বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

খুনের ঘেরাটোপে

|| প্রথম পর্ব||


"অনেকক্ষন ধরে দেখছি আপনি একই কথা বারবার বলে যাচ্ছেন" - বেশ বিরক্তির সুরেই কথাগুলো বললেন পুলিশ অফিসারটি |


কথাটা শেষ করেই জলের গ্লাসটি এগিয়ে দিলেন দীপার দিকে |


দীপা হাতটা কচলাচ্ছে  | বিড়বিড় করে বলেই চলেছে একই কথা |


অফিসারটি আরো রেগে গেলেন |

"আপনাকে বহুবার বলেছি আপনি শান্ত হয়ে বসুন |এতো ছটফট করবেন না |আপনি এরকম করলে কি আপনার সমস্যার সমাধান হবে?"


দীপা তখনও টেবিলের দিকে তাকিয়ে একইভাবে বিড়বিড় করেই চলেছে |


"মহিলাটি পাগল নাকি?"- পুলিশ অফিসারটি মনে মনে ভাবলেন |


"আচ্ছা আপনি যেটা বলছেন সেটা কি ভেবে বলছেন দীপা দেবী?"


তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাল দীপা |

"আপনার কাছে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে |ঠিকাছে আমি আসলাম|" - রেগে উঠে গেলেন তিনি |


অফিসারটি অবাক হলেন |

"আচ্ছা মুশকিল তো" !

"আরে বাবা আপনাকে কি আমি চলে যেতে বলেছি?


দীপা পিছনে ফিরলেন |

"আপনি মনে হয়না এই কেসে আমাকে কোনভাবে সাহায্য করতে পারবেন"! - ব্যঙ্গের সুরে বললেন তিনি |


অফিসারের জেরার মুখে যাতে পুনরায় পড়তে না হয় তাই দীপা কথাগুলিকে এড়িয়ে গেলেন | আবার অফিসারের সামনে এসে বসলেন |


"এবার দয়া করে বলুন দীপা দেবী, কোথায় আপনার সমস্যা?"




||দ্বিতীয় পর্ব||


আপনি আমার মা কে চেনেন না অফিসার |তিনি পারেন না এমন কোন কাজ নেই |আমার মা-ই আমার বাবা কে খুন করেছেন |ঠিক এক মাস আগে |


অফিসারটি বললেন, "আমাকে আপনি পুরো ঘটনাটি বলুন" |


এই ঘটনাটি ঘটেছিলো ঠিক একমাস আগে |আমার মায়ের সাথে আমার বাবার বৈবাহিক সম্পর্ক কোনদিনই ভালো ছিলোনা |ছোটবেলা থেকেই শুধু অন্তর্কলহ হতেই দেখেছি দুজনের মধ্যে |আমার মা কোনদিনই চাননি এই সংসারে আসতে |


মায়ের জীবনে টাকাই ছিল সব কিছু |বাবার ও টাকার অভাব ছিলোনা |তবে মায়ের টাকার চাহিদা অল্পেতে সীমিত ছিলোনা কোনদিনই |যতই টাকা বাবা এনে দিক না কেন, কম পড়ত |বাবাও মায়ের জেদ এর কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন |


তবে মা কোনভাবেই শান্ত থাকতে পারলেন না |মায়ের রাগ দিনপ্রতিদিন বাড়তেই থাকলো |বাবা সন্দেহ করতেন আমার মা নাকি বাইরে কারুর সাথে দেখা করতেন |সে নাকি মায়ের প্রেমিক |এমনটাই সন্দেহ করতেন বাবা |তবে কোনদিনই মাকে হাতে নাতে ধরা যায়নি |কারণ মায়ের সাথে যে ছেলেটি দেখা করত তার মুখ আমরা কোনদিন দেখতে পাইনি |


মা বহুবার বিষয়গুলি আমাদের থেকে লোকাবার চেষ্টা করেছিলেন | একদিন বাবা বাড়ির বাইরে গেছিলেন |আমি বাড়িতে একা ছিলাম |আমার ঘরের জানলা দিয়ে দেখলাম একটা কালো গাড়ি এসে দাঁড়ালো আমাদের সদর দরজার ঠিক সামনে | মা তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন |


কালো গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলেন একজন সুদর্শন যুবক | এসেই মায়ের হাতে বেশ কিছু খাম তুলে দিলেন | মা মৃদু হেসে খামগুলি ছেলেটির হাত থেকে নিয়ে নিলেন | দোতলার দিকে চোখ যেতেই মা আমাকে দেখতে পেলেন |আমার দিকে চোখ যাওয়ার সাথে সাথেই মা খাম গুলিকে লুকিয়ে ফেললেন |


সেদিন রাতেই আমার বাবার গাড়ি একসিডেন্ট হয় |বাবার শরীরটার কোন অংশ আমরা খুঁজে পাইনি |একটি বড় ট্রাক এসে থেঁতলে দিয়ে যায় তার দেহটি |আমার সারা গা ঘিনঘিন করে উঠেছিল |এতো নৃশংস মৃত্যু এর আগে আমার চোখে পড়েনি কোনদিন | আমি আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিলাম |কিন্তু আমার মায়ের মুখে আমি কোন হতাশার চিহ্ন সেদিন দেখতে পাইনি | মাকে দেখে মনে হচ্ছিল চিরদিনের শান্তি পেয়েছেন তিনি|


এরপর থেকেই আমার উপর নানান ভাবে অত্যাচার করতে থাকেন মা| আমার খাওয়া দাওয়া কোন কিছুর দিকেই আর তার খেয়াল ছিল না| এরপরেও সেই অজ্ঞাতপরিচয় ছেলেটি আমাদের বাড়িতে আরো দু একবার এসেছিল| কিন্তু এবার ওই খামগুলো আমার হাতে এসে পড়ল | মা বাড়িতে না থাকায় আমি সন্তর্পনে খামগুলো খুলে দেখলাম| দুটি থামের মধ্যেই গুচ্ছের টাকা ভর্তি ছিল| বুঝতে পারলাম পারিশ্রমিক বাবদ মাকে এই টাকাগুলি পাঠানো হয়েছে| কিন্তু আমার বাবাকে খুন করার পেছনে মায়ের কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? তাহলে কি মা বাবার সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য খুন করল ? তখন আমার মাথায় এলো, এটা এমন কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়! কারণ মায়ের প্রথম দিন থেকেই পয়সার ওপর ঝোঁক ছিল| যেকোনো মুহূর্তেই ধনী হওয়ার জন্য আমার মা যে কোনো রকমের কাজ করতে পারেন, সেই বিশ্বাস আমার ছিল| তবে এত নৃসংসতা তার মধ্যে কিভাবে জন্মালো আমি জানিনা? নিজের স্বামীকে খুন করতেও তার হাত কাঁপলো না?


" ওই খাম গুলি দেখে আপনি এতটা নিশ্চিত কিভাবে হতে পারেন? আপনার মাইই যে আপনার বাবাকে খুন করেছেন এমনটা তো নাও হতে পারে?" - বিতর্কের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন পুলিশ অফিসারটি|


" আমার কথা এখনো শেষ হয়নি অফিসার| মন দিয়ে শুনুন আমি যা বলছি| আপনি ঠিকই বুঝতে পারবেন|"- আবার বলতে থাকে দীপা|



||তৃতীয় পর্ব||


একদিন আমার মা কোন এক বিশেষ কাজে বাড়ির বাইরে গেলেন| আমি বাড়িতে সেদিন একা ছিলাম| হঠাৎ দেখলাম ওই কালো গাড়িটি এসে দাঁড়ালো আমাদের বাড়ির সামনে| সেদিন আর ওই যুবকটিকে দেখতে পেলাম না|  সাদা রংয়ের কোট পড়ে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন| তিনি এসে অনেকবার কলিংবেল টিপলেন| আমি সাহস করে নিচে যেতে পারলাম না| তখন দেখলাম উনি দরজার ফাঁক দিয়ে একটি খাম গলিয়ে দিলেন আমাদের ঘরের ভিতরে | তারপর দৌড়ে উঠলেন গাড়িতে| চোখের নিমিষে গাড়িটি নিয়ে চলে গেলেন|


সেদিন ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল খামটি তে বিশেষ কিছু রয়েছে| লোকটি চলে গেলে আমি ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে একতলার ঘরে আসলাম| সেখানে আসতেই আমি দেখলাম করিডরের উপরে একটি কালো কাগজে মোড়া খাম গড়াগড়ি খাচ্ছে| এবারের খামটি  ছিল বাকিগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা| কালো রঙের খামটিতে গোল্ডেন কালারের জরি দিয়ে কারুকার্য করা ছিল| খামটি খুলতেই আমি চমকে উঠলাম| এতদিন বাকি দুটি খামে আমি টাকার গোছা দেখেছিলাম| এখন দেখতে পেলাম একটি চিরকুট| চিরকুটটি হাতে নিয়ে আমি দেখলাম| ভিতরে লাল রঙ দিয়ে লেখা ছিল,  " আপনার এই কাজটির জন্য আমরা টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি| আগামী কাজটি এক মাসের মধ্যেই করতে হবে| যত শীঘ্র সম্ভব কাজটি করে ফেলুন| আপনার টাকা পৌঁছে যাবে|"


ভয় পেয়ে হাত থেকে আমার খামটি পড়ে গেলো | আমি কোনরকমে খামটি কে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখলাম আমার একটি বইয়ের ভিতরে| কারণ আমি জানতাম এরপর কে খুন হতে চলেছে|


পুলিশ অফিসারটি দীপাকে প্রশ্ন করলেন, " কে খুন হতে চলেছে"?


" আমি"- বললেন দীপা|

" আপনি? কী করে বুঝলেন যে এরপরের ভিকটিম টি আপনি?"


আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমার মন মেজাজ খুব খারাপ থাকত| আমি প্রায়শই বাবার ঘরে গিয়ে বসতাম| বাবার ঘরে প্রচুর বই সাজানো থাকত| বাবা চিরকালই বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন| একদিন যখন বাবার বইগুলো নাড়া ঘাটা করছি, ঠিক সেই সময় একটি বইয়ের পাতা থেকে ঠিক এরকমই দেখতে কয়েকটি খাম মেঝের উপর পরল| আমি খাম গুলি হাতে তুলে দেখলাম তাতে লেখা ছিল-


" এই মাসের মধ্যেই কাজটি সেরে ফেলতে হবে"|


সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, বাবার মৃত্যুর দিন যত এগিয়ে আসছিল তার সাথে খামের এই লেখাগুলির একটা অদ্ভুত মিল পাওয়া যাচ্ছিলো|  খাম গুলিকে পরপর সাজাতেই দেখলাম লেখাগুলির মধ্যে একটা অদ্ভূত মিল রয়েছে |দিনগুলির কথা সেখানে লেখা ছিল |এমনকি কোনদিন বাবার গাড়ির একসিডেন্ট করা হবে সেটিও লেখা ছিল |


আজকে মাসের সাতাশ তারিখ |আমি শেষবারের জন্য যে খামটি পেয়েছিলাম তাতে লেখা ছিল পরের মাসের ত্রিশ তারিখে কাজ করতে হবে |আমার বাবার মৃত্যু হয়েছিল গত মাসের ত্রিশ তারিখে |সুতরাং আর ঠিক তিন দিন বাকি |বাবাকে মা পছন্দ করতেন না কোনদিনই  |তাই বাবাকে মেরে ফেলা হলো  |আমাকেও মা পছন্দ করেননি কোনদিনই |কাজেই আমিও মায়ের পথের কাঁটা |এবার মা তাই আমাকেই শেষ করবেন  |ত্রিশ তারিখ যাকে মারতে বলা হয়েছে সে আর কেউ নয় সে হলাম আমি |



||চতুর্থ পর্ব||


অফিসারটি এতক্ষন দীপার কথাগুলি এক মনে শুনলেন |সব কথা যে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো এমনটা নয় |তাই তিনি দীপাকে বললেন,


"আচ্ছা দীপা দেবী আপনি এতক্ষন আপনার মা এবং বাবার বিষয়ে সব কথাই আমাকে বললেন |কিন্তু একটা বিষয় আমি বলেননি |আপনার বাবা এবং মায়ের নাম |ওটা কি জানতে পারি আমি? তাহলে আপনার বাবার কেসটা আমি রি ওপেন করে দেখতে পারি |এতে আপনার ও সুবিধা হবে |এছাড়া ও আপনার বাড়ির বাইরে আমি পুলিশের পাহারা ও বসাতে পারি |তবে তার আগে আমাকে এবং আমার টিমকে আপনাকে সাহায্য করতেই হবে |কারণ আপনি জানেন আইন কারুর মুখের কথায় বিশ্বাসী নয় |আইনের কাছে প্রমানটাই কিন্তু সব |কাজেই আপনি আরো প্রমান খোঁজার চেষ্টা করুন |আমি কথা দিচ্ছি আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা করা হবে "|


দীপা শুধু ঘাড়টা নাড়লেন |অফিসার বুঝলেন মৌনতা সম্মতির লক্ষণ |দীপা বললেন,


"আজ তবে উঠি অফিসার? আবার দেখা হবে আমাদের |ত্রিশ তারিখের আগেই আমি আপনাকে ফোন করে সবটা জানাবো |দয়া করে আপনি ত্রিশ তারিখে আমার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে যাবেন |তা না হলে কিন্তু আমার মৃত্যু অবধারিত |আমি এতো তাড়াতাড়ি মরতে চাইনা অফিসার |কিছুতেই মরতে চাইনা |"- কথাটি শেষ করেই দীপা দেবী কাঁদতে লাগলেন |


অফিসারটি উঠে এসে তাকে স্বান্তনা দিলেন |


"আপনার কোন ভয় নেই |আমি সঠিক সময়েই টিম নিয়ে আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবো |আপনি শুধু নিজের খেয়াল  রাখুন |একটা অনুরোধ, এই কদিন বাড়ির বাইরে যাবেন না |তাহলে বাইরে থেকে আপনার উপরে হামলা হতে পারে |"


দীপা ঘাড় নেড়ে বললেন, "ঠিকাছে অফিসার"|


এরপর পুলিশ স্টেশনের সামনে দাঁড়ানো একটি সাদা বড় গাড়িতে উঠে চলে গেলেন তিনি |




||পঞ্চম পর্ব||


দীপার উপর অফিসারের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল| দীপা তার সমস্যার কথাগুলি অফিসার কে বললেন ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে অসংখ্য অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়ল তাঁর | যেমন দীপা তার মা-বাবার পরিচয়ের কথা তাকে জানালেন না| এত বার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও বর্তমান পরিস্থিতির কথা দীপার মুখ থেকে বার করতে পারলেন না তিনি | বিষয়টা অনেকটাই সন্দেহজনক ঠেকলো |


তবে প্রথমেই তিনি দীপাকে বিশ্বাস করতে চাইলেন না| ভাবলেন তাকে না জানিয়ে একবার তাদের পাড়া থেকে ঘুরে আসবেন| আবার ভাবলেন আরতো মাত্র তিন দিনের অপেক্ষা| তারপর তো এমনিতেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে| সুতরাং আগে থেকে তড়িঘড়ি করে পুলিশ নিয়ে পাড়াতে গেলে পরিস্থিতি ঘুরে যেতে পারে| দীপা দেবীর মা হয়ত চক্রান্ত করে পুরো বিষয়টি ঘুরিয়ে দিতে পারেন| হঠাৎ করে পাড়ায় পুলিশের গাড়ি দেখলে তারা মত বদল করে ফেলতেই পারেন| এছাড়া দীপা দেবীর প্রাণ সংশয়ও হতে পারে| এসব ভেবে অফিসার আর কোন পদক্ষেপ নিলেন না| তিনি দীপা দেবীর ফোনের অপেক্ষা করতে লাগলেন|


এই ভাবেই দুদিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল| দীপা দেবীর তরফ থেকে কোন খবর  এলো না| অফিসার ভাবলেন, দীপা দেবী হয় তো শুধু শুধুই ভয় পেয়েছেন| তার বাবার মৃত্যুর সাথে হয়ত এই সমস্ত ঘটনা গুলির কোন যোগসূত্র নেই|


30 তারিখ সকাল| ঘড়িতে তখন নটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট হয়েছে| হঠাৎ অফিসারের ফোনে একটি ফোন এলো| একটি আননোন নম্বর থেকে কল করা হয়েছে| অফিসারটি ফোনটি ধরলেন|

ফোনটা ধরে তিনি জানতে পারলেন দীপা দেবী ফোন করেছেন|


" আমায় বাঁচান অফিসার| দয়া করে আমাকে বাঁচান| আমি খুব অস্থির হয়ে পড়েছি| আমার মা আমাকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছেন| হয়তো তিনি আজকেই আমাকে শেষ করবেন| আর মাত্র কিছুক্ষণ এর অপেক্ষা| আমি এভাবে শেষ হতে চাই না অফিসার| দয়া করে আমাকে বাঁচান, বাঁচান আমাকে|" - কথাটি শেষ হওয়ার পরেই অফিসার একটি আর্তচিৎকার শুনলেন|


দীপা দেবীর ফোন রাখার পরেই অফিসারটি আরো দুজন কনস্টেবল কে নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন তার বাড়ির উদ্দেশ্যে|



||ষষ্ঠ পর্ব||


পুলিশের গাড়ি এসে থামল দীপা দেবীর  বাড়ির ঠিক সামনে| বাড়ির পরিবেশ বেশ শান্ত| ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজাটি খুলে গেল| অফিসার একটু ঘাবড়ে গেলেন| তিনি বাকি দুজন কনস্টেবল কে বললেন,


" মনে হয় বাড়ির মধ্যে কেউ এসেছে| বাইরের কোন লোক| আমাদের আসার আগেই সে ঢুকে পড়েছে| সেই জন্য ঘরের সদর দরজা টি খোলা| ভিকটিম নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এই বাড়ির মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে| সেই জন্য সদর দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও কারোর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই| তোমরা দুজন দু দিকে যাও| একজন বাঁদিকে আর একজন ডানদিকে| আমি সিঁড়ি দিয়ে উপরের ঘরে যাচ্ছি| যদি তোমরা কেউ দীপার কোন খোঁজ পাও, সাথে সাথে আমাকে জানাবে| আমি উপরেই আছি| খুব সাবধানে আমাদের কাজ সারতে হবে|"


কনস্টেবল দুটি দুদিকে চলে গেলেন | অফিসার পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলেন| কিছুদুর যাওয়ার পরেই তিনি দেখলেন দোতলার উপর একটি ছোট্ট ঘর| ঘরে ঢুকতেই তিনি যা দেখলেন তা নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না| কালো বসন পড়ে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সামনে| তার মাথায় লাল তিলক কাটা| গলায় রুদ্রাক্ষের মালা| আর হাতে একটি বড় ভোজালি | অফিসারটি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন, মেয়েটি আর কেউ নয়, স্বয়ং দীপা|


তারপরেই অট্টহাসিতে গর্জে উঠল চারিদিক| অফিসারটি বুঝতে পারলেন তাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে| কিছু বোঝার আগেই পিছন থেকে কেউ একজন এসে তার মুখটা কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেললো| তবে তিনি ঘাবড়ে গেলেন না| তিনি সজোরে সেই ব্যাক্তিটির পায়ে আঘাত করলেন| ব্যক্তিটি সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল| তিনিও তার পিছন পিছন তরতর করে নিচে নামতে লাগলেন| কিন্তু যে ব্যক্তিটিকে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছিলেন, সে ক্ষণিক যাওয়ার পরেই আবার তাকে ধরল| এবার অফিসার কিছুতেই তার বাঁধন ছাড়িয়ে বেরোতে পারছিলেন না| এতটাই শক্ত বাঁধন| তিনি বেশ ভালই বুঝতে পারলেন তার সামনের ব্যক্তিটি একটি পুরুষ| তিনি কোনরকমে লোকটিকে ঠেলা মেরে নিচে নেমে এলেন|



||সপ্তম পর্ব||


সাথে সাথে দীপা দেবী ও তাকে ধরবার জন্য নিচে নামলেন| সঙ্গে সঙ্গে দুটো কনস্টেবল এসে ধরলো দীপা দেবী কে| এরপর তাকে একটি চেয়ারে বসানো হলো| সাথে সাথে তার হাত-পা ও বেঁধে দেওয়া হলো|


কনস্টেবল দুটি বললেন, তারা নিচের ঘরে একজন মহিলাকে পেয়েছেন| মহিলাটির মুখ বাঁধা ছিল| আর হাত দুটি জানলার সাথে লোহার শিকল দিয়ে আটকানো ছিল| মহিলাটির গায়ে অনেক ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেয়েছেন তারা| বেশ ভালই বোঝা যাচ্ছে এই মহিলাটিকে বহুদিন ধরে অত্যাচার করা হয়েছে| পরে জানতে পারা যায় এই মহিলাটিই  দীপা দেবীর নিজের মা|


দীপা দেবীর সামনেই আর একটি চেয়ারে তাকে বসানো হল | এরপর অফিসার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করলেন | দীপা দেবীর মা কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না| তবুও তিনি জানালেন,


" আজ প্রায় এক মাস বাবদ আমাকে নিচের ঘরে আটকে রাখা হয়েছে অফিসার| কোনদিন আমাকে খেতে দেওয়া হতো আবার কোন দিন হতোও না| এইসব কিছু করেছে আমার মেয়ে দীপা| সে আমাকেও মারতে চেয়েছিল| আপনারা ওকে ছাড়বেন না| এ আমার স্বামীকেও খেয়েছে| আমাকেও খেতে চাইছে| আর হয়তো আপনাকে ও আজকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল|"


অফিসার তখন বললেন, " আপনি কিছু চিন্তা করবেন না| আপনাদের বাড়ির চাকর হারু কে আমি পাকড়াও করেছি| সে আমাকে ধরতে চেয়েছিল| তবে পুলিশের হাত থেকে বাঁচা এত সহজ নয়| ওই দেখুন, মেঝেতে পড়ে রয়েছে সে| আমি তাকে এমন মেরেছি, যে আর চলাফেরার অবস্থায় নেই সে | আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন| আমরা আপনার মেয়ের সব খেলা অনেক আগেই বুঝতে পেরে গেছিলাম| তবে আমি নিজের চোখে বিষয়টা বোঝার জন্যই আজকে এখানে এসেছি| আমি এর থেকে আরও অনেক বেশি পুলিশ ফোর্স নিয়ে আপনার বাড়িতে হানা দিতে পারতাম| তবে আমাদের প্রমাণের দরকার ছিল| সঠিক প্রমাণ না পেলে আমরা অপরাধীকে গ্রেফতার করতে পারতাম না|"


এবার অফিসার সরাসরি দীপা দেবীর গালে একটি চড় মারলেন|


" আপনার লজ্জা করেনা, একজন মেয়ে হয়ে আপনি আপনার পিতা কে খুন করেছেন| নিজের মাকে এইভাবে বেঁধে রেখে শারীরিক অত্যাচার চালিয়েছেন| আপনি জানেন এর জন্য আইন আপনাকে কত বড় শাস্তি দিতে পারে? এবার বলুন কেন আপনি এই অপরাধ গুলি করেছেন? আর কেনই বা আপনি আমাকে খুন করতে চেয়েছিলেন? কি হলো বলুন? " - কথাটি শেষ করেই অফিসারটি আরো একবার দীপা দেবীর ওপর হাত ওঠাতে যাবেন, এমন সময় দীপা দেবী বলে উঠলেন,


"আমাকে মারবেন না অফিসার| আমি সব বলছি"|



||অষ্টম পর্ব||


আমার বাবা এবং মা আমার আচরণে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন| আমার বাবার সম্পত্তির উপর আমার কোনদিন কোন লোভ ছিল না| তবে কলেজে পড়াকালীন আমি একটি ছেলেকে ভালোবেসে ফেলি| আমি আমার বাড়িতে ছেলেটির কথা জানিয়েও ছিলাম| ছেলেটি গরীব হওয়ায় আমার বাবা-মা তাকে মেনে নিলেন না| অনেক বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও যখন তারা তাদের মত বদল করলেন না তখন আমার মাথায় আগুন চেপে গেল| আমি দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়লাম|


আমার বয়ফ্রেন্ডের নাম পরেশ| সে এখন পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার| ভদ্র, শিক্ষিত এবং পরিমার্জিত একটি ছেলে| তবুও আমার বাবা তার সাথে আমার বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না| আমার বাবা এই শহরের একজন ধনী ব্যবসায়ী| তার কাছে একজন ইঞ্জিনিয়ারের মূল্যই বা কি?


আমি আর পরেশ ঠিক করলাম যেভাবেই হোক আমাদের পালাতে হবে| পরেশ তখন সদ্য চাকরি পেয়েছিল| ফলে ওর কাছেও তেমন টাকা পয়সা ছিল না| সেই জন্য আমি ঠিক করলাম বাবার সাথে কথা বলে সম্পত্তির অর্ধেক অংশ আমি নিজের নামে লিখিয়ে নেব| আমি এই পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ার দরুন সম্পত্তির একটা বড় অংশ আমার এমনিতেই পাওনা ছিল| বাবার কাছে এই প্রস্তাব রাখতেই বাবা আমার উদ্দেশ্য জেনে ফেললেন| আর মুখের উপর না করে দিলেন|


তখন আমার রাগ আরো বেড়ে গেল| আমি ঠিক করলাম সোজা আঙুলে যখন ঘি উঠলো না তখন আঙ্গুল বেঁকিয়েই এই কাজ উদ্ধার করব | আমি আর পরেশ ঠিক করলাম আমাদের পরবর্তী প্ল্যান গুলি| বাবাকে আমি রাস্তা থেকে সরাতে চাইনি| কিন্তু আমার কাছে আর কোন উপায় ছিলনা সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া ছাড়া| ফলে আমি আর পরেশ চক্রান্ত করে বাবার গাড়ি এক্সিডেন্ট করালাম| কিন্তু মা এই পুরো বিষয়টাই জেনে গেছিলেন | তাই বাধ্য হয়ে আমাকে মাকে কষ্ট দিতে হলো| মায়ের মুখ বন্ধ না করলে মা অনেক আগেই পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সবকিছু বলে দিতেন| তাই আমি মাকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে ছিলাম|


তবে আপনাকে আমি মারতে চাইনি| বাবার মৃত্যুর পরে আমি যখন সম্পত্তি হস্তান্তর করতে কোর্টে গেলাম, তখন জানতে পারলাম বাবা তার সমস্ত সম্পত্তি মারা যাওয়ার আগেই একটি ট্রাস্টকে লিখে দিয়ে গেছেন| হয়তো আমাদের অভিসন্ধির কথা বুঝতে পেরেই তিনি এমনটা করেছিলেন| তখন আমি শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারলাম না|


এই সময় আমার এক বান্ধবী আমাকে কালাজাদু চর্চার পরামর্শ দিল| দুজন মানুষের বলি দিতে পারলেই আমি নাকি এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে যেতে পারবো যে আমি যা চাই তাইই পাবো| আমার তখন মাথা কাজ করছিল না| যে করেই হোক ওই সম্পত্তির  টাকাগুলি পাওয়া আমার কাছে ছিল খুব জরুরী| তাই আমি কালাযাদু চর্চা করা শুরু করলাম| আজকেই আমি ঠিক করেছিলাম আমার মায়ের বলি দেব| আরো একজনের প্রয়োজন ছিল| আমি ভেবেছিলাম আপনাকেও আমি বলি দেব| তাই আপনাকে আমি এখানে ডেকে পাঠিয়েছিলাম| আমি জানতাম আপনি আমার কৌশলে পা দেবেন| তাই আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম| কিন্তু সবকিছুই ভেস্তে গেল| আমাকে ক্ষমা করে দিন অফিসার| আমি এসব কিছুই করতে চাইনি| আমি শুধুই পরেশকে ভালোবাসি |





||নবম পর্ব||


"আপনার সব চাল আমি অনেক আগেই ধরে ফেলেছিলাম দীপা দেবী |আপনাকে আইন কোনদিনই ক্ষমা করতে পারবেনা |কারণ আপনি আপনার স্বার্থকে চরিতার্থ  করবার জন্য খুনের মতো জঘন্য অপরাধ করেছেন |শুধু তাইই নয় আপনি আরো দুটো খুন করতে চেয়েছিলেন |এই সবকিছু আপনি শুধু আপনার সুবিধার জন্য করতে চেয়েছিলেন |অর্থের লোভে আপনি এতটাই অন্ধ হয়ে গেছিলেন যে আপনি আপনার মা বাবাকে ও খুন করতে দ্বিধা বোধ করেননি |ভালোবাসা অন্ধ হয়  জানতাম কিন্তু এতটা হয় জানতাম না |


আমি আপনার অভিসন্ধির কথা অনেক আগেই জানতে পেরেছিলাম |


আপনি পুলিশ স্টেশনে যেদিন এলেন সেদিন আপনি বারবার বলছিলেন আপনার মাইই খুনি |অথচ আপনি কোন প্রমান সেদিন সঙ্গে করে নিয়ে আসেননি |


যখন কাউকে মারার চেষ্টা করে কেউ তখন কারুর পক্ষেই এতো শান্ত থাকা সম্ভব হয়না |আপনার মা যখন আপনাকে খুন করতে পারেন বলেই আপনি জানতেন তখনও আপনি নিশ্চিন্তেই এই বাড়িতে থেকে গেলেন |যেখানে আপনার এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল |


আরো একটা ভুল আপনার হয়েছে দীপা দেবী |আমি যখন আপনার মা, বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলাম তখন আপনি আমাকে সেটা বলতে চাননি |কারণ আপনি জানতেন আপনার বাবার নাম জানতে পারলে আমি কেস রি ওপেন করাতে পারি |তখন আপনার বাবার মার্ডার কেসের ফাইলগুলো আমার হাতে চলে আসলে আপনি ফেঁসে যেতে পারেন |সেইজন্য আপনি সন্তর্পনে সেটি কাটিয়ে উঠতে আমাকে কোন কিছুই বলতে চাননি |


আপনি কি ভেবেছিলেন? আপনি আমাকে আপনার জালে জড়াতে পারবেন? এতো কাঁচা বুদ্ধির লোক আমি  নই |আপনার সব চাল শেষ |এবার আপনাকে আইন শাস্তি দেবে |



||দশম পর্ব||


দীপা দেবী কাঁদতে লাগলেন | স্বার্থের জন্য পাপ করলে আইনের হাত থেকে তার মুক্তি পাওয়া কোনদিনই সম্ভব নয় |জীবনে যা পাওয়ার জন্য তিনি অন্যায় করেছিলেন আজকে তাইই তার জীবন নষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ালো |অতিরিক্ত লোভ সর্বদা জীবনাশাই হয় |তাই লোভ হইতে সাবধান |নাহলে আপনারাও এমন করুন পরিণতির স্বীকার হতে পারেন |


সমাপ্ত

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু