বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

পর্ব ২

পিনাকী, শৈলজা এবং মিস্ দেব মিস্ চামেলী তরফদারের গোপন ঘরে প্রবেশ ক’রে দেখে ঘরটি খালি। কিছু পরে মিঃ তরফদার এসে মনে করে যে এই তিনজন তার মেয়েকে পালিয়ে যেতে সাহায্য ক’রেছে;  তাই এই তিনজনের উপর লেলিয়ে দেবার জন্যে নিয়ে আসে ওর ড্যাশুন্ড কুকুরকে। মিঃ তরফদারের দুর্ভাগ্য যে, কুকুরটি দুর্ঘটনাক্রমে অন্য দিনের তুলনায় বেশি সময় ধরে ক্ষুধার্ত ছিল, তাই মিঃ তরফদারের নির্দ্দেশ না মেনে, মনিব মিঃ তরফদারকেই ও আক্রমণ ক’রেছিল। শৈলজা তার রিভলবার দিয়ে কুকুরটিকে গুলি করে। গুলির আওয়াজ শুনে মিসেস পাকড়াশী ছুটে এলো সেই ঘরে; কুকুর ও মিঃ তরফদারের অবস্থা দেখে প্রথমে কিছুক্ষণ হতভম্ব হ’য়ে দাঁড়ালো; তারপরেই ‘তাড়াতাড়ি এসো এদিকে’ ব’লে দৌড় দিলো মিঃ পাকড়াশীকে ডাকতে।  মিঃ পাকড়াশী কুড়ি মিনিটের মধ্যেই হাজির ক’রলো দুটো অ্যাম্বুল্যান্স ভ্যান – একটা ড্যাশুন্ড কুকুরের জন্যে, অপরটা কুকুরের মনিবের জন্যে। এর পরে, মিস্ দেব মিস্টার ও মিসেস পাকড়াশীর সঙ্গে পিনাকী ও শৈলজার পরিচয় ক’রিয়ে দিল। মিস্ দেব মনোবিজ্ঞানে পি-এইচ-ডি, খুব সহজেই অন্তরঙ্গ হ’য়ে উঠতে পারে; মিস্টার ও মিসেস পাকড়াশী খুব সহজেই অনেক কথা মন খুলে প্রকাশ ক’রলো, যে কথাগুলো এই দুর্ঘটনার আগে ওরা কাউকে বলেনি – এমনকি একে অপরকেও নয়।
মিস্টার পাকড়াশী এদিন সামান্যই মাতাল ছিল, ব’ললো কেন ও এখন রোজ মাতাল হ’য়ে থাকে। মিসেস তরফদারকে ও নিজের ছোটবোনের মতোই ভালবাসতো, ওকে টুলু ব’লে ডাকতো; টুলুর বিয়ের আগে, ছোটবেলায় টুলু আর ও একই পাড়ায় থাকতো, তখন থেকেই টুলু ওকে ‘মন্টুদা’ ব’লে ডাকতো। টুলুর যখন বিয়ে হ’য়েছিল, তখন মিঃ তরফদারের বাবা বেঁচে ছিলেন, তিনি টুলুবৌমাকে খুবই স্নেহ ক’রতেন; হয়তো ছেলের চেয়ে বেশী ভালবাসতেন বৌমাকে; তাই মরার কয়েক বছর আগেই তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি টুলুবৌমার নামে ক’রে দিয়েছিলেন। টুলু মিঃ তরফদারকে ভয় পেতো। টুলু বাড়ীর কাজের লোকের সঙ্গে এতো কথা বলে, সেটা ওনার পছন্দ ছিল না। তারপর, হঠাৎ কদিনের জ্বরে টুলুর মৃত্যু হ’লো। তবে মৃত্যুর আগেই টুলু যাবতীয় সম্পত্তি ওর মেয়ে চামেলীর নামে উইল ক’রে দিয়ে গেছিল। টুলুর মৃত্যুর মাত্র ছ-মাস পরেই মিঃ তরফদার আবার বিয়ে করেন। এখনকার মিসেস তরফদার মিঃ তরফদারের দ্বিতীয় স্ত্রী। এই সময়েই মিসেস তরফদার একটা মারাত্মক কুকুর নিয়ে এলেন; এতে বেড়েছিল