বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

অধ্যায় 2

আজ আমি সকাল সকাল স্নান করে মানুর চকে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছি, সঙ্গে রয়েছে আমার প্রিয় সাইকেল। আমি অপেক্ষা করছি নীপা আর পৌলমীর জন্য। গতকাল সন্ধেবেলায় নীপা হঠাৎ ফোন করে বলে আমার শহরের মানুর চকে একজন স্যারের কাছে ও ইউনিভার্সিটির এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কোচিং নিতে আসবে। পৌলমীও ওর সঙ্গে আসতে রাজি হয়েছে। এমনিতে পৌলমীরও রেজাল্ট যা রয়েছে সেও আমার মতই সরাসরি ইউনিভার্সিটিতে সুযোগ পেয়ে যাবে, আমাদের মধ্যে গ্রাজুয়েশন ফাইনালে কলেজে কে প্রথম হবে সেটাই দেখার। তবুও পৌলমী এন্ট্রান্সের কোচিং নেবে। আসলে ওর একটু বাড়ির থেকে দূরে গিয়ে একলা স্বাধীন ভাবে প্রতি ফ্যাসিনেশন রয়েছে। তাছাড়া ও আমার মত গল্পের বই পড়ে না বা সিনেমা দেখে না। এই পড়াশুনা ছাড়া ছুটির সময়গুলো ওর খুব কষ্ট করে কাটে। আমাকে বলেছিল সময় কাটানোর জন্য বাড়িতে ড্রইং ক্লাস শুরু করেছে কিন্তু সেভাবে ছাত্রছাত্রী পাচ্ছে না, যাদের পেয়েছে তাদের কারুর আঁকার হাত ভাল নয় তাই সেদিক থেকেও সন্তুষ্ট হতে পারছে না। গতকাল নীপার কথায় বুঝলাম মূলত সময় কাটাতেই পৌলমী এই কোচিং আসবে বলে ঠিক করেছে। নীপার ফোন রেখে মা বাবাকে বিষয়টা জানালাম। বাবা বলল, "শিক্ষার তো কোনো বিকল্প হয় না, ইচ্ছে হলে যাও ওখানে। নিশ্চয় নতুন কিছু শিখতে পারবে।"

সেইমত এক রাতের সিদ্ধান্তে আমি সকাল সকাল এখানে হাজির হয়েছি। 



          নীপা কোনোদিনও কোনো জায়গাতে সময়ে পৌঁছায় না। আজকেও তাই হল। আমি প্রায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করার পর বাস থেকে হন্তদন্ত হয়ে নামতে দেখলাম নীপা আর পৌলমীকে। নীপার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য সকলের মত দেরী করে আসার পেছনে কোনো অজুহাত দেয় না, সত্যি কথাটাই বলে। আজকেও আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে বলল,


"আর বলিস না, এই গরমে ঠান্ডা জলটা গায়ে পড়তেই বাথরুমে আধঘন্টা কাটিয়ে দিলাম। যাইহোক, শোন না, বলছি..."


নীপা এবার কী বলবে তা আমি ভাল করেই জানতাম, তাই সে মুখ ফুটে বলার আগেই জলের বোতলটা বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। নীপা একটা চওড়া হাসি হেসে বলল, "এই জন্য তোকে এত ভালোবাসি, তুই আমার মনের কথা অবধি বুঝে যাস।"


আমি বললাম, "থাক, প্রশংসা করতে হবে না, এখন তাড়াতাড়ি চল, দেরী হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।"


নীপা ঢকঢক করে প্রায় আধ বোতল জল শেষ করে আমাকে বোতলটা ফেরৎ দিল। মেয়েটার এই এক রোগ, হাজারবার বলেও শুধরাতে পারিনি। যেখানেই যাক যতক্ষণের জন্যই যাক, কিছুতেই জল সঙ্গে নিয়ে বেরোবে না। সব জায়গায় কী চেয়েচিন্তে খাওয়ার মত লোক পাওয়া যায়! বারবার বলেও কোনো লাভ হয়নি। 




             একে তাকে জিজ্ঞেস করে করে অবশেষে সেই স্যারের বাড়িতে পৌঁছালাম। নীপার মুখে শুনলাম এই স্যারের নাকি খুব নাম। ভাল কিছু শেখার আশায় অনেক উৎসাহ নিয়ে পর্দা সরালাম। ভেতরের দৃশ্য দেখে প্রথমেই ধাক্কা লাগল। দেখলাম ছোট একটা অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘর। সেই ঘরের দেওয়ালের তাকে থেকে শুরু করে মেঝেতে অবধি বই, খাতা, নোটস ডাঁই করে রাখা। তার মাঝে একটা উঁচু টুলে সেই স্যার বসে রয়েছেন রাজার মত। আর স্যারের ঘিরে গায়ে গায়ে বসে রয়েছে প্রায় জনা তিরিশেক ছাত্রছাত্রী। আমরা তিনজন করুণ চোখে পরস্পরের দিকে চাইলাম। ভেতরের দৃশ্য দেখে এতটাই ধাক্কা খেয়েছিলাম যে ভেতরে ঢোকার অনুমতি অবধি চাইতে ভুলে গেলাম। আমাদের দেখতে পেয়ে স্যার নিজেই বললেন, "তাড়াতাড়ি ঢুকে বসুন, আমার কাছে আপনাদের অপ্যায়নের জন্য সারাদিন পড়ে নেই।"

বলাই বাহুল্য স্যারের গলাখানা বিশেষ একটা মধুর শোনাল না। আমরা কোনোক্রমে ভেতরে ঢুকে গাদাগাদি করে বসে পড়লাম, পুরো শরীরটা রাখারও জায়গা হল না। আমার তো একটা পা তুলে রাখতে হল অর্ধেক। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, এই অবস্থায় দুই ঘন্টা কাটানোর পর আমি উঠে দাঁড়াতে পারব তো!



              যাইহোক, স্যার বুঝলাম কিছু বলছিলেন। আমরা আসায় বাধা পড়েছিল, আবার শুরু করলেন বলা। মিনিট খানেক শোনার পরেই বুঝলাম স্যার আসলে নিজের স্তুতি গান গাইছেন। আটটা চল্লিশ বাজতে স্যারের নিজের স্তুতির ইতি ঘটল। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম আটটা থেকে পড়া শুরু হয়েছে, আমরা খানিক দেরীতে ঢুকেছি। স্যার এই এতটা সময় এক নাগাড়ে নিজেই নিজের প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন! 

হয়ত তাই হবে। স্তুতিপাঠ শেষ হতে স্যার বললেন, 

"আগের দিন যেটা পড়া দিয়েছিলাম সবাই পড়ে এসেছিস? পরীক্ষা নেব।"

আমরা তিনজন জানালাম আমরা নতুন, তাই পড়া জানতাম না। স্যার আবারও কর্কশ কন্ঠে বললেন যে আমাদের নাকি জেনে আসা উচিৎ ছিল। এই কথার পেছনে আমি কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না, কারণ কার কাছ থেকে জানব, কোথার থেকে জানব! এখানের কাউকেই তো চিনি না। 

স্যার এরপর আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন, রেজাল্টও শুনলেন। তারপর বললেন পরীক্ষাটা দিতে। আমরা মাথা নেড়ে প্রশ্নপত্র নিয়ে পরীক্ষা দিতে বসলাম। আমি দেখলাম বেশ কয়েকটা প্রশ্ন আমার অজানা অর্থাৎ আমি সেই বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি ঠিক করলাম পরীক্ষার শেষে স্যারের কাছ থেকে জেনে নেব বিষয়গুলো। 


       

              পরীক্ষার নির্দিষ্ট সময় শেষ হতেই স্যার জোরে জোরে উত্তর বলতে লাগলেন। আর সেই সঙ্গে সেই নির্দিষ্ট উত্তর যাদের ভুল হয়েছে তাদের হাত তুলতে হচ্ছিল। আমি যে প্রশ্নগুলো পারিনি সেগুলোতে আসতেই আমি হাত তুললাম। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি হেসে বলল, "ভুল হয়েছে!"


আমি মাথা নেড়ে বললাম, "হ্যাঁ স্যার, ঠিক ভুল নয়, আসলে আমি এই বিষয়টা জানি না। একটু বলে দেবেন।" আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জানতে চাইলাম। কোনো অজানা জিনিস জানতে আমি কখনও কুন্ঠাবোধ করি না। কোনো শিক্ষক হোক, সহপাঠী হোক কী বয়সে ছোট কেউ হোক আমি যাকে পাই তাকেই জিজ্ঞাসা করি। আজকেও তাই মনে কোনো দ্বিধা না রেখেই জিজ্ঞাসা করলাম। কিন্তু স্যার আমার জবাব দেওয়ার বদলে বললেন, "এটা তো আমার বলার কথা নয়, এটা তো কলেজে শেখার কথা। তা এই সাধারণ জিনিস না জেনে কী করে এত নম্বর পেলি শুনি! চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ নিশ্চয়।"

শেষ ব্যঙ্গটার অর্থ আমি ধরতে পারলাম না। আমার চোখে চশমা রয়েছে, সেই নিয়ে কী কিছু উপহাস করলেন!

পৌলমী পাশ থেকে ফিসফিস করে আমাকে বলল, "বলতে চাইলেন তুই লোকের দেখে দেখে লিখে পরীক্ষা দিস।"

আমি চমকে উঠলাম। দেখলাম সবাই মুখ টিপে টিপে হাসছে। অপমানে আমার কান লাল হয়ে উঠল। আমি আজ অবধি কোনোদিন পরীক্ষায় কোনো অসৎ উপায় অবলম্বন করিনি আর আজকে একটা জিনিস জানি না বলে আমার সব পরিশ্রম মিথ্যে হয়ে গেল!

স্যার এরপর আবার নিজের বক্তৃতা শুরু করলেন। 'আমার মত ফোকটে নম্বর পাওয়া' স্টুডেন্টদের নিয়ে কথা বলতে বলতে তিনি আচমকা বললেন, "আসলে এদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই শহরে আমি আর দত্ত স্যার ছাড়া আর যোগ্য কে আছে শুনি! সব তো গরু গাধাগুলো কোচিং খুলে বসেছে, তারা আর কী শেখাবে!"

ওই স্যারের এই মন্তব্য শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ কী মুখের ভাষা! একজন শিক্ষক হয়ে কেউ কিভাবে অন্য শিক্ষকদের 'গরু গাধা' বলে সম্বোধন করতে পারে। আমি গ্র্যাজুয়েশন চলাকালীন আমার কলেজের অধ্যাপক বাদে আর তিনজন শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছি। তিনজনেই নামকরা কলেজে অধ্যাপনা করেন। তাঁদের জ্ঞান আমাকে বরাবর বিস্মিত করেছে। আজ আমার রেজাল্টের পেছনেও এই মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে। ভীষণ খারাপ লাগছিল আমার। 




               কী কষ্টে যে দুই ঘন্টা কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম তা আমিই জানি। বাড়ি ফেরার পরেও কিছুতেই বিষয়টা ভুলতে পারছিলাম না। সেই সঙ্গে কেমন একটা অস্বস্তিও হচ্ছিল। যখনই মনে পড়ছিল ওখানে আবার যেতে হবে তখনই একটা খারাপ লাগা এসে ঘিরে ধরছিল আমায়। আমার মা বাবা বারবার টিউশন ধরা ছাড়া একদম পছন্দ করেন না। ওই স্যারের মন্তব্যগুলো ওদের বললেও সাহস করে বলতে পারলাম না যে ওখানে যাব না আর। আমার মনের মধ্যে চলা এই দ্বন্দ্ব ফোনের ওপার থেকেই টের পেল রিশান। তাকে সবটা খুলে বললাম। রিশান সব শুনে বলল, 


"কাকু কাকিমাকে জানা তোর অস্বস্তির কথা। যেখানে গিয়ে তুই সম্মান পাবি না, যে লোকটা অন্য কাউকে সম্মান দিতে পারে না, তার কাছে পড়তে গিয়ে আদৌ কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না। শুধু শুধু সময় আর অর্থ নষ্ট করার দরকার নেই।"


রিশান রীতিমতো কড়া গলায় আমাকে বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলল। রবিবার দিন টিউশনি থাকে কিন্তু শুক্রবার অবধি আমি কিছুই বলে উঠতে পারলাম না। শনিবার সকাল থেকে অনেকবার চেষ্টা করলাম কিন্তু সেইদিন বিভিন্ন কারণে মা বাবার মেজাজ এমনিতেই গরম ছিল তাই বলতে গিয়েও বারবার পিছিয়ে আসতে হচ্ছিল। অবশেষে দুপুরবেলায় ভাত ঘুম সেরে উঠে এক নিঃশ্বাসে বলেই ফেললাম কথাটা। ভাবছিলাম বাবা হয়ত এক্ষুণি বলবে যে একদিনে কি সব বোঝা যায়! কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা বলল, 

"যেতে ইচ্ছে না করলে যেও না। বড় হয়েছ, নিজের ভালমন্দ এবার নিজেকেই বুঝতে হবে।" 

বাবা ভীষণ খোলা মনে কথাটা বলল। মা বলল, "যেখানে গেলে অস্বস্তি করে, ওরকম অপমানজনক কথা শুনতে হয় সেখানে গিয়ে আর যাইহোক পড়া হবে না। একদিন গেছো, ঠিক আছে। আর যেতে হবে না।"

মা মনে হল যেন রিশানের কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করল। আগেও এই জিনিসটা লক্ষ্য করেছি, দুজনের মতামতের এত মিল যেন মা'টা আমার নয় রিশানের বলে মনে হয়। 



              যাইহোক, ওই অস্বস্তিকর জায়গাটা থেকে মুক্তি পেয়েছি ভেবে আমার আনন্দ আর দেখে কে। নীপা, পৌলমী, রিশান সবাইকে মেসেজ করে জানিয়ে দিলাম। কিন্তু তখনও ভাবতে পারিনি ওই লোকটার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া এতোটাও সোজা নয়...

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু