বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

প্রিয়তম




             প্রিয়তম


   আজ সকাল থেকেই মীরার মনটা ভয়ানক উচাটন হয়ে রয়েছে। ছেলে , বৌমা -অনি আর নীলা চা, জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে যাবার পর থেকেই মনটা অস্থির হয়ে রয়েছে । কোনো কাজেই মন বসছেনা । বারান্দায় রাখা কাঠের চেয়ারটায় কোনোমতে শরীরটাকে ফেলে দিয়ে , দূরের নারকেল গাছটার ঝিরিঝিরি পাতার দিকে চোখ মেলতেই মন চলে গেলো সুদূর অতীতে।


          তখন কতোই বা বয়েস হবে মীরার ! বড়জোর এগারো কি বারো । সেই প্রথম বাবা- মায়ের সঙ্গে,  হুগলীর অখ্যাত এক গ্রামে , নিজেদের সাত পুরুষের ভিটেতে গিয়ে দাঁড়ানো মীরার। জ্ঞাতিরা অনেকেই সেই ভিটেতে থাকতেন তখনো। মীরাদের তরফটাই শুধু শহরবাসী হয়েছিলো। বিষয় সম্পত্তি সংক্রান্ত কাজেই বোধহয় ডাক পড়েছিলো বাবার। গ্রামে পৌঁছানোর পরেই নিজের নিজের জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো বাবা , মা । একাকিনী মীরা সারা বাড়িতে চক্কর দিতে দিতে কখন যেন হাজির হয়ে গিয়েছিলো এল শেপের একতলা বাড়িটার একেবারে শেষ প্রান্তে । যেখানে মোড় ঘুরেই চোখে পড়েছিলো একখানা নীল রঙের বন্ধ দরজা । ঘরটার পাশের  একটুখানি খোলা জমি কঞ্চির বেড়া দিয়ে ঘিরে কটা দেশি ফুলের গাছে ফুল ফুটে আছে। আর মস্ত একটা আমগাছের ছায়া এসে পড়ে নীল দরজাটায় জাফরির মতো আলো- ছায়ার আল্পনা এঁকে দিয়েছে যেন কেউ। নিজের অজান্তেই এক পা ,এক পা করে এগিয়ে গিয়ে দরজাটায় একটু ঠেলা দিতেই খুলে গিয়েছিলো পাল্লা দুটো। অবাক হয়ে দেখেছিলো ঘর আলো করে দাঁড়িয়ে আছে সে । কি রূপ , কি রূপ । পুরুষের এতো রূপ ও হয় ! আবার ঠোঁটের কোনে টিপিটিপি হাসি । মীরাকে দেখে সেই হাসি বুঝি ছড়িয়ে পড়েছিলো দুই চোখের দৃষ্টিতেও । সঙ্গে অতলে তলাবার আহ্বানও বোধহয় । বুকটা থরথর করে কেঁপে উঠেছিলো মীরার। একেই কি বলে প্রথম দর্শণে প্রেম ? কোনোরকমে দৌড়ে ফিরে এসেছিলো মায়ের আঁচলে । আমগাছটাতে বসে একটা বিরহী কোকিল তখন ডেকে যাচ্ছিলো তার সাথীকে। কুহু কুহু কুহু। আজ সন্দেহ হয় কোকিলটা তার বুকের মধ্যে বসে ডাকছিলো নাতো !