চামেলীর আতঙ্ক। ওর প্রয়াত মায়ের উইল অনুযায়ী চামেলীর প্রতি মাসে আর্থিক ভাতা পাওয়ার কথা। মিঃ ও মিসেস তরফদার ওদের প্রথম পক্ষের মেয়েকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত ক’রতে চেয়েছিল; এই জন্যে ওরা চামেলীকে না খাইয়ে রেখে জোর ক’রেছিল একটা সাদা কাগজে সই করার জন্যে। চামেলী সই করেনি; কিন্তু অত্যধিক অসহ্য অত্যাচারের চাপে চামেলী মস্তিষ্কের জ্বরে অসুস্থ হ’য়ে পড়েছিল; এবং তার চুল কাটতে হ’য়েছিল। তবে ওর চুল একটা লকারে রাখা আছে। মিঃ ও মিসেস তরফদার চামেলীকে তার বয়ফ্রেণ্ডের থেকে দূরে রাখার জন্যে এই বাড়ীটির রহস্যে ঘেরা অব্যবহৃত অংশে আটক ক’রে রেখেছিল। পরে চামেলীর ছদ্মবেশ নিয়ে ওদের ছেলে লাল্টুকে পড়ানোর জন্যে জন্য মিস্ দেবকে নিয়োগ করা হ’য়েছিল।
টুলুর শোক ভুলে থাকার জন্যে টুলুর মন্টুদা মদ খাওয়া শুরু ক’রেছিল; খাওয়ার মাত্রা আরও বেড়ে যায় মিঃ তরফদার দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পরে। এর পরে মিঃ তরফদারের তাগিদে বিয়ে করে মিঃ পাকড়াশী; কিন্তু বিয়ের পরে ও আরও একা হ’য়ে যায়। ওর স্ত্রী মিসেস্ পাকড়াশী অর্থাৎ নীতা কোনদিনই টুলুর মতো আপন ক’রে শ্রদ্ধা করেনি ওকে; বরং মনে ক’রেছে ওর স্বামী মন্টু ওর এম.এস.সি পাশ স্ত্রীর তুলনায় নিতান্তই অশিক্ষিত; একমাত্র একটা কারণেই ও মন্টুকে ভালবাসতো, সে কারণ হ’লো - বিরাট ড্যাশুন্ড কুকুরটিকে মন্টু সামলাতে পারতো। কিন্তু মন্টু বিয়ের পরে আরও বেশী মাতাল হ’য়ে থাকতো- প্রথমতঃ টুলুর স্মৃতি ভুলতে, দ্বিতীয়তঃ ও যে বিবাহিত সেকথা ভুলে থাকতে।
এর পরে, মিসেস পাকড়াশী কথা শুরু ক’রলো, ‘মন্টুকে এতদিন আমি মাতাল ছাড়া আর কিছু ভাবিনি। আজ প্রথম জানলুম যে আগের মিসেস তরফদারের নাম ছিল টুলু, যে মন্টুকে দাদার মতো শ্রদ্ধা ক’রতো। আমি সন্দেহ ক’রতাম, আগের মিসেস তরফদারের সঙ্গে মন্টুর অন্য সম্পর্ক ছিল আর সেই কারণেই ওঁকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হ’য়েছিল। পাছে ও আবার নতুন মিসেস তরফদারের সঙ্গে আবার ওরকম কিছু করে, সেই ভয়ে মিঃ তরফদার আমাকে এ বাড়ীতে নিয়ে এসেছেন মন্টুর বৌ ক’রে। যেহেতু আমি উচ্চ-শিক্ষিতা, ব্যবসার কাজে হিসেব রাখতে পারবো, চামেলীকে পড়াতে পারবো, পরে নতুন মিসেস তরফদারের যখন ছেলে হ’লো, ভেবেছিলাম তখন তাকে মানুষ ক’রে তোলার দায়িত্বও আমারই থাকবে। …. আমার নাম ‘নীতা’ – অনেকটা ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমার নীতার মতোই মা, বাবা, ভাইবোনেদের জন্যে আত্মদান ক’রে এসেছি আমি। বাবা গাড়ীর ধাক্কায়, পা ভেঙ্গে পঙ্গু হওয়ার পরে সংসার চালানোর ভার নিতে হয়েছে আমাকে। দাদা সঙ্গীত নিয়ে সাধনা ক’রেছে অনেক, কিন্তু রোজগার ক’রতে পারেনি। আমি আমার পরের দুই ভাই আর দুই বোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় ক’রেছি; দুই বোনের বিয়ে দিয়েছি; ছোট দুই ভাই কাজ শুরু করার পরে আমার গলায় যন্ত্রণার জন্যে ডাক্তার দেখাই; অপারেশনের পরে বায়োপ্সিতে জানা গেছিল, কিছু ক্যান্সারের টিস্যু রয়ে গেছে, ক্যান্সার লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞেরা বলেছিলেন যে ক্যান্সার খুব বেশি ছড়িয়ে পড়েনি; এখনও দিল্লীর অল ইন্ডিয়া মেডিকেল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটে রেডিও-অ্যাক্টিভ আয়োডিন (RAI) থেরাপির চিকিত্সা দিয়ে নিরাময় করা সম্ভব। দিল্লীর অল ইন্ডিয়া মেডিকেল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট থেকে নির্দ্ধারিত হ’লো রেডিও-অ্যাক্টিভ আয়োডিন (RAI) থেরাপির চিকিত্সার দিন। এক সপ্তাহের থেরাপিতে সেরে উঠলাম। এই সময়েই আমার মনে হ’লো, আমিও বাকী ভাইবোনেদের মতো বাঁচতে চাই, বিয়ে ক’রে সংসার ক’রতে চাই। কিন্তু এই বয়সে কে আমাকে বিয়ে ক’রবে; আমার বয়সী পুরুষদের অনেক আগেই বিয়ে হ’য়ে গিয়েছে। এই সময়ে আমার কনিষ্ঠতম ভাই চঞ্চল ওর বান্ধবী চামেলীর কছে জানতে পারে এ বাড়ীতে এক বয়স্ক পাত্র মন্টু পাকড়াশীর জন্যে একটু বয়স্কা পাত্রীর খোঁজ চলছে। এর পরে আার বিয়ে হ’তে দেরী হয়নি। এইমাত্র আমি চঞ্চলকে জানিয়েছি মিঃ তরফদারের হাসপাতালে যাওয়ার কথা; ও চামেলীকে জানানোর চেষ্টা ক’রবে।‘
এর মধ্যে কখন মিসেস তরফদার এসে ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়েছে, কেউই বুঝতে পারেনি, ও এ-পর্য্যন্ত কতটা কথা শুনেছে বোঝা যায়নি, এবার সুযোগ পেয়ে ব’ললো, ‘আমি মিসেস সোমা তরফদার। বলুন কে কে আমার সঙ্গে আসবে? আমি এবারে দুই হাসপাতালে যেতে চাই। এক হাসপাতালে আমার স্বামী তিমির, যার জন্যে আমার এ-বাড়ীতে আসা, গত সাত বছর ধ’রে এখানে ঘর করা। আর এক হাসপাতালে আমার প্রিয় কুকুর ড্যাশুন্ড, গত দশ বছর ধরে যে আমার খেলার সঙ্গী, যাকে আমি বিয়ের পরেই নিয়ে এসেছি এখানে।‘
অগত্যা পিনাকী, শৈলজা আর প্রণতি মিসেস সোমা তরফদারের সঙ্গে হাজির হ’লো মিঃ তরফদারের হাসপাতালে।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু