দাদা আর দিদিদের বিয়ে হোলো
বাস ব্রেকডাউন আর তার পরে অঞ্জু মাসীর সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে, এক বিছানায় রাত কাটানোর গোপন ঘটনার কয়েক মাস পর থেকেই আমার দাদা-দিদিদের বিয়ে হওয়া শুরু হোলো। হয়তো শীগগিরই আমারও বিয়ে হবে।
অনেক দিন ধরে মিলির জন্যে সুপাত্র খোঁজার জন্যে অনেক চেষ্টার পরে, যখন মা ও বাবা প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে তুলির জন্যে সম্বন্ধ দেখা আরম্ভ ক’রে দিয়েছে, তখন নির্ম্মল মঞ্চে অবতীর্ণ হ’লো । বাবার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় ওর পরিচয় করিয়ে দেয়। মিলির থেকে ও আট বছরের বড়, বাণিজ্যে স্নাতক, এক সরকারি প্রকল্প ন্যাশন্যাল ইন্সট্রুমেন্টস কোম্পানী লিমিটেডে কাজ করে। সে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, তাকে তার মা ও বোনকে দেখতে হয়, অবশ্য তার ভাই, যে একজন ইলেকট্রিশিয়ান হিসাবে কাজ করে, তাকে সংসার চালাতে সাহায্য করে। নির্ম্মল ও তার মা-ভাইবোনেরা পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া তাদের নিজেদের বাড়ীতে বাস করে। নির্ম্মল বিয়েতে কোন যৌতুক নিতে চায়নি যদিও বাবা ওকে ওদের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে আতিথেয়তায় খরচ করার জন্যে ১০০০ টাকা দেবে ব’লেছে। বাবা ঠিক ক’রেছে মিলি, নির্ম্মল ও তার আত্মীয় স্বজনদের জন্যে উপহার কিনতে ৪০০০ টাকা খরচ ক’রবে আর নিজের বাড়ী বিয়ের অনুষ্ঠানে আতিথেয়তায় ১০০০ টাকা খরচ ক’রবে। এটা জানা নেই অন্যান্য বিয়ের পাত্রদের মত নির্ম্মল কেন যৌতুক চায়নি। হ’তে পারে সে বাবার তৈরী নিজের বাড়ীতে সুখে শান্তিতে আছে বলে, হ’য়ত কোলকাতার আমার বাবার বাড়ী আছে ব’লে সে বাবার আত্মীয় হ’তে চায়, হ’তে পারে সে ইঞ্জিনীয়ার ভাই হৃদয় আর কিরীটির সাথে সান্নিধ্য চায়, হয়ত সে ভেবেছে এই ভাবে সে তার সুন্দরী ও সুশিক্ষিতা শালী তুলির সাহচর্য্যও পাবে। হৃদয় তখন দিল্লীতে আছে – মিলির বিয়ের জন্যে বাবাকে হৃদয়ের কাছ থেকে কোন সাহায্য নেবার দরকার হয়নি। আমি আমার জাতীয় বৃত্তি – যা আমি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে পড়ার সময় মাসে মাসে পেতাম – তার পুরোটাই - ৬০০০ টাকা জমিয়েছিলাম। আমি সেই টাকা বাবাকে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিলাম কেননা আমার ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার সময় ফ্রী স্টুডেন্টশিপ থাকায় কোনও মাইনে দিতে হোতো না; আমার হাতখরচের টাকা বাবা আর দাদা হৃদয় জুগিয়েছিল। খুব দরকার লাগলে হৃদয়ের থেকে তো টাকা পাওয়াই যাবে তবে এখনকার মত দাদার বাবাকে কোন টাকা আগাম পাঠাবার দরকার নেই, বিয়ের দিনের কয়েকদিন আগে তার সশরীরে দমদমে উপস্থিত থাকলেই হবে।
আমি বিয়ের অনুষ্ঠানের আর খরচের একটা খসড়া ক’রে ফেললাম। বার্ন কোম্পানীতে কাজ ক’রে আমি জেনে গেছি - কি ক’রে মজুরদের মধ্যে কাজ ঠিকমত বেঁটে দিয়ে ও তাদের দিয়ে তা ক’রিয়ে নিয়ে, সারা দিনের কাজ তুলে ফেলা যায়। প্রোডাকসান ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার সময় আমি জেনে নিয়েছি কি ক’রে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর সাহায্যে কষ্ট না ক’রেও উৎপাদন অনেক বাড়ান যায়। আমার খসড়ায় আমি সব কাজের কথা লিখলাম আর কোন কাজ কার ওপর নির্ভরশীল তাও লিখলাম। আমি মা, বাবা, মিলি ও তুলিকে বললাম আমাকে সব কাজের ফর্দ্দ জানাতে - যেমন কি কি জিনিষ কিনতে হবে ও তার আনুমানিক মূল্য, বাড়ীতে কি কি তৈরী হবে ও কে কি ক’রবে, কি ধরণের কাজ বাইরে থেকে পয়সা দিয়ে করাতে হ’বে। যদিও বাবা অনুষ্ঠানের প্রধান হোতা আমি অনিল মামাকে রান্নার জিনিষপত্র কেনার ভার দিলাম, কৃষ্ণ মেসো ও কিছু খুড়তুতো / মামাতো ভাইদের ভার দিলাম অতিথিদের আপ্যায়ন করার। সমস্ত কেনাকাটা ও বাইরের থেকে পয়সা দিয়ে করানো কাজের দায়িত্ব আমি নিজে নিয়েছিলাম যাতে পুরো খরচগুলো আমার হিসেবের মধ্যে থাকে।
খসড়া খুব ভালো ক’রে করা হ’য়েছিল বলে সব অনুষ্ঠান ও অন্যান্য কাজ ভালো মতো হ’লো । সব নিমন্ত্রিত লোকেরা খুব খুশী হ’য়েছিল তাদের ঠিকমত আপ্যায়ন করা হ’য়েছিল ব’লে। তাও বেশ কিছু অঘটন ঘটেছিল কেননা ব্যার্থতার কারণগুলো আমার আগে থেকে বোঝা সম্ভব ছিল না। আমার কাছে জিনিষগুলো মেরামত করার মত ক্ষমতা তখন ছিল না। আমি ড্রেসিং টেবিল ও অন্যান্য উপহারের জিনিষ একটা টেম্পো ক’রে মিলির শ্বশুর বাড়ীতে নিয়ে যাচ্ছিলম। আমি আর আমাদের বাড়ীর ঝি টেম্পোর খোলের মধ্যে বসেছিলাম, যার মধ্যে জিনিষগুলো রাখা ছিল কিন্তু ভালো ভাবে বাঁধা ছিল না। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে চলার সময় ঝাঁকুনিতে ড্রেসিং টেবিল নড়ে গিয়ে তার আয়না ভেঙ্গে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় অঘটন ঘটেছিল আমার অনবধানতায়। নির্ম্মল তার ক্যামেরা আমাকে দেখাচ্ছিল। আমি জানতাম না যে ভিতরে ফিল্ম ভরা আছে। আমি ভুলক্রমে ক্যামেরার পিছনের ডালাটা একটু খুলে ফেলেছিলাম আর ভিতরের ফিল্মে আলো লেগে গিয়েছিল। তাই ছবি ডেভেলপ করার পরে বেশ কিছু ছবি ভালো হয়নি।
মিলির বিয়ে হ’য়ে যাবার পরেই বাবা ও মা হৃদয়ের জন্যে মেয়ে খুঁজতে আরম্ভ ক’রলো। হৃদয় বেশ কিছু দিন ধরে দিল্লীতে একাই থাকছিল। তাই ওরা ঠিক ক’রলো হৃদয়ের শীঘ্র বিয়ে দিতে হবে যাতে তার বঊ তাকে সাহায্য ক’রতে পারে দিল্লীতে তাদের সংসার পাততে। সুযোগ্যা পাত্রীদের বাবামাকে পাঠানোর জন্যে হৃদয় একটি বায়োডেটা তৈরী ক’রে বাবা-মাকে পাঠিয়ে দিলো। এই বায়োডেটাতে হৃদয়ের শিক্ষার আর পেশাগত যোগ্যতার পাশাপাশি এটাও বলা ছিল যে তার কোলকাতায় একটা নিজস্ব দোতলা বাড়ী আছে এবং বাবার মালিকানা ২/৭ – অংশ আছে বাবার পৈতৃক বাড়ীতে। অনেক সুপাত্রীর বাবার দাদাকে খুবই পছন্দ হ’লো ও তাদের মেয়ের বিয়ে দেবার আগ্রহ জানালো। এদের মধ্যে রোমি বলে একটি মেয়েকে মা ও বাবা পছন্দ ক’রলো ও হৃদয়ও রাজী হ’লো ।
পরের ফেব্রুয়ারী মাসে হৃদয়ের বিয়ে হ’লো । মিলির বিয়ের অনুষ্ঠানের বন্দোবস্ত করার অভিজ্ঞতা আমার খুব কাজে লাগল। আমি প্রায় একই রকমের একটা খসড়া বানালম অনুষ্ঠানের ও খরচের। প্রায় সব উপহার ও অন্যান্য বস্তু আমিই কিনলুম কেননা আমিই এই অনুষ্ঠানের হিসাবরক্ষক হিসাবে কাজ করলুম। বেশীর ভাগ অনুষ্ঠান যেরকম ঠিক করা হ’য়েছিল ও আশা করা গিয়েছিল সে রকমই হ’য়েছিল, শুধু একটি ঘটনা ছাড়া। একটা আমার কেনা স্যুটকেস খুব একটা শক্তপোক্ত ছিল না। ওটার হ্যান্ডেলটা হৃদয় ও তার স্ত্রী রোমি বিয়ের ঠিক পরে দিল্লীতে ট্রেনে ক’রে যাবার আগে স্টেশনেই ছিঁড়ে গেলো। হৃদয় পরে আমাকে বলেছিলো নতুন সম্বন্ধীদের সামনে তার কি রকম অপ্রস্তুত লেগেছিল।
এই রকম একটা সময়ে, যখন আমি কাজ শেষে ঘরে ফিরলাম মিলিকে আমাদের বাড়ীতে দেখতে পেলুম। আমি কৌতুহলী হ’য়ে উঠলুম কেন মিলি আমাদের বাড়ীতে এসেছে তা জানতে। আমি শীঘ্রই জানতে পারলুম গর্ভপাতের ফলে মিলি তার প্রথম তার প্রথম সন্তানকে হারিয়েছে। সে খুব ভেঙ্গে পড়েছে আর ভাবতে শুরু ক’রেছে তার বেশী বয়েসে বিয়ে হবার কারণে সে হয়ত আর কোনদিন মা হতে পারবে না। আমি জানতুম না মিলি কবে অন্তঃসত্ত্বা হ’য়েছিল। এধরণের মেয়েদের কথা মা আমাকে প্রায়ই জানাতো না। কিন্তু তার কাছ থেকে এই দুঃসংবাদ পেয়ে আমার খুব কষ্ট হ’লো।
যাই হোক কয়েকমাস বাদেই মিলি আবার অন্তঃসত্ত্বা হ’লো ও সময়ে একটা ফুটফুটে মেয়ের জন্ম দিলো। আমার বাবার বাড়ীতে এই নিয়ম ছিল অন্তঃসত্ত্বা মেয়ের প্রথম সন্তান জন্মাবার আগে ও পরে দায়িত্ত্ব নিতে হবে। হৃদয় বাইরে থাকে বলে ও বাবার বয়েস হ’য়েছে বলে আমাকেই মিলিকে দেখাশোনার ভার নিতে হ’লো , সে হাসপাতালে ভর্তি হ’লে আমাকেই হাসপাতালে যাওয়া আসা ক’রতে হ’তো। মিলির মেয়ে বাবা-মার প্রথম নাতনি। তার নাম দেওয়া হ’লো মুনা। সারা বাবা পরিবারে সে আনন্দ নিয়ে এল। আমি মনে করতুম সেই সবচেয়ে বুদ্ধিমান শিশু। মাড্যাম ক্যুরির নামে আমি ওর নাম দিলুম ক্যুরি। মাড্যাম ক্যুরিই প্রথম দুটো নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন।
হৃদয় তার বিয়ের সময় দিল্লীতে থাকতো ব’লে সে তার বৌ রোমিকে তার সাথে থাকার জন্যে সেখানে নিয়ে গেলো। বছরের শেষের দিকে হৃদয়ের ৬ মাসের একটা কাজের জন্যে প্যারিস যাবার দরকার পড়লো। তখন রোমি ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা; কাজের জন্যে হৃদয়ের তখুনি যাবার দরকার, তার পক্ষে তাদের প্রথমের সন্তানের জন্ম অবধি অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। হৃদয় রোমিকে নিয়ে ওর বাপের বাড়ী তালতলায় রেখে গেলো; সেখানে রোমির বাবা ওর যত্নের দায়িত্ত্ব নিলো। হৃদয় ও রোমি উভয়ের পরিবারেই নিয়ম ছিল অন্তঃসত্ত্বা মেয়ের – বিশেষ ক’রে প্রথম সন্তানের জন্মের সময় – যত্নের ভার মেয়ের বাপের বাড়ীর লোকেদের। রোমির একটা মেয়ে হ’লো আসন্ন সময়ের থেকে ১ মাস আগে। আমি তার নাম দিলাম প্যারী কারণ তার বাবা তখনও প্যারিসে রয়েছে। আমার বোনঝি ও ভাইঝির নাম ছন্দ মিলানো – ক্যুরি ও প্যারী। প্যারী জন্মাবার ৩ মাস পরে হৃদয় তার প্যারিসের কাজ শেষ হ’য়ে গেলে দিল্লীতে ফিরে এল। তারপরেই সে তালতলায় এসে রোমি আর প্যারীকে নিয়ে দিল্লীতে গিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠল।
বাবা ও মা এবার তুলির বিয়ে দেবার জন্যে উদগ্রীব হ’লো । তাদের জাতে তুলি শুধু দেখতে ভালো তাইই নয়, উচ্চশিক্ষিত ও একটা নামকরা স্কুলে অঙ্কের শিক্ষয়িত্রী। তুলির সাথে মানাবে এমন কোন সুপাত্র আমাদের জাতে দুষ্প্রাপ্য। যাই হোক, এ রকম একজন ছেলে পাওয়া গেলো। তমোজিত নামে একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিংএর স্নাতক আমাদের বাড়িতে অল্প আলাপেই তুলিকে বিয়ে ক’রতে রাজী হ’লো । অভিজিত, তমোজিতের বড় ভাই, এই সম্বন্ধ গড়ে ওঠার পিছনে মূল উদ্যোক্তা।
বাবা এটা জেনে খুব খুশী হ’লো যে অভিজিত চাইছে তমোজিতের সাথে তাদের মেয়ে তুলির বিয়ে হোক। উনি ভুলে গেলেন ওঁর কাছে কত টাকা আছে, এবং হৃদয়ের, তুলির ও আমার থেকে কত পেতে পারেন। অভিজিত যা যৌতুক চাইল বাবা তৎক্ষণাৎ দিতে রাজী হ’য়ে গেলেন, চিন্তা করলেন না যে পণের জন্যে অত টাকা খরচ উনি ক’রতে পারবেন কি না। বাবা নিশ্চিত ছিলেন যে, যা টাকাই দরকার হোক হৃদয়ের কাছে চাইলেই তা পাওয়া যাবে। বাড়ী কেনার সময় হৃদয় বাবাকে কথা দিয়েছিল ওনার মেয়েদের বিয়েতে সাহায্য ক’রবে। বাবা দিল্লীতে হৃদয়ের কাছে একটা চিঠি পাঠিয়ে জানালেন কত টাকা বিয়েতে খরচের জন্যে লাগবে। বাবার চিঠি পেয়ে হৃদয় হতবাক হ’য়ে গেলো। তার অবস্থা তখন এমন নয় যে তুলির বিয়েতে অত টাকা খরচ ক’রতে পারে। কিন্তু বাবাকে উত্তর দেবার বদলে সে ঠিক ক’রলো বাবার হ’য়ে সে অভিজিতকে তার বিয়েতে পণ ও উপহার চাওয়ার বিরুদ্ধে মন্তব্য ক’রে জানাবে।
অভিজিত হৃদয়ের চিঠি পেয়ে খুব রেগে গেলো। সে দু লাইনে বাবাকে উত্তর দিলো যে সে তার ভাইয়ের বিয়ে বাবার মেয়ের সাথে দিতে আর চায়না। বাবা অভিজিতকে ফোন ক’রলো। অভিজিত জানিয়ে দিলো, সে বাবার সাথে কথা বলতে বা তাকে চিঠি লিখতে আর চায়না। বাবার জানার কোন সুযোগই রইল না যে তমোজিতের এ ব্যাপারে কোন মত ছিল কিনা।
তুলি ভাবছিল তার বিয়ে করার কি দরকার। সে নিজে রোজগার করার মত শিক্ষা অর্জন ক’রেছে। এখনই সে একটা নামকরা স্কুলে অঙ্কের শিক্ষয়িত্রী। বাবা যদি হৃদয়কে না লিখত, আর হৃদয় যদি অভিজিতকে না লিখত সে হয়ত নিজের সঞ্চয় থেকেই অভিজিতের সব দাবী পূরণ ক’রতে পারতো। এখন কি করা যাবে? মার্টিনা, বাবা ও হৃদয় এখন চায় অন্য কোন যোগ্য ছেলের সাথে তার বিয়ে হোক।
আরও ছয় মাস ধরে খোঁজাখুঁজি ক’রে একজন সুপাত্রকে পাওয়া গেলো। তার নাম দীনেশ, সে এম-এ-এল-এল-বি কিন্তু ওকালতি করে না, মেদিনীপুরে একটা স্কুলে শিক্ষক।
দীনেশের বাবা, বিভূতি অতিশয় ধূর্ত লোক। সে বাবার সাথে এমন ক’রে আলোচনা ক’রছিলো যেন একটা মোটা পণ বিয়েতে দেওয়া হয়। বাবা সরল মনে ভাবলো সে যদি বিভূতির সব রকম দাবীদাওয়া না মানে তবে হয়ত দীনেশের মত একজন জামাই পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হ’য়ে যাবে। হৃদয় তখনও দিল্লীতে। তাই মা ও তুলি আমাকে বাবার সাথে পাঠাল যাতে হৃদয়ের সাথে আলোচনা না ক’রে বাবা কোন পণের টাকায় রাজী হ’য়ে না যায়; তুলিও হৃদয়কে জানিয়ে দিলো তার বিয়েতে তুলি নিজে কত টাকা সাহায্য ক’রতে পারে।
বাবা তমোজিতের সাথে সম্বন্ধ হাতছাড়া হবার পরে এবার খুব সতর্ক। আমি হৃদয়কে একটা চিঠিতে বিভূতির দাবী দাওয়া সম্বন্ধে বিশদভাবে জানালুম এবং বাবা ও তুলিকে তা ভালো ক’রে দেখে নিতে ব’ললুম। তুলি এর মধ্যেই অনেক টাকা জমিয়ে ফেলেছে, তাই সে আনুমানিক মোট খরচের বেশীর ভাগটাই (৯০%) দেবে ব’ললো। হৃদয় আমার চিঠিটা ভালো ক’রে প’ড়লো। এবার আর বিভূতিকে লিখলো না তবে বাবাকে একটা খসড়া পাঠাল যাতে কি কি দিতে রাজী হবে তা লেখা আছে। হৃদয়ের খসড়া অনুযায়ী বাবা একটা চিঠি বিভূতির জন্যে লিখে পাঠিয়ে দিলো।
বিভূতি পুরো অবস্থাটা যাচাই ক’রে বুঝে গেলো সে যদি বাবার প্রস্তাবে সম্মত না হয় তাহলে সে আর এ রকম সুব্দরী ও শিক্ষিতা সুপাত্রী পাবে না। বাবা অবশ্য চাইছিল একটা ভালো পরিবার ও একজন সুপাত্রের সাথে সম্পর্ক তৈরী ক’রতে; কি ক’রে নিজের সুবিধে যতটা পারা যায় আদায় ক’রে নেওয়া যায় তা তিনি শেখেননি। তিনি এটাও বোঝেন না যে যারা অল্প কিছুদিন বাদে তাঁর নিকট আত্মীয় হবে তারাই সে সম্পর্ক হবার আগে তাকে যতটা পারা যায় শোষণ ক’রতে চাইতে পারে। তুলি যাচাই করার কোন সুযোগই পেল না দীনেশ তার সাথে জীবন কাটাবার জন্যে কি রকম পরিকল্পনা ক’রেছে।
তুলির দীনেশের সাথে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে হ’য়ে গেলো ও তাকে দীনেশের সাথে জীবন কাটাবার জন্যে মেদিনীপুরে যেতে হ’লো । তাকে বেশ কিছু স্বার্থত্যাগ ক’রতে হ’লো । তাকে শ্যামবাজার বালিকা বিদ্যালয় ছাড়তে হ’লো কেননা মেদিনীপুর থেকে ওই বিদ্যালয়ে প্রত্যহ যাওয়া আসা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল, আর তার শ্বশুর শ্বাশুড়িও চাইত না সে আর কাজ করুক। তাকে বিভূতিদের বাড়ীর গ্রাম্য পরিবেশে থাকাও মানিয়ে নিতে হ’লো । এ ব্যাপারে দীনেশের প্রায় কিছুই বলার ছিল না। দীনেশ ক’রত বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, তাকে বিভূতির ওপরেই নির্ভর ক’রতে হত। বাড়ীর মালিক বিভূতি তখনও আদালতে মুহুরী হিসাবে ভালোই ঊপার্জন ক’রত।
আমি যে বার্ন কোম্পানিতে কাজ করতুম, তারাও খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিল না। মজদুর ইউনিয়ন তাদের ম্যানেজমেন্টকে নোটিস পাঠিয়েছিল যে তারা যদি অবিলম্বে তাদের মজুরী বাড়াবার দাবী না মেনে নেয় তবে তারা প্রোডাকশন বন্ধ ক’রবে; এর প্রত্যুত্তরে ও কিছু মজদুরের বিশৃঙ্খল আচরণের অজুহাতে ম্যানেজমেন্ট লক-আউটের ঘোষণা ক’রলো, যাতে কোন মজদুর কোম্পানির কম্পাউণ্ডে ঢুকতে না পারে ও কোন মজুরী দাবী ক’রতে না পারে। আমি অফিসে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলুম, এমন সময় রেডিওতে বার্ন কোম্পানির লক-আউটের ঘোষণা শুনলুম। আমি বুঝতে পারলুম যে, লক-আউটের জন্যে ফ্যাক্টরীর গেট বন্ধ থাকবে, কাজেই ফ্যাক্টরীর ভিতরে ঢুকতে পারবো না। তাই আমি ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জি.এল.দের বাড়ীতে গেলুম ও লক-আঊটের সময় কি ক’রবো জিগ্যেস ক’রলুম। জি.এল.দে তাদের স্ট্রাকচারাল শপ ম্যানেজার মিস্টার দামের বাড়ীতে যেতে ব’ললো। সব অফিসার ও ম্যনেজমেন্ট ট্রেনীদের সেখানে জড়ো হ’য়ে কিছু পারসোনেল ম্যানেজমেন্টের কাজ ক’রতে হবে কেননা পারসোনেল ম্যানেজমেন্টের নন-অফিসার কর্মীরা লক-আউটের সময় কাজে যোগ দিতে পারবে না।
মিস্টার দামের বাড়ীতে, সব অফিসার ও ম্যনেজমেন্ট ট্রেনীদের কিছু বিশেষ কাজ দেওয়া হ’লো । হাতে যা অর্ডার আছে তা প্রস্তুত ক’রতে কোন কোন মেসিন লাগবে তা বিচার ক’রে প্রত্যেক শপে ন্যুনতম ক’জন মজুর লাগবে তা হিসেব ক’রে বার করা হ’লো প্রথম কাজ। দ্বিতীয় কাজ হ’লো বর্তমানে যত মজুর আছে তাদের থেকে কাকে কাকে রাখতে হবে। লক-আউটের সময় মোট ৭৫০০ জন মজুর ছিল আর ম্যানেজমেন্ট হিসেব ক’রে দেখলো তাদের কাজ চালাবার জন্যে ২৫০০ মজুর হলেই চলবে। তারপরে প্রত্যেক বিশেষ কাজের শপের জন্যে অফিসারের দলকে সেই শপের মজুরদের নামের লিস্ট দেওয়া হ’লো, তারা লিফো পদ্ধতিতে কোন কোন মজুরকে রাখতে হবে তা ঠিক ক’রে নেবে। আমার খুব নিকট বন্ধু-সহকর্ম্মী, এক ম্যনেজমেন্ট ট্রেনী যখন ফাউন্ড্রি শপের মজুরদের জন্যে এই হিসাব ক’রছিলো, তখন দেখলো যারা ছাঁটাই হবে তাদের নামের লিস্টে তার নিজের বাবার নাম রয়েছে। সে আমাকে ও আমাদের দলের অন্য লোকেদের এ কথা ব’ললো। তবে যেহেতু লিফো (Last In First Out) পদ্ধতি অনুযায়ী লিস্ট তৈরী ক’রতে হবে তাই কোন ভাবেই সেই লিস্টে কোন পরিবর্তন আনা গেলো না।
বার্ন কোম্পানি ৯ মাস বাদে মজুরদের কাজে যোগদানের জন্যে দরজা খুললো। দুই-তৃতীয়াংশ মজুরদের সেদিনেই ছাঁটাই করা হ’লো ও কারখানা আবার খোলা হ’লো । ভারী কলকব্জা ও রেলের ওয়াগন তৈরীর কাজ অনেক কমিয়ে দেওয়া হ’লো, ফলে অনেক ইঞ্জিনীয়ারদেরও আর প্রয়োজন রইল না। আমিও অন্যদের মত অন্য জায়গায় কাজ খুঁজছিলাম।
যাই হোক, মেদিনীপুরে তুলির শ্বশুরবাড়ী অতটা দূরে না। আমি সেখানে দু সপ্তাহ অন্তর যেতাম। কখনও কখনও আমি দীনেশকে অনুরোধ ক’রতাম আমাকে সাইকেল চালানো শেখানোর জন্যে। যদিও দীনেশ নিজে সাইকেল চালাতে জানতো না, মেদিনীপুরে আমি সাইকেল চালানোর অনুশীলন করার সময় সে আমাকে সঙ্গ দিত।
তুলির পক্ষে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল শ্বশুর শ্বাশুড়ির সঙ্গে মানিয়ে চলতে। প্রথমতঃ এখানে তার কোন শিক্ষা বা পেশা বিষয়ক কেরিয়ার ছিল না, সে আর এখানে গণিতের শিক্ষয়িত্রী নয়, দ্বিতীয়তঃ গ্রাম্য পদ্ধতিতে অনেক ঘরের কাজ ক’রতে হয়; এধরণের কাজ করার অভ্যেস তার নেই। তৃতীয়তঃ সে বুঝতে পারল তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি সব সময় তার দোষ খোঁজার চেষ্টায় রয়েছে। সে তার স্বামী দীনেশের কাছে থেকে ভালোবাসা আর ভরসা পেলে হয়ত এই সব অসুবিধা সহ্য ক’রে নিত। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যাতেই দীনেশ রাতের খাওয়ার পরে ধূমপান করার অছিলায় বাড়ী থেকে বেরিয়ে যেতো। দীনেশের পরিবারে এ রকম নিয়ম ছিল না যে এ ধরণের বাড়ীর বাইরে বেরোবার সময় স্ত্রীকে নিয়ে যেতে হবে, তাই তুলি সংসারের সব কাজ হ’য়ে যাবার পরে দীনেশের জন্যে অপেক্ষা ক’রতো। তুলি অল্প কদিন বাদেই বুঝতে পারল দীনেশ রাতে বেরোয় শুধু সিগারেট খাবার জন্যে নয় – সে বেশ কিছু মাস ধ’রে – হয়ত তুলির সাথে বিয়ে হবার আগে অনেক বছর ধ’রে – একজন মেয়ের সাথে দেখা ক’রতে যায়। তুলি ঠিক বুঝতে পারছিল না ওর এখন কি করা উচিত, সে দীনেশের বাবা-মাকে ব’লতে পারে না কেননা তাহলে তারা দীনেশকে দোষ না দিয়ে ওকে দোষী ঠিক ক’রবে। সে নিজের মা বা বাবাকেও লিখতে চায় না কেননা তারা তাহলে তার জন্যে চিন্তা ক’রবে, কিন্তু হয়ত দীনেশের সাথে বিবাহ-বিচ্ছেদ করার মত কঠিন পথও বেছে নেবে না।
আমি প্রায় প্রত্যেক দুই বা তিন সপ্তাহ অন্তর তুলির সাথে দেখা করতে যেতুম। কিন্তু সাধারণতঃ আমি তখন এত ক্লান্ত থাকতুম যে তুলির সাথে অনেকক্ষণ ধ’রে কথা ব’লতে পারতুম না। আমি দীনেশের সাথে কিছুক্ষণ সাইকেল চালাতুম, তুলির শ্বশুর শ্বাশুড়ির স্বাস্থ্য সম্বন্ধে খোঁজ নিতুম। তারপরে দুপুরবেলার খাওয়াদাওয়া ভালোভাবে সেরে একটা টানা ঘুম লাগাতুম। সন্ধ্যায় আমি আবার একটা কাজের সপ্তাহ কাটাবার জন্যে মেদিনীপুর থেকে ফিরে আসতুম। আমি জানতেই পারিনি তুলির শ্বশুর বাড়িতে কি অসুবিধা হচ্ছে; তুলি নিজেও কোন দিন আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি, যতক্ষণ না আমি আমার বাবার কাছে থেকে একটা টেলিগ্রাম পেলাম যাতে লেখা আছে,- ‘তুলি হাসপাতালে, মেদিনীপুরে যাও।’
আমি তাড়াতাড়ি তুলির সাথে দেখা ক’রতে মেদিনীপুরে গেলুম। প্রথমে আমি ওর শ্বশুর বাড়ী গেলুম, সেখান থেকে হাসপাতালের ঠিকানা নিয়ে তুলির সাথে দেখা ক’রে বুঝলুম যে এখন আর কোনো বড় বিপদের ভয় নেই। শরীর-মনের ধকল কাটিয়ে ও এখন সেরে উঠছে। আমি যখন তুলির বিছানার পাশে গেলুম তখন দীনেশ ওর পাশে রয়েছে। তুলি যে আত্মহত্যা ক’রতে যাচ্ছিল সে ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি, তাই বলেনি কেন আত্মহত্যা ক’রতে যাচ্ছিল। উলটে দীনেশের খুব প্রশংসা ক’রলো, বর্ণনা ক’রলো কিভাবে সে তাকে কাঁধে ক’রে তাদের বাড়ীর সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে ট্যাক্সি ক’রে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে, কেমন ক’রে সে তার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
তুলির শ্বশুড়বাড়ীতে ফিরে এসে আমাকে অনেকগুলো কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হ’তে হ’লো । ১) তোমার বোনের ব্যবহার পাড়াপড়শীদের কাছে আমাদের পরিবারের সুনাম নষ্ট ক’রেছে। পাড়ার লোকেরা ভাবছে আমরা তার প্রতি দুর্ব্যবহার ক’রতাম ও তাকে কষ্ট দিতাম।
২) তোমার বোন কেন কোলকাতাতেই অন্য কারুর সঙ্গে বিয়ের জন্যে অপেক্ষা ক’রতে চেয়েছিল?
৩) যখন সে চায়নি তখন কেন জোর ক’রে তার বিয়ে দিয়েছিলে?
আমি বোঝাতে পারেনি কেন আমার বোন আত্মহত্যা ক’রতে চেয়েছিল। তবে আমি নিশ্চিতভাবে জানিয়েছিলাম যে তুলির কোন ছেলে-বন্ধু বা প্রেমিক বিয়ের আগে ছিল না আর এমন কোন কারণ থাকতে পারে না যার জন্যে সে দীনেশের মত ছেলেকে বিয়ে ক’রতে আপত্তি ক’রতে পারে। তুলি হয়তো কোলকাতার জীবন ধারা চাইছিল যেখানে পড়াশুনা ও স্কুলের কাজ ক’রে সময় কাটাতে তার আনন্দ লাগতো।
তুলি হাসপতাল থেকে ফিরে আসার পরে দেখলো তার পক্ষে শ্বশুর বাড়ীতে থাকা আরও অসম্ভব হ’য়ে পড়েছে। প্রায় প্রত্যেক পরিবারের লোকের কাছে সে অপরাধী হ’য়ে গেছে যদিও সে কাউকেই তার আত্মহত্যার চেষ্টা করার আসল কারণ জানাতে পারছে না। তুলি এই চেষ্টার আসল কারণ আমাকে, বা মা, বাবা কাউকেও জানায়নি। একমাত্র দীনেশ হয়ত তুলির আত্মহত্যা করার কারণটা আন্দাজ ক’রতে পেরেছিল। কিন্তু সে এ কথা পরিবারের কাউকে জানায়নি, এমনকি যে মেয়েটির সাথে সে রোজ দেখা ক’রতে যায় হয়তো তাকেও না।
তুলির সমস্যার কিছুটা সমাধান হ’লো যখন সে দীনেশের দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা হ’লো। অন্তঃসত্ত্বা হবার তিন মাস পরে বাবা ভালো যত্নের জন্যে তুলিকে কোলকাতায় নিয়ে এল। তুলির প্রসব কিছুটা গোলমেলে হ’লো কেননা তার চিকিৎসক সিজারিয়ান করার উপদেশ দিয়েছিল। তুলি তার আগের শিক্ষিকার চাকরি করার সময় কিছু সঞ্চয় ক’রেছিল। সে বাবাকে বড় চিকিৎসকের ফি দেবার জন্যে সাহায্য ক’রল। তুলি এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিলো। তার নাম দেওয়া হ’লো জলপরী।
আমি ক্রমে ক্রমে ভালোভাবে সাইকেল চালাতে শিখলুম। কিন্তু আমি বুঝতে পারলুম, আমাকে কাজের জন্যে অনেক ঘোরাফেরা ক’রতে হবে, বিশেষ ক’রে খুব শীঘ্রই আমাকে হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে কোন কোয়ার্টারে যেতে হবে। আমি এখানে আসার পর প্রত্যেক মাসে সংসার-খরচের অংশ হিসাবে বাবাকে ২০০ টাকা ক’রে পাঠাতুম। তা সত্ত্বেও আমি কিছু টাকা জমাতে পেরেছিলাম ও দু বছর পরিশ্রম করার পরে আমি একটা ল্যামব্রেটা স্কুটার কিনলাম। ঠিক এক মাস পরে আমি বাবার থেকে একটা চিঠি পেলাম যে ডলির বিয়ে ঠিক হ’য়েছে, বিয়ে এ মাসের শেষে হবে ও আমি যেন যত শীঘ্র সম্ভব বেশ কিছু টাকা পাঠাই। মিলি ও তুলির মতো এবার আর বাবাকে ডলির পাত্রের জন্যে খুব একটা খোঁজাখুঁজি ক’রতে হয়নি। বাবা একটা বিয়ের বিজ্ঞাপনের জবাব দিয়েছিল। পাত্র ভিক্টর নিজে ও তার বড় ভাই আমাদের বাড়ীতে এসেছিল ও ডলিকে পছন্দ ক’রে গিয়েছিল। বাবা আমাকে যত শীঘ্র সম্ভব ৩০০০ টাকা পাঠাতে বলেছিলো কেননা অনেক কিছু ক’রতে হবে ডলির বিয়ের দিনের আগেই। আমি খুবই অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম কেননা আমি সবে আমার সমস্ত পয়সা খরচ ক’রে ফেলেছি স্কুটার কেনার জন্যে। কিন্তু আমি বাবাকে এ কথা তখন জানাতে পারলুম না। আমি জানি না, হৃদয়ের কাছ থেকে বাবা কত টাকা চেয়েছিল। আমি তক্ষুনি ডলির বিয়ের জন্যে এক সপ্তাহের ছুটির দরখাস্ত দিলাম ও প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে ৪০০০ টাকা ধার করার দরখাস্ত ক’রলাম, যাতে বাবা বা ডলির কোন অসুবিধে না হয়।
যদিও আমরা পরিবারের সবাই ডলি সম্বন্ধে চিন্তিত ছিলাম কিন্তু তার বিয়েতে কোন সমস্যা হ’লো না। মিলি, হৃদয় আর তুলির বিয়েতে যেরকম ক’রেছিলাম সে রকম ডলির বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজনও আমি ক’রলাম। মা একটা স্যুটকেসে সব রকম আয়ুর্বেদিক ওষুধ ভ’রে দিয়েছিল যা ডলির অনিদ্রা হ’লে খাওয়া দরকার। মিলি ও তুলির মতো ডলির ঘরের কাজ করার অত দক্ষতা ছিল না; তবে সে ঘরে খাওয়ার সাধারণ রান্না ক’রতে পারত আর তার শ্বশুর-শ্বাশুড়িরও তাকে ভালো লাগল। কিন্তু ডলি একজন সরল মেয়ে ও ভিক্টর পরিবারের রাজনীতিটা একদম ধ’রতে পারেনি।
আমাদের পরিবারের সবাই ডলির বিয়ে হ’য়ে যাবার পরে খুব খশী হ’য়েছিল, কেননা আর ডলির জন্যে একজন পাত্র খোঁজার জন্যে দুশ্চিন্তা ক’রতে হ’বে না, হয়তো ডলির স্বাস্থ্য নিয়েও আর চিন্তা ক’রতে হবে না। আমি প্রতিজ্ঞা ক’রেছিলাম ডলির বিয়ে হবার আগে বিয়ে করবো না। তাই আমি এবার আমার নিজের বিয়ে শীগগিরই হবে এই আশা ক’রে খুশী হচ্ছিলাম। ডলির বিয়ের ৬ মাস পরে আমি যখন খুব খুশী মনে মুন টাউনে চাকরী ক’রছিলাম তখন আমি তুলির থেকে একটা চিঠি পেলাম যা আমার চেনা পৃথিবীটা বদলে দিলো। এতে লেখা ছিল:
‘প্রিয় কিরীটি,
ডলি আমাদের বাড়ীতে গত শনিবারে ফিরে এসেছে। ভিক্টর তাকে আমাদের বাড়ী পৌঁছে দিয়ে গেছে আর বাবা-মাকে ব’লে গেছে ওকে ফেরত নিতে আসবে না। ডলি একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে এসেছে, হয়ত ভিক্টরের তাকে বাপের বাড়ী ফেলে রেখে যাবার কথা সে জানতো না।
ভিক্টর ব’লে গেছে ডলি অদ্ভুত আচরণ ক’রছিলো যাতে ভিক্টর ও বাড়ীর অন্যান্যরা আশ্চর্য্য হ’য়ে গিয়েছিল। জিগ্যেস ক’রতে ডলি বলে সে তার আয়ুর্বেদিক ওষুধ খেতে ভুলে গিয়েছিল আর তাই তার ঠিক মত ঘুম আসছে না। তা থেকে ভিক্টর বুঝেছে ডলির মানসিক ভারসাম্যের অভাব আছে ও বিয়ের প্রস্তাব দেবার সময় তা ভিক্টরকে জানান উচিৎ ছিল।
…….. ‘
ডলিকে সাহায্য করার জন্যে আমি কী ক’রতে পারি তা আমি জানতাম না। আমি আরও ভালো কাজের সন্ধান ক’রছিলাম, যাতে আমি আরও অর্থোপার্জন ক’রতে পারি এবং বাবা, মা এবং ডলিকে সাহায্য ক’রতে পারি। আমি ভেবেছিলাম আমি আর বিয়ে ক’রবো না; আমরা আমাদের বোনেদের বিয়ে দেবার জন্যে অনেক চেষ্টা ক’রেছি, কিন্তু তাদের বিয়ে দিয়ে সুখী ক’রতে পারি নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বরের পরিবার এবং কনের পরিবার একে অপরকে তাদের আপনজন ব’লে মনে করে না। এমনকি বর এবং কনে একে অপরকে ভালোবাসে না। বিবাহের সমস্ত অংশীদাররা ঐতিহ্য অনুসরণ করে এবং আইনী ব্যবস্থার অনুমতি অনুসারে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে শোষণ করার দিকে লক্ষ্য রাখে। যৌতুক প্রথাটির ঐতিহ্য এখনও অব্যাহত রয়েছে, যদিও এটি এখন আইনতঃ অনুমোদিত নয়। বাস ব্রেক-ডাউনের পরে অঞ্জু মাসীর সাথে আমার যে কথোপকথন হ’য়েছিল তা মনে পড়ে গেলো এবং অঞ্জু মাসী এই প্রশ্নটি ক’রেছিলেন, ‘বিয়ে যদি পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায় তবে কী হবে?’
দাদা হৃদয় মা ও বাবাকে দিল্লীতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ক’রেছিল, কারণ তাদের বয়স বাড়ছে এবং নিয়মিত দেখা শোনা করার দরকার। ডলিও মা ও বাবার কাছে থাকতো ব’লে, দাদা হৃদয় তাদের তিনজনকেই ওর দিল্লীর তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে গেলো। আমি একা ভবানীপুরের ফ্ল্যাটেই চালিয়ে গেলাম, কারণ বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তিনি কখনই তাঁর ফ্ল্যাট ছেড়ে দেবেন না; আমাদের পরিবারের কেউ সেখানে থাকবে, এবং প্রতিমাসে ৪০ টাকা ভাড়া দেওয়া অব্যাহত রাখবে।
আমি যেমন ভাড়াটিয়া হিসাবে ভবানীপুরের একতলার ফ্ল্যাটে আমার দিন কাটাতে রইলুম, তেমনই ঐ একই বাড়ীর দোতলা আর তিনতলায় আমার বাড়িওয়ালাও রয়ে গেলো। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখার সঙ্গে সঙ্গে, বার্ন কোম্পানীর চাকরিতে ব্যস্ত থাকার কারণে আমি ফ্ল্যাটে কেবল রাতটুকু কাটিয়েছি, এবং পরী-দিদা, প্রদীপকা, চেরি মাসী, লালু, ভুলু, স্বপনকা, অঞ্জু মাসী ও টুম্পার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ বড় একটা পাইনি ।
তবুও বারবার, আমি অঞ্জু মাসীর এই প্রশ্নটি নিয়ে ভেবেছিলাম, ‘বিবাহের প্রথা ও আনুসঙ্গিক নিয়ম পুরোপুরি বাতিল হয়ে গেলে কী হবে?’
এই ব্যাপারে একটু আলোচনা করা যাক নীচের কয়েকটি অনুচ্ছেদে:
বিবাহিত দম্পতির দুই পার্টনারের মধ্যে খাবার, পোশাক এবং আশ্রয় সমান ভাবে ভাগ ক’রে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকা উচিত. এবং যৌন কার্য্যকলাপ কেবল দুই পার্টনারের মধ্যেই হওয়া উচিত, অন্য কারুর সাথে নয়।
প্রায়ই বাড়িতে অন্যান্য অতিথিদের ভিড় থাকে, দম্পতির উভয় সদস্যই প্রতি অতিথিকে পছন্দ করে ন। অন্য অতিথি অনেক সময় বিবাহিত দম্পতির একজনের সঙ্গে যৌন সম্পর্কেও দখল নিতে চায়, যেখানে বিবাহিত দম্পতির সদস্যদের কেবল একে অপরের একচেটিয়া অধিকার থাকা উচিত।
একচেটিয়া অধিকারগুলির অমর্য্যাদার জন্যে প্রায়ই হয় বিবাহ-বিচ্ছেদ যা ক্রমশঃই বেড়ে চলেছে। তবুও, প্রায়ই লোকেরা বিবাহ-বিচ্ছেদ ছাড়াই চালিয়ে যায়, কারণ এটি অনেক ব্যয়বহুল, এতে প্রচুর অর্থ এবং সময়ের অপব্যয় হয়। সেই অর্থ এবং সময় কাজে লাগানো যেতে পারে জীবনের অন্য স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে। যারা তালাক দেয় তাদের প্রায়শই তাদের উপার্জন এবং সম্পত্তির বৃহৎ অংশ পূর্ববর্তী অংশীদারদের সাথে ভাগ করে নিতে হয়। প্রায়ই তারা অন্য সঙ্গী পেতে পারে না, যারা তাদের মানসিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ; এই কারণে বিবাহিত দম্পতির জন্য অপরিহার্য পারস্পরিক বিশ্বাস তৈরি করতে পারে না।
অধিকংশ দেশের সমাজ এবং আইন বিবাহিতদের জন্য সুবিধা প্রদান করে:
· বিবাহিতকে আরও ধনী করে তোলে,
· অপেক্ষাকৃত ভালো ট্যাক্স সুবিধা দেয়,
· স্বাস্থ্য বীমার খরচ অপেক্ষাকৃত কম,
· মামলা ইত্যাদির জন্যে দুশ্চিন্তা কম,
· হতাশায় ভোগার সম্ভাবনা কম,
· বিবাহিতেরা ঝুঁকি কম নেয়।
“There is no doubt that marriage has financial benefits to the individual and to the married couple. The benefits are from taxes to insurance policies and make great incentives for getting married. However, many poorer and less educated Americans are opting not to get married at all. They’re living together, and often raising kids together, but deciding not to tie the knot. Marriage is becoming a more durable, but far more exclusive institution. The marriage gap describes observed economic, political and educational disparities in the United States between those who are married and those who are not. In today’s economy, a person with a Bachelor’s degree will receive, on average, 66% higher lifetime earnings than persons with a high school diploma or less. The average married couple reports to have an average net worth of around $43,000 after 10 years of being married, compared to $11,000 for people who stayed single. Together, the benefits of marriage and the lifetime earnings of having a higher education are escalating income disparity in America.”[1] However, people who had married and then divorced were worse off than any other group.
“The study of about 9,000 people found that divorce reduces a person's wealth by about three-quarters (77 percent) compared to that of a single person, while being married almost doubles comparative wealth (93 percent). And people who get divorced see their wealth begin to drop long before the decree becomes final[2].”
নির্বিবাহ জগৎ হোক একটি বিরাট পরিবার, যেখানে বিবাহিতেরা অবিবাহিতদের সঙ্গে সমান সুযোগ সুবিধা পাবে । স্বামী বা স্ত্রীকে প্রবঞ্চিত ক’রে ব্যক্তিগত লাভ করার সুযোগ থাকবে না।
বিবাহের প্রয়োজন ২০৫০-এর পরে একেবারেই অন্তর্হিত হবে। গর্ভনিরোধক পিলের উদ্ভাবক Carl Djerassi[3]-এর জীবনদর্শন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের পরে নারী আর পুরুষে মিলে সেক্স বা রতিক্রিয়া ক’রবে শুধু নির্ম্মল মজার জন্যে, সন্তানকে জন্ম দেওয়ার আশা বা দুশ্চিন্তা কিছুই থাকবে না। গর্ভনিরোধক পিলের আর দরকার থাকবে না, কারণ নারীরা তাদের ডিম অর্থাৎ eggs আর পুরুষেরা তাদের শুক্রাণু বা শুক্রকীট অর্থাৎ sperm ঠাণ্ডাঘরে জমিয়ে রেখে নির্বীজন ক’রবে নিজেদের, অর্থাৎ বন্ধ্যা হয়ে যাবে। কৃত্রিম ডিমও তৈরী হবে হয়তো ২০৩০এর আগেই। ভ্রূণহত্যার আর প্রয়োজন হবে না, কারণ বিনা পরিকল্পনায় সন্তানের ভ্রূণ সৃষ্টি ক’রবে না কেউ। সন্তান উৎপাদন ক’রতে সক্ষম অনেক নারী তাদের তরুণীজীবনের ডিম [eggs] ঠাণ্ডাঘরে জমিয়ে রাখবে একটু বড় বয়সে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে IVF-এর মাধ্যমে অন্তঃসত্ত্বা হবার জন্যে। বিশ বছরের তরুণীরা এই পন্থা নিয়ে নিশ্চিন্ত হবে যে বয়স হ’য়ে ডিম নিঃশেষ হবার আগে, তাদের জীবনসঙ্গী বেছে নিতে হবে না; কর্ম্মজীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পরে সন্তানকে জন্ম দিয়ে লালনপালন করার সুযোগ পাবে। সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য নারী ও পুরুষের রতিক্রিয়ার প্রয়োজন হবে না।
[1] Taken from a memo
From: Gustav Ole Dyrhauge, Kevin Cook & Yangying Ye
To: American Politicians, Date: 10th December 2018
Topic: The Marriage Gap in The United States of America
[2] A 2005 study at Ohio State University (OSU)
[3] http://www.djerassi.com/Daily_Teleg_Interv.11-9-14.pdf
Sex will soon be just for fun not babies, says father of the Pill: Prof Carl Djerassi claims advances in fertility treatment make it safer for parents without fertility problems to consider IVF. By Sarah Knapton, Science Editor (Daily Telegraph, London) 7:am GMT 09NOV2014