     চিন্তার সুতোটা হঠাৎই নাড়া খেলো । মোবাইলটা বাজছে । ফোনটা ধরতেই অনির গলা -" মা , পৌঁছে গেছি প্রায় । বলছিলাম কি , ভদ্রলোকের নামটা একটু মনে করে দেখোনা । অন্ততঃ ডাকনামটা । আজ এতোবছর পরে ঐ ঘরটাতেই যদি না থাকেন , যদি ---"

  

" না থাকলে , চলে আসিস "- বলে মাঝপথেই ফোনটা রেখে দিলেন মীরা । নাম ! নামে কিই বা আসে যায় ! সেই প্রথম দিনের পর বাবার সঙ্গে কম দিন তো যাননি সেখানে । শেষদিকে তো নেশাগ্রস্তের মতো বাবাকে প্রায় টেনেই নিয়ে যেতেন । সে কি নামের টানে ? না নামের মালিকের টানে ! যতবার গেছেন , ততোবার দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে  সেই অমোঘ আকর্ষণ । মনের গভীরে লেখা হয়ে গেছে একটিমাত্র নাম - ' প্রিয়তম'। সে নামে  আজ কে চিনবে তাকে!

   

          তারপরে তো তাড়াহুড়ো করে বাবা বিয়েই দিয়ে দিলেন । ভাগ্য করে স্বামী পেয়েছিলেন বিনোদকে । মীরার মন পড়তে পারতো লোকটা। মীরার মুখ থেকে , তার মনের মানুষের খবরটা বার করতে পারেনি  অবশ্য কোনোদিন । তবে আছে যে কেউ , সারাজীবন অনুভব করে গেছে তা। বুঝেছে এই আনমনা , বৈরাগিনী মীরার দেহটাই সে পেয়েছে , মনটা নয় । সেই কষ্টেই বুঝি রোগ বাধিয়ে জীবনটা দিলো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মীরা । কে জানে তারও হয়তো স্বামীর প্রতি কর্তব্যে কোনো ত্রুটি রয়ে গিয়েছিলো । না হলে মৃত্যুর আগে ছেলেকে বসিয়ে কেনো বলেছিলো বিনোদ -" খোঁজ নিয়ে , তোর মায়ের সাথে , তার মনের মানুষটির একবার দেখা করাস বাবা। কথা দে আমায় । আমার অসমাপ্ত কাজটা তুই করবি ।" তাই তো আজ অনি মায়ের কথা না শুনেই রওনা হয়ে গেলো।


         আবার বেজে উঠেছে ফোন । এবার নীলার । ভারি উত্তেজিত তার কন্ঠস্বর ।

" পেয়েছি মা ! তোমার মনের মানুষকে । মিথ্যে কথা বলবো না , আসার সময় এ নিয়ে অনির সঙ্গে অনেক ঝগড়াও করেছি । বলেছি ছিঃ। বুড়ো বয়েসে মায়ের মনের মানুষ খুঁজতে যাওয়া। এ সব কি ! অনি শুধু ম্লান হেসেছে । বাবার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো যে ও । তাই বোধহয় । কিন্তু এখানে এসে ঐ ঘরে ঢুকে দেখি , যা ভেবেছিলাম , তা তো নয় । এ বাবা ! কোথায় পাকাচুল আর কোথায়ই বা পুরু কাঁচের চশমা পরা ঝোলা মুখ ! তিনি তো অপেক্ষা করে আছেন আজও । তোমারই জন্যে , মা । সেই হলুদ রঙের ধুতিটি পরে , সেই আড় বাঁশীটি দু হাত দিয়ে ঠোঁটের কাছে ধরে , সেই মাথার চূড়ো করে বাঁধা চুলে ময়ূরের পাখা গুঁজে , টিপিটিপি হাসিতে মুখ চোখ ভরিয়ে তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন তোমার মদনমোহন , মা । হ্যাঁ , নামটা কিন্তু এখানে এসেই জেনে গেছি আমরা ।"

       

           ফোনটা কেটে গেলো । গলাটা কেনো যে কান্নায় বুজে আসছে মীরার । চোখে  বিনা মেঘে শ্রাবণের ধারা নেমেছে বুঝি ! মনের মাঝে ডাকছে সেই প্রথম দিনের কোকিলটা । কুহু , কুহু , কুহু । যেন বলছে " আসছি , আসছি , আসছি - প্রিয়তম আমার "।।

                       সমাপ্ত

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু