বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

জতুগৃহ

নাহ, এবারে আর পৃথার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। আবার লেগেছে সেই ভয়ানক আগুন। ভয়ে বুকটা ধ্বক করে উঠল ওর, হৃদপিন্ডটা যেন গলার কাছে এসে আটকে গেল, আরেকটু হলেই বেরিয়ে আসত। উফ কী গরম, এত গরম যেন আগে কখনও অনুভব করেনি সে, সেই সঙ্গে চোখ ধাঁধানো আলো আর দম বন্ধ করে দেওয়া ধোঁয়া।   

বুঝতে পেরেছিল পৃথা ঠিকই কিন্তু এবারেও যেন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আসলে বড্ড বোকা যে সে। খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে সবাইকে। এবারেও পালাবার পথ নেই তার। শোওয়ার ঘরটায় চলে এসেছে সর্বগ্রাসী আগুন। নাহ, সেটা বলাটা ভুল হল। শোওয়ার ঘর থেকেই তো আগুনটার শুরু। ভূমিকম্পের এপিসেন্টারের মতন। ঘন কালো বিষাক্ত ধোঁয়া গলগল করে ধেয়ে আসছে। গায়ের লোম পুড়িয়ে দিয়ে ফুসফুসে ঢুকে দম বন্ধ করে দিচ্ছে।      

লাল হলুদ শিখাগুলো সারা ঘরময় নেচে বেড়াচ্ছে। যেন আগুনের শিখা নয় লাল-হলুদ-কমলা রঙের পোশাক পরা একদল মেয়ে গানের তালে তালে নাচছে, ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে, তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’। ছোটবেলায় একবার স্কুলে এই গানেতে নেচেছিল পৃথা। সেই চেনা গানের তালে এক সঙ্গে নাচতে নাচতে পৃথার দিকে এগিয়ে আসছে আগুনের মেয়েগুলো সবাই মিলে। তাদের উষ্ণ নিঃশ্বাসের ছোঁওয়া অনুভব করতে পারছে পৃথা। কিন্তু কী করবে সে? বড্ড দেরি হয়ে গেছে না? তাছাড়া পায়ে যে শিকল। কি ভাবে পালাবে? দরজার দিকে তো যাওয়া যাবে না, ওদিক থেকেই তো আগুনটা আসছে, কিন্তু জানালাটা? ওখান দিয়ে পালানো যাবে কী? না মনে হয়। ওটাতেও তো গ্রিল দেওয়া। শক্ত লোহার গ্রিল, জানালা দিয়েও তাই কোথাও যাওয়া যাবে না। কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে। শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করে দেবে সে? একটুও লড়াই করবে না? একবারও জানাবে না এখুনি মরতে চায় না পৃথা?       

কিন্তু শরীরটা যে অবশ লাগছে, ওঠার যেন ক্ষমতা নেই। তাও শত্রুর সম্মুখীন হওয়ার জন্যে তৈরি হতে চেষ্টা করে পৃথা। তারপর ভাবে কী দরকার? আগুনের হাতে নিজেকে সঁপে দিলেই তো হয়। কী আর হবে কিছুক্ষণের জন্যে যন্ত্রণা হবে এই যা। প্রচন্ড যন্ত্রণা – চামড়া, চুল পুড়ে যাওয়ার অসহ্য কষ্ট। কিন্তু তারপরই তো সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কিম্বা হয়তো সব কিছু পুড়ে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতেও হবে না ওকে, তার আগেই হয়তো কালো ধোঁয়ায় দম আটকে বা কার্বন মনোক্সাইডের প্রভাবে জ্ঞান হারাবে সে, কিছুই বুঝতে পারবে না আর।      

আর সময় নেই, আর সময় নেই। আগুনের শিখা ধেয়ে আসছে। বিছানার চাদরটা জ্বলছে দাউদাউ করে এবার। পৃথার গলা দিয়ে একটা চিৎকার দলা পাকিয়ে ঠেলে বেরিয়ে এল। ওমা গলার স্বরটাও যেন ওর নয়। যেন সেই ছোটবেলাকার পৃথার গলার স্বর। দাদা যখন ওর চুল টেনে পালিয়ে যেত বা ওকে তাড়া করে বাড়িময় ছোটাতো তখন যে রকম একটা কিনকিনে রিনরিনে চিৎকার বেরত ওর গলা থেকে ঠিক সেই রকম। নাহ, আর তো অপেক্ষা করা যাবে না, অবশ শরীরটাকে কোন রকমে টেনে তোলে পৃথা। জানালার কাছে যেতে হবে ওকে, বন্ধ জানালাগুলোকে খুলতে হবে। কিন্তু পারে না, বাঁধা পায়ে বিছানা থেকে নামতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় সে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে – না, না, শত্রুদের জিততে দেবে না সে, কোনদিন না। নিজেকে বলে, নিঃশ্বাস নাও পৃথা, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নাও! বিষাক্ত গ্যাসগুলোকে গিলে ফেলো – আগুনের কাছে আত্মসমর্পণ কোরো না! ওই আসছে ধেয়ে। আবার একটা বীভৎস চিৎকার বের হল ওর গলা থেকে।    

অন্ধকার ঘরের নিস্তদ্ধতা খানখান করে ফেলল সেই চিৎকারআর পৃথার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ঘামে ভিজে গেছে ওর সারা শরীর। হাপরের মতন নিশ্বাস পড়ছে। ক্রমে অন্ধকার চোখ সওয়া হয়ে গেল, স্বাভাবিক হয়ে গেল হৃদয়ের গতিওবিছানা ছেড়ে উঠে পাখার স্পিডটা বাড়িয়ে দিয়ে এক গেলাস জল খেল পৃথা। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলরাত এখন দুটো। আবার গিয়ে বিছানায় শুলো।      

স্বপ্নগুলোর ওপর ভারি রাগ হয় পৃথার। মানুষ যতই মনে করুক সে সেরে উঠেছে, পিছনে ফেলে চলে এসছে সব বিবর্ণ অতীত কিন্তু ওই স্বপ্নগুলো ভুলতে দেয় না তাকে। স্বপ্নের নিষ্ঠুর বাস্তব এসে সব কিছু ঝাঁকিয়ে দিয়ে চলে যায়। ধাক্কা মেরে, টিটকিরি কেটে বলে, “কেমন মনে করছিলি তুই সেরে উঠেছিস, দিলাম তো সব কিছু ভন্ডুল করে?” যে আগুন একদিন শত চেষ্টা করেও মেরে ফেলতে পারেনি পৃথার শরীরটাকে সেই আগুন এখন এসে ওর মনটাকে পোড়ায়। মনের ডাক্তার বলেছেন, ‘সময় সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। তুমিও ভুলে যাবে একদিন। নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে সারারাত’।   

দীর্ঘশ্বাস ফেলল পৃথা। না, আজ আর ঘুম আসবে না। ঘুম এলেও সঙ্গে আসবে সেই ভয়ঙ্করে দাবানল। ডাক্তারের কথা হয়তো ঠিক কারণ আগে রোজ দেখত ওই আগুনের স্বপ্ন, এখন অত ঘনঘন দেখে না, তবে তাও দেখে।     

বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের আলোটা জ্বালালো পৃথা। টেবিলে বসে ল্যাপটপটাকে অন করল। ওর নিজের হাতে গড়া সংস্থা ‘পদার্পণ’ তাই সব সময়ই কিছু না কিছু কাজ থাকে করার। এনজিও, নন প্রফিট সংস্থা হলে যা হয়। সব সময় টাকার অভাব, কাজের লোকের অভাব। তবুও লড়ে যাচ্ছে পৃথা, যেমন একদিন লড়েছিল যমের সঙ্গে।   

প্রতিদিনের মতন আজও দেওয়ালে আটকানো কাগজের কাটিংটার ওপর চোখ পড়ে গেল। কোন এক পত্রিকা থেকে ছেঁড়া একটা পাতা। তাতে একটা কবিতা লেখা, আলো পড়ে যেন জ্বল জ্বল করছে।   

আগুন

মল্লিকা সেনগুপ্ত

এবার পেঁয়াজ আদা টক দই টাটকা রসুন
আলু আর শালগম দিয়ে
ডেকচিতে ঢিমে আঁচে তরুণীরর মাংস কষুন
দাউদাউ আগুনের মধ্য থেকে সিঁদুরের টিপ
একটি কাজল চোখ ভাসলেও
টাকার বান্ডিল ছুঁড়ে রুখে দিন পুলিশের জিপ
মেয়েটির কি কি দোষ? বাপ দেয়নি যৌতুক
এ তো স্বতঃ সিদ্ধ, কালো মেয়ে তবু
মারলেই প্রতিবাদ করে ওঠে এমনি কৌতুক!

ঠাকুরের ঘরে বসে শ্বশুর লেখেন-
'এ মেয়েকে জলজ্যান্ত রাখা মুশকিল ছিল
ভাগ্যবান ছেলে তাই বউটাকে আগুনে সঁপিল।'

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু