উপসংহার
এটি যদি একটি নাটক হ’তো তবে আমরা এখানেই থেমে যেতাম, আর কিছু বলার থাকতো না। হাততালির অবিশ্রান্ত আওয়াজে অভিনন্দিত অভিনেতারা মঞ্চে একত্রিত হ'য়ে, মাথা নত ক’রে দাঁড়াতেন দর্শকদের সামনে। তবে বাস্তব জীবন অনেক আলাদা নাটক বা উপন্যাস থেকে। বাস্তব জীবনের সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা বিবেচনা ক’রে আমরা সবসময় অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে শেষ ক’রে দিতে পারি না, পারি না বীরদের পুরস্কৃত ক’রতে, যাতে তারা পারে এগিয়ে যেতে, পারে সমৃদ্ধি আনতে – শুধু নিজের একার নয় – দেশের, সারা পৃথিবীর।
কারা ছিল এই উপন্যাসের অপরাধী? অনেক প্রসিকিউটর বা অভিশংসক চাইবেন শাস্তি দিতে প্রথমে অঞ্জু মাসীকে, পরে প্রয়োজন হ’লে আমাকেও। তারা স্বপনকার দুর্ভাগ্যের জন্য মমতা এবং সহানুভূতি দেখাবেন এবং তাকে মোটা টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা ক’রবেন।
তবে এখানে স্বপনকা আমার ও মিলির মতো অপরাধীদের ক্ষমা ক’রে দিয়েছে; তাই আমরা তাকে মিলির বাবার স্নেহাশীষ এবং নন্দিতার ভালোবাসা উপভোগ ক’রতে দিয়ে দৃশ্যটি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। মিলি ও আমি পরস্পরকে শিখিয়েছিলাম আমাদের অতীতকে ভুলে যেতে, ভুলে যেতে যে মিলি এক সময়ে আমার অঞ্জু মাসী ছিল, অঞ্জু মাসীর স্বামী ছিল স্বপন ও কন্যা ছিল টুম্পা।
মিলি ও আমি ফিরে এলাম আমাদের ফ্ল্যাটে দিল্লীতে; সেখানে আমাদের শিশুদের লালন পালন ক’রে, আমরা মানুষ ক’রে তুললাম রিমি আর মিন্টুকে। টুম্পার ভবিষ্যৎ গড়ার ব্যাপারে আমরা অপেক্ষা ক’রলাম টুম্পার নিজের পছন্দের উপর – কার সাথে ও জীবন কাটাবে স্বনির্ভর হওয়ার আগে পর্য্যন্ত - তার নিজের বাবা স্বপন ও নতুন মা নন্দিতার সঙ্গে, অথবা নিজের মা মিলি ও তার স্বামী কিরীটির অর্থাৎ আমার সঙ্গে, অথবা অন্য কারুর সঙ্গে, অথবা একাই – কোনো মা বা বাবার অভিভাবকত্ব না নিয়ে।
আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি আদৌ বিয়ে ক’রবে? সারা জীবন এক বা একাধিক পার্টনারের সঙ্গে থাকতে পছন্দ ক’রবে? আমি বিশ্বের সকল দেশের সরকারকে আবেদন করছি যাতে বিবাহিত ব্যক্তিরা কোনও অতিরিক্ত সুবিধা না পায় যা সঙ্গীহীন মানুষেরা পায় না। বিবাহিত হোক বা না হোক প্রত্যেকেই ন্যায়সঙ্গত সুবিধা পাওয়ার যোগ্য এবং ন্যায়সঙ্গত করের দায়বদ্ধ হওয়া উচিত। বিবাহিত ব্যক্তিরা যদি কোনও অতিরিক্ত সুবিধা না পায়, তাহ’লে ঐ সুবিধাগুলি পাওয়র জন্যে কেউ বিবাহিত থাকতে চাইবে না।
এবারে আবর ফিরে আসি - সংক্ষেপে বলি - স্বপনকা আমাদের কোনো বাধ্যবাধকতার চাপ না দিয়ে ক্ষমা করার পরে কী ঘটেছিল।
মিলি এবং আমি আমাদের দিল্লীর ইস্ট অফ কৈলাস অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসেছিলাম; আমাদের মেয়ে রিমি এবং ছেলে মিন্টুকে দাদা ও বৌদির অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিলাম। কোলকাতার ভবানীপুরে যাওয়ার আগে আমরা যেখানে ছিলাম ঠিক সেখানেই আমরা আবার জীবন শুরু ক’রেছিলাম।
আমরা জুনিয়র বাবলুর মাসীর বাড়িতে গিয়েছিলাম, ওখানে টুম্পার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। ওকে রাইসিনা স্কুলে ভর্তি করানোর এবং ওর উচ্চশিক্ষিত মা মিলির কাছে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে আমাদের প্রস্তাবের প্রশংসা ক’রেছিল টুম্পা। কিন্তু যেহেতু তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মাত্র আট মাস বাকি ছিল, স্কুল বদল ক’রতে রাজি হয় নি টুম্পা। জুনিয়র বাবলু তাকে স্বপনকার বাড়ীতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছিল এবং সেখান থেকে পড়াশোনা চালিয়ে গেছিল এবং পরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল।
দু বছর পরে, আমি দিল্লীর কানাডিয়ান হাই কমিশন থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলাম যাতে বলা হ’য়েছিল যে কানাডায় অভিবাসনের জন্যে আমার আবেদন মঞ্জুর হয়েছে: তার জন্যে আমার পরিবারের চারজনকে (কিরীটি, মিলি, রিমি এবং মিন্টু) হাই কমিশন অফিসে ইন্টারভিউ দিতে হবে; আর লাগবে মেডিকেল ক্লিয়ারেন্স , পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এবং আয়কর ছাড়পত্র। যদিও আমার সমস্ত বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজন বিশ্বাস ক’রেছিল যে আমি মিলির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি, তবুও আমাদের কোনও ম্যারেজ সার্টিফিকেট ছিল না।। কানাডিয়ান সরকার নির্দ্দেশ অনুযায়ী, মিলি এবং আমি দিল্লী আদালতে আমাদের বিয়ের একটি হলফনামা বা এফিডেভিট করিয়েছিলাম, এতে আমার দাদা আমাদের বিয়ের সাক্ষী হিসাবে সই ক’রেছিলেন। আমরা টুম্পাকে আমাদের কানাডা যাওয়ার কথা জানিয়েছিলাম এবং জিগ্যেস ক’রেছিলাম, ও আমাদের সাথে যেতে চায় কিনা; ও ওর বাবা অর্থাৎ স্বপনকার কাছে থাকতে পছন্দ ক’রেছিল।
এর পরে অনেক বছর কেটে গেছে, মিলির মেয়ে রিমি একটি কানাডিয়ান ছেলের প্রেমে পড়েছিল; তারা তখন থেকেই সুখে বিবাহিত; তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন কানাডার ওটাওয়াতে হ’য়েছিল, সেখানে তাদের খ্রীস্টান বিবাহ অনুষ্ঠানও হ’য়েছিল। দিল্লীতে আবার তাদের একটি বাঙালি স্টাইলে হিন্দু বিয়েও দেওয়া হ’য়েছিল।
টুম্পা ও জুনিয়র বাবলু খুব বেশি দিন একসঙ্গে চালাতে পারেনি; পরে টুম্পা একটি মুসলিম ছেলের প্রেমে পড়ে যায় - ইমরান; তবে সেই সম্পর্কও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তার পরে ও পুরোপুরি বিয়ে না করার জন্যে মনস্থ ক’রেছে।
আমাদের কনিষ্ঠ পুত্র মিন্টু এখনও ভারতে জন্ম নেওয়া এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে ক’রার জন্যে উৎসুক; তবে ও সবে অর্থনীতি এবং অ্যাকচুয়ারীতে স্নাতক হ’য়েছে।
স্বপনকা নন্দিতাকে বিয়ে ক’রে সুখে আছে; তাদের আরও দুটি মেয়ে হ’য়েছে; তারা দুজনেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা ক’রছে।
আমি বেশিরভাগ ব্যাঙ্কিং সফটওয়্যার এবং বিজনেস ইন্টালিজেন্সে আমার আই.টি. কেরিয়ারটি তৈরী ক’রেছি; ইঞ্জিনীয়ারিং-এর কাজ আর ক’রিনি। মিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত পড়ানোর চাকরি পেয়েছে; সেখানে ও সম্প্রতি অধ্যাপিকা হয়েছে। মিলি এবং আমি দুজনেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি (১) ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রতিরোধের জন্যে, (২) সীমান্তহীন পৃথিবীর প্রতিষ্ঠার জন্যে, (৩) বিবাহবিহীন বা নির্বিবাহ সমাজের প্রতিষ্ঠার জন্যে, এবং (৪) রোবোটিক কোম্পানী ডাইরেক্টর - নিয়ে গবেষণা করার জন্যে। আমরা যদি পৃথিবীর নাগরিকদের মধ্যে সহানুভূতি প্রতিষ্ঠা ক’রতে পারি তবে পৃথিবী কীভাবে প্রতি নাগরিকের আরও ভালো বাসস্থান আর কর্ম্মস্থল হ’য়ে উঠবে তা দেখানোর জন্য আমরা এই বিষয়গুলিতে কয়েকটি বই লিখেছি।
আবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, উপসংহারটিও আমার কল্পনাপ্রসূত। মূল উপন্যাসের অস্বীকৃতি উপসংহারের জন্য প্রযোজ্য।
*** উপসংহারের ** শেষ ***