বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

পর্ব - ১

বিছানায় শুয়ে ছিল সমরেশ। গায়ে একটা চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা। মাথার ওপর পাখাটা খুব স্লথ গতিতে যেন নিজের অভ্যাস বশেই ঘুরে চলেছে। ভেজান দরজা খুলে ‘বাবা বাবা’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ঢুকল শাওন।

-ও বাবা সাড়া দিচ্ছ না কেন? কী যে সব সময় তোমার ঘুম তা বুঝি না বাপু।

চাদরের ভেতর থেকেই সমরেশ উত্তর দিল, ডাইনিং টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া আছে শাওন। খেয়ে নে।

উত্তর দেবার অবস্থায় সে তখন নেই। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। অসম্ভব দুর্বল। কথাই বলতে পারছে না তো উঠবে কী করে। চাদর খুলে মুখ বাড়ালেও ঠাণ্ডা হাওয়াটায় শরীর যেন ছ্যাঁত করে উঠছে।

-ও আমি শুভর বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।

কষ্ট সত্ত্বেও মুখের চাপা খুলল সমরেশ। খুব দুর্বল ভাবে বলল, আচ্ছা। তোর জন্যে আমি মুগের ডাল করেছিলুম মা। তুই ভালবাসিস তাই-

কথাটা শেষ করতে না দিয়েই শাওন বলে উঠল, শুভর মা অনেক করে বলল। আর তুমিও তো অসুস্থ। আমি কাল থেকে শুভদের বাড়িতেই খেয়ে আসব বাবা। ওর মা আমাকে খুব ভালবাসে। বলে বাবা যখন বিছানায় পড়ে তখন আর তাকে শুধু শুধু কষ্ট দেওয়া কেন? বাবা তুমি কাল থেকে একার জন্যেই রান্না কর। আমার জন্যে আর শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না।

সমরেশের বুকের ভেতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠল। বলল, নিজের বাড়ি থাকতে তুই অন্যের বাড়িতে খাবি?

মুখের মধ্যে একটা শ্লেষের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল শাওনের। সেটা অবশ্য দেখতে পেল না সমরেশ। সে আবার মুখে ঢাকা দিয়ে দিয়েছিল। দেখতে পেলে দুঃখের বোঝা আরও বাড়ত। কিন্তু চাদর ঢাকা থাকলেও কানে শব্দের পৌঁছতে বাধা নেই।

শাওন বলল, কে নিজের আর কে যে পর সময়ই তা বলে দেয় বাবা। আর মা যখন নেই তখন আর এ সংসারে আমার বলতে কে আছে বল? মা আমার জন্যে কত ভাবত। সে আমার কত আপন ছিল।

চুপ করে রইল সমরেশ। কারণ প্রশ্নটা তার খুব জটিল মনে হল। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নিজেকে বড় একা মনে হতে লাগল। লাবণী চলে গিয়ে তার মতই একা হয়ে গেছে মেয়েটাও। তাই হয়ত বলে ফেলেছে শাওন। এটা কি তার মনের কথা হতে পারে? মানুষ অভিমান বশে অনেক কথা বলে সব কি ধরতে আছে? হয়ত বাবার ওপর তার অভিমান জমেছে। জমতেই পারে। অভিমান তারই করা সাজে যে ভালবাসে। তার মানে শাওন তাকে খুব ভালবাসে। জ্বরের এত কষ্টের মধ্যেও এই ভাবনাটা তার বেশ ভাল লাগল।

একটা মাত্র মানুষ। কিন্তু সে যখন চলে যায় তখন সে নিজেও হয়ত ভাবতে পারে না তার অভাবে গোটা সংসারটা কেমন থাকবে। লাবণীর অভাবে আজ সংসারটাও তাই হয়েছে ছন্নছাড়া। শাওনের তবু বন্ধু-বান্ধব আছে। কিন্তু তার তো কেউ নেই বলতে গেলে। কিছু নেই তার। একমাত্র সম্বল আছে যে মেয়েটা সেও যদি এমন কথা বলে তবে নিজেকে বড় অসহায় লাগে। তার নিজের কর্তব্যবোধে নিজেরই সন্দেহ লাগে।

তাই রান্না নিয়ে থাকে। একটা তো কিছু করতেই হয়। নিজের ক্ষতবিক্ষত মনটাকে ব্যস্ত রাখতে হয় কিছু সময়ের জন্যে। নাহলে সে যে প্রতি নিয়ত কুরে কুরে খাবে তার মনটাকে। অপরাধবোধ আর আত্মগ্লানি তাকে দগ্ধে মারবে।

রান্না ভালই লাগে। ধরতে গেলে রান্নাই তা্কে সঙ্গ দেয় এখন। নিজের খাওয়া নিয়ে ভাবে না সমরেশ। সে জানে তার খাওয়ার মূল অর্থ এখন এসে দাঁড়িয়েছে জীবন ধারণ। আর এই জীবন ধারণ তার মেয়েটার জন্যেই। মেয়েটাকে বড় করে বিয়ে দিতে পারলে সে আপাতত চিন্তামুক্ত হয়। মেয়েদের এই ‘বিয়ে’ জিনিসটাকে যেমন সে খুব গতানুগতিক দেখে না তেমনি দেখে না এতে মেয়েদের একটা হিল্লে হয়ে গেল গোছের। আসলে যৌবন প্রাপ্তিতে ছেলে বা মেয়ের বিয়ে হলে যেন মনে হয় তার জীবনে একটা পূর্ণতা এল। বিয়ে যে সর্বদাই মানুষের জীবনে সুখের পসরা নিয়ে আসে তা নয়। কিন্তু আসার সম্ভাবনা নিয়েই তো মানুষ বাঁচে।

তাই নিজের খাওয়া নিয়ে সে চিন্তা করে না। কিন্তু চিন্তা মেয়েটাকে নিয়ে। সে জানে মেয়েটা কী খেতে ভালবাসে। তাই সেই সব রান্না করে রেখে দেয়। যত্ন আর ভালবাসার সঙ্গে। নিজের শরীরের সব কষ্ট সে ভুলে যায়। সর্বদা মনে পড়ে মেয়ের হাসিমাখা মুখটা।

মেয়ে এসে খেলে বড় ভাল লাগে। মেয়ের চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ তার মনেও ছাপ ফেলে দেয় গভীর তৃপ্তির। আরও ভাল লাগে যদি সে খেতে বলে, আজ ফুলকপিটা দারুন করেছ তো বাবা। কিংবা, আজ চিকেনটা তো দারুন করেছ বাবা। আমি বন্ধুদের ডেকে একদিন খাওয়াব তোমার হাতের রান্না। তুমি কী সুন্দর রান্না কর বাবা। মেয়েদের পর্যন্ত হারিয়ে দেবে তুমি।

ইদানিং অবশ্য আর বলে না। হয়ত বলার সুযোগ পায় না। মোবাইল খুলে খেতে বসে। বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করতে করতে রান্নার স্বাদের ব্যাপারে তার কোনও আগ্রহ থাকে কিনা ঠিক বোঝা যায় না। আর বোঝা যায় না বাবার বা বাবার রান্নার ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে কিনা। ডান হাত খেতে আর বাঁ হাত চ্যটে ব্যস্ত থাকে। মনটাও হয়ত খাওয়ায় নয়, ব্যস্ত থাকে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতায়।

মায়ের কথা উঠতে বেশ কিছুক্ষণ আর কোনও কথা বলতে পারে না সমরেশ। এই একটা অত্যন্ত দুর্বলতার স্থান তার কাছে। শাওন বলে, যাক গে যা বলতে এসেছিলুম বাবা। দেখ একটা দরকারী কথা-

-আজ আমি খুব অসুস্থ মা। জ্বরটাও বেশ বেড়েছে। যন্ত্রণায় মাথাটা ফেটে যাচ্ছে।

সত্যিই তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। ঘরে কোথাও কিছু একফোঁটা শব্দ তার বিরক্তি ধরিয়ে দিচ্ছে। এমন কি খুব মৃদু গতিতে ঘোরা পাখার ব্লেডের পিন পিন শব্দটা পর্যন্ত। শরীরের আপাদমস্তক ঢাকনাটার মতই একটা নিস্তন্ধতার আবরণ চাইছে সে।

-কথাটা বলতে আ্মারও বুক ফেটে যাচ্ছে বাবা। কিন্তু কী করব বল? তুমি পাষাণ বলে তো আর আমি তা হতে পারি না।

ধাক্কাটাতেও সমরেশ তবু চুপ করে রইল। মনের মধ্যে একটা কান্না তার গলা রুদ্ধ করে দিয়েছে। বাবার এই অবস্থা তো নিজে চোখেই দেখল শাওন। আবার মুখ ফুটে বলতেও হল সমরেশকে। তবু বিশ্বাস করল না মেয়েটা? ভাল না বাসার দুঃখ তবু সহা যায়। কিন্তু অবিশ্বাসের আঘাত কাঁটার মত বিঁধতে থাকে বহুক্ষণ ধরে।

কিন্তু শাওনের হঠাৎ এই পরিবর্তিত আচরণ তাকে বিস্মিত করল। এমন রূঢ় তো আগে সে ছিল না? কিছুদিন ধরে তার ব্যবহারে একটা পরিবর্তন আসছিল বটে তবে সমরেশ ভেবেছিল এটা সাময়িক আর বাইরে কোথাও থেকে এটা এসেছে। ভেবেছিল তার এই অভিমানের কারণ সে অনুসন্ধান করবে আর দূর করার চেষ্টা করবে সেটা। কিন্তু তার আগেই সে এমন অসুস্থ হয়ে পড়ল।

-আমি আর এখানে থাকতে পারব না বাবা। তোমার সঙ্গে আমার আর একসঙ্গে থাকাটাও ঠিক হবে না বলেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিয়েছি। অনুমতিটতি চাইছি না কিন্তু। আমি এডাল্ট। তোমার অনুমতির অপেক্ষা রাখি না। শুধুমাত্র সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিলুম। কারণ এটা তোমার জানা দরকার।

সমরেশের কানে তখন কিছু ঢোকার কথা নয়। তবু সেটুকু ঢুকল তাতে সে তার অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছিল মনে মনে। কিন্তু সে যে কোনদিক থেকে কীভাবে আর কখন মেয়েকে আঘাত করেছে সেটা বিন্দুমাত্র বুঝে উঠতে পারল না।

তার দিক থেকে কোনও উত্তর এল না। উত্তরের অপেক্ষা শাওনও করল না। সবেগে বেরিয়ে গেল সে। গতিটা ঝড়ের বেগে বলা চলে কারণ দরজা বন্ধ করার শব্দটা এল বেশ ‘ধড়াম’ করে।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু