বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বীরপুর রেলগেট

ও মাসিমা ? শুনতে পায় না কানে নাকি রে বাবা ! আরে বলি ও মাসিমা ?


হ্যাঁ রে বাবা বলনা !আমি সব শুনতে পাই বুঝলি ! বয়েস হয়েছে বলে ভাবিস না আর পাঁচটা বুড়ির মতো আমিও কানে কম শুনি ।


এই হলো বীণা মাসিমা ।পুরো নাম বীণাপানি ভট্টাচার্য্য ।লিখতে পড়তে না জানলে ও দেখে দেখে অনেক কিছুই বেশ আয়ত্ত করতে পেরেছেন তিঁনি গোটা জীবদ্দশায় ।আজকে উঁনি বাড়ি ফিরছেন।বসতবাড়ি গোবরডাঙায় ।কলকাতায় এসেছিলেন একটি বিশেষ কাজে ।বীণা মাসিমার বয়েস হবে প্রায় সত্তর এর কাছাকাছি ।বিয়ে করেননি তিঁনি ।গোবরডাঙায় থাকেন ঠিকই কিন্তু বাবার দিয়ে যাওয়া কিছু সম্পত্তি আর টাকাকড়ি নিয়েই থাকতে হয় এখন তাকে ।বাড়িতে উচ্ছিষ্ট হয়ে পড়ে আছেন ।কবে পগার পার হবেন এখন শুধু সেই জন্যই হাত গুনছেন ।কিছু টাকাকড়ির সমস্যা ছিল বলে কলকাতায় এসেছিলেন ব্যাঙ্কের হেড অফিসে যোগাযোগ করতে ।শেষ জীবনে ওনার আর ভালো লাগছে না ঐ বাড়িতে থাকতে ।তাই যেখানে যা টাকা পয়সা আছে সেই নিয়ে এবার কোন আশ্রমে চলে যেতে চান ।আর পিছনে মাসিমা মাসিমা করে যে চিত্কার করছিলো একটু আগে সে আর কেউ নয় সে মাসিমার পাড়ায় থাকে ।গোবরডাঙায় মাসিমার বাড়ির পাশের বাড়িতে থাকে সে ।একটা মাঝ বয়সী ছেলে ।কলকাতায় চাকরি করে ।সে আজকে মাসিমা কে ধরে ধরে নিয়ে এসেছে কলকাতায় কাজ করাতে ।এখন দুটিতে মিলে ট্রেন ধরে বাড়ি যাবার জন্য তোড়জোড় করছে আর কি ।ছেলেটির নাম বিমল ।সে ভাবে বয়েস হয়েছে বলে বীণা মাসিমা বোধহয় কানে শুনতে পান না ঠিকঠাক ।সেই জন্যই পিছনে ওত হাঁক ডাক করছিলো সে ।


"ও বিমল আমাদের ট্রেনখানা কটায় আসবে গো বাছা "-


"এই ত এইবার চলে আসলো হলে মাসিমা ।আর বেশী দেরি নেই ।আমরা ত শিয়ালদা থেকে একেবারে লাস্ট ট্রেন টাই পাকরাও করবো গো ।তোমার সাধের গোবরডাঙা লোকাল ।সোজা একেবারে বাড়ি।ইস্টিশনে নেমেই রিক্সায় চেপে বাড়ি চলে যাব ।তোমার কিছু চিন্তা করতে হবেনা ।হারান রিক্সা নিয়ে অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য ।ওকে আমি বলে এসেছি ।সে ত তোমায় নিজের মায়ের চেয়ে ও বেশী মনে করে গো ।নিজের জমানো টাকাগুলো দিয়ে তুমি ওর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পার করলে যে ?"


"তুই চুপ কর ত ভাই ,এবার মনে হয় আসছে ট্রেনটা সিগনাল দিচ্ছে বোধহয় দেখত একবার"।


"হ্যাঁ মাসিমা হাতটা ধরো আমার শক্ত করে ।এবার কিন্তু আমাদের উঠতে হবে ট্রেনে। এখন ত রাতের বেলা ট্রেন একেবারে ফাঁকা থাকবে ।তোমার বসতে অসুবিধা হবেনা ।তুমি তোমার পছন্দের জানলার পাশের সিটটা নিয়ে বসে পড়ো ।আমিও তোমার পাশেই বসব বুঝলে"-


মাসিমা বলল "ঠিক আছে রে বাবা ,এইবার ওঠ দেখিনি তাড়াতাড়ি ,নাহলে আবার বিপদ বাড়বে বই কমবে না ।আমি একা একা উঠতে পারি না জানিস ত "।


"এই জন্যই বলি তুমি কানে কালা ,এক্ষুনি ত বললাম আমার হাতটা ধরে উঠতে ,উফফ মাঝে মাঝে কি যে বিরক্তি লাগে না কি বলব ? "বলে চুপ করলো বিমল ।


বীণা মাসিমার চিরকালের এক দোষ আছে ।সেটা হলো সব বিষয়ে খুঁতখুঁত করা ।লোকাল ট্রেনে উঠে ও তার একেবারে ফার্স্ট ক্লাস কামরার মত সার্ভিস চাই ।সে কি আর দেওয়া সম্ভব !


নিজে সারাজীবন ভালো থাকবেন বলেই প্রচুর ছেলে দেখবার পরেও আজও তিঁনি সিঙ্গেল ।এতো গেল একটা গুণ ।আরেকটা বড় গুণও আছে মাসিমার ।সেটা হলো মারত্মক প্রকৃতির ভূতের ভয় ।বিমল অনেকবার আলোচনা করেছে এই ব্যাপরে ।গোবরডাঙায় যাবার পথে ঠিক আগেই একটা নির্জন স্টেশন পরে ।নাম বীরপুর।সেখানে বেশী রাতে ট্রেন আর দাঁড়ায় না ।কারন অনেকে বলে ঐ স্টেশনে নাকি এক মহিলা ট্রেনে কাটা পরে মারা গেছিলো ।মারা গেলে ও নাকি সে ঐ স্টেশনেই ঘোরাফেরা করে ।তার এক পা ছিল না ।এরকম অবস্থায় আরেক পায়ে ভর দিয়ে রাতের বেলা ট্রেনলাইন ক্রস করতে গিয়েই নাকি এরকম একটা বিপত্তি ঘটেছিলো ।ফলে সেটা নিয়েই বীণা মাসিমার এতো ভয় ।ট্রেনে ওঠা থেকেই রাম নাম জপ করতে শুরু করলেন উঁনি ।যদি এরকম কোন অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় তখন এটাই মাসিমার রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করবে বৈকি ।


বিমল একটু দূরেই বসেছে ।দুটো সিট দূরে ।ট্রেনে রাতের বেলায় প্যাসেঞ্জার খুবই কম থাকে ।মেইন লাইন বলে তবুও দশজন এর মত প্যাসেঞ্জার রয়েছে গোটা কামরাটায় ।বিমল ব্যাগের থেকে সকালের কাগজটা বের করে পড়তে লাগল ।ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে প্রায় কুড়ি মিনিট মত হয়ে গেছে ।মোট দেড় ঘণ্টার পথ বলতে পারেন ।অফিসের কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয় বলে রাতের বেলা বাড়ি ফেরার সময়েই সে কাগজখানা পড়তে পড়তে আসে ।বিমল ও অবিবাহিত ।বাপের ভিটে সে একাই সামলায় ।মা আর বোনকে নিয়ে থাকে ।বোন ক্লাস টেনে পড়ছে আর মা বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে ।বাবা মারা যাবার পরে বাবার চাকরিটা বিমল পেয়েছে ।এখনো বিয়ের ইচ্ছে নেই ।আগে একটু গুছিয়ে উঠে তারপর ভাববে ,এই  মনস্থির করেছে সে ।



একটা স্টেশনে ট্রেন থামল ।এখান থেকে আর আধ ঘন্টা মত লাগবে গোবরডাঙা যেতে ।বীণা মাসিমার চোখ ত এপাশে ওপাশে গোল গোল ঘুরেই চলেছে আর মনের মধ্যে শুধু পেত্নি পেত্নি এই কু ডাক ডেকে চলেছে ।হঠাৎ  এক মহিলা একেবারে ঘেমে নেয়ে চান করে উঠলো সেই কামরায় ।দৌড়তে দৌড়তে নাকি ট্রেনে উঠেছে৷ মাসিমা জিজ্ঞাসা করলে সে এটাই বলল ।


মাসিমা ওকে পেয়ে গল্প জুড়ে দিল বেশ ভালোই ।কিন্তু মেয়েটার চোখের পাতা পড়ছে না সেটা লক্ষ্য করলো মাসিমা ।কিন্তু অতটা খেয়াল করেননি ।আসতে আসতে ট্রেনের সমস্ত প্যাসেঞ্জাররা নেমে গেল ।ট্রেনের কামরায় এখন শুধু বিমল ,মাসিমা আর মেয়েটি ।মেয়েটি বিবাহিত ।মাথায় সিঁদুর আছে ।দেখতে শুনতে ও মন্দ নয় ।


হঠাৎ কিছুদূর যাবার পরে ট্রেনটা, মাসিমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল "আচ্ছা আপনার নাম বীণা ভট্টাচার্য্য

কি "।


তুমি কিভাবে জানলে আমার নাম ?মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন মেয়েটিকে ।


মেয়েটি বলল "আমি সব জানি" ।

মেয়েটির পরনে সাদা শাড়ি আর লাল ব্লাউজ ।দেখে মাসিমার মনে হলো কোন ভালো ঘরেরই বৌ হবে ।


মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন "আচ্ছা মা ,তুমি এতো রাতে একা একটা মেয়ে হয়ে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছ! তোমার বাড়ির লোক তোমায় ছেড়ে দিলো কি করে ?এই দেখনা আমি বুড়ি হয়েছি বলে নয় যখন কম বয়েসের ছিলাম তখনও কিন্তু রাতের বেলা এই ট্রেনে ফিরতে সাহস পেতাম না ।তুমি এরকম এলো চুল করে এতো রাতে বাড়ি ফিরছ? তুমি জাননা এখানে বীরপুর স্টেশনের সেই পেত্নির কথাটা ।সে যদি তোমায় ধরে কি করবে তখন"?


"আরে ধুর , ওসব আমি মানিনা ।আমি বীরপুরেই থাকি ত ।ওখানেই ত নামব আমি ।" এটা বলেই একটা সজোরে হাসি দিলো মেয়েটি।


মাসিমা বললেন "সে কি মা ! আমি ত যতদূর জানি ওখানে ট্রেন থামে না আর তাছাড়া তুমি এরকম একটা নির্জন স্টেশনে একা নেমে এখন কোন গাড়িঘোড়া ও পাবে না ।তার চেয়ে তুমি আগের স্টেশনে নামো বরং"।


এই কথোপকথন চলতে চলতে হঠাত্ ট্রেনের আলোটা জোর হয়ে গেল ।সামনে বীরপুর আসছে ।এখানে ট্রেনের স্পিড আরো বেড়ে গেল ।সাইসাই করে ছুটছে ট্রেনটি ।আর হুঁশ হুঁশ করে সরে যাচ্ছে পাশের লাইট পোষ্ট গুল ।সেই সাথে তীব্র হর্নের আওয়াজ ।এসবের মধ্যেই মাসিমা লক্ষ্য করছেন মেয়েটি আসতে আসতে সিট ছেড়ে উঠে পরে দরজার দিকে যাচ্ছে ।কিন্তু ট্রেন ত দাঁড়াবে না ।ওকে বাঁধা দিতে গিয়ে মাসিমা ও উঠে পড়লেন ওর পিছন পিছন ।ওকে যে আটকাতে হবেই ।


"ও বাছা শোন শোন ,এভাবে যে ও না চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেবে নাকি গো ,ও বাছা তোমার মতিগতি আমার একেবারেই ঠিক লাগছে না যে ।" মাসিমা চেঁচাতে লাগলেন ।


মাসিমা কে চেঁচাতে দেখে বিমল এর ঘুমটা ভেঙে গেল ।ক্লান্ত হয়ে কাগজ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল বেচারা ।সে ও উঠে পড়ল ।মাসিমা দরজার দিকে একা একা যাচ্ছে দেখে ।


আরেকটা ট্রেন সেই সময় পাশ দিয়ে পাশ করছিলো ।মাসিমা সেটার আলোয় দেখতে পেলেন মেয়েটার একটা পা নেই ।আর অন্য পা খানা উল্টো দিকে রয়েছে ।সে মাসিমা কে নিজের সাথে সেদিন নিয়েই চলে যেত আরেকটু হলেই ।মাসিমা হাত বাড়িয়ে মেয়েটি কে ধরতে যাবে ওমনি দেখলেন উঁনি পাশের ট্রেনের গায়ে লেগে মেয়েটি ট্রেনের সাথে হাওয়ায় কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো নিমিষে ।পিছনে হাত ধরে বিমল মাসিমা বলে না টানলে আজকেই বোধহয় বীণা মাসিমার শেষ দিন হত এই পৃথিবীতে ।


আর হুঁশ রাখতে না পেরে বিমল এর গায়েই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান বীণা মাসিমা ।যখন চোখ খুললেন তখন সকাল ।


বিমল পাশে বসে আছে ।মাসিমা গতকাল রাত থেকেই স্থানীয় হাসপাতাল এ ভর্তি ।হারান ছিল বলে রিক্সায় করে এখানে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিলো বিমল এর ।


বিমল বলল "কাকে ধরতে যাচ্ছিলে গো কালকে ।তোমার সামনে ত কেউ ছিল না ।আমি না ধরলে ত চলন্ত ট্রেন থেকে পড়েই যেতে আর জায়গাটা ছিল কি জানো ? সেই বীরপুরের রেলগেট"।


বীণা মাসিমা শুধু একটা কথাই বললেন "তাহলে কি সেই মেয়েটাই ,বলে আবার চেতনা হারালেন উঁনি "।


সমাপ্ত

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু