বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

চলন্ত হোটেলে সাত রাত্তির

হিমাংশু বেহুলাকে ব’লেছিল, ’ধরো ছুটি কাটাতে আমরা একটা হোটেলে গিয়ে উঠবো; আর রাতে যখন আমরা ঘুমোব, তখন হোটেলটাই যাবে এক শহর থেকে অন্য শহরে; তার পরের রাতে অন্য আর একটা শহরে। প্রতিদিন নতুন শহরে গিয়ে দেখবো ঘুরে ঘুরে। এইভাবে সাত রাত কাটিয়ে, হোটেল পৌঁছাবে সেই শহরে– যেখানে শেষ হবে আমাদের ট্যুর। এই চলমান হোটেলটা হ’লো ট্রেণ- প্যালেস অন হুইলস্।‘
৫/১০/২০২২:
 ‘প্যালেস অন হুইলস'- ট্রেনে ওঠার পরে, বেহুলা ওর মেয়েকে স্কাইপ ক’রে দেখালো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নিঃশব্দ প্রাসাদের মতো ট্রেন, কামরায় দুটি বেড আর অনসুইট। ট্রেনটিতে প্রাচীন জাঁকজমক, তবুও আরামদায়ক। প্রতিটি কোচে আছে একটি লাউঞ্জ যেখানে যাত্রীরা বসতে পারে ব্রেকফাস্ট আর গল্প করার জন্যে।  
সফদারজং থেকে ছাড়বে ট্রেনটি হপ্তাভর বেড়ানোর জন্যে; যাত্রা শুরুর আগে, সবাইকে ডাকা হ’লো একটি বারে। এখানে বেহুলা ও হিমাংশুর সঙ্গে পরিচয় হ’লো রাশিয়া, স্পেন, ব্রেজিল, ইউ-এস-এ, ফ্রান্স, ও কানাডার সহযাত্রীদের সাথে; আর ছিল লম্বা একা মানুষ- নেদারল্যান্ডের কার্স্টেন। এক ইস্রায়েলী যাত্রী আলাপ ক’রতে উৎসুক; হিমাংশু বুঝতে পারছিল- ও স্কুলের বন্ধু শৈবাল; কিন্তু এখানে হিমাংশু অন্য মানুষ- শ্রীলঙ্কা-বাসী লখিন্দরের ভূমিকায়, তাই হিমাংশু ওর শৈশব স্মৃতি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা ক’রছিল এবং বিনীতভাবে শৈবালের সঙ্গে কথোপকথন এড়িয়ে গেছিলো।
ট্রেনটি চলতে শুরু করার আগে ট্রেনের ক্যাপ্টেন যাত্রীদের ব’লেছিলেন ’রকিং-ইন-ট্রেন গুড নাইট’ আর দিয়েছিলেন জয়পুরে একটি ব্যস্ত দিনের প্রত্যাশা।
হিমাংশু ভাবলো, আগামী কয়েকদিনে, বিভিন্ন দেশের সহযাত্রীদের সাথে ওর জীবন-দর্শন নিয়ে আলোচনা ক’রবে; ব’ললো,-
‘পৃথিবী, আমরা তোমার সন্তান,

না চাহিতে তুমি ক’রিয়াছ দান –

আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,

সীমারেখাহীন দেশ, কাল, স্থান,

সাদর আমন্ত্রণ, অবাধ অভিযান।

ঘুচে যাক দেশ-বিদেশের সীমারেখা, ব্যবধান;

লুপ্ত হোক ভিসার আইন – তোমার অপমান।’

 
৬/১০/২০২২:
সকাল ৩-৪৫শে ট্রেনটি জয়পুরে পৌঁছেছিল; অধিকাংশ যাত্রীই গভীর ঘুমে নিমগ্ন, ঘুমের মধ্যে ট্রেন যে অন্য শহরে এসেছে, বুঝতে পারেনি তারা। ব্রেকফাস্ট হ’লো সকাল সাড়ে সাতটায়।
সব যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হ’লো জয়পুর সফরের কোচে, তবে তার আগে হ’লো জয়পুর স্টেশনের অভ্যর্থনা:  রাজস্থানী পোশাকপরা মেয়েরা যাত্রীদের মালা পরালো; বিরাট ঢোলের বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, ফুলের গয়নায় সাজানো হাতীরা আবাহন জানালো যাত্রীদের। রাজস্থানের দৃশ্য, সঙ্গীতের ধুন আর ব্যঞ্জনের স্বাদ উপভোগ করার জন্যে যাত্রীরা উঠলো তাদের কোচে।
১৮৫৩ সালে যুবরাজ অ্যালবার্টের সফরের সময়ে, জয়পুর শহরটিকে গোলাপী রঙে সাজানো হ’য়েছিল, তখন সাংবাদিক স্ট্যানলি রিড জয়পুরের নাম দিয়েছিলেন গোলাপী শহর বা পিঙ্ক সিটি।
হিমাংশুরা দেখলো- হাওয়া মহল,  নিখুঁতভাবে বজায় রাখা স্থাপত্যশিল্পের এক যাদুঘর। ওরা দেখলো- যন্তর মন্তর পর্যবেক্ষণিকা বা মানমন্দির, অ্যালবার্ট যাদুঘর, অ্যাম্বার ফোর্ট এবং সুন্দর শীশ মহল।
জয়পুরে গয়না, রত্নশিলা বা পাথর, টাই-অ্যান্ড-ডাই বাঁধনী শাড়ী-জামা, চামড়ার মোজারির জুতো ইত্যাদি কিনতে পারা যায়।
 

৭/১০/২০২২:  
ট্রেনটি সকাল ৫-৩০টায় রাজকীয় বাঘের জন্যে বিখ্যাত সোয়াই মাধোপুরে পৌঁছেছিল।
রণথম্ভর দুর্গটি শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। আরাভালি এবং বিন্ধ্যাচল পর্বতের সংযোগস্থলে, ৩৯২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, রণথম্ভর জাতীয় উদ্যানের আর একটি নাম- টাইগার রিজার্ভ।
বেড-টী নেবার পরে, হিমাংশুরা গায়ে চড়ালো শীতবস্ত্রের কয়েকটি আস্তরণ, স্কার্ফ, গ্লাভস আর টুপি। সকাল ছটায় খোলা জিপে চড়ে, ওরা পার্কের দিকে রওনা হ’লো। পুরো কম্বল দিয়ে মোড়া শরীর; তবু বাতাসের ঠাণ্ডা যেন হাড়ে বিঁধছে। তবুও, খোলা জায়গায় বাঘ দেখার আশায় কেউ হিমশীতল আবহাওয়াকে ভয় করেনি। কিন্তু, কোন বাঘ নজরে আসেনি। দেখা গিয়েছিল কিছু বাঘের পায়ের ছাপ। হঠাৎ চোখে পড়লো- দুটি বাঘের বাচ্চা গাছে দুলছে, ওরা ফোনে ভিডিও তুলে নিলো। এছাড়া ওরা নানান্ পাখি, হরিণ, ময়ূর এমনকি কুমীরও দেখেছিল, তবে কোনও বড় বাঘ দেখতে পায়নি।
সকাল ৯টায় ট্রেনে ফিরে ওরা গেলো ডাইনিং কারে প্রাতঃরাশের উদ্দেশ্যে। শীগ্গিরই ট্রেনটি চিতোরগড়ের দিকে যাত্রা শুরু ক’রলো; ওরা জানালা থেকে বাইরের দৃশ্য উপভোগ ক’রলো। বিকেল চারটায় চিতোরগড় পৌঁছে, দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে ওরা একটি কোচে চড়লো।
চিতোরগড়ের দূর্দ্ধর্ষ দুর্গ এখন অনেকটাই বিধ্বস্ত; তবুও বহু বীরত্ব এবং রোম্যান্সের স্মৃতি আঁকা আছে এর দেওয়ালে আর চাতালে। মূর্তি এবং চিত্রের মাধ্যমে, হিমাংশুরা দেখেছিল রাজপুত যোদ্ধা ও সাহসী রানীদের বীরত্বের নিদর্শন।
সন্ধ্যা সাতটায় তারা ট্রেনে ফিরে এসে ডিনার ক’রলো; হিমাংশু কার্স্টেনের সাথে ওর লেখা নিয়ে আলোচনা ক’রেছিল; পৃথিবীর সব দেশ এবং পরিবারের মধ্যে সমস্ত সীমানা অপসারণ করার জন্যে অহিংস আন্দোলনের প্রেরণা দেবে হিমাংশুর বই।
 
৮/১০/২০২২:
ট্রেনটি উদয়পুরে পৌঁছেছিল সকাল আটটায়।
পিচোলা লেকের প্যালেস হোটেলের জন্য উদয়পুর বিখ্যাত। কৃত্রিম স্বাদু জলের এই হ্রদটি নির্মিত হ’য়েছিল ১৩৬২ সালে; গ্রাম পিচোলির নামে এই হ্রদের নামকরণ। জেমস্ বন্ডের মুভি ’অক্টোপাসি’র শুটিং হ’য়েছিল এখানে।
উদয়পুর শান্ত ছবির মতো নিখুঁত; বহু শতাব্দীর প্রাচীন শহরের পটভূমিতে রয়েছে সিটি প্যালেস আর জগদীশ মন্দির, যা অতটা পুরোনো নয়। প্রাসাদটি মোর চৌকের জন্য বিখ্যাত, ময়ূরগুলি সবুজ এবং নীল কাচের অলঙ্করণে সজ্জিত। তবে, জগ-নিবাস বা লেক-প্যালেসও উদয়পুরের অলঙ্কার।
পিচোলা হ্রদের একটি পুরো দ্বীপ জুড়ে তৈরী লেক প্যালেস। প্রাসাদের অনেকটাই রূপান্তরিত হ’য়েছে এক বিলাসবহুল হোটেলে। একে প্রায়ই ’প্রাচ্যের ভেনিস’ বলা হয়; ’লেক সিটি’ নামেও শহরটিকে ডাকা হয়।
প্রাসাদের অভ্যন্তরে যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হ’য়েছিল- অসামান্য ভাবে সাজানো, সুস্বাদু ভোজে পরিপূর্ণ একটি পাঁচ-তারকা রেস্তোঁরায়। মধ্যাহ্নভোজের পরে যাত্রীদের প্রাসাদের উঠোনে এম্পোরিয়াম থেকে কেনাকাটা করার জন্য আহ্বান জানানো হ’য়েছিল। তারপরে যাত্রীরা পিচোলার লেকের পটভূমিতে স্নিগ্ধ-সুন্দর লেক প্যালেসকে আরও ভালো ক’রে দেখার জন্য নৌকায় চড়ে লেকে ঘুরলো।
ট্রেনে ফিরে আসার পরে, যাত্রীরা ট্রেনের পান-ঘরে আনন্দ উদযাপনের জন্য জড়ো হ’য়েছিল। প্রত্যেককেই সম্ভ্রান্ত ভারতীয় পোশাক পরতে দেওয়া হ’য়েছিল এবং সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিতে বলা হ’য়েছিল। মিঃ পিচোলা, মিস্ পিচোলা এবং পিচোলা দম্পতি নির্বাচনের জন্য গোপন ব্যালট দেওয়া হ’য়েছিল প্রত্যেক যাত্রীকে। পিচোলা দম্পতির পুরস্কার জিতেছিল হিমাংশু আর বেহুলা; সুদর্শন ব্যাচেলর হিসেবে মিঃ পিচোলা নির্ব্বাচিত হ’য়েছিল কার্স্টেন;  এবং একজন ইতালিয়ান মহিলা বিয়াঙ্কাকে মিস পিচোলা হিসেবে ভূষিত করা হ’য়েছিল।
 
 

৯/১০/২০২২:
ট্রেনটি জয়সালমীর পৌঁছেছিল সকাল ৯টায়।
‘গোল্ডেন সিটি’, জয়সালমীর হলুদ বেলেপাথরের এক শৈলশিরার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। মুকুটের মতো একটা দুর্গ জয়সালমীর শহরের মাথায়, এছাড়া  রয়েছে রাজপ্রাসাদ এবং বেশ কয়েকটি অলঙ্কৃত জৈন মন্দির। এছাড়া  অনেক বাড়িঘর এবং মন্দির সূক্ষ্ম ভাস্কর্যের নিদর্শন। এখানের বাড়ীগুলো শহরের পারিপার্শিককে হলুদ-সোনার রঙে রঙীন ক’রে রেখেছে। বিরট ভারতীয় মরুভূমি থরের প্রাণকেন্দ্রে এটি অবস্থিত। বহু পর্যটক জয়সালমীর ভ্রমণে উৎসুক; কারণ সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ’সোনার কেল্লা’-র শুটিং হ’য়েছিল এখানেই।
কোচে চড়ে হিমাংশুরা জয়সালমীর ঘুরে দেখেছিল; হস্তশিল্পের দোকানগুলিতে ভরা সরু গলিগুলির মধ্যে দিয়ে পৌঁছেছিল জৈন মন্দিরে, তারপরে গাদিসর হ্রদ দেখে ওরা কেল্লার ভিতরে গিয়েছিল।
জয়সালমীর দুর্গ বিশ্বের বৃহত্তম দুর্গগুলির মধ্যে একটি। ১১৫৬ খ্রীস্টাব্দে রাও জয়সাল এটির নির্ম্মাণ ক’রেছিলেন। বহু যুদ্ধের দ্রষ্টা, এই দুর্গটি ত্রিকুটা পাহাড়ের উপরে বিশাল থর মরুভূমির সোনালী প্রান্তে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। এর বিশাল হলুদ বেলেপাথরের দেয়ালগুলির রঙ দিনের বেলায় সিংহের চামড়ার মতো হালকা হলুদ, সূর্য অস্ত গেলে এই রঙ সোনালী মধুর মতো মিশে যায় হলুদ মরুভূমির প্রান্তরে; দুর্গটি ’সোনার কেল্লা’ নামেও পরিচিত।
মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য যাত্রীরা ট্রেনে ফিরে এলো। তারপরে বেহুলা, হিমাংশু আর কয়েকজন যাত্রী অটোরিকশা চড়ে গেলো এখানে তৈরী গয়না কিনতে। মানুষ, গরু, কুকুর আর ছাগলের ভিড়ের পাশ কাটিয়ে, সরু রাস্তা দিয়ে অটোরিকশাটি ভীষণ জোরে দৌড়োচ্ছিল। সেখান থেকে ট্রেনে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তারা চড়লো উটের পিঠে, বালির টিলাতে গিয়ে সূর্য্যাস্ত দেখার জন্য। উটের পিঠে চড়ে যাওয়া খুব আরামের নয়; তবু এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
উট থেকে নামার পরে, ষাত্রীরা চা, কফি আর স্থানীয় বিনোদনের জন্য ক্যাম্পে জমায়েত হ’লো। প্যালেস অন হুইলস থেকে নয় এমন অনেক পর্যটক এখানে রাত্রে থাকে; এখানে আসার জন্য গাড়ী ভাড়া পাওয়া যায়।
হিমাংশুরা ট্রেনে ফিরে এসেছিল, পোশাক বদল ক’রে গিয়েছিল প্রাসাদ প্রাঙ্গণের রেস্তোঁরাতে- আনুষ্ঠানিক নৈশভোজ ক’রতে। নৈশ ভোজের মুক্ত অঙ্গনে পরিবেশিত হ’য়েছিল স্থানীয় লোকনৃত্য, গান এবং বিখ্যাত পুতুল নাচ। বেহুলা ও হিমাংশু নাচে যোগ দিয়েছিল। চারজনের টেবিলে বসেছিল বেহুলা, হিমাংশু, শৈবাল এবং ইটালিয়ান মহিলা বিয়াঙ্কা।  বিয়াঙ্কা শৈবালের মন পাবার জন্য খুবই চেষ্টা ক’রছিল; ও এই সফরের পরে দিল্লিতে একটা তারিখ চেয়েছিল শৈবালের কাছে; শৈবাল আগ্রহ দেখায়নি।
শৈবাল ব’লেছিল, ’চারটে ডিভোর্সের পরে এখন আমি আমার পঞ্চম স্ত্রীর সাথে অবিচল। নতুন উদ্যোগের কোনো দরকার নেই।’
বিয়াঙ্কা ব’লেছিল, ’আমি কেবল একবারই বিবাহবিচ্ছেদ ক’রেছি। এখন আমি এমন একজনকে খুঁজছি যাকে আর ডিভোর্স ক’রতে হবে না।’
বিয়াঙ্কা বেহুলা-কিরীটদেরও কয়েকটি জটিল প্রশ্ন জিজ্ঞেস ক’রেছিল; মন্তব্য ক’রেছিল যে বেহুলা ও হিমাংশু পরস্পরকে খুব ভালভাবে চেনে; একে অপরের জন্য তৈরি হ’য়েছে।
শৈবাল হিমাংশুকে ব’ললো, ’আমার একজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, যার মুখের আদল এবং কণ্ঠস্বর ঠিক তোমার মতো; তবে সে ছিল বাঙ্গালী, এবং তাঁর স্ত্রীও ছিলেন কলকাতা থেকে।’
লখিন্দর-রূপে পরিচিত সিংহলী ভদ্রলোক হিমাংশু হেসে ব’ললো, ’আমিও তোমার বন্ধু হ’তে চাই। আমরা শীগ্গিরই ইস্রায়েল বেড়াতে যাবো। তুমি ইস্রায়েলে কেন? মনে হয়, তোমার জন্ম কলকাতায়।’
শৈবাল ব’লেছিল, ’আমি সাউন্ড অফ মিউজিকের শহর সাল্জবার্গে অনেক দিন কাজ ক’রেছি। সেখানে আমি একজন ইস্রায়েলি মহিলাকে বিয়ে ক’রেছি; অবসর নেবার পরে আমি কলকাতায় ফিরে যেতে চাই; তবে আমার স্ত্রীর ইচ্ছাতেই ইস্রায়েলে র’য়ে গেছি।‘
তারা সকলেই ১১টার সময় ট্রেনে ফিরে. বিছানায় শুয়ে পড়ে।  রাত্রি ১১:৪৫-এ ট্রেনটি যোধপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু ক’রলো।
 
১০/১০/২০২২:
ট্রেনটি সকাল সাতটায় যোধপুরে পৌঁছালো।
যোধপুরের প্রাসাদ, দুর্গ এবং মন্দিরগুলি থর মরুভূমির অনমনীয় প্রাকৃতিক দৃশ্যে নির্মিত। বর্ষব্যাপী রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ার জন্যে শহরটি ’সান সিটি’ নামে পরিচিত। মেহেরানগড় দুর্গের চারপাশে চকচকে নীল রঙের বাড়ীগুলির জন্য যোধপুরের অন্য নাম ’ব্লু সিটি’। দুর্গের সীমানার মধ্যে যাদুঘর; কাঠ এবং আইভরির শিল্পদ্রব্য ছাড়াও কমপক্ষে ১৫০ ধরণের কামান রয়েছে।
‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস্’ চলচ্চিত্রটির আংশিক শুটিং হ’য়েছে মেহেরানগড় দুর্গের আশেপাশে। কয়েকটি দৃশ্যে ব্রুস ওয়েনকে কারাবন্দী দেখানো হ’য়েছিল জেলের একটি কূপের কাছে। ওয়েন যখন কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়, মেহেরানগড় দুর্গের এক ঝলক দেখানো হ’য়েছিল পটভূমিতে।
এখানে যশবন্ত সিংয়ের সাদা মার্বেলের স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ ক’রেছিলেন সরদার সিং ১৮৯৯ সালে। সম্পূর্ণ সৌধটি কয়েকটি খোদাইকরা পাথরের প্লেট দিয়ে গড়া। এখানেই আছে কয়েকটি অসাধারণ খোদাই করা গাজিবো, একটি বহু স্তরের সুন্দর বাগান আর একটি ছোট হ্রদ।

উমাইদ-ভবন বিশ্বের বৃহত্তম ব্যক্তিগত আবাসস্থলগুলির মধ্যে একটি। প্রাসাদের বর্তমান মালিকদের পিতামহ মহারাজা উমাইদ সিংহের নামে এই স্মৃতিসৌধটির নাম। এই প্রাসাদে ৩৪৭টি কক্ষ রয়েছে।
আরও একটি পাঁচ-তারা প্রাসাদ হোটেল/রেস্তোঁরায় মধ্যাহ্নভোজনের পরে, বেহুলা এবং হিমাংশু তাদের দলের অন্যান্য যাত্রীদের না জানিয়ে, একচেটিয়া শপিংয়ে বেড়াতে গিয়েছিল। এক ঘন্টা ঘুরে, তারা ট্রেনে ফিরে এল। বেলা তিনটায় ট্রেনটি আগ্রার দিকে যাত্রা ক’রলো, বেহুলা বিছানায় বসে গ্রামগুলির দৃশ্যগুলি দেখছিল, আর হিমাংশু তার ল্যাপটপে ব্যস্ত ছিল, তার বই লেখার জন্য, আর মোবাইল ফোন থেকে ফটো ডাউনলোড করার জন্য।
সন্ধ্যেবেলা ডিনারের সময় কার্স্টেন হিমাংশুকে ব’লেছিল, ও বিয়ে ক’রবে না; মানুষকে আধ্যাত্মিকভাবে সাহায্য ক’রবে, যদিও ওর ভাইবোনেরা সবাই বিবাহিত। হিমাংশু মন্তব্য ক’রেছিল যে বেশিরভাগ দেশগুলিতে বিবাহিতেরা অবিবাহিতদের চেয়ে বেশি সুবিধা পায়। ও আরও ব’লেছিল যে ভবিষ্যতে লোকেরা নিজেদের সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য বিয়ে ক’রবে না। পাশ্চাত্যের বিপুল সংখ্যক শিশু আইভিএফ-এর মাধ্যমে জন্ম নেবে।
হিমাংশু উল্লেখ ক’রেছিল যে, অস্ট্রিয়ান-আমেরিকান রসায়নবিদ প্রফেসর কার্ল ডিজারেসি, যিনি গর্ভনিরোধক পিল আবিষ্কার ক’রেছিলেন, ব’লেছেন,- ২০৫০ সালের পরে গর্ভনিরোধক পিলের আর প্রয়োজন থাকবে না, কারণ যৌবনেই পুরুষ ও মহিলারা তাদের শুক্রাণু এবং ডিম হিমায়িত ক’রবে, তারপরে নিজেদের নির্বীজন ক’রিয়ে নেবে। যৌন সঙ্গম তখন নিখুঁতভাবে বিনোদনমূলক হ’য়ে উঠবে।  তিনি ব’লেছিলেন,- গর্ভপাতেরও দরকার থাকবে না, কারণ কোনও শিশু অপরিকল্পিত বা অবাঞ্ছিত হবে না।
 
১১/১০/২০২২:  
ট্রেনটি ভোর পাঁচটায় ভরতপুরে পৌঁছেছিল। কিছু সহযাত্রী ঘানা পক্ষিপালনশালা দেখতে গেলেন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে। হিমাংশুরা বিবেচনা ক’রে দেখলো, পরের দিন তাদের যাত্রা শেষ হবে; তাই তারা ঠিক ক’রলো- পক্ষিপালনশালা দেখতে যাবেনা, ব্যাগ গুছিয়ে রাখবে পরের দিনের চেক আউটের জন্যে।
প্রাতঃরাশের পরে ট্রেনটি আগ্রার দিকে যাত্রা শুরু করে। দর্শনীয় স্থানের প্রথম স্টপ ছিল আগ্রা ফোর্ট।
আগ্রার দুর্গটি হিন্দু রাজপুতদের দ্বারা নির্ম্মিত একটি ইঁটের দুর্গ বাদলগড়। অবস্থানের গুরুত্ব উপলব্ধি ক’রে আকবর, লাল বেলেপাথর দিয়ে এটির পুনর্নির্মাণ ক’রে, নাম দিয়েছিলেন ’আগ্রা ফোর্ট’।
দুর্গ পরিদর্শনের পরে, যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হ’য়েছিল পাঁচ-তারা রেস্তোঁরা আই-টি-সি মৌর্য্যের বুফে লাঞ্চে - কয়েকশো আইটেম সাজানো ছিল সেখানে যাত্রীদের আপ্যায়নের জন্যে। মধ্যাহ্নভোজের পরে তাদের যাত্রা শুরু হ’লো তাজমহল দেখতে যাওয়ার জন্যে।
মমতাজ বেগমের সমাধিটি তাজমহল কমপ্লেক্সের কেন্দ্রবিন্দু। এই বিশাল সাদা মার্বেলের কাঠামোটি একটি বর্গাকার ভিত্তিমূলের উপর দাঁড়িয়ে থাকা খিলান-দেওয়া দরজা-সমেত একটি প্রতিসম ভবন। এই ভবনের চূড়ায় রয়েছে একটি বৃহৎ গম্বুজ এবং স্বর্ণালঙ্কার। সহযাত্রীদের সাথে, বেহুলা ও হিমাংশু তাজমহলের ছবি তুললো; ভাষায় এটির বর্ণনা করা যায় না। দেখলো, কার্স্টেন তাজমহলের দিকে তাকিয়ে ধ্যান ক’রছে; তাকে বিরক্ত না ক’রে বেহুলা ও হিমাংশু নিঃশব্দে চলে গেলো ওকে একা রেখে।
ট্রেনে ফিরে হিমাংশুরা শেষ ডিনারের জন্য ডাইনিং কারে গেলো। সন্ধ্যে সাতটায়, ট্রেনটি ছাড়লো দিল্লির উদ্দেশ্যে।
 

১২/১০/২০২২:  
ট্রেনটি পৌঁছালো দিল্লি সফদারজং স্টেশনে। যেখান থেকে সাত দিন আগে শুরু হ’য়েছিল যাত্রা, সেখানেই হ’লো শেষ। সকাল ৬-টায় বেড-টি দিয়ে গেলো এবং প্রাতঃরাশ শুরু হ’লো সকাল সাড়ে ছটায়। সবাইকে বিদায় জানিয়ে সকাল সাড়ে সাতটায় বেহুলা ও হিমাংশু ট্রেন থেকে নেমে গেলো।
এরকম হোটেলের মত ট্রেনে চড়ে নানা শহর দেখার অভিজ্ঞতা জীবনে হয়তো একবারই আসে। এই এক সপ্তাহের ট্রেন-যাত্রায়, বেহুলা ও হিমাংশু দেখেছিল অনেক বিস্ময়কর দুর্গ, স্মৃতিস্তম্ভ, আর কোনোদিন না ভোলার- তাজমহল; ওরা উট, হাতি আর নৌকায় চড়েছিল, অনেক মনে রাখার মতো জিনিস কিনেছিল; প্রতি রাত্রে ট্রেন তাদের বাচ্চাদের মতো দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়িয়েছিল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোক সহজেই ওদের নিকট প্রতিবেশী হ’য়ে উঠেছিল, বিভিন্ন চিন্তাধারার বিনিময় হ’য়েছিল। বিশেষতঃ, হিমাংশু কার্স্টেনকে কখনও ভুলতে পারবে না; কার্স্টেনের এক ভারতীয় গুরু ছিল, ও বেদ পড়েছে, যোগ অনুশীলন ক’রেছে। মানুষের মধ্যে একমেবাদ্বিতীয়ম্-এর খোঁজ ওর জীবনদর্শন ছিল। হিমাংশু ওকে দিল্লিতে আরও কিছু দিন কাটাতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। হিমাংশুরা নয়ডার হোটেলে ইতিমধ্যে বুকিং ক’রেছিল। সফদারজং স্টেশন থেকে তারা কার্স্টেনকে নিয়ে চললো সেখানে; শীগ্গিরই, তারা হোটেলে পৌঁছেছিল; কার্স্টেনের জন্যেও ঘর পেয়েছিল। হিমাংশু কার্স্টেন সীমান্তহীন দেশ এবং বিবাহবিহীন সমাজের বিষয়ে একসাথে আরও গবেষণা শুরু ক’রলো।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু