধরে জোরে টান দিতেই বেত নীলকান্তের হাতে চলে আসে।

 

◆ তারপর মাস্টার মশাই কে ছেড়ে দিয়ে বেত নিয়ে তার মাথার উপর দিয়ে লাঠি খেলার মতো করে কয়েক পাক ঘুরিয়ে নেয়।

 

◆ নীলকান্ত চিৎকার করে উঠে বলে :- আপনারা কেউ দয়া করে আমার গায়ে বেত চালাবেন না। আমি কিন্তু বর্তমানে বিচার অধীন অপরাধী। এই মুহূর্তে বেত চালালে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে আর আপনাদের সম্মান নষ্ট হতে পারে।

 

আগে আমার আর পন্ডিত মাস্টারের মধ্যে হওয়া গন্ডগোলের সূত্রপাতের সমস্যা গুলো শুনুন, তারপর বিচার হবে। আর বিচারে যদি অপরাধী হয় তাহলে মনে মতো বেত মেরে আমার দেহ ক্ষত বিক্ষত করে দেবেন তবুও কিছু বলবো না। 

 

◆ নীলকান্ত যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ধীরে ধীরে প্রধান মাস্টারের রুমে ঢুকে বেঞ্চের উপর বসে পড়ে বলে :- পন্ডিত মশাই যা পিটিয়েছে তাতে ছয় মাস যন্ত্রণা থাকবো কিন্তু সমস্যার সমাধান করুন। 

 

◆ প্রধান মাস্টার মধ্য বয়স্ক আজিজুল হক সাহেব বলেন :- কেন! তুই দুষ্টুমি করিস বাপ।

 

◆ নীলকান্ত বলে :- স্যার; টাকা দেন যন্ত্রণার ঔষধ আনতে হবে, আমি নিয়ে আসছি। দেন না স্যার। বলে যন্ত্রণায় ছটফট করে কান্নাকাটি করতে থাকে।

 

◆ রুমের মধ্যে উপস্থিত অন্য মাষ্টার গণ বলেন :- স্যার; ওকে যেতে দেবেন না, ধূর্ত শেয়ালের মতো পালিয়ে যাবে।

 

 ◆ প্রধান মাস্টার মশাই ৫০ টাকা নীলকান্তের হাতে দিয়ে বলেন :- মাস্টার মশাই আপনারা চুপ করুন। নীলকান্ত ঔষধ নিয়ে তাড়াতাড়ি আয়।

 

◆ নীলকান্ত দলের ছেলেরা স্কুলের অফিসের বাইরে ২৩ থেকে ২৫ জন অপেক্ষা করে আছে।

 

◆ নীলকান্ত এক জন ছেলে কে ডেকে তার হাতে টাকা দিয়ে বলে :- রুটি, মিষ্টি আর ঔষধ নিয়ে আয় কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবি।

 

◆ উক্ত ছাত্র বলে :- এই টাকায় এত জিনিস হবে না, আরো টাকা দাও দাদা ।

 

◆ নীলকান্ত বলে :- না হয়, তোদের পকেট থেকে দিয়ে নিয়ে আয়। তাও না থাকলে বন্ধু তাপসের দোকানে গিয়ে আমার কথা বল।

 

◆ সুবোধ মাস্টার মশাই ছাত্রদের সমস্যা দেখে পকেট থেকে ত্রিশ টাকা দিয়ে বলেন :- ঔষধ ও খাবার নিয়ে আয়।

 

◆ কিছু সময়ের মধ্যেই তার ঔষধ ও খাবার চলে আসে। মাস্টার রুমে বসে খাবার ও ওষুধ সেবন করে জল পান করে। তারপর ধীরে ধীরে প্রধান মাস্টারের রুমে ঢুকে বেঞ্চের উপর বসে পড়ে।

 

◆ প্রধান মাস্টার মশাই বললেন :- তোর বন্ধু আলমগীর কে মারলি কেন?

 

◆ নীলকান্ত বলে :- মাস্টার মশাই; যা বলবে সত্য বলবে কিন্তু মিথ্যা বলবে না। পন্ডিত মাস্টার মহাশয়ের কাছে আমার প্রতি আলমগীর, আনোয়ারের সিনেমা হলে "জঙ্গল কি লাভ" হিন্দি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি দেখার অভিযোগ করেছে।

 

◆ গতকাল বুধবার আমি নাকি টিফিনের সময়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে শহরের সিনেমা হলে হিন্দি সিনেমা দেখতে গিয়ে ছিলাম। আমি স্বীকার করছি যে সিনেমা দেখা আমার নেশা আছে। গতকাল আমি মধ্যাহ্নের খাবারের অবসর (টিফিন পিরিয়ডের) সময়ে কিন্তু সিনেমা দেখতে যায়নি। প্রয়োজনে মধ্যাহ্নের খাবারের অবসর সময়ের পরের ক্লাসের মাস্টার মশাইয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করুন।

 

বরুণ মাস্টারমশাই বলেন :- নীলকান্ত ঘটনার দিন আমার ক্লাস করেছে।

 

◆ নীলকান্ত বলে :- স্যার; আজ পন্ডিত মাস্টার মশাইয়ের ক্লাস চলাকালীন সময়ে আলমগীর আমার বিরুদ্ধে উক্ত অভিযোগ দায়ের করে। কিন্তু পন্ডিত মাস্টার উক্ত অভিযোগের বিষয়ে কোন তদন্ত করে না। আমাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না করেই কিন্তু আমার ওপর এলোপাতাড়ি ভাবে বেতের লাঠি চালাতে শুরু করে।

 

◆ নীলকান্ত কয়েক মিনিট চুপচাপ থাকার পর বলে :- আসলে পন্ডিত মাস্টার কানে কালা। আলমগীর বলেছে এক রকম আর মাস্টার শুনেছেন অন্যরকম। বিচার না করে আমাকে আঘাত করার কারণ হচ্ছে আমি তো অনেক দোষে দোষী হয়ে আছি। আমার শরীরে সাইনবোর্ড লাগানো আছে। এই জন্য দোষ না করলেও কিন্তু আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে সবাই সাজা দিতে থাকে।

 

◆ পন্ডিত মাস্টার উত্তেজিত হয়ে বলেন :- আমি কানে কালা,দেখাচ্ছি তোর মজা।

 

◆ প্রধান মাস্টার মশায় পন্ডিত মাস্টারের উদ্দেশ্য করে বলেন :- চুপ করুন আপনি। নীলকান্ত তারপর কি হল?

 

◆ নীলকান্ত বলে :- আমি বার বার বলেছিলাম, আমি হিন্দি সিনেমা দেখতে যায়নি। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন বর্তমান বাংলা ছবি দেখানো হচ্ছে। কে কার কথা শোনে, থানায় অনেক দিন পর চোর ধরা পড়লে যেমন মারে ঠিক সেই ভাবে পন্ডিত মাস্টার চোঁখ কান বন্ধ করে মরতে থাকে।

 

◆ পন্ডিত মাস্টার আমার প্রতিবেশী সকাল বেলা তার স্ত্রীর সাথে ভীষণভাবে ঝগড়া অশান্তি হয়েছে, সেই স্ত্রীর উপরের রাগ কিন্তু আমাকে আঘাত করে করে মিটিয়েছেন। মাস্টার মশাইয়ের স্ত্রী কিন্তু আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন। এই ঘটনা শোনার পরে আজ আরও অশান্তি বিশাল আকারে রূপ ধারণ করবে।

 

◆ পন্ডিত মাস্টার বলেন :- নীলকান্ত একদম বাজে কথা বলবে না। এই অবাঞ্ছিত কথাবার্তা বলার কারণে জন্যই তুই মার খাস।

 

◆ প্রধান মাস্টার মশাই বলেন :- মাস্টার মশায় চুপ করুন। আমাকে ঘটনা কি বুঝতে দেবেন তো, কার দোষ তা পরে বিচার হবে।

 

◆ নীলকান্ত বলে :- অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতে গেলেই নীলকান্ত খারাপ কিন্তু তেল মাখিয়ে অন্যায়কে সমর্থন করলে ভালো ছেলে। শিক্ষকরা, ছাত্রদের শিক্ষাদানের নাম করে- নিজের ইচ্ছা মতো পেটানো, তাতে দোষ নেই কেন?

 

◆ শিক্ষকরা সবাই কিন্তু সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারী আর তাদের কাজ ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দান করা কিন্তু অমানবিক ভাবে অত্যাচার করে ছাত্রদের দেহের চামড়া তুলে নেওয়া এ কোন শিক্ষা ব্যবস্থা। 

 

◆ বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে পৌছিয়ে আমরা শিক্ষাকে নিয়ে ভীষণভাবে গৌরব বোধ করি। কিন্তু শিক্ষকদের উপর আঘাত করলাম কেন! জানতে চাইলে না?

 

◆ প্রধান মাস্টার মশাই বলেন :- নীলকান্ত ; তুমি বলে যাও আমি শুনছি।

 

◆ নীলকান্ত টেবিল থেকে জলের গ্লাস নিয়ে জল পান করে বলে :- অতীতের কথা গুলো , হয়তো আপনাদের মনে নেই।

 

বেশি দিনের ঘটনা নয় কিন্তু সাত মাস আগে এই স্কুলে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এই স্কুলের সমগ্র শিক্ষকদের কঠিন হৃদয়ের মাঝে সেই ঘটনার কোন রেখাপাত করেনি। 

 

 আমার সহপাঠী দশম শ্রেণীর ছাত্র সাইফুল ইসলাম। আরবি শিক্ষক আতিয়ার রহমানের আরবি শিক্ষা ক্লাসে বলেছিল :- আরবি পড়তে ভালো লাগে না। আমি মাতৃভাষা বাংলা ঠিক মতো জানি না। আরবি ইসলাম ধর্মীয় বিদেশি আরব দেশের ভাষা কিন্তু বাঙালি ছেলেদের পড়ে লাভ কি ?

 

বরংচ বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মীয় সম্পর্কে জানলে, অনেক কিছু শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করতে পারবো।

 

◆ শিক্ষক আতিয়ার রহমান উত্তেজিত হয়ে, মৌলবাদী সন্ত্রাসী ব্যক্তিদের মতো বিধর্মী কাফের কে বিনাশ করার জন্য শয়তানের মত হয়ে এলোপাতাড়িভাবে সাইফুল কে পেটাতে শুরু করেন। তাহলে ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার এটাই মূল অস্ত্র।

 

সেই মুহূর্তে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সাইফুল চোখ গেল চোখ গেল বলে চিৎকার করতে থাকে, তবুও নিষ্ঠুর হৃদয়ের আরবি শিক্ষক পেটানো বন্ধ করেনি। 

 

আরবি শিক্ষকের ভাষায় সাইফুল নাকি ইসলামকে অবমাননা করে কাফের হয়ে গিয়েছে। ইসলাম তো শান্তির ধর্ম তাহলে ইসলাম নাম করে মানুষকে পিটিয়ে খুন করতে চেয়েছিলেন কেন? সেই মুহূর্তে সাইফুলকে নিয়ে কোনো প্রতিবাদ হয়নি বা আপনারা তার কোন সঠিক বিচার করেননি।

 

 আমি বিধর্মী হিন্দু হয়েও, ইসলাম সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, ইসলাম ধর্মের অবমাননা আমার বন্ধু কখনো করেনি বরং ইসলামকে নিজের মাতৃভাষায় জানতে চেয়েছে তাকে সম্মানের আসনে বসাতে চেয়েছিল।

 

◆ আরবি শিক্ষকের কারণে সাইফুলের চোখের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সঠিক চিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে চোখের সমস্যা বেড়ে চলেছে , হয়তো ভবিষ্যতে অন্ধ হয়ে যেতে পারে।

 

◆ দিন আনা দিন খাওয়া দারিদ্র্য বাবা-মা সন্তানকে বাঁচানোর জন্য কিন্তু সব কিছু হারিয়ে ভিখারীর দশা হয়েছে। এক ছেলের উপর অমানবিক অত্যাচার হওয়ার কারণে তাদের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু আপনার মুসলিম সমাজ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি বরং উল্টো তাদের উপর কাফের তকমা লাগানো হয়েছে।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে কিন্তু ধর্মের শাসক বা ধার্মিক হওয়া যায় না। তার জন্য হৃদয়ে আল্লাহর সৃষ্টি মানুষকে ভালোবাসা ও মানবতা বোধ রাখতে হবে।

 

 সমাজের গরীব মানুষ বলে আরবি শিক্ষকের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে নাই। আপনাদের বহুবার সাইফুলের সমস্যার কথা জানিয়েছি কিন্তু কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। 

 

আপনারা তো মাস গেলে সরকারি টাকা পেয়ে যাচ্ছেন কিন্তু দারিদ্র্য ছাত্রদের কথা ভেবেছেন কখনো ? 

সাইফুলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কে, আপনারা নষ্ট করে দিয়েছে। আপনাদের মত বর্বর শিক্ষকের হাজার হাজার ধিক্কার জানায় । 

 

◆ প্রধান মাস্টার মশাই বলেন :- নীলকান্ত; আজকের ঘটনা বিবরণ দাও। সাইফুলের প্রতি আমরা সত্যিই অন্যায় করেছি কিন্তু তার বিষয়টি নিয়ে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে।

 

◆ নীলকান্ত বলে :- পন্ডিত মাস্টারমশাই আমার নামে আপনার কাছে শিক্ষকের মারার অভিযোগ করেছেন। সেই মুহূর্তে আমি আর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কিন্তু মাস্টার মশায় কে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। হয়ত মাস্টার মশাইয়ের দেহে আঘাত লেগেছে কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য মাস্টারমশাই এর কাছে মাফ চাচ্ছি। 

 

সবাই আমার দোষ খোঁজে কিন্তু আজকের গন্ডগোলের জন্য বলবে একমাত্র পন্ডিত মাস্টার মহাশয় দায়ী।

 

◆ ছাত্রদের বেত মারা বন্ধ করুন, না হলে এক দিন বিপদে পড়বেন। আমার মত শয়তান কখন কি করে বসবে তার কিন্তু ঠিক নেই। 

 

◆ আমাদের ভালোর জন্য আপনারা চেষ্টা করছেন কিন্তু এইভাবে ছাত্রদের উপর অত্যাচার না করে, অন্যভাবে শাসন করতে পারেন। চোখ দেখে যদি ভয় না পায়, তাহলে বেতের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ভয় পাওয়ানো যাই না। 

 

আপনাদের ছাত্র পেটানোর কাজ বাংলার সরকার দেয়নি, ছাত্র ছাত্রীদের লেখা পড়া শিক্ষা দেওয়া আপনাদের প্রধান কাজ ।

 

◆ এক মাস্টার মশাই বলেন :- অন্যায় করলে পেটাবে না।

 

◆ নীলকান্ত বলে :- ছাত্রদের আপনারা অভিভাবক হিসেবে শাসন করতেই পারেন কিন্তু মন মানসিকতা হারিয়ে অমানবিকভাবে অত্যাচার করে নয়। আপনার বাড়িতে ছেলে মেয়ে আছে। তাদের কে আগে পিটিয়ে হাত ঠিক করুন, কত টা পেটাবেন পরের ছেলে কে । নিশ্চয়ই ছেলে-মেয়েদের মারধর করার পর অনুভব করতে পারবেন।

 

◆ আতিয়ার রহমান মাষ্টার বলেন :- নীলকান্ত অতিরিক্ত বাজে কথা বলছিস।

 

◆ নীলকান্ত তার সামনের চেয়ারে বসে থাকা আতিয়ার রহমান মাষ্টারের দিকে তাকিয়ে বলে :- আপনি; তো স্কুলের মধ্যে ছাত্রদের কাছে লাফানো মাস্টার নামে খ্যাতি অর্জন করেছেন। ক্লাস রুমে গিয়ে চেয়ার থাকতে লাফ দিয়ে হনুমানের মতো টেবিলে উঠে বসেন কেন? 

 

◆ মৌলভী স্যার বলেন :- নীলকান্ত; ভীষণ ভাবে মাস্টার গণ কে অপমান করছিস। ধৈর্যের সীমা হারিয়ে যাচ্ছে।

 

◆ মৌলভী আনসার আলী খান মাস্টারের দিকে তাকিয়ে নীলকান্ত বলে :- আপনি তো; আর একজন খ্যাতিসম্পন্ন মাস্টারমশাই, কারণে অকারণে ছাত্রদের সামনের দিকে প্যান্টের মধ্যে হাত ডুকিয়ে দিয়ে টানাটানি করার মাস্টার। আপনার অভিনব কায়দা সত্যিই মজার বিষয় কিন্তু আমরাও খুব মজা পায়।

 

◆ অনীশ পাল মাস্টার মশাই বলেন :- নীলকান্ত; তোর তো অনেক দোষ, তুই আবার মাস্টারদের দোষ খুঁজে বের করেছিস। 

 

◆ নীলকান্ত বলে :- আপনি তো আরেক মহান প্রেমিক মাস্টার। আপনার চরিত্রের ইতিহাস একজন শিশু জানে। ছেলেদের স্কুলে চাকরি দিয়ে সরকার নিশ্চয়ই ভীষণ ভুল করেছেন।

 

 এই স্কুলের মাস্টারের কার কেমন চরিত্র তা কিন্তু আমার জানা আছে। বেশি আমাকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করবেন না, তাহলে সবকিছু প্রকাশ্যে চলে আসবে।

 

যত দোষ ছাত্রদের কিন্তু মাস্টার গণের কোন দোষ নেই। যদি মাস্টারের চরিত্র খারাপ হয় তাহলে ছাত্ররা আপনাদের কাছ থেকে কি শিক্ষা লাভ করবে!

 

◆ এই স্কুলের দ্বিতীয় প্রধান মাস্টার মশাই বলেন :- নীলকান্ত চুপ কর বাবা। অনেক হয়েছে আর কারোর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে হবে না। 

 তারপর প্রধান মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, মাস্টার মশাই যা করবেন তাড়াতাড়ি করে নীলকান্ত কে বিদায় করুন। না হলে নীলকান্ত আমাদের সবাইকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে।

 

◆ নীলকান্ত প্রধান মাস্টার দিকে তাকিয়ে বলে :- মাস্টার মশাই; আপনার বিচার রায় ঘোষণা করুন। আজকের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যদি সবাই মিলে আমাকে আবার মারধর করেন, তাহলে কিন্তু নতুন করে আবার একজন ছাত্রের জীবনে সন্ত্রাসের পথে যেতে বাধ্য হবে। আমি কোন অন্যায় করিনি।

 

◆ প্রধান মাস্টার মহাশয় বলেন :- আজকের ঘটনার জন্য পন্ডিত মাষ্টারকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। তারপর পন্ডিত মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনি ছাত্রদের এভাবে আর পেটাবেন না। আপনার বিরুদ্ধে ছাত্রদের কাছে থেকে বহুবার নালিশ এসেছে। ছাত্রদের শাসন করুন কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে নয়। 

 

আপনি নিজেই দেখুন। নীলকান্ত কে কিভাবে মেরেছেন! মারতে মারতে তার জামা পর্যন্ত ছিঁড়ে গেছে কিন্তু ছাত্রদের প্রতি একটু মায়া, দয়া, সহানুভূতি ও মানবতা দেখান। আপনার পাড়ার ছেলে যদি রাগের বশবর্তী হয়ে কিছু করে বসে তার দায়ভার কে নেবে?

 

◆ প্রধান মাস্টার মশাই চেয়ার থেকে উঠে ঘুরে নীলকান্ত কাছে গিয়ে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, বাপ; বাড়ি চলে যা আর এরকম করিস না! লেখাপড়ায় মন দে।

 

◆ নীলকান্ত সুযোগ পেয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে পন্ডিত মাস্টারের কাছে গিয়ে আবদার করে মাথা নিচু করে বলে :- জ্যাঠামশাই; আমার চিকিৎসার টাকা দেন।

 

◆ পন্ডিত মাস্টার বলেন :- কত টাকা দিতে হবে।

 

◆ নীলকান্ত বলে :- কমপক্ষে হাজার টাকা তো দেবেন। আমার শরীরের এক্সরে করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে হাড়গোড় ভেঙে গেল কিনা! যদি আরও বেশি টাকা লাগে তাহলে আবার আপনার কাছে হাত পাতবো।

 

◆ অন্যান্য মাস্টার মশাইয়েরা নীলকান্তকে সমর্থন করে পন্ডিত মাষ্টারের উদ্দেশ্যে বলেন :- মাস্টারমশাই দিয়ে দেন ঝামেলা বিদায় হোক।

না হলে আবার কোন বিপদে ফেলে দেবে।

 

◆ মাস্টার গণের চুপচাপ থাকতে দেখে নীলকান্ত উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, মরে গেলাম রে মরে গেলাম রে কি ব্যথা বলে চিৎকার করে বেঞ্চের উপর বসে পড়ে বলে :- পন্ডিত মাস্টারের গায়ে কি জোর রে বাবা! একদম নড়তে চড়তে পাচ্ছিনা।

 

◆ প্রধান মাস্টার বলেন :- কি হলো নীলকান্ত! আবার বসে পড়লে।

 

 ◆ নীলকান্ত যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বলে :- মাস্টারমশাই খুব যন্ত্রণা হচ্ছে টাকা দেন, ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে বাড়ি যেতে হবে। বাড়িতে গিয়ে আবার বাবার সাথে কি অশান্তি হয়? তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।

 

◆ প্রধান মাস্টার মশাই তার কাছে যা ছিল তা নীলকান্তের হাতে দিয়ে বলেন তাড়াতাড়ি ঔষধ কিনে নে। তারপর উপস্থিত মাস্টারবানের উদ্দেশ্যে প্রধান মাস্টার বলেন, আজ পন্ডিত স্যারের বিপদ হয়েছে কিন্তু আগামীকাল আমাদের হতে পারে। তাই সবাই মিলে মানবিক দিক দিয়ে নীলকান্ত কে চিকিৎসার সাহায্য করা আমাদের উচিত।

 

◆ যা কাছে যা টাকা ছিল সবাই নীলকান্তের হাতে দিতে শুরু করে । 

◆ নীলকান্ত টাকা গোনা শেষ করে বলে :- মাত্র ৮০০ টাকা হয়েছে কিন্তু এখনো ২০০ টাকা বাকি আছে। তারপর পন্ডিত মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বলে, তাহলে বাড়িতে গিয়ে বড়মার কাছ থেকে ২০০ টাকা নিয়ে আসব। নীলকান্ত রুমের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে সবার উদ্দেশ্যে প্রণাম ও সালাম জানিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করে।

 

◆ মাস্টার মশারা ভাবে কি বিপদেই না পড়েছিলাম! আপদ বিদায় হয়েছে তো বেঁচে গেলাম।

 

◆ নীলকান্ত চলতে চলতে ভাবে দশে মিলে করি কাজ কিন্তু হার জিত নাহি লাজ। নীলকান্তের লজ্জা ঘেন্না ভয় কিছু নাই। ছোট বেলা থেকেই পিটানী খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে। বন্ধু আলমগীরের বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে হবে।

 

◆ নীলকান্তের চলার ভঙ্গি দেখে রাস্তার লোকজন বিরাট অপরাধীদের ভাবে তাকিয়ে দেখতে থাকে।

 

◆ আলমগীরের মা নীলকান্ত কে সংরক্ষিত বাড়ির মধ্যে আসতে দেখা মাত্রই রেগে উঠে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে।

 

◆ আলমগীরের বাবা ঘর থেকে বের হয়ে আলমগীরের মা কে বলেন :- খামাখা ছেলেটার উপর বকাবকি করে কোন লাভ আছে, দেখো তোমার ছেলেকে দেখতে বাড়িতে চলে এসেছে।

 

◆ নীলকান্ত বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আলমগীর আলমগীর বলে ডাকতে থাকে।

 

◆ আলমগীরের বাবা তার ছেলেকে ডেকে দুই বন্ধুর সাথে হাত মিলিয়ে দেয়।

 

◆ আলমগীরের বাবা নীলকান্ত করুন অবস্থা দেখে বলে :- এ কি অবস্থা হয়েছে তো? বলে তার ডাক্তারখানা থেকে ঔষধ ও ব্যান্ডেজ নিয়ে এসে ক্ষতস্থানে যত্ন করে ঔষধ লাগাতে থাকে।

 

◆ নীলকান্ত নির্লজ্জের মত আলমগীরের মায়ের কাছে গিয়ে বলে :- চাচি; খুব খিদে পেয়েছে, ভাত খেতে দাও। 

 

◆ আলমগীরের মা চুপচাপ থাকার জন্য নীলকান্ত পা জড়িয়ে ধরে বলে :- চাচি; আর কোনদিন এরকম হবে না মাফ করে দাও। আলমগীর তো আমার বন্ধু।

 

◆ আলমগীরের বাবা বলেন :- আলমগীরের মা; মান অভিমানের পালা শেষ করে আর ছেলেটার খেতে দাও।

 

◆ নীলকান্ত হাজার টাকা নিয়ে বন্ধু সাইফুলের বাড়িতে গিয়ে তার মায়ের হাতে টাকা দেয়। 

  ------------------------------------~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ রচনা কাল :- ২৭ শে জুলাই ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে।

শ্রী শ্রী মা সেবাশ্রম। দোলন ঘাটা, খাটুরা, মাঝদিয়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ।

◆ সংশোধনের তারিখ :- ৯ আগস্ট ২০২৩ সালে। দত্তপুলিয়া যুব গোষ্ঠী ক্লাব, নদীয়া।

----------------------------------------------------------~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

 ------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

 

                                                গল্প নম্বর :- ১০

 

ছেলের হাতে বাবা খুন।

 

       গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

(কবিতা দিবস ও কবির ভাবনা ২২ যৌথ কবিতা সংকলনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।)

 

◆ রচনার শ্রেণী :- সামাজিক অবক্ষয় ও শিক্ষামূলক বাস্তব অনুগল্প। 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ ভোর বেলা প্রতিবেশী কান্নার আওয়াজ শুনে মহাদেবের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আওয়াজ লক্ষ করে এগিয়ে গিয়ে জানতে পারে কর্মকার বাড়ির বয়স্ক সজল কর্মকার গামছা গলায় দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

 

◆ মৃতের একজন ছেলে আর দুটি মেয়ে। ছেলে ঘরের নাতি নাতনি নিয়ে দুঃখের সংসার। ছেলে বৌমা মৃতের খেতে পড়তে দেয়নি, এই নিয়ে অনেক বার গ্রামের মেম্বার সহ কয়েকজন ব্যক্তি কর্মকারের বাড়িতে মিটিং হয়েছে। মৃতের ছেলেকে পাড়া প্রতিবেশী গণ তার বাবাকে খেতে দেওয়ার জন্য প্রথমে অনুরোধ করে কিন্তু রাজি না হওয়ায় হুমকি দিয়ে থাকে, তবুও কোন কাজ হয়নি।

 

◆ সজল কর্মকার মহাশয়ের যতদিন শরীরে জোর ছিল, ততদিন লোহা পিটিয়ে দা, কুড়াল ও কাঁচি ইত্যাদি তৈরি করে নিজের জীবন নির্বাহ করতেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে ছেলে বৌমার কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সজল বাবুর তৈরি পাকা বাড়িতে থাকার কোন অধিকার ছিল না। পাশে থাকা জরাজীর্ণ ভাঙা ঘরে একা বাস করতো। খাওয়া দাওয়া হোটেলে চলতো।

 

◆ সজল বাবুর একমাত্র ছেলে তড়িঘড়ি করে লাশ শ্মশানে নিয়ে যায়। কয়েক জন প্রতিবেশীর মাধ্যমে চিতায় উঠানোর তড়িঘড়ি ব্যবস্থা চলতে থাকে।

 

◆ সজল বাবুর আত্মহত্যার চিহ্ন দেখে পাড়ার লোকের সন্দেহ হয়। মৃতের ছেলে বৌমা কে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। বরং প্রতিবেশীদের উপর উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলতে শুরু করে।

 

◆ প্রতিবেশীর মধ্যে থেকে তৎক্ষণাৎ পাড়ায় থাকা সহযোগী পুলিশকে ফোন করে জানিয়ে দেয়। কিছু সময়ের মধ্যেই থানার পুলিশ শ্মশানে এসে হাজির হয়। সেই মুহূর্তে সজল কর্মকারের লাশ জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য তার ছেলে আগুন হাতে নিয়ে ঘুরতে থাকে।

 

◆ পুলিশ তাৎক্ষণিক মৃতের ছেলেকে বাধা দান করে এবং লাশকে পোসমাডাম করার জন্য ডোমকে নির্দেশ দেন। পুলিশ তার ছেলে বৌমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য থানায় নিয়ে যায়। 

 

◆ পুলিশ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ভয় দেখিয়ে সজল কর্মকারের ছেলে-বৌমা কে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তার বাবার হত্যা করার ঘটনা বিস্তারিত ভাবে জানায়। 

 

◆ স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলিত হয়ে তার বাবাকে হত্যা করার পর, গামছা গলায় বেঁধে দেওয়া হয়। অসুস্থ বাবাকে দেখাশোনা করতে করতে নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। 

 

◆ পোস্টমাডাম রিপোর্ট অনুসারে হত্যার মামলা দায়ের করে দুজনকে কোর্টে চালান করে।             

      

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ রচনাকাল :- ২৩/০৭/২১ সাল। দত্তপুলিয়া যুব গোষ্ঠী ক্লাব,নদীয়া।

◆ সংশোধনের তারিখ :- ১০ আগস্ট ২০২৩ সালে। কবি ও সাহিত্যিক দীনবন্ধু সরকারের বাড়ি, বগুলা, নদীয়া। 

----------------------------------------------------------

 

 

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

 

 

 

 

                                                     গল্প নম্বর :- ১১

 

বৌমার অত্যাচার শাশুড়ির।

   (সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জিত।)

গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

(কবিতা দিবস ও কবির ভাবনা ২২ যৌথ কবিতা সংকলনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।)

 

◆ রচনার শ্রেণী :- সামাজিক অবক্ষয়ের শিক্ষামূলক বাস্তব অনুগল্প।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ সুভদ্রা হালদার উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বাদুড়িয়া থানার এলাকার সুভাষ পল্লী গ্রামে বসবাস করেন। দেড় বছর আগে স্বামী মারা গেছে। তেষট্টি বছরের বৃদ্ধা সুভদ্রা হালদার এখন বড় একা। বড় ছেলে-বউমা খেতে দেয়না। ছোট ছেলে দুমুঠো খাবার দিলেও কিন্তু ছোট বৌমার অত্যাচার লাগাম ছাড়া। 

 

◆ একদিন তিন ছেলে মিলিত হয়ে মায়ের কাছে এসে বলে :- "মা, তোমার বয়স হয়েছে। তোমার নামের জমি বাড়ি আমাদের নামে লিখে দাও।

 

◆ মা সুভদ্রা বলেন :- জমি আছে তার জন্য ঘরে থাকতে পারি আর অবহেলায় হলেও এক মুঠো খেতে দিচ্ছে। তিন ছেলে ও তিন বৌমার ব্যবহার চোখে দেখছি, তাতে জমি ও বাড়ি লিখে দিলে রাস্তায় ভিখারীর মতন ঘুরে বেড়াতে হবে।

 

◆ বৌমারা উত্তেজিত হয়ে বলে :- এবার তোমার মজা দেখাচ্ছি। অত্যাচার করে তাড়াতাড়ি মরে ফেলবে।

 

◆ মা সুভদ্রা ঘরের বারান্দায় বসে ভাবে মনে:- এই বৃদ্ধার সাথে ছেলে ও বৌমা সহ কেউ ভাল করে কথা বলে না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এক কাপ গরম চা, সেটাও আজকাল জোটে না। 

 

◆ ছেলে-বউমা ধোঁয়া ওঠা কাপ হাতে নিয়ে গল্প করছে। এতো সুখের কথা নয় কিন্তু কাদের জন্য রক্ত জল করে তিলে তিলে এই সংসার গড়ে তোলা হয়েছে। বৃদ্ধা বয়সে ছেলে বৌমার হাতে একটু সেবা সুস্থতা পাওয়ার আশা কে না করে?

  

◆ আমার স্বামী মরে গিয়ে কিন্তু এই ছেলে বৌমার নরক যন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আমার স্বামীর জমি,বাড়ি ও ব্যবসা আর আমাকে করে চলেছে অবহেলা। 

 

◆ রাতের শুকনো রুটি অনেক সময় ধরে হজম করতে হয়, তবুও শেষ বয়সে খিদের বড় জ্বালাতন করে। বেলা গড়িয়ে গেলেও কেউ ফিরে তাকায়না, অথচ সব কিছু ঘরে হচ্ছে।

 

◆ রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা ডালে সম্বার দেওয়ার গন্ধে খিদে চাগিয়ে ওঠে। চিত্‍কার করে বলতে ইচ্ছে করে, খিদে পেয়েছে কিন্তু লজ্জা লাগে। বাইরের কেউ যদি জানতে পারে, ভেবে গলার স্বর নেমে যায় কিন্তু তবুও বলতে হবে।

 

◆ শাশুড়ি সুভদ্রা আস্তে আস্তে বলে :- বড় বৌমা ভীষণ ভাবে খিদে পেয়েছে, কিছু খেতে দাও না।

 

◆ বড় বৌমা রান্না করতে করতে শাশুড়ির কথা শুনা মাত্র তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে শাশুড়ির মুখে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে বলে :- সব সময় শুধু খাই খাই দেখতে পারছেন না, আপনাদের পিন্ডি রান্না করছি। 

 

◆ সুভদ্রা হালদার ছেলে বৌমার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কিন্তু দুর্বল শরীর নিয়ে সুভাষ পল্লি গ্রাম থেকে দশ কিলোমিটার পথ হেটে বাদুড়িয়া থানায় অভিযোগ জানায়।

 

◆ পুলিশ অভিযোগ পেয়ে দুই বৌমা কে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে। আর বৃদ্ধা সুভদ্রা হালদার কে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার ব্যবস্থা করে।

 

◆ গ্রামে প্রতিবেশী থেকে শুরু করে পাড়ায় পাড়ায় মেম্বার ও রাজনৈতিক লোকজন থাকে কিন্তু চোখের সামনে অত্যাচার দেখে চোখ বন্ধ থাকা সমাজের জন্য লজ্জাজনক সমস্যা।

            ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ রচনাকাল :- ২৬/০২/২০২২ সালে। মেদিনীপুর।

 

◆ সংশোধনের তারিখ :- ১১ আগস্ট ২০২৩ সালে। দত্তপুলিয়া হাসপাতাল মোড় অলোকের কম্পিউটার দোকানে থাকাকালীন সময়ে, নদীয়া।

 

----------------------------------------------------------

 

 

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

 

                                                     গল্প নাম্বার :- ১২

 

নিম্ন বর্ণের উপর অত্যাচার।

 (সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জিত।)

 

গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

("মাতৃভূমির স্মৃতির টানে" গল্পের নাম পরিবর্তন করে " নিম্ন বর্ণের উপর অত্যাচার" রাখা হয়েছে।)

 

◆ রচনার শ্রেণী :- জাত পাতের অত্যাচারের এক বৈষ্ণব বাবাজির আত্মচরিত বাস্তব ছোট গল্প।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ সত্যজিৎ দাস বাবাজি মহারাজ রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে আশ্রমের মধ্যে তার ব্যক্তিগত রুমে শুয়ে শুয়ে ভাবে মনে। একুশ বছর ধরে সাধুর বেশ ধারণ করে আছি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থ ক্ষেত্র গুলো ঘুরতে ঘুরতে মানুষের জীবনের বাস্তব ঘটনা গুলো ও বিভিন্ন সমস্যা দেখেছি। 

 

◆ ধনী ব্যক্তিদের দ্বারা গরিব মানুষের উপর অত্যাচার হয়তো আর কোনদিন বন্ধ হবে না। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার সৃষ্টি থেকেই চলে আসছে। বৈদিক ধর্মের বৈষম্যতা আদিকালের সময় থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। 

 

◆ বৈদিক ধর্ম অর্থাৎ সনাতন বা হিন্দু ধর্মের আদি মানব পিতা স্বয়ম্ভু মনু ও মাতা শতরূপা। সমাজ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের জন্য আদি পিতা স্বয়ম্ভু মনু "মনুসংহিতা" নামক আইন গ্রন্থ সৃষ্টি করেন। 

 

◆ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এই মনুসংহিতা থেকেই, অর্থাৎ উচ্চবর্ণ আর নিম্নবর্ণের সৃষ্টি হয়েছে। উক্ত মনুসংহিতার সূত্র ধরে উচ্চ বর্ণের হিন্দু গণ, আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার করে চলেছেন। মানুষের মানবতার ধর্ম বিলুপ্ত হয়েছে। 

 

◆ আধুনিক যুগের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর দাঁড়িয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের এখনো অনেক মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান ও দিল্লি সহ হিন্দু প্রধান হিন্দিভাষী প্রদেশগুলোতে বিভিন্ন জায়গায় এখনো দলিতদের উপর বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। 

 

◆ এই সব উচ্চ বর্ণের মানুষের এলাকায় বসবাস করতে গিয়ে কিন্তু আমি জন্মগতভাবে শূদ্র শ্রেণীর মানুষ হওয়ার সত্ত্বেও, আমার দেহে নয় গুন (৯টা সুতা) পৈতা ধারণ করতে বাধ্য হয়েছি। যা একমাত্র ব্রাহ্মণের জন্মগত ভাবে অধিকার ।

 

◆ ব্রাহ্মনের পৈতা ধারণ না করলে, কিন্তু এই এলাকার মানুষ মূল্যায়ন করে না। আমি পৈতা ধারণ করে উচ্চ বর্ণের সাধু বলে খ্যাতি অর্জন করেছি। সাধারণ মানুষের ধারণা একমাত্র উচ্চবর্ণের মানুষেরাই কিন্তু সাধুসন্ত হতে পারে। জন্মগত নিম্ন বর্ণের সাধুদের কে শাস্ত্র গ্রন্থ সহ অতীত ও বর্তমান যুগের মানুষেরা কোনদিন মূল্যায়ন করেনি আবার ভবিষ্যতে কখনোই করবে না।

 

◆ এই সব এলাকায় মাঝে মধ্যে জাত পাতের লড়াই সহ খুন খারাবি চলতে থাকে।

 

◆ সাধু সন্ন্যাসী তৃষ্ণায় মরে গেলেও কিন্তু নিম্ন বর্ণের মানুষগুলো এক গ্লাস জল দেওয়ার কোন অধিকার নেই। কোন কারনে জল দান করলে, উচ্চ বর্ণের মানুষেরা তাদের বিভিন্ন ভাবে শান্তি সহ অত্যাচার করতে থাকে। উচ্চবর্ণের মানুষের জলের কল বা কুয়া ছোঁয়া তো দূরের কথা। 

 

◆ বহুবার দেখেছি নিম্ন বর্ণের মানুষ তৃষ্ণার্ত হয়ে উচ্চবর্ণের জলের কুয়া স্পর্শ করার জন্য দলিত শ্রেণীর মানুষকে পিটিয়ে খুন করেছে।

 

◆১৯৫৬ সালে উত্তর প্রদেশের কোন এক গ্রামে দেখেছিলাম, উচ্চবর্ণের জলের কুয়া স্পর্শ করে জল পানের পরিণতি। নতুন জলের কুয়া তৈরি করার জন্য কয়েক লাখ টাকা জরিমানা, না দিতে পাড়ায় কিন্তু দলিত শ্রেণীর সমাজের মানুষদের উপর অমানবিক নির্যাতন দীর্ঘদিন চলতে দেখেছি। উচ্চ বর্ণের সমাজপতিদের দাদাগিরির দাপটে কিন্তু থানা পুলিশ উচ্চ প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে থাকে।

 

◆ আমি সাধু বেশ ধারণ করে সাধারণ মানুষের ধর্মের পূর্ণতা ও স্বর্গ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে কিন্তু শিষ্য ও ভক্তদের দেওয়া টাকায়, আজ কোটিপতি ও বিশাল রাজপ্রাসাদের ন্যায় আশ্রমের মালিক হয়ে পড়েছি।

 

◆ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য শিষ্য মহল তৈরি হয়েছে। বৃন্দাবন ধামের সমগ্র সাধু সন্ন্যাসী গণের মধ্যে ও মোহন্তগণের উচ্চ পর্যায়ের ১০ জনের মধ্যে বর্তমানে আমি একজন বাঙালি সন্ন্যাসী।

 

◆ বর্তমান বিংশ শতাব্দীর সাধু সন্ন্যাসী গণ বাতানুকূল শীতাতাপ রুমে বসবাস করে আর যেখানেই যাক না কেন! এক কোটি টাকার উপর দামের গাড়িতে চড়ে।

 

◆ হাজার হাজার আশ্রমবাসী সাধু, সন্ন্যাসী, বাবাজি, মোহন্ত ও মন্ত্র বিক্রি গুরু ব্যবসায়ী গণ সমাজের মানুষের কাছে থেকে ছলে-বলে, কলে-কৌশলে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও প্রতারনার ফাঁদে ফেলে টাকা নিয়ে কেউ লক্ষপতি আবার কেউ কোটিপতি।

 

◆ সাধারণ মানুষেরা ইহজগতে ও পরজগতের পূর্ণ লাভ আবার স্বর্গবাসের আশায় আশায় বিভিন্ন মন্দিরে করে দান। মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সাধু সন্ন্যাসী গুরু বর্গগণ শিষ্যের টাকায় অট্টালিকা বানিয়ে তাদের কোটি কোটি টাকার পাহাড় বানিয়ে চলেছে।

 

◆ সমাজের মানুষের উন্নয়ন, কর্মস্থান, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার কোন দায়বদ্ধতা নেই। 

 

◆ হাজার হাজার আশ্রমের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি আশ্রমে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দেখা যায়। 

 

◆ আবার প্রতিদিন বিনামূল্যে বিভিন্ন আশ্রম থেকে নির্দিষ্ট সময়ে খাবার দেওয়া হয় কিন্তু এর পিছনে গোপন রহস্য এক শ্রেণীর সাধু মোহন্ত গণের ব্যবসায়ী পরিকল্পনা। 

 

◆ বড় বড় ব্যবসায়ী ও সমাজের দুই নম্বর কারবারি ব্যবসায়ী গণের দানের টাকায় কিন্তু এই সব দানছত্র চলে।

 

◆ দানের উপর ভিত্তি করে প্রতিদিনের নির্দিষ্ট বাজেট থাকে কিন্তু বাজেটের শতকরা ৬০ টাকা খরচ করে আর বাদবাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। দাতাগণ অতিরিক্ত ভাবে কয়েক জন কাজের শ্রমিকের টাকা দেয়। 

 

◆ কথায় আছে, যত বেশি কাজ করতে পারবে কিন্তু তত বেশি টাকা আত্মসাৎ করতে পারবে। 

তীর্থ ক্ষেত্রে যত বেশি ভক্ত ও সাধু সন্ন্যাসীর খাওয়ানো যাবে, তত বেশি টাকা আত্মসাৎ করা সম্ভব।

    

 ◆ এত কিছুর মাঝেও কিন্তু মনের শান্তি খুঁজে পাচ্ছিনা। শিষ্য মহলের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে করতে সাধন ভজন বন্ধ হয়েছে। 

 

◆ আশ্রম পরিচালনা করার জন্য একশোর উপরে বেতনভুক্ত কর্মচারী সহ একজন ম্যানেজার নিয়োগ করা হয়েছে। আশ্রমে প্রতিদিন বিনামূল্যে শত শত নারী-পুরুষ আহার করছে কিন্তু একদিন আমি একমুঠো খাবারের জন্য কত কিছু না করেছিলাম।

 

◆ গরিব ও সমাজের নিম্ন বর্ণের মানুষ হওয়ার কারণে সাত পুরুষের ভিটা মাটি হারানোর ঘটনাগুলো স্মৃতির পাতায় বারবার মনে পড়ে।

 

◆ ১৯৩৮ সালে আমি তখন একুশ বছরের নব যুবক। পিতা-মাতা হারা হয়ে সাত পুরুষের কয়েক বিঘা ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে পড়ে ছিলাম। দারিদ্রতার সংসারের মাঝে দিন আনা দিন খাওয়া তবুও ভিটেমাটি বিক্রি করতে রাজি ছিলাম না।

 

◆ বাংলার অত্যাচারী জমিদার শিশির সামন্ত একদিন দলবল নিয়ে আমার ভাঙ্গা ঘরের উঠানে এসে দাঁড়িয়ে বলেন :- সত্যানন্দ; তোমার পাঁচ বিঘা জমি কিন্তু আমার চাই।

 

◆ আমি বিনয়ের সাথে হাত জোড় বলেছিলাম :- বাবু; সাত পুরুষের ভিটা মাটি আপনাকে দিতে পারবে না।

 

◆ জমিদার শিশির শান্ত গলায় বলেন :- তোমার জমি খানি পেলে কিন্তু আমার শখের বাগান আরে দিঘি সমান হবে। জমির জন্য অবশ্যই টাকা তুমি কিছু পাবে।

 

◆ আমি বলেছিলাম :- না বাবু; আমি জমি দিতে পারবে না।

 

◆ জমিদার শিশির ক্রোধিত হয়ে বলেন :- জমিদারের আজ্ঞা পালন না করে কিন্তু তার সঙ্গে বিবাদ করেছে, তোমার সাত পুরুষের ভিটা মাটি সহ পাঁচ বিঘা জমি কেড়ে নেবো। 

 

◆ আমি বলেছিলাম :- আপনি; আমাদের ভূস্বামী, এই জমি ছাড়া আমার আর কিছু নাই। বাবা-মায়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে কিন্তু ঋণের দায়ে সব গেছে চলে। এই প্রজা কে দয়া করুন।

 

 ◆ কয়েক মাস পরে জমিদারের নির্দেশে আমাকে জমিদারের লোকজন ধরে নিয়ে আম বাগানের মধ্যে একটি গাছের ডালে উল্টো করে অর্থাৎ পা দুটো গাছের ডালে বেঁধে দেয়। ঝুলন্ত অবস্থায় চাবুক মারতে থাকে।

 

◆ জমিদার শিশির বলেন :- তোমার মা ভিটেবাড়ি বন্ধক রেখে কয়েক হাজার টাকা আমার কাছ থেকে সুদে নিয়েছিল। সুদ আসলে টাকা দাও, না হয় জমি লিখে দাও।

 

◆ আমি চোখের জলে কপাল ভিজিয়ে বলেছিলাম :- বাবু; এই সব মিথ্যা ষড়যন্ত্র করেছেন কিন্তু জমি আমি দেবো না। যদি আমার মৃত্যু হয় হোক।

 

◆ জমিদারের লোকজন আমার উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় আর আমার আর্তনাদ চিৎকার আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে এবং অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বনের পাখিরা ভয়ে পালিয়ে যায়।

 

◆ জমিদার ক্রোধিত হয়ে আমার হাত চেপে ধরে জমির দলিলের উপর টিপসই নিয়ে নেয়।

 

◆ জমিদার অট্টহাসিতে হাসতে হাসতে বলেন :- সত্যানন্দ; তোমার সাত পুরুষের ভিটা মাটি, এখন আমার দখলে হা হা হা হা হা হা হা হা হা।

 

◆ মন্দিরে ভোরের শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে, মঙ্গল আরতি উপস্থিত হওয়ার জন্য মন্দিরের পূজারী গোপাল বাবাজী সবাইকে আহ্বান করছেন।

 

 ◆ আরো কয়েক বছর পর সন্ন্যাসী সত্যজিৎ মহাশয় মাতৃভূমির টানে শ্রী শ্রী বৃন্দাবন ধামের মন্দির কে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন। একজন কাছের শিষ্য অবনী কান্ত দাস বাবাজি কে আশ্রমের মোহন্ত বানিয়ে তার কাছে আশ্রমের দায়-দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। তারপর হঠাৎ করে একদিন নিখোঁজ হয়ে হারানো সাত পুরুষের জন্মভূমিতে চলে আসেন।

 

◆ জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। "মা (জননী) ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেয়।" 

 

◆ সন্ন্যাসী সত্যজিৎ মহাশয় জন্মভূমিকে প্রণাম করে বলেন, মা দীর্ঘ ২৮ বছর তোমার সাথে দেখা করতে পারিনি কিন্তু অধম সন্তান কে ক্ষমা করে।

 

সাত পুরুষের ভিটেমাটি সহ বসতি পাড়া আজ পরিত্যক্ত জঙ্গলে রূপান্তর হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতবাসী মুক্তির স্বাধীনতা লাভের পর কিন্তু ধীরে ধীরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়। অত্যাচারী জমিদার শিশির সামন্ত কে তার শত্রুগণ সবংশে ধ্বংস করেছে।  

 

◆ তারপর কিছু সময় ধরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এক পরিত্যাক্ত জলের কুয়া দেখতে পায়, ভাবে এই তো আমার সাত পুরুষের ভিটা মাটি। গাছের শুকনো গুড়ির উপর বসে পড়ে মনের আনন্দে গান ধরে।

 

মা গো মা আর ভিক্ষার ঝুলি চাই না,

কর্মের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করবো।

 

সাত পুরুষের ভিটা মাটিতে গড়ে তুলবো  

"মাতৃভূমি মানব সেবা আশ্রয়স্থল "। 

 

নদীমাতৃক বনাঞ্চল এলাকায় বসবাসকারী

সকল শ্রেণীর মানুষকে স্বনির্ভর করে তুলব। 

 

শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাসস্থান, বিজ্ঞান আলোয়

আলোকিত ও চিকিৎসা বাস্তবায়ন করবো। 

 

তবেই তো জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে 

মাতৃভূমির মানুষের সেবা করা হবে।

 

মা গো মা আর ভিক্ষার ঝুলি চাই না।

মা গো মা আর ভিক্ষার ঝুলি চাই না।

মা গো মা আর ভিক্ষার ঝুলি চাই না।              

        -----------------------------------------

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ রচনাকাল :- ৪ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে। তীর্থ ভ্রমণ কালীন সময়ে উমরালা মণি কুন্ড আশ্রম অবস্থান, কোর্টবন, কোশী কলা, মথুরা, উত্তর প্রদেশ, ভারত।

 

◆ সংশোধনের তারিখ :- ১২ আগস্ট ২০২৩ সাল। বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্য, পারমাদন, নলডুগারি, সিন্দ্রানি, উত্তর ২৪ পরগনা।   

----------------------------------------------------------

 

 

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

                                                    গল্প নাম্বার :- ১৩

                   

    ট্রেনের অযাচিত প্রেম।

 (সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জিত।)

 

               গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

◆ রচনার শ্রেণী :- ভ্রমণ কাহিনী। ভালোবাসা এক বাস্তব ছোট গল্প।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ মদন নামে একজন যুবক কাজের সন্ধানে দিল্লি যাওয়ার জন্য হাওড়া স্টেশন থেকে দিল্লি গামী সুপারফাস্ট ট্রেনের অপেক্ষাকৃত সংরক্ষিত অর্থাৎ ওয়েটিং রিজার্ভেশন লিস্ট টিকিট নিয়ে, এক সংরক্ষিত কামরায় উঠে পড়ে ।

 

◆ গাড়িতে ওঠার আগে একবার টিকিট পরীক্ষা করে দেখে নেয় কিন্তু সিট নাম্বার নিশ্চিত সংরক্ষিত হয়নি। 

 

◆ মদন ভাবে মনে :- অগত্য মধুসূদন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিল্লিতে যেতে হবে। 

 

◆ মদন এক বার ট্রেনের কামরার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় এবং ফাঁকা জায়গা দেখে বসার দুই আসনের মাঝে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে।  

 

◆ আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে পায়, একজন সুন্দরী যুবতী জানালার পাশের সিটে বসে আছে। তার ডান পাশে একজন বয়স্ক মহিলা কিন্তু দুই জন মহিলার মধ্যে এক জন বসার মতো জায়গা ফাঁকা রয়েছে। সাহস করে মদন বসার কথা বলতে পারছে না। কারণ এই ভাবে ট্রেনের কামরায় বা বাইরের জগতের সাথে চলাফেরা নেই। একবার ভাবে বসতে গিয়ে যদি অপমান করে কিছু বলে। সিট নম্বর থাকলে অবশ্যই জোর করা যায়।

 

◆ এক সময় হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন চলতে শুরু করে। ট্রেনের নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে শহর, গ্রাম ও বন-জঙ্গল পেরিয়ে দিল্লির দিকে।

 

◆ মদন কে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুন্দরী যুবতী বলে :- কোথায় যাবেন ?

 

◆ মদন বলে :- দিল্লি ।

 

◆ যুবতী হাসি দিয়ে বলে :- সে তো; অনেক দূরের পথ ! মনে হচ্ছে আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন। বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলে কিন্তু সিট পাওয়া যাবে না। তা সাধারণ কামরার টিকিট কেটে সংরক্ষিত কামরায় আসেনি তো?

 

◆ মদন বলে :- না; ওয়েটিং টিকিট কেটেছিলাম কিন্তু এখনো কনফার্ম হয়নি, হয়তো মাঝখানে কোথায় হয়ে যেতে পারে।

 

◆ যুবতী বলে :- তাহলে, ফাঁকা জায়গা পেয়ে বসছেন না কেন?

 

◆ মদন বলে :- আমি ভেবেছি সিট কনফার্ম না হলে রিজার্ভেশন কামরায় বসা যাবে কিনা?

 

◆ যুবতী জোরে হাসি দিয়ে বলে :- আচ্ছা বুঝতে পারলাম; ট্রেন ভ্রমণের আপনার কোন অভিজ্ঞতা নেই, সেই জন্যই বোকার মত দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের পাশেই বসে পড়ুন, কতক্ষন আর দাঁড়িয়ে থাকবেন।

 

◆ বয়স্ক মহিলা যুবতীর দিকে চেপে বসে এবং অতিথি আপ্যায়ন করার জন্য এক পাশে জায়গা করে দেয়। মদন বয়স্ক মহিলার পাশে বসে পড়ে।

  

◆ কিছু সময় চুপচাপ কেটে যাওয়ার পর যুবতী জালনার পাশে থেকে উঠে বয়স্ক মহিলাকে বলে :- ঠাকুমা, তোমার খুব গরম লাগছে না, জানলার ধারে গিয়ে বসো।

 

◆ যুবতী তার বসার আসন পরিবর্তন করে মদনের পাশে এসে বসে আর মদন বোকার মতো নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে তার স্পর্শ বাঁচাতে থাকে।

 

◆ যুবতী বলে :- দিল্লিতে কোথায় যাবেন ?

 

◆ মদন বলে :- কাজের সন্ধানে চলেছি।

 

◆ যুবতী বলে :- জানা শোনা কেউ আছেন।

 

◆ মদন বলে :- এক বন্ধু রাজমিস্ত্রির কাজ করে, বলেছে দিল্লি স্টেশন থেকে নিয়ে যাবে।

 

◆ যুবতী বলে :- বসার আসন নাম্বার যখন নির্দিষ্ট (কনফার্ম) হয়নি, তবে কি রাত জেগে থাকবেন ?

 

◆ মদন হালকা হাসি দিয়ে বলে :- অগত্য মধুসূদন; আপনার পায়ের তলায় বসার দুই আসনের মাঝে ফাঁকা জায়গায় দিব্যি এক রাত কাটিয়ে দেবো। বাংলায় একটা প্রবাদ বাক্যে বলে :- এক রাত জেগে থাকলে, শত রাত জীবিত থাকা যায়।  

 

◆ যুবতী মৃদু মৃদু হেসে বলে :- বাবু মশায়, মেয়েদের মন জয় করার জন্য কবির কল্পনায় আপনার মহিমা প্রকাশ করতে হবে না।

 

◆ মদন চুপচাপ হয়ে ভাবে মনে :- মনের অজান্তে হয়তো বেশি কিছু বলে ফেলেছি। দেখে মনে হচ্ছে আভিজাত্য সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে কিন্তু আলাপ ব্যবহার নমনীয়। এই সুন্দরী মহিলাকে আমার মনে ধরেছো কিন্তু ভালোবাসার কথা বলার সুযোগ এখনো আসেনি।

 

◆ কয়েক ঘণ্টা পরে যুবতী বলে :-আরো মশায়, কথাবার্তা বলছেন না, সময় কাটবে কেমন করে! আসুন একদান লুডু খেলার মধ্যে দিয়ে সময় কে পার করে দেয়।

 

যুবতী বসার আসনের নিচ থেকে ব্যাগ থেকে লুডু খেলার বোর্ড ও গুটি বের করে বলে :- মদন বাবু, উপরে শোয়ার আসনে চলে আসুন। বলে সিঁড়ি দিয়ে থর থর করে উপরে উঠে পড়ে।

 

◆ মদন ইতস্তবোধ করে ভাবে মনে :- যাবো কি! যাবো না?

 

◆ বয়স্ক ঠাকুমা দুষ্টু-মিষ্টি মুচকি হাসতে হাসতে মদনের ধাক্কা দিয়ে বলে :- আরো; আমার নাতনি ডাকছে শুনতে পাচ্ছো না! যাও উপরে গিয়ে লুডু খেলা করে, তাহলে মন ও শরীর ভালো থাকবে। সময় কেটে গিয়ে ক্লান্তি বোধ দূর হয়ে যাবে।

 

◆ মদন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে, অসাবধানতার কারণে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার মত হয়-আর সেই মুহূর্তে যুবতী হাত ধরে টেনে উপরে তুলে নিয়ে এসে বলে :- মনে হচ্ছে; ট্রেনে চড়ার অভ্যাস নেই, তারপর সুন্দরী মহিলার আহবানে সাড়া দিতে গিয়ে --------------------।

 

◆ যুবতী লুডু খেলা করতে করতে বলে :- আপনার পরিবারে কে কে আছেন ?

 

◆ মদন বলে :- একমাত্র ভালোবাসার মতো বউ বাদে, বিধবা মা, এক ভাই ও এক অবিবাহিত বোনকে নিয়ে সংসার।

 

◆ যুবতী হাসতে হাসতে বলে :- মদন বাবু, দারুণ বলেছেন। আমারও, আপনার মত কিন্তু একটু ব্যতিক্রম আছে। আপনাকে যত বোকা মনে করেছিলাম কিন্তু আপনি তো বোকা না। আবার রসে বসে কথা বলতে পারেন।

 

◆ মদন বলে :- ঠিক বুঝতে পারলাম না ।

 

◆ মদনের গুটি কেটে দিয়ে যুবতী বলে :- নিজের গুটি গুলো ঠিকমত চালাতে পারছেন না, তাহলে সংসার করবেন কি করে?

 

◆ মদন বলে :- সংসারের খেলাটাও লুডু ও দাবা খেলার মতো কাটা-কাটি ও হার-জিত থাকবেই। আর সংসার চক্রের মাঝে মেয়েদের কাছে-ছেলেরা চিরকাল হেরে থাকে। পাড়ার বৌদিরা বলেন, লাঠির জোরে নাকি সংসার চলে।

 

◆ যুবতী হাসতে হাসতে বলে :- ঠিক বলেছেন, যেখানেই যাবে সেখানেই লাঠির জোর সব সময় দরকার হয়।

 

◆ মদন বলে :- সংসার চক্রে "বিশ্বাস" নামক ছোট একটি শব্দ কে মজ্জাগত করে রাখতে হয়। না হলে হনুমানের মত সোনার লঙ্কায় আগুন লেগে যায়।

 

◆ যুবতী হাসতে হাসতে বলে :- আরে মশাই; মনে হচ্ছে আপনি তো সংসারের খুঁটিনাটি সবই জানেন।

 

◆ মদন বলে :- অল্প বয়সের বাবা হারা হই আর কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা করেছি। আবার সংসারে চরম দারিদ্রতার জ্বালা অনুভব বর্তমান সময়ে করে চলেছি। 

 

অতল সমুদ্রের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিন্তু অজানা উদ্দেশ্যে অবিরাম ভাবে সাঁতার কেটে চলেছি। 

 

কখনো আশার আলো দেখি আবার 

কখনো চরম নিরাশায় ভুগতে থাকি।

সান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নাই পাশে,

১৬ বছরের বোনকে দিতে হবে বিয়ে।

জন্মভূমি ত্যাগ করে কাজের সন্ধানে

দেশের রাজধানী দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা।

 

মদন তার বিপক্ষে খেলোয়াড়ের একটি গুটি কেটে দিয়ে মুখে হালকা হাসি দিয়ে বলে :- আরো ম্যাডাম; গুটি বাঁচাতে পারলেন না। 

 

◆ যুবতী বলে :- না; কিন্তু মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন বার বার বিরক্ত করছে।

 

◆ মদন বলে :- বলে ফেলুন, জানা থাকলে অবশ্যই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।

 

◆ যুবতী বলে :- তা কোন মেয়ের চক্রে পড়েছেন। বলে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকায়।

 

◆ মদন বলে :- লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু কিন্তু হয়নি। মেয়েদের চক্রে পড়া তো দূরের কথা, আমার জীবনের ২৮ বসন্ত পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন মহিলা ভালোবাসার ইঙ্গিত পর্যন্ত করেনি। আচ্ছা আমি দেখতে কি ভীষণ খারাপ?

 

◆ যুবতী চন্দনা তিন ঘর গুটি এগিয়ে দিয়ে ভাবে মনে :- মদনবাবু ভালবাসার ইঙ্গিত করছে কিন্তু কথাবার্তা বলতে বলতে আরো তথ্য জানতে হবে। দেখে তো মনে হচ্ছে সরল-সোজা মানুষ কিন্তু একদম বোকা নয়।

 

◆ মদনের ইঙ্গিতপূর্ণ কথার মানে নিজের মনে উপলব্ধি করতে পেরে আনন্দিত হয়ে চিৎকার করে চন্দনা বলে :- ছয় ছয় আরেক এবার কিন্তু পাঁচ হয়েছে। এবার কিন্তু মদন বাবুর দুইটি গুটি খাওয়া যাবে। বলে হাতে তালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে।

 

◆ মদন লুডুর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে :- খেলায় চোরাকারবারি হচ্ছে। বলে মাথা উঁচু করতেই, চন্দনার থুতনির সাথে মদনের মাথা ঠোকাঠুকি হয়। 

 

◆ চন্দনা হাসতে হাসতে বলে :- আরে মশাই; এক ঠোকাঠুকি করলে কিন্তু যমরাজের মতো শিং গজাবে। বলে দুই হাত দিয়ে মদনের মাথা ধরে আরো তিনবার ঠোকাঠুকি করতে থাকে।

 

◆ মদন বলে :- আধুনিক যুগের বিংশ শতাব্দীর মহিলা হয়েও কিন্তু অন্ধ কুসংস্কার কে বিশ্বাস করেন ?

 

◆ চন্দনা বলে :- কুসংস্কার বড় কথা নয়, আসল কথা অন্তরঙ্গ মানুষের সাথে তিন বার ঠোকাঠুকি হয়ে থাকে। অন্য কেউ করলে কিন্তু সেটাকে আঘাত হিসাবে ধরে ঝগড়া অশান্তি বাদে। 

 

◆ নতুন করে আবার খেলা করতে করতে মদন বলে :- আপনার মাথায় অনেক বুদ্ধি আছে। আপনি নিশ্চয় উচ্চশিক্ষিত ও আভিজাত্য সম্পন্ন মহিলা। সে যাই হোক কথায় কথায় আমার পরিচয় দিয়েছি কিন্তু আপনার পরিচয় নেওয়া হয়নি।

 

◆ চন্দনা লুডু খেলা বন্ধ করে লুডু বোড গুছিয়ে নেয়। মুখমন্ডলে সূর্যের আলোকে ঢেকে গিয়ে ঘন কালো মেঘে পরিণত হয়ে যায়। আর হালকা মেঘের গর্জনের সাথে ভারী বর্ষণ শুরু হয়। 

 

◆ মদন অপরাধীর মত জড়োসড়ো হয়ে, আস্তে আস্তে বলে :- আমি; আপনার মনে নিশ্চয়ই দুঃখ দিয়ে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করবেন, নিচের দিকে যাচ্ছি।

 

◆ চন্দনা এক হাত দিয়ে মদনের হাত চেপে ধরে আর অন্য হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলে :- কপাল আমার মন্দ, দুঃখের কথা আর কি বলবো ?

 

◆ মদন বলে :- আমাকে যদি বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনার জীবনের দুঃখময় ঘটনা জানাতে পারেন।

 

◆ চন্দনা বলে :- বিয়ের ছয় মাসের পর এক পথ দুর্ঘটনায় স্বামী মারা যায়। তাকে কে চিরদিনের মতো চিতার আগুনে পুড়ে ছাই করে, সুবাসিত চন্দনের সৌরভ হারিয়ে বিধবা হয়েছি।

 

◆ চন্দনার চোখের জল মুছে দিতে দিতে মদন বলে :- সত্যিই; অসময়ে বিধবা হয়ে ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। বিধির বিধান মানুষের কি সাধ্য আছে?

 

◆ চা ওয়ালা বলে :- গরম চায়ে, গরম চায়ে। 

 

◆ মদন বলে :- একটু চা পান করুন মনটা আবার আগের মত তরতাজা হয়ে যাবে। চা বিক্রেতা কে তিনটি চা দিতে বলে। 

 

◆ দীর্ঘ সময় ধরে দু'জনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা চলাতে থাকে।

 

◆ মদনের প্রশ্নের উত্তরে একসময় চন্দনা বলে :- আরে মশাই; এখন নতুন করে কোন পুরুষের সাথে মন দেওয়া নেওয়া হয়নি কিন্তু হতে কতক্ষণ! 

 

◆ মদন বলে :- দিল্লি আপনার বাবা কি করেন?

 

◆ চন্দনা বলে :- বাবা-মা সহ ঠাকুমা কে নিয়ে দিল্লি যাচ্ছি। দিল্লিতে বাবার বড় ব্যবসা ও নিজস্ব তিন তলা বিশিষ্ট বসবাসের বাড়ি রয়েছে। 

 

◆ মদন বলে :- বাংলায় কোথায় বাড়ি?

 

◆ চন্দনা বলে :- পূর্বপুরুষের পৈত্রিক বাড়ি বাঁকুড়া জেলার রাধা কৃষ্ণ নগর গ্রামের দামোদর নদীর পাড়ে।

 

◆ মদন বলে :- গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকে।

 

◆ চন্দনা বলে :- গ্রামের বাড়িতে বাবা মা বেড়াতে গিয়েছিলেন। আমি ঠাকুমা, জ্যাঠা, জেঠিমা, কাকা, কাকিমা, দাদা, বৌদি ও দিদিদের সাথে ছোটবেলা থেকে গ্রামের পরিবেশের সাথে বড় হয়েছি।

 

◆ মদন বলে :- পড়াশোনা কোথায় করেছেন।

 

◆ চন্দনা বলে :- গ্রামের বাড়িতে বসবাস করে শহরে কলেজে পড়াশোনা করেছি কিন্তু মাঝে মধ্যে স্কুল ছুটির সময়ে দিল্লিতে বাবা-মা, ছোট ভাই-বোনের সাথে বসবাস করি।

 

◆ প্রকৃতির নিয়মে দিনের আলো বিদায় নিয়ে, ধীরে ধীরে সন্ধ্যা থেকে রাত নয়টা হয়ে যায়। 

 

◆ চন্দনা; রাতের খাবারের জন্য তার বাবা-মায়ের সাথে আলোচনা করে তারপর মদন সহ সবাই একসাথে খাওয়ার ব্যবস্থা করে। 

 

◆ খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর চন্দনা বলে :- মদন বাবু; আমাদের একজন ব্যক্তির আসার কথা ছিল কিন্তু কোনো কারণবশত আসতে পারেননি। আমাদের কারখানায় ম্যানেজারের পদে কাজ করার কথা হয়েছিল। 

 

◆ চন্দনার ঠাকুমা বলেন :- দাদু ভাই; উপরের ডান দিকের সিটে গিয়ে শুয়ে পড়ো। একজন বাঙালি হয়ে আরেক জন বাঙালি কে কাঙ্গালের মতো করে রাখতে পারি না। 

 

◆ চন্দনার দিকে তাকিয়ে মদন বলে :- আপনার কাছে চির ঋণী হয়ে গেলাম, শুভ রাত্রি।

 

◆ হালকা মুচকি হাসি দিতে দিতে চন্দনা বলে :- আরে মশাই; সময় ও সুযোগ পেলে কিন্তু ঋণ শোধ করে দেবেন।

 

◆ মদন হালকা হাসি দিয়ে বলে :- 'ঈশ্বর; সেই সুযোগ কি আর আমাকে দেবে?

 

◆ মদনের কাছাকাছি হয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে চন্দনা বলে :- আপনার সোজাসুজি বিপরীত দিকে থাকবো কিন্তু ঋণের বোঝা বাড়াতে চাইলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

 

◆ মদন শুয়ে চন্দনার সাথে আজকের স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে কল্পনার জগতে ডুবে দিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। অন্যদিকে চন্দনা কামরার আলো-আঁধারিতে মদনের দিকে মুখ করে তাকিয়ে মদনের রূপ যৌবনের সৌন্দর্য কল্পনার মাধ্যমে উপভোগ করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

 

◆ সকালে চন্দনা তার শোয়ার সিট থেকে হাত বাড়িয়ে মদনের হালকা চিমটি কেটে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় আর মদন তাড়াহুড়ো করে বিছানার উপর উঠে বসে।

 

◆ চন্দনা হাসতে হাসতে রহস্য করে বলে :- মাত্র দুই হাত লাফ দেওয়ার সাহস নেই কিন্তু সংসারের জলময় সমুদ্রে সাঁতার কাটবে কি করে ? 

 

◆ চন্দনা ভাবে মনে :- রাতের অন্ধকারে সবার অলক্ষ্যে, মদন একবার ভালবাসার হাত বাড়ালেই কিন্তু দুটি হৃদয়ের মিলন ঘটে যেতো। ভালোবাসা নিবেদনের ক্ষেত্রে মদন বড়ই লাজুক মনে হচ্ছে। মুখখানা দেখে মনে হচ্ছে আমার কথায় কতই না লজ্জা পেয়েছে।

 

◆ মদন ঘুম ঘুম চোখে বলে :- কি হয়েছে?

 

◆ চন্দনা বলে :- অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে।

তা মদনবাবু, পড়াশোনা কতদূর করেছেন ?

 

◆ মদন বিরক্তি হয়ে মুখ কালো করে বলে :- এই সামান্য কথা জানার জন্য কি! আমার সুখের স্বপ্ন টাকে নষ্ট করে দিলেন। 

 

◆ চন্দনা বলে :- আরে মশাই; নাটক না করে সোজাসুজি বলুন না।

 

◆ মদন চোখে হাত দিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলে :- এপাস-ওপাস আর নিচের থেকে পাস আবার উপর থেকে পাস কিন্তু মাঝখানে ধপাস করে বিয়ে না করেই আবার বিএ পাস।

 

◆ চন্দনা বলে :- চলবে কিন্তু স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে বাস্তবে ফিরে আসুন। জানিনা কোন রাজকুমারীর গল্প শুনে স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন।

 

◆ মদন মৃদু মৃদু মুখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে বলে :- স্বপ্নের নারী হয়তো, সত্যিই; বাংলার কোন এক রাজার আদরের দুলালী রাজকুমারী হবে। তাকে স্পর্শ করার শক্তি হয়তো একমাত্র স্বপ্নের মাধ্যমেই সম্ভব।

 

◆ চন্দনা বলে :- আর কাব্য কথা বলে সময় নষ্ট না করে, কিন্তু দয়া করে হাত মুখ ধুয়ে নেবেন। চা পান করার জন্য বাবা-মা সহ সবাই কিন্তু আপনার অপেক্ষা করে বসে আছে।

 

◆ মদন লজ্জিত হয়ে বলে :- এখনো হয়নি, আমার জন্য অপেক্ষা ।

 

◆ চন্দনা অভিমানের সুরে বলে :- ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রাজকুমারী স্বপ্ন দেখলে তবে, হবে কি করে ?

 

◆ সারাদিন নানারকম অন্তরঙ্গতার কথাবার্তার মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। উভয় উভয়ের আরো কাছে পাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রশ্নের উত্তর চলতে থাকে। 

 

◆ চন্দনা বলে :- মদন বাবু, এক ঘন্টা পরে দিল্লি পৌঁছে যাবে কিন্তু কিছু মনে না করলে, একটা কথা বলার ছিল।

 

◆ মদন মনের অজান্তেই বলে ফেলে :- বল কি বলতে চাও! তুমি কি আমার পর ?  

 

◆ চন্দনা আনন্দে পুলকিত হয়ে বলে :- আমাদের সাথেই চলে, তোমার বিষয়ে বাবা-মা কে বলেছি।

 

◆ মদন ভাবে :- কি করব! কাজ তো আমার চাই কিন্তু আবার চন্দনা কে ভালোবেসে ফেলেছি। আমাকে কি চন্দনার বাবা কোন কাজ দেবেন? 

◆ বড়লোকের মেয়ে চন্দনার খামখেয়ালিপনার বশবর্তী হয়ে, আমাকে ব্যবহার করে নর্দমায় ফেলে দেবে না তো।

 

◆ চন্দনা বলে :- দিল্লি বোম্বে যেখানেই যাও না কেন! সব জায়গায় কাজ করতেই হবে। কাজের দক্ষতা অনুসারে টাকা নামক লক্ষ্মী তার ঘরে ঢুকে পড়ে। এলাকার মানুষের সাথে থাকা অবশ্যই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয়।

 

◆ মদন কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ হয়ে ভাবতে থাকে। চন্দনার সাথে কথাবার্তার মাধ্যমে যা বুঝতে পারলাম। আভিজাত্য সম্পন্ন ব্যবসায়ীর এক মাত্র বিধবা কন্যা কিন্তু চন্দনার সাথে মিলেমিশে থাকতে আমি পারবে তো । আমাকে তো কর্মচারী হিসেবে থাকতে হবে কিন্তু চন্দনা তার ভালোবাসার মর্যাদা কখনো দেবে কি? 

 

 ◆ হয়তো ট্রেনের সময় কাটানোর জন্য আমার সাথে আলাপ পরিচয় কিন্তু ভালোবাসা তো হতে পারে না। তবে কি আমাকে দয়া দেখাচ্ছে ?

 

◆ দুই জনের নীরবতার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে এক সময় ট্রেন দিল্লি স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ে।

 চন্দনা একবার মদনের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ঘুরিয়ে মুখ কালো করে নামার জন্য তার ঠাকুমাকে তাড়াতাড়ি করতে বলে। 

 

◆ মদন মনের সাথে লড়াই চালিয়ে ট্রেন থেকে নামার আগেই, মনে সাহস সঞ্চয় করে চন্দনার সামনে পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে পড়ে।

 

◆ চন্দনা অমাবস্যার অন্ধকারের মতো গম্ভীর মুখ করে বলে :- কিছু বলতে চান?

 

◆ মদন সকলের সামনে চন্দনার হাত ধরে বলে :- চলে তবে, আপন জনের সাথে থাকি। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে এগিয়ে যাবে কিন্তু চন্দনা! আমার এই হাত কখনো ছেড়ে দেবে না তো ?

         

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ রচনাকাল :- 25 জুলাই 2019 সালে। হাওড়া স্টেশন থেকে নিউ দিল্লি সুপারফাস্ট ট্রেনে যাওয়ার সময়ে রচিত।

 

◆ সংশোধনের তারিখ :- ১৩ আগস্ট ২০২৩ সালে। দত্তপুলিয়া বাড়ি থাকাকালীন, নদীয়া।

----------------------------------------------------------

 

 

 

------------------ পৃষ্ঠা সীমারেখা ------------------

 

 

                                                            গল্প নাম্বার :- ১৪

 

     পরের বউ অতি সুন্দর।

 (সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জিত।)

                       গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

◆ রচনার শ্রেণী :- সামাজিক শিক্ষামূলক অনুগল্প। পরকিয়া প্রেমের কাহিনী।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, 

ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। 

 

◆ পুরুষের মনে নিজের বৌয়ের থেকে অন্যের বউকে দেখতে সুন্দর লাগে। পল্লী বাংলার এক যুবক অখিল ঘোষ দুধের ব্যবসা করে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাড়িতে বাড়িতে গরুর দুধ দেওয়া ও নেওয়ার কাজ করে আবার সময় মতো বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা। তার মধ্যে সুযোগ বুঝে কুড়ি লিটার দুধে পাঁচ লিটার জল মেশানো ঘোষেদের বংশপরম্পরায় ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

◆ অখিল এক পল্লী গাঁয়ের অপরূপ সুন্দরী যুবতী শিখা বৌদি কে নিয়মিত এক লিটার করে দুধ দেয়। দুধ দিতে দিতে এক সময় বহু টাকা বাকি পড়ে যায়।

 

◆ শিখা বৌদির বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে অখিল চিৎকার করে বলে :- বৌদি; দুধ নিয়ে যান ।

 

◆ শিখা বৌদি দ্রুত দুধ নেওয়ার বালতি নিয়ে অখিল ঘোষের সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলে :- ঘোষ, আজ এক লিটার বেশি দেবে কারণ বাপের বাড়ির লোকজন আসবে।

 

◆ অখিল দুধ মেপে দিতে দিতে আড্ডা করে বলে :- বৌদি; তোমার রূপ যৌবনের মাধুর্য দাদা বুঝতে পারল না ,সারা বছর বিদেশে পড়ে থাকে।

 

◆ শিখা বৌদি হাসতে হাসতে বলে :- পরের বৌকে শুধু দেখে যাও কিন্তু নিজের বৌয়ের মতো করে কোন দিন কাছে পাবে না, আর ভেবে ভেবে শরীর ও মনকে খারাপ করোনা। 

 

◆ অখিল বলে :- বৌদি দুধের দাম কিন্তু অনেক টাকা বাকি হয়ে গিয়েছে। দেবো, দেবো করে এক বছর ধরে ঘুরাচ্ছে তা দেবে কবে ? আমার তো চিন্তায় চিন্তায় সব শুকিয়ে যাচ্ছে।

 

◆ শিখা বৌদি, দুষ্টুমি করার মাধ্যমে হাসি হাসি মুখে বলে :- বর্তমানে তো মাসে মাসে পেয়ে যাচ্ছে আর কোন কারণবশতঃ হয়তো হাজার দুয়েক টাকা পাবে। কিন্তু চিন্তা করেছো কেন ?

 

◆ অখিল বলে :- এই বাজারে ২০০০ টাকা তোমার কাছে কম মনে হচ্ছে। এই টাকায় কোন বাচ্চা দিচ্ছে না, তাহলে ফেলে রেখে আমার লাভ কি?

 

◆ শিখা বৌদি বলে :- এমন ভাব করছো, যেন টাকা না দিয়ে ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে চলে যাবে, এবার তোমার দাদা একাউন্টে টাকা পাঠালে কিন্তু আগে তোমাকে টাকা দিয়ে দেবো।

 

◆ শিখা বৌদি দুধ ঘরে রেখে এসে বলে :- এই ঘোষ, রৌদ্রের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছো, কিছু সময় বসো- চা জল পান করে যাবে। 

 

◆ অখিল ঘোষ বলে :- না, থাক! যেতে হবে বহুদুরে ঐ উত্তর পাড়ায় ।

 

◆ শিখা বৌদি ঘোষের হাত চেপে ধরে আদর করে বলে :- তোমার ঘরের বৌ, আমার মতো আদর করে এই কাঠফাটা রোদ্দুরে লেবু জলের শরবত ও চা বিস্কুট খেতে দেবে না। সাইকেল রেখে চলে ঘরে, আমার হাতের চা পান করলে কিন্তু তোমার শরীরের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।

 

◆ শিখা বৌদির ব্যবহারিক ছলাকলায় মুগ্ধ হয়ে ঘোষ অখিল বাকি টাকার জন্য চাপাচাপি করে না। দুধের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে ৫,৪৫৬ টাকা বাকি হয়ে যায়।

 

◆ অখিল ঘোষ ভাবে মনে মনে :- বৌদির রূপ যৌবন ও সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। মিলনের ইচ্ছা জাগে মনে কিন্তু সম্ভব হবে কি করে ?

 

◆ একদিন দুপুরে ঘোষ দুধ মেপে দিতে গিয়ে, শিখা বৌদির সদ্য স্নানের মুক্ত বুকের দিকে তাকিয়ে দুধ দিতে গিয়ে মাটিতে পড়তে থাকে।

 

◆ শিখা বৌদি বলে :- এই ঘোষ, তোমার কি হয়েছে! আমার অঙ্গের দিকে তাকিয়ে দুধ ফেলে চলছে।

 

◆ অখিল ঘোষ বলে :- বৌদি; আমার বুকের জ্বালা পোড়া বুঝতে পারে না!

 

◆ শিখা বৌদি বলে :- অপেক্ষা করে জল নিয়ে আসছি, পড়ে যাওয়া দুধে জল দিতে হবে। না হলে নাকি সংসারে অমঙ্গল হয়।

 

◆ অখিল ঘোষ বলে :- থাক, আমার মন প্রাণ উত্তপ্ত করে আর মাটিতে জল ঢালতে হবে না।

 

◆ শিখা বৌদি ভাবে মনে :- স্বামী ঘরে থাকে না কিন্তু দেহের সুখ পাওয়ার জন্য একমাত্র রাস্তা ঐ যুবক ঘোষ । হয়তো কিছু সময়ের জন্য পরকীয়া ভাবে যদি স্বামী সুখ লাভ করা যায়।   

 

◆ অখিল ঘোষ ভাবে মনে সবই কি বৌদির ছোলা কলা? না ভালোবাসার কোন বহিঃপ্রকাশ।

 

◆ শিখা বৌদি বলে :- বুকে বুক রেখে ভরিয়ে দেবে ক্ষুধার্ত যৌবনের আগুন নিভিয়ে। তারপর মনে ভাবে, ঘোষ যে ভাবে আমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, মনে হচ্ছে কিন্তু আমার প্রতি আসক্ত হয়েছে। প্রস্তাব দিলে হয়তো কাজ হতে পারে, দুধের টাকা আর শোধ করতে হবে না।

 

◆ শিখা বৌদির বাড়িতে ঘোষ, প্রতিদিনের অভ্যাসের মতো দুধ দিতে আসে কিন্তু কেউ কারোর কাছে প্রস্তাব রাখতে পারে না ।

 

◆ ঘোষ দুধ মেপে দেওয়ার পর বলে :- বৌদি, দুধের দাম অনেক টাকা বাকি হয়েছে কিন্তু দেবো দেবো করে দিচ্ছে না। 

 

◆ শিখা বৌদি, ঘোষের অঙ্গে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে :- টাকা, আমি দিতে পারবে না কিন্তু টাকা পরিশোধের রাস্তা আছে। 

 

◆ তোমার দেহ স্পর্শ করে বুকে মাথা রেখে মিলনের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করতে চাই,যদি রাজি থাকো তবে এসে রাতে পিছনের দরজা দিয়ে। আমি তোমার ভাব দেখে বুঝতে পেরেছি, তুমি আমার ভীষণ ভালোবাসো।

 

◆ অখিল আনন্দিত মনে বলে:- তাহলে গাঁয়ে গাঁয়ে টাকা শোধ।

 

◆ শিখা বৌদি বলে :- তাই হোক, এসে রাতে তোমার জন্যই থাকবো জেগে।

 

◆ অখিল ঘোষ ভাবে মনে :- আমার বৌ কালো, রোগা পটকা বিশ্রী তার চেহারা। সারাদিন কাজকর্ম করার পরে রাতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে আমার সমস্যাগুলো সমাধান হয় না। বৌদির দেহ কত না সুন্দর, মিলনে দেবে হয়তো নতুন নতুন সুখের সন্ধান ।

 

◆ অখিল ঘোষ রাতের অন্ধকারে মিলনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শিখা বৌদির ঘরে মনের আনন্দে আসে।

 

◆ অখিল মিলনের শেষে ভাবে মনে মনে :- হে ঈশ্বর, এ আমি কি ভুল করলাম! কালা-ধোলা (অর্থাৎ কালো ও সুন্দরী নারীর পার্থক্য নির্ণয়) সব এক জিনিষ, এই করোনা ভাইরাসের দুর্যোগপূর্ণ লকডাউনের বাজারে আমার কেবল দুধের দাম কয়েক হাজার টাকা নষ্ট করলাম।

 

◆ অন্যের ধন-সম্পত্তি, ঐশ্বর্য সুন্দর রূপ যৌবন দেখে, নিজের মনুষ্যত্ব কে বিসর্জন দেওয়া ঠিক নয়।

 

◆ দৈহিক সুখ কিন্তু পরম সুখ নয়।

        

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ রচনাকাল :- ২০ জুন ২০০০ খ্রিস্টাব্দে। দত্তপুলিয়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ।

 

◆ সংশোধনের তারিখ :- ১৪ আগস্ট ২০২৩ সালে। রানাঘাট, নদীয়া।

 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

 

 

 

                                                গল্প নাম্বার :- ১৫

 

                           বন্দিদশায় (সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জিত।)

 

    গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।

 

◆ রচনার শ্রেণী :- সামাজিক শিক্ষামূলক অনুগল্প। নোটবন্দি সমস্যায় বিপদগ্রস্ত বালকের কাহিনী।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

◆ গভীর রাতে দশ বছরের এক বালক মাঠ ঘাট পেরিয়ে পড়িমড়ি করে জোর কদমে ছুটে চলেছে। উঁচু-নিচু ও সমতল-অসমতল জায়গা পার হতে গিয়ে বার বার আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় থেকে রক্ত ঝরছে তবুও আবার উঠে দৌড়াতে শুরু করে।

 

◆ দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় প্রধান সড়কে এসে পড়ে। এই সড়ক দিয়ে দিন-রাতে ২৪ ঘন্টায় হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করে কিন্তু বালকের গাড়ির গতি দিকে কোন নজর নেই। একসময় রাতের টহলদারি পুলিশের নজরে আসে। কয়েক জন পুলিশ বালকের পথ অবরোধ করে তারপর ধরে গাড়িতে তুলে নেয়। 

 

◆ বালকটি কান্না করতে করতে বলে :- আমাকে মারবেন না, যা বলবেন তাই করে দেবো। আমি আর বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করবে না।

 

◆ পুলিশ উর্দু ভাষায় বলে :- آپ کا گھر کہاں ہے؟ অর্থাৎ তোমার বাড়ি কোথায় ?

 

◆ একজন পুলিশ হিন্দি ভাষায় বলে :- आपका घर कहां है।

 

◆ অন্য একজন ইংরেজি ভাষায় বলে :- Where is your home।

 

◆ পুলিশের ভাষা বালক বুঝতে না পেরে জড়োসড়ো হয়ে কান্না করতে থাকে।

 

◆ জম্বু পুলিশের কেউ বালকের ভাষা বুঝতে পারে না। ভাষা শুনে ধারণা করে বাংলা হবে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, না আসাম, না ত্রিপুরা রাজ্যের বোঝা যাচ্ছে না।

 

◆ বালকটিকে জম্বু রাজ্যের কাঁটরা এলাকার কোন এক থানায় নিয়ে আসা হয় এবং একজন দোভাষী কে সন্ধান করা হয়।

 

◆ দোভাষী বাংলা ভাষায় বালকটিকে বোঝানোর চেষ্টা করে বিশ্বাস অর্জন করার জন্য আদর করে সান্তনা দিতে থাকে। একসময় বালকটি কান্না থামিয়ে দোভাষির সাথে কথা বলতে শুরু করে।

 

◆ দোভাষী আদর করতে করতে বলে :- তোমার বাড়ির ঠিকানা বলে বাবা। আমরা ভারতবর্ষের জম্মু রাজ্য সরকারের পুলিশ, তোমার বাবা-মার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসবো।

 

◆ বালকটি তার বাবার নাম সহ বাড়ির ঠিকানা বলতে শুরু করে।

 

◆ দোভাষী বলে :- তুমি কলকাতা থেকে জম্মু রাজ্যে চলে এলে কি ভাবে?

 

◆ বালকটি বলে :- প্রায় এক বছর আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে দিল্লিতে বেড়াতে এসেছিলাম কিন্তু হঠাৎ করে নোট বন্দি শুরু হয়ে যায়। 

 

◆ দোভাষী তার সহযোগী পুলিশ কর্মীদের বলেন :- ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর, ঠিক রাত ৮টা। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে ডিমনিটাইজেশন (Demonetization) বা নোটবন্দির কথা ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন।

 

◆ বালকটি বলে :- বাবা; কয়েকদিনের চেষ্টায় নতুন কিছু টাকা সংগ্রহ করে এবং আমরা দিল্লি স্টেশনে কয়েকদিন অবস্থান করার পর হঠাৎ একদিন কলকাতা যাওয়ার টিকিট পেয়ে যায়। 

 

◆ সবাই তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠতে গি

য়ে, প্রচন্ড ভীড়ের চাপের মধ্যে বাবার হাত থেকে আমার হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমি বিপরীত দিকের গাড়িতে উঠে পড়ি এবং ভাবনা করি বাবা-মা এই বগিতেই আছে। 

 

◆ আমি ট্রেনের মধ্যে বাবা মাকে অনেক বগীর মধ্যে খুঁজেছি কিন্তু দেখা পাইনি, ভেবেছিলাম কলকাতা গিয়ে নিশ্চয় বাবার সাথে দেখা হবে।

 

◆ একদিন ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে পড়ে, ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি বাংলায় কোন কিছুই লেখা নেই। 

 

◆ তখন ভাবি মনে তাহলে আমি হারিয়ে গিয়েছি ও মনের ভয়ে আতঙ্কে কান্না শুরু করে দেয়। অনেকেই ভিখারি মনে করে পয়সা দিয়ে চলে যায়। সন্ধ্যার সময় খিদের জ্বালায় জড়োসড়ো হয়ে কুকুরের মত সিঁড়ির উপরে শুয়ে পড়ি। 

 

◆ একজন ব্যক্তি আমার কাছে এসে খাবার দিয়ে আকার-ইঙ্গিতে বলে :- বাবার কাছে পাঠিয়ে দেবে। আমি বিশ্বাস করে সেই ব্যক্তির সঙ্গে অনেক দূরের এক গ্রামের বাড়িতে যায়। 

 

◆ প্রথম কয়েক দিন আমাকে আদর যত্ন ভালই করতে থাকে। তারপর কুয়ো থেকে জল নিয়ে আসতে হতো এবং মাঠে নিয়ে গিয়ে চাষের কাজ করাতো, না পারলে লাঠি দিয়ে পেটাতে।

 

◆ প্রায় এক বছর জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে চলি কিন্তু বাবা মায়ের কাছে ফেরত যাওয়ার কথা বলতে, আমাকে প্রচন্ড ভাবে মারধর করতো। আমি বাড়ি যাওয়ার জন্য পালিয়ে এসেছি।

 

◆ দোভাষী বলে :- এখানে কেউ তোমাকে মারবে না। সব পুলিশ কাকুরা তোমার বাবা-মায়ের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে কিন্তু কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে।

 

◆ সরকারি নিয়ম অনুসারে বালকটিকে হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক এক সপ্তাহের মধ্যেই জম্বু রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের তৎপরতায় ও বালকটির বসবাসকারী লোকাল থানার সহযোগিতায় এবং চাইল্ড লাইনের কর্মীরা বালকের পিতা-মাতার নিকট পৌঁছে দেন। 

 

◆ বালকটির সাহসিকতার জন্য জম্বু রাজ্যের পক্ষ থেকে সম্মান জানানো হয় ও বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রী সহ নতুন নতুন জামা কাপড় উপহার দেয়।

 

◆ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উক্ত বালকের শিক্ষা লাভের জন্য তার বাবাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। বালকের দুঃসাহসিক অভিযান কে অভিনন্দন জানান।

         

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

◆ রচনাকাল :- 15 জুলাই 2018 খ্রিস্টাব্দে।

দত্তপুলিয়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

 

◆ সংশোধনের তারিখ :- ১৫ আগস্ট ২০২৩ সালে। দত্তপুলিয়া বাড়ি থাকাকালীন, নদীয়া।

 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

।। প্রথম খন্ড সমাপ্ত।।

 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

 

 

 

 

 

                 

 

 

 

 

 

                     

 

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